ভীন দেশের গল্প পর্ব ৮+৯

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৮
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

-‘আপনি এখানে কী করছেন?’

তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ, ম্যাক্সের মনোযোগ পুরোপুরি ভাবে ছিন্ন করে দিলো। কিছুটা চমকেই সে পেছন ঘুরে দেখল, লাবণী জেগে উঠেছে। এবং তারচেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, লাবণীর করা প্রশ্নটি সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। এমনকি এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলা প্রয়োজন, তা-ও তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে মিঃ ড্যামের প্রতি আরও একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ম্যাক্স।
নিজে কী করছিল তা লুকিয়ে সে বলল,
-‘কী আর করব? জানালা খোলা ছিল। আঁটকাচ্ছিলাম।’
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো লাবণী। তার চোখজোড়া এতবড় হলো যেন কোটর থেকে এক্ষুনি জাম্প করে বেরিয়ে আসবে। তার হতবাক চোখমুখ ম্যাক্সের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটিয়ে তোলে। ম্যাক্স নিজে থেকেই বলল,
-‘কী আর করব বলো। তুমি জার্মানি ভাষাও জানো না,বাংলাও জানো না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই বাংলা শিখতে হলো। কথাবার্তা তো বলতে হবে,নাকি?’
-‘তাই বলে এত দ্রুত? এত স্পষ্ট?’
নিজের অবাকতা মোটেও লুকোনোর চেষ্টা করল না লাবণী। ম্যাক্সের কথা শুনেও নিজেকে ধাতস্থ করতে পারল না সে। লাবণীর মনে কী চলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পেরে কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠে ম্যাক্স। আসলেই তো! এভাবে ভেবে দেখা হয়নি। এত দ্রুত এত শুদ্ধ ভাবে ভাষা শেখা টা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হবে না। লাবণীর কাছেও হচ্ছে না স্বাভাবিক।
ম্যাক্স কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর থেকে বলে উঠল,
-‘তুমি কী ভাবছো? আমি বাংলা আজকেই শিখলাম? আসলে না। আমি অনেক আগে থেকেই পারি। আমাদের এখানে আগে যে মেইড ছিল,সেও বাংলাদেশী ছিল। তার থেকেই শেখা মূলত। আমি বুঝতে পারিনি তুমি একদম ইংলিশ পারো না। বাংলা বলতে অস্বস্তি হয় আমার। আর এমনিতেও সবসময় ইংলিশ নয়তো জার্মান ভাষায় কথা বলি তাই এটাতেই অভ্যাস বেশি। বাধ্য হয়ে তোমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে হচ্ছে।’

ম্যাক্স সরু চোখ করে তাকাল। লাবণীর বিশ্বাস হয়েছে কীনা এই কথাগুলো কে জানে। কিন্তু সে বোঝার চেষ্টা করল। লাবণীর চোখমুখ দেখে বুঝতে না পারলেও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে সে তৎক্ষনাৎ বলল,
-‘তুমি জেগে গেলে যে? ঠান্ডা লাগছে?’
ঠোঁটের অদৃশ্য সেলোটেপ সরিয়ে মুখ খুললো লাবণী,
-‘ঘুম ভেঙে গেল।’
-‘আচ্ছা! ঘুমাও তাহলে। আমি যাই।’
ম্যাক্স জানালা আঁটকে দিলো। আঁটকানোর সময় লাবণীর চোখ এড়িয়ে বার কয়েক গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু অদ্ভুত, এখন আর কোনোপ্রকার গন্ধ পেল না। অথচ একটু আগেই বাতাসে তাজা র’ক্তের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল! অস্থির মন নিয়ে ম্যাক্স জানালা আঁটকে দেয়। লাবণীর দিকে চেয়ে ফের বলল,
-‘দরজা লাগানোর প্রয়োজন নেই। এই বাসায় আমি, জুলিয়া আর তুমি বাদে আর কেউ নেই। তাই কেউই আসবে না তোমার ঘরে। আর কাবার্ডে এক্সট্রা কম্বল আছে। প্রয়োজন পড়লে নিও। আগুনে হাত দিও না। আমি যেভাবে সেট করে দিছি তাতে ভোর রাত পর্যন্ত জ্বলতে থাকবে। এতে যথেষ্ট গরম হবে তোমার ঘরটা। সকাল সকাল উঠার দরকার নেই। আমরা অনেক লেট করেই উঠি সবাই। সো তুমি তোমার সময় মতো উঠে যেও। আর শোনো, আমরা কেউ ভারী খাবার খাই না। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশীরা সকাল-বিকাল,ভারী খাবার খেয়েই অভ্যস্ত। তোমার নিজের জন্য যেটা ভালো লাগে বানিয়ে নিও। কিন্তু আমাদের দু’ভাই-বোনের জন্য লাইট কিছু তৈরি করো। এইতো… বাকিটা আগামীকাল জুলিয়াই তোমাকে বলে দেবে। আপাতত এইটুকুই… গুড নাইট।’

