মন দিয়েছে ধরা পর্ব -০৯

#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ৯
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা

নীরার ফোন বাজছে অনেকক্ষণ থেকে। নীরা ইচ্ছে করে ফোন তুলছে না। সাইলেন্ট করে রেখেছে। সে পণ করেছে এডভোকেটের ফোন সে কিছুতেই তুলবে না। নিজেকে ভাবেটা কি? নীরা যে রাগ করে চলে এল সেটা কি মাথায় নেই? কোন সাহসে ফোন করে নীরাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে?

সেদিন নীরার মায়ের সাথে কথা হয়েছে রিপের সাথে। শ্বাশড়ি মা জামাইয়ের এক কথায় পটে গেল দেখে নীরা ভারী অবাক। মানে তিনি কি এমন বলেছেন যার জন্য জামাইয়ের যশোগান করে উল্টিয়ে ফেলছন তার মা জননী?

নওফুজ সাহেবও সেরাতে বেশ খুশির খবর নিয়ে আসলেন। বেশ খুশি দেখালেন উনাকে। নীরাকে ডেকে বললেন

নীরা মা এডভোকেট সাহেব তো দেখছি ফাটিয়ে দিয়েছে। মামলাটা চলছিল গত তিনমাস ধরে ওই রাজনীতিবিদ কাশেম মোল্লার ছেলের সাথে। আজ শেষ হয়েছে। শালার জেল হয়ে ভালো হয়েছে।
জামাই তো দেখছি আমার বড়ই সুবিধা করে দিল কেস জিতে। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আমাকে তো ফ্রিতে চা খাইয়ে দিল এই বলে আমি খান সাহেবের শ্বশুর। আহা গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছে।

নীরা চেঁতে উঠে বলল

তো সবাই ঢোল পিটিয়ে সেটা বলে আসো উনাকে। তোমাদের কোলে নিয়ে নাচবে।

নাজিয়া বেগম ধমক দিয়ে বলল

কিসব কথা! তোকে সহ্য কিভাবে করে সেটাই ভাবি মাঝেমধ্যে। কত শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে। ভাগ্য করে এমন মেয়ে জামাই পেয়েছি। দেখ নীরু একদম বেয়াদবি করবিনা জামাইয়ের সাথে। তুই নাকি ফোনটোনও ধরছিস না?

সেসবও বলেছে? বাহ।

নীরা জেদ করে ফোন অফ করে রেখেছে। দুপুরে খুলেছে। তখন থেকে এখন অব্দি দুবার ফোন এসেছে। আচ্ছা রেগে থাকা বউয়ের রাগ ভাঙাতে মানুষ শুধু দুবার ফোন দেয়? ধুরর কার কাছে কি আশা করে সে? কাঁঠাল গাছে আম চাওয়ার মতো।

তারপরের দুদিন কোনো ফোন এল না আর। নিজের দোষে কি এবার সব শেষ হয়ে গেল নাকি? নীরার ইচ্ছে হলো হাউমাউ করে কান্না করতে। কিন্তু তার কান্না এল না। সে গুম ধরে ঘরের ভেতরে বসে বসে শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো কবে উনি আসবেন। এসে নিয়ে গেলেই তো হয়। নীরা কি একবারও যাবে না বলেছে? তার তো ঝগড়া করতে না পেরে ভাত হজম হচ্ছে না।

পরের দিন নওফুজ সাহেব বাড়িতে দুঃসংবাদ নিয়ে হাজির হলেন । মেয়ের উপর খানিকটা ক্ষেপে গিয়ে বললেন

ছেলেটা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে দুদিন হলো। তোর কি এটা করা ঠিক হলো? আমি না শুনে এলে তো তুই জানতেই পারতিস না। ওই বাড়ির সবাই কি মনে করবে এখন? এতটা স্বার্থপর হওয়া যায় না নীরা মা।

মা আচ্ছা করে বকে দিয়ে বললেন

হারামির মতো স্বভাব তার। ওরকম একটা ছেলের সাথে তোর এমন করতে ইচ্ছে হলো নীরু? ছেলেটা কি কষ্ট পেল না? কষ্ট না পেলে তোকে জানাতো না এই বিষয়ে? হ্যা গো বেশি আঘাত পেয়েছে কি?

