বেসামাল প্রেম পর্ব – ১৯+২০+২১

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৯
দাদিন সহ তার তিন নাতি এলো সন্ধ্যার পর। রাদিফের আসার কথা থাকলেও অফিসে জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি। সে আসেনি বলে তার মা, বউ, বাচ্চা কেউই এলো না। ছোটো চাচা, চাচি তারাও আসেনি। শুধু ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছে। সাদমান, সোহান, রোশান বাড়িতে পা রাখতেই পুরো বাড়ির আমেজ বদলে গেল। দাদিন এসেই নিজের ঘরে গিয়ে হায় হুতাশ করতে শুরু করলেন। এই বয়সে এসে এমন জার্নি তার শরীরে কুলোয় না। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললেন। আর ঢাকার মুখ সে দেখবে না। পায়ে ব্যথায় আহাজারি শুরু করাতে কাজের মেয়েটা ছুটে গেল তার পা টিপতে। মাহের শাওয়ার নিচ্ছিল বলে সেই ফাঁকে দাদিনের সঙ্গে দেখা করল সূচনা। কথার ছলে দাদিনকে বলল,
-” তুমি তাহলে রেস্ট করো। তোমার নাত জামাইকে কফি দিয়ে আসি। ”

দাদিন বলল,
-” যা যা খাবার সময় দেখা করবনি ওর সাথে। ”

সূচনা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ কাজের মেয়েটার দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” কুসুম তুই অমন মুখ চেপে রেখে হাসছিস কেন? কী হয়েছে? ”

দাদিনের পা টেপা থামিয়ে কুসুম লজ্জায় মুখ লুকাল। বলল,
-” আপা আমি কমু না। আয়নার সামনে যেয়ে আপনি নিজেই দেখে নিয়েন। ”

কপালে দু’ভাঁজ ফেলে রুম ছেড়ে বের হলো সূচনা। ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাল না। ড্রয়িংরুমে সাদমান, সোহান, রোশান হুড়োহুড়ি করছে। তাদের চ্যাঁচামেচি বড্ড কানে লাগছে। একটু ধমক দেয়া প্রয়োজন। তাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। তিনজনকে কঠিন করে ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন ভীষণ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সাদমান সূচনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহসা বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে হাসল। তার হাসির দিকে তাকিয়ে বাকি দু’জনও হাসতে লাগল। কিছুটা বিব্রত হলো সূচনা। বলল,
-” বলদের মতো হাসছিস কেন? জার্নি করে তোদের মাথা কি গেল নাকি? ফ্রিজে সরবত বানানো আছে দেখ গিয়ে। ”

বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে গেল সে। সাদমান সোহানের মাথায় গাট্টা মেরে জিজ্ঞেস করল,
-” হাসছিস কেন? ”

সোহান, রোশান দু’জনই একসাথে বলল,
-” তোমার হাসিতে সঙ্গ দিলাম ব্রো। ”

সাদমান মনে মনে স্বস্তি পেল। যাক বাঁদর দু’টো তাহলে হাসির আসল কারণ বুঝতে পারেনি। কিন্তু সোহান বুঝে যেতেও পারে। তার তো আবার গার্লফ্রেন্ড আছে। যতদূর জানে বেশ লুতুপুতু ধরনের সম্পর্ক। গার্লফ্রেন্ড অবশ্য তার নিজেরও আছে। তাই সূচনার ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয়নি। শত হোক বড়ো বোন এভাবে লজ্জায় ফেলাও দৃষ্টিকটু তাই বাকি দু’জনের চোখে যেন সূচনা এ মূহুর্তে না পড়ে। তাই বলল,
-” তোরা দু’জন এখানে বসে থাক আমি সরবত এনে দিচ্ছি। ”

সূচনা কফি বানিয়ে যেই ঘুরল অমনি সাদমান দাঁত ক্যালিয়ে হাসি দিল। সূচনা চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” ভালো হচ্ছে সাদু এমন করে হাসছিস কেন? ”

সাদমান মাথা চুলকে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালে। হ্যাংলা, পাতলা বডির দিকে তাকিয়ে সূচনা বলল,
-” সামনে থেকে সরে দাঁড়া ভাই। এখন ইয়ার্কি মারার সময় নেই। ”

সাদমান ভীষণ সিরিয়াস হয়ে সরে দাঁড়াল। সতর্কী কণ্ঠে বলল,
-” বিচ্ছু দু’টোর সামনে আপাতত যেও না আপা। ওরা কিন্তু অনেক বেশি পেকে গেছে। ”

চোখমুখ শক্ত করে সূচনা তাকাল সাদমানের দিকে। বলল,
-” তুইও অনেক বেশি পেকেছিস। মাসে কয়টা গার্লফ্রেন্ড বদলাস সে খবর ঠিক কানে আসে। আর মুখ খুলতে বাধ্য করিস না। ফ্রিজে সরবত আছে, আইসক্রিম আছে, ফ্রুটস আছে, যা পারিস খেয়ে রেস্ট কর। ”

গটগট পায়ে সাদমানের সামনে থেকে চলে এলো সূচনা। ড্রয়িংরুমে বিচ্ছু দু’টো গেমস খেলায় ব্যস্ত। সূচনার বুকের ভিতরটায় অদ্ভুতরকম কাঁপছে। তখন ওভাবে মাহেরের বুকে নিজের জায়গা করে নেয়া তার দ্বারা সত্যি অসম্ভব ছিল৷ সেই অসম্ভটা সম্ভব করেছে মাহের নিজেই। এর পাশাপাশি আরো একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে মানুষটা। তার কান্নার গতি যখন বেড়ে চলছিল তাকে থামানোর জন্য এ প্রথমবার আদর করেছে। সেই আদরের মাঝেই কখন যেন গালে গাঢ় করে চুম্বনও এঁটেছে। সেই শক্ত চুম্বনের রেশটা এখনো রয়ে গেছে। মাহেরের পুরুষালি পাতলা ওষ্ঠজোড়া যেন এখনো লেগে আছে তার নরম তুলতুলে গালটায়। অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব হচ্ছে। তার এই অনুভূতিটা কি কাজের মেয়ে কুসুম, ভাই সাদমান কোনোভাবে টের পেয়েছে? নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে মাহেরের দেয়া আদর তারা দেখে নিয়েছে। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে রুমে প্রবেশ করল সূচনা। মাহের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছিল। সূচনা রুমে প্রবেশ করতেই ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
-” দাদিনরা এসে গেছে? ”

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে কফির মগ এগিয়ে দিল সূচনা। মৃদু হেসে কফির মগ হাতে নিয়ে মাহের বলল,
-” আপনার জন্য বানাননি? ”

-” আমি এখন খাব না। ”

নরম সুরে কথাটা বলেই আয়না দেখার উদ্দেশ্যে পিছন ঘুরল সে। পা আগাতে নিতেই বিচলিত হয়ে মাহের বলল,
-” দেখি এদিকে ঘুরুন কী হয়েছে? ”

আঁতকে ওঠে মাহেরের দিকে ফিরে তাকাল। বেড সাইট টেবিলে মগ রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মাহের। সূচনার বাম গালে কয়েক পল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-” এটা আমি করেছি? ”

কণ্ঠে অবিশ্বাস স্পষ্ট। সূচনা কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” কী করেছেন? আমাকে দেখে ওরা হাসল, কী হয়েছে আমার ? ”

-” কারা হাসল! ”

-” কুসুম, সাদু মানে সাদমান! ”

অস্পষ্ট স্বরে মাহের বলল,
-” শীট! আমার খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল। ”