লাবণীর হঠাৎ মনে হলো, অনেক বছর পর এতোটা কেয়ার নিয়ে কেউ তার কথা চিন্তা করল! সে কীভাবে ঘুমাবে, তার ঘরের জানালা খোলা, আগুন কতটা আছে, শীত করছে কীনা- কই, মাজহাব তো কখনো ফিরেও তাকায়নি! লাবণীর মন হুট করে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। নিশ্চুপ লাবণীকে দেখে ম্যাক্স ভ্রু কুঁচকালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও আবার থেমে দাঁড়াল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভাব করে বলল,
-‘আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে প্রথমেই নেগেটিভ ভাবে নিয়ে নিয়েছো। বাট বিলিভ মী, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমাদের এখানে এসব একদমই নর্মাল! হয়তো তোমার কালচারটা আলাদা। তাই আমি যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবো এরপর থেকে। ডোন্ট ওরি, আমার তরফ থেকে কোনোপ্রকার ঝামেলা পাবে না। বি ইজি। নিজের বাড়ি মনে করেই থেকো। ও, হ্যাঁ, একটা কথা লাবণী, আমাকে একটা ব্যাংক একাউন্ট দিও। তোমার ফ্যামিলিতে টাকা পাঠাবো কোন একাউন্টে, সেটা। নাকি তুমি তোমার বেতনটা নিজের কাছে রাখবে?’

লাবণী ছোট্ট করে বলল,
-‘দেশে আমার আর কেউ নেই।’
একটু থেমে পুনরায় বলল,
-‘কোনো পিছুটানও নেই।’
ম্যাক্স নিরব রইলো। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, বাবা-মা, অথবা ভাই-বোন, কেউ কী নেই? কিন্তু লাবণীর চোখমুখ দেখে আর প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
-‘দেখো, তোমার ঘুমের ভেতর ডিস্টার্ব করলাম আমি এসে! আচ্ছা তুমি ঘুমাও। আমি চললাম।’
ম্যাক্স বেরিয়ে এলো। দরজা ভিড়িয়ে দিলো লাবণী। তারপর চুপচাপ বিছানায় বসে গায়ে কম্বল টা টেনে নিলো। ঘুম এলো না তবে নানান চিন্তারা মাথায় ঘুরপাক করতে লাগল। প্রথমে এসে যতটা ভয় পেয়েছিল সে, তা অনেকাংশেই কমে গেছে এই মুহূর্তে। ম্যাক্সের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে মনে হয়েছে, লোকটা অদ্ভুত হলেও ভালো। অত্যন্ত এখানে নিরাপদ লাবণী। শুধু একটাই আজব জিনিস, এত সুন্দর ভাবে বাংলা বলতে পারে কীভাবে সে! আর পারলেও কেন আগে বলল না?
লাবণী শত ভেবেও এর কোনো উত্তর অথবা অনুমান বের করতে পারল না।

গা হিম করা বাতাস ছেড়েছে। গায়ে ওভার কোটটা জড়িয়ে ম্যাক্স বাড়ির লনে পা রাখে। লাবণীর ঘরের জানালা বরাবর জায়গাটায় গিয়ে বারকয়েক চোখ বুলালো। আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করে কিছু একটা। কিছুই পেল না। র’ক্তের গন্ধ পুরোপুরি গায়েব। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই! ম্যাক্সের কাছে অদ্ভুত লাগল ঘটনাটা। নিচ থেকে লাবণীর ঘরের জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে পুনরায় বাড়িতে ঢুকল ম্যাক্স।

-‘What are you doing here bro?’
জুলিয়া নিচে নেমে এসেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ভাইয়ের দিকে। ম্যাক্স দরজা আঁটকে গা থেকে ওভার কোটটা খুলতে খুলতে বলল,
-‘Nothing. Anyway, you didn’t’ sleep yet?’
-‘No brother, i feel strange, don’t know why. I feel like something is wrong. something is going to happen to us!’
জুলিয়ার নিচু কণ্ঠ। পাছে লাবণী শুনে না ফেলে!
ম্যাক্স বুঝল, জুলিয়ার থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং তাকে সবকিছু খোলাসা করে বলা ভালো। এতে করে জুলিয়াও প্রস্তুত থাকবে আগাম বিপদের।

ম্যাক্স বলল,
-‘Come with me.’

জুলিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল ম্যাক্স। দরজাটা আঁটকে দিয়ে জুলিয়াকে বলল,
(এখানে ম্যাক্স এবং জুলিয়ার সমস্ত কথাবার্তা টুকু আমি বাংলায় রূপান্তর করছি। জুলিয়া বাংলা জানে না, ম্যাক্স জানে। তারা ইংরেজিতে কথা বলছে কিন্তু আমি সেটাকে বাংলা আকারে লিখলাম যেন সবার বুঝতে সুবিধে হয়।)

