ভীন দেশের গল্প পর্ব শেষ

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_১১ (শেষ পর্ব – ১ম অংশ)
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

(অতীত)
কুক কুক করে কু পাখি ডেকে গেল তারস্বরে। গোমেজ বাড়িতে বিষাদের ছায়া। মালোকো গোমেজ চিৎকার করে ডাকলেন,
-‘ড্যাড!’
বুকে হাত চেপে দোরগোড়ায় পড়ে রয়েছেন ফুজিন গোমেজ। তার চোখজোড়া বন্ধ। বুকটা হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। র’ক্তে বুকের কাছের জামাটা লাল হয়ে আছে। মালোকো এবং তার স্ত্রী আলিজা দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামলেন। ছেলে হয়েও পিতার এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন মালোকো। পিতার বুকে অস্থির ভঙ্গিতে হাত রেখে থেমে থেমে বলে চলেন,
-‘ড্যাড! ড্যাড, প্লিজ চোখ খোলেন। আমাকে…আমাদের একা করে দিয়ে চলে যাইয়েন না আপনি। চোখ খোলেন ড্যাড। প্লিজ।’

ফুজিন চোখ খুলে চাইলেন। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া হাতখানা কোনোরকমে নাড়িয়ে পকেটের ভেতর থেকে একটা পাথর বের করে আনলেন। পাথরটি কোনো সাধারণ পাথর নয়। মালোকো অবাক চোখে তাকিয়ে বলেন,
-‘ব্লাড স্টোন! আপনি ব্লাড স্টোন উদ্ধার করতে পেরেছেন?’
ফুজিন মাথা নাড়ান। ছেলের হাতে দ্রুততার সঙ্গে অতি দামী ‘ব্লাড স্টোন’ হস্তান্তর করে দুর্বল গলায় বলেন,
-‘মাই সান, আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। এখন যাওয়ার পালা। তবে যাওয়ার আগে এইটুকু বলে যেতে চাই, আমার আব্বা ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন, আজ আমিও দিয়েছি। আর তোমার… তোমার মা-ও।’
-‘মম?’
মালোকোর গলা কেঁপে উঠে। চোখের ইশারায় আলিজার দিকে তাকালে আলিজা দ্রুত উঠে বাহিরে দৌড়ে গেল। উদ্দেশ্য শ্বাশুড়ি হেলেন কে খুঁজে বের করা। ফুজিনের দম ঘন হয়ে আসে। বুক ভরে বাতাস টেনে তিনি পুনরায় দুর্বল কণ্ঠটি নাড়ালেন,
-‘মালোকো, কথা দাও, তুমি আর তোমার পরবর্তী বংশধর কখনো একে হারাতে দেবে না। কখনো এর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচ আসতে দেবে না। কথা দাও মালোকো। কথা দাও আমাকে।’
চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে মালোকোর। ভেজা কণ্ঠে সে উত্তর করল,
-‘কথা দিলাম ড্যাড, কথা দিলাম।’
ফুজিন চোখ বন্ধ করে বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হারিয়ে গেলেন। বিদায় জানালেন যুদ্ধ করতে করতে বেঁচে থাকা এই সুন্দর পৃথিবীকে। মালোকো পিতার নিথর দেহ বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ডুকরে উঠে।। সেই সঙ্গে হাতে ধরে রাখা পাথরটিকে চেপে ধরে আরও শক্ত ভাবে। কিছুক্ষণ পর পিতার নিস্তেজ দেহ মাটিতে শুইয়ে রেখে সে উঠে দাঁড়াল জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে।

উঁচু গলায় ডাকলেন,
-‘ম্যাক্স, ম্যাক্স!’
চপল পায়ে সিড়ি মাড়ালো ম্যাক্স। বয়স তার চৌদ্দ’র কোঠায়। মাত্রই কিশোর থেকে যুবকে পা দিচ্ছে সে। চারিপাশে যা-ই দেখে তাই সুন্দর লাগে। হাসিখুশি ম্যাক্সের চেহারাটা মলিন হয়ে গেল দাদার নিশ্চুপ দেহ দেখে। বাবাকে ডিঙিয়ে দাদার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ার সাহস তার হলো না। সেই সঙ্গে এক ঝাঁক প্রশ্ন মগজে ভীড় জমালো। বাবার সামনে প্রশ্নবিদ্ধ চোখ নিয়ে এসে দাঁড়াল। নির্বাক রইলো।
মালোকো একমাত্র ছেলের দু’কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
-‘তোমার দাদা আর নেই।’
-‘কে,কে করল এসব?’
প্রশ্নটি বেরিয়ে এলো তাৎক্ষণিক। মালোকো দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললেন,
-‘আমাদের শত্রুর অভাব নেই ম্যাক্স। কে করেছে কেমন করে বলি! তবে ড্যাড চলে যাওয়ার আগে একে ঠিক রক্ষা করতে পেরেছেন।’
বলেই নিজের হাতের মুঠো বাড়িয়ে ধরেন। এর আগে শুধু একবার ‘ব্লাড স্টোন’ কে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ম্যাক্সের। তাই এবার দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারল। ম্যাক্স অবাক গলায় বলল,
-‘এর জন্য? এর জন্য খু’ন হলো দাদা?’
মালোকো ঘাড় নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। ম্যাক্স ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। মালোকোর হাত থেকে প্রায় ছো মেরে ‘ব্লাড স্টোন’ কেড়ে নিলো। রাগী স্বরে বলল,
-‘তবে একে ভেঙে ফেলছো না কেন ড্যাড? কেন এর জন্য আমাদের স্বজনরা একে একে হারিয়ে যাবে? কেন এর জন্য আমাদের এত শত্রু হবে ড্যাড? আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি। তবুও আমাদের এত শত্রু, এত সমস্যা, সব এর জন্য!তাহলে একেই নষ্ট করে দাও। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।’

ম্যাক্স হাতটা উঁচু করে। ভাবখানা এমন, এক্ষুনি ছুঁড়ে মারবে পাথরটি। মালোকো সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্সের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিলো। হুংকার ছেড়ে বলল,
-‘ম্যাক্স!! তোমার সাহস হয় কী করে এমন কথা বলো?’
ম্যাক্সের হাত থেকে দ্রুততার সঙ্গে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে নেয় মালোকো। অগ্নিচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়৷ অপরদিকে ম্যাক্সও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। একটা পাথরের জন্য কেন এতকিছু! সে বুঝতে পারে না। মালোকো ছেলের চোখের ভাষা পড়তে পারে। হতাশামিশ্রিত শ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিঁড়ে। ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে এবার খানিকটা নরম সুরে সে বলল,
-‘তুমি অনেক কিছু জানো না ম্যাক্স। তাই এই কথা বললে। যদি জানতে আজ বুঝতে পারতে, তোমার দাদা খু’ন হয়নি, শহীদ হয়েছে।’
ম্যাক্স অভিমানী গলায় জবাব ছোঁড়ে,
-‘আমাকে কখনো কিছু জানিয়েছো তোমরা? তুমি বা মা, কেউই আমাকে বলোনি কী এটা। কেন এটার জন্য এতকিছু। কেন এত সুরক্ষিত রাখার পরও এটা চুরি হয়ে যায়। আর তারপর ওকে রক্ষা করতে গিয়ে কেউ না কেউ জীবন যুদ্ধেই পরাজিত হয়ে আসে। আর না, আজ আমি জানতে চাই। আমাকে বলতেই হবে। নইলে আমি সত্যি বলছি, এবার ভেঙে ফেলবো এটাকে। আমাকে কেউ থামাতে পারবে না।’

ম্যাক্সের কণ্ঠে আক্রোশ স্পষ্ট। মালোকো বুঝলেন তার ছেলে বড় হয়ে গেছে। ‘ব্লাড স্টোন’ এবং তাদের উপর আরোপিত দায়িত্বের কথা তাকে জানানোর সময় এসে গেছে। মালোকো ‘ব্লাড স্টোন’ এর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলতে লাগলেন,
-‘আমি তখন তোমার চেয়ে একটু বড় হবো। তোমার দাদা আমাকে একদিন ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বের হলেন। আমি তো মহাখুশি। অনেকদিন বাদে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি! ভেবেছিলাম,কত সুন্দর জায়গাতেই না যাবো। অথচ কীসের কী। তোমার দাদা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা জঙ্গলে। এমন গভীর জঙ্গল আমার জীবনেও আমি দেখিনি। মাটিতে পা রাখা দায়। মাথা তুলে আকাশ দেখা দায়। দিন দুপুরেও যেন কোনো ভয়ানক রাত নেমে এসেছে! প্রচুর ঘাবড়ে গেলাম, অপ্রস্তুত হলাম কিন্তু মনে সাহস হারালাম না। ড্যাডের হাত ধরে সামলে পথ চলতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা থামলাম। ড্যাড আশেপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়লেন। তারপর মাটির একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে ফুঁ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটি ফাঁক হয়ে সিড়ির দেখা পেলাম। বিশ্বাস করো,জীবনে ওই প্রথম আমি এতোটা হতবাক হয়েছিলাম, যা বলার মতো না! ড্যাড আমাকে একটুও কাছ ছাড়া করলেন না। আঙুল ধরে নিচে নামালেন। পুনরায় ফুঁ দিলে মাটির গহ্বর বন্ধ হয়ে গেল। উপর থেকে দেখলে কেউ বুঝবেই না আমরা নিচে আছি! আমি অবাক চোখে শুধু চেয়ে রইলাম। এরপর প্রায় ৩২ টা দরজা পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম কাঙ্ক্ষিত রুমে। যেখানে ছয়টা ছায়া মূর্তির মধ্যিখানে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছিল এই পাথরটি, ‘ব্লাড স্টোন’। এছাড়াও সেখানে পাহারার জন্য ছিল ২০০ টি বাঁদুর। আমি এতোটাই অবাক হয়েছিলাম, যা তোমাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তোমার মতো আমার মনেও একই প্রশ্ন জেগেছিল, একটা সামান্য পাথরকে এত কড়া পাহারার ভেতর রাখার কী প্রয়োজন! ড্যাডকে প্রশ্ন করতে হয়নি। তার আগেই তিনি আমাকে সব খুলে বলেছিলেন।

