ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ২৫

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ২৫

দরজা খুলে মিম হতভম্ব হয়ে যায়। মাথাটা কিছুটা ঝুঁকিয়ে এনে দরজাটা দুই হাত দিয়ে আকড়িয়ে ধরে স্বয়ং সবুজ দাঁড়িয়ে।
চুলগুলো উশকুখুশকু, চোখ রক্তজবার মত টকটকে লাল, কপালজুড়ে সুক্ষ্ম ভাজ, গলার কাছের রগগুলো দ্রুত নিঃশ্বাসের সাথে উঠানামা করছে আর ক্রমে ক্রমে স্পষ্টতর হচ্ছে। মিমের বুকের ভেতর কেমন কেমন জানি হতে লাগলো।
” আমি কি দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকবো না চলে যাব?”
গম্ভীরভাবে কথাটা বললো সবুজ।
” এসে আবার ন্যাকামো করা হচ্ছে। ”
মিম বিড়বিড় করে বললো। অবশ্য ওটা সবুজের কান পর্যন্ত পৌছায়নি।
কথা না বাড়িয়ে মিম সরে দাঁড়ালো। সবুজ দুই আঙুলে থুতনি ধরে সোফায় বসে পড়লো।
” আমার সময়ের কোন দাম নেই। দরজা খুলতে কি এতোক্ষন লাগে।”

চক্ষু গরম করেই মিমের দিকে তাকায়।

” ইবতিহাজ উঠে পড়েছিলো। ওকে আধা ঘুমে রেখে আমি কিভাবে দরজা খুলবো?”
মিম শান্তভাবেই জবাব দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো।

” ইশ্ কি সুন্দর লেইম যুক্তি! ছেলে কোলে করে দরজা খুললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত।”
নিজের মনে নিজেই বলে উঠলো।

” আচ্ছা ডিনার করে এসেছেন? নাহ্ খেতে দিব?”
মিম উৎসুক দৃষ্টিতে সবুজের দিকে তাকায়।

” খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। আমি কি তোমার এই আপনি আপনি নমো নমো প্যাচাল শোনার জন্য এতরাতে আসছি? কোথায় কি সম্বোধন করতে হয় না বলে দিলে তুমি বুঝো না।”
রাগে গড়গড় করে সবুজ কথাগুলো বলে দিলো।
মিমের প্রচণ্ড খারাপ লাগছে। কোন মানুষ এতোটা অসভ্য হয় কি করে? এসে যদি এই রাগারাগিই করিস তবে আসতে কে বলেছিলো রে? এতোদিন একা ছিল বেশ ছিল।
মিম কথা না বাড়িয়ে কিচেনে চলে গেলো। খাবার গরম করে প্লেট সাজিয়ে নিয়াসলো। চিকেনটাই নিলো , মাছ নিলে আবার চেঁচামেচি করতে পারে।
প্লেট নিয়ে সবুজকে ইশারায় নিতে বলে মিম।

” তুমি কি বোবা? না মুখে ব্যাঙ ঢুকেছে কোনটা?”
মিম বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বললো,
” নাও প্লেট ধরো। ”

” হাত বাড়ীতে রেখে আসছি খেতে পারবোনা। ”

মিম কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভাত মাখাতে থাকে।
” হা করো।”
সবুজের প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। খাওয়া শেষে মিম ভুল করে আবার বলতে থাকে,
” নিন পানি খান।”

সবুজ রাগে গ্লাসসহ ছুড়ে মারে।

” আমাকে তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি তোমার ভাসুর লাগি তাইনা। আমাকেতো তোমার মানুষই মনে হয়না।” সবুজ পানি না খেয়ে রাগে গটগট করতে করতে বিছানার একপাশে কোলবালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ে।
মিম হতবাক হয়ে সবুজের কার্যকলাপগুলো দেখতে থাকে। কোন মানে হয় এরকম অযথা রাগের। ইশ ওর সাধের গ্লাসটাই ফিল ভেঙ্গে।
বিছানায় গিয়ে সবুজের মেজাজটা আরো বিগড়ে যায়,
“কেমন বেয়াদব ছেলেকে ঠিক মাঝখানে শুইয়েছে। হ্যা শোয়াবেইতো আমারতো গরজ বেশি। তারতো কোন আগ্রহই নেই। সব জোড় করে জবরদস্তি করে। ইনফ্যাক্ট তারতো আমাকে কোন দরকারই নেই। সেতো আবার স্বাবলম্বী!”
নিজের মনে নিজেই কতক্ষন বিড়বিড়িয়ে উঠলো।
মিম রুমে এসে সবুজের ভাবগতি বুঝার চেষ্টা করলো। নাহ্ পুরো ঘরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
ও কি একটা ডাক দিবে। অবশ্যই দিবে। মুখে আপনি ডাক এনেও সেটাকে শোধরে তুমিতে পরিণত করলো। এইবার আপনি ডাকলে নির্ঘাৎ ঘরের বাইরেও বের করে দিতে পারে।কোন বিশ্বাস নাই।

