ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ৮

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৮

ঘড়ির কাটায় রাত ৯ টা ১০ মিনিট। শিউলি চৌধুরী বারবার অসসহায়ভাবে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। আর প্রতিবারই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে বসা মহিলার দিকে মনোযোগ দেয়ার বৃথা চেষ্টা করলেন।
মহিলাটি তার বান্ধবী। বলতে গেলো অনেক দহরমমহরম সম্পর্ক। কিছু দিন হলো ইউ. কে থেকে ফিরেছেন। বিডিতে ফিরেই সোজা পুরোনো বান্ধবীর বাড়ী চলে এসেছে। পেটের যতো কথা আছে সব একেবারে উজাড় করতে। অন্যসময় হলে হয়তো শিউলিও বেশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করতো। কিন্তু আজকের হিসেব আলাদা। সবুজের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যে ছেলে ওর, না গেলে হয়তো আজকের ওষুধটাই স্কিপ করে যাবে। আবার সেজুকা হচ্ছে এমনি নাছোড়বান্দা ওকে ফেলে একদন্ডের জন্যেও উঠবার জো নেই। নাহ্ মিমকেই বলতে হবে সবুজকে ওষুধ খাওয়ানোর কথাটা।
তাছাড়া কেমন যেন একটু গিলটি ফিলিংস হচ্ছে। নাহ্ মিমকে এইভাবে সবুজের থেকে দূরে রাখাটা বোধ হয় ওর উচিৎ হচ্ছেনা। তাছাড়া ওরা বিবাহিত ওদের এইভাবে দূরে রাখার কোন ভ্যালিড রিজন আপাতত ওর কাছে নেই। আর ছেলেমেয়ে দুইটা ভালো থাকুক এটাইতো ওর একমাতে চাওয়া। শিউলি নিজের বিছানায় বসেই উচ্চস্বরে মিমকে ডাকতে লাগলেন।
মিম তখন ড্রয়িংরুমেই ছিলো। শিউলি চৌধুরীর রুমটা ড্রয়িংরুমের ঠিক ডানদিকেই বেশ বড় সরো আর খোলামেলা।
প্রচন্ড তেষ্টায় মিম গ্লাসে পানি ভরেতেছিলো শাশুড়ির গলা শুনতে পেয়ে পানি না খেয়েই রুমের দিকে পা বাড়ায়।

” মিম, যাতো সবুজকে ওষুধটা খাইয়ে দিয়ায়। ওর ওষুধ খাওয়ার টাইম হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি যা আর খাইয়ে দিয়ে আমাকে ইনফর্ম করবি কেমন।”

মিম ভ্রুকুচকে শিউলি বেগমের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ সময় লাগে ওর ব্যাপারখানা বুঝতে। তারপর মিনমিনেয়ে বলে উঠে।

” কিন্তু মা, আমিতো জানি না কোন ওষুধ খাওয়াতে হবে।”

সেজুকা এমন ভাবে চোখ মুখ কুচকাতে লাগলো যেন এমন কথা জীবনেও শুনেনি। তারপর দুম করে বলে উঠলো,

” শিউলি, এ কেমন বউরে? স্বামীর কখন ওষুধ খাওয়ার সময়, তাও শাশুড়িকে বলে দিতে হচ্ছে! এখন আবার কি ওষুধ তাও জানেনা। ওরে আল্লাহ, আজকালকার মেয়েগুলা যে স্বামী সংসারের প্রতি এতো উদাসীন..
তা মা, এতো ক্যায়ারলেস হলে চলে?
মানুষটাতো অসুস্থ নাকি!
আহারে বাছা আমার!
এখনো তোমার আংকেল অসুস্থ হলে আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনা।”

” আহা সেজুকা, একটু থাম। ওদের ব্যাপার ওদেরই বুঝতে দেনা। আমরা বুড়োরা কেন খামোখা নাক গলাবো।”
সবুজের কাছে মিমকে না যেতে দেয়ার ব্যাপারটা শিউলি একেবারেই হাইড করে গেলো। শুনলে কি ভাবে সেজুকা কে জানে।
তাছাড়া ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু।
আর একমুহুর্ত ও এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে নেই নিঃশ্বব্দে রুম থেকে বের হয়। সবুজের রুমের সামনে যেতেই, কিছু একটা পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার মতো শব্দ শুনতে পায় মিম। সামনে আগাতেই ফটোফ্রেমট ভেঙ্গে গুড়োগুড়ো অবস্থায় দেখা যায়। মিম হাটু ভাজ করে ফ্লোরে বসে কাচের টুকরো হাতে তুলে নেয়। অদূরেই ওর আর সবুজের বিয়ের ছবি পড়ে আছে। মিম হাত বাড়িয়ে ছবিটা তুলে নেয়। লাল বেনারসি, খোপায় গোলাপ ফুল, আর হাতে একগাদা চুড়ি পাশে বর বেশে গোলগাল চেহারার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখে ওর চোখের কোণে জল ছলছল করে উঠলো। এই ছবির মিম আর আজকের মিমের মাঝে অনেক ফারাক। সেদিন সবুজের প্রতি যে পরিমাণ বিতৃষ্ণা ছিলো আজ তা ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ন। তবে সবুজই এখন ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হয়তোবা এটাই ওর ভবিতব্য। একটা কথা আছে না, দাতঁ থাকতে দাতেঁর মর্যাদা বুঝতে হয়।
মিম চরম বিদ্বেষে উর্ধপানে তাকায়, নিস্পৃহভাবে সবুজ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সমস্ত বিদ্বেষ মুহুর্তেই পানি হয়ে গেলো। তবুও নিচুস্বরে বলে উঠলো,
” ছবিটা ছুড়ে মারলেই কি আমাকে অস্বীকার করা যাবে? না সব সম্পর্ক মিথ্যে হয়ে যাবে?”