সূচনা আর অপেক্ষা করতে পারল না। ত্বরিৎ পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজের মুখশ্রীতে সচেতন দৃষ্টি বুলালো। বাম গালে স্পষ্ট লালচে দাগ সুক্ষ্ম নজরে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যাবে কেউ দৃঢ় চুম্বন এঁটেছে এই গালে। আর সেই কেউ যে তার স্বামী মাহের এ কথা কারোরি অজানা নয়। তীব্র লজ্জায় পুরো মুখশ্রীই রক্তিম হয়ে ওঠল এবার। নিশ্বাস হয়ে গেল বড়োই বেসামাল। একটুখানি পিছু তাকাতেই মাহেরের অদ্ভুত চাহনি দেখে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করল। তার অমন কঠিনতম লজ্জা দেখে অধর কামড়ে হাসল মাহের। কফির মগ হাতে নিয়ে সন্তর্পণে চুমক দিল। এরপর হালকা কাশি দিয়ে সূচনার অ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করল। বলল,
-” একটু সময় নিন ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত কিছু সময় বের হবেন না। ”

সূচনা মাথা দোলালো। মাহের তৃপ্তি নিয়ে আরেকটু হাসল। পরিস্থিতি স্বাভাবিকতায় আনতে প্রশ্ন করল,
-” হৈমী কোথায়? ওদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে? ”

চমকে ওঠল সূচনা সত্যিই তো হৈমী কোথায়?
________
রুদ্রর রুম থেকে বেরিয়ে হৈমী সূচনাদের গেস্ট রুমে গিয়ে বসে ছিল দীর্ঘক্ষণ। তীব্র বিষণ্ণতায় আচ্ছাদিত মন। তাই এই বিষণ্নভরা মনে একমাত্র সম্বল হিসেবে টিশাকেই মনে পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে কলও করে ফেলল। রুদ্রর বলা কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে জানালো টিশাকে। সব শুনে টিশা ভীষণ রেগে গিয়ে ধমক দিল, বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
-” তুই কাঁদছিস! তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। একজন গর্ভবতী মেয়েকে ফোন করে কাঁদিস। আর কান্নার কারণ কী বললি? ঐ রুদ্র না ছিদ্র, হ্যাঁ ছিদ্রই তার নাম। তোর হৃদয় ছিদ্র করেই তো দিয়েছে। ব্যাটা খাটাশ, এই শোন খাটাশের দিল ওয়ালি। আরে বেটি থাম আগে আমার কথা শোন। আরে আশ্চর্য তোর সঙ্গে চিল্লাতে চিল্লাতে আমার ডেলিভারি হওয়ার উপক্রম, আর তুই থামছিস না। দেখ হৈমী আমার জামাই বাসায় নেই। খালামুনি রান্নাঘরে বিপদ ঘটলে কিন্তু সর্বনাশ! ”

ধমক খেয়ে কিছুটা দমে এলো হৈমী। ভাঙা কণ্ঠে নাক টেনে বলল,
-” বল শুনছি । ”

-” আমি যা বলব একদম মাথায় সেট করে ফেলবি। আর সে অনুযায়ীই কাজ করবি কেমন? তাহলে দেখবি ব্যাটা বেয়াই কেমন জব্দ হয়। ”

-” আচ্ছা বল। ”

-” ওকে মস্তিষ্কে নোট করে ফেল। ”
______
ডিনারের সময় সবাই একত্রিত হলো। টিশার সঙ্গে কথা বলার পর মনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা কেটে গিয়েছিল। তাই সবার সঙ্গে অর্থাৎ সাদমান, সোহান, রোশানের সঙ্গে দেখাটা স্বাচ্ছন্দ মতোই হলো। খেতে বসার পর রুদ্রর মুখোমুখি হলেও একবার তাকিয়ে দেখল না। বোনের মাঝে কিঞ্চিৎ নিরবতা দেখে মাহের আড়ালে জিজ্ঞেস করল,
-” তোমার শরীর খারাপ লাগছে? চোখ, মুখ লাল কেন? ঠান্ডা লাগিয়েছ? ”

হৈমী মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। মৃদু হেসে বলল,
-” দুপুরে একটু আইসক্রিম খেয়েছিলাম তাই বোধহয় একটু ঠান্ডা লেগেছে। ”

সকলকে খাবার বেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সূচনা। মাহের মৃদু কণ্ঠে তাকে আদেশ করল,
-” দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আমাদের সাথেই খেয়ে নিন। কারো কিছু প্রয়োজন হলে কুসুম এনে দেবে বসুন। ”

মাহেরের এটুকু আদেশকে রুদ্র ভীষণ পজেটিভ নিল। আপনমনে খুশিও হলো ভীষণ। তাই গম্ভীর কণ্ঠে বোনকে বলল,
-” দাঁড়িয়ে কেন খেতে বোস। ”

খাবারের পাট চুকিয়ে হৈমী রাতে কোথায়, কার সঙ্গে ঘুমাবে এই আলোচনা করে উপরে চলে গেল মাহের। একা যেহেতু এক রুমে থাকতে পারবে না তাই আজ রাত সে দাদিনের সঙ্গে ঘুমাবে বলে ঠিক হলো। হৈমীর ঘুমের স্টাইল তেমন সুবিধার নয়। তাই সে ভীষণ চিন্তিত। বুড়ো মানুষ না জানি আজ রাতে কী অঘটন ঘটে যায়! ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে ভাইদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে হৈমীকে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলে সূচন চলে গেল। কিন্তু হৈমীকে যেতে দিল না রোশান। তার বায়না তিন ভাইয়ের সঙ্গে এবার লুডু খেলতে হবে। খেলায় একটি নিয়মও দেয়া হলো। যে জিতবে সে দু’টো শর্ত দেবে। সেই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে যে হারবে তাকে। দূর্ভাগ্যবশত আজ হেরে গেল হৈমী। আর জিতে গেল সোহান। মনটাই খারাপ হয়ে গেল হৈমীর। বিরস মুখে বলল,
-” আমার শরীরটা ভালো নেই আজ৷ না জানি কী শর্ত দেবে আজকে সেসবের জন্য আমি প্রস্তুত নই। তাছাড়া রাতও হয়েছে অনেক এবার ঘুমাতে যাই। যত শর্ত সব কাল পূরণ করব। ”

প্রতিবাদ করল সোহান কিন্তু সাদমান মেনে নিল। মাত্রই তার ফোনে রুদ্রর ম্যাসেজ এসেছে। অ্যাংরি ইমোজি দিয়ে সে লিখেছে,
-” বারোটা চব্বিশ বাজে। এবার তোদের খেলা বন্ধ না হলে খুব খারাপ হবে! ”

এমন ম্যাসেজ পেয়ে সাদমান বাকি দু’জনকে ম্যানেজ করে উপরে চলে গেল। বিরস মুখে হৈমীও দাদিনের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারারাত না ঘুমিয়ে ছটফট ছটফট করেই কাটল তার। একদিকে অবশ্য ভালই হলো, ঘুমের ঘোরে মহাবিপদ ডেকে আনা হলো না।

পরের দিন সকাল থেকে রুদ্র ভীষণ ছটফট করতে লাগল। গতকাল হৈমী তাকে উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। এরপর সকলের ভীরে আর উত্তর শোনা হয়নি। কিন্তু আজ শুনতেই হবে তার উত্তরটি। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমী কোথায় সেটাই দেখার চেষ্টা করছিল সে। এমন সময় সূচনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হৈমী। রুদ্রও তার সামনে দেয়াল সরূপ দাঁড়াল। রাশভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আমার উত্তরটা? ”

