#ভ্রান্তির_অগোচরে
পার্ট ২৮
আশিকা জামান
দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়খানি ফেটে চৌচির হওয়ার উপক্রম হতেই শরীরটাও নিস্তেজ আর ন্যুজ হয়ে পড়লো। শারীরিক তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ার সাথে সাথে প্রলাপ বকার পরিমাণ ও বাড়তে থাকলো সমানতালে।
শিউলি অসুস্থ ছেলের শিউরে বসে মনে মনে একশত ছাব্বিশ বার মিমকে শাপশাপান্ত করতে লাগলো। এরুপ অহেতুক শাপশপান্তে মিমের কিছু ক্ষতি হোক বা না হোক তাতে উনার বিন্দুপরিমাণ যায় আসে না। তবে হ্যা সাময়িক মানসিক শান্তি পাচ্ছেন এই আরকি। কিন্তু এই মুহুর্তে ভাববার জন্য একটা টপিক মাথায় হুট করে চলে আসলো। সবুজ জ্বরের ঘোরে মিমের নাম একশতবার নিক তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই ইবতিহাজটা কে? আবার বলছে” লক্ষি বাবা আসোনা একটু কোলে নেই।
আমার তুলতুলে তুলার বস্তা। গুলুমুলু বাবা।”
ওর কথার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা ছেলে বাবু। কিন্তু এই বাবুটার সাথে ওর সম্পর্কটাই বা কি? বারবার বাচ্চাটার নাম করছে কেন? মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ। বাচ্চাটার সাথে কি ওর গভীর কোন সম্পর্ক আছে? হুট করেই কথাটা মাথায় আসতেই শিউলি একেবারে ভাবনাটা উড়িয়ে দিলো। কি করে সম্ভব! মিমতো হারিয়েই গেছে ওকেতো আর শত চেষ্টাতেও পাওয়া যাবেনা । হয়তোবা এতোদিনে নিজের লাইফ ঠিকি গুছিয়ে নিয়েছে। মাঝখান থেকে শুধু শুধু আমার ছেলেটাই কষ্ট পাচ্ছে । শিউলি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবুজের দিকে মনোনিবেশ করে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। পানি এনে মাথায় জলপট্টি করে দিতে লাগলো। এখনো সবুজ ইবতিহাজ নাম করেই যাচ্ছে। বিষয়টা শিউলিকে বড্ড ভাবাচ্ছে । নাহ্ ছেলের গতিবিধির দিকে নজর দেয়া জরুরী। ইদানীং সবুজের কার্যকলাপ যথেষ্ট সন্দেহজনক। রাত বিরেতে কোথায় থাকছে কে জানে?
এখন থেকে বিষয়টা খতিয়ে না দেখলে পরে না জানি কোন বিপদে পড়ে কে জানে?
————————————
দরজার উপাশে নতুন কাউকে দেখে মিম কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়।
লম্বাটে মুখের ধারালো নাকের ছিপছিপে গঠনের মেয়েটিই প্রথমে বলে উঠলো,
” ভেতরে আসতে বলবেন না?”
মুখে মেকি হাসিটেনে মিম বললো,
” হ্যা আসুন।”
কিছুটা সরে গিয়ে সোফায় বসার ইশারা করতেই মেয়েটি উদ্ধত ভঙিতে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়ে।
মেয়েটি অদ্ভুতভাবে পা নাচাতে থাকে। মিমের বড্ড বিরক্ত লাগছে ।
” বাবুকে একটু কোলে দিনতো। এক সেকেন্ড ডায়াপার পরানো আছেতো?”
” জি আছে?”
নায়রা নিজেই হাত বাড়িয়েই ইবতিহাজকে কোলে নেয়।
” একদম বাবার কার্বন কপি।”
” আপনি ওর বাবাকে চিনেন?”
মিম উৎসুক দৃষ্টিতে নায়রার দিকে তাকায়।
” চিনি বললে ভুল হবে ভালোভাবে চিনি। ”
” কিছু মনে না করলে
আসলে আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না।”
” হুম না চেনারি কথা। আপনারতো আর আমাকে চিনার দরকার নাই তাইনা!”
” সরি বুঝলাম না।”
” না বুঝারতো কিছু নাই। আমি নায়রা। আপনার নীলিমা আন্টির একমাত্র মেয়ে। এবার নিশ্চয় চিনতে পারছেন।”
” আপনিই নায়রা! ইচ্ছা ছিলো আপনার সাথে পরিচিত হওয়ার। ফাইনালি হয়ে গেলো।
আচ্ছা আপনি বসুন আমি বরং চা করে নিয়াসি। আচ্ছা আপনি চা খানতো?”
” লাগবে না বসুন। আমার চায়ের নেশা নেই তাছাড়া আমি চা খাইও না।”
” তাহলে অন্য কিছু?”
” আপনি বসুন। আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যা খুশি তাই খাইনা।”
মেয়েটার এইরকম উদ্ধৃত আচরণ মিমের কাছে অস্বাভাবিক লাগলো। তবুও যথাসম্ভব শান্ত থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
” আচ্ছা আপনি কিন্তু এখনো বলেননি সবুজকে কি করে চিনেন?”
” ওহ হ্যা কাম টু দ্যা পয়েন্ট, আচ্ছা সবুজ আপনাকে আমার কথা কিছু বলেনি?”
” বললে নিশ্চয় হ্যাংলার মতন আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম না।”
” স্ট্রেঞ্জড, একি বাসায় এত পরিচিত থাকা সত্বেও ও কেন আমার কথা হাইড করতে গেলো কে জানে?
