#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৭
ফোনে কথা শেষ করেই কলটা কেটে দিলো সারিয়া। এখানে নেটওয়ার্কের বড়ই সমস্যা। সব অপারেটর এর নেটওয়ার্ক ঠিক মতো কাজ করে না। কিছু কিছু অপারেটর এর নেটওয়ার্ক রিসোর্ট থেকেই পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু অপারেটর এ কথা বলতে হলে পাহাড়ের ঢাল থেকে একটু নিচে নেমে আসতে হয়। আসার পর থেকে বাসায় কথা বলেনি সে। তাই সন্ধ্যার পরে মুন্নি নামে মেয়েটাকে নিয়ে পাহাড়ের ঢাল থেকে নিচে নেমে এসেছে কথা বলতে।
–এই সময় তুমি এখানে কি করছ?
নীরব পরিবেশে গম্ভীর আওয়াজের কথাটা যেন ঝমঝম করে বেজে উঠলো। চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল সারিয়া। অরন্য কে ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বিরক্ত হল। আচরনেও সেই বিরক্তির প্রকাশ ঘটাল। হেয়ালি করে বলল
–ঘরের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছিলাম। তাই বন্য প্রাণীর সাথে একটু সময় কাটাতে এসেছি।
অরন্য সারিয়ার কৌতুকপূর্ণ কথা ধরতে পারল। তবুও বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই বলল
–কাল ভুত প্রেতের কথা শুনে যত ভয় পেয়েছিলে। ভেবেছিলাম তো বাথরুমেই যেতে পারবে না দুইদিন। কিন্তু আজ তো দেখি পুরো ঘটনাই উল্টে গেছে।
সারিয়া কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকাল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–ঘটনা উল্টে গেছে মানে কি?
অরন্য আশে পাশে তাকাল। বলল
–এই নীরব পরিবেশে রাতের বেলা পাহাড়ের ঢালে একা একা চলে এলে বন্য প্রাণীর সাথে সময় কাটাতে। তোমার সাহসের প্রসংশা করতে হয়।
–একা না তো সাথে মুন্নি…।
কথাটা বলতে বলতেই পেছনে তাকিয়ে থেমে গেলো সারিয়া। তারপর অস্থির দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাল। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। এতক্ষন একা একা কথা বলছিল ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এলো তার। অরন্য এগিয়ে এসে সারিয়ার পাশে দাঁড়ালো। সারিয়া অসহায়ের মতো তার দিকে তাকাল। অরন্য ঠোট চেপে হাসছে। সামনে তাকিয়েই বলল
–বলেছিলাম না আমাকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করবে না। প্রমান হল তো।
সারিয়া সরু চোখে তাকাল। বলল
–মেয়েটা গেলো কোথায়?
–আমি এসে এখানে কাউকে দেখিনি। তোমাকে একা কথা বলতে দেখেই দাড়িয়ে গেলাম।
সারিয়া পুরোটা ঘুরে দাঁড়ালো অরন্যর দিকে। হাত গুঁজে বলল
–তার মানে আপনি আমার কথা শুনছিলেন?
অরন্য বেশ বিরক্ত হল। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এতো জোরে কথা বললে যে কেউ শুনতে পাবে। আমার এখানে কোন দোষ নেই। আমি ইচ্ছা করে শুনতে চাই নি। কানে এসেছিল তাই দাড়িয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম একা একা ভয় পাবে তাই সঙ্গ দেই। এখন দেখছি কারো উপকার করতে নেই।
বলেই অরন্য ঘুরে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। সারিয়া অরন্যকে যেতে দেখেই ঘাবড়ে গেলো। নিজের সব সংকোচ বিসর্জন দিয়ে বাচ্চাদের মতো আবেগি কণ্ঠে বলল
–এতো নিষ্ঠুর আপনি? এভাবে একটা অসহায় মেয়েকে বন্য প্রাণীর মাঝে একা ফেলে চলে যাচ্ছেন। আপনার কি একটুও মায়া হচ্ছে না?
অরন্য থেমে গেলো। সারিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল। কয়েকবার পলক ফেলে বলল
–কেন? বন্য প্রাণীর সাথে সময় কাটানো শেষ?