সূচনার ঘর থেকে মাহের বেরিয়ে এলো। রুদ্র কৌশলে হৈমীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মাহের জিজ্ঞেস করল,
-” এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রুদ্র কিছু বলেছে? ”

-” কইই না তো আমি যাচ্ছিলাম উনি তো ছাদে গেলেন। সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিলাম। ”

-” আচ্ছা, বাইরে যাচ্ছি কিছু খাবে? কী আনব? ”

-” যা খুশি এনো। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাহের। থতমত খেয়ে হৈমী বলল,
-” চকলেট, আর চাটনি এনো। ভাবি তো চিকেন ফ্রাই বানাচ্ছে কোকাকলাও নিয়ে এসো। ”
______
দুপুর বেলা হঠাৎ হৈমীর মনে পড়ল সে গতকাল লুডু খেলায় হেরেছে। সে জন্য তাকে আজ দু’টো শর্ত পূরণ করতে হবে। কিন্তু শর্তগুলো কী কী জানা হয়নি। তাই রোশান, সোহানকে খুঁজতে বের হলো। খোঁজাখোঁজি করতে করতে রুদ্রর রুমের সামনে এসে দ্বিধায় পড়ল। দুবার ডাকল,
-” সোহান… রোশান… তোমরা আছো? ”

কোনো সাড়া পেল না। ব্যর্থ হয়ে সরে যেতে উদ্যত হলো। পেছন ঘুরেছে অমনি দরজা শব্দ করে খুলে রুদ্র
তার ওড়না টেনে ধরল আচমকা। আঁতকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমী। বড়ো বড়ো চোখ করে শুঁকনো ঢোক গিলল বারকয়েক। পুরো ওড়না যখন রুদ্রর দখলে তখন নিজের শেষ চেষ্টাটুকু দিয়ে ওড়নার শেষ কোণাটা টেনে ধরল হৈমী। শঙ্কিত হয়ে বলল,
-” প্লিজ এমন করবেন না। ভাইয়া এসে যাবে। ”

প্রতুত্তরে রুদ্র কিছু না বলে ওড়নায় হেঁচকা টান দিল। ফলশ্রুতিতে ওড়না সহ পুরো হৈমীটাই রুদ্রর ঘরে চলে গেল। ত্বরিত গতিতে দরজা লক করে দিল রুদ্র৷ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে হৈমী। সুক্ষ্ম নজরে বোঝা যাবে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। চোখের পাতা চঞ্চলিত। ঢোক গিলছে ঘনঘন। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। হাতে থাকা ওড়নাটা ছুঁড়ে দিল হৈমীর দিকে। হৈমী তৎক্ষনাৎ ওড়না গলায় জড়িয়ে নিল। রুদ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে। তীব্র রোষানলে কপালের রগ ফুলে ওঠেছে তার। চোয়ালজোড়াও দৃঢ়। হৈমী ভীতু চোখে তার পানে তাকাতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করল,
-” উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে চলছো কেন? আমার উত্তর চাই। ”

হৈমী এক সেকেণ্ড সময় না নিয়ে বলল,
-” আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার উত্তর কর হতে পারে? ”

চিল্লিয়ে ওঠল রুদ্র। দু’কদম তেড়ে এলো হৈমীর দিকে। হাত বাড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরল হৈমীর কাঁধজোড়া। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলল হৈমী। রুদ্র ধমকে বলল,
-” না জানি না৷ আমি তোমার মুখে উত্তরটা শুনতে চাই। ”

কয়েক পল পর অসহায় চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্রর কঠিন দৃষ্টিজোড়া তার চোখেতেই স্থির। সে চোখে নিজের চাহনি দৃঢ় করল হৈমী। কিঞ্চিৎ দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,
-” কোনো মেয়ে তার ভালোবাসার জন্য মাতৃসত্তা ত্যাগ করেছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি করতে রাজি যদি আপনি আপনার পৌরুষ চাহিদা ত্যাগ করতে পারেন। আপনার বউ হতে রাজি তখন হবো যখন আপনি আমাকে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন। মা তো আর একা একা হওয়া যায় না তাই না? এবার আপনি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে আমাকে উত্তরটা জানান ? মনে রাখবেন আপনার আমার মনের সম্পর্ক তৈরি হবে, দেহের না৷ আপনি, আপনার পৌরুষচিত মন, দেহ যদি এই ত্যাগটুকু করতে পারে আমারো নারী মন, মাতৃসত্তা ত্যাগ করতে পারবে। ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২০
স্তম্ভিত রুদ্রের দু-হাত আচম্বিত নম্রতায় পরিণত হলো। হৈমীর দৃষ্টি ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। কয়েক পল অতিবাহিত হওয়ার পর হৈমীর কাঁধজোড়া পুরোপুরি আলগা করে দিল রুদ্র। একই সঙ্গে বিস্ময়, অবিশ্বাস্য চাহনি তার। এমন একটি উত্তরের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। হৈমীর এই শীতল ক্রোধ হজম করতে ভীষণ বেগ পেতে হলো৷ থমথমে স্বরে কেবল উচ্চারণ করল,
-” বেরিয়ে যাও। ”

তার বলতে দেরি কিন্তু হৈমীর বেরিয়ে যেতে দেরি হলো না৷ এ ঘটনা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে পড়ার মতোন ঘটনা। তাই অসহনীয় হয়ে দু-হাত শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন ক্ষণে ক্ষণে তার বক্ষ তীরে আছড়ে পড়তে লাগল।
_____
সন্ধ্যার পর মাহেরের অনুরোধে জর্জেটের মধ্যে একটি হলুদ শাড়ি পরল সূচনা। বাসন্তী হলুদ শাড়ি। সূচনাকে বেশ মানিয়েছে। সেই যে বিয়ের ক’দিন শাড়ি পরেছিল এরপর আর পরা হয়নি। শাড়িতে সূচনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল মাহেরের। পাশাপাশি বউ নিয়ে রাতের শহর ঘুরারও ইচ্ছে হচ্ছিল। সারপ্রাইজের কথাটাও সে ভুলেনি। কিন্তু সময়, সুযোগই পাচ্ছিল না। তাই প্ল্যান করল কোথাও একটা ঘুরে আসা যাক। সূচনারও মন ভালো হবে, তারও একান্তে পাওয়া হবে মানুষটাকে। কাঙ্ক্ষিত উপহারটুকুও দেওয়া হবে। বাইকের চাবি হাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মাহের৷ সূচনার সাজ কমপ্লিট হতেই বের হবে সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সূচনা। সাজ সম্পন্ন হলেও লজ্জায় আয়নার সামনে থেকে সরতে পারছে না। কারণ সরলেই মাহেরের মুখোমুখি হতে হবে। পেতে হবে বুক কাঁপা, ঠোঁট কাঁপা, দু গাল রঙিন হয়ে ওঠা লজ্জাদের। সময় অপচয় করতে চুলের আগায় চিরুনি বুলাতে শুরু করল৷ মাহের মৃদু কেশে বলল,
-” সব ঠিক আছে তো, আরো সাজবেন? ”

মুহুর্তেই বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠল তার। ইস কী লজ্জা, কী লজ্জা! আরো কেন সাজবে? সব তো ঠিকই আছে। মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা করল সে। নরম সুরে বলল,
-” আপনি এগোন আমি আসছি। ”

শাড়ি পরে বাইকে বসতে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হলো। মাহের বুঝতে পেরে বলল,
-” আঁচল কোলে তুলুন। একহাত কাঁধে রাখুন। ”

