#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৫
প্রায়শ্চিত্ত মানে চিত্তের বিশুদ্ধতাসাধন। এই বোধ জাগ্রত হওয়ার পর আর কখনো কষ্ট পাননি সুরভি বেগম। তবে বুকের গহীনে আফসোস রয়েছে। গর্হিত সেই পাপটির জন্য। যেই আফসোস আমৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সেলাই মেশিনে ছিঁড়ে যাওয়া মেকসির হাতা সেলাই করে চুপচাপ বসে সুরভি বেগম। আজকাল অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে সে। একটু সেলাই করেই হাঁপিয়ে গেছে। ইদানীং বেশ বুঝতে পারে, বয়স বাড়ছে। চমকে ওঠল সুরভি। বয়স? কত বয়স তার? এক মুহুর্ত শ্বাস আঁটকে গেল যেন। যৌবনের শুরুতেই বিয়ে হয়েছিল তার। রুদ্রর বাবার সঙ্গে। সদ্য আঠারোতে পা পড়েছে। তরতাজা ফুলটাকে নিজের ঘরে তুলেছিল সুস্বাস্থ্যের প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি। কত প্রেম, কত স্নেহ, কত সুখ। আহা,সেই রঙিন দিনগুলো স্মরণে আসা মাত্রই বুক ভার হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিসেব কষল তার বর্তমান বয়স কত? ঊনিশের মাঝামাঝিতে রুদ্রর জন্ম। চব্বিশে সূচনার। দুই সন্তানের পরিপূর্ণ সংসার ছিল তার। আহা! একেই বোধহয় বলে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। পাপে ধরেছিল তাকে। একেবারে নিঃস্ব করেই ছাড়ল। ছাব্বিশ বছর বয়সে যৌবনের উত্তাপে বুকের ভেতর যে খরা নেমেছিল। সেই খরায় আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দিলওয়ার শেখ। শুরুতে সে সায় দেয়নি। ভয় পেতো। কিন্তু ধীরেধীরে মনের ভিতর শয়তান বাসা বাঁধল। সেই একটি রাত সবকিছু ওলটপালট করে দিল। সেদিন কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল না? কেন আচমকা সেই স্পর্শের বিনিময়ে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগালো না ভাসুরের গালে? তাহলেই তো আজ সব অন্যরকম হতো। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল সুরভি। বয়স আজ ছেচল্লিশে এসে ঠেকেছে। কিন্তু কাঁধে থাকা পাপটা এত ভারি যে তার ভারে বয়স পঞ্চাশের অধিক মনে হয়। পাপ করা সহজ কিন্তু
পাপের বোঝা বহন করা বড়ো কঠিন।
সেদিন, ফাঁকা বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে একা ছিল সে। ঝড়বৃষ্টির রাত। রুদ্র, আর সূচনাকে ঘুম পাড়িয়েছে মাত্র। এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় টোকা পড়ে। সে গিয়ে দরজা খুললে দিলওয়ারের ভিজে চুপেচুপে বলিষ্ঠ শরীরটা নজরে আসে। মাথায় কাপড় তুলে সরে দাঁড়ায় সে। পূর্বে তার থেকে অনৈতিক আহ্বান পেয়েছিল। বিধায় সে মুহুর্তে তীব্র অস্বস্তিতে পড়ল। দিলওয়ার স্বাভাবিক চিত্তে ভেতরে ঢুকে। বলে,
-” খাবার গরম করতে পারবে? খুব খিদে পেয়েছে। ”
বাঙালি ভীতু নারী সে। অধিক লজ্জাবতীও। তাই সে মুহুর্তে মাথা নুইয়ে খাবার গরম করে দিল। দিলওয়ার তৃপ্তি ভরে খেল। সুরভি সব গুছিয়ে বেসিনে হাত ধুতে গেলে আচমকা তার পেছনে এসে দাঁড়ায় দিলওয়ার। আঁচল সরে যাওয়া ন’গ্ন কোমরটা স্পর্শ করে আবেগঘন হয়ে। সুরভির মস্তিষ্ক তখন দিশেহারা। ফাঁকা বাড়ি। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। প্রকৃতি শীতল। হৃদয়ে উত্তাপ। সবমিলিয়ে শয়তানের প্ররোচনায় ক্রমশ তারা লিপ্ত হতে থাকে অবৈধ স্পর্শে। সেই স্পর্শ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় শেখ বাড়ির দোতলার তৃতীয় ঘরটায়। যতক্ষণে জগতে হুঁশ ফেরে ততক্ষণে তার শরীরটাকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে ফেলেছে দিলওয়ার। আর পিছু হটার সুযোগ নেই। একবার পিছুপা হয়েছিলও। সন্তানদের কথা ভেবে। কিন্তু সেই সময় দিলওয়ারের প্রেম তাকে বাঁধ্য করেছিল সব ছেড়ে এক তাকেই আঁকড়ে ধরতে।
যে স্পর্শ শুরুতে তাকে ভয়, লজ্জা দিয়েছিল। সেই স্পর্শই সেদিনের পর থেকে তাকে আনন্দ দিতে লাগল। মন, শরীর এতটাই পাপে জর্জরিত হলো যে। দু’জন মিলে দু’টো সংসার ধ্বংস করে চলে এলো। শুধু কি দু’টো সংসার? সে কি নিজেকে ধ্বংস করেনি? আজ তার জীবন তার ছেলের জীবন অনিশ্চিত। এর দায় কার? তারই তো। সে মা হারা করেছিল রুদ্র, সূচনাকে। বাবা হারা করেছিল রাদিফ, সাদমানকে। পুরষ্কার সরূপ কী পেয়েছে? এই তো জীবন। একাকী, নিঃসঙ্গতা।
দরজায় করাঘাত হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সুরভি। দরজা খুলতেই রিমনের ক্লান্ত মুখের দেখা মিলল। সুরভি ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল তাকে। রিমন সেটা খেয়ে মায়ের হাতে চারহাজার টাকা গুঁজে দিল। বলল,
-” টিউশনির টাকা। কালকে আরো দুহাজার পাবো। ঘর ভাড়াটা আজ দিয়ে দাও মা। ”
-” গোসল করে আয় ভাত বাড়ছি। ”
শার্ট খুলতে খুলতে রিমন বলল,
-” কী রেঁধেছ? ”
-” ছোটো মাছ চর্চরী। ”
-” কাল মাংস আনব। ”
মৃদু হেসে সুরভি বলল,
-” আনিস। ”