সারিয়া কোন কথা বলল না। তার চোখে পানি চলে এসেছে। অরন্য মৃদু হেসে বলল
–চলো।
সারিয়া দাঁত বের করে হাসল। বলল
–আর একটা কল করবো। একটু দাঁড়ান প্লিজ।
অরন্য কিছুক্ষন ভাবল। তারপর এগিয়ে গিয়ে সারিয়ার পাশে দাঁড়ালো। বলল
–তাড়াতাড়ি শেষ করো। ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ না হলে কিন্তু আমি চলে যাবো।
–৫ মিনিট হলেই হবে।
বলেই আবারো দাঁত বের করে হাসল সারিয়া। অরন্য কিছু বলল না। এক পাশে গাছে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে সারিয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। সারিয়া ফোনে কথা বলছে। অরন্যর দিকে তার কোন খেয়াল নেই। কিছুক্ষন কথা বলে ফোনটা রেখে একটু ঝাঁঝালো গলায় বলল
–শেষ। এখন চলুন।
গলার স্বর শুনে অরন্য ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–উপকারের এই প্রতিদান। কথার স্বর এখনই বদলে গেলো?
সারিয়া পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘটনা বুঝতে পেরেই মিষ্টি হেসে বলল
–আরে না না। ভুল বুঝবেন না। আমি এভাবেই কথা বলি।
অরন্য শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সারিয়া আবারো বলল
–এতদিনে আপনার সেটা বোঝা উচিৎ ছিল।
অরন্য মৃদু হেসে বলল
–কি বুঝব?
–এই যে আমি এভাবেই কথা বলি।
অরন্য মাথা নাড়িয়ে বলল
–সেটা তো বুঝেই গেছি। আরও একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝে গেছি।
সারিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল। অরন্য তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি আমাকে একদম পছন্দ করো না। কোন কারনে আমার উপরে বেশ বিরক্ত। আমি যদিও বা জানি আমাকে পছন্দ করার কোন যৌক্তিক কারন নেই। তবুও অপছন্দ করার মতই বা কি কারন আছে।
সারিয়া কোন কথা বলল না। চুপ করে তাকিয়ে থাকল। অরন্য ঘুরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল
–চল। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে।
সারিয়া তার পিছে পিছে হাঁটতে থাকল। অনেকটা দূরে যাওয়ায় তাদের রিসোর্টে আসতে অনেকটা সময় লেগে গেল। এসেই সীমান্তর মুখোমুখি হয়ে গেলো। তাদের দুজনকে দেখেই সে ভ্রু কুচকে বলল
–এই সময় কোথায় গিয়েছিলেন সারিয়া? আর অরন্য আপনার সাথে কি করছে?
বিরক্তিতে সারিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। সে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
–আমি ফোন করতে গিয়েছিলাম। একা একা এতটা পথ নিরাপদ না তাই ওনাকে আমার সাথে যেতে বলেছিলাম।
সীমান্ত তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। তারপর হেসে বলল
–আমাকে বললেই তো হতো। আমিও কল করতে যেতাম। আমারও কিছু জরুরী কল করতে হতো।
সারিয়া হেসে বলল
–আপনার অপারেটর এর নেটওয়ার্ক তো রিসোর্ট থেকেই পাওয়া যায়। আমি সকালেই আপনাকে রিসোর্টের বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। তাছাড়াও আপনার যা ব্যবস্থা যেই মেয়েকে আমার দেখাশোনার ভার দিয়েছিলেন তাকে সাথে করেই নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝপথে কিভাবে যেন গায়েব হয়ে যায়। ভাগ্যিস অরন্য সাহেব ছিলেন। নাহলে যে আজ আমার কি হতো।
অরন্য বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারিয়ার দিকে। সীমান্ত বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আর এটাও বুঝতে বাকি থাকল না যে সারিয়া তাকে সূক্ষ্ম অপমান করলো। সে সেখানে না দাড়িয়ে থেকে অপ্রস্তুত হেসে সেখান থেকে চলে গেলো। অরন্য এখনও অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। সারিয়া ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো।
————-
সদ্য ভোরের আলো ফুটেছে। সবুজ ঘাসের উপরে শিশির বিন্দু মুক্তার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। রিসোর্টের সামনেই একটা দোলনা ঝুলানো। অরন্য সেখানে বসে সবে সিগারেট জ্বালিয়েছে। দুই একটা টান দিতেই মিষ্টি মৃদু আওয়াজ কানে এলো।
