#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব১১
পরিবেশটা থমথমে।ভিত চোখে জেরিন স্পর্শের দিকে চেয়ে আছে।অপ্রত্যাশিত কথা এবং প্রস্তাবে বিস্মিত জেরিন।সবাই গভীর মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে আছে স্পর্শের মুখের দিকে।স্পর্শ এক দৃষ্টিতে ফ্লোরে চেয়ে আছে।চোখে -মুখে গভীর চিন্তা।দুহাতের আঙুল এক করে থুতনিতে ঠেকিয়ে আছে।নিরবতা ভেঙে প্যান্ট থেকে ফোন বেড় করে কাউকে কল দিলো।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে রিসিভ ও হলো।গলা ঝেরে শান্ত স্বরে স্পর্শ বলে,
—-“সাদ, বাবা কে একটু জানিয়ে দাও আমি কিছু দিনের জন্য বাসায় ফিরবো না।অফিসিয়াল কাজে বাইরে আছি তবে শহরের মাঝেই।”
ওপাশ থেকে কী উত্তর এলো কেউ শুনতে পেলো না।স্পর্শ হাল্কা হেসে বলে,
—-“ধন্যবাদ সাদ! অফিসে দেখা হচ্ছে আর ইন্টোডিওর নতুন ডিজাইনের ফাইলটা কাল আমার টেবিলে রেখো।রাখছি!”
স্পর্শ ফোন কেটে দিলো।সবাই নড়েচড়ে বসলো।ঘুরে ফিরে স্পর্শ কে সবাই দেখছে।স্পর্শ হাল্কা কেশে মৃদু হেসে বলে,
—-“আশা করছি আমার উত্তর পেয়েছেন আপনারা। ”
এতো সময় পর জেরিনের খালু নুরু সাহেব বলেন,
—-“সবই বুঝলাম! তা তোমার পরিবারে সবাই জানে বিয়ের কথা?”
স্পর্শ জেরিনের দিকে ঘাড় ফিরে চেয়ে শিতল কন্ঠে বলে,
—-“আমার কাছের মানুষ গুলো এখনো সেভাবে জানে না।যারা জানার তারাই জানে।জেরিনের জীবন থেকে সব ঝামেলা সারিয়ে মেহরাব ম্যানশনে বরণ করা হবে।”
স্পর্শের এতো সহজ কথায় পরিবারের লোকসহ জেরিন ও অবাক।হাত কাপছে জেরিনের। নাজমুন বেগম লম্বাশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।গম্ভীর গলায় বলেন,
—-“ওদের খেতে দাও কেউ।”
কথাটা বলেই তিনি রুমে চলে গেলেন।জসীম সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলেন,
—-“জেরিনের সাথে তুমি রুমে যাও।”
স্পর্শ হাল্কা হাসলো। সবাই একে একে বাকা চোখে তাকিয়ে উঠে গেলেন।রুমটা ফাকা হতেই গাল ফুলিয়ে নিশ্বাস নিলো স্পর্শ। সোফায় পিঠ লাগিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
—-“আমি কী একটু ফ্রেশ হতে পারি?”
জেরিনের ধ্যান ভাঙলো। চট করে উঠে ব্যস্ত হয়ে বলে,
—-“জ্বি অবশ্যই হতে পারেন।আপনি আসুন আমার সাথে।”
স্পর্শ এক গাল হাসি দিয়ে জেরিনের পিছু পিছু চলতে লাগে।করিডোর পেরিয়ে শেষের দিকে সজ্জিত একটু রুমে পা রাখে স্পর্শ। অন্ধকার রুমে আলো জ্বালিয়ে দিতেই চোখ বরাবর দেখতে পায় একটি মায়াবী হাসি মাখা জেরিনের ছবি।থমকে গেলো স্পর্শ। ক্লান্ত দেহে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে জেরিনের দিকে তাকাল।জেরিন লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বলে,
—-“মায়ের বিয়ের শাড়ি এটা।”
—-“আপনাকে এই শাড়িতে হয়তো নববধূ লাগবে।যদিও শাড়িটা শুধুই মাথার উপর ধরে রাখা তবুও,বউ এর মতোই লাগছে।”
জেরিন মাথা নিচু করে হাসলো।রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে স্পর্শ কে ওয়াসরুম দেখিয়ে দিলো।স্পর্শ ওয়াসরুমে দরজায় যেতেই জেরিন পিছু ডাকে,
—-“কিন্তু আপনার ড্রেস?”
