#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ১
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা
ডাক শুনতে পেয়ে চটজলদি খাবার রেডি করে বাক্সে ভরে দিতে দিতে মুনা জবাব দিল
শুনছি, বলুন।
ও কাঁদছে কেন দেখেছ?
মুনা টিফিনবাক্সটা নিয়ে লিভিংরুমের দিকে ছুটলো। লাল সোনালী শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা পড়া বধূটি বেগুনি রঙের ফ্রক পড়া একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে খেলছে। তার হাতের পুতুল কেড়ে নিতেই সে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলছে
আহহহ আমাল।
বধূটি বলছে, না এটা আমাল। বাচ্চা মেয়েটি কেঁদে উঠছে তক্ষুণি। পুতুল দিতেই আবারও শান্ত।
নীরা তাকে কোলে নিয়ে গালে আদর করে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো
রিইই’কে ডাকো।
মেয়েটা মুখে মুখে ডেকে উঠলো
রিইইই
নীরা খিক করে হেসে বলল
আরও জোরে ডাকো। বলো রিইই আসো।
গোলগোল চোখ পাকিয়ে নতুন বউয়ের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালো বাচ্চা মেয়েটা। মাথা নেড়ে বলল,
রিইই নাই?
তার ঝলমলে চুলগুলো নড়ে উঠলো। নীরা হেসে বলল
আছে।
ছাইরঙা শার্ট পরিহিত, এক সৌম্যদর্শন পুরুষকে দেখা গেল সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে। তার খালি পা। হাতে একটা লোহার বালতি।
তৃতীয় তলায় তার অফিস নির্মাণের কাজ চলছে। রাজমিস্ত্রীরা এসে পড়েছে।
নীরা অবাক হয়। মানুষটা এত সাদাসিধা দেখে মনেই হয় না উনি এ শহরের স্বনামধন্য একজন এডভোকেট । অবশ্য একারণেই হয়ত তিনি স্বনামধন্য। এত সাধারণের ভেতরে অসাধারণ একজন মানুষ তিনি নীরার চোখে। নীরা এজন্যই মানুষটাকে মন দিয়েছে। একদিন ঠিক সেও তার মন পাবে।
পরী হাততালি দিয়ে উঠলো।
রিইই ওততো। রিইই?
রিপ বালতি রেখে দিল। ঘাড় ফিরিয়ে শাড়ি পড়া মেয়েটি আর তার কোলের বাচ্চাটির দিকে তাকালো। নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে উত্তর দিল
জ্বি।
রিইই নাই?
এইতো এখানে। কি বলবেন? পাপা কাজ করছি।
পরী নীরার মুখের দিকে তাকালো। অর্থাৎ আমি রিইইকে ডেকেছি। নীরা তার গালে আরেকটা চুমু খেয়ে বলল
বলো, রিইই চা খাবে?
পরী ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মুনা এসে বলল
কিরে দু’জন মিলে কি ঝগড়া করছিলি নাকি?
হ্যা।
রিপ ঘাড় ঘুরিয়ে খানিকটা অদ্ভুত চোখে তাকালো। এটুকুনি বাচ্চা মেয়ের সাথে ঝগড়া?
রিপকে ওভাবে তাকাতে দেখে নীরা লজ্জা পেয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল।
রিক এসে বলল
মা আসছি। টা টা।
পরী ঠোঁট বাঁকালো। মুনা বলে উঠলো
আহা যাওয়ার সময় ওকে দেখা দেয়ার কি দরকার? কান্না থামতে কতক্ষণ লাগে জানেন?