রিমন গোসলে চলে গেল। সুরভি নিজেকে শক্ত করে নিয়ে ভাত বাড়তে লাগল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ছেলেটা একসময় মাংস ছাড়া ভাত খেতো না। বাবা ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতো না। অথচ আজ? সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। মাসান্তর একবার মাংস খেতে পারে। বাবা ছাড়া কাটিয়ে দিল দু’টো বছর। মানুষটা কি নিষ্ঠুর! মুহুর্তেই চমকাল। যে প্রথম দু’টো সন্তান ছেড়ে তার হাত ধরতে পারে সে অবশ্যই তৃতীয় সন্তান ছেড়েও অন্য কারো হাত ধরার ক্ষমতা রাখে? একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। সে রিদওয়ানকে নিঃসঙ্গ করে এসেছিল। আজ নিজেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। রিদওয়ানের পরিস্থিতি তার মতো শোচনীয় নয়। বরং সে পরিবার নিয়ে সুখেই আছে। শুনেছে রুদ্রর বউ গর্ভবতী। ক’দিন পর নিশ্চয়ই পরিবারে সুখের ঢেউ খেলবে? বড়ো ছেলের কথা মনে হতেই মেয়েটাকে মনে পড়ে গেল। বুক ভার হলো আবারো। সে কী জঘন্য। সময়ের বেড়াজালে না আটকালে কখনোই টের পেত না। রিদওয়ান তাকে ছাড় দিলেও সৃষ্টিকর্তা এক চুলও ছাড় দেননি।
__________________________
মাঝরাত। হৈমীর পেটের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্র। ঘুমন্ত হৈমী যেন জেগে না যায় তাই খুব সাবধানে মেকসি উপরে তুলল। আলগা করল পেট। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে জায়গাটা। রুদ্র ভয় ভয়ে তাকিয়ে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। এই অল্প জায়গাতে দু’দুটো বাচ্চা আছে। তার এমন ছোটো বউ। ছোট্ট একটা পেট। সেখানে কিনা দু’টো বাচ্চা! নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সেই দুপুর থেকে বড্ড পাগলামি করছে রুদ্র। হৈমীর ভেতরের পাগলাটে সত্তা আজ যেন নিজের মাঝে ধারণ করেছে সে। হাত বাড়িয়ে পেটে স্পর্শ করল রুদ্র। সারাদিন ঠিকভাবে দেখতে পারেনি। আদর করতে পারেনি। সূচনা, মাহের, হামিদা সকলেই এসেছিল। আলট্রা করার পর সবাই হসপিটাল থেকে বাড়ি এলো। কত হৈচৈ করল। তাকে কেউ সুযোগ দেয়নি। আর যখন সুযোগ পেয়েছে নিজের ভারিক্কি খোলসটা খুলতে পারেনি। হৈমী ঘুমানোর পর সেই খোলস উন্মুক্ত হয়েছে। মন ভরে আদর করল রুদ্র। ভাবল কত কী। এরপর ঠোঁট এগিয়ে চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিল উঁচু হওয়া পেটটা। হৈমী নড়েচড়ে ওঠল। সে কিঞ্চিৎ দমে আবারো চুমু খেল। এক, দুই, তিন কত হলো? একশো হয়েছে কি? হতেও পারে। একশো চুমুতে সিক্ত করে তুলল। সহসা হৈমীর পেটের ভিতর নড়াচড়া শুরু হলো। রুদ্র চমকে ওঠল। বেবি রেসপন্স করছে তাকে! ঘুম ছুটে গেল হৈমীর৷ হাত চলে গেল পেটে। বাবুরা বেশি নড়াচড়া করছে। আশপাশে তাকিতুকি করতেই দেখল রুদ্র তার পেটের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। কয়েক পল পর যেখানটায় বাবু নড়ল ওখানটায় হাত রাখল রুদ্র। হৈমী বলল,
-” উহ এত নড়ছে ওরা। ”
হৈমীর কণ্ঠ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল রুদ্র। বিস্মিত স্বরে বলল,
-” অ্যাঁই হৈমী, আমি ওদের ছুঁতে পাচ্ছি। ওরা আমাকে ছুঁতে সাহায্য করছে। ওয়েট তোমাকে ছবি তুলে দেখাচ্ছি। ”
রুদ্র ঝটপট কয়েকটা ছবি ওঠিয়ে ফোনটা হৈমীকে দিল। হৈমী যা দেখল তাতে ওর শরীর শিউরে ওঠল। নাভির কিঞ্চিৎ নিচে পেটের দু’পাশে উঁচু হয়ে আছে। বাবুরা কি হাত বা পা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মুখে বলে ফেলল। রুদ্র উন্মাদের মতো মাথা নাড়াল। বাচ্চাদের মতো বলল,
-” ওরা এখানে আর থাকতে চাইছে না। আমার কাছে আসতে চাচ্ছে। আমার বুকে ঘুমাতে চাইছে। ”
মিটিমিটি হাসল হৈমী। আরাম করে শুয়ে বলল,
-” হ্যাঁ আপনার বুকেই তো ঘুমাতে হবে। ওরা এলেই তো আমার ছুটি। ”
সহসা চমকে ওঠল রুদ্র। বলল,
-” ছুটি মানে? ”
খিলখিল করে হাসল হৈমী। বলল,
-” বারে, নিজের কথা নিজেই ভুলে গেছেন? ”
মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল রুদ্র। ধীরেধীরে পাশে শুইয়ে পড়ল। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল। এরপর হৈমীকে টেনে নিজের মুখোমুখি করল। বলল,
-” তুমি ছাড়া ওদের ভাবতে পারি না আমি। ”
ভেঙচি কাটল হৈমী। বলল,
-” সব জানা আছে আমার। সময় বুঝে গিরগিটি হওয়ার ওস্তাদ আপনি। ”
আচমকা হৈমীকে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। পুরুষরা তো হাউমাউ করে কাঁদে না। পুরুষ কাঁদে নিঃশব্দে। রুদ্র কি কাঁদল? আলগোছে রুদ্রর মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল হৈমী। ফিসফিস করে বলল,
-” যারা নিজের ভুল বুঝে মাথা নত করে, ভুল স্বীকার করে তাদের ক্ষমা করা মহৎ গুণ৷ কিন্তু যারা ভুল বুঝে ইগো দেখিয়ে গুমরে মরে ওদের কী করা উচিৎ জানেন? ”
রুদ্র মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে জানে না। হৈমী চোখ কটমটিয়ে বলল,
-” আচ্ছা জানাচ্ছি। ”
বলেই রুদ্রর ঝুঁটিতে শক্ত করে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ওপর থেকে সরালো ওভাবেই। কিঞ্চিৎ ব্যথায় রুদ্র বলল,
-” আহ, কী হচ্ছে টা কী? ”
-” কিছু হয়নি এবার হবে। ”
কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর বুকের বা’পাশে শক্ত এক কামড় বসালো। দাঁত ডাবিয়ে! ব্যথায় উহু, আহ করল রুদ্র। ইচ্ছে করলেই পারত এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে। কিন্তু সরালো না। হৈমী নিজের মতো ওকে শাস্তি দিল। রক্ত বেরোতেই আচমকা সরে গেল। সে। রুদ্রর চোখের কার্ণিশে এক ফোঁটা অশ্রু। হৈমী নিঃশব্দে সরে গেল। পাশফিরে ভারি নিঃশ্বাস ফেলল চোখ বন্ধ করে। রুদ্র রক্তে লাল বুকের বা’পাশটায় তাকিয়ে এক হাত চেপে ধরল। নিঃশব্দে হৈমীর গা ঘেঁষে চিবুক ছোঁয়াল কাঁধে। বলল,
-” কাঁদছ কেন? আমিত বকিনি। কামড়েছ বেশ করেছ। ইট’স গুড। ”
হৈমী কথা বলল না। বুকে ভার হয়ে ওঠেছে তার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। সে তো সত্যিই ছাড়তে পারবে না এই মানুষটাকে। এই মানুষটাও কি পারবে? সেই প্রমাণ তো এখনো পায়নি। তবে পাবে নিশ্চিত।
________________________
ভরদুপুরে দাদিন খবর পেল তার বড়ো ছেলে দু’বছর আগে তৃতীয় বিয়ে করেছে। খবরটি টেলিফোনে ফোন করে দিল তার বড়ো বোন। বড়ো বোনের ছেলের বউ যে হাসপাতালের নার্স হিসেবে যুক্ত। সেই হাসপাতালে দিলওয়ারের তৃতীয় বউ কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তরতাজা এ খবরটি পেয়ে দাদিন আঁচ করল, এতদিন দিলওয়ার তাকে মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়েছে। সে আসলে সুরভি বা ছেলে রিমনের জন্য নয়। তৃতীয় বউ, তৃতীয় সংসার খরচের টাকা নিয়েছে মায়ের থেকে। তাহলে সুরভি, রিমন ওরা কোথায়? ওদের পথে বসিয়ে দিলওয়ার নতুন সংসার পেতেছে! আর কত অমানুষী রূপ দেখাবে ছেলেটা? রক্তে চাপ পড়ল দাদিনের। প্রেশার বেড়ে জ্ঞান হারালো আচমকা। হৈমী খাচ্ছিল, জেরিন বাসনপত্র ধুতে ব্যস্ত। এমন সময় দাদিন জ্ঞান হারানোয় সবার প্রথম নজরে পড়ল হৈমীরই৷ সে ছুটে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল! চিৎকার করে কেবল উচ্চারণ করল,
-” দাদিন! “#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৬
ভবিতব্য বদলে যেতে সময় লাগল এক মুহুর্ত মাত্র। বদলে গেল নাকি এটাই লেখা ছিল রুদ্র, হৈমীর কপালে? দাদিনের জ্ঞান ফিরতে খুব বেশি সময় নেয়নি। বাড়ির বড়ো বউ জেরিন তার দেখভাল করছে। কিন্তু ওদিকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে হৈমী! সাত মাসের পেট নিয়ে হোঁচট খাওয়া। পুরো পেটে মেঝের সঙ্গে ঘর্ষণ। ফলশ্রুতিতে প্রচণ্ড রক্তপাত শুরু। এরপরই জ্ঞান হারানো। শহরের সবচেয়ে উন্নত হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হৈমীকে। ইমিডিয়েটলি সিজার করতে হবে। হৈমী বেঁচে আছে কিন্তু বাচ্চারা বেঁচে আছে কিনা নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ডক্টররা। রুদ্রর দেখা সেই ভয়ানক স্বপ্নটা যেন আচমকা সত্যি হয়ে গেল। স্বপ্নে দেখা সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন এখন সে। সামনে মেঝেতে বসে আছে শাশুড়ি। অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর মুখপানে। করুণ চোখদুটো যেন বলছে, ‘ আমার মেয়েটাকে বাঁচাও। ‘ ভিক্ষে চাইছে সে তার সন্তানকে। অথচ রুদ্রর সন্তানদের কথা এখন সে ভাবছে না। পৃথিবীতে সব মায়েরা বোধহয় এইক্ষেত্রে ভীষণ রকম স্বার্থপর। স্বার্থপরের মতোই হামিদা আকুতি জানাচ্ছে রুদ্র যেন নিজের সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়ে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দেয়। পাশেই অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাহের, সূচনা। তারা কেবল অপেক্ষায় আছে রুদ্রর একটি সাইনের। সূচনার দৃঢ় বিশ্বাস তার ভাই হৈমী ছাড়া এ মুহুর্তে কিচ্ছু চাইবে না। কিন্তু সেই দৃঢ় বিশ্বাস টুকু স্পর্শ করতে পারেনি মাহের, হামিদাকে। স্পর্শ করার কথাও নয়। ধরে রাখা কাগজগুলোতে সাইন করার সময় এক মুহুর্ত চোখ বুজল রুদ্র। মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করল সেই মুহুর্তগুলো। যারা গত তিনমাস তার পিতৃ সত্তাকে সময়ে অসময়ে জাগিয়ে তুলেছে। মনে পড়ল সেই মুহুর্তকে। যে মুহুর্তে সে হৈমীর গায়ে আঘাত করেছিল। বলেছিল, তার সন্তান পৃথিবীতে আসা মাত্র ডিভোর্স দেবে হৈমীকে। সেই মুহুর্তও মনে পড়ল। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। এ প্রথম সবাই দেখল বদরাগী, কঠোর প্রকৃতির রুদ্ররাও কাঁদে।
একেই বোধহয় শাস্তি বলে। যা সে করতে পারবে না পরিস্থিতির চাপে, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তেজ দেখিয়ে সে কথা বলার শাস্তি এমন নির্মম ভাবে হবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। সময় মানুষকে কোনদিকে নিয়ে যায় তা সে নিজেও জানে না। আজকের রুদ্র কি সেইদিন জানত আজ তার এমন একটা দিন আসবে? গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয়ায় যে হৈমীকে সে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। আজ সে হৈমীকেই বাঁচাতে সন্তানদের আল্লাহর নামে ছেড়ে দেবে?