শুধু আমরাই না, পুরো ভ্যাম্পায়ার জাতির জীবনের মূল উৎস এই পাথরটি। যাকে তুমি তুচ্ছ নজরে দেখছো। এই পাথরটির গায়ে যদি সামান্য তম আঁচ এসে লাগে তবে আমাদের জাতির এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এটাকে তুমি ভেঙে দিতে চাইছো ম্যাক্স? বলতে পারো, আমাদের জীবন, আমাদের শক্তি, এই একটি পাথরের ভেতর নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। বিধাতা আমাদের সবদিক থেকে শক্তিশালী করলেও এদিক থেকে দুর্বল বানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই পাথরটি এমন এমন কাজ করতে পারে যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না ম্যাক্স। যখন ঘোর সংকট,কোনোদিকে কোনো পথ খোলা পাবে না, তখন একমাত্র এইটিই পারবে তোমার বিপদ উদ্ধার করতে। আর তুমি এটাকেই হেলাফেলা করলে! আমাদের চৌদ্দ পুরুষ একে রক্ষা করে এসেছে। আমাদের জোশ দেখে বিধাতা খুশি হয়েছেন। তাই আগামী চৌদ্দ পুরুষ ও এটি আমাদের দখলেই থাকবে। শুধু আর্নিশ বংশের দখলে। এটি আমাদের জন্য কতবড় পাওয়া, তুমি ভাবতে পারো ম্যাক্স? আর এ কারণেই আমাদের শত্রু নেহাতই কম নয়। ‘ব্লাড স্টোন’ যার কাছেই থাকবে,তার চেয়ে শক্তিশালী আর কারো হবার উপায় নেই। তাই আমাদের শত্রুরা সর্বক্ষণ ওঁৎ পেতে থাকে এটিকে চুরির উদ্দেশ্যে। এর আগে বহুবার এটি চুরি হয়েছে। ফিরিয়েও এনেছি আমরা যুদ্ধ করে। হয়তো ভবিষ্যতেও এরকম বহু যুদ্ধ আমাদের করে যেতে হবে টিকে থাকার জন্য, ‘ব্লাড স্টোন’ কে রক্ষা করার জন্য। আজকে তোমার দাদা শহীদ হলেন, একদিন আমিও হয়তো চলে যাবো এমন করেই। আমার পরে তুমি এই বংশের রাজা হবে ম্যাক্স। তাই তোমার একমাত্র দায়িত্ব একে রক্ষা করা। তাতে যদি জীবন যায়, যাবে। তবুও এর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচ আসতে দেবে না ম্যাক্স, কথা দাও।’

ম্যাক্স হতভম্ব হয়ে চেয়ে ছিল, মালোকোর কথা শেষ হতে তার ধ্যান ভাঙলো। সে অবিশ্বাস্য চোখে ‘ব্লাড স্টোন’ এর দিকে তাকাল। এতক্ষণ যাকে সামান্য একটা পাথর দেখাচ্ছিল, এখন তাকে দেখতে ভয় লাগছে ম্যাক্সের। এই পাথরের এত ক্ষমতা! এর জন্যই টিকে আছে ওদের পুরো জগত,জাতিটা! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!

মালোকো ছেলের তরফ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে ফের প্রশ্ন করল,
-‘কী হলো ম্যাক্স? জবাব দিচ্ছো না কেন? নাকি তুমি তৈরি না এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য?’
ম্যাক্স সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত মাথা ঝাঁকালো। মালোকোর হাত থেকে ভয়ে ভয়ে ‘ব্লাড স্টোন’ নিজের হাতে নিয়ে বলল,
-‘আ…আমি তৈরি। আমি সত্যিই তৈরি।’
মালোকোর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসে ফুঁটে উঠে। সে জানে,তার ছেলে তাদেরই র’ক্তের ধারা বহমান রাখবে। তাদের মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান কখনো অক্ষুণ্ণ হতে দেবে না। ম্যাক্স যোগ্য। তার পরে আর্নিশ বংশের হাল ধরার জন্য।

(বর্তমান)

একটা নদী। অন্যান্য আর দশটা স্বাভাবিক নদীর চাইতে এর বৈশিষ্ট্য সামান্য আলাদা। এই নদীর পানির স্থিরতা হয় না কখনো। সারাদিন কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলে তীব্র স্রোত নিয়ে। ভ্যাম্পায়ার অথবা সামুদ্রিক জীব ছাড়া আর কারো এই নদী ডিঙিয়ে ওপারের জগতে প্রবেশ করা শুধু কঠিনই না, দুঃসাধ্য বলা চলে। তাই তো যুগ যুগ ধরে শত্রুদের প্রত্যক্ষ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে চলেছে আর্নিশ বংশের সকলেই। তবুও মাঝে মাঝে ‘ব্লাড স্টোন’ চুরির পরোক্ষ আক্রমণ টা ভাবিয়ে তোলে সবাইকে।

ম্যাক্স প্রায় বাতাসের গতিতে ছুটে এসেছে। মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে এবার খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিলো। মূল ফটকে দু’জন দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে। তারা ম্যাক্সকে দেখামাত্র কপালে হাত উঠিয়ে সালাম ঠুকলো। এটাকে ঠিক সালামও বলা চলে না। সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে কুর্নিশ করা আর কী। ম্যাক্স ঘাড় নাড়িয়ে কিছু না বলেই ভেতরেই পা রাখে। অনেকক্ষণ ধরে বুকের ভেতরে যে ঝড়টা লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছিলো সবকিছু, তা যেন নিমিষেই থেমে গেল। একটু স্বস্তি এবং অনেকখানি আশা সূর্যের রশ্মির ন্যায় জেগে উঠল মন আকাশে। কথা আছে, নিজ বাড়িই নিরাপদ এবং আরামদায়ক হয় সবচেয়ে বেশি। তাই নিজের ঘরে ফিরে এলে যত কষ্টই থাকুক,কিছুটা হলেও লাঘব হয় তা।

দূর পাহাড়ের খাঁজে বিশাল প্যালেসটাই ম্যাক্সদের বাড়ি। ওখানে বাবা-মা সহ ৮ জন দাস-দাসী থাকে। ম্যাক্স বাড়িতে প্রবেশ করে। মালোকো উপরে, হল ঘরে আলিজা বসে কিছু একটা করছিলেন। ছেলেকে দেখতে পেয়ে কিছুটা খুশি এবং অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে হাতের কাজ ফেলে দ্রুত এগিয়ে এলেন।

-‘ম্যাক্স, তুই?’

ম্যাক্স মলিন মুখে অল্প একটু হাসল।
-‘আমাকে দেখে এত অবাক হওয়ার কী আছে মম?’
ম্যাক্স প্রশ্ন করে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল। পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘ড্যাড কই?’
-‘আছে ঘরেই। আমি ডেকে দিচ্ছি। তুই বস না। কী খাবি, বল? ছাগলের গরম গরম র’ক্ত আনা হয়েছে। খাবি, দেবো?’
জিভে জল চলে এলেও নিজেকে সংবরণ করল ম্যাক্স। প্রতিজ্ঞা নিয়েছে, জুলিয়াকে বিপদ থেকে উদ্ধার না করা অবধি এক ফোঁটা র’ক্ত সে মুখে তুলবে না। তাই আলিজাকে বলল,
-‘নো মম। ড্যাডকে ডাকো।’
আলিজার চোখেমুখে বিস্ময়তার পাশাপাশি একটা চাপা উদ্বেগ ও দেখা দিলো।
-‘কী হয়েছে? কোনো বিপদ..’
-‘ড্যাডকে ডাকো প্লিজ!’
আলিজার কথার মাঝেই নিজের কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে ম্যাক্স। সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। আলিজা দ্রুত পায়ে মালোকোকে ডাকতে ছুটলেন। ম্যাক্সের চোখমুখ বলছে,বড় কোনো সমস্যা হয়েছে।

আলিজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মালোকো পিঠ টান টান করে বসে রয়েছেন। আর ম্যাক্স একটু দূরে মাথা নিচু করে রেখেছে। বাবা-মা নিজের অপারগতার কথা বলতে গিয়ে লজ্জায়, হতাশায়, মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। বড় ভাই হয়েও বোনের জন্য কিছু করতে না পেরে ছুটে এসেছে সে এখানে! এরচেয়ে অপমান আর কী হতে পারে?