ধীরেসুস্থে তাই করল সূচনা। মাহেরও বাইক স্টার্ট দিল। ধীরেসুস্থে চলতে শুরু করল শহরের পরিচিত রাস্তায় । এরপর চলে গেল লেকের পাড়ে। সেখানে মাহেরের গুটিকয়েক বন্ধু, বান্ধবী ছিল। সূচনার সঙ্গে আগেই পরিচিত থাকার দরুন কুশল বিনিময় করল তারা। লেকের একপাশে সারি সারি কফিশপ। রাতের পরিবেশটাকে রঙবেরঙের আলোকচ্ছটা মুখরিত করে রেখেছে। ভালোই লাগছিল সূচনার৷ চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করছিল সে। এমন সময় সকলের মাঝেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল মাহের। হাতে হাত আলতো ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-” হাত ধরুন। ”

সকলের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল সে। বিব্রত চোখে তাকাল মাহেরের পানে। মাহের পুনরায় শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” হাত ধরুন একটা জায়গায় যাব আমরা। ভয় পেতে পারেন, হাত ধরলে সাহস পাবেন। ”

সিরিয়াস হয়ে মাহেরের শক্তপোক্ত হাতটা আলতো করে স্পর্শ করল সে। অধর কামড়ে হাসল মাহের। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আমুদে সুরে বলল,
-” বউ আমার ব্যাপক লজ্জাবতী! ”

বাক্যটির ইতি টেনেই সূচনার নরম হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে শক্ত করে ধরল সে। সূচনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটানে সকল আলোকচ্ছটা এবং বন্ধুদের মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল দু’জনায়। তলিয়ে গেল নিবিড় অন্ধকারে। মাহেরের সঙ্গে কয়েক পা মিলিয়ে হাঁটার পর ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” এত অন্ধকার কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”

-” ভয় পাচ্ছেন? ”

একটু বেশি কাছাকাছি হয়ে সূচনা বলল,
-” ফোন বের করুন, ফ্লাশ অন করুন। ”

মৃদু হেসে সূচনার কাঁধ জড়িয়ে ধরল মাহের। ঘন অন্ধকারে আচমকাই এমন উষ্ণ আলিঙ্গন পেয়ে বুক ধড়ফড় করে ওঠল। কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি। ”

একহাতে সূচনাকে জড়িয়ে অপর হাতে পকেট থেকে ফোন বের করল মাহের। ফ্লাশ অন করে নিজের দিকে ধরেই বলল,
-” এই তো আমিই ভয় কীসের? ”

-” আমরা কথায় যাচ্ছি? ”

-” কোথায় না এখানেই বসব। ”

ফোনের আলোটুকু সম্মুখে ধরতেই সূচনা দেখল কয়েক টুকরো কাঠ জড়ো করে রাখা হয়েছে। মাহের তার কাঁধ ছেড়ে হাত ধরে বসতে ইশারা করল। বসার পর কাঠগুলোতে আগুন ধরাল সে।

পৌষের প্রথম সপ্তাহ চলছে। আহামরি শীত পড়েনি তাই অবাক হলো সূচনা। আমতা আমতা করে বলল,
-” এসব কী চলুন ওদিকে যাই। ”

আড়চোখে তাকিয়ে ঘাসের ওপর লাইটার রাখল মাহের। সূচনা খেয়াল করল চারপাশে বেশ ঘন গাছ। ছোট্ট খাটো জঙ্গল বলা চলে। সে জঙ্গলের ভীতর ফাঁকা অংশের ঘাসের ওপর বসে আছে তারা। আশ্চর্য হয়ে মাহেরের পানে তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল,
-” এখানে আমি কখনো আসিনি। ”

-” আমিও। এটা কফিশপের পিছনের অংশ। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। দিনের বেলায় অনেক ছোটো-ছোটো ছেলেরা এখানে এসে সিগারেট খায়। কেউ কেউ নেশাও করে। ”

মন খারাপ হলো সূচনার। বলল,
-” তাহলে আমরা এখানে কেন? ”

-” নেশা করব তাই। ”

-” ছিঃ আপনি এসব কী বলছেন? ”

-” সত্যি বলছি তার আগে সারপ্রাইজটা দিই? ”

বিস্মিত হলো সূচনা। এমন জায়গায় তাকে সারপ্রাইজ দিতে এনেছে মাহের? কী এমন সারপ্রাইজ যা এখানে দিতে হবে? চিন্তায় মগ্ন সে হঠাৎ চমকে ওঠল পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর পেয়ে। ভীতিগ্রস্ত হয়ে সামনে তাকাল সে। হ্যাঁ লিমন তার প্রাক্তন। আঁতকে ওঠে পাশে তাকাল। মাহের তার দিকেই তাকিয়ে। সূচনা ঢোক গিলল কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের! ”

মাহের তার দিকে চেপে বসল। একহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। মৃদু স্বরে বলল,
-” পুরো ভিডিয়োটা দেখুন সূচনা। ”

সূচনার শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। মাহের ফোনের স্ক্রিনে ভিডিয়ো প্লে করে তার সামনে ধরে আছে। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, র”ক্তা”ক্ত অবস্থায় বসে আছে লিমন। তার সামনে চার-পাঁচ জন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবাই এক ডাকে প্রশ্ন করছে লিমনকে,
-” বল তোর সঙ্গে মাহেরের বউয়ের ঠিক কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমরাও শুনি? ”

উত্তরে আহত সুরে লিমন বলল,
-” আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যা বলেছি সব রাগের বশে। সব মিথ্যা সব মিথ্যা। সূচনা পবিত্র আমি ওকে কোনোদিন সেভাবে স্পর্শই করিনি। হাত ধরা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক হয়নি। ও খুব ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে। শুধুমাত্র ওর সংসারে আগুন ধারনোর জন্য, ওর হাজব্যন্ডের ওর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আমি এসব করেছি। কারণ আমি ওকে এভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। মায়ের কথায় ওকে রিফিউজড করলেও এবার হারে হারে টের পাচ্ছি কী রত্ন হারিয়েছি আমি। ভাইয়েরা আমার আপনারাও তো কাউকে না কাউকে ভালোবাসেন। আপনাদের ভালোবাসার মানুষটা যদি অন্যকারো সঙ্গে ঘরবাঁধে আপনার বুকে কি আগুন জ্বলবে না? সেই আগুন আমি সহ্য করতে পারছিলাম না বলেই ওদের ঘরে আগুন ধরাতে চেয়েছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। আমি মাহেরের পা ধরে মাফ চাইব। প্রয়োজনে সূচনার পা ধরেও মাফ চাইব। আমাকে ছেড়ে দিন। ”

আকস্মাৎ ফুঁপিয়ে ওঠল সূচনা। তরিৎবেগে ভিডিয়োটা বন্ধ করে দিল মাহের। চমকে তাকাল সূচনার দিকে। প্রচণ্ড খারাপ লাগায় বুকটা বিষিয়ে ওঠল তার। এত কিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিল সূচনা লিমনকে ভালোবাসতো! সূচনাকে ছেড়ে দিয়ে থমথমে স্বরে বলল,
-” আ’ম সরি সূচনা। ওরা এভাবে ওকে মারবে আমি জানতাম না। সে সময় আমি কক্সবাজার ছিলাম। আমি বলেছিলাম শান্ত ভাবে বুঝিয়ে জাস্ট ওর মুখ থেকেই সত্যিটা বের করা৷ সত্যিটা আমি জানতাম, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে চেয়েছি শুধুমাত্র আপনার মনের স্বস্তির জন্য। কারণ আমি মুখে যতই বলি আমি আপনাকে বিশ্বাস করি আপনি গিল্টি ফিল করতেন। ইভেন করছিলেনও। তাই সত্যি টা বের করার জন্য বন্ধুদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ওরা সহজ ভাবে লিমনকে বুঝিয়েছিল। যেহেতু আপনাদের একটি সম্পর্ক ছিল, সে সম্পর্কে সম্মান রেখেই যেন সত্যি বলে। শুরুতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এভাবে সবটা উন্মোচন করেছে। ওদের হয়ে আমি আবারো সরি। ”