-‘জুলিয়া, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং বাবা-মাকেও খবর দিতে হবে তারা যেন এখানে আসেন।’
এতটুকু শুনেই জুলিয়ার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা জমে উঠে। সে চিন্তিত গলায় বলল,
-‘কেন ভাইয়া? কী হইছে?’
-‘ব্লাড স্টোন’ এর পেছনে আবারও শত্রু লেগেছে। তারা কারা তা সম্পর্কে আমাকে অবগত করেননি মিঃ ড্যাম। তবে বলেছে আমরা যেন তৈরি থাকি। যেকোনো মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এবারের শত্রুরা পূর্বের তুলনায় আরও শক্তিশালী হবে।’
জুলিয়া প্রায় কেঁদে ফেলবে যেন। তার চোখেমুখে নিদারুণ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
ম্যাক্স জুলিয়ার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
-‘ভয় পাইস না। আমরা সবাই মিলে একটা না একটা উপায় বের করবোই। কিন্তু সবার আগে আমাদের প্রয়োজন, বাবা-মাকে এই বিষয়ে জানানো। ‘ব্লাড স্টোন’ এর চারপাশের নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও মজবুত করা।’

জুলিয়া নিজেকে সামলালো।
-‘হুম। তাই করো ভাইয়া। তুমি তাহলে আজকেই চলে যাও বাবা-মায়ের কাছে। আর এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি, তুমি চিন্তা করবে না একদম।’
-‘রাতের আঁধারেই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।’
জুলিয়া আলিঙ্গন করে ম্যাক্সকে। ম্যাক্স জুলিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ভয় পাবি না। তুই রাজ বংশের একমাত্র কন্যা! তোকে ভয় পাওয়া মানায় না। সাবধানে থাকিস। অপরিচিত কাউকে ধারেকাছে ভিড়তে দিস না। আমরা জানি না, আমাদের শত্রু কারা। তাই আমাদেরকে অনেক অনেক সাবধানেই থাকতে হবে।’
হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে জুলিয়া বলে উঠল,
-‘ভাইয়া, লাবণী?’
ম্যাক্স নিশ্চুপ থাকে কয়েক সেকেন্ড।
ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
-‘মিঃ ড্যামকে বলব, ওর আসল পরিচয়টা বের করতে। ও কে, সত্যিই কী সাধারণ একজন মানুষ নাকি ও-ই আমাদের শত্রু! জানা নেই। ওর থেকেও সাবধানে থাকিস জুলিয়া। আমি দ্রুত ফিরবো। খুব দ্রুত…’

জানালার কপাট বাতাসের দাপটে দু’দিকে বারি খায়। লম্বা জানালা দিয়ে হু’হু করে শরীর-মন কাঁপানো বাতাস ঢুকছে হুড়মুড় করে। জুলিয়া দাঁতে ঠকঠক করে চেয়ে আছে দূরে… তার ভাই ছুটে যাচ্ছে আঁধারের মাঝে। আঁধারে হারাতে…
তারপর একসময় দৃষ্টি সীমানা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর জানালা আঁটকে বড় পর্দা ছেড়ে দিলো সে। মোমবাতির আলোয় ঝলমল করতে থাকা ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে দেখল। বুক দুরুদুরু কাঁপছে তার। প্রচন্ড ভয় লাগছে। সে তড়িঘড়ি করে লাবণীর ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালো।

লাবণী জেগেই ছিল। দরজায় শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জুলিয়া এসেছে।
লাবণী নড়েচড়ে উঠে বসে। জুলিয়া লাবণীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাবার্ড থেকে একটা পাতলা ব্ল্যাংকেট বের করে নিজের গায়ে জড়ায়। তারপর শুয়ে পড়ে বিছানার সোজাসুজি বরাবর লম্বা সোফাটায়। লাবণী কতক্ষণ বসে রইলো একই ভাবে। পরে বুঝতে পারল, জুলিয়া এই ঘরে ঘুমাবে তাই এসেছে। লাবণী একবার বলতে চাইলো, ‘আপনি খাটে ঘুমান, আমি ওখানে যাচ্ছি।’
কিন্তু পরমুহূর্তে আর বলে উঠল না। নিজেও চুপ করে শুয়ে পড়ল। দ্রুতই ঘুম চলে এলো লাবণীর চোখে। এতক্ষণ একলা অচেনা জায়গায় থাকার জন্য যে ভয় ভয় ভাবটা হচ্ছিল, তা এই মুহূর্তে কেটে গেছে জুলিয়ার আগমনে। খুব গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল লাবণী।