ম্যাক্স মাথা তুলে জোরালো কণ্ঠে বলল,
-‘আমি যোগ্য নই ড্যাড। তোমার ধারণা ভুল ছিল আমাকে নিয়ে। আমার কোনো যোগ্যতাই নেই এই বংশের রাজা হওয়ার। আমি…আমি আমার বোনকেই সুরক্ষা দিতে পারলাম না। তাহলে ‘ব্লাড স্টোন’ কে কী করে সুরক্ষিত রাখবো?’
প্রতিটি শব্দে হতাশা মেশানো। মালোকো ছেলের কথার পিঠে বললেন,
-‘আমি জানি, যদি কেউ যোগ্য হয়ে থাকে তবে সেটা তুমিই। তাই তো বোনকে বিপদে একা ফেলে হারিয়ে যেতে পারোনি। বরং যখন সব পথ বন্ধ পেয়েছো তখন চলে এসেছো শেষ উপায় অবলম্বন করতে। যদিও তুমি জানো, এরচেয়ে রিস্কি আর কিছু হতে পারে না।’
-‘আমি কী করব ড্যাড? ওই লাইটগুলো… ওগুলো না থাকলে আমি ঠিক ছাড়িয়ে নিয়ে আসতাম জুলিয়াকে। আর ওই হা’রাম’জাদাকে পিষে রেখে আসতাম মাটিতে.. ওর ওই অন্ধকার কুঠুরিতে ওকে পু’তে রেখে আসতাম।’

শেষের বাক্যগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সের গলার স্বর কেঁপে উঠে। দাঁত কিড়মিড় করে সে। তার চোখে আগুন ক্রোধ স্পষ্ট। মালোকো বললেন,
-‘সামলাও নিজেকে। রাগ ভালো তবে অতিরিক্ত নয়। তোমার পরিকল্পনা এক মুহূর্তে বানচাল করার জন্য এই রাগই যথেষ্ট।’
ম্যাক্স দীর্ঘশ্বাস চাপিয়ে চুপ করে গেল।
মালোকো বললেন,
-‘এখন বলো, কী চাচ্ছো তুমি? ‘ব্লাড স্টোন’ নিতে? তাই তো?’
-‘এছাড়া..’ ম্যাক্স মাথা তুলে তাকায়, কথাটুকু শেষ করে, ‘আর কী কোনো উপায় আছে ড্যাড?’
মালোকো এক মুহুর্ত নিরব থেকে বলল,
-‘কিন্তু আমি তোমাকে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিতে পারবো না ম্যাক্স।’

ম্যাক্স,আলিজা দু’জনেই অবাক হয়ে বড় চোখ করে তাকায়। মালোকো ঢোক চেপে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বললেন,
-‘জুলিয়া আমার মেয়ে। আমি ওর বাবা। কিন্তু তার আগে আমি এই বংশের রাজা। আর রাজা হয়ে আমি পুরো বংশের সবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারব না। আমি কোনো ভরসাতেই ‘ব্লাড স্টোন’ কে ঝুঁকিতে ফেলতে পারব না।’
-‘তুমি এসব কী বলছো মালোকো?’ এতক্ষণ পর আলিজা কথা বললেন, তার চোখেমুখে একই সঙ্গে ক্রোধ, বিস্ময়, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’
মালোকো নরম সুরে জবাব দেন,
-‘আমার মাথা ঠিক আছে বলেই আমি ভেবেচিন্তে আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।’
-‘ড্যাড,জুলিয়াকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র ‘ব্লাড স্টোন’ ই পারবে ওই আলো গুলোকে ফিঁকে করে তুলতে। ড্যাড প্লিজ..’
-‘আর যদি ওখানে গিয়ে কোনোভাবে ‘ব্লাড স্টোন’ হারিয়ে ফেলো তুমি, তখন? কী হবে ম্যাক্স? ভাবছো একবারও?’
ম্যাক্স কথা বলতে পারল না। তার মাথাটা পুনরায় নিচু হয়ে গেল। নিজের প্রতি নিজের রাগ, ক্রোধ, হতাশা- সব একত্রেই অনুভব করল সে।

আলিজা তেজ পূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন,
-‘এর মানে তুমি তোমার মেয়েকে ম’রতে দেখতে চাও? তাই তো মালোকো? তাই তো?’
-‘আমি..আমার কথাটা একবার বোঝো আলিজা। আমি কেমন করে সবার জীবন… ‘
-‘রাখো আর সবার কথা। তোমার মেয়ে একজন সাইকোর হাতে বন্দী! ওই আলো গুলো আমাদের জন্য কতটা ভয়ানক তা কী তুমি জানো না? সেই আলোর মাঝে আমার মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করে কাতরাচ্ছে। আর তুমি আছো বংশের অন্য সবার জীবন নিয়ে? তুমি কী সত্যিই ওর পিতা মালোকো?’

মালোকো হঠাৎই গলার স্বর শক্ত করে বললেন,
-‘তুমি আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো। কিন্তু আমি ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে যাওয়ার আদেশ কিছুতেই দিতে পারব না। আমরা অন্য কোনো উপায় বের করব আলিজা। তুমি একটু শান্ত হও প্লিজ!’
-‘শান্ত হবো? তুমিও কী ভালো করে জানো না ওসব আলোর সামনে একমাত্র ‘ব্লাড স্টোন’ই কাজে আসবে। এছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। জানো না তুমি?’

আলিজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। ম্যাক্স ছুটে এসে মালোকোর পায়ের কাছটায় বসল। ভেজা কণ্ঠে বলে,
-‘আদেশ দাও ড্যাড, প্লিজ আদেশ দাও। নইলে জুলিয়া..আর বাঁচাতে পারব না ওকে। একবার নিয়ে যেতে দাও আমাকে। কথা দিচ্ছি, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষা করব। আমাদের জাতির জীবন আমি হুমকির মুখে ফেলব না। আমাকে আদেশ দাও বাবা। প্লিজ, একবার আদেশ দাও।’

আলিজা দৌড়ে গেলেন হুট করে। তিন তলার একটি বন্ধ ঘরে ঢুকে রূপার বাক্স থেকে সোনালী রঙের চা’কু বের করে আনেন। এই চা’কু একবার যার বুকে ঢুকবে,তার জীবন নিশ্চিত শেষ। চা’কুটি নিয়ে এসে তিনি মালোকোর সামনে দাঁড়ালেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-‘যদি তুমি আদেশ না দাও মালোকো, আমি এই চা’কু দিয়ে নিজেকে আঘাত করতে দুইবার ভাববো না।’
মালোকো একবার ম্যাক্সের দিকে তাকালেন, একবার আলিজার দিকে। বেশ কয়েকবার ছেলে ও স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে রাজী হলেন ‘ব্লাড স্টোন’ ম্যাক্সের হাতে তুলে দেওয়ার। তবে শর্ত একটাই, ‘ব্লাড স্টোন’ যেভাবে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যদি এর কিছু হয়, তবে এর প্রায়শ্চিত্ত ম্যাক্স নিজের জীবন দিয়েও শোধ করতে পারবে না।
ম্যাক্স রাজী হয়। সে কথা দিলো, জুলিয়া এবং ‘ব্লাড স্টোন’ দুটোকেই ঠিকঠাক ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে সে। সেই সঙ্গে মনে মনে আরও একটি প্রতিজ্ঞা করল, ‘লাবণী, তোমাকেও আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসবো আর এরপর কক্ষনো কোনো বিপদে পড়তে দেবো না। কথা দিচ্ছি।’

-‘মালিক, গ্রাম বাসীরা ফুঁসে উঠেছে। তারা খবর পেয়ে গেছে রাজকুমার ‘ব্লাড স্টোন’ নেওয়ার জন্য এসেছে। সবাই বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। রীতিমতো চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে গেছে।’
একজন দাস দৌড়ে এসে কথাগুলো জানালো। মালোকো,আলিজা এবং ম্যাক্স- উপস্থিত তিনজনই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। মালোকো মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিল, ঠিক সেটাই বাস্তবে রূপ নিলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। তাদের ভেতরকার কথা এতদ্রুত কে ছড়ালো গ্রামবাসীদের ভেতরে?
আলিজা ফুঁসে উঠে বললেন,
-‘দেখলে মালোকো, তাদের রাজার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই। কতবার স্বার্থপর এবং ছোটলোক এরা!’
মালোকো হাত উঁচু করে বিরক্তি ভরা স্বরে আলিজাকে থামতে নির্দেশ দিলেন। বললেন,
-‘ওরা একদম ঠিক কাজটাই করছে। আমাদের মেয়ে বলে আমরা জীবনের পরোয়া করছি না। কিন্তু ওরা ওদের জীবনের পরোয়া করে। একটা জুলিয়া গেলে কী আসবে যাবে তাতে। অথচ ‘ব্লাড স্টোন’ এর কিছু হলে লাখ-কোটি র’ক্তচোষাদের জীবন নাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
আলিজা প্রত্যুত্তর করতে নিচ্ছিলো, তার আগে ম্যাক্স বলে উঠল,
-‘ড্যাড, আমি গিয়ে সবাইকে বোঝাচ্ছি। আমার কথা তারা নিশ্চয়ই বুঝবে।’
কথা শেষ করেই ম্যাক্স ছুটে চলল বাহিরে। পেছন থেকে ম্যাক্সের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে মালোকো এবং আলিজাও ছুটলো।