সূচনার কান্নার বেগ বাড়ল। পাশাপাশি রাগে, অভিমানে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাঙা আওয়াজে বলল,
-” আপনি আমাকে সরি বলছেন কেন? ”

ওঠে দাঁড়াল মাহেরও। সূচনার মুখোমুখি হয়ে বলল,
-” আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ”

-” আমি কেন কষ্ট পাবো? ”

-” কাঁদছেন তো! ”

অসহায় কণ্ঠে বলল মাহের। সূচনা নাক টেনে, হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছল। বলল,
-” আপনি আমায় এতটুকু বিশ্বাস করেন এটা জেনেই কাঁদছি মাহের! যার কাছে যা আশা করি তার কাছে তা পাই না৷ অথচ যার কাছে আশা সীমিত সেই সবটা উজার করে দেয়। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব বলুন তো? ”

ঈষৎ হেসে হাত বাড়িয়ে আঙুল ছুঁয়ে চোখের পানি মুছে দিল মাহের। সূচনা নত মাথায় দাঁড়িয়ে। মাহের তার চিবুক ছুঁয়ে স্নেহময় কণ্ঠে বলল,
-” কষ্ট কমাতে চেয়ে কি বাড়িয়ে দিলাম। ”

মাথা নাড়িয়ে সূচনা না বোঝাল। মাহের আবারো বলল,
-” যেই রাতে আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে এসেছিলেন সেই রাতে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। ইচ্ছে করছিল কয়েকটা মার দিয়ে বুঝিয়ে দিই মাহের লিমন নয়। আর সে সময় আপনার থেকে দূরে থেকেছি, অভিমান করে থেকেছি এর পিছনে কারণ একটাই, তা হলো আপনি কোন সাহসে অমন একটা বেইমানকে ভালোবেসেছিলেন? যে কিনা সুযোগ পেয়ে এভাবে অসম্মান করে? ”

-” ভুল হয়ে গেছে আমার৷ ”

চট করে ভুল স্বীকার করে দায় ছাড়া হলো সূচনা। মাহেরকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
-” ভুল আপনারো আছে। ”

অবাক হয়ে মাহের বলল,
-” আমার ভুল! ”

-” হ্যাঁ আপনি কেন আরো আগে আমার জীবনে এলেন না? যে পৃথিবীতে নেই তার কত ভাগ্য ইস সেই ভাগ্যটা যদি আমার হতো৷ পৃথিবীতে না থেকেও আপনার গভীর ভালোবাসা পেতাম। ”

-” সূচনা! ”

মৃদু ধমক দিয়ে সহসা সূচনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মাহের। অদ্ভুত স্বরে বার বার করে বলল,
-” এমন কথা আর কখনো বলবেন না আপনি। দ্বিতীয়বার এমন কথা শুনলে ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে ফেলব বলে দিলাম। আপনি ভাগ্যবতী, বরং ওই অভাগী। তাই তো আমার ভালোবাসা না-পেয়েই হারিয়ে গেল। একজনকে হারিয়েছি নিজের করে না পেয়েই। আপনাকে নিজের করে পেয়েছি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি, আপনি হারালে আমিটাই হারিয়ে যাব। এমন কথা আর কখনো বলবেন না কক্ষোনো না। ”

দু’হাতে শক্ত করে সূচনার পৃষ্ঠদেশ চেপে ধরে কথাগুলো বলছিল মাহের। তার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস গুলো একের পর এক সূচনার ঘাড় ছুঁয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শরীরের লোমকূপ গুলোও কেঁপে ওঠছে সূচনার। দীর্ঘক্ষণ পর মাহের শান্ত হলো। সূচনা তার পিঠে আলতো ছুঁয়ে নরম সুরে বলল,
-” সরি এমন কথা আর কখনো বলব না, প্রমিজ। ”

লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলল মাহের। কিন্তু সূচনাকে ছাড়ল না। সূচনা ওভাবেই পড়ে রইল তার বুকে। কিছুসময় পর হঠাৎ কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের পাশাপাশি ফিসফিসে আওয়াজ শুনল,
-” আই ক্যান হ্যাভ টু কিসেস প্লিজ.

ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ছোটো করেই সম্মতি দিল সূচনা। মাহের ধীরে ধীরে মাথা তুলে তার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁটে দিল। সন্তর্পণে চোখজোড়া বদ্ধ করে ফেলল সে। বুকের ভিতর একনাগাড়ে শব্দ হতে লাগল ধিকধিক ধিকধিক। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে স্বল্প আলোয় সূচনার ভীতু, লাজুক মুখটায় দৃষ্টিপাত করল মাহের। ধীরেধীরে ঠোঁটজোড়া নামিয়ে নিল সূচনার অধর সুধা পান করার জন্য। দু’জোড়া ঠোঁট খুব কাছাকাছি আসার পর সহসা চোখ বন্ধ করে ফেলল মাহেরও। অতি সন্তর্পণে নিজ ওষ্ঠাধর ফাঁক করে সূচনার নরম অধর নিজ অধিকৃত করে নিল। একহাত সূচনার কোমরে রেখে অপরহাতে কান এবং ঘাড় বেষ্টন করে নিল। কয়েক পল পেরোতেই একজোড়া নর, নারীর উত্তপ্ত নিশ্বাসে রাতের আঁধার, থমথমে পরিবেশ মুখরিত হয়ে ওঠল। সূচনার চোখের কোণ বেয়ে ঝরতে লাগল সুখাশ্রু। মাহেরের সুললিত ওষ্ঠ চুম্বনে হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে ওঠল বড্ড বেসামাল। এমন আদর মেখে যত্ন নিয়ে পাওয়া চুমুটায় যেন সুখে মরণ যন্ত্রণা পেল সে। শেষে প্রকৃতির কোন নিয়ম মেনে আপনাআপনিই দু-হাত চলে গেল মাহেরের পৃষ্ঠদেশে জানেনা। প্রচন্ড জোরে খামচে ধরল পিঠে। মাহেরের দখলে থাকা ওষ্ঠজোড়া যেন একটু সুযোগ পেলেই লাজুক স্বরে বলে বসবে,
-” এই সারপ্রাইজ আমি কীভাবে সহ্য করি, কোথায় লুকিয়ে রাখি? এই মুহূর্তটা আমি কীভাবে ভুলি? ”
______
সোহান, রোশানের দু’টো শর্ত পূরণ করার জন্য রাত আটটার দিকে হৈমীকে ছাদে যেতে হলো। বিচ্ছু দু’টো বলেছিল বারোটার পর ছাদে গিয়ে একা একা আধাঘন্টা কাটাতে হবে। সে রাজি হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে তারা সময় নির্ধারণ করেছে রাত আটটা। রোশান, সোহানের জন্য সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আজ হৈমীকে তারা দারুণভাবে জব্দ করবে। কেউ বাঁধা দেবে না। কারণ বাড়িতে এ সময় কেউ নেই। দাদিন আর কুসুম নিচেই থাকে তারা এ সময় উপরে আসবে না। সূচনা গেছে স্বামীর সঙ্গে একটু বাইরে সময় কাটাতে। রুদ্র কোথায় গেছে জানে না৷ সাদমান গেছে এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে, ফিরতে রাত দশ, এগারোটা বাজবে। তাই পুরো দমে জমে যাবে তাদের দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা।
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১
অন্ধকারে আচ্ছন্ন নিরিবিলি নিস্তব্ধ ছাদে প্রবেশ করল হৈমী। একদলা হিমশীতল বাতাস আচমকা ধাক্কা দিল ওকে। নিমিষেই চোখ বুজে ফেলল, কেঁপে ওঠল ওষ্ঠাধর। দুরুদুরু বুকে ছাদের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলল। ওষ্ঠাধর নাড়িয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে নিল বুকপটে। লম্বা করে দম ছেড়ে পিছু তাকাল। রোশান, সোহান মিটিমিটি হাসছে, চোখের ইশারায় এগুতে বলছে। তারজন্য নাকি ছাদের মাঝখানে টুল রাখা হয়েছে। যেখানটায় তাদের দেয়া সময় পর্যন্ত একাকী বসে থাকতে হবে। সেসব কথা স্মরণ করেই মৃদু হাসার চেষ্টা করল সে। মুখশ্রীতে ভর করা সমস্ত ভয়টুকু লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টাও করল। তীব্র সাহস সঞ্চয় করে মুখ ফিরিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বসল ছাদের মাঝ বরাবর। তৎক্ষনাৎ ছাদের লাইট অফ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সোহান। আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমী। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” একি! এটাত কথা ছিল না। সোহান, সোহান, রোশান… ”