” তুমি কি ঘুমিয়েছো। এই শোননা। ঘুমিয়েছো?”
মিমের বড্ড লজ্জা লাগছিল। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করতে লাগলো।
” নাহ।”
” আচ্ছা তাহলে চেঞ্জ করে একেবারে শোয়ে পড়ে।”
” কি হবে চেঞ্জ করে। ”
নাহ এই মানুষটার কোন কিছু বলার ইচ্ছে নেই।
মিম বাচ্চাকে সাইডকরে মাঝখানে ধপাশ করে শুয়ে পড়লো। কখন দেখা গেল বাচ্চার উপরে হাত পা তুলে দিয়েছে। দুইজন দুইমেরুতে এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। সবুজ নিলিপ্ত ভঙ্গিতে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে ভেতরে ভেতরে প্রবল রাগে ফুঁসতে থাকলো।
সবুজের এই অকারণ নির্লিপ্ততা মিমের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে তোলপাড় করে দিতে লাগলো। বুকের ভেতরটা শক্ত হাতুড়ির নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকলো। মাথাটা কাজ করছে না। ভালোবাসাটা বুকের খাঁচা ভেদ করে প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছে চাইছে। শারীরিক আবেদন প্রবলভাবে শরীর মন জুড়ে চেপে বসতে লাগলো।
মিম হুট ঘুরে পেছন থেকে সবুজের জড়িয়ে ধরা কোলবালিশটা এক টানে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।
সবুজ বিস্মিত হয়ে মিমের দিকে তাকায়। ওর কোলবালিশটা কি এমন দোষ করলো ভেবে পায়না। সবুজ নিশ্চুপ থেকে আবার কপালে হাত দিয়ে শুয়ে পড়ে। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। যেন পরিস্থিত সব স্বাভাভিক এখানে আদৌ কিছু ঘটার মত পরিস্থিতিই নেই। মিম তার উষ্ণ হাতের আলতো স্পর্শে সবুজকে নিজের দিকে টানতে থাকে। সবুজ ভাষাশুন্য হয়ে মিমের টানে সাড়া দিতে লাগলো। মিম গভীর প্রণয়ে সবুজকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে দু হাত দিয়ে শক্ত করে শার্ট খামচে ধরে। জড় পদার্থের মত সবুজ মিমকে জাপটে ধরে শুয়ে থাকলো। সবুজের উষ্ণ নিঃশ্বাস গলার কাছটায় পড়তেই মিমের ভেতরটা ছটফট করতে লাগলো। কতোক্ষন কেটে গেলো কে জানে? ধাতস্থ হতেই মিম রাগে দুঃখে সবুজকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নামার উপক্রম হতেই, সবুজ পেছন থেকে শক্ত করে হাত টেনে ধরে। ঝোক সামলাতে না পেরে বুকে গিয়ে পড়ে। এইবার সবুজ দুই হাত দিয়ে ওর কোমড় চেপে ধরে।
” কি হয়েছে ওরকম ছটফট করছো কেন?
বলবেতো সমস্যাটা কি?”
সবুজ আধোআধো ভাঙ্গা গলায় ফিসফিসিয়ে বললো।
মিম নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
” সরো, ছোঁবে না আমাকে। ছাড় কিচ্ছুটি হয়নি।”

সবুজের বুকে এলোপাথাড়ি কতগুলো কিল ঘুষি দিতে লাগলো।
” ইশ মেরে ফেলবেতো। খবরের কাগজে বড় বড় করে হেডলাইন বেরোবে ” আদর না করায় স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, কি সাংঘাতিক! ”
লজ্জায়, রাগে দুঃখে, মিমের মুর্ছা যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আবার সজোরে কিল ঘুষি দিতে দিতে মিম বললো,
” অসভ্য, ইতর, বজ্জাত, তেলাপোকা, ছেঁচড়া, কাণ্ডজ্ঞানহীন…….”
বাকী কথা গুলো বলার চান্স আর পেলোনা। তার আগেই বিছানায় চিৎপটাৎ।

————————————
সকাল সকাল রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম দেখে সবুজের মেজাজ খুব খারাপ। নাসিরের বাচ্চাকে এত করে বলা সত্বেও সে গাড়ি ঘুরাচ্ছে না। সে পণ করেই বসেছে এদিক দিয়েই যেতে হবে। যে রাস্তা দিয়ে এসেছে ফেরার সময় সেই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে নইলে নাকি ও রাস্তায় এক্সিডেন্ট করবে। এটা ওর স্বপ্ন দেবির আদেশ। কিছুতেই অমান্য করতে পারবে না। ভাবা যায় যত্তসব লেইম লযুক্তি। সবুজের মাঝে মাঝে মনে হয় এতোসব পাগলদের সাথে থাকতে থাকতে ও কোনদিন না পাগল হয়ে যায়।
তারউপর মা আবার কোন জরুরি তলবে ডেকেছে কে জানে?