নীরু ওকে নিয়ে চলে যাহ তো।
নীরা ওকে কোলে নিল। পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো জোরে। ধমক দিল
নীআআ মাববো।
রিক হেসে বলল
আচ্ছা আসো। আদর করে দেই।
পরী ঝাঁপ দিল তার কোলে। কাঁধে পড়ে থাকলো। রিক যাওয়ার সময় রিপের কোলে দিয়ে দিল। রিপের তাকে শান্ত করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নীরা দৃশ্যটি দেখে আনমনে হাসলো। তারও এমন একটা বাচ্চা হবে। এডভোকেট সাহেব এভাবে তাকে শান্ত করাবে। ভাবতেই নীরার লজ্জা লাগলো।
—-
তোর পছন্দ হলে হবে? বউ নাকি ছোটমাছ খায় না।
কে?
তোর বউ।
রিপ নীরার দিকে তাকালো। নীরার মুখের পাশটা ঢাকা পড়েছে ঘোমটার আড়ালে।
ছোটমাছ খাবে না? তাহলে কি এখন আবার আমাকে বাজারে যেতে হবে?
তোর আব্বা বললো যাবে। নতুন বউ। ওর পছন্দ অপছন্দ জেনে নিবি না? মাংসের গন্ধ আর কারো ভালো লাগছে না। তাই তোকে মাছ আনতে বলেছি।
কি মাছ খায়?
প্রশ্নটা কাকে করলো কেউ বুঝতে উঠতে পারেনি শুরুতেই। নীরা বুঝে উঠার সাথে সাথেই পাশ ফিরতেই একদম চোখাচোখি হয়ে গেল রিপের সাথে। দ্রুত চোখ সরিয়ে মাথা নামিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি করতে করতে গেল
আমি ছোট মাছ খাব।
মুনা বলল
ওইদিন চিংড়ি খেয়েছিল দেখলাম। ফ্রিজে আর নেই । পেলে চিংড়ি আনিস।
রিপ কথাটা শুনে চলেই যাচ্ছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার তাকাতেই নীরার চোখাচোখি হয়ে গেল পুনরায়। রিপ মুনাকে জিজ্ঞেস করলো
এলার্জি আছে?
আমার কেন এলার্জি থাকবে?
পরক্ষনেই বুঝতে পেরে বলল
ওহ নীরুর? এই তোর এলার্জি আছে চিংড়িতে?
নীরা মিথ্যেই বললো। চিংড়ি খাওয়ার জন্য হাজারটা মিথ্যে বলতে সে রাজী আছে। বাবা কখনোই তাকে চিংড়ি খেতে দিত না। এখানে তো বাবা নেই। সে খেয়ে ফেলতে পারবে। এলার্জি হলে হোক। বাবার মতো চিন্তিত হওয়ার মানুষ এখানে এখনো হয়নি। যার সাথে তার দু-মাসের সংসার এক ঘরে থেকেও তার বুকে এখনো ঠাঁই হয়নি তার। নীরার কান্না পায় না কারণ মানুষটাকে সে সময় দিয়েছে। তা যদি হোক সহস্র শত বছর। এক ঘরে পাশাপাশি থেকে মাঝরাতে জেগে উঠে যখন সে মানুষটার মুখটা দেখতে থাকে তখন মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ এখানেই । আরেকটু কাছে গিয়ে দেখলে হয়ত সে মরেই যাবে। বাবা তাকে বলেছে, নীরা মা তুই তার বর্তমান,তুই তার ভবিষ্যৎ। অপেক্ষার ফল মিষ্ট হয়। দেখিস একদিন তুই তার রাণী হবি, আমি তোকে রাজার হাতেই দিয়েছি। নীরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকে। মানুষটা তাকে ভালোবাসবে, তার জন্য পাগলামি করবে এসব কেমন স্বপ্নের মতো তার কাছে। আর সে সেই স্বপ্ন জেগে জেগে দেখে।
—————-
ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলতে গিয়ে রাত হয়েছে তা খেয়ালই ছিল না রিপের। অফিসটা হয়ে গেলে সে এই ঘর ছেড়ে দিতে পারবে। নিজের ঘরটা এখন তার একার ঘর নেই। রাত দশটা নামার আগেই মেয়েটার ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তাও লাইট জ্বালিয়ে রাখলে ঘুমাতে পারেনা। বিছানার এপাশ ওপাশ করতে থাকে। রিপের এসব খারাপ লাগে। তাই সে অফিস নির্মাণের কাজে হাত লাগিয়েছে গত একমাস ধরে। কাজ শেষ। দরজা জানালার কাজ চলছে। আর দু’দিনের মাথায় সে অফিসে ডেস্ক সাজিয়ে ফেলবে।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোতেই রিপ ঘুমাতে গেল। বিছানার অর্ধেকটা জুড়ে নারী শরীর লেপ্টে আছে। শুয়েছে বেশ গুছিয়ে। রিপ পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। লাইট অফ করে দেয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় কচকচ আওয়াজের শব্দে তার চোখ খুলে গেল। ফোনের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে বেশ জোরে নখ দিয়ে হাতের চুলকাতে দেখলো। রিপ এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল চুলকানোর অংশটা লাল হয়ে গিয়েছে এবং গুটিগুটি দানা দেখা দিয়েছে। মেয়েটার এলার্জি আছে সেটা তাকে মিথ্যে বললো?
