#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩০)
মহসীন চোখ বন্ধ করে দম আটকে বললো,,
“” আমি কখনোই জন্মদাতা হতে পারবো না।””
মহসীনের কথাটা ঠিক কোথায় গিয়ে মোচড় কেটেছে তা উপলব্ধী করতে পারছেনা মিন্মি। সন্দিগ্ধ চোখদুটো মহসীনের চওড়া পিঠেই একধারে পড়ে আছে। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে,সে মহসীনের বাহ্যিক নয় ভেতরে অতলে লুকিয়ে থাকা কষ্টদায়ক শিখাটা ঠিক কতটা উত্তাপে জ্বলছে তা স্পষ্ট আঁখিবরণ করছে। নিরবতার পাতলা চাদরটা দুজনের উপরেই পড়েছে। এই মুহুর্তে কি বললে মহসীনের বুকের যন্ত্রণাটা কমাতে পারবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা মিন্মি। তবে মন তার সর্বোৎকৃষ্ট কিছু আউড়াতে চাচ্ছে। নিরবতার চাদরটা মহসীনই তুললো,,
“”আমি প্রথম দেখাই রিপ্তির প্রেমে পড়েছিলাম। আসলে প্রেম বললে ভুল হবে। হতে পারে রিপ্তি কিশোরী কিন্তু আমি নই। তাই আমার জন্যে প্রেমবাক্যটা ব্যবহার করাটা বেমানান। সেসূত্রে শুদ্ধ করে বললে হবে,প্রথম দেখায় আমি রিপ্তিকে বউ হিসেবে কল্পনা করেছিলাম। কিন্তু ওর বাচ্চামী আচরণে আমি পিছিয়ে গেলেও আমার মন? সে তো শতগুনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার পথ ধরেই প্রথম ভুলটা করি। যেহেতু আমি একজন শিক্ষক তার উপর রিপ্তির থেকে বয়সে অনেকটাই বড় তাই নিজ থেকে ওর কাছে যেতে পারছিলাম না। বারংবার বিবেকের কাছে বাধা পাচ্ছিলাম। আর এই বাধা পেরিয়ে ইচ্ছে করেই রিপ্তির খাতায় লাল কালি ঢেলে দিলাম। যেমন ভেবেছিলাম তেমনি হলো। রিপ্তি দৌড়ে আমার কাছে হাজির। প্রাইভেট পড়বে। ওর সরলতা দেখে সেদিনই মনে মনে ভেবেছিলাম,এই মেয়েটাকে আমার চাই। ভাগ্যের সুফলতায় নিজের কাটা ছকে যখন আমি পরিপূর্ণ তখনি আমার সুখের স্বপ্নে কাঁটা পড়লো। ইউনিভার্সিটির এক শ্রদ্ধেয় স্যারের সহায়তায় স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। তার জন্য আমাকে মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। সেখানের এক সুক্ষসূত্র ধরে জানতে পারি আমার সন্তান জন্ম দেওয়ায় অক্ষমতার বিষয়টা। ভেঙে পড়েছিলাম আমি। এতোটাই যে রিপ্তির সামনে যাওয়ার ইচ্ছেশক্তিটাও পাচ্ছিলাম না। অথচ তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম,রিপ্তির বাসায় বিয়ের কথা বলবো। কিন্তু কে জানতো,আমার সুখের সাগরে এভাবে সুনামী আসবে? না সহ্য করতে পারছিলাম না এড়িয়ে যেতে পারছিলাম। এই ব্যাপারটা নিয়ে যে রিপ্তির সাথে আলোচনায় বসবো সেরকম জ্ঞানবোধটা রিপ্তির মধ্যে তৈরীই হয়নি। সংসার,স্বামী,বাচ্চা এই শব্দগুলো হয়তো ও শুনেছে কিন্তু এর গাম্ভীর্য বুঝার বোধশক্তি কি আদৌ ওর মধ্যে তৈরী হয়েছিলো? রিপ্তির চোখে,মুখে,মস্তিষ্কে তখন শুধুই আমি। আমি এটা নিশ্চিত ছিলাম যে,আমার অক্ষমতার কথাটা পারলে হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু আমি তো ওর মতো অবুঝ ছিলাম না। নিজে জেনেশুনে কি করে ওর ভবিষ্যতের সাথে নিজেকে জড়াতাম? কি করে পারতাম মাতৃত্বের স্বাদ কেড়ে নিতে? এখন নাহয় অবুঝ কিন্তু যখন বুঝের হবে তখন? তখন যদি আমাকে দোষী বানিয়ে দেয়? বাকি জীবনটা তো মাথা নত করে থাকতে হতো। হয়তো রিপ্তিও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিতো। কিন্তু মনের ভেতর আমাকে নিয়ে অজানা কালো দাগের ক্ষত সহ্য করতো ঠিকই। তাই সেদিন রিপ্তিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। বড্ড খারাপভাবেই। ফিরিয়ে দেওয়াটা আরো সুন্দর হতে পারতো। মন চেয়েওছিলো কিন্তু মনে হয়েছিলো আমি নরম আচরণ করলে ও জেদ ধরবে যেটাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারব না। আর সব থেকে বড় কথা,রিপ্তির এমন একটা ধাক্কার প্রয়োজন ছিলো যেটা আমাকে ভুলতে সাহায্য করবে। আমি সেই উদ্দেশ্যেই ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছিলাম। তার ঠিক চারদিন পড়েই আমার বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ফ্লাইট ছিলো। রিপ্তিকে ছাড়া এখানে থাকাটা আমার জন্য অসহনীয় হয়ে পড়েছিলো। তাই যতটা পেরেছি নিজেকে সংযত করে সবকিছু গুছিয়ে বাংলাদেশ থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। এয়ারপোর্টে ঢুকতেই আমার মন বেকে বসলো। মনে হলো,অপেক্ষা করি,রিপ্তির বড় হওয়ার অপেক্ষা। ঠিক ততটাই বড়,যে বড় হওয়ায় নির্দ্বিধায় নিজের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। হ্যা অপেক্ষাটা দীর্ঘায়িত হবে। কিন্তু এর ফল যদি সুমিষ্ট হয় তাহলে? এক অতি নগন্য আশার আলো নিয়েই আমি আমার নিজ ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে থেকে যায়। মন তো চেয়েছে বারবার,রিপ্তির কাছে ছুটে যায়। কিন্তু অদূরভবিষ্যৎ ঠিক কি হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো অনুমানশক্তিই আমার ছিলো না। নতুন করে রিপ্তির সাথে জড়ানোর পর যদি ও আমাকে ফিরিয়ে দেয়? আমি নাহয় নিজেকে সামলাতে পারবো কিন্তু রিপ্তি? ও যে বড্ড বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। এমন পীড়াদায়ক মুহুর্তটা ওর সামনে তুলে ধরতে চায়নি। তাই দুরে থাকা। ভেবেছিলাম,এমন সময় ওর সামনে দাড়াবো যখন কোনো মায়া,সহানুভূতি,আবেগ থেকে নয় একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমত্তা,ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা থেকে আমাকে গ্রহণ অথবা বর্জন করবে।””
মহসীন একটানা কথাগুলো বলে দম ফেললো। বড় নিশ্বাস নিয়ে গলা ভেজাতে ব্যস্ত হতেই মিন্মির উৎকন্ঠিত সুর,,
“” তাহলে আসেন নি কেন?””
মহসীন কয়েকবার ঢোক গিলেও গলাটা ভেজাতে পারেনি। তাই পানি খেতে বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলের দিকে এগোয়। পানিভর্তি জগটি নিয়ে শূন্যগ্লাস ভরতে ভরতে বললো,,
“” গিয়েছিলাম।””
মিন্মির উত্তেজনাপূর্ণ কন্ঠ,,
“” রিপ্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলো?””
মহসীন চোখ তুলে তাকালো কৌতুহলী মিন্মির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না। পানি পান করছে। গ্লাসটা আগের মতো শূন্য করে টেবিলে রেখে বললো,,
“” বলার সময়,সুযোগ, পরিবেশ কোনোটাই পাইনি।””
মিন্মি মহসীনের কাছে এসে উদ্বেগিকন্ঠে বললো,,
“” কেন?””
মহসীন ম্লান হেঁসে বললো,,
“” রিপ্তি তখন অনুভবের মাঝে ডুবেছিলো। ঠিক ততটাই অতলে যেটা আপনাকে বলতে পারবো না। তবে এতটুকু জেনে রাখুন,রিপ্তি আর অনুভবের করা ভুলটা আপনাদের বাড়ীতেই হয়েছে। যার একমাত্র চক্ষুসাক্ষী আমি নিজে!””
মুহুর্তেই মিন্মির শরীর বরফজমা অবস্থা। সাথে কন্ঠটাও কি কঠিন পদার্থে আটকে গেলো? মহসীনের না বলা কথাটা যেন অদৃশ্য আয়নায় ভেসে উঠেছে তার চোখে।
মহসীন চাপা কন্ঠে বললো,,
“” এটা আমার সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য বুঝতে পারছিনা। পৃথিবীতে হয়তো আমিই প্রথম মানব,যার মাথার উপর কোনো সম্পর্কের ছায়া ছিলো না আর কখনো হবেওনা! একা একা পৃথিবীকে ভোগ করে মাটির নিচে ঠাঁই নিবো একজন অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে!””
“” আপনি চাইলেই তো সম্পূর্ণ হতে পারেন।””
মিন্মির আকস্মিক কথায় মহসীন খানিকটা থমকে গেলো। মিন্মির দিকে পূর্ণদৃষ্টি। ও ঠিক কি বুঝাতে চাচ্ছে তাই বুঝার চেষ্টা করছে। মহসীনের কষ্টটাকে হ্রাস করে মিন্মির বিনয়বাণী,,,
“” যে জিনিসটার অভাবে আপনি নিজেকে অসম্পূর্ণ,ত্রুটিপূর্ণ মানুষ ভাবছেন,ঠিক সেই জিনিসটা নিয়েই তো রিপ্তি আজ আপনার দুয়ারে। যেটা তার জন্য অতিরিক্ত। তাহলে দুজন মিলে যোজন-বিয়োজন করে একটি সম্পূর্ণ সংসার সাজিয়ে নিচ্ছেন না কেন?””
মহসীন বসা থেকে উঠে পড়লো। তার মৌনতা দেখে মিন্মিই উৎসাহ নিয়ে বললো,,
“” রিপ্তির সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রয়োজন,সাথে আপনাকেও। আর আপনার সন্তান প্রয়োজন সাথে রিপ্তিকেও। আপনারা দুজনই যেহেতু একে অপরের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন তাহলে এখনো কেন বিনা সম্পর্কে দুরত্বতা বাড়িয়ে চলছেন? একটি বিবাহ যদি আপনাদের অপ্রকাশিত ভালোবাসাটাকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করার সুযোগ দেয় তাহলে কি সেটা করে নেওয়া উত্তম নয়? হয়তো এটাই সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য যার প্রতিফলিত ঘটাতেই রিপ্তি আবারও আপনার নিকটে এসেছে।””
মিন্মি আরো কিছু বলবে তার আগেই মহসীন দুদিকে মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে উদাসগলায় বললো,,
“” না। আমার সৃষ্টিকর্তা কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই রিপ্তিকে আমার সামনে হাজির করেছে সেটা আমি মানছি। কিন্তু আমার মন বলছে সেটা অন্যকিছু।””
মিন্মির সন্দেহীগলা,,
“” অন্যকিছু? সেটা কি?””
মহসীন আগের ন্যায় বিছানায় বসে পড়লো। ভাবুক কন্ঠে বললো,,
“”আমার জানা নেই!””
~~~
কলিংবেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। দরজার আড়াল থেকে রিপ্তির লাজুক মুখ দেখে মহসীনের সন্দেহিদৃষ্টি। মিন্মি আসার পর দরজাতো দুর ড্রয়িংরুমেও রিপ্তির দেখা মেলেনা। কড়া যত্নে আছে সে। আজ হঠাৎ রুম ছেড়ে দরজায়? তাও এমন লজ্জাবতী সেজে। ব্যাপার কি! বেল পড়ার সাথে সাথে দরজা খুলেছে মানে সে দরজার কাছেই দাড়িয়ে ছিলো। এমন নয় তো সে মহসীনের জন্য অপেক্ষায় ছিলো?
মহসীনের ভাবনামাঝেই সম্পূর্ণ দরজাটা খোলে ফেলে রিপ্তি। তার ভাবনার সুতো কাটতে একটু উচুগলায় বললো,,
“” আজ কি বাইরেই থাকবে? ভাবীকে বলবো খাবার আর কাঁথা-বালিশ বাইরে রেখে দিতে?””
মহসীনের চোখদুটো আগেও রিপ্তির উপরে ছিলো এখনো তাই। তবে আগেরটা ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলো আর এখন? মুগ্ধতায়। চমকানোর পর্ব দ্রুত শেষ করে বললো,,
“” হঠাৎ শাড়ী?””