ওর সাথে আমার পরিচয় কানাডায়। আমরা ভালো বন্ধু বলতে খুব ক্লোজড ফ্রেন্ড। আমাদের মাঝে বন্ডিংটা একটু বেশিই বলা চলে।প”
” আচ্ছা কেমন বন্ডিং?”
” আমরা সব কিছু শেয়ার করি। নিজেদের মত এক্সপ্লেইন করি। একে অন্যকে মেন্টাল সাপোর্ট দেই। এই যে আপনার দেয়া চরম কষ্টের সময় আমিই ওর পাশে ছিলাম। বলতে গেলে আমিই ওকে সামলিয়েছি।”
নায়রা একটা মেকি হাসি টেনে মিমের দিকে তাকিয়ে ওর এক্সপ্রেশন বুঝার চেষ্টা করে।
মিমের এই মুহুর্তে প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। এই মেয়ে আরো দুই সেকেন্ড বসে থাকলে ও নির্ঘাত হার্টফেইল করবে।
কেন এসেছে মেয়েটা, এইসব বলাটাকি খুব জরুরী ছিলো।
তাছাড়া মেয়েটা হয়তোবা স্বাভাবিক কথাই বলছে কিন্তু ওর কেন অস্বাভাবিক লাগছে। কেন এই মেয়েটাকে সহ্য হচ্ছেনা কে জানে? হঠাৎ মেয়েটার কন্ঠস্বরে মিম চকিত হয়ে উঠে,
” আচ্ছা এখনতো সব ঠিক। তাহলে নিজের বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না কেন? তাছাড়া এখানে কি এমন জীনিস আছে যে ফিরে যাচ্ছেন না।”
মিমের এইমুহুর্তে চরম রাগ হচ্ছে। মেয়েটার মাঝে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। অন্যের পারসোনাল ম্যাটারে বিনাকারণে নাক গলিয়েই যাচ্ছে।
” সবুজ আপ্নাকেতো সব শেয়ার করে তাহলে এই কথাটা বলেনি বুঝি।”
নায়রার আত্নসম্মানে লাগলো মিমের এই কথাটা। আচ্ছা এই মিম কি কোনভাবে ওর মোটিভ বুঝে ফেলেছে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই উড়িয়ে দিলো। ধুর তা কি করে সম্ভব। যথাসম্ভব নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,
“বলেছে বলেইতো বলতে আসলাম। আচ্ছা অনেকতো নাটক করলেন এবারতো একটু ক্ষ্যান্ত দিতে পারেন নাকি?”
” দেখুন আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে। আপনি আসতে পারেন।”
মেয়েটার সাহস দেখে নায়রার মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করছে । এত বড় সাহস ওকে চলে যেতে বলছে।
” সত্যি বললে সবারই গায়ে লাগে। যাই হোক যে জন্য এসেছিলাম, আমি ইবতিহাজকে নিয়ে যাচ্ছি। ভাইয়া অফিস থেকে ফিরে ওর কথা বলতেছে। আসি।”
নায়রা ইবতিহাজকে নিয়ে চলে যেতে থাকে।
মিম হা হু শব্দ করলো না।
————————————
নিয়াজ ইবতিহাজকে নিয়ে আদর করতে করতে একসময় নিজের রুমে নিয়ে যায়। নায়রাও কিছু একটা ভেবে নিয়ে নিয়াজের পিছু পিছু রুমে ঢুকে। একটা চেয়ারটেনে বসে নিয়াজ আর ইবতিহাজের দিকে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করে।নিয়াজের ফুল কন্সট্রেশন তখন ইবতিহাজের দিকে।
“ভাইয়া দেখেছিস তোকে পেলে বাচ্চাটা কতোটা খুশি হয়। তোদের দেখলে মনে হয় বাচ্চাটা তোরি রে।”
নিয়াজ নায়রার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠে।
” জানিস ভাইয়া ওর মাকে দেখলে আমার যে কি কষ্ট হয়। একটা সিংগেল মাদারকে আমাদের সমাজ ঠিক কতোটা হীন চোখে দেখে তা বলে বুঝাতে পারবোনা। দেখেছিস মেয়েটা এই অল্প বয়সে কতটা স্ট্রাগল করছে, সত্যি আমাদের থেকে জীবনটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে ও।”
” আচ্ছা তুই আমাকে এসব কেন বলছিস?”
নিয়াজ নায়রার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাটা বলে।
” আচ্ছা যদি ইবতিহাজ তোর কাছে সারাজীবন থাকে তাহলে কেমন হয়। ”
অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে নায়রা কথাটা বললো।
ভাইয়া হয়তোবা সবুজের বিষয়টা এখনো জানে না। উফ ওকে যদি কোনভাবে উস্কে দেওয়া যায় তবেই কেল্লাফতে।। অবশ্য এতে হিতের বিপরীতও হতে পারে। সে যাই হোক এটুকু রিস্ক তো নেয়াই যায় ।
নিয়াজ চমকে উঠে। এই মেয়ে কিসব আবুলতাবুল বলে চলেছে।
ছিঃ লোকে কি ভাববে?
” ভাইয়া তুই কি ভাবছিস এত? ভাবছিস মানুষ কি ভাববে?”
নিয়াজ আবার চমকে উঠে।
” ভাইয়া দেখ মিমতো বাকী জীবন একা কাটাতে পারবেনা। মানুষ ওকে ওর সিংগেল লাইফের জন্য বারবার কথা শুনাবে। তার থেকে তুইও পারিস ওকে রক্ষা করতে ওর পাশে থাকতে। তোদের দুজনের ডেসটিনি কিন্তু একই।”
চলবে…