উঠোন জুড়ে উপস্থিত জনতার ভীড়। একজনের ঘাড় টপকে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে যেন। ম্যাক্স প্রাসাদের সম্মুখে সবচেয়ে বড় বারান্দায় উঠে দাঁড়ায়। তাকে দেখামাত্র সবার মধ্যে হৈচৈ কলরব বেড়ে উঠে। ম্যাক্স হাত উঁচু করে সবাইকে থামতে বললেও কেউ তার কথা পরোয়া করল না। অবস্থা বেগতিক, ম্যাক্স বুঝতে পারছে এখানেও ঝামেলা হতে দেড়ি নেই। সে হাত উঁচু করে হাতজোড় করে। গলার স্বর অসম্ভব রকমের তীব্র করে চিৎকার ছুঁড়ে দিলো।

-‘আপনারা সবাই চুপ করুন৷ প্লিজ চুপ করুন৷ আমার কথাটা একটু শুনুন।’

এবার অনেকেই চুপ করে গেল। তবে কারো চোখেমুখে বিন্দুমাত্র নরমতা নেই। সবাই ক্ষুব্ধ৷ রাগ নিয়ে চেয়ে রয়েছে ম্যাক্সের পানে। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস টাকে কোনোভাবেই লুকোতে পারে না ম্যাক্স। সে আকুতির সুরে বলল,
-‘আমি জানি না কে আপনাদের খবর দিয়েছে যে আমি ‘ব্লাড স্টোন’ নিতে এসেছি। আমি সত্যিই নিতে এসেছি কিন্তু আপনাদের রাজকুমারীর জীবন বাঁচাতে। তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেই আমি আবার জায়গা মতোন জিনিসটা রেখে দেবো। কথা দিচ্ছি, এতটুকু ক্ষতি আমি হতে দেবো না ‘ব্লাড স্টোন’ এর। আমার উপর একটু ভরসা করুন।’

-‘ভরসা? যে নিজের বোনকে বাঁচাতে পারে না, ‘ব্লাড স্টোন’ এর কাছে ছুটে আসে, তাকে আবার কীসের ভরসা করব?’

উপস্থিত জনতাদের ভেতর থেকে কেউ একজন কথাখানা ছুঁড়ে মারলো তীব্র বিদ্রুপ নিয়ে৷ ম্যাক্স গায়ে মাখালো না। পূর্বের ন্যায় অনুরোধ করে বলল,
-‘আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে এমনভাবে আঁটকে রেখেছে যে ‘ব্লাড স্টোন’ ছাড়া আর কোনো গতি নেই।’
-‘রাজকুমার, আপনার বোনের জন্য আমরা আমাদের সবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। শুধু আমরা কেন, আমাদের অন্য বংশ গুলোও এই অন্যায় মেনে নেবে না৷ ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর আরোপিত বলে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। একদিকে রাজকুমারী,অন্যদিকে আমরা সবাই- লাখো-কোটি র’ক্তচোষার দল। এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন যে কী করবেন। আমরা কোনোভাবেই আমাদের জীবন বাজি রাখতে চাচ্ছি না।’

রুক্ষ স্বরে কথার বাণ ছুটে এসে বিদ্ধ করল ম্যাক্সের বুক। এই এদের জন্য তার দাদা,পরদাদা সহ গোষ্ঠীর আরও অনেকেই জীবন দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন৷ তার বাবা এবং সেও একই লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে। অথচ এদের তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই! সবাই শুধু নিজেকে নিয়েই পড়ে আছে!

ম্যাক্স এবার গলায় খানিকটা কাঠিন্য যুক্ত করে বলল,
-‘তাহলে এই যদি হয় তোমাদের শেষ সিদ্ধান্ত, তবে আমার শেষ সিদ্ধান্ত ও শুনে রাখো। আমি আমার বোনকে বাঁচাবোই। ‘ব্লাড স্টোন’ কেও নিয়ে যাবো এবং ঠিকঠাক ভাবে ফেরতও নিয়ে আসবো। সাহস থাকলে আমাকে থামাও। এসো,কে আসবে আমার সামনে, এসো!’

ম্যাক্সের হুংকার শুনে গুটিকয়েক ভ্যাম্পায়ার ভয়ে পিছিয়ে গেলেও হৈহৈ করে একদল ভ্যাম্পায়ার আগুন চোখ নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। ম্যাক্স নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। মনে মনে আওড়ে যায় শেখানো মন্ত্র। তারপর চোখ খুলতেই দেখা যায়, টকটকে লাল বর্ণের একজোড়া মণি, যেন সবকিছু ভস্ম করে দেওয়া আগুন খেলা করছে ওর ভেতরে। ঠিক তখনই ম্যাক্সের ঘাড়ে একটা হাত পড়ল। তাকে ঝাঁকি দিয়ে রীতিমতো ধমকের সুরে বলল,
-‘কী করছ ম্যাক্স? এরা তোমার স্বজাতি,তোমার ভাই। ভুলে গেছো?’
ম্যাক্স হুশ ফিরে পায়। পেছন ফিরে মালোকোকে দেখতে পেয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলল। হতাশ গলায় বলল,
-‘আমি কী করব ড্যাড? এরা যে আমাকে কোনোভাবেই ভরসা করছে না। আমি যে এদের বোঝাতে পারছি না। এরা যুদ্ধ চায়, তাহলে হোক যুদ্ধ।’
-‘পাগল হয়ো না। আমি এখনো জীবিত আছি।’

ছেলেকে শান্ত করে মালোকো এগিয়ে গেলেন। উপস্থিত জনতাদের বোঝানোর শেষ চেষ্টাটুকু করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন। কেউ তো বুঝলোই না উল্টো রাজা এবং রাজ বংশের সকলকে বন্দী করার কথা বলল সকলেই এক যোগে। মালোকো বুঝতে পারলেন, জীবন নাশের শংকার জন্যেই সবাই এতোটা ক্ষেপে উঠেছে। এদের বোঝানো যাবে না। ঠান্ডা ও করা যাবে না। একদিকে নিজের র’ক্তের সন্তান, অপরদিকে আর্নিশ জগত বাসী। কোথায় যাবেন মালোকো! কোন পক্ষকে সমর্থন জানাবেন? দু’পক্ষই যে যার যার তরফ থেকে সঠিক!

ম্যাক্স জোরালো কণ্ঠে বলল,
-‘ড্যাড, এরা বুঝবে না। সব কয়টা স্বার্থপর। দেখছো না নিজেদের চিন্তায় বিভোর সবাই। আমার বোনের জীবন নিয়ে কেউ ভাবছে না।’
-‘এটাই কী স্বাভাবিক নয় ম্যাক্স?’
বললেন মালোকো।
ম্যাক্স তেজী গলায় বলল,
-‘আমি এত কিছু জানি না ড্যাড। আমি আমার বোনকে মৃ’ত্যুর মুখে ফেলে চলে আসতে পারবো না। আমার বোনের মৃ’ত্যু অবধারিত যদি সে ওখানে থাকে। এখানে এদের বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করারও মানে হয় না। তুমি এদিকটা সামলাও, আমি চললাম।’
-‘ম্যাক্স!’
-‘আমার কসম লাগে ড্যাড, তোমাকে আমার এই উপকার টুকু করতেই হবে।’

মালোকো ম্যাক্সের এহেন কথা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কোনোটাই প্রত্যুত্তরে বলতে পারলেন না। তার আগেই ম্যাক্স ছুটে চলল পেছনের রাস্তার দিকে। এই দিকের পথ দিয়ে সে সোজা চলে যাবে সেখানে যেখানে লুকিয়ে আছে ‘ব্লাড স্টোন’ আর তারপর জুলিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে সে।

মালোকো উপস্থিত জনতাদের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন। তিনি জানেন, খুব বেশি হলে তিরিশ মিনিট, এরপরই সবাই জেনে যাবে ম্যাক্স পালিয়েছে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে। আর তারপর কেউ তো তার কোনো কথা শুনবেই না বরং তাকে এবং তার স্ত্রীকে রাজবন্দী করা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না ম্যাক্স তাদের হাতে এনে দেবে ‘ব্লাড স্টোন’। সেই সঙ্গে কথার বরখেলাপ ও প্রতারণা করার অপরাধে তাদের উপর আরোপিত দায়িত্ব বদলে লানত ও অভিশাপ বর্ষিত হতে শত শত বছর ধরে। তবুও মালোকো নিরুপায়। আগাম ভবিষ্যৎ জেনেও তিনি সবকিছু মেনে নিলেন একমাত্র ছেলের খাতিরে। ম্যাক্সকে তিনি বড় ভালোবাসেন, ঠিক যেমন ম্যাক্স ভালোবাসে তার ছোট বোন জুলিয়াকে!