হাতে নাকি বেশি আঘাত লেগেছে। হাঁড় ভেঙে গিয়েছে। অনেকদিন হাতটা নড়াচড়া করতে পারবে না।

নীরার তখন অন্য কোনোকিছু মাথায় নেই। সে তো জানে যত কিছু সে করছে সবটুকুই মানুষটার কাছে যাওয়ার জন্য। যাকে সে তার সবটা দিয়ে ভালোবাসে তার ক্ষতি, আঘাত, অসম্মান কখনোই চাইবে না সে। ঘরে গিয়ে এতদিনের জমানো কান্নাদের সে প্রশয় দিল। রাতারাতি ফিরে গেল খান বাড়িতে। তালহা বেগম তাকে দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। নওফুজ সাহেবকে বললেন

কেমন মেয়ে আপনার? স্বামী তো শত্রু হলেও মানুষ এমন মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনা সেখানে আপনার মেয়ে দু’দিন একটা ফোনও দিল না। আপনারাও কেউ এলেন না? এ কেমন কথা? আপনার মেয়েকে আপনি নিয়ে যান। ওর এমন বউয়ের দরকার নেই।

মুনা ছুটে এসে অপ্রস্তুত হেসে নওফুজ সাহেবের হাত ধরে বলল

আঙ্কেল মায়ের কথায় কিছু মনে করবেন না। বসুন। আমি রিপকে খবর দিচ্ছি।

নওফুজ সাহেব নীরার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল

না নিজেদেরই তো দোষ। কি মনে করব? আমার ছেলে হলে আমিও একই ব্যবহার করতাম।

তালহা বেগম নীরার দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলেন

দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও আরও কিছুদিন থেকে এসো বাপের বাড়ি। কি আজব মেয়ের বাবা!

রিক এল। নওফুজ সাহেবের বুকে বুক মিলিয়ে সোফায় বসে বললো

কি রে নীরু তোর আসতে এত দেরী হলো কেন? আঙ্কেল ওকে আবার বকাঝকা করেননি তো?

নওফুজ সাহেব নীরার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বললেন

কি আর বলব? এত বড় মেয়ে হয়েও যদি নিজের ভালোমন্দ না বুঝে। জামাই যদি আসতে না পারে গিয়ে দেখে আসি।

রিক বলল

ও আসছে। এই মুনা রিপকে আসতে বলো। এই নীরু তুই যাহ বোরকাটা পাল্টে আয়। মায়ের কথায় মন খারাপ করিস না।

নীরা মাথা দুলিয়ে পা বাড়াবে তখনি রিপের আগমন তাই সে আর পা বাড়াতে পারলো না। রিপ তার দিকে একপলক তাকিয়ে নওফুজ সাহেবের কাছে এগিয়ে গেল। কথাবার্তা বলা শেষে নওফুজ সাহেব মেয়ের প্রতি আরও রুষ্ট হলেন। এত ভালো একটা ছেলের উপর কি করে রাগ করে থাকলো তার মেয়েটা। তালহা বেগম এসে বললে

তোর শ্বশুরকে কিছু তো বল রিপ। উনার ধিঙি মেয়ে ধেইধেই করে গেল আর ফিরলো না এমনকি একটা ফোনও করলো না।

নীরা কোমল চোখে তাকিয়ে রইলো রিপের দিকে। মানুষটা দুদিনে কি পরিমাণ শুকিয়ে গিয়েছে। একদিকে তার দুঃখ অপরদিকে নিজের উপর রাগ লাগছে অন্যদিকে কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে তাকে কেউই কেন বুