#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ১২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
—”শুভ্রতা আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলবো বলে দিচ্ছি।”
কথাটা বলার খানিকটা সময় পর বিকট একটা শব্দ কানে আসতেই দরজার দিকে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখলাম আদ্র রুমের দরজা ভেঙে ভিতরে এসেছেন। আমাকে এভাবে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে অস্থির হয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। আমাকে মেঝে থেকে তুলে ওনার বুকের মাঝে আগলে নিলেন। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। এইতো আমার আদ্র যে কি না আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। উনি বদলায়নি আর ওনার ভালোবাসারও রংবদলায়নি। আজ কতদিন পর ওনার বুকে মাথা রাখতে পারলাম। আদ্র আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই মুখে পানি ছিটিয়ে অস্থির কন্ঠে বার বার বলছেন-
—”শুভি প্লিজ এখন নিজেকে দূর্বল করিস না। প্লিজ শুভি আর কিছুক্ষন সহ্য কর এই মুহূর্তে ভেঙে পরিস না শুভি। দেখ আমি আছি তো তোর পাশে। আর কোনো কষ্ট পেতে দিবো না আমার শুভিকে। প্লিজ একটু নিজেকে শক্ত কর উঠে বস।”
আমি ধীরে ধীরে মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমার চোখ মুখ মুছে চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে বললেন-
—”তুই একটু বস এখানে আমি এক্ষুনি আসছি।”
আদ্র কথাটা বলেই ঝড়েরবেগে রুমের বাহিরে চলে গেলেন। মিনিটের মধ্যেই আবার চলে আসলেন। আমার কাছে এসে মেঝেতে বসে পরলেন। আমার হাতে পায়ে খুব যত্ন কিরে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন উনি। আমি কিছু বলছি না, কথা বলার মতো কোনো অবস্থা আমার নেই। মাথাটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদ্র আমাকে মলম লাগিয়ে দিয়ে হাটুর উপর ভর দিয়ে বসে আমার গাল দু’হাতে আগলে ধরে বললেন-
—”বেশি কষ্ট হচ্ছে শুভি?? একটু ধৈর্য ধর আমি সব ঠিক করে দিবো। আর কখনো কষ্ট পাবি না তুই। এখন চল আমার সাথে কিছু পেকিং করতে হবে না তোর এভাবেই আমার যাবো।”
আমি ওনার কথায় এবারও কিছু বললাম না। মাথা নিচু করেই বসে আছি আগের মতো। একটু পর পর শুধু হিচকি তুলছি এতক্ষন কান্না করার ফলে। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আদ্র আমাকে কোলে তুলে নিয়েই হাঁটা শুরু করলেন। আমি নিরব দর্শকের মতো সব দেখে যাচ্ছি কোনো আপত্তি করছি না। পা খুব বেশিই জ্বালা পোড়া করছে তাই এখন এমনিতেও আমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব না। আদ্র আমাকে ড্রয়িং রুমে এনে সোফায় বসিয়ে দিলেন। তারপর দীপ্তকে চেচিয়ে ডাক দিয়ে বললেন সবাইকে ড্রয়িংরুমে আসতে। ওনার চিৎকার শুনেই সবাই এমনিতেই চলে এসেছে। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কেমন যেন নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ। আদ্র আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে ওনার আম্মুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত গলায় বললেন-
—”আজ তুমি তোমার ছেলে একজন ব্যর্থ পুরুষ হিসেবে গণ্য করে দিলে। তাকিয়ে দেখো শুভ্রতার দিকে কি হাল হয়েছে ওর। আমিই একদিন ভালোবেসে এই মেয়েটাকে নিজের দায়িত্বে এই বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। ওর বাবা ওকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলন শুভ্রতার খেয়াল রাখতে সারাজীবন কিন্তু আমি একদিনও পারিনি এই মেয়েটার খেয়াল রাখতে। মা না থাকার পরেও এই মেয়েটা কখনো কষ্টে ছোয়া পায় নি। শুধু মাত্র ওর বাবা আর দিদুমনির আদরেই কতো ভালো ছিলো আর এখন তাকিয়ে দেখ আমি ভালোবেসে ভালো রাখার কথা দিয়েও কথা রাখতে পারলাম না। কি দোষ ছিলো ওর?? আমাকে বিয়ে করেছে এটা ওর দোষ?? যদি তা-ই হয় তাহলে আমি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি আদ্র ওর পিছনে লেগেছিলাম। আমি নিজে গিয়েছিলাম ওর বাসায় বিয়ের কথা বলতে এই মেয়ে তো কিছুই জানতো না। আর কিসের জন্য তোমার এতো আক্ষেপ?? রূপাকে নিজের ছেলের বউ করতে পারো নি বলে!!!জিজ্ঞেস করো তো রূপাকে ও আমাকে বিয়ে করতে চাইতো কি না!!”