চোয়ালদ্বয় কঠিন করে ভেজা চোখ দু’টো খুলল রুদ্র। কাঁপা হাতে ত্বরিত সাইনও করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নার্স ছুটে এসে কাগজগুলো নিয়ে গেল। তার পেছন পেছন গেল সূচনা। হৈমীকে ওটিতে নেয়া হয়েছে। রুদ্র ওটির সামনে গিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়াল। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল মাহের। কাঁধ স্পর্শ করল ভরসার সঙ্গে। বলল,
-” হৈমীর কিচ্ছু হবে না রুদ্র। আপনি যে ত্যাগ করেছেন এর পর ওর কিচ্ছু হতে পারে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সবদিক দিয়ে কাউকে নিঃস্ব করে না। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? ”
রুদ্রর নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত। তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা বোঝা বড়ো দায়। পুরুষ মানুষ কী কঠিন খোলসে নিজেকে মুড়িয়ে রাখে। তা মাহেরের থেকে আর কে ভালো জানে? সে আর সূচনা সৃষ্টিকর্তার কাছে কতগুলো দিন ধরে সন্তান ভিক্ষা চাইছে। আর রুদ্র, হৈমীর জীবনে না চাইতেও সন্তান এলো। একটি দূর্ঘটনার জন্য তাদের সৃষ্টিকর্তা আবার নিয়েও যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড়ো আফসোস তো এজন্যই হবে যে নিজেদের অসতর্কতার জন্যই বাচ্চা দু’টো পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না। মাহেরকে সবচেয়ে বেশি অবাক তো করেছে আজ রুদ্র। যেই রুদ্রকে তারা চেনে সেই রুদ্র তো ছেড়ে কথা বলার মানুষ নয়। সেই রুদ্র তো ঠিক হৈমীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো। এই সময় হৈমী নয় বাচ্চাদের বেছে নিত। তাহলে কি রুদ্রর মনে ভালোবাসা নামক মূল্যবান অনুভূতিটুকু হৈমীর জন্য সত্যি আছে? উহুম আজকের পর প্রশ্ন করার জায়গা থাকে না। রুদ্র ভালোবাসে হৈমীকে। যা ওর ত্যাগেই প্রমাণিত।
ঘাড় ফিরিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্র। মাহের বলল,
-” এই কঠিন সময়ে আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। আপনি প্লিজ দুই রাকাত নামাজ পড়ে আসুন। স্বামীর দোয়া স্ত্রীর জন্য ম্যাজিকের মতো। ”
মাহেরের কথায় রুদ্র কাছাকাছি এক মসজিদে চলে গেল। বাস্তবতার কঠিন নিয়মে আজ যেন রুদ্র এক শিশু মাত্র। যে যেভাবে পথ দেখাবে সে সেভাবেই এগোবে। হৈমী এই দৃশ্য দেখলে নিশ্চয়ই অবাক হতো। সময় গড়াল বেশকিছু ক্ষণ। হঠাৎ ওটি থেকে নার্সের চিৎকার শোনা গেল! বেঁচে আছে, বেঁচে আছে। হৈমীর জমজ বেবিদের মধ্যে ছেলে বাচ্চাটা রেসপন্স করছে। মেয়েটা রেসপন্স করছে না। অর্থাৎ একটি জীবিত অপরটি মৃত। সাতমাসের বাচ্চা দু’টো। ওজন কম, চোখও ফোটেনি। ইমিডিয়েটলি জীবিত বাচ্চাটিকে এন আই সি ইউতে পাঠাতে হবে। মাহের তৎপর হলো। সমস্ত ব্যবস্থা করার পর হসপিটালে রুদ্রর প্রবেশ। আর তখনি মহিলা ডক্টর নার্স ডাকাডাকি শুরু করল। মেয়ে বাচ্চাটিরও হার্টবিট সচল! রুদ্রর কর্ণে সমস্ত কথাই পৌঁছাল। সে নিথর দেহে উন্মুখ চোখে তাকিয়ে রইল সূচনার দিকে। সূচনা আশ্বস্ত করল,
-” হৈমী ঠিক আছে ভাইয়া৷ ওর জ্ঞান ফেরেনি এখনো। ”
সূচনার বক্তব্য শুনে এবার সে অবিশ্বাস্য চোখমুখে আশপাশে তাকাল। ততক্ষণে মাহের আর হামিদা ডক্টরদের পরামর্শে বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে ছুটোছুটি করছে৷ রুদ্রর বাবা, চাচাত ভাইরা তখন হসপিটালে এলো। রুদ্র চোখমুখের ঘাম মুছে নিঃশব্দে বসে পড়ল। সে জানে তার সন্তানরা দুনিয়াতে এসেছে। যারা মৃত বলে ঘোষিত হয়েছিল! যাদের আশা ছেড়ে বন্ড সই করেছিল সে। তারা বেঁচে আছে। এ যে মহান আল্লাহ তায়ালারই কৃপা। একটু আশার আলো পেয়েও নিথর রইল সে। নিভু নিভু প্রদীপ। পুরোপুরি জ্বলবে? নাকি দপ করে নিভে যাবে? প্রশ্ন দুটোয় বুকটা ছিন্নভিন্ন হতে শুরু হলো। একবার মন চাইল এক ছুটে যেতে ওদের কাছে। আবার ভয় পেল। খুব বেশি সুখ তার যে সয় না। আচমকা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে ওঠল রুদ্র। ছেলের এহেন দশায় কাঁধে হাত রাখল রিদওয়ান শেখ। পাশে বসে বুকে টেনে নিল। ভরসা দিয়ে বলল,
-” আমার নিষ্ঠুর রুদ্রকে যারা কাঁদাচ্ছে উপরওয়ালা তাদেরকে আমার আয়ু দান করে হলেও বাঁচিয়ে রাখুক। ”