দু’ভাই দরজা লাগিয়ে দৌড়ে চলে গেল নিজেদের ঘরে। মোবাইলে সময় দেখে নিল। ত্রিশ মিনিটের আগে ঘর ছেড়েই বের হবে না পণ করল৷ সময় কাটাতে দু’জন বেশ আয়েশ করে মুভি দেখতে বসল। ওদিকে হৈমী দরজায় করাঘাত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ভয়ে, উত্তেজনায় শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। চারপাশে ভীতু চোখে তাকিয়ে আকস্মিক জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ল। শীতের মৌসুম চলছে তবুও আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ফলশ্রুতিতে জোৎস্নার বালাই নেই চারদিক কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে শুধু গুটিকয়েক বিল্ডিংয়ে আলোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। যা খুবই স্বল্প। সেদিকে তাকিয়েই ঘনঘন ঢোক গিলল হৈমী। মনে মনে নিজেকেই বকুনি দিল খুব। কেন সে লুকিয়ে ফোন আনল না? ওরা না করবে বলেই তাকে কেন এতটা ইনোসেন্ট হতে হবে? গায়ে জড়ানো চাদরটা দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ঠাঁই বসে রইল সে। বিরবির করে একাধারে পড়তে লাগল দোয়া, দরূদ। এ পৃথিবীতে কিছু দুর্বল হৃদয়ের নারী থাকে। যারা জানে দুনিয়াতে ভুতপ্রেত বলতে কিছু নেই। এই সত্যিটা জানা সত্ত্বেও দিনশেষে রাতের আঁধারে একাকী তারা ভুতে ভয় পায়। অসম্ভব রকমের ভয়। হৈমী হচ্ছে সেই দুর্বল নারীদের মধ্যেই একজন। সে জানে পৃথিবীতে ভুত পেত্নী বলে কিছু নেই। তবুও সে ভুত, পেত্নীর ভয় পায়। আর এই ভয় মারাত্মক রকমের ভয়। তীব্র শীতে যেমন হাড় কাঁপে তেমনি ভুতের তীব্র ভয়ে হাড় কেঁপে ওঠে তার। আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তার প্রতিকূলে। তাই তো নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে থমথমে করে তোলার জন্য আকস্মাৎ দূরপানের একটি শেয়াল ডেকে ওঠল। অতিরিক্ত ভয়ের তাড়নায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে ছিল হৈমীর। তাই আকস্মাৎ এই ডাকটি তার ভয়ের মাত্রা চূড়ান্তে পৌঁছে দিল। ভীতু মেয়েটা দু’হাতে খামচে ধরা চাদর ছেড়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দরজায় করাঘাত শুরু করল। শরীরে জড়ানো চাদর খুলে পড়ল, কয়েক পল পর ওড়না পড়ে গেল। দূর থেকে ধেয়ে আসা শেয়ালের ডাকগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হলো। বেড়ে গেল হৈমীর ভয় সেই সাথে দরজার করাঘাত।

সূচনা ফোন করে জানাল তাদের ফিরতে দেরি হবে। আজ রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে। বাড়ির সবাইকে যেন জানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি হৈমীর যত্নেরও যেন ত্রুটি না হয়৷ কুসুমকে সবটা বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল সূচনা। কুসুমও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারণ রাতে খাবারের সময় এখনো হয়নি। সময় হলে সবাইকে একসঙ্গেই খেতে দেবে। রুদ্র বাড়িতে ঢুকতেই কুসুম তাকে সূচনার কথা জানিয়ে দিল। রুদ্র গম্ভীর স্বরে ‘ হুম ‘ বলে পা বাড়াল দোতলায়। সে যখন তার ঘরের লক খুলতে উদ্যত হলো ঠিক সে মুহুর্তেই অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ছোটোবেলায় বাথরুম ঢুকে দরজা লাগিয়ে জোরে কথা বললে যেমন প্রতিধ্বনি হয়, কণ্ঠের স্বাভাবিকতা হারিয়ে অদ্ভুত শোনায় ঠিক তেমনি কণ্ঠস্বর। এই স্বর আরো তীব্র, ভীতিকর, সবচেয়ে বড়ো কথা এটি একটি নারী কণ্ঠস্বর! রুমের দরজা খোলা বাদ রেখে ভ্রু কুঁচকে কিয়ৎকাল দাঁড়িয়ে রইল সে। এরপর কানখাড়া করে এক পা, দুপা করে এগুতে লাগল। থামল গিয়ে ছাদের সিঁড়ির সামনে। তৎক্ষনাৎ চমকে ওঠল তার অন্তরআত্মা। এ বাড়িতে মেয়ে বলতে তো গুটিকয়েক জনই। কুসুম নিচে, সূচনা বাইরে তাহলে ছাদে কে হৈমী? মেজাজ কিছুটা বিগ্রে গেল৷ পরোক্ষণেই আবার থমকেও গেল। চটজলদি জিহ্বা দিয়ে অধর ভিজিয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে ওঠল। ছাদের দরজা লাগানো দেখে আরেক ধাপ অবাক হলো। বিষয়টি বোধগম্য না হলেও হৈমীর কান্নার শব্দ, চিৎকারই যথেষ্ট ছিল তার শ্বাস, প্রশ্বাস গুলো বেসামাল করে দেয়ার। আর এক মুহুর্ত সময়ও সে নষ্ট করল না। ঝড়ের গতিতে দরজা খুলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-” তুমি, তুমি এখানে, কী হয়েছে? ”

তৎপরতার সঙ্গে ছাদের লাইট অন করল রুদ্র। রুদ্রকে দেখে দু’হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে বসে পড়ল হৈমী। বিধ্বস্ত হৈমীকে দেখে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠল রুদ্রর। হতভম্ব হয়ে এক হাঁটু গেড়ে সেও বসল। হাত বাড়িয়ে হৈমীর কাঁধ স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল,
-” এই মেয়ে এভাবে কাঁদছ কেন? একি তোমার শরীর তো কাঁপছে, কী হয়েছে, ভয়ে পেয়েছ? লিসেন, হৈমী শুনছ? ”