রিপ্তি মুখ বাকিয়ে বললো,,
“” আমি বাহিরের লোকের সাথে কথা বলিনা। এ বাড়ীর কর্তার কড়া নিষেধ আছে।””
মহসীন দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়লো। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়েই রিপ্তির দিকে পুনরায় চোখ আটকালো। রিপ্তি আগের প্রশ্নের জের ধরেই জবাব দিলো,,
“” আপনার বাসায় থাকছি,খাচ্ছি তাও বিনে পয়সায়,তাই ভাবলাম একটু আপনার পছন্দে সাজা হোক। দায়ের কিছু অংশ যদি কমে!””
রিপ্তির ঠেস দেওয়া কথাটার তোয়াক্কা করছেনা মহসীন। এতোবছর পর রিপ্তিকে শাড়ীতে দেখে চোখদুটো গাঢ় তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত। হঠাৎ পেটে চোখ পড়তেই মহসীনের কন্ঠে সতর্কবাণী ফুটে উঠলো,,
“” এই সময় শাড়ী পড়া উচিত নয়। তুমি বরং…
মহসীনের কথা টেনে নিলো রিপ্তি,,
“”পেট নিয়ে শাড়ী পড়তে কষ্ট হয় দেখেই এতোদিন পড়িনি। এখন তো পড়িয়ে দেওয়ার মানুষ আছে। আমি ঠিক করেছি ভাবী যে কয়দিন থাকবে সে কয়দিন আমি শাড়ী পড়বো। কিন্তু আমি তো সঙ্গে করে শাড়ী আনি নি। এটা ভাবীর। তুমি কি আমাকে কিছু শাড়ী কিনে দিবে? কিছু না অনেকগুলো লাগবে। নিত্যদিন ভিন্নরঙের শাড়ী পড়ে তোমার…””
“” আমার মনোরঞ্জনা করবে?””
রিপ্তি ফিক করে হেঁসে বললো,,
“” অনেকটা সেরকমই! আনবে তো?””
মহসীনের দিক থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিপ্তি নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
~~~
এ মাসের আঠারো তারিখে রিপ্তির ডেলিভারীর ডেট দিয়েছে। ডেলিভারীর সময় হিসেব করে মিন্মি গ্রামে গিয়েছে। রাসেলকে অনেক কিছু বলার আছে তার। তারমধ্যে তাকে একটা দীর্ঘসময়ের জন্য রিপ্তির সাথে থাকতে হবে। ডেলিভারী থেকে শুরু করে মা ও সন্তানের দেখভালোর দায়িত্বটা যে তাকেই নিতে হবে। ততদিনের জন্য গ্রামের মধ্যে নিজের ছোট্ট সংসারটাকেও তো গুছিয়ে দিয়ে আসতে হবে। সে সব চিন্তা-ভাবনা নিয়েই পনেরো তারিখে ঢাকার ট্রেণ ধরবে বলে কথা দিয়ে গিয়েছে। এদিকে মহসীনের রাতের ঘুম গায়েব। ডেলিভারির ডেট যত এগিয়ে আসছে তত সে ছটফটে মরছে। তারমধ্যে ভাবীও নেই। রিপ্তি রুমে একা। কোনো দরকার পড়লে? ভালো-মন্দ দুর্ঘটনা ঘটে গেলে? যত সতর্কেই থাকুক তবুও দুজন তো দু’রুমে। যদি জানতে দেরি হয়ে যায়? তার একটু অসতর্কতায় বড় কিছু ঘটে যায় তাহলে? নিজের মনের অস্থিরতা কমাতে ড্রয়িং রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহসীন। রিপ্তির রুমের দরজা সম্পূর্ণ খোলা থাকবে। যাতে সে চোখ মেললেই রিপ্তিকে দেখতে পায়। অস্থিরতার মধ্যে একবার বিড়বিড় করে বলেও ফেলেছে,আমার এই দুশ্চিন্তা দুর করার জন্য হলেও তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে,রাজি নাহলে জোর করে। যাতে তোমার পাশে শোয়ার অনুমতি পাই!
মহসীন যাতে গভীর ঘুমে তলিয়ে না যায় তাই আধঘন্টা অন্তর অন্তর এলার্মের ব্যবস্থা করেছে। এলার্ম বাজলেই লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে। রিপ্তিকে ভালো করে পরখ করে আবার ঘুমায়। তার আধঘন্টা বাধেই আবার লাফিয়ে উঠে। তেমনি তৃতীয় রাতে এলার্মের শব্দে সে লাফিয়ে উঠলো। সজাগীদৃষ্টি রিপ্তির উপর রাখতেই সে মোহগ্রস্থ হলো। পুনরায় শুয়ে না পড়ে রিপ্তির রুমের দিকে এগুচ্ছে। শব্দহীন পায়ে রিপ্তির কাছে এসে দাড়ালো। রিপ্তি তখন ঘুমের শেষকক্ষে। শাড়ী পড়ে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। দরজার দিকে মুখ করা। মহসীন হাটুগেড়ে বসলো। রিপ্তির পেটে চুম্বন খেতে যাবে তখনি রিপ্তির আৎকা প্রশ্ন,,
“” কি করছো?””