বাবার এই আশ্রয়টুকু জীবদ্দশায় কখনো কি পেয়েছিল রুদ্র? সেই যখন মা ছেড়ে চলে গেল তখনও তো বাবা পাশে ছিল না৷ ওইটুকু বয়সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ থেকে বোনের পাশে থাকতে হয়েছে তাকে। ধীরেধীরে বড়ো হলো। শক্ত পাথরের খোলস তৈরি করল নিজের চারপাশে। বাবা নামক ছায়াটি আড়াল থেকেই ছায়া দিয়েছে তাকে। আজ জীবনের কঠিন মুহুর্তে বাবার এই আশ্রয়টুকু খুব বেশি প্রয়োজন ছিল খুব। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদল রুদ্র। কাঁদল রিদওয়ান শেখও। স্মৃতি হাতড়াল সেও। কারণ এমন এক সময় তিনিও পার করেছেন। যদিও রুদ্রর মতো জটিলতা ভোগ করেননি। তবুও রুদ্র যখন জন্মাল। তার পূর্ব মুহুর্তে সেও ভেঙে পড়েছিল। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়েছিল। তার অস্থির মন, ব্যথাহত চোখ দু’টিতে শান্তি দিয়েছিল রুদ্রর ফুটফুটে মুখ।
_____________________
ওটি থেকে নরমাল কেবিনে নেয়া হয়েছে হৈমীকে। জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ। সেলাইন চলছে। কিন্তু মেয়েটা কথা বলছে না! তার অবশ হাতটা ধরে পাশে বসে আছে রুদ্র। মাথা নিচু করে আছে সে। রুমের এক কোণায় রুদ্রর ছোটো চাচি রিনা দাঁড়িয়ে। সূচনা, মাহের, হামিদা তখনো বাচ্চাদের কাছে। রুদ্র একটিবারও সেখানে যায়নি। কাউকে কোনো প্রশ্ন করেনি। তার ভেতরে কী চলছে এ মুহুর্তে বোঝা মুশকিল। কয়েক পল অতিবাহিত হলো নিঃশব্দেই। সহসা ফোপাঁনোর শব্দ শুনতে পেল রুদ্র। নত মাথা আচমকা উঁচু করতেই দেখল, হৈমী তার দিকে তাকিয়ে। রুদ্র ব্যাকুল হলো। হাত বাড়িয়ে হৈমীর এক গাল স্পর্শ করল। বলতে চাইল অনেক কিছু কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই উচ্চারণ করতে পারল না। শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে স্বস্তি নিয়ে কাঁদতেও পারছিল না হৈমী। রুদ্র বুঝতে পেরে দু’হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিল। মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করল, কাঁদতে। হৈমী ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” আমি খুব খারাপ মা। সেদিন ওদের মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আজ ওদের পুরোপুরি শেষ করে দিলাম। ”
চমকে ওঠল রুদ্র। এর মানে হৈমী জানে না তার বাচ্চারা বেঁচে আছে? তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল, এ ব্যাপারে তো কথাই হয়নি আর। রুদ্র ত্বরিত সবটা বলতে গিয়েও থমকে গেল। যদি শেষ পর্যন্ত ওরা না বাঁচে? কী হবে একটুখানি খুশি দিয়ে? ওদের বেঁচে থাকার কথা সম্পূর্ণ চেপে গেল রুদ্র। রিনা চাচি বলতে নিলেও রুদ্র ইশারায় থামিয়ে দিল। এরপর হৈমীর একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-” তোমার কোনো দোষ নেই হৈমী। আমিই তো ওদের চাইনি। তাই শেষ বেলায় সৃষ্টিকর্তা আমাকেই শাস্তি দিচ্ছে। ”
হৈমীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। দু’চোখে বাঁধভাঙা অশ্রু। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করল। সহ্য করতে পারছিল না নিজেকেই। হঠাৎ প্রশ্ন করল,
-” ডাক্তাররা কী বলেছিল? ”
সহসা রিনা বলে ফেলল,
-” তুমি তো জানো না কিছুই। জানো, রুদ্র কী করেছে? ও বার বার করে ডাক্তারকে বলেছে যে কোনো মূল্যে তোমাকে বাঁচাতে। শেষ মুহুর্তে রুদ্র বাচ্চা নয় তোমাকেই বেছে নিয়েছে। ”
কথাগুলো হৈমীর মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলল। সে রুদ্রর দিকে অসহায় চাহনি ছুঁড়ে কাঁপা গলায় বলল,
-” আমার বাচ্চা, আমাদের বাচ্চা রুদ্র, ওরা কোথায় আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন। ”
এ প্রথম হৈমী নিজের মুখে রুদ্রর নাম উচ্চারণ করল। ঠিক কতখানি সিরিয়াস জীবন এসে গেছে তাদের। হৈমীর এই সম্বোধনটুকুই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। রুদ্র ওর মাথায় হাত রাখল। বলল,
-” শান্ত হও হৈমী। ”
-” ভাইয়া, ভাবি, মা কোথায়? ওরা কি আমার বাচ্চাদের কবর দিয়ে দিয়েছে? ”
কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হলো হৈমী। রুদ্র সহসা আঁতকে ওঠল,
-” না, না। ”
এমন সময় নার্স ঢুকল। ধমক দিয়ে বলল,
-” কী হচ্ছে। আপনি কথা বলছেন কেন? আর আপনিই বা চিল্লাচিল্লি করছেন কেন? ”
হৈমী পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করল। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি খাঁটিয়ে আচমকা ওঠে বসল। সদ্য সিজার করেছে সে৷ এটুকু হুঁশ নেই। কা’টা পেটে চাপ পড়তেই হুঁশ ফিরল। ব্যথায় নীল হয়ে ওঠল চোখ, মুখ। শরীর ছেড়ে দিল। রুদ্র, নার্স সামলে নিল ওকে। পাশাপাশি নার্সের মুখের অগণিত কটুবাক্য শুনল। শেষে বিরক্ত হয়ে নার্সকে ধমকে ওঠল রুদ্র। মহিলাটি কেঁপে ওঠল। রুদ্র শক্ত গলায় নার্সের থেকে হৈমীকে ছাড়িয়ে নিল। বলল,