(চলবে)
[পরশুদিন শেষ পর্বের ২য় অংশ পেয়ে যাবেন। এবং ২য় পরিচ্ছদ আবার কবে নাগাদ শুরু করব তাও আমি পরশুদিন জানিয়ে দেবো ইনশা আল্লাহ। আজকের পর্ব পড়ে কার কী অনুভূতি, জানাবেন।]#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_১১ (শেষ পর্ব – ২য় অংশ)
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

পিটপিট করে চোখ খুলতেই চোখ ধাঁধানো আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করল লাবণী। আলোর তীব্রতায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। কপালে পড়া ঈষৎ কয়েকটি ভাঁজ এবং ঠোঁটের কুঁচকানি জানান দিলো, তার হুশ ফিরে এসেছে। স্মৃতির পাতায় কয়েক ঘন্টা আগের ঘটা ঘটনাগুলো এক এক করে হৈচৈ লাগাতেই সে অস্পষ্ট কণ্ঠে ডেকে উঠে,
-‘আপু!’
সে আশা করেছিল, কোনো জবাব আসবে না। এখানে নিশ্চিত সে একা। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পরিচিত কণ্ঠটি নড়ে উঠল তৎক্ষনাৎ।
-‘লাবণী? লাবণী তুমি উঠেছো? থ্যাংক গড!’
লাবণী ঝট করে চোখ খুলল। এবার আলোর তীব্রতা কমে এলো তার কাছে। চোখে সয়ে গেছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে অপরিচিত কাউকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই জুলিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করতে চমকে উঠল। জুলিয়ার চেহারার অবস্থা করুণ,অনেকটাই রুগ্ন লাগছে তাকে। সেই সাথে চোখের উপর কিছু একটা বেঁধে রেখেছে। লাবণী ভাবল, নিশ্চয়ই শয়তানের দল গুলো এই কাজ করেছে। জুলিয়ার চোখ বেঁধে দিয়েছে। সে দ্রুত জুলিয়ার চোখের পট্টি খুলতে হাত বাড়ালে, জুলিয়া বুঝতে পেরে হৈহৈ করে উঠল।
-‘আরে আরে,করছ কী! স্টপ লাবণী। প্লিজ।’
লাবণী বিব্র‍ত ভঙ্গিতে সরে গেল। জুলিয়া রুক্ষতার সহিত বলল,
-‘এই পট্টি খুললেই আমি অন্ধ হয়ে যাবো লাবণী।’
-‘অন্ধ হয়ে যাবেন! অন্ধ কেন হবেন?’
নিজের বিস্ময়তা লুকোতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সে। জুলিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-‘আমি কয়েকটা কথা কনফেস করতে চাই তোমার কাছে। কিন্তু তার আগে তোমার থেকে কিছু উত্তর জানতে চাই। আমি যা যা প্রশ্ন করব, তুমি তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?’
লাবণী উৎসুক হয়ে উঠেছে। জুলিয়া তাকে কী বলতে চায়! তা আক্ষরিক অর্থে ধরতে না পারলেও নিজের ভেতরকার সমস্ত কথাগুলো সত্য আকারেই তার সামনে পেশ করতে মন সায় জানাচ্ছে।
লাবণী উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বলল,
-‘হুম। বলেন।’
কোনোপ্রকার ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন-উত্তরের পর্বমালা শুরু করে জুলিয়া।
-‘তুমি কে?’
আকস্মিক এ ধরনের প্রশ্নে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে লাবণী। একই সঙ্গে হতবিহ্বল।
হতভম্ব হয়ে যাওয়া গলায় তোতলাতে তোতলাতে উত্তর করে,
-‘আ..আমি..আমি লাবণী। মানে..আর কী পরিচয় দেবো আমার?’
-‘তোমার সম্পর্কে সব কথা বলো। তুমি কোথা থেকে এসেছো, কেন এসেছো, আগে কোথায় থাকতে, ওখানটা কেন ছেড়ে এসেছো, আর তুমি নাকি ভাইয়াকে বলেছো, তোমার কেউ নেই। সব মানুষেরই পরিবার থাকে। তাহলে তোমার পরিবার কোথায়?’

এক সঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন শুনে লাবণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সেই সঙ্গে অতীতের জ্বালাময়ী চ্যাপ্টার গুলো একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছে,এই যে,এই তো মাজহাবের বিয়ে হচ্ছে মহুয়ার সঙ্গে। মঞ্চের উপর দু’জনে জোড়া সেজে বসে রয়েছে কত সুন্দর ভাবে!
লুকোতে চাইলে অনেক কিছু লুকানো যায়। কিন্তু কেন যেন জুলিয়ার তোপে পড়েও কোনোকিছু লুকোতে ইচ্ছে করল না লাবণীর। খাঁচা টা স্টিলের তৈরি। মেঝে পরিষ্কার। লাবণী সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে বলতে শুরু করল,

-‘আমি লাবণী। আমার বাবা-মা কে,জানি না। আমি থাকতাম এক গায়ে, এক মামার বাড়িতে। সে আমার আপন মামা কীনা তাও জানি না। তবে বুঝ হওয়ার পর থেকেই তাকে দেখেছি, আমার দেখভাল করতে। তাদের গোয়াল ঘরে শোয়ার স্থান টুকু এবং প্রতি বেলায় একটু আহার করার বিনিময়ে তাদের ঘরের, ক্ষেতের প্রায় সমস্ত কাজ আমি করে দিতাম। সেখানেই আমার শ্বাশুড়ি আলেয়া খাতুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি কেন গিয়েছিলেন ওই গ্রামে আমি জানি না। আমি ক্ষেতে কাজ করছিলাম, তখন নাকি তিনি আমাকে দেখেন। আমার প্রতি তার মায়া হয়। ওই মামার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমাকে নিয়ে আসেন নিজের সঙ্গে। তারপর আস্তেধীরে শহরের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখি। শুদ্ধ ভাষাটা রপ্ত করি। কমবেশ সবকিছুই আমি রপ্ত করতে পেরেছিলাম, শুধু স্বামীর মন ছাড়া। আমার শ্বাশুড়িই তার মেজো ছেলের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়ে যান উনার মৃত্যুর আগে আগে। উনি যতদিন ছিলেন আমি সম্মানের সহিত ওই বাড়িতে ছিলাম। যেই না উনি চলে গেলেন, আমার আসল স্থান কোথায়, তা সবাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগল। আমার স্বামীর আমার মতো ক্ষেত,গেঁয়ো,আনস্মার্ট কাউকে দিয়ে জীবন চলবে না তাই তিনি পুনরায় দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় বিয়ের পর আমাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলা হলো। আমার তো কেউ নেই,কোথায় যাবো? কাউকে চিনি না,জানি না। তখন আমার বড় ভাবী, মানে আমার স্বামীর বড় ভাইয়ের বউ,আমাকে বলল,তার চাচা বিদেশে কাজের লোক পাঠান। আমি চাইলে আমার জন্যেও ব্যবস্থা করে দিবে। আমি রাজী হয়ে গেলাম। এছাড়া তো আর কোনো পথ ছিল না। এভাবেই আপনাদের কাছে এসে পৌঁছালাম। এরচেয়ে বেশি আমার ব্যাপারে বলার মতো আর কিছুই নেই আপু।’

লাবণী থামলো। তার চোখদুটো ছলছল করছে রাগে,দুঃখে,অপমানে। একটা বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবত কোনো কুকুর থাকলেও তার সাথে এভাবে ব্যবহার হয় না যেভাবে লাবণীর সাথে করা হয়েছে এবং তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

জুলিয়া ছোট্ট করে বলল,
-‘ওহ।’
পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল। লাবণীকে দেখতে পারছে না সে, তবে লাবণীর মনের অবস্থাটা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছে। কথাগুলো বলার সময় তার গলার স্বরের তারতম্য বলে দিয়েছে,প্রতিটি কথা সত্য। এক বিন্দু মিথ্যে নেই এতে। এর মানে এই দাঁড়ায়,লাবণী সহজ-সরল সাধারণ একজন মানুষ। যার আগেপিছে কোনো কিছুই নেই জুলিয়াদের প্রতি। সে স্রেফ একজন কাজের লোক হিসেবেই এসেছে ওদের বাড়িতে।

নিরবতা ধীরেদ ধীরে গ্রাস করে নিলো তাদের দু’জনকে। প্রহর গুলো খুব লম্বা মনে হতে লাগল। লাবণী চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, জুলিয়া চুপ করে বসে রয়েছে। আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কার্নিশে জমা জল ফোঁটা গুলো মুছে নিয়ে লাবণী বলল,
-‘আপু,আপনি কী যেন বলবেন বলছিলেন।’
-‘উম?’ নড়েচড়ে বসে জুলিয়া। নিজের ভাবনার জগতটাকে আপাতত স্থগিত রেখে সে উপরনিচ মাথা দোলাতে শুরু করে। হালকা গলায় জবাব দেয়,
-‘বলব। তার আগে তোমাকে একটা ওয়াদা করতে হবে। সবকিছু জানার পর আমাকে বা আমার পরিবারকে মোটেও ভয় করতে পারবে না তুমি। আমরা কাউকে নিজ থেকে ক্ষতি করি না। তোমাকে এইসব কিছু জানানোরও কোনো ইচ্ছে আমার নেই৷ কিন্তু এখন তোমার থেকে যেসব সাহায্য আমার প্রয়োজন, তা করতে গেলে তুমি হাজারটা প্রশ্ন করবে। তাই শুরুতেই সব বলে দিতে চাইছি। আর হ্যাঁ, এই কথাগুলো তুমি ব্যতীত আর কেউ যেন না জানে। কেউ না। লাবণী, গট ইট? কেউ না!’

