#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat
বেশ কিছুক্ষন সময় চারপাশে আঁধার নেমে বৃষ্টি আসার পর এখন রোদে চকচক করছে চারপাশ। ঠিক যেমনটা ভালোবাসার রংবদলায় তেমন। প্রায় ঘন্টা খানেক আগে আদ্র ভাইয়ের পরিবার এসেছে বিয়ের ফাইনাল কথা বলতে। সবই ঠিক ছিলো তবে আন্টির গম্ভীর মুখটা বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে তার ভালোবাসার রঙিন রঙ এখন ধূসর রঙে পরিবর্তন হয়েছে। যে মানুষটা আমাকে সব সময় নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন, দীপ্ত আর আমাকে কখনো আলাদাভাবে দেখেনি৷ সেই মানুষটা আজ আমার দিকে তাকাতেই চাইছে না।
দীপ্তর জোরাজোরিতে আদ্র ভাইয়ের সাথে একা কথা বলার জন্য ছাদে আসা। দুইজন দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি মাঝখানে দূরত্ব বেশ। আমি কোনো কথা বলছি না চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আন্টির এইরকম ব্যবহারটা কেন যেন আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ওনাকে সব সময় নিজের মায়ের মতোই দেখতাম আমি।
—”আম্মুর এমন ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছিস তাই না পিচ্চি??”
আদ্র ভাইয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি নিশ্চুপে। আদ্র ভাই আমার পাশে এসে দাড়িয়ে নরম গলায় বললেন-
—”শোন শুভি সব সময় এমন অল্পতেই মন খারাপ করলে চলবে না। নিজেকে শক্ত কর সব রকম পরিস্থিতিতে যেন নিজেকে সামলিয়ে তুলতে পারিস। সবার ভালোবাসা হয়তো সব সময় এক রকম থাকবে না এটা মেনে নিতেই হবে তোকে। আম্মু এখন রাগ করে আছে তবে কিছুদিন পর হয়তো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে এসব নিয়ে এতো চিন্তা করিস না।”
আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-
—”আপনার ভালোবাসারও কি রংবদলাবে আদ্র??”
আদ্র ভাই আমার হাত ওনার দু’হাতে মুঠোয় নিয়ে বললেন-
—”হ্যাঁ আমার ভালোবাসাও বদলাবে তবে কথা দিচ্ছি সেটা সব রঙিন হবে ধূসর কালো না। এই দেখ যেভাবে এই আকাশের ধূসর কালো মেঘ কেটে এখন এখন চারপাশ চিকচিক করছে বৃষ্টির পানিতে। ঠিক একই ভাবে আমার ভালোবাসাও রংবদলাবে।”
আদ্র ভাইয়ের কথায় মুচকি হাসলাম। মনের সব কষ্ট যেন আদ্র ভাইয়ের কথায় নিমিষেই নিমজ্জিত হয়ে গেল।
—————————
—”আব্বু এতো তাড়াতাড়ি কি বিয়ে দেওয়াটা খুব জরুরি ছিলো?? আমি বিয়ে করতে চাই না আব্বু।”
হঠাৎ খাওয়ার মাঝে আমার এমন কথায় আব্বু চমকে উঠলো। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অপলকভাবে কিছু ক্ষন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো-
—”বিয়ে কেন করবি না তুই?? আদ্রকে কি তোর পছন্দ হয়নি??”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম-
—”আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আব্বু?? আমাকে এভাবে তোমার মতো খাইয়ে দিবে কে??”
আব্বু কিছু বললেন না চুপ করে আছেন। আমি আবারও বলে উঠলাম-
—”আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না আব্বু। ছোট থেকে প্রতিটা মূহুর্তে তুমি আমার কাছে ছিলে। তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। বিয়ে হয়ে গেলে কীভাবে থাকবো আমি!!”
কথা গুলো বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আব্বু হাত থেকে প্লেট রেখে আমার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে খুব যত্ন করে।
—”মেয়েদের আজ না হোক কাল তো বিয়ে দিতেই হবে। আর তোর যখন ইচ্ছে হবে তুই চলে আসবি আমার কাছে তাহলেই তো হলো।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম-
—”আমি কখনো তোমাকে ছাড়া কোথাও থাকিনি তাহলে ওই বাসায় কিভাবে থাকবো আব্বু!! তুমি আদ্র ভাইকে না করে দাও বিয়ের জন্য”
—”আরে পাগলি মেয়ে কি বলে এইসব!! আদ্র এই কথা শুনলে তোর কি হবে ভাবতে পারছিস তুই?? আচ্ছা এখন কান্না থামা। এইরকম বাচ্চামো করলে হবে না-কি?? আর এক সপ্তাহ পরেই তো তোর বিয়ে।”
আমি চুপচাপ আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। এই মানুষটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি জানি না।
———————
চোখের পলকেই মনে হলো এই একটা সপ্তাহ চলে গেল। যেই সময়টুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম সেই সময়টুকুই দ্রুত চলে গেল। সব কিছু কেমন বলদে গেছে, আগের মতো কিছুই নেই। যে বাড়ি সব সময় হাসি আনন্দে মেতে থাকতো সেই বাড়িটাই এখন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
আব্বু এখন আর আগের মতো কথা বলে না, হাসে না বেশিরভাগই মলিন মুখে চুপচাপ বসে থাকে। আমি সামনে আসলেই মুখে হাসি ফুটে। তবে আব্বুর এই হাসির আড়ালে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট আমি দেখতে পাই। আর দিদুমনি তো আমাকে চোখে হারায়। এক মিনিটের জন্যেও আমার কাছ থেকে দূরে যায় না। ভালোবাসা যেন আগামী দশ বছরের টা এই এক সপ্তাহেই পূরণ করে দিতে চাইছে। আমি কিছু বলছি না নীরব দর্শকের মতো সব দেখে যাচ্ছি। প্রিয় মানুষ আর প্রিয় বাড়িটা ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট আমাকে ভিতর ভিতর কুড়ে খাচ্ছে।
মামার বাড়ি থেকে অনেকবার ফোন এসেছিলো তবে বিয়ের কার্ড পাঠানোর পর তারা থেমে যায়। আইয়ান একটা ফুলের তোড়া আর একটা চিরকুট লিখে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। চিরকুটে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা ছিলো-
“জোর করে পছন্দের মানুষকে পাওয়ার মতো কাপুরষ আমি না। ভালোবাসার মানুষ যেখানে ভালো থাকবে সেখানেই আমি তাকে দেখতে চাই। বিয়ের আগাম শুভেচ্ছা রইলো মায়াবিনী।”
চিরকুটটা পরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম। লোকটার বেশ বুদ্ধিমান বলতেই হয়।
—————————
—”আব্বু আজ আমি তোমার সাথে থাকি??”