-” দেখছেন না আমার বউ ছোটো। আর একটা বকা দেয়ার সাহসও দেখাবেন না। আপনার মতো হাড়ে হাড়ে জ্ঞান ওর নেই। এইটুকু বয়সে এত ধকল তো আপনার যায়নি ওর গেছে। সো, যার ব্যথা সেই বোঝে। আপনি যেহেতু বোঝেন না সেহেতু চুপচাপ থাকুন। ”
বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল নার্সটি। রিনা চাচি তাকে ইশারায় চুপই থাকতে বলল। উনি চুপচাপ তাকিতুকি করে সেলাইন চেক দিয়ে বিরবির করতে করতে বেরিয়ে গেল,
-” যেমন বউ তেমন তার হাজব্যন্ড! ”
বাচ্চাদের কথা মাত্র চারঘন্টা গোপন রাখা গেল। রাত যত বাড়ছিল হৈমীর আহাজারিও তত বাড়ছিল। না পেরে রিনা সত্যিটা বলেই দিল ওকে। সত্যি শুনে এবার হৈমীর উত্তেজনা এতই বাড়ল যে। কিছুতেই আঁটকে রাখা যাচ্ছিল না। মেয়ের কথা শুনে হামিদা ছুটে এলো। ডক্টর এসে তাকে বোঝাল তার বাচ্চাদের কন্ডিশন। তারা এও বোঝাল কিছুদিন বাচ্চাদের থেকে দূরে থেকে যদি সারাজীবনের জন্য কাছে পাওয়া যায় এটাই ভালো? নাকি কিছু সময় কাছে পাওয়ার লোভে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলা ভালো? এমন প্রশ্নে শান্ত হলো রুদ্র। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সে। ডক্টরের কথা শুনে সেও ভরসা পেল। হৈমীর দিকে তাকাল থমকানো দৃষ্টিতে। হৈমী তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। কাছে যেতেই বলল,
-” বাবুদের একবার দেখে আসুন না… মোবাইল নিয়ে যাবেন প্লিজ। ওদের কিছু পিক আর ভিডিয়ো এনে দেখান আমাকে। আমার বুকের ভেতরটা খুব জ্বলছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমি পারছি না সহ্য করতে। প্লিজ রুদ্র প্লিজ। ”
রুদ্রর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠল। #বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৭
মা হওয়ার পর সেরা মুহুর্তটি পায়নি হৈমী। যারা মা হয়েছে তারাই জানে তাদের সেরা মুহুর্ত কোনটি। সৃষ্টিকর্তা হৈমীকে সেই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত করেছে। হয়তো সেই অনুভূতিটুকু থেকে বঞ্চিত করার পেছনেও কোনো না কোনো মঙ্গল রয়েছে। রুদ্রর নিয়ে আসা ভিডিয়ো গুলো দেখছে আর চোখে অশ্রু ঝড়াচ্ছে মেয়েটা। অসহায়ের ন্যায় পাশে বসে আছে রুদ্র। একবার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে তার বাচ্চাদের। আর একবার দেখছে বাচ্চার মায়ের অসহায় মুখাবয়ব। হৈমী বার বার করে একটা কথাই বলছে,
-” ওরা আমার পেটে ছিল? কী কপাল আমার এখনো ওদের ছুঁয়ে দেখতে পারলাম নাহ। ”
রুদ্র স্বান্তনা দিল,
-” আফসোস করছ কেন হৈমী? হিসেব অনুযায়ী ওরা আরো এক, দেড়মাস পর পৃথিবীতে আসার কথা। এক্সিডেন্টের জন্য দ্রুত এসে পড়েছে। কান্না না করে, আফসোস না করে দোয়া করো। যেন খুব তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারি ওদের। ”
সহসা থমকানো স্বরে হৈমী বলল,
-” ওদের নিয়ে সব কেন এক্সিডেন্টলি হচ্ছে! ”
থমকাল রুদ্র নিজেও। এক মুহুর্ত শক্ত হয়ে গেল সে। একই ভাবনা মাথাচাড়া দিল তারও। হৈমী মিথ্যে কিছু বলেনি। বিনা প্রস্তুতিতে সব কিছু হচ্ছে। যখন ওরা হৈমীর গর্ভে এলো সে জানতে পারেনি। হৈমী যখন জেনেছিল তখন সেও অবাক হয়েছিল। পুরো বিষয়টাই দূর্ঘটনার মতো হয়ে গিয়েছিল। এরপর রুদ্রকে না জানিয়ে গর্ভপাতের চেষ্টা। কাকতালীয় ভাবে হৈমীর প্রেগ্নেসি বিষয়ে রুদ্রর জেনে যাওয়া। এরপর সবটা যখন স্বাভাবিকতায় মোড় নিল তখনি আরো একটা এক্সিডেন্ট! সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। হৈমীকে শুনিয়ে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে বলল,
-” সন্তান হিসেবে হতভাগা ছিলাম। বাবা হিসেবেও হতভাগাই রইলাম। ”
হৈমী কেঁপে ওঠল। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে টলমল চোখে বলল,
-” সব আমার জন্য। ”
রুদ্র মাথা নিচু করে শ্বাস ফেলল ঘনঘন। বলল,
-” নাহ সব ঠিক হয়ে যাবে সব ঠিক করে নিব। শুধু পরা সুস্থ হয়ে ফিরুক। তুমি, আমি মিলে আমাদের সন্তানকে ঠিক আগলে রাখতে পারব। এই যে দূর্ঘটনা ঘটল এটাই যেন আমাদের জীবনের শেষ দূর্ঘটনা হয়। ”
হৈমীর শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। রুদ্র সে চাহনি খেয়াল করে আশপাশে নজর ঘোরাতে লাগল। যেন সে হৈমীর চোখে তার জন্য যে মুগ্ধতা টের পেয়েছে। এই টের পাওয়া টুকুও গোপন করার চেষ্টা করল। তার সেই লুকোচুরি যখন হৈমী টের পেল তখন মুচকি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে হৈমীকে বলল,