স্পর্শ দরজা ঠেলে ভিতরে যেতে যেতে বলে,
—-“মিনিট দু-একের মাঝেই সাদ পাঠিয়ে দিবে।”
.
.
.
.
কাজের মেয়ে এসে দরজায় কড়া দিলো।জেরিন বিছানা রেডি করছিল।ঘাড় ফিরিয়ে দরজায় তাকিয়ে বলে,
—-“কিছু বলবে?”
কাজের মেয়েটা হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে রুমে পা দিলো।জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-“আফা মনি, একটা লোক স্যার এর কাপড় দিয়ে গেছে।”
জেরিন হাতের ইশারায় ব্যাগটা রাখতে বলে মেয়েটা কে বিদায় করল।অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।অনেক আগে হাসান একবার এসেছিল এভাবে। ভয়ে কুঁকড়িয়ে জ্বর চলে এসে ছিল জেরিনের।কিন্তু আজ সত্যি বউ বউ লাগছে।ব্যাগটা ধরবে কী ধরবে না করে ধরলো।চেইন খুলে দ্বিধাহীন হাতে সাদা টি- শার্ট এবং থ্রি কোয়াটার প্যান্ট বেড় করল।স্পর্শের সব জামা নিজের আলমারিতে সাজিয়ে নিচ্ছে।টাওয়াল দিয়ে মাথার চুল এবং মুখ মুছতে মুছতে রুমে আসে স্পর্শ। জেরিনকে তার জামা আলমারিতে রাখতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
—-“মিস জেরিন, আপনি তো দেখছি আমাকে একবারেই এখানে রেখে দিবেন।ভুলে গেলে চলবে না যে,আপনাকে শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে।”
জেরিন অপ্রস্তুত হয়ে পিছনে ফিরতেই ক্রাশিত হলো।ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।স্পর্শ ঠোঁট উলটে বলে,
—-“দুঃখিত আমি আপনার টাওয়াল ব্যবহার করছি।”
জেরিন চোখ নামিয়ে আলতো গলায় বলে,
—-“আপনি আমার সব কিছুই ব্যবহার করতে পারেন। ”
স্পর্শ ভাবনিত ভঙিতে চুল মুছতে মুছতে টাওয়াল বিছানায় রেখে বলে,
—-“আপনার সব ব্যবহার করতে পারবো?”