সবুজের বিধ্বংশী অট্টহাসিতে মিমের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যেতে লাগলো।
মুহূর্তেই ঘোরে দাঁড়িয়ে সবুজের চোখে চোখ রাখলো মিম।

এই চোখের ভাষা বুঝা মিমের কম্ম নয়।

” এইভাবে বোকার মত হাসছেন কেন?”

” আমি যে বোকা তাই,
আমি বোকা বলেই আমাকে সাপোর্ট হিসেবে নিয়ে সবাই নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারে।
আমি বোকা বলেই, নিজের জীবন বিপন্ন করে কাউকে ভালোবেসেও বিনিময়ে পাই বিশ্বাসঘাতকরা, ঘৃনা আর অবহেলা। এনাফ মিম, জাস্ট ফেড আপ।
সত্যিটা স্বীকার করার সাহস না থাকলে
প্লিজ অন্তত নাটক করতে এসোনা।
আমি কোন ড্রামা কুইনকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাইনা।
গেট লস্ট। ”
মিমের পুরো ২ মিনিট সময় লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। কিন্তু সবুজের এতো রিএক্ট করার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ ও খুঁজে পেলনা। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করলো।
” হ্যা, আমি চলে যাচ্ছি আপনি উত্তেজিত হবেন না। এই জাস্ট দু মিনিট সময় নিবো। মেডিসিন বক্সটা আমাকে দেখিয়ে দিন, আমি খাইয়ে দিয়েই চলে যাবো।”

” আবারো বলছি, আমার কোন কাজ তোমাকে করতে হবেনা। যাও এখান থেকে।”
দাতঁ মুখ খিঁচে সবুজ কথাটা বললো।

মিম সবুজের কথার খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে মেডিসিন বক্সটা তুলে নেয়। প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে ওষুধগুলো একে একে মেডিসিন গুলো হাতে তুলে নেয়। সাইডে রাখা পানির গ্লাস নিয়ে সবুজের হাতে তুলে দিতে যায়। কালবিলম্ব না করে পানির গ্লাসটা ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেয় সবুজ। মিম চমকে উঠে সবুজের দিকে তাকায়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ছাঁপিয়ে উঠে এক ভিন্ন মূর্তিরুপে সবুজ ওর সামনে প্রতীয়মান। এর আদ্যোপান্ত সম্পূর্ন মিমের অজানা।
তাল হারিয়ে মিম পা পিছলে পড়ে যেতে লাগলে, সবুজ ওর হাতদুটো দ্বিতীয়বারের মতো ধরতে একসেকেন্ড ও বিলম্ব করেনি। ভীরু ভীরু দৃষ্টিতে মিম সবুজের দিকে তাকায়। কিছু একটা ভেবে নিয়ে সবুজ মিমের হাত ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
” তোমার হাতে কিছু খেতেও আমার ঘেন্না লাগে। প্লিজ বিরক্ত করোনা। আমাকে একা ছেড়ে দাও।”
ছলছল চোখে মিম ফ্লোরে পড়ে থাকা ওষুধ আর পানির দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে।
প্রচন্ড রাগে আর ঘৃনায় সবুজের মাথার তালু জ্বলতে থাকলো। ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে, এই মেয়েকে বাঁচাতে ও গাড়ীর সামনে পড়েছিলো। ও এতো অসুস্থ জানা সত্বেও ওকে একটিবার চোখের দেখাও দেখতে আসলোনা। আর ও কিনা অসুস্থতাকে দূরে সরিয়ে মিমকে একপলক দেখার জন্য উথালপাতাল লাগিয়ে দিয়েছিলো। তাইতো আস্তে আস্তে পা ফেলে লুকিয়ে চুরিয়ে মিমকেই দেখতে গিয়েছিলো। আর ওর সো কল্ড স্ত্রী নিজের রুমে না থেকে মেঘের হাতে হাত রেখে হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত। ওর অসুস্থতাকে বেশ ভালোভাবেইই কাজে লাগাচ্ছে ওরা। সবুজের সারা শরীর ঘামতে লাগলো। ক্ষণেক্ষণে হৃদয়পটে একটি ভাবনায় উদিত হতে লাগলো। মিম আর মেঘের মাঝে কি সম্পর্ক?
সারাজীবন পড়াশুনো নিয়ে পড়ে থাকার জন্য নিজের চেহারার দিকে তাকানোর সময় সবুজের হয়নি। স্কলারশিপ পেয়েও বাবা-মাকে ছেড়ে দূর দেশে থাকার সাহস ওর হয়ে উঠেনি।
উল্টোদিকে মেঘ ছোট থেকেই বিদেশি কালচারে বড় হয়েছে। যথেষ্ট স্মার্ট আর সুদর্শন। অনেক মেয়েরি ক্রাশ। মিমের চোখেও হয়তোবা মেঘ তেমনি একজন।সামনে কম্পেয়ার করার মত এইরকম একজন থাকতে মিম কেন ওর দিকে দৃষ্টি দিবে। সত্যিইতো মিমের আর কি দোষ! জোড় করে কি কোন কিছু হয়। থাকুক না ও মেঘকে নিয়ে ভালো। অযথা এই মিনিংলেস বিয়ে বিয়ে খেলা দিয়ে ওদের সম্পর্কটা ভাঙার কোন অধিকার সবুজের নেই।
সবুজ হাত মুঠ পাকিয়ে ওয়ালে ঘুষি দেয়। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে দাঁত মুখ খিঁচে ফ্লোরে বসে পড়ে। ভাবনাগুলো বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। শুকনো বালুকণার মতো বাতাসের তান্ডবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে যেতে থাকে।
চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here