নতুন দেশে প্রথম ভোর হলো লাবণীর। কিন্তু ভোর সকালের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য সে উপলব্ধি করতে পারল না। লাবণী যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল তখন বেলা এগারোটা। বিছানার সাইডে একটা টেবিল ঘড়ি রয়েছে। লম্বা কাঠিটা ঠিক এগারোটায় আঁটকে আছে দেখে লাবণী আঁতকে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে যায় সোফাটায়। জুলিয়া নেই! লাবণী বিদ্যুৎ বেগে বিছানা ছাড়ল। আলুথালু চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনোরকমে আঁটকে সে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। তরতর করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। ডায়নিং স্পেসে কেউ নেই। রান্নাঘর ঘুরে এসেও কাউকে পেল না লাবণী। তার সন্দেহ হলো, সে বাসায় একা নয়তো?
সন্দেহ থেকেই ঢোক চেপে মনে সাহস সঞ্চয় করে পুরো বাড়িটা একবার চক্কর দেয় লাবণী। কাউকে না পেয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বুকের ছাতি পানির তৃষ্ণায় ফেটে যাবার জোগাড়। ম্যাক্স,জুলিয়া,কোথায় সবাই? কেউ কেন তাকে ডাকল না সকাল বেলা? আর যদি বাহিরে গিয়ে থাকে তবে কেন কেউ অন্তত বলে গেল না! লাবণীর হুট করেই কান্না পেয়ে বসে। অসহায় মুখ করে সে এসে বসল ডায়নিং স্পেসের সোফায়। দু’হাত দু’গালে চেপে ধরে সে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল নিরবে। এ কোন অদ্ভুত বাড়িতে এসে পড়েছে সে কে জানে! কারো কোনো খোঁজ পাত্তা থাকে না৷ একেকজন একেক রকম। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ওই লোকটি…কী যেন নাম? লাবণী বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, ‘ম্যাক্স’। এর কথাবার্তা, আচার আচরণ সবকিছুতে অদ্ভুত রহস্যময়তা। বিশেষত তার চোখ, ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় যেন!

কোথা থেকে এক দলা বাতাস আসে আচমকা। লাবণীর চুল উড়িয়ে দিয়ে যায়। সে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে বাতাসের তীব্রতায়। যখন খুললো, মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত, সবকিছু চমকে উঠে। এ কে? কাকে দেখছে? এটা মানুষ… নাকি?
কিছু বুঝে উঠার আগেই লম্বা একজোড়া হাত এগিয়ে আসে। লাবণী চিল্লানোর জন্য মুখ খুলতেই একটা ফুঁ উড়ে এসে পড়ল তার গায়ের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে ঘুমের ভেতর ঢলে পড়ে সে। ঢলে পড়ে আগন্তুকের গায়ের উপর। আগন্তুক হাসলো।
এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করল তবে!

ম্যাক্স যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। এক আঁধারে বেরিয়ে গেছিল, আরেক আঁধারে ফিরলো। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ম্যাক্স ঘর্মাক্ত মুখখানা নিয়ে বার কয়েক কলিং বেল টেপার পরও কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছে না দেখে অবাক না হয়ে পারল না। বাতাসে কিছু একটার গন্ধ। নাক কুঁচকে শোঁকার চেষ্টা করল। পেয়েও গেল। তীব্র ধাক্কায় মোটা কাঠের দরজার পাল্লা নড়বড়ে হয়ে গেল। ম্যাক্স ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকলো,
-‘জুলিয়া…জুলিয়া!!! লাবণী?’
কেউ নেই, কেউ নেই!
পাগলের মতো হয়ে উঠল ম্যাক্স। যে চিন্তারা এতক্ষণ যাবত তার পিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, এখন সেটাই সত্যি হলো। নিয়ে গেছে। ওদের নিয়ে গেছে তারা! ওরা আবার এসেছে। আবার ফিরে এসেছে!
ম্যাক্স সোফার উপর ধপ করে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। লাবণীকেও ছাড়ল না! লাবণীকে ওদেরই একজন ভেবে নিয়ে গেছে। নাহ…এবার কী করবে ম্যাক্স?
একটা পাতা ফড়ফড় করে উড়ছে। কিঞ্চিৎ শব্দ তৈরি হয় তাতে। ম্যাক্স দ্রুততার সঙ্গে কাগজের পাতাটা তুলে নিলো হাতে। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
‘Welcome us Max! Remember me?
—–S. Sherlock’
#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৯
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