আমি চুপচাপ সোফায় বসে মাথা নিচু করে আদ্রর বলা প্রতিটি কথা মনযোগ দিয়ে শুনছি। আর দীপ্ত আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আদ্রর কথার সাথে সাথেই রূপা বললো-
—”খালামনি আমি তো একজনকে ভালোবাসি আর আম্মুও এই কথা জানে। আর ছোটবেলায় কিসের বিয়ের কথা বলেছো সেটা যে তুমি এখনো এতটা গুরুত্ব দিচ্ছো আমরা তো জানতাম না। আর এই সামান্য একটা কারনে তুমি মেয়েটার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করতে??”
রূপার সাথে সাথে রূপার মা-ও বলে উঠলেন-
—”এটা তুমি ঠিক করনি আপা। সেই কত বছর আগে আমরা কথার ছলে কি না কি বলেছি তুমি সেটাকে এতটা সিরিয়াস ভাবে না নিলেই পারতে আপা। ছেলে মেয়ে বড় হলে ওদের আলাদা পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে তাই বলে কি আমরা জোর করে ওদের বিয়ে দিবো না-কি!! যদি ওরা একে অপরকে পছন্দ করতো তাহলে হয়তো আমাদের আপত্তি থাকতো না। কিন্তু এখন তো ব্যাপারটা একদমই আলাদা। আর আদ্র যেহেতু বিয়ে করেই ফেলেছে তাই বলে কি বউমার সাথে এমন ব্যবহার করবে তুমি??”
ওনাদের কথা শুনে আদ্রর আম্মু চুপ করে আছে কিছুই বলছেন না উনি। আদ্র এবার আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
—”তোকে কেন থাপ্পড় দিয়েছি জানিস?? তোর চুপ থাকার কারনে। বিয়ের পরের দিনই আমি তোকে বলেছিলাম আমার সাথে সব কথা শেয়ার করতে কিন্তু তুই তো কখনো আম্মুর কোনো কথাই আমাকে বলিস নি। প্রতি রাতে বাড়ি ফিরে তোর এই মিথ্যা হাসি দেখেই আমি বুঝতাম কিছু একটা হয়েছে। তাই দীপ্তর কাছে প্রতিদিনের সব কথা জেনে নিতাম। আমি তোকে বার বার সুযোগ দিয়েছি বার বার জানতে চেয়েছি তোর কিছু বলার আছে কি না কিন্তু তুই প্রতিবারই সব কথা লুকিয়ে গেলি। ওইদিন গাড়িতেও আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আর আজ আম্মু তোকে এত কিছু বলার পরেও কোনো প্রতিবাদ করিসনি এমনকি দীপ্তিকেও চুপ করে দিয়েছিস এই জন্যই তোকে থাপ্পড় দিয়েছি। তোর এভাবে চুপ থাকার জন্য এটাই তোর প্রাপ্য ছিল।”
ওনার কথায় আমি খুব চমকে গেলাম। উনি সব জানতেন বলেই আমি যখন খুব কষ্টে থাকতাম তখনই উনি এসে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। আর এই জন্য ওইদিন গাড়িতে গানটা গেয়েছিলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কিছু বলতে চাই কি না!! কিন্তু তারপর কেন আমাকে এভাবে এড়িয়ে গেছেন এতদিন??