লাল টকটকে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী তুলে এক পলক রুদ্রকে দেখল হৈমী। রুদ্র বিচলিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। তার সে দৃষ্টিকে আশ্চর্যান্বিত করে দিয়ে সহসা হৈমী জড়িয়ে ধরল তাকে। তার বলিষ্ঠ বুকটায় মুখ গুঁজে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উচ্চারণ করল,
-” ভুভুত! ”

চোখ, মুখ কুঁচকে গেল রুদ্রর। ভুত মানে? কিন্তু কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না, হৈমীর কান্না দেখে। যা সত্যি বোঝাচ্ছে ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু এই ভয়ের উৎস কোথায় থেকে? হৈমীই বা ছাদে আটকা পড়ল কীভাবে? এ সকল প্রশ্ন মনে চেপে দু’হাতে বুকপটে আগলে নিল ভয়ে তটস্থ মেয়েটাকে। পৌষের আবহাওয়াতেও হৈমীর উত্তপ্ত দেহের অবিশ্রান্ত স্বেদজলে ভিজে ওঠল রুদ্রর বক্ষপট। শরীরে জড়ানো সাদা কাবলী, সেন্ডো গেঞ্জি লেপ্টে গেল বুকের পাটাতে। বাকরুদ্ধ রুদ্র আর কিছু বলতে পারল না। কেবল অতি সন্তর্পণে জড়িয়ে রাখল মেয়েটাকে। যতক্ষণ না ভয় কাটছে, যতক্ষণ না শান্ত হচ্ছে ততক্ষণ এই বুক থেকে রেহাই নেই তার। যদি সময়টা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তও যায় তবুও রেহাই দেবে না। ঠিক এভাবেই জড়িয়ে রাখবে। ভয় কাটুক, শান্ত হোক, কান্না থামুক তবেই এই বুক থেকে ছাড় পাবে তার আপন পাখিটা। #বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১ (বর্ধিত অংশ)
খোলা আকাশের নিচে উষ্ণ দেহটাকে আগলে বসে রুদ্র। ছোট্ট, নরম দেহটি অবিরত কাঁপছে। দু’জনের ক্রমাগত শ্বাস-প্রশ্বাসে পরিবেশটা থমথমে।পরিবেশের এই গুমোট ভাব পরিবর্তন করে সহসা হৈমীর মাথায় হাত রাখল রুদ্র বলল,
-” ঠিক আছো? ”

নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই বিব্রত হলো। অনুভব করল এ মুহূর্তে তার গম্ভীর স্বরটায় একটু নম্রভাব আনা প্রয়োজন। মেয়েটা এমনিতেই ভয় পেয়েছে এমন পরিস্থিতিতে এমন শাসালো স্বর শুনলে আরো বেশি ভয় পাবে। তাই পুনরায় কণ্ঠে স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করে বলল,
-” ঠিক আছো? ”

উহুম হলো না বোধহয়। তার স্বাভাবিক কণ্ঠ মানেই তো রাশভারি, ভীষণ গম্ভীর। তার গলা দিয়ে নরম বুলি বের হওয়া কখনোই সম্ভব হয় না। তাই অমন রাশভারি কণ্ঠে আর কিছু বলার ইচ্ছেও করল না। হৈমীকে কৌশলে আগলে ধরে মাথা ঝুঁকাল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হৈমীর করুণ মুখশ্রীতে। সহসা চমকে ওঠল হৈমী। সংবিৎশক্তি ফিরে পেল সে। নিজেকে রুদ্রর পক্ষপটে লেপ্টে থাকতে দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” আমি ঠিক আছি, ছাড়ুন। ”

রুদ্র তাকে ছড়তে উদ্যত হলেও কী মনে করে যেন ছাড়ল না৷ বরং পূর্বের তুলনায় একটু বেশি গভীরভাবে জড়িয়ে নিল। হতভম্ব হৈমী দুর্বল শরীরে নড়েচড়ে ওঠল। রুদ্র তার দুহাত মুড়িয়ে এমনভাবে জড়িয়ে নিল যে আর অল্প নড়চড়ও করতে পারল না। বেশ আয়েশ করে চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল সে। হৈমী কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” ছাড়বেন না? ”

স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলো। তুমি এখানে কীভাবে আটকা পড়লে? যতক্ষণ সবটা জানতে না পারছি ততক্ষণ ছাড়ব না। ”

লজ্জায় বিব্রত হলো হৈমী। রুদ্র তার দিকে কতটা খেয়াল করেছে সে জানেনা। কিন্তু সে সম্পূর্ণ হুঁশে আছে। তার গায়ে ওড়না নেই, চাদর নেই। একে-তো রুদ্রর শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে, তারওপর গায়ে নেই ওড়না। মাথা ভনভন করতে শুরু করল তার। লজ্জায় আড়ষ্ট চোখে একবার রুদ্রর দৃষ্টি বরাবর তাকিয়ে আর একবার নিজের দিকে তাকাল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। রুদ্রর দৃষ্টি তার মুখশ্রীতেই স্থির। হৈমীর মন কথন সে টের পায়নি। তাই সহজ গলায় পুনরায় বলল,
-” তুমি এখানে কেন? ”

ঢোক গিলল হৈমী। চাপা স্বরে বলল,
-” ছাড়ুন তারপর বলছি। ”

রুদ্র ছাড়ল না তার দু’হাতের বন্ধন আরো গাঢ় হলো। ফলশ্রুতিতে হৈমীর শরীর আরো বেশি গভীর হলো তার সঙ্গে। সহসা শিউরে ওঠল সে। অথচ রুদ্রর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার মতোই উত্তর জানতে মগ্ন। লজ্জায়, জড়তায় থমথমে হয়ে গেল হৈমী। জড়োসড়ো হয়ে শরীর বাঁকিয়ে পড়ে রইল রুদ্রর বাহুডোরে। কিয়ৎকাল পর বুঝতে পারল উত্তর না দিলে ছাড়াছাড়ি নেই। উত্তর দিলেই মুক্তি মিলবে তার রুদ্র দ্যা ডন বেয়াইয়ের থেকে। তাই সমস্ত কথা খুলে বলল। সব কথা শুনে আচমকা হৈমীকে ছেড়ে দিল সে। টাল সামলাতে না পেরে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল হৈমী। ভয় ভয় চোখে বড়ো বড়ো করে তাকাল। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তোমায় বলেছিলাম ওদের সঙ্গে এত মাখামাখি না করতে! ”

ক্রোধে গর্জন ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াল। অমনি তড়াক করে হৈমী তার এক পা আঁকড়ে ধরল। মিনমিনে স্বরে বলল,
-” প্লিজ আমাকে একা রেখে যাবেন না। প্লিজ। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। পিছু ঘুরে হৈমীকে হাত টেনে দাঁড় করাল। হৈমী আশপাশে তাকিয়ে ওড়না আর চাদর তুলে নিয়ে রুদ্রর এক বাহু জাবটে ধরল। ভয়কাতুরে গলায় বলল,
-” আমি এভাবেই যাব একদম নিচে গিয়ে ছাড়ব। ”