মহসীন বেশ ঘাবড়ে গেলো। চোখের পলক ফেলার সময়টুকুতেই তার কপালভর্তি ঘামের অসংখ্য বিন্দুকণা। মাথা নত করে আড়ষ্টগলায় বললো,,
“” তুমি যা ভাবছো তা নয়,রজনীগন্ধা!””
রিপ্তিরও দ্রুত উত্তর,,
“” আমি যা ভাবছি তাই-ই।””
মহসীন বিনাবাক্যে মেঝেতে বসে পড়লো। শেষ সময়ে এসে লোভটাকে আটকাতে পারলাম না? কি করে বুঝাবো আমি,কোনোরকম লালসা,লোলুপতা থেকে তোমাকে স্পর্শ করতে চাইনা। তোমাকে নয়,তোমার ভেতরে বেড়ে উঠা প্রাণবিন্দুটাকে ছুতে চেয়েছিলাম!
“” বসে আছো কেন? চুমু খেয়ে বিদেয় হও। আমি ঘুমাবো!””
মহসীন চোখ তুলে তাকালো। রিপ্তি ঠোঁট টিপে হাঁসছে। তবে কি সে মহসীনের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে?
রিপ্তি নরমসুরে বললো,,
“” তোমার উপর বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস থাকলেও আমি তোমার কাছে আসতাম না,মহসীন।””
রিপ্তির কথায় মহসীনের ঠোঁটে সস্থির হাঁসি। তবে অনুমতি পাওয়ার পরেও সে কিছুক্ষণ আগে করতে চাওয়া কাজটি দ্বিতীয়বার করার সাহস পেলোনা। তখনকার মোহটা কেটে গিয়েছে এখন সে রিপ্তির মোহে ভুগছে। আর এই মোহে তাকে স্পর্শ করা মানে জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দেওয়া। মহসীন উঠে দাড়ালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিপ্তিকে খুটিয়ে দেখলো। দেখা শেষ হতেই বুক পকেটে হাত দিয়েছে। রিপ্তির ডানহাতের শাহাদাৎ অঙ্গুলিতে লিখলো,,
*তোমার পুনরায় আগমনীর কারণটা কবে সামনে আসবে,রজনীগন্ধা?*
আঙুলের লেখাগুলোতে চোখ রেখেই রিপ্তির কপালে বিরক্তির ভাজ। এই প্রথম সে বুঝদার হয়েও মহসীনের আঙুলপত্রের মানে বুঝতে পারছেনা। মানেটা জিজ্ঞেস করতে যেয়ে রিপ্তির ঠোঁট কেঁপে উঠলো তীক্ষ্ণ ব্যথায়। মহসীনের হাতটা খামচে ধরে চাপা আর্তনাদ তুললো,,
“” ভাবীকে আসতে বলো,জলদি!””
~~~
রিপ্তির পুত্র সন্তান হয়েছে। মা,ছেলে দুজনেই সুস্থ। মহসীনের কাতরমাখা দোয়া কবুল হয়েছে বলেই হয়তো নতুন কোনো বিপদের আঁচ পড়েনি তাদের উপর। মিন্মি হাসপাতালে পৌছুলো দুপুরে। সাথে রাসেলও এসেছে।
হাসপাতালের বিল,নানারকম নিয়মকানুন শেষে দুদিন পর রিপ্তিকে ছুটি দিলো। এই দুদিনে একটিবারের জন্যও রিপ্তির সামনে যায়নি মহসীন। অথচ চব্বিশঘন্টায় সে তার কক্ষের সামনেই পায়চারী করেছে। নাওয়া,খাওয়া সব ভুলেই গিয়েছে। বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটালের গেট পার হতেই মহসীনকে দেখতে পেলো রিপ্তি।
“” আমার বাবুকে ছুয়ে দেখবেনা?””
মহসীন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,,
“”যে দুরে চলে যাবে তাকে ছুয়ে আর মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?””