‘S.Sherlock’- ওর পুরো নামটা ছিল শারু শার্লক। প্রায় ছ বছর আগের কথা। সেবার জুলিয়ার জন্মদিনে নতুন প্রতিবেশী হিসেবে শারুও দাওয়াত পেয়েছিল। একটা ডেনিম নেভি ব্লু স্যুট-কোটে সে এটেন্ড করেছিল গোমেজ পরিবারের আয়োজিত অনুষ্ঠানে। বার স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক ছিপ নিতে ব্যস্ত ছিল যখন, তখন ফুলের গালিচা মাড়িয়ে লম্বা সাদা ফ্রক পরনে জুলিয়া আগুন জৌলুশ রূপ নিয়ে নিচে নামলো একের পর এক সিড়ি বেয়ে। একপলক দেখতেই শারুর চোখজোড়া থেমে গিয়েছিল জুলিয়াতে। খুব বেশিদিন হয়নি নতুন বাড়িতে এসে উঠার। চেনা পরিচিত লোক নেই বললেই চলে- তাই সারাদিন একা নিজের মতো সময় পার করতো শারু। বাহিরে সময় কাটানো খুব একটা পছন্দ নয় বলে এর আগে জুলিয়াকে দেখা হয়নি তার। এই দাওয়াতটা পেয়েও আসার ইচ্ছে ছিল না মোটেও। তবুও কী ভেবে যেন চলেই এলো শেষমেশ। ভাগ্যিস এসেছিল, নইলে এত সুন্দরী রমণীর দেখা পেত কেমন করে?
ভালোলাগাটা মূলত সেখান থেকেই শুরু। তার পরদিনই জুলিয়াকে সরাসরি নিজের পছন্দের কথাটুকু জানিয়ে দেয় শারু। উঁচা-লম্বা, সুদর্শন, পুরুষালী শরীরের অধিকারী শারুকে ভালো লেগে যায় জুলিয়ারও। দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক গাঢ় হয় ধীরে ধীরে। তারপর একটা দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনার পর থেকেই শারুর সঙ্গে জুলিয়ার পারিবারিক সম্পর্কটা বন্ধু থেকে পাল্টে শত্রুতে রূপ নিয়েছিল। শারু চলে গিয়েছিল এক বুক কষ্ট এবং আঘাত নিয়ে। বলে গিয়েছিল, আর কোনোদিন জুলিয়া বা তার পরিবারের কারো মুখ সে দেখতে চায় না। তবে আবার কেন ফিরে এলো? এই ফিরে আসার পেছনের আসল কারণ কী?
ভাবতে ভাবতে মাথা পাগল হওয়ার অবস্থা ম্যাক্স। সে কী করবে,কোথায় যাবে,কোথায় গেলে উপায় মিলবে জুলিয়া এবং লাবণীকে মুক্ত করার- তা ভাবতে ভাবতেই মিঃ ড্যামের কথা পুনরায় মনে পড়ে ম্যাক্সের। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বেগে সে ছুটলো চার্চের উদ্দেশ্যে।

-‘আমি সত্যি সত্যি দুঃখীত মিঃ ড্যাম। আপনাকে এরকম সময়ে বিরক্ত করার জন্য!’

ধ্যানে বসেছিলেন মিঃ ড্যাম। এমন সময়ে ম্যাক্স এসে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলে অগত্যা ধ্যান রেখে উঠে আসতে হয় তাকে। যা দেখে ম্যাক্সের ভেতরটা গ্লানিতে ভরে গেল। সে অপরাধী কণ্ঠস্বরে উপরিউক্ত কথাটুকু বলে ঘাড়টা যথাসম্ভব নিচু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মিঃ ড্যাম স্মিত হেসে এগিয়ে গেলেন। ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
-‘রাজকুমার, আপনি কেন এত নরম মনের, বলুন তো? আপনাকে এ-সাজে মানায় না। আমি আপনার দাস। আপনি আমাকে হুকুম করবেন, আমি তা পালন করব।’
ম্যাক্স সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে,
-‘মিঃ ড্যাম, আপনার সাহস হয় কী করে এই ধরনের কথা বলার? আপনাকে আমি কতবার বলব, আপনি আমাদের পরিবারের একজন। আপনাকে আমার দাদা-দাদী অথবা বাবা-মা কখনোই দাস হিসেবে ভাবেনি। তাহলে আমি কেমন করে ভাববো?’
কথার মাঝে একটু বিরতি দিয়ে ম্যাক্স গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলল,
-‘ফের যেন না শুনি এইধরনের কোনো কিছু না বলতে।’
মিঃ ড্যাম মেকী কুর্নিশের ভঙ্গি করে ম্যাক্সের কথায় সম্মত হলো। ম্যাক্স ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে। মিঃ ড্যাম বললেন,
-‘কী ব্যাপার রাজকুমার? আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে।’
-‘চিন্তারই বিষয় ড্যাম। আপনি যদি শোনেন,তবে আপনিও চিন্তায় পড়বেন।’
-‘আমাকে বলুন রাজকুমার। আমি আমার সর্বাত্মক সাহায্য করবো আপনাকে।’
ম্যাক্স স্বস্তির সহিত বলল,
-‘এইজন্যেই তো আপনার কাছে ছুটে আসা। আমি জানি, আপনিই পারবেন আমাকে যেকোনো একটা পথ বাতলে দিতে।’

মিঃ ড্যামকে সবকিছু খুলে বলল ম্যাক্স। শারুকে আগে থেকে মিঃ ড্যাম ও চিনতেন। তাই তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হলেন। এতগুলো বছর পর এসে জুলিয়া এবং লাবণীকে এভাবে কিডন্যাপ করার কারণ কী হতে পারে তা সঠিক ভাবে বুঝতে পারলেন না তিনিও। কিন্তু তাই বলে ম্যাক্সকে খালি হাতে ফিরিয়েও দিলেন না। ম্যাক্সের থেকে সময় চেয়ে তিনি পুনরায় ধ্যানে বসলেন। নিজের মনশ্চক্ষু খুলে খুঁজতে লাগলেন একটি পথ। অন্তত ওদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই জায়গার খোঁজটুকু পেলেও চলবে।

পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে অন্ধকারের মাঝে আবিষ্কার করে লাবণী। ঘামে ভেজা মুখখানা। মাথার ভেতর একধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। কোথায় আছে,কী হয়েছিল,তা মনে করতে চাইলে যন্ত্রণারা চাপ দিয়ে বসল। মুখ ফুঁটে অস্ফুটে উহঃ জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসে তার। ঠিক তখনই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় লাবণী।

-‘ল্যাবণী? তুমি ঠিক আছো?’