-” আপনি সারাক্ষণ শুয়েই থাকেন। ডাক্তার ম্যাডাম বলেছে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আপনারই উপকার হবে আমাদের না। ”
বাঁকা কথায় রুদ্র বিরক্তি সূচক শ্বাস ফেলল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল নার্সের দিকে। বলল,
-” গতকাল সিজার আজি হাঁটাহাঁটি করবে? ওকে কি আপনাদের মানুষ মনে হয় না? ”
আজ নার্সও চটে গেল। বলল,
-” আপনি মশাই বেশি আহ্লাদ করে বউয়ের বিপদ ডেকে আনবেন। আপনার মতো ত্যাড়া পেশেন্ট পার্টি এর আগে একটাও দেখিনি! কোথায় আমাদের সাজেশন মেনে চলবেন তা না মেজাজ দেখান। মনে হয় আমরা আপনার বাড়ির শরিক! ”
হৈমী হতভম্ব হয়ে গেল। নার্স মহিলাটিকে থামতে ইশারা করল। রুদ্রর মেজাজ তো সপ্তম আকাশে ওঠে গেছে। এবার ধপাস করে নিচে পড়ার অপেক্ষা।
হৈমী ভয়ে ভয়ে বলল,
-” আচ্ছা আচ্ছা আমি হাঁটব এই এখনি। ”
রুদ্র গজগজ করতে করতে বলল,
-” তুমি চুপ করো। ”
নার্স বললেন,
-” আপনি প্রথম মা হয়েছেন, উনি প্রথম বাবা। কিন্তু আমাদের হসপিটালে আপনিই প্রথম মা হননি৷ ”
হৈমী জোরপূর্বক হেসে আমতা আমতা করে বলল,
-” আসলে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। তাই উনিও ভয় পাচ্ছেন। কিছু মনে করবেন না। উনার একটু মাথা গরমের স্বভাব আছে। ”
নার্স মহিলাটি কিছু মেডিসিন দিয়ে চলে গেলেন। নিচু গলায় বলে গেলেন,
-” আপনার হাজব্যান্ডের একটু না বেশিই মাথা গরম করার স্বভাব আছে। সামলাতে বলবেন নয়তো বিপদে পড়বে। ”
তিনি চলে যাবার পর রুদ্র হৈমীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল৷ বলল,
-” ওকে এটা বলার কী দরকার ছিল? ”
-” কোনটা? ”
চিবিয়ে চিবিয়ে রুদ্র বলল,
-” আমার মাথা গরম। ”
ঠোঁট টিপে হাসল হৈমী বলল,
-” মিথ্যে নাকি? ”
দ্বিগুন চটে গেল রুদ্র। হৈমী আর বেশি না ঘেঁটে বলল,
-” আমি তো ওঠার সাহস পাচ্ছি না। সাহায্য করুন কিছুক্ষণ হাঁটি। ”
রুদ্র বিচলিত হচ্ছিল হৈমী শান্ত করতে বলল,
-” আপনি অযথা হাইপার হচ্ছেন। আম্মু, রিনা কাকিও বলেছে হাঁটাহাঁটি করতে। এটা আমার জন্যই ভালো। দেখুন না পা দু’টো কেমন অবশ হয়ে আছে। এভাবে থাকতে থাকতে পঙ্গু হয়ে যাব। ”
রুদ্র রাজি হলো। হৈমীকে কোলে করে বেড থেকে নামাল। মেঝেতে পা দু’টো রাখতে পারছিল না। রুদ্রর বাহু চেপে কোনোরকমে দাঁড়াল। তার শারীরিক অবস্থা বুঝল রুদ্র। চিন্তিত হলো ভীষণ। কীভাবে হাঁটাবে এ অবস্থায়? ভাবতে ভাবতেই হৈমীর একদম পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ওর কাঁধ চেপে ধরল যে হৈমীর মাথা ঠেকল ওর কাঁধে। সম্পূর্ণ সাপোর্ট পেয়ে হৈমী এক পা আগাল। রুদ্র এক হাতে কাঁধ অপরহাতে হৈমীর একটি হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। সূচনা আর মাহের এসেছে রুদ্র, হৈমীর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে। কেবিনের সামনে দাঁড়াতেই ওদের নজর কাড়ল দৃশ্যটি। কমলা রঙের একটি মেকসি পরা হৈমী। চুলগুলো বিনুনি করা। একটা, দু’টো চুল কপাল ছুঁয়েছে। কিছু চুল চোখের ওপরে পড়তেই রুদ্র তা ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল। কাবলি পরিহিত বিশাল দেহি পুরুষটির বুক জুড়ে হৈমীর রুগ্ন দেহখানি। দেখতে কী যে মনোমুগ্ধকর লাগছে। মাহের দুচোখ ভরে দৃশ্যটি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সূচনাকে মৃদু স্বরে বলল,
-” পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষের বুকেই তিনটি আদর্শ ঘুমিয়ে থাকে। সন্তান, স্বামী, পিতা৷ এ মুহুর্তে আমি আদর্শ স্বামীকে দেখতে পাচ্ছি। ”
মাহেরের দিকে তাকাল সূচনা। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
-” ভাইয়ার মাঝেকার এই আদর্শ যেন আর না ঘুমায় মাহের। ”
-” মহান আল্লাহ তায়ালা উনাকে হেদায়েত দান করুক আমিন। ”
__________________________
হৈমীকে রিলিজ করে দেয়া হয়েছে। সবাই মিলে বাচ্চাদের দেখে তারপর বাড়ি ফিরল৷ হৈমীর কান্না থামছেই না৷ বাচ্চাদের রেখে সে বাড়ি ফিরবে না৷ জোরপূর্বক তাকে গাড়িতে বসানো হয়েছে। পেটে সেলাইয়ের জন্য শব্দ করে কাঁদতেও পারছে না৷ নিঃশব্দে কেঁদে হেঁচকি ওঠে গেছে। এদিকে রুদ্র সঙ্গে আসেনি। মাহের, সূচনা, হামিদা ওকে সামলাচ্ছে। রুদ্র বাচ্চাদের ওখানে রয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তারপর আসবে। হৈমীর মতো সে কাঁদতে পারছে না৷ ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রাখছে। সর্বোচ্চ চেষ্টায়। যতদিন বাচ্চাদের সুস্থভাবে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে না যাবে ততদিনে এক মুষ্টি স্বস্তি বা শান্তি কোনোটাই মিলবে না৷
মাহের, সূচনা মিলে হৈমীকে দোতলায় রেখে আসতে উদ্যত হলো। সকাল থেকেই শরীর ভালো না সূচনার। এ কয়েকটা দিন বেশ ধকল গেছে তার। ঠিকভাবে খাওয়া, ঘুম কিচ্ছু হয়নি। বাবুদের নিয়ে চিন্তা, হৈমীর দেখাশোনা। বাড়ি টু হসপিটাল। হসপিটাল টু বাড়ি করে রাত, দিন পার করেছে। এ মুহুর্তে শরীর খারাপ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হৈমীকে নিয়ে যেতে বেগ পেতে হলো বেশ। সূচনা অসহায় মুখে মাহেরকে বলল,
-” মাহের, আমার শক্তিতে কুলচ্ছে না৷ তুমি এক কাজ করো পাঁজা কোল করে নাও ওকে। ”
সূচনার মুখের অবস্থা দেখে হকচকিয়ে গেল মাহের। সহসা বুকটা ধক করে ওঠল তার। এ কয়েকদিন এই মেয়েটার ওপর একেবারেই নজর দেয়া হয়নি। অথচ মেয়েটা রাতদিন এক করে তার বোন, বোনের সন্তানের জন্য খেটে গেছে। মাথা নাড়াল মাহের বলল,
-” তুমি গিয়ে রেস্ট করো। ”
হৈমীকে রুমে রেখে সূচনার কাছে এলো মাহের। হামিদা সঙ্গে এসেছে। হৈমীর যত্নে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপাতত সূচনাকে সময় দেয়া প্রয়োজন। আবহাওয়া বেশ শীতল। তবুও ফ্যান জুড়েছে সূচনা। মাহের অবাক হলো। বলল,
-” তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? ”
-” ভীষণ অস্থির লাগছে মাহের। কাউকে একটু বলবে আমাকে এক গ্লাস শরবত করে দিতে? ”
সময় অপচয় না করে জলদি নিচে চলে গেল মাহের। রিনা কাকিকে দিয়ে শরবত পাঠাল উপরে। তার সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে চট করেই ধরা পড়ল বিশেষ কিছু। মনে মনে বলল,
-” উপরওয়ালার লীলাখেলা বোঝা বড়োই মুশকিল! যা ভাবছি তাই যদি সত্যি হয়… ”
এক মুহুর্ত চোখ বুজল মাহের। বুকের ভেতরটায় উত্তেজনা শুরু হলো। ত্বরিত চলে গেল কাছাকাছি এক ফার্মেসীতে। ফিরে আসার পর সূচনার হাতে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট কীট দিতেই আচমকা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল সূচনা। জিভ কেটে বলল,
-” আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম মাহের। আ’ম সরি… ”
ঈষৎ হেসে মাহের বলল,
-” ইট’স ওকে। এ’কদিন আমাদের ওপর যা গেল। খেয়াল না থাকাই স্বাভাবিক। যাও… আমার হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে গেছে। ”
সহসা নিজের বুকের বা’পাশে হাত রাখল সূচনা। আচম্বিতে চোখ পড়ল মাহেরের স্তব্ধ দৃষ্টিতে। কাঁপা স্বরে বলল,
-” আমারো… ”
……..
হাত, পা ক্রমাগত কাঁপছে সূচনার। মাহের তাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছে। একে বোধহয় মহান আল্লাহর নেয়ামত বলে। মাহের আনন্দে দিশেহারা হয়ে বলল,
-” আমাদের কারো সঙ্গে আর খারাপ হবে না সূচনা। বোনের ঘরে যে নেয়ামত এলো সেই উছিলায় এবার আমাদের ঘরেও নেয়ামত ঢেলে দিলেন সৃষ্টিকতা। ”
চোখ দু’টি বন্ধ সূচনার। মাহের বুকে মুখ গুঁজে আছে সে। ডানহাতটা পেটের ওপর আলতো ছুঁয়ে। সেই হাতের ওপর আলগোছে মাহেরের হাত পড়ল। সূচনা খুশিতে, লজ্জায় মুখ তুলতে পারল না আর। মা হবে সেও মা হবে। সে ব্যর্থ নয়, সে অক্ষম নয়। চোখ গলে পানি পড়তে শুরু করল এবার। টের পেয়ে মাহের বলল,
-” ডোন্ট ক্রাই সূচনা। ইউ আর প্রেগন্যান্ট। সো, উই উইল বি ফাদার এণ্ড মাদার। ”
_________________________
শেখ বাড়িতে আরো একটি খুশির সংবাদ। এই সংবাদে সূচনা, মাহেরের পর সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন হামিদা বেগম। এ কয়েকদিন রুদ্র হৈমীকে নিয়ে এত বেশি বিভোর ছিল যে বাচ্চাদের সব দায়িত্ব সূচনা আর মাহের পালন করেছে। হসপিটাল ছুটোছুটি, ডক্টরদের সঙ্গে বুঝ, পরামর্শ সব৷ সচক্ষে সেসব দেখে হামিদা সৃষ্টিকর্তার নিকট কত আকুতি করেছে। সূচনার বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা তার মাতৃ হৃদয়কেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। অবশেষে তাদের চাওয়া পূর্ণ হলো। সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চেয়েছেন। আর কোনো খারাপ কারো সাথে না হোক। হৈমীর বাচ্চা দু’টো সহিসালামতে হৈমীর বুকে ফিরুক। তার দুই ছেলে, মেয়ের সুখ কানায় কানায় পূর্ণতা পাক এই কামনাই করল হামিদা।
চলবে…
কনকনে শীতে লিখতে লিখতে হাত বরফ হয়ে যায়। এর বেশি আর সম্ভব হলো না। পরবর্তী পর্বই হবে শেষ পর্ব। এক বা দুই দিন পর দিব।
চলবে….