চমকের উপর চমক যেন আজ অপেক্ষা করছে লাবণীর জন্য। অস্ফুটস্বরে ঠোঁট চিঁড়ে বেরিয়ে আসে,
-‘আচ্ছা।’
পরমুহূর্তেই সব শান্ত,নিস্তব্ধ। লাবণী চোখ গোল করে তাকিয়ে রয়েছে রহস্যময়ী কিছু শোনার জন্য। এই পরিবারটাকে একটু হলেও অদ্ভুত লেগেছিল তার। এখন হতে পারে সেই রহস্যের সবকিছু খোলাসা হতে চলেছে।

জুলিয়া শক্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল,
-‘লাবণী, আমি..আমরা মানুষ নই। আমরা র’ক্তচোষা।’

এতটুকু বলতেই লাবণীর চোখজোড়া ছানাবড়া। র’ক্তচোষা মানে কী তা সে জানে না। শুধু ‘আমরা মানুষ নই’ এইটুকু শুনেই তার হাত-পায়ে অসম্ভব কাঁপন ধরে গেল। ছিটকে একটুখানি পিছনে সরে যেতেই জুলিয়া সরল কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘কেন ভয় পাচ্ছো লাবণী? তোমাকে কী আমি কিছু করব? আর প্রথমেই বলেছি না,তোমার কোনো ক্ষতি আমরা করব না। আমি তোমার নড়াচড়া টের পাই চোখে না দেখলেও। লাবণী, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো প্লিজ!’

বুক চিঁড়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজেকে কোনোরকমে ধাতস্থ করে জুলিয়ার বাকি কথাগুলো শোনার জন্য। কম্পমান গলায় বলে,
-‘ব…বলেন।’
জুলিয়া মৃদু স্বরে পুনরায় বলতে শুরু করল,
-‘লাবণী, দেখো, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই এখানে। আমরা মানুষ নই, তাই বলে তোমার কোনো ক্ষতি করব বা আমরা ভয়ংকর এমন কিছু না। আমরা র’ক্তচোষা। আমরা বিভিন্ন প্রাণীর র’ক্ত গ্রহণ করে থাকি। সত্যি বলতে মানুষের র’ক্তও আমাদের অনেক পছন্দ তবে সেটা খুউউউব কম করে থাকি। আমাদের চোখের রঙ,গায়ের রঙ এবং কথাবার্তা,আচার-আচরণে তাই পরিবর্তন আছে৷ আমরা যদি নিজে থেকে পরিচয় না দেই, তবে কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু হ্যাঁ, আমরা যে অদ্ভুত তাতে মানুষের সন্দেহ বাড়বে। লাবণী, আরও একটা কথা, আমরা অতিরিক্ত আলো সহ্য করতে পারি না। যত কম আলো হয়, ততই মঙ্গল। একদম অন্ধকার তো আমাদের খুব পছন্দের।’

-‘এইজন্যেই আপনি ওইসময় বলছিলেন, যে আপনি অন্ধকারে দেখতে পান, তাই না?’
এ পর্যায়ে কথার মাঝখানে ফট করে বলে বসল লাবণী। জুলিয়া মাথা ঝাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ উত্তর করে।
-‘হুম যাক এবার বুঝছো তাহলে।’
-‘ওহ, এই জন্যেই এই আলো গুলো আপনাকে সমস্যায় ফেলেছে। আপনি চোখে পট্টি বেঁধে আছেন, না?’
পুনরায় প্রশ্ন ছোঁড়ে লাবণী। জুলিয়া আপ্লুত কণ্ঠে বলল,
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো, কত দ্রুত সবটা বুঝে গেলে তুমি। ট্যালেন্টেড!’
লাবণী মৃদু শ্বাস ফেলে। ভয়ে ভয়ে একটু এগিয়ে যায় জুলিয়ার দিকে। জুলিয়া তার নড়াচড়ার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলে,
-‘আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না লাবণী৷ ভয় পেও না। এই দেখো..’
বলে নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। লাবণী রয়ে সয়ে সেই হাতের উপর নিজের হাতটা ছোঁয়াতেই জুলিয়া খপ করে ধরে ফেলে। লাবণী কেঁপে উঠল। জুলিয়া হেসে বলল,
-‘আমরা তোমাদের মতোই। সাধারণ, তবে তোমাদের চোখে অন্যরকম, এই যা। বিশ্বাস করো, আমার কাছে তুমি নিরাপদ। এবং আমার পরিবারের কাছেও।’
এতক্ষণ ধরে অন্তর খামচে ধরা ভয় আর ধুকপুকানিটা কিছুটা হলেও কমে একরাশ স্বস্তি ধীরে ধীরে জায়গা দখল করতে শুরু করল।
জুলিয়া বলল,
-‘এবার আমাকে একটা সাহায্য করো প্লিজ। এই আলো গুলো সরিয়ে দাও। নইলে আমি চোখ খুলতে পারব না। আমার সমস্ত শক্তি এই চোখেই।’
-‘হুম। আমি দেখছি।’
লাবণীর প্রত্যুত্তর। সে সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াল, খাঁচার পাশে গিয়ে ছোট ছোট উজ্জ্বল আলো দেওয়া লাইট গুলো সরানোর জন্য হাত বাড়ালো।

মালোকো এবং আলিজাকে বন্দী করা হয়েছে। রাজবন্দী নয়, সাধারণ জনগণকে যেভাবে টেনেহিঁচড়ে, অসম্মানের সহিত বন্দী করা হয়, ঠিক তেমন ভাবে। মালোকো অতি আশ্চর্য হয়ে গেছে এরকম আচরণ দেখে। সে এতোটা নিকৃষ্টতা এবং নিষ্ঠুরতা আশা করেনি। এখন তো মনে হচ্ছে,এতদিন যাদের জন্য ভেবেছিল সে এবং তার দাদা, পরদাদারা- তারা সবাই ভুল করেছে। তারা চিনে যেতে পারেনি আর্নিশ বংশের র’ক্তচোষাদের আসল রূপ, আসল চেহারা।
আলিজা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগে গজগজ করে বললেন,
-‘দেখলে মালোকো, দেখলে তুমি। কাদের জন্য নিজেকে ত্যাগ করে এসেছো এতদিন?’
মালোকো নিস্তরঙ্গ গলায় বললেন,
-‘দেখলাম।’
-‘ম্যাক্সকে একবার ফিরে আসতে দাও, সব ক’টাকে দেখে নেবো আমি।’
-‘একটু চুপ থাকো আলিজা। প্রার্থনা করো,ম্যাক্স যাতে ফিরে আসতে পারে।’
কথাটুকু বলেই মালোকো চুপ হয়ে গেলেন। আলিজা অবাক দৃষ্টিপাত করে বললেন,
-‘তুমি কী বলতে চাইছো মালোকো? এতকিছুর পরও কী আমার ছেলের প্রতি তোমার বিশ্বাস জন্মায় না?’
মালোকো বিরক্তির স্বরে বললেন,
-‘আলিজা, তুমি নিজেও জানো আমার পরে এই বংশের হাল ধরার জন্য যোগ্য যদি কেউ হয়ে থাকে তবে সে ম্যাক্সই। কিন্তু…ওকে আরও সাবধানী হতে হবে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে সেটা যেন না ঘটতে পারে সেই বিষয়ে হুশিয়ার থাকতে হবে।’
-‘আজব কথা বলছো মালোকো। বিপদ কী আসার আগে তোমাকে টেলিফোন করে আসবে যে আমি আসতেছি?’
এত দুশ্চিন্তা ও কঠোর সময়ের মাঝেও আলিজার এমন কথা শুনে মালোকোর অধরে হাসি ফুঁটে উঠে। সে স্ত্রীর দিকে মমতা নিয়ে তাকান। আলিজা রাগে ফুঁসছে। তার নাসিকাপথ বেয়ে ফোঁসফোঁস আওয়াজে গরম বায়ু বেরিয়ে আসছে৷ মালোকো মেকী ভয় পাওয়ার অভিনয়ে বললেন,
-‘ওরি বাপরে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার ঘাড়ে ফুঁটো করতে তোমার দাঁত গুলো হিশহিশ করছে আলিজা।’
আলিজা শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে কারাঘরের ভেতরে থাকা বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে পড়লেন। বললেন,
-‘মালোকো, তোমার এই মজা করার স্বভাবটা আপাতত বন্ধ রাখো। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার ক্লান্ত লাগছে মালোকো।’
মালোকো চোখে স্নেহ নিয়ে স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন। আলিজাকে টেনে তার মাথাটা নিজের বুকের উপরে রেখে আরেক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আশ্বাসের সুরে বললেন,
-‘এখনই ক্লান্ত হয়ে গেলে সামনে কী হবে রাণী? আপনি যে আমার মনের রাণীর পাশাপাশি এই বংশেরও রাণী। আপনাকে যে শক্ত থাকতে হবে। আপনার ছেলে এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখলে তার কী ভালো লাগবে? সে ‘ব্লাড স্টোন’ এবং জুলিয়াকে নিয়ে ফেরা মাত্রই আমরা আমাদের আসনে পুনরায় বসতে পারব৷ আর তখন..দেখে নেবো সব ক’টাকে। সেই পর্যন্ত আপনাকে ধৈর্যের সহিত শক্তভাবে অপেক্ষা করে যেতে হবে রাণী।’
আলিজা প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে শুধু মাথাটা আরেকটু শক্ত করে মালোকোর বুকের ভেতর ঢুকে গেলেন।