আব্বু বারান্দায় বসে ছিলেন। পেছন থেকে আমার কথা শুনেই চমকে তাকালেন। বিস্ময়ের সুরে বললেন-
—”তুই এখনো ঘুমাস নি কেন শুভ্রতা। কাল তোর বিয়ে আর তুই আজ রাতে না ঘুমিয়ে জেগে আছিস!!”
আমি আব্বুর পাশে বসে মলিন কন্ঠে বললাম-
—”ঘুম আসছে না আব্বু। আজ তোমার এখানে ঘুমাই??”
—”এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে!! চল ভিতরে চল ঘুমাবি।”
আব্বু আমাকে ভিতরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমার পাশে বসেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে খুব যত্নসহকারে। আজ আমাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ হয়ে আছে পুরো রুমটা। একটু পর পর শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আব্বু হয়তো আমার সামনে দুর্বল হতে চাচ্ছে না। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। আব্বুর কাছে এটা ওটা নিয়ে বায়না করা হবে না। আব্বুর হাতে খাওয়া হবে না। সারাদিনের সব কথা আব্বুর সাথে শেয়ার করা হবে না। এইসব কিছু ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার।
—————————
তিন বার কবুল বলেই বাবার বাড়ির রাজকন্যা থেকে মেহমান হয়ে গেলাম। হ্যাঁ এই মাত্রই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেল। আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি নেই, আছে শুধু আব্বুকে ছেড়ে যাওয়ার ভয়। আদ্র ভাইয়ের মুখে শুরু থেকেই একটা তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব খুশি আমার সাথে ওনার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেছে তাই। আমিও খুশি ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে। তবে এই মুহূর্তে খুশির চেয়ে মনে চাপা কষ্টটা-ই বেশি অনুভব হচ্ছে।
কেন যেন আজ একটুও কান্না করি নি এমনকি কবুল বলার সময়ও না।
অবশেষে বিদায়ের সময় চলে এসেছে। আব্বু এতো দিন নিজেকে শক্ত রাখলেও এখন আর পারলেন না। আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখেরজল ফেলা শুরু করে দিলেন। আমিও কান্না করছি তবে নিরবে। দিদুমনি এতো দিন আমার পিছনে ঘুরঘুর করলেও বিদায়ের সময় আমার সামনেই আসলেন না। রুমে যেয়ে বসে আছেন উনি। দীপ্ত বার বার ডেকেছে তবে দিদুমনি আসতে রাজি না। উনি না-কি আমাকে বিদায় দিতে পারবেন না।
আব্বু আদ্র ভাইয়ের হাতে আমার হাত দিয়ে বললেন-
—”আমার একমাত্র সম্বল তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি কখনো কষ্ট দিও না আদ্র। আমার জান আটকে আছে শুভ্রতার মধ্যে। কখনো ওকে একা কোথাও যেতে দেইনি আজ তোমার ভরসায় সারাজীবনের জন্য শুভ্রতাকে তোমার দায়িত্বে দিলাম খেয়াল রেখো আমার শুভ্রতার। হাত জোড় করে অনুরোধ করছি।”
আদ্র ভাই আব্বুর দুহাত ধরে বললেন-
—”এভাবে বলবেন না আংকেল। আমি সারাজীবন শুভ্রতার খেয়াল রাখবো, চিন্তা করবেন না আপনি।”
আদ্র আব্বুকে নানাভাবে আশ্বাস দিয়ে আমাকে নিয়ে পাড়ি জমালেন এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথেই আমার কান্নার পরিমাণ হাজার গুণ বেরে গেল। আদ্র আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে চুপ করে আছেন। আজ আমাকে কান্না করতে বাধা দিচ্ছে না আর কোনো প্রকার সান্ত্বনাও দিচ্ছেন না উনি। হয়তো উনি চাচ্ছেন আমি আজ কান্না করি। হয়তো বুঝতে পারছেন আমার কষ্ট। কান্নাকাটি করে একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে হিচকি তুলতে তুলতেই আমি ঘুমিয়ে পরলাম।
চলবে….
(হ্যাপি রিডিং…. ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️)