রিপ্তি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,,
“” চলো।””
গাড়ী থেকে নামার পূর্বে নাড়ী ছিড়ে বের হয়ে আসা পুত্রটিকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিপ্তি। ছলছল নয়নে নরম কপালে নরম চুমু খেলো। ঝাপসা চোখেই তাকালো নিজের হাতের কাগজটির দিকে। আরেকবার পড়ে নিলো,,
*অপ্রিয় লাল ব্যাঙ,
আপনার নাম লাল ব্যাঙ নয়,বিষাক্ত ব্যাঙ রাখা উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আপনাকে আশেপাশে দেখলেই নিজেকে সাবধানি করতে পারতাম। লুকিয়ে থাকতাম অথবা পালিয়ে বেড়াতাম! সামান্য নামে ভুল হওয়ায় আপনার বিষাক্ত কথা,বিষাক্ত উপস্থিতি,বিষাক্ত আচরণ পরিশেষে বিষাক্ত ছোয়াটাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। যার ফলস্বরূপ,একটা বছর আমাকে আপনার বিষ নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে,মানুষের দুয়ারে দুয়ারে খটখট করতে হয়েছে,হারাতে হয়েছে নিজের প্রিয় মানুষ ও তাদের ভালোবাসা!
সেদিনের সন্ধ্যের কথা মনে আছে আপনার? বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যের কথা? যাকে আপনি ‘ভালোবাসায় ভেজা সন্ধ্যে’ নাম দিয়েছিলেন? আমিও কি বোকা আপনার রসালো বাক্যে সব হারিয়ে ভুলপথে হারিয়ে গেলাম। আসলে সেটা ভালোবাসায় ভেজা নয়,অশ্রুতে ভেজা ভুল সন্ধ্যে ছিলো। আমার জীবনের চরম ভুল। যার গ্লানি আমাকে আরো কত বছর বয়তে হবে আমি জানিনা। কিন্তু বয়তে হবে তো?
আচ্ছা,আমি এটাকে ভুল বলছি কেন? আসলেই কি ভুল ছিলো? ভুল তো না বুঝে করে কিন্তু আমরা? আমরা তো সজ্ঞানে সব করেছি। তুমি মানো বা না মানো,আমি এটা বিশ্বাস করে ফেলেছি,মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতিটা অচেতনে করা সম্ভব নয়,যদি না সে নিজ থেকে অচেতন হতে চায়। যার মানে আমরা দুজনই সজ্ঞানে,বুঝে শুনে এতবড় একটা অন্যায় করেছি,যারফল তোমার সামনে। অন্যায় যেহেতু দুজন করেছি শাস্তিতো দুজনেরই পাওয়া উচিত তাইনা? অবৈধ মিলনে নর-নারী উভয়ে সুখটা অনুভব করেছে মানে উভয়েই ভুল করেছে। তাহলে সেই ভুলের ভোগান্তি সবসময় মেয়েদেরকেই করতে হয় কেন? মেয়েদের মন নরম বলে? মায়াই ভরপুর বলে? হয়তো তাই হবে। কিন্তু আমি সেসব মেয়েদের মতো মহান হতে পারছি না। নিজের জীবন নষ্ট করে তোমাকে সুখী হতে দিতে পারছি না। এতোদিন ওকে পেটে নিয়ে আমি মাশুল গুনেছি এবার তোমার পালা। খুনী হতে পারিনি,আর ভালো মাও হতে পারব না। তোমার সম্পদ তোমাকে দিয়ে গেলাম,এখন ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিবে নাকি অন্য কোথাও ফেলে আসবে সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। আমি আমার সকল দায়-দায়িত্ব তুলে নিলাম।
ইতি
কঠিন মনের মেয়ে
খয়েরি রঙের গেটটার সামনে দাড়িয়ে আছে রিপ্তি। ছেলেকে আরো কিছুক্ষণ প্রাণভরে দেখে অসংখ্য চুমু আকলো ঘুমন্ত মুখটিতে। চোখের পানি মুছে গেটে কড়াঘাত করতেই দাড়োয়ান মাথা বের করলো। কোনো রকম কথারবার্তায় না গিয়ে সরাসরি বাচ্চারিকে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সাথে চিঠিটা দিয়ে বললো,,
“” উপহারটা অনুভবের জন্য। চিঠিটা তার হাতেই দিবেন।””
চলবে
[আজকের পর্বটা অনেকের কাছেই খারাপ লাগতে পারে। তাই আগে থেকেই দুঃখিত😥]অপেক্ষা করেন শেষ হলে একেবারে পোস্ট করে দেবো