থু করে এক দলা থুতু ছুঁড়ে মারে শারু। সে বসে রয়েছে একটা গাছের গুড়ির উপরে। তার কপালের উপর রাগ এবং বিরক্তির মিশ্রণে বেশ কয়েকটি ভাঁজ পড়ে রয়েছে অবহেলায়। তার বা হাতে ধরা সিগারেট, ধোঁয়া উড়ছে লঘু আকারে। শারু অপেক্ষা করছে পরবর্তী চালের। আর কতক্ষণ এখানে এভাবে বসে থাকতে হবে কে জানে। আর সেই-বা কেন আসছে না এখনো? সে তো বলেছিল, ম্যাক্স ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে চলে আসার আগ মুহূর্তেই সে চলে আসবে। নিজ হাতে ম্যাক্সের হাত থেকে ছিনিয়ে নিবে পৃথিবীর অতি দামী ‘ব্লাড স্টোন’ পাথরটি,রত্নটি। তাহলে সে কই? আর কিছুক্ষণ পরই সকাল হবে। রাতের আঁধার ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করেছে। পূর্ব আকাশের অন্ধকার ফ্যাকাশে।
শারু চূড়ান্ত রাগ নিয়ে গাঁকগাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল,
-‘এখনো আসছে না কেন! উফ!’
ঠিক তখনই তার পেছন থেকে ভেসে এলো একটি কণ্ঠস্বর, ‘আমাকে খুঁজছিলে?’
শারু ঝট করে পেছনে তাকিয়েই মৃদু হেসে উঠে।
-‘অবশেষে, অবশেষে তোমার দেখা পেলাম ম্যাডাম!’
মহুয়া শারুর খুব কাছে এসে, শারুর শার্টের কলারে হাত বোলাতে বোলাতে এক ভ্রু উঁচু করে নিয়ে বলল,
-‘কেন? খুব কষ্ট হচ্ছিল বুঝি আমাকে না দেখতে পেয়ে?’
মহুয়ার গলায় আলতো আঙুলের ছোঁয়া স্পর্শ করায় শারু। সেই আঙুল ধীরে ধীরে গলা থেকে নেমে চিবুক, তারপর বুকের মধ্যিখানে গিয়ে থেমে দাঁড়াল। তার ওষ্ঠে দুষ্টু হাসি। গলার স্বর টেনে টেনে সে উত্তর করল,
-‘হুউউউম। খুউউউব। খুব কষ্ট হচ্ছিল ম্যাডাম।’
ঠোঁটে হাসি রেখেই মহুয়া শারুর হাতটা সরিয়ে দিলো। শারুর কপালের উপর থাকা এলো চুলগুলোকে গুছোতে গুছোতে বলল,
-‘এখন নয়। আগে কাজটা শেষ হোক।’
-‘জি আজ্ঞা ম্যাডাম।’
বলে নিজের ঘাড়টা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিচু করে শারু। প্রত্যুত্তরে মহুয়া হেসে উঠে। নিজের সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয় আচরণ দিয়ে যেকোনো পুরুষকে কাবু করতে সে সক্ষম, তা যেন আরও একবার প্রমাণিত হলো।

-‘ও কী এসেছে?’
প্রশ্ন ছোঁড়ে মহুয়া। শারু উত্তর করল,
-‘জানি না। চলো, কক্ষে গিয়ে দেখা যাক।’
-‘আমি যা যা রেডি করতে বলেছিলাম, সব কিছু রেডি করেছো কী?’
-‘জি জনাবা। সব তৈরি। শুধু তোমার আমার বাসর ঘরটাই তৈরি না এখনো।’
বলে এক চোখ টিপে দিলো শারু। মহুয়া সদ্য কিশোরে পা দেওয়া কিশোরীর ন্যায় খিলখিল করে হেসে উঠে। শারুর নাকটা টিপে ধরে বলে,
-‘তুমি কিন্তু অনেক দুষ্টু আছো ছেলে। কাজটা শেষ হোক, দেখবো কত তেজ শরীরে।’
-‘ভেবে দেখো। আমি কিন্তু একবার ধরলে সহজে ছাড়ব না।’
-‘তুমি ভেবে দেখো। আমার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া কিন্তু অনেক মুশকিল। এমনকি, তোমার জান চলে যাবে, তাও ছাড়া পাবে কীনা সন্দেহ।’
মহুয়ার কথাগুলো শোনায় রহস্যময়, কিন্তু কামুকের আগুনে জ্বলতে থাকা শারুর নিকট তা স্বাভাবিক কথোপকথন যেন।
নিজের টোন ঠিক করে মহুয়া ফের বলল,
-‘চলো,কক্ষে চলো। আর ওই লাবণীর কী ব্যবস্থা করেছো শুনি?’
-‘ওকে? নিজেকে অনেক বড় শেয়ানা ভেবেছিল বুঝলে। লাইটগুলো সরাতে গিয়েছিল। ভাগ্যিস আমার লোক ওকে দেখে ফেলে। পরে আর কী, গিয়ে একটা বারি দিলাম মাথায়। ওখানেই চিৎপটাং। আর ওর সঙ্গের টা কাঁদছে ভেউ ভেউ করে। হা হা হা!’
মহুয়া ক্রুর হাসি হাসে।
-‘জুলিয়াকে আমার জীবিত চাই শারু। মনে আছে তো?’
-‘আছে। তাই তো ওকে আমি এখন অবধি ছুঁয়েও দেখিনি। কিন্তু ওকে দিয়ে কী করবে তুমি? একটা অপদার্থ মেয়ে। পারে শুধু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে আর নিজের সৌন্দর্যের বড়াই করতে।’
-‘কী করব,সেটা পরে দেখা যাবে। তোমাকে যা বললাম, তা মনে রেখো। কোনোকিছু এদিক ওদিক হলে…’
-‘হবে না। কিন্তু বিনিময়ে আমাকে কী দিবে,তাও মনে রেখো।’
শারুর পুরুষাঙ্গকে স্পর্শ করে মহুয়া বিদ্রুপের সুরে বললাম,
-‘এর শান্তি চাই,তাই তো? ওকে মনে রাখলাম।’

-‘লাবণী, লাবণী প্লিজ জেগে উঠো লাবণী, প্লিজ..’
জুলিয়া চাপাস্বরে কাঁদছে। তার চেয়ে একটু দূরে এলোমেলো ভাবে অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে লাবণী। সে যেইমাত্র লাইটগুলো ছুঁতে যাবে,ওমনি শারু চলে আসে কক্ষের ভেতর। তারপর খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি শেষে লাবণীর মাথায় তীব্র আঘাত করে বসে শারু। লাবণী মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে ধূলো মাখানো মাটির উপরে। অপরদিকে জুলিয়া, কোনোকিছু দেখতে না পেলেও আঘাতের শব্দ এবং লাবণীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা ঠিকই টের পেয়েছে। একটু সন্দেহও জাগছে তার মনে। লাবণী ম’রে ট’রে গেল না তো!

-‘লাবণী, কী হয়েছে লাবণীর?’