জেরিন কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বুঝতে পারে সে কী বুঝাতে চাইলো।দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে লজ্জিত গলায় বলে,
—-“আমি খাবার আনছি।”
কথাটা বলে আর এক মিনিট ও থাকলো না রুমে।স্পর্শ বিছানায় বসে নিঃশব্দে হাসলো।মিনিট পাচ-এক পর খাবারের প্লেট হাতে গুটি গুটি পায়ে রুমে এলো জেরিন।সাইড টেবিলে প্লেট রেখে গলা পরিষ্কার করল।স্পর্শ চোখ বন্ধ করে পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে।
—-“আপনার জন্য খাবার এনেছি।”
স্পর্শ চোখ খুলে তাকায়।আলতে দেহে উঠে বসে।হাল্কা হেসে খাবার প্লেট হাতে তুলে বলে,
—-“ধন্যবাদ আপনাকে!আজ অনেক কাজের চাপ ছিল অফিসে।অনেক ক্লান্ত আমি। ”
জেরিন এক মনে স্পর্শ কে পাশে বসলো।মাথা নিচু করে বলে,
—-“আমার জন্য আপনাকে এই অবস্থায় পরতে হয়েছে।আমি জানতাম না এমন কিছু ভেবেছে উনারা।”
স্পর্শ মুখে ভাত তুলে বলে,
—-“পরিস্থিতি আমাদের বলে আসবে না জেরি।ভাগ্য যে কক্সবাজার আমাদের ওমন পরিস্থিতিতে ফেলবে আমরা কী জানতাম?উপস্থিত বুদ্ধিতে সব কিছুর চিন্তা করতে হবে।আর সমস্যা কী বলুন?আমাদের সম্পর্ক গভীর হওয়ার সুযোগ দিয়েছে তারা।আমি তো ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
স্পর্শের কথায় শরীর কেপে উঠে।অস্থিরতা নিয়ে জেরিন বলে,
—-“আমি একটু আসছি।”
____________________________
নাস্তার টেবিলে বসে আছে জসীম সাহেব,নাজমুন বেগম, জেসমিন,লতিফ সাহেব এবং তার স্ত্রী সেলিনা।কেউ কোনো কথা বলছে না।জসীম সাহেব দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো-৯ঃ১০ বাজে।নাজমুন বেগম নিঃশব্দে সবার পাতে রুটি এবং তরকারি দিচ্ছে।জসীম সাহেব গম্ভীর মুখে বলেন,
—-“জেরিন কোথায়?এখনো খেয়ে আসেনি?”
নাজমুন বেগম কথা বলল না।সেলিনা গ্লাসে জুস দিতে দিতে বলেন,
—-“এখনো আসেনি ভাই।এখন না এলে ডাকতে পাঠাবো ওদের।”
লতিফ সাহেব মুখ বাকিয়ে বলেন,
—-“ঢং আর অভিনয় যতসব।”
নাজমুন বেগম বিরক্তি নিয়ে বলেন,
—-“সবাই খাওয়া শুরু করো।”
রৌদের আলো চোখে পরতেই জেরিন নড়ে উঠলো।পিটপিট করে চোখে খুলে অফিসের জন্য রেডি হওয়া স্পর্শের হাসি মুখ দেখলো।গলায় টাই ঝুলিয়ে মৃদু গলায় বলে,
—-“গুড মর্নিং! ”
জেরিন মোহিত চোখে চেয়ে শুধালো,
—-“উঠে পরেছেন?”
স্পর্শ আয়নার সামনে থেকে সরে এলো।জেরিন উঠে বসে এলো মেলো চুল গুলো খোপা করে নেয়।স্পর্শ শান্ত ভাবে বলে,
—-“দশটায় মিটিং আছে তাই অফিস যাচ্ছি।আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই বিরক্ত করলাম না।এমনিতে ও কাল রাতে আপনি সেই যে গেলেন আমার খাওয়ার পর ও এলেন না।আপনাকে খুজতে ড্রয়িংরুম এসে দেখি সোফায় শুয়ে আছে।দুঃখিত,অনুমতি ছাড়াই আপনাকে কোলে তুলে রুমে এনেছি।”
জেরিন লজ্জায় মাথা নামিয়ে বলে,
—-“আসলে নাটক দেখছিলাম। কখন যে চোখ লেগে গেছে জানি না।”
স্পর্শ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
—-“ফ্রেশ হয়ে আসুন খিদে পেয়েছে।”
জেরিন দ্রুত উঠে যায়।ফ্রেশ হয়ে দুজনেই নাস্তার উদ্দেশ্যে গেলো।স্পর্শের মৃদু কাশির শব্দে সবাই পিছনে তাকাল।অফিসের ফর্মাল পোশাকে যথেষ্ট সুদর্শন লাগছে।সবাই বেশ মোহিত চোখে তাকাল।স্পর্শ হাসার চেষ্টা করে একটা চেয়ার টেনে বসে।জেরিন ও পাশের চেয়ারে বসে।সেলিনা দুজনকে হেসে নাস্তা দিলো।জেসমিন স্পর্শের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলেন,
—-“আমি জেরিনের মেঝো আন্টি।গত কাল আমার সাথে দেখা হয়নি তোমাদের।আমি একটু রাত করেই এসে ছিলাম।”
স্পর্শ মৃদু হেসে বলে,
—-“অবশ্য জেরি আমাকে বলেছিল সবার কথা।”
“জেরি” নামটা শুনেই অদ্ভুত চোখে তাকাল সবাই।জেরিন ঠোঁট কামড়ে বলে,
—-“আপনার লেট হয়ে যাচ্ছে।”
স্পর্শ হাল্কা হেসে নাস্তা শুরু করে।সবার চোখ এড়ালেও লতিফ সাহেবের চোখ এড়ালো না ” আপনি” শব্দটা।সুর তুলে বলেন,
—-“প্রেম করে বিয়ে করে ও আপনি করে বলছিস।আসল কাহিনী কী?”