কিছু বলল না রুদ্র। শুধু ভ্রুজোড়া কুঁচকে একবার তাকাল হৈমীর দিকে। সত্যি সত্যি হৈমী ওভাবেই
সিঁড়ি দিয়ে নামল। শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই মুখোমুখি হলো সোহান, রোশানের। ওদের দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না রুদ্র। হৈমীকে ছাড়িয়ে ওরা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই তৎক্ষনাৎ সোহানের গালে ঠাশ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ভয়ে রোশান পিছিয়ে গেল কয়েক পা৷ সোহানের ডান হাত আপনাআপনিই থাপ্পড় খাওয়া গালটায় চেপে ধরল। রুদ্র বীভৎস এক ধমক দিয়ে বলল,
-” হাতে পায়ে বড়ো হয়েছিস, বুদ্ধি খোলেনি। এসব কী ধরনের মজা তোদের? রোশান না হয় ছোটো তুই কীভাবে এসবে সমর্থন করলি! ”

সোহান থমকানো স্বরে বলল,
-” সরি ভাইয়া আর হবে না। ”

রুদ্র মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। সোহান রোশান দু’জন হৈমীকেও সরি বলল। এরপর রুদ্রর কঠিন চোখের সামনে থেকে পালিয়ে গেল দু’ভাই। হৈমী হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল। অমনি আমতাআমতা করে সে বলল,
-” আআমি দাদিনের কাছে যাব। কুসুম আপুকে বলব পোড়া লোহা পানিতে ভিজিয়ে সে পানি দিতে। আমি খাব, ভয় পেলে এমন করে পানি খেতে হয়, এতে ভয় কেটে যায়। দাদিনকে বলব যেন দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে দেয় আমি খাব৷ আআমি নিচে যাব, মানে নিচে যাই? ”

রুদ্র চোখ কটমট করে তাকাল। হৈমী জোরপূর্বক হেসে আমতা আমতা করেই বলল,
-” আচ্ছা ঠিক আছে যাই আমি হ্যাঁ? যাই, গেলাম ”
______
সকাল ৭ঃ ৪৫ মিনিটে শেখ বাড়িতে হামিদার আগমন ঘটল৷ কাউকে কিছু না জানিয়ে সকাল সকাল মায়ের আগমনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল মাহের। সে চিন্তাটুকুকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলেন হামিদা নিজেই।

শাশুড়ির এভাবে আসাতে প্রথমে অবাক হলেও পরবর্তীতে ভীষণ খুশি হয় সূচনা৷ গল্পস্বল্প করে সকালের খাবার আয়োজন করে। খেতে বসার পরই সকলের অগোচরে মাহেরকে হামিদা বলেন,
-” বউমাকে নিয়ে আজই বাড়িতে ফিরতে হবে। জরুরি কাজ আছে, বাড়ি গিয়ে সব বলব। ”

ব্যস এইটুকুতেই মাহের বুঝে নিয়েছে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। নয়তো টিশার প্রেগ্ন্যাসির শেষ সপ্তাহে টিশাকে ফেলে এভাবে তার মা ছুটে আসত না। সূচনা আরো কয়েকটা দিন থাকতে চেয়েছিল। শাশুড়ির তাড়ায় থাকা হলো না। স্বামী, ননদ, শাশুড়ির সঙ্গে দুপুরের আগেই শশুর বাড়ি চলে যেতে হলো। বাড়িতে যাওয়ার পর মাহেরকে পোশাক পরিবর্তনের জন্যও সময় দিল না হামিদা৷ ছেলেকে আলাদা করে ডেকে জানাল, দু’দিনের ভিতরে হৈমীর বিয়ে দেবে সে। ছেলে তার পরিচিতই টিশার ছোটো কাকার বড়ো ছেলে আমান। মাহের যতদূর জানে মাত্র একটি এমপিওভূক্ত কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে আমান। বিবিএসের জন্যও প্রিপারেশন নিচ্ছে। তার সমবয়সী ছেলেটা৷ সে যাইহোক হঠাৎ মায়ের এ সিদ্ধান্ত কেন? মনের প্রশ্ন মুখে আনার পূর্বেই হামিদা ভীতু কণ্ঠে বলল,
-” তুই না করিস না, আমি যা বলছি হৈমীর ভালোর জন্যই বলছি। ”

-” তুমি শান্ত হও মা। আমার দিকে তাকাও। কী হয়েছে?”

দু’হাতে মায়ের চোয়াল চেপে ধরল মাহের। ভরসার সাথে তাকিয়ে বলল কথাটা। হামিদা বিচলিত হয়ে বলল,
-” যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হৈমীর বিয়ে দে মাহের। আমার কথাটা শোন নয়তো সামনে গুরুতর বিপদ ঘটবে। ”

-” সবটা খুলে বলো মা তুমি কোন বিপদের কথা বলছ পরিষ্কার বুঝতে পারছি না। ”

-” সূচনার ভাই!”

-” রুদ্র আগের মতো নেই মা। ও নিজেকে শোধরানো চেষ্টা করছে। তাছাড়া তুমি নিজেই বলেছিলে ও যদি নিজেকে শোধরায় আর হৈমীর প্রতি ওর মনোভাবটি সত্যি হয় তাহলে তুমি আপত্তি করবে না। তোমার কথা শুনেই আমি রুদ্রকে বুঝিয়েছিলাম। ”

হামিদা উত্তেজিত স্বরে বলল,
-” হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম সময় নিয়ে রুদ্রকে নিয়ে ভাবতে কিন্তু… ”

-” কিন্তু কী মা? ”

-” জেনেশুনে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ আমি নষ্ট করতে পারি না। গতকাল আমি যা শুনেছি এরপর রুদ্রর হাতে আমার মেয়েকে তুলে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ”

-” কী শুনেছ! ”

-” রুদ্র হৈমীকে পছন্দ করে এটা সত্যি, বিয়ে করতে চায় সেটাও সত্যি। কিন্তু ও কখনো হৈমীকে মা হতে দেবে না। ”

-” এসব কী বলছ! ”

-” হ্যাঁ আমি টিশাকে হৈমীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। আড়াল থেকে সমস্তটাই শুনেছি। তুই তো জানিস টিশা আস্তে কথা বলতে পারে না৷ ওপাশে হৈমী কী বলেছে না শুনলেও টিশার মুখে সবটাই শুনেছি। রুদ্র হৈমীকে শর্ত দিয়েছে বিয়ের পর কখনো বাচ্চা নেবে না। মাহের, হৈমী অবুঝ ওর বয়স কম আবেগের বশে ও ভুল সিদ্ধান্ত নেবে। জল বেশিদূর আগানোর আগেই আমাদের ওকে সঠিক রাস্তা দেখাতে হবে। ”

থমকানো স্বরে মাহের বলল,
-” কী করতে চাইছ? ”

-” আমি সব কথা সেরে এসেছি। তুই সম্মত হলেই একদিন পর বিয়েটা দিয়ে দিব। এখন ওঠিয়ে দিব না শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখি। তেমন কাউকে জানাবোও না। শুধু আমানের বাবা, মা ভাই, আর আমরা। টিশাও জানে না কিছু শুধু ওর জামাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলেছিও এসব যেন টিশাকে না জানায়। মুখ পাতলা তো হৈমীকে জানিয়ে সমস্যা বাঁধাবে। ”

-” হৈমীকে না জানিয়ে কীভাবে বিয়ে হবে? ”

-” ওকে জানাবো আজ। আমি চাইনি ও বাড়ি থাকাকালীন সব জানুক। তুই কী বলিস? ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাহের৷ থমথমে স্বরে বলল,
-” রুদ্র যা বলেছে এরপর তোমার কথার বিরোধিতা করার সাহস আমার নেই৷ আমি আমার বোনের এতবড়ো সর্বনাশ করতে চাই না। ”

-” তাহলে জানিয়ে দিই তোর মত আছে? ”

-” দাও। ”

চলবে…রিচেক দিইনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here