জুলিয়া? কণ্ঠটা জুলিয়ার। তবে কী সেও রয়েছে লাবণীর সঙ্গে? কোথায়? কোথায় জুলিয়া? লাবণী আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারের মাঝেই জুলিয়ার অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করল। ব্যর্থ হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো কিছু দেখা দায়। তবুও অজানার উদ্দেশ্যে প্রত্যুত্তর ছুঁড়ে দিলো সে,
-‘জুলিয়া? আপনি কোথায়? আপনি ঠিক আছেন? আ.। আমি ঠিক আছি।’
-‘আমি তোমার আশেপাশেই আছি লাবণী। আমাকে তুমি যেমন দেখতে পাচ্ছো না, কিন্তু আমি তোমাকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।’
-‘দেখতে পাচ্ছেন? এই অন্ধকারের ভেতরও আমাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন? কীভাবে?’
-‘তা তোমার জানার বিষয় নয় ল্যাবণী। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, তুমি আমাদের শত্রু নও।’
-‘আমি আপনার শত্রু হতে যাবো কেন! আমি আপনার কথার আগামাথা কোনোকিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ, আপনি লাইটটা জ্বালান। অন্ধকারে আমার ভয় করছে।’

জুলিয়ার কথাগুলো আহত করে লাবণীকে। একই সঙ্গে করে তোলে বিস্ময়। অন্ধকার একেবারেই অপছন্দ লাবণীর নিকট। সেই সঙ্গে এরকম অদ্ভুত কথাবার্তা তার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুললো। লাবণী পুনরায় আকুতির স্বরে বলল,
-‘প্লিজ আপনি লাইট জ্বালান। আমার ভালো লাগছে না।’
প্রত্যুত্তরে ধমকে কথা বলে উঠে জুলিয়া,
-‘আমার হাত-পা বাঁধা। আমি যদি পারতাম তবে কী অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতাম তোমাকে? তাছাড়া আমার তো বেশ ভালোই লাগছে। বহুদিন পর এত অন্ধকার উপভোগ করতে পারছি।’
এহেন কথা শুনে লাবণীর ভ্রু-যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো।
-‘আ…আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন আপু? অন্ধকার কার ভালো লাগে? কোনো মানুষেরই অন্ধকার ভালো লাগে না। এই ঘুটঘুটে অন্ধকার তো একদম না।’
-‘এত কথা বোঝানোর মতো সময় এখন নেই। আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।’
অধৈর্য্য কণ্ঠ জুলিয়ার। পরক্ষণেই আদেশের সুরে বলল,
-‘তোমার বাম পায়ের পাশেই একটা চা’কু পড়ে আছে। ওটা পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে দিতে পারবে ল্যাবণী?’
লাবণী অবাক গলায় বলল,
-‘আপনি কী করে দেখলেন?আমি তো..আমি তো..’
-‘উফফো! এত কথা কেন বলো মেয়ে?যে কাজ দিয়েছি তা করো না। চা’কুটা দাও।’
পুনরায় ধমকে উঠে জুলিয়া। লাবণী এবার কেঁদেই ফেলল। একটার পর একটা এসব ঘটনা নেওয়া যাচ্ছে না। তাও যদি স্বাভাবিক হতো! সবগুলো ঘটনাই অস্বাভাবিক। লাবণী মনে মনে বলল, ‘আমার ঘাট হয়েছে!! আমি অনেক বড় ভুল করেছি এই দেশে এসে। আমি বাংলাদেশেই ভালো ছিলাম। সতীন নিয়েই থাকতাম নাহয়। অন্তত এসব অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা সহ্য করতে হতো না।’

নিশ্চুপ লাবণীর ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্নার শব্দ জুলিয়াকে ভয়ংকর ভাবে রাগিয়ে তুলল। সে রীতিমতো হুংকার ছেড়ে বলল,
-‘ঘা’ড় ফুটো করে মে’রে ফেলবো একদম। এটা কান্নার সময়? এই মেয়ে,কথার জবাব দাও। এটা কান্নার সময়?’
-‘আ..আপনি কে? সত্যি করে বলুন আপনি কেন আমাকে এখানে ধরে এনেছেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করি নাই। আপনি জুলিয়া আপু নন। উনি আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারে না।’
ঠিক তখনই লাবণীর বিদ্যুতের মতো একটা কথা মাথার ভেতর চিলিক মেরে উঠে। জুলিয়া ইংরেজী ব্যতীত অন্যকোনো ভাষায় কথা বলেনি। সে এত স্পষ্ট বাংলা কী করে বলছে? এতক্ষণ ঘটনার মারপ্যাঁচে পড়ে বিষয়টা নজরে না এলেও এখন হুশ ফিরেছে। সঙ্গে সঙ্গে কান্নার বেগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। রীতিমতো হেঁচকি উঠে গেল লাবণীর। সে আকুতির স্বরে বলে চলল,
-‘কে আপনি? জুলিয়া আপু তো বাংলা-ই জানে না। আপনি আমাকে কেন ধরে এনেছেন? আপনি আমার সর্বনাশ করতে চান? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি? আমাকে ছেড়ে দেন। আমি দেশে চলে যাবো। আর আসবো না,কক্ষনো না।’