লতিফ সাহেবের কথায় দুজনেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরে।কয়েক সেকেন্ড ভেবে জেরিন বলে,
—-“আমি যখন যেটা ভালো লাগে বলি।”
স্পর্শ পাশ থেকে বলে,
—-“জেরিনের কাছে আপনি শব্দটা হচ্ছে, শ্রদ্ধা এবং পরম ভালবাসার।আমার প্রতি ভালবাসা বাড়লেই আপনি করে বলে।”
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব১২
পরিবেশটা নিশ্চুপ একদম।রান্না ঘরে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। নাজমুন বেগম গম্ভীর মুখে খুন্তি নাড়ছেন।সেলিনা প্লেট সাজিয়ে রাখছে ডাইনিং টেবিলে।কাজের মেয়েটা কাটা কাটি করে দিচ্ছে।নিশ্চুপ পরিবেশে জেসমিন পানি খেতে ফ্রিজ থেকে বোতল বেড় করে মৃদু গলায় বলে,
—-“জেরিন কোথায় সেলি?”
সেলিনা প্লেট আস্তে করে উল্টে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
—-“আছে হয়তো রুমে না হয় বারান্দায়।”
জেসমিন বোতল থেকে কয়েক ঢোগ পানি খেয়ে আস্তে করে ফ্রিজে রেখে দিলো।ঝলঝল চাহনি নিয়ে টেবিলের কাছে এসে বলেন,
—-“স্পর্শ জেরিন কে বেশ সম্মান আর ভালবাসে।”
জেসমিনের কথায় রান্না ঘর থেকে তাচ্ছিল্য হেসে নাজমুন বেগম বলেন,
—-“ভালবাসা না ছাই! হাসানের মতো ছেলেকে ধরে রাখতে পারলো না বার ভালবাসা?”
নাজমুন বেগমের কথায় জেসমিন স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে বলেন,
—–“নাজমুন তুই মা হয়ে এমন কথা বলতে পারলি?স্পর্শের মতো নামি ধনি ছেলে যদি তোর মেয়ের স্বামী হয় বা অন্য কারো, তাহলে হাসানের মতো অসভ্য ছেলের স্ত্রী কে হতে চাইবে?”
নাজমুন বেগম বেশ শক্ত গলায় বলেন,
—-“একদিনে কোন কচু বুঝা যায়?এইসব ঢং না সত্য কে জানে! জেরিনের মতো বেয়াদব মেয়েকে নামি দামি মানুষ বউ করবে কল্পনার ও বাইরে।”
সেলিনা হাতের শেষ প্লেট রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা উঁচু গলায় বলেন,
—-“দেখ নাজমুন, কাল রাত থেকে এই অব্দি যতটুকু দেখলাম আমার কিন্তু স্পর্শ কে মিথ্যে মনে হয়নি।যা সত্যি তাই বলছি! আর জসীম ভাই যেখানে প্রথম দেখেই বলেছেন স্পর্শ মেহরাব নাম করা বিসনেস ম্যান,সেখানে আমাদের তর্ক বা সন্দেহ করা উচিত না।তুই আমার ক্লাস মেট হলেও সম্পর্কে আমি বড়। তাই এইটুকু আমি বলতেই পারি।”
নাজমুন বেগম কিছু বলার উদ্বেগ নিতেই জেসমিন ধিক্কার জানিয়ে বলেন,
—-“শুন আমার একটা মেয়ে নেই বলে আমি জানি একটা মেয়েকে বউ সাজিয়ে পাঠানো কত বড় স্বপ্ন।শুধু নিজেকে উপরে রাখতে যেয়ে তুই জেরিনকে অবহেলা করছিস। আর কিছুই বলার নেই আমার।”
.