আচানক ম্যাক্সের প্রশ্নে জুলিয়া বিদ্যুৎ বেগে পিঠ সোজা করে বসল। আশেপাশে খুঁজে বেড়ায় ভাইকে। ম্যাক্স একটা নির্দিষ্ট দিক থেকে বলল,
-‘আমি এখানে জুলিয়া। আমি আসছি। আমার হাতে ‘ব্লাড স্টোন’। এই আলো আমার কিছুই করতে পারছে না। কিন্তু লাবণী,ওর কী হয়েছে জুলিয়া?’
-‘লাবণীকে আঘাত করেছে শারু ভাইয়া। ও, ও অজ্ঞান ভাইয়া। ও আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল।’
-‘শারু!’
দাঁত কটমট করে নামটা উচ্চারণ করল ম্যাক্স।
জুলিয়া তড়িঘড়ি করে বলল,
-‘তুমি এখান থেকে চলে যাও ভাইয়া। শারু আর ওর দলবল আশেপাশেই আছে। তোমাকে দেখতে পেলে..’
-‘কিচ্ছু করতে পারবে না। আমার হাতে ‘ব্লাড স্টোন’ আছে, এর ক্ষমতা তুই জানিস?’

কক্ষের ভেতরে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ হয়। জুলিয়া,ম্যাক্স দু’জনেই তটস্থ হয়ে উঠে। জুলিয়ার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেলেও তা নিঃশব্দ রইলো। অপরদিকে ম্যাক্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে। প্রথমে শারু ঢুকল, তারপর কেউ একজন। তার চেহারাটা অস্পষ্ট এই শেষ রাতের প্রহরে। ম্যাক্সের চোখের চাহনি সরু করে, আরও শক্তি দিয়ে চাইলো। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় এবার। মহুয়া!
এত গুলো বছর পর! ম্যাক্সের মনে হলো, তার মাথার উপর আসমান ভেঙে পড়েছে। তার হতবিহ্বল চেহারাটা দেখে যারপরনাই হাসি ফুঁটে উঠে মহুয়ার ঠোঁটে। সে ব্যঙ্গ নিয়ে বলে উঠল,
-‘কেমন আছেন?আমাকে জীবিত দেখে নিশ্চয়ই ভালো নেই।’
-‘তু…তুমি?’
ম্যাক্সের উচ্চারণ তোতলে আসে। সত্যিই,সে এবং তার পরিবার জানত মহুয়া বেঁচে নেই। কিন্তু..
মহুয়া শব্দ করে হেসে উঠল।
-‘রাজকুমারের কণ্ঠ কাঁপছে, এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!’
কথাটা শোনা মাত্রই তড়িৎ নিজেকে সামলে শক্ত হয়ে উঠে ম্যাক্স। গলার স্বরে কাঠিন্য যোগ করে বলল,
-‘হেয়ালি ছাড়ো মহুয়া। তুমি এখানে কী করছো? তাও আবার শারুর সাথে..’
-‘কাম অন রাজকুমার। তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে দেখে কী ভেবেছো, আমি আর কারও হবো না? তোমার অপেক্ষাতেই থাকবো? নো। শারু আমার নতুন ভালোবাসা। সে তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে আমাকে। আমি যদি তাকে আমার জন্য জান দিয়ে দিতে বলি, তবে সে তা-ই করতে প্রস্তুত। আর তুমি সামান্য ‘ব্লাড স্টোন’ আমাকে দিতে পারলে না!’
-‘ওটাকে ভালোবাসা না,মোহ বলে। যার কাছে নিজের জীবন দামী নয়, তার কাছে তুমি কেমন দামী, তা আমার বুঝতে বাকী নেই আর। আর খবরদার যদি ‘ব্লাড স্টোন’ কে তুমি সামান্য বলো। অবশ্য তোমার মতো সামান্য মেয়ের মুখে এছাড়া আর কীইবা আশা করা যায়।’
ম্যাক্সের ঠোঁটের কোণে ঠাট্টারা লুটোপুটি খায়। মহুয়া শক্ত হয়ে উঠে। জোরালো কণ্ঠে বলে,
-‘তোমার এই বড় বড় কথাগুলো একটু পরেই গায়েব হয়ে যাবে রাজকুমার। মনে রেখো।’
-‘এর আগেও আমাকে অপদস্ত করার কম চেষ্টা করেছো কী? পেরেছো বলো?’
-‘না পারি তবে এবার পারবো।’
মহুয়া চিৎকার করে উঠে। শারুকে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করতেই ম্যাক্স যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পেছন দিক থেকে একটা বড় পাথর গড়িয়ে নামল। ম্যাক্স কিছু বুঝে উঠার আগেই পাথরের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল। সেই সঙ্গে হাত থেকে খসে পড়ে ‘ব্লাড স্টোন’। একই সঙ্গে উপর থেকে অনেক গুলো বড় বড় লতা গড়িয়ে পড়ল ম্যাক্সের গায়ের উপর। প্রতিটি লতায় পঞ্চাশ পিস করে ছোট উজ্জ্বল লাইট। ম্যাক্স আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে। নাম ধরে ডাকল, ‘মহুয়ায়ায়ায়ায়ায়া…’

ততক্ষণে ‘ব্লাড স্টোন’ মাটি থেকে কুড়িয়ে মহুয়া নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। অবাক বিস্ময় নিয়ে ‘ব্লাড স্টোন’ ঘুরে ঘুরে দেখে সে। জীবনে এই প্রথম, এই প্রথম ‘ব্লাড স্টোন’ নিজের হাতের মুঠোয় পেল। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বড় হা করে ‘ব্লাড স্টোন’ টাকে মুহূর্তেই নিজের মুখের ভেতর পুড়ে গিলে নিলো মহুয়া। শারু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। মহুয়া তাকে দেখে হেসে উঠে। শারুর দিকে হাত বাড়ালেও শারু আরেকটু দূরে সরে যায় হাত ধরার বদলে। মহুয়া বলল,
-‘কী শারু? বাসর করবে না আমার সাথে?’
-‘তু..তুমিও মা..মানুষ..’
-‘হুম, আমিও মানুষ নই। আমি পিচাশ। আমি পিচাশ রাজ্যের রাজকন্যা মহুয়া। হা হা হা।’
দু’দিকে দু’হাত প্রশস্ত করে কক্ষ কাঁপিয়ে তোলে হাসির দমকে। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে আদেশের সুরে শারুকে বলল,
-‘তোলো..তোলো ওই মেয়েটাকে।’
শারু সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করল। খাঁচা সরিয়ে জুলিয়াকে ধরতেই জুলিয়া চিৎকার করে ‘ভাইয়া…ভাইয়া’ বলে ডাকতে লাগল। ওদিকে ম্যাক্স পড়ে রয়েছে হাজার হাজার লাইটের নিচে। প্রায় অবশ,অচেতন হয়ে যাওয়া অবস্থায়। তার দু’চোখ ইতিমধ্যেই অন্ধ হয়ে গিয়েছে।
জুলিয়াকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল শারু। মহুয়া ম্যাক্সের কাছে এসে নিচু হয়ে ম্যাক্সের কানের কাছে মুখটা নামিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
-‘তোমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলাম জানো? যেন তোমাদের জগতে গিয়ে নিজেই নিজের বোকামির কথাটা বলতে পারো। আমাকে যে অপমান, লজ্জা তোমার কারণে নিজের জগতে সহ্য করতে হয়েছিল, তা এবার তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে। এবং তারপর এই অন্ধ চোখ নিয়ে শত লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করার চাইতে ম’রে যাওয়া উত্তম মনে করবে। এটাই হবে তোমার শাস্তি ম্যাক্স।আর আমি? আমি হবো এই পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী এবং সুখী ব্যক্তিটি…আমার অন্তরে যে গেঁথে গিয়েছে তোমাদের অতি দামী ‘ব্লাড স্টোন’। বায় মিঃ ম্যাক্স। তোমার মৃ’ত্যু হলে আমি অনেক গুলো র’ক্তচোষাকে র’ক্ত খাইয়ে দিবো। প্রমিস।’

জুলিয়াকে আর ‘ব্লাড স্টোন’ কে নিয়ে যে ম্যাক্সের ফেরার অপেক্ষায় তার বাবা-মা অপেক্ষারত, সেই জুলিয়া এবং ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে চলে গেল মহুয়া। অন্ধকার ধূলো মাখানো ঘরটায় পড়ে রইলো নিস্তেজ, অবশ হয়ে যাওয়া অন্ধ র’ক্তচোষা এবং র’ক্তে-মাংসের মানবীটি। এরপর? মহুয়া কী জিতে গেল তাহলে? জুলিয়ার শেষ পরিণতি কী হবে? ম্যাক্স কী আদৌও বেঁচে ফিরবে নাকি ম’রে যাবে আত্মগ্লানি সইতে না পেরে। আর অভাগী কন্যা লাবণী, তারই বা শেষ পর্যন্ত কী হবে?

বাইরে নতুন ভোরের প্রথম আলো ফুঁটি ফুঁটি করছে। ভোর সবার জীবনে নতুন সুযোগ, নতুন উদ্যম নিয়ে এলেও ম্যাক্স এবং লাবণীর জীবনে কী শুধুই অন্ধকার নিয়ে নামলো?

(১ম পরিচ্ছদের সমাপ্তি)
[

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here