দাঁতে দাঁত কামড়ে নিজের রাগটা সংবরণ করে জুলিয়া। লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর স্বরে বলল,
-‘আমি জুলিয়াই। তোমাকে আমি কেন ধরে নিয়ে আসবো? আমি নিজেও এখানে ফেঁসে আছি, দেখছো না? আর আমি কীভাবে বাংলা কথা বললাম, তা যথাসময়ে জানতে পারবে। এখন কান্না থামাও। প্লিজ লাবণী, কান্না থামাও!’
লাবণীর কান্নার দমক খানিকটা কমলো এইবার। তবে ফোঁপানি রয়ে গেল।
জুলিয়া বলল,
-‘লাবণী, আমরা এখানে ফেঁসে গেছি। আমার জন্য তুমিও ফেঁসে গেছো। তোমার উচিত ছিল আরও পরে ঘুম থেকে জেগে ওঠার। তাহলে ফাঁসতে না। যাইহোক, এখন আমাদেরকেই একটা পথ বের করতে হবে এখান থেকে বের হওয়ার। আমি অন্ধকারে সবকিছু দেখতে পারি,সবকিছু স্পষ্ট টের পাই। তাই ভয় নেই। শুধু আমি যেমনটা বলে যাই, তেমনটা করো। কেমন?’
লাবণী অন্ধকারে নিরবে ঘাড় নাড়ে। মুখ দিয়ে হা হুঁ কিছু করল না। জুলিয়া এত কঠিন সময়েও মৃদু হাসল। এরকম ভীতু এবং ছিচকাঁদুনে মেয়ে সে এই প্রথমবার দেখল।

অধির আগ্রহ নিয়ে বসে রয়েছে ম্যাক্স। প্রতিটা সেকেন্ড যেন ঘন্টার সমান! একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে একটু দূরে ধ্যানে বসা মিঃ ড্যামের দিকে। বুকের ভেতরটা হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। তার বোনের সঙ্গে কীরকম আচরণ করা হচ্ছে, তা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে লাবণীর চিন্তা যে তার মাথায় উঁকি দিচ্ছে না,তা অবশ্য না। তবে লাবণীর চেয়েও অধিক চিন্তা জুলিয়ার। লাবণী তার কেউ না। যদি প্রা’ন যায় তার,তবে যাক। কিন্তু জুলিয়া..জুলিয়ার কিচ্ছু হওয়া যাবে না। জুলিয়ার কিচ্ছু হলে সে পুরো পৃথিবী নড়িয়ে তুলবে।

সাত-পাঁচ ভাবনায় মাথার ভেতরটা যখন জ্যাম পাঁকিয়েছে, ঠিক তখনই মিঃ ড্যাম গর্বিত ভঙ্গিতে চেঁচালেন,
-‘রাজকুমার, আমি পেয়েছি।’
চোখের পলকে মিঃ ড্যামের সামনে গিয়ে বসে ম্যাক্স। দ্রুততার সঙ্গে বলল,
-‘কী? কী পেয়েছেন? আমাকে জলদি বলুন। কোথায় আছে ওরা? কোথায় রেখেছে শার্লক ওদের? রাস্তা দেখান।’
এ কথা শুনে মিঃ ড্যামের চোখেমুখে হালকা মেদুর রঙের ছায়া নেমে এলো। তিনি গলায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বললেন,
-‘রাস্তা পাইনি রাজকুমার। তবে সেই রাস্তা পাওয়ার জন্য কী উপায় অবলম্বন করতে হবে,তা পেয়েছি।’
নিমিষেই এক ছটাক হতাশা ঘিরে ধরল ম্যাক্সকে। তবে মনের জোর হারালো না। আপাতত এইটুকুই ভরসা। সে তড়িৎ গতিতে বলল,
-‘বলুন।’
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মিঃ ড্যাম বললেন,
-‘তবে এখানে আপনার জীবনসঙ্গিনীর ও ভূমিকা রয়েছে রাজকুমার। আপনার জীবনসঙ্গিনীর যেকোনো কিছু আপনি স্পর্শ করার সাথে সাথে আপনার কাছে একটি সুযোগ আসবে। আপনি চোখ বন্ধ করে জুলিয়ার নাম ধরে উচ্চারণ করলে সে কোথায় আছে,সেখানে যাওয়ার রাস্তা- সবটা আপনি মনের আয়নায় দেখতে পারবেন।’
-‘অ্যাহ!’
ম্যাক্সের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠে। আক্রোশপূর্ণ গলায় সে বলে উঠল,
-‘আমার জীবনসঙ্গিনী? তাকে কোথায় পাবো আমি? আমার তো কেউ নেই!’
-‘জানি। জানি বলেই তো আমিও হতাশ হয়ে পড়েছি রাজকুমার।’
অস্বস্তির নিরবতায় ডুবে যায় দু’জনেই। ম্যাক্সের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বোনকে ফিরে পাওয়ার আশাটুকু নিরাশা ঢেকে নিচ্ছে। তার কোনো গার্লফ্রেন্ডই নেই, সেখানে জীবনসঙ্গিনী আসার প্রশ্নই উঠে না!
মুখ ঘুরিয়ে নিজের অসহায়ত্ব লুকোতে চেষ্টা করে ম্যাক্স। মিঃ ড্যাম ম্যাক্সের পিঠের উপর হাত রেখে বললেন,
-‘রাজকুমার, হতাশ হবেন না। আমরা খুঁজবো চলুন। আপনার জীবনসঙ্গিনী অবশ্যই আছে।’
-‘হুম, আছে তো, আমার মাথায় আছে! মানে এতোই সোজা? আমরা খুঁজতে বের হয়ে গেলাম, আর পেয়ে গেলাম? এই জার্মানিতে কত কোটি মেয়ে আছে, কোনো আইডিয়া আছে আপনার? তাদের ভেতর কে আমার জীবনসঙ্গিনী,সেটা কেমন করে বুঝবো আমি?’
-‘আদৌও এই দেশের কীনা, তাও বা কে জানে!’
বলে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মিঃ ড্যাম। তার কথার মর্মার্থ ধরতে পেরে ম্যাক্সের বুক চিঁড়ে হাহাকার বেরিয়ে আসে। শব্দরা হারিয়ে যায়। সে ব্যর্থ চিত্তে বাসার পথে রওনা হলো।