.
.
.
অফিসের সব মিটিং শেষ করে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্পর্শ। সাদ সব ফাইন সাবধানে গুছিয়ে নিচ্ছে।হাত ঘড়িতে সময় দেখে স্পর্শ ৫ঃ১৫ বাজে।কপালে ভাজ ফেলে স্পর্শ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চেয়ারের গায়ে থাকা কোট হাতে তুলে কেবিনের দরজা পেরিয়ে গেলো।সাদ পাশে পাশেই হাটছে।কিছুটা আগ্রহ নিয়ে মৃদু গলায় সাদ প্রশ্ন করে,
—-“স্যার এখন বাসায় যাচ্ছেন?”
স্পর্শ হাটতে হাটতে উত্তর দিলো,
—-“হ্যা সাদ।”
—-“কোন বাসায় স্যার?”
সাদের প্রশ্নে গাড়ির কাছে এসে পা থামলো।কিছুটা অপ্রস্তুত চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।গাড়িতে বসতে বসতে বলে,
—-“তুমি ভালো করেই জানো কোথায় যাচ্ছি।এ’বিষয়ে বাড়িতে কথা হওয়া চাই না।তোমার সাথে কাল কথা হবে।”
সাদ দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলে,
—-“যাওয়ার সময় পারলে ম্যাডামের জন্য ফুল বা চকলেট নিয়ে যাবেন স্যার।”
স্পর্শ শুধু হাসলো।ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতেই ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল সে।আজ ক্লান্ত কম মনে হচ্ছে।অফিস থেকে জেরিনদের বাসা প্রায় আধা ঘন্টার রাস্তা।অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, স্পর্শের কেরিয়ারের এত বছরে জেরিনকে দেখেনি সে।এই বাড়ির সামনে অনেক বার এসে ছিল স্পর্শ।মৃদু জ্যামে গাড়ির কাচে শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো বাইরে।কাচ নামাতেই একটা কম বয়সী ছেলে বলে,
—-“স্যার,স্যার ম্যাডামের জন্য ফুল গুলো নিয়ে যান।অনেক খুশি হবে।”
স্পর্শ হাতে থাকা একগুচ্ছ গোলাপের দিকে তাকালো।হুট করেই চোখের সামনে ভেসে উঠে জেরিনের ঘুমন্ত মুখ।ঠোঁট টিপে মৃদু হেসে ফুল গুলো নিলো সে।ছেলেটা এক গাল হাসি দিয়ে চলে গেলো।ফুল গুলো আপন মনে দেখতে লাগে স্পর্শ। জীবনে কেরিয়ার নিয়ে পরে থাকা ছেলেটাও যে কারো জন্য ফুল কিনবে একদম ভাবনার বাইরে।শুভ সব সময় বলতো “তুই আমার ভাই হলেও একদম আন রোমান্টিক।তোকে মেয়েরা পছন্দ করলেও তুই কাউকে মন দিতে পারবি না” কথাটা ভাবতেই স্পর্শ নিঃশব্দে হেসে দিলো।
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে গেলো স্পর্শ। আর বলে দিলো ড্রাইভার কে “এ’বাড়িতে আমি আছি বাবাকে বলতে হবে না।” ড্রাইভার সম্মতি দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।গেটের ভিতর পা রেখে ফাল ফুলিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বলে,
—-“স্পর্শ মেহরাব,ওয়েলকাম টু দ্যা শ্বশুর বাড়ি।”
দরজায় বেল বাজতেই জেরিন খুলে দিলো।স্পর্শ মোহিত চাহনিতে তাকিয়ে শুধালো,
—-“ভালো আছেন জেরি?”