–শুভ সকাল।
অরন্য হকচকিয়ে পেছনে তাকাল। সারিয়া দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। অরন্যর হাতে তখনও জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে ধোঁয়া উড়ছে। সে তড়িঘড়ি করে সিগারেট ফেলে দিলো। হাত দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে আবার পেছন ফিরে তাকাল। এই অবস্থায় সারিয়ার চোখে পড়ায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সারিয়া একটু এগিয়ে এসে দাড়াতেই তার পায়ের দিকে অরন্যর চোখ পড়লো। খালি পা দেখেই ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল
–পা খালি কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো। স্যান্ডেল পরে আসো।
সারিয়া বিরক্ত নিয়ে তাকাল। অরন্যর কথাটা তার পছন্দ হয়নি। সে ইচ্ছা করেই খালি পায়ে বের হয়েছে। আজ তার শিশির ভেজা ঘাসের উপরে খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছা করছে। অরন্য চোখ তুলে মুখের দিকে তাকাল। প্রশস্ত হেসে বলল
–আমার কথা শুনতে হলে কান দিয়ে শুনতে হবে। চেহারায় কিছুই লেখা নাই।
সারিয়া মুখ ভার করে নিলো। বলল
–আমি ইচ্ছা করেই খালি পায়ে এসেছি। আজ খালি পায়েই হাঁটবো।
অরন্য অবাক হয়ে তাকাল। মানুষের কত রকমের সখ থাকতে পারে। কিছু বলল না সে। সারিয়া দাঁত বের করে হেসে আবার বলল
–আপনার কাছে একটা আবদার করবো। রাখবেন?
অরন্য অবাক হয়ে তাকাল। মুখে কিছু না বললেও চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো তার। মনে হল যে আবদার করুক না কেন প্রয়োজন হলে নিজের জীবন দিয়ে পুরন করবে। সারিয়া হেসেই বলল
–আমার সাথে একটু ওদিকে যাবেন? হাঁটতাম। এখনও কেউ উঠেনি। একা একা ভয় লাগছে।
অরন্য কয়েকবার পলক ফেললো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। বলল
–চলো।
সারিয়া খুশী হয়ে গেলো। তার মুখের হাসি যেন ধরছেই না। কিছুদুর এগিয়ে যেতেই অরন্য বলল
–তোমার এসিস্টেন্ট কোথায়?
–কে?
সারিয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করতেই অরন্য আবার বলল
–ওই যে মেয়েটা।
–ওহ আচ্ছা! মুন্নি। কাল রাতের ঘটনার পরে আর রিস্ক নিতে চাইনি। তাই তাকে ডাকি নি। আজ আবার কোথায় গায়েব হয়ে যায় কে জানে।
অরন্য মৃদু হেসে বলল
–আমি যদি বাইরে না থাকতাম তাহলে কি করতে?
সারিয়া কোন কিছু না ভেবেই ফটাফট বলে ফেললো
–ডাকতাম। কারন আমি জানি আপনি অনেক সকালে ঘুম থেকে ওঠেন।
অরন্য অবাক চোখে তাকাল। মৃদু হাসল। বলল
–এতো বিশ্বাস কিভাবে করছ আমাকে? আমিও যদি তোমাকে রেখে চলে যাই।
সারিয়া শব্দ করে হাসল। অরন্য ভ্রু কুচকে তাকাল। সারিয়া হাসি থামিয়ে বলল
–ভুত প্রেত এসব এখানে আছে কিনা তা জানি না। তবে একজন ভরসার মানুষ আছে। যে কোন কারন ছাড়াই আমার ভালো নিয়ে ভাবে।
অরন্য থেমে গেলো। বিস্ময়কর দৃষ্টি মেলে তাকাল। সারিয়ার এমন আচরন তার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। খুব শান্ত ভাবে বলল
–কি বলতে চাইছ?
সারিয়া সামনে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল
–সেদিন রাতে আমাকে ভুতের ভয় দেখানোটা ছিল একটা বাহানা মাত্র যাতে আমি আর রাতে কারো সাথে হাঁটতে না যাই। কারন সেদিন হাঁটতে গিয়ে যা হয়েছিল আপনি সবটা জানতেন। আমি আপনাকে অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি। আর তাছাড়াও আপনিই তো প্রথমদিন বলেছিলেন আপনাকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস না করতে।
বলেই থেমে গেলো। আবার বলল
–আচ্ছা ধরলাম এই মুহূর্তে আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি না। কিন্তু এই সকাল বেলা এমন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার জন্য এমন একটা সঙ্গী খারাপ নয় তো।
চলবে……