” নাসির, তোকেতো একটা কথা বলাই হয়নি। মা কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলো।”

” তো কি হইছে?”

” আরে শোননা, বাসায় নাকি কোন মেয়ে এসে বলতেছে তোর নাকি বউ লাগে। হ্যারে তুই বিয়ে কবে করলিরে?”

” কি?”

নাসির বিস্মিত হয়ে সবুজের দিকে তাকায়।
” ওইভাবে তাকাচ্ছিস কেন? মা আমাকে
এইজন্যেই এত তাড়া দিচ্ছে। ”

” ভাইজান বিশ্বাস করেন আমিতো বাবু, এহনো মায়ের আচলে তলায়
থাকি,আমিতো বিয়া করতেই পারিনা । বিয়ার বয়সই হয়নাই। সব মিছা। সব মিছা। ”

“সেই জন্যেইতো আমাদের বাসায় পৌছেতে হবে তাড়াতাড়ি। আর আমি না হয় তোর কথা বিশ্বাস করলাম কিন্তু বাকী সবাই? প্রমাণতো তোকেই করতে হবে তাই না।”

” হ, শালার ব্যাডি তোরে আমি খাইছি। আমার নামে অপবাদ দেয়া।”
নাসির গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ড্রাইভ করতে লাগলো। যাক প্ল্যানটা তবে কাজে দিলো। সবুজ একগাদা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বাড়ীতে এসে নায়রাকে দেখে আবার অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এই মেয়ে এতো সকালে এই বাসায় কি করতে এসেছে কে জানে?
সবুজ বাসায় না ঢুকে লুকিয়ে পড়ে। নাসির বুক ফুলিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে । সোফায় বসে থাকা অপূর্ব সুন্দরি মেয়েটাকে দেখেতো ও চোখের পলকই ফেলতে পারছেনা। পোষাক আশাক দেখেতো বিদেশি ম্যাম মনে হইতাছে।।এই মেয়ে ওর বউ! উফ্ ভাবতেই নাসির লজ্জায় লাল আরেকবার নীল হতে লাগল।
নাসির হাত দিয়া চুল হাতড়াতে হাতড়াতে বুক ফুলিয়ে অস্বাভাবিকভাবে নায়রার ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
নায়রা ভ্রুকুচকে ছেলেটির দিকে তাকায়।
” এই আপনি কে?.এমন অসভ্যের মত সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন?”

” আমি নাসির। তোমার স্বামী। ছিঃ এখনি তুমি ভুলে গেলা।”

” হুয়াট?” নায়রা বিস্মিত হয়ে নাসিরের দিকে তাকায়।

সবুজ অদুরে দাঁড়িয়ে নাসিরের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলো। দাতে দাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো।

” কথায় কথায় ইংলিশ বলো কেন বউ।”
বলেই নাসির নায়রার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।

” কে আপনার বউ। সরুন বলছি। ভালো হবেনা।”

” সরবোতো তবে একা না তোমাকে সাথে নিয়ে। চলো চলো তোমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাই। ”
নাসির খপ করে নায়রার হাত ধরে ফেলে।
নায়রার ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা চড় মারতে।।এসব কি হচ্ছে। এই নাসির ঠাসির কে? হারামজাদা সবুজটাই বা কই। উফ্ আর এক মুহুর্ত এখানে থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে। অসভ্য ছেলেটা কেমন এখনো হাত ধরে আছে? একটুপর আবার কোথায় হাত দেয় কে জানে।
নায়রা নাসিরের হাত ছাড়িয়ে
সোজা দৌড় দেয়। নাসির ও বউ বউ বলে নায়রার পিছে পিছে দৌড়াতে থাকে।
সবুজ ৩২ পাটি দাত বের করে ক্যালাতে ক্যালাতে ঘরে ঢুকে।
চলবে…

গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আমি কষ্ট করে গল্প লিখতে পারলে ফিডব্যাক পাওয়ার আশাও রাখি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here