ঘরের দরজা হাট করে খোলা। এক পাশে একটু ঝুলে রয়েছে। সন্ধ্যের সময় দরজা লাথি দিয়ে ভেঙে রেখে যাওয়ার ফল। এভাবেই ঘরবাড়ি উদাম রেখে চলে গিয়েছিল ম্যাক্স। এতক্ষণে ঘরের ভেতরে সব ফাঁকা করে দিয়েছে কীনা চোরেরা,কে জানে! অবশ্য এসব নিয়ে মোটেও ভাবনা নেই ম্যাক্সের মনে। নিয়ে যাক,সব নিয়ে যাক,ঘরবাড়ির দলিলও নিয়ে যাক। শুধু জুলিয়াকে ফিরে পাওয়ার একটা রাস্তা কেউ বলে দিক। কোথায় আছে জুলিয়া? কেমন আছে সে? তাকে এতক্ষণে জীবিত রেখেছে নাকি…
ম্যাক্সের মনটা হু’হু করে কেঁদে উঠে। সে সোফায় বসে পড়ল ধপ করে। মনটাকে নানান ভাবে বুঝিয়ে শক্ত করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বারবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। ভাগ্যিস সে একা,কেউ নেই তার এই কান্না দেখার। তাহলে কী হাসির পাত্রটাই না হতো!
আঙুল দিয়ে মুছতে গিয়ে নখের কোণা চোখের ভেতর লেগে ভীষণ জ্বালা করে উঠে ম্যাক্সের। আশেপাশে খুঁজে একটা ওড়না পেল সে। কার ওড়না তা খেয়াল না করে দ্রুত চোখের উপর চেপে ধরে। ডলে ডলে চোখ মুছে নেওয়ার সময় হুট করেই সম্মোহনের মতো হলো। বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল, ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি কক্ষ। তারপর কয়েকটি গাছের পাতা, আকাশে অমাবস্যার আঁধার। এরপর একটি জঙ্গলে দু’জন নারীর দৌড়ের শব্দ। ওইতো, ওইতো জুলিয়া! দৌড়াচ্ছে। তাদের পেছনে কেউ আছে! কে? কে সে?
দেখার আগেই সবকিছু নিমিষেই মিলিয়ে গেল। সেকেন্ডের ব্যবধানে অনেক কিছু দেখে ফেলল ম্যাক্স। সারা শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে তার। সে চোখ মেলতেই হাতে ধরা ওড়নাটা নজরবন্দী হয়। এটা কার যেন?
লাবণীর? মনে পড়ে ম্যাক্সের। সেই সঙ্গে মনে পড়ে আরও একটি কথা, মিঃ ড্যাম বলেছিলেন, তবে এখানে আপনার জীবনসঙ্গিনীর ও ভূমিকা রয়েছে রাজকুমার। আপনার জীবনসঙ্গিনীর যেকোনো কিছু আপনি স্পর্শ করার সাথে সাথে আপনার কাছে একটি সুযোগ আসবে। আপনি চোখ বন্ধ করে জুলিয়ার নাম ধরে উচ্চারণ করলে সে কোথায় আছে,সেখানে যাওয়ার রাস্তা- সবটা আপনি মনের আয়নায় দেখতে পারবেন।”
তবে কী…তবে কী লাবণীই ম্যাক্সের জীবনসঙ্গিনী?
ম্যাক্সের মনে হলো, ছোট খাটো একটা ভূমিকম্প তার পায়ের তলায় অনুভূত হয়েছে।

(চলবে)
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here