আদ্র আমার হাত ধরে দাড় করিয়ে ওনার কাছে নিয়ে বললেন-
—”মা তুমি আর শুভ্রতাকে নিয়ে বিরক্ত হবে না আজকের পর থেকে। শুভ্রতা আর কখনো এবাসায় আসবে না চিন্তা করো না তুমি। আমি এতোদিন চুপ করে ছিলাম কারন আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো শুভ্রতাকে আবারও আগের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু আমার ধরনা ভুল তাই আজ আমি বাধ্য হচ্ছি শুভিকে নিয়ে এ বাড়ি ছাড়তে। কি করবো বলো!! আমি তো কথা দিয়েছে সারাজীবন শুভির খেয়াল রাখবো, ভালো রাখবো কিন্তু এই বাসায় থেকে শুভ্রতা কখনো ভালো থাকবে না ভিতর ভিতর কষ্টে কুড়ে কুড়ে মরবে। ভয় পেও না তোমাদের সাথে আমার সম্পর্ক ঠিকই থাকবে কারণ শুভি চায় না ওর জন্য আমাদের কারও সম্পর্ক নষ্ট হোক এই জন্যই তো চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে এসেছে এতো দিন। শেষ একটা কথা বলছি, শুভ্রতার মা নেই ও তোমাকেই মায়ের মতো দেখতো ভেবেছিল তোমার ভালোবাসা পাবে কিন্তু তুমি ওকে মায়ের মতো আগলে রাখা তো দূরের থাক ওর মা কে নিয়েই কুট কথা শুনিয়েছো। এটা কী ঠিক ছিলো!! আচ্ছা আজ আসছি আমরা ভালো থেকো।”
আদ্রর কথা গুলো শুনে আমি শুধু নিরবে চোখেরজল ফেলছি। কষ্টে নাকি আদ্রর এতো ভালোবাসা দেখে আমি জানি না। আর জানতেও চাই না কিছু কিছু জিনিস অজানাই থাক। আদ্র আমাকে এতোটা ভালোবাসে!! আমাকে নিয়ে তার এতো চিন্তা!! আদ্রর ভালোবাসার রঙ তাহলে বদলায়নি!!
আদ্র আমাকে হুট করেই সবার সামনে কোলে তুলে নিয়ে বাহিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে উনিও বসে পরলেন। বেশ কিছুক্ষন সময় ধরে আদ্র চুপচাপ ড্রাইভ করে যাচ্ছেন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নিশ্চুপে বসে কান্না করে যাচ্ছি। আজ কেন যেন আমার চোখেরজল থামতে চাইছে না। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কান্না করছি এমন সময় হঠাৎ করেই একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থাময়ে দিলেন। আমি চমকে গিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি এখনো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কেন যেন খুব ভয় করছে এখানে। এমন নির্জন জায়গায় তার উপর আবার রাত প্রায় বারোটা বাজে। আশেপাশে কোনো মানুষ, গাড়ি, বাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না চারপাশে শুধু গাছ দেখা যাচ্ছে। পুরো থমথমে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ। এমন একটা ভূতূড়ে পরিবেশ দেখে ভয়ে আমার গায়ের সব কয়টা লোম দাঁড়িয়ে গেছে। শরীরে কেমন যেন শীতল হাওয়া অনুভব করছি।
আজ এতোক্ষন ধরে ওনার সাথে কথা না বললেও এখন আর কথা না বলে পারছি না। আমি কান্না করতে করতেই ভয়াতুর কন্ঠে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
—”এখানে নিয়ে এসেছেন কেন আমাকে? আমার ভয় করছে আদ্র, আপনি প্লিজ গাড়ি চালান।”
আদ্র কিছু না বলে এখনো আগের মতোই সামনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন পর আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বললেন-
—”তোকে মেরে ফেলার জন্য। এখানে মেরে তোকে গুম করে রেখে যাবো।”
ওনার এমন শীতল কন্ঠে এই ধরনের কথা শুনে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। ভয়ের চোটে আপনা আপনিই আমার কান্না থেমে গেছে। আমি ভয়ে আমতা-আমতা করে বললাম-
—”দেখুন আদ্র এই সময় মজা করবেন না প্লিজ। আমার সত্যি সত্যিই খুব ভয় করছে।”
আদ্র আবারও আগের ভঙ্গিতেই বললেন-
—”তোর কি মনে হয় আমি এই সময় তোর সাথে মজা করবো শুভ্রতা??”
আমি ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে আবারও চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলাম। আদ্রকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি খুব স্পিডে গাড়ি চালানো শুরু করে দিলেন। ওনার এমন ব্যবহারে আমার ভয়ের পরিমান আরও হাজার গুণ বেরে যাচ্ছে। হঠাৎ করে কি হলো ওনার?? এমন ভয়ানকভাবে কথা বলছেন কেন!!
আমি কান্না থামিয়ে এখন গুটিসুটি হয়ে চুপটি মেরে বসে রইলাম। আদ্র আমার দিকে আর তাকায়নি মনোযোগ দিয়েই গাড়ি চালাচ্ছেন তবে অনেক স্পিডে। বাসায় এক রকম ব্যবহার করলেন আর এখন অন্য রকম!! ওনার এমন ব্যবহার সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
চলবে…..
(অনেক বড় করে লিখেছি আজ। গঠনমূলক মন্তব্য না করলে গল্প আবারও ছোট করে দিবো হুহহ.. মনে থাকে যেন।😒😒 ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে ❤️)