নীরা চোখ ফিরিয়ে পাশের জনকে দেখতে যাবে তখনি চোখাচোখি পড়ে গেল রিপের। ফোনে আবছা আলোয় দুজন দু’জনকে দেখে খানিক্ষণের অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও নীরার কাছে মুহূর্তটি ছিল অসম্ভব প্রিয়। এভাবে তার উপর ঝুঁকে থাকার সময় মানুষটাকে চমৎকার লাগছিল। সে হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল
শালার এলার্জি।
রিপ গলা খাকাড়ি দিয়ে তখনি বলে উঠলো
মিথ্যে কথা আমার একদম পছন্দ না নীরা।
নীরা চমকালো। এভাবে ডাকটা শোনার জন্য সে হাজারবার মিথ্যে বলতে রাজী। হাজার বার।
হাত চুলকাতে চুলকাতে সে ছিঁড়ে ফেললো চামড়া। খেয়াল করলো খুব জ্বলছে। হাতে কম বুকে বেশি। তাকে একটু বুকে টেনে নিলে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যেত।
_____________
হসপিটালে আজ হাফ নাইট ডিউটি ছিল আদির। ডিউটি থেকে ফিরে দেখলো সবুজ রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায়। ঘরে ডিমলাইট জ্বলছে। সে লাইট জ্বালায়নি। এপ্রোন, ব্যাগ সব বিছানায় রেখে হাতের ঘড়ি খুললো। গলার টাই খুলতে খুলতে গিয়ে বসলো রকিং চেয়ারটাতে। আজ পেশেন্টের বেশ চাপ ছিল। অনেকদিন পর কাজে ফেরার পর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিল চেয়ারে। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো ছোট্র ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে আসছে ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে। তার ঝলমলে চুল, ডাগর ডাগর চোখ, তুলতুলে শরীরটা ঝাঁপ দিয়ে কোলে তুলে নিল আদি। আদরে আদরে ভরিয়ে দিল মুখখানা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকের সাথে।
কল্পনা মনে হতেই তার চোখের কোণা ভিজে উঠেছে। ফোনের স্ক্রীনে মেয়েটির ছবির উপর গভীর চুমু খেল সে।
তারপর কি হলো কে জানে। চেয়ার ছেড়ে উঠে চেয়ারটা এক লাতি দিয়ে দূরে সরালো। বিকট শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠলো ইশা। বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই ডেকে উঠলো
ডক্টর!
কখন এসেছেন?
আদি জবাবহীন ফিরে তাকালো। ইশা ভড়কে গেল তার চোখদুটো দেখে। মিনমিন করে বলল
কি হয়েছে?
আদি দাঁত কিড়মিড় করে বলল
আমার মেয়ে এখানে কবে আসবে?
ইশা নিরুত্তর রইলো।
চলবে……