জেরিন কয়েকে সেকেন্ড থম মেরে থেকে হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“জ্বি, আপনি ভালো আছেন?”
স্পর্শ হেসে সম্মতি দিলো।হঠাৎ জেরিনের নিজেকে খুব বোকা মনে হলো।কি সব বলছে সে?এখন কি কেমন আছেন,কি খবর জানার সময়?জেরিন দ্রুত স্পর্শের হাত থেকে কোট কেড়ে নিলো।স্পর্শ সেদিকে তেমন চোখ দিলো না।ড্রয়িংরুম পা দিতেই সোফায় বসে জসীম সাহেব উকি দিলেন পত্রিকার ফাকে।দরজা লাগিয়ে জেরিন সামনে ফিরতেই একগুচ্ছ গোলাপ দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো।ফুলের দিকে তাকিয়ে স্পর্শের দিকে তাকায়।স্পর্শ বেশ শান্ত গলায় বলে,
—-“ফুল গুলো দেখে আপনার ঘুমন্ত মুখ ভেসে উঠে তাই নিয়ে এলাম।আর একটা জিনিস ও আছে তবে রুমে দিবো না হয়?”
জেরিন অপ্রস্তুত এবং বিস্ময় নিয়ে মাথা দুলিয়ে ফুল গুলো হাতে নিলো।স্পর্শ হঠাৎ কি মনে করে জেরিনের চুলে হাত চালিয়ে রুমে চলে গেলো।জেরিন মৃদু বিস্ময় নিয়ে হাসলো।জসীম সাহেব এই দৃশ্য দেখে দ্রুত চোখে নামিয়ে নিলেন।মেয়ে এবং মেয়ে জামাইয়ের রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে বেশ নড়েচড়ে বসেন।নাজমুন বেগম চায়ের কাপ হাতে রান্না ঘর থেকে নিজে রুমে যাচ্ছিলেন।এমন দৃশ্য দেখে তিনি নিজেও লজ্জিত হয়ে একা হাসলেন।
___________________________
রাতের খাওয়া শেষে সবাই বসার ঘরে বসে আছে।স্পর্শ জসীম সাহেবের পাশেই বসে আছে।লতিফ সাহেব টিভিতে সংবাদ দেখছেন।নাজমুন বেগম খাওয়ার পর সবাইকে মিষ্টি দিয়ে সবে বসলেন।জসীম সাহেব বেশ চাপা আগ্রহ নিয়ে বলেন,
—-“তোমার অফিসের কাজ কেমন যাচ্ছে?মেহরাব গ্রুপে সম্ভবত বড় প্রজেক্ট এসেছে শুনলাম?”
স্পর্শ নম্রভাবে বলে,
—-“জ্বি সেটা বাবার কম্পানিতে। ”
জসীম সাহেব ভ্রু উঁচিয়ে বলেন,
—-“বাবার মানে? তোমার কম্পানি নেই? ”
—-“ভাইয়া এবং বাবা মেহরাব গ্রুপের মালিক। সেটা পুরোই উনাদের।স্পর্শ ফ্যাশন হাউজ এবং মেহরাব ওয়াল্ড আমার নিজস্ব। দুটোই এক সাথে। ”
জসীম সাহেব এবং নাজমুন বেগম অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না।জসীম সাহেব আরো কিছু বলতে লাগে। কিন্তু সেদিকে স্পর্শের বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই।চোখের সামনে সাদা আর আকাশি রঙের সেলওয়ার -কামিজ পরিহিত জেরিনকে দেখে স্তব্ধ স্পর্শ। কোমর ছুঁয়ে যাওয়া লম্বা চুল গুলো শক্ত হাতে খোপা করে ডাইনিং টেবিলে পানি খাচ্ছে জেরিন।সোফায় বসে এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো স্পর্শ। কালো টাউজারের পকেটে এক হাত রেখে আকাশি রঙা টি- শার্ট টেনে উঠে দাঁড়াল স্পর্শ। দৃষ্টি জেরিনের উপর রেখে নিচুস্বরে বলে,
—-“স্যার আমি রুমে যাচ্ছি।সবাইকে শুভ রাত্রি।”
স্পর্শ হাসার চেষ্টা করে রুমের দিকে পা দেয়।সেলিনা এমন দৃশ্য লক্ষ্য করে দুষ্টুমি করে বলেন,
—-“ছেলেটা দেখছি জেরিন কে চোখে হারায়।”
নাজমুন বেগম সেদিকে একবার তাকিয়ে বিরবির করে বলেন,
—-“ওদের মাঝে কী সত্যি সম্পর্ক আছে?”
.
.
.
.
বিছানা ঝেরে পরিষ্কার করল জেরিন।সাইড টেবিলে জগ ভরে পানি এবং ক্লাস সচেতন হাতে রাখে।নিঃশব্দে পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে স্পর্শ। অদ্ভুত ভাবে জেরিনের হার্টবিট বেড়ে গেলো।ডিপডিপ করে চলতে লাগে হৃদস্পন্দন। কম্পিত বুক নিয়ে পাশ ফিরে দরজায় চোখ দিতেই স্নিগ্ধকর স্পর্শের হাস্যউজ্জ্বল মুখ দেখতে পেলো।চোখে অদ্ভুত ঝলঝলে চাহনি।লজ্জায় জেরিনের পলক ঝুকে গেলো।স্পর্শ এক পা এক পা করে সামনে এসে মৃদু শিতল গলায় বলে,
—-“আপনি কি সব সময় চোখ নামিয়ে নেন লজ্জা পেলে?”
জেরিন লজ্জিত গলায় বলে,
—-“কই নাতো! ”
স্পর্শ একদম কাছে এসে দাঁড়ায়।দুজনের মাঝে চার আঙুল দুরত্ব রেখেছে শুধু।জেরিনের শরীর মৃদু কেপে উঠে।বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে এক দল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে দুজনকে।স্পর্শ একদম শান্ত কন্ঠে বলে,
—-“ভাইয়া বলতো, আমি কোনো মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারবো না।শুধু কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত জীবন। তুমি জানো,সেই ব্যস্ত ছেলেটে আজ তোমার জন্য গোলাল এনেছে।সমাজে তোমার মাথা উঁচু করতে আর একটা জিনিস এনেছে।”
জেরিন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।টাউজারের পকেট থেকে মেরুন রঙের ছোট্ট একটা বক্স চোখের সামনে ধরলো।বিস্ময় নিয়ে বক্সের দিকে তাকায় জেরিন।স্পর্শ হাতে তুলে দিয়ে বলে,
—-“আশা করছি পছন্দ হবে।”
জেরিন ভ্রু কুঁচকে ধির হাতে বক্স খুলে।চিকচিক করতে থাকা পাথর চোখে পরছে।ভালো করে দেখতেই বুঝে গেলো ডায়মন্ডের নোস পিন এটা।অবাক হয়ে জেরিন বলে,
—-“নোস পিন কেনো?এতো দাম দিয়ে কেনার তো…”
স্পর্শ মুখে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলো।মৃদু গলায় বলে,
—-“সমাজ এবং পরিনার মানে স্বামী কে নোস পিন দিতে হয়।এটাই বিবাহিত জীবনের একটা বিশেষ পার্ট।তবে এটা আমি নিজের পছন্দ থেকে দিচ্ছি।আপনাকে আর একটু মুগ্ধ হয়ে দেখতে চাওয়া আমি।”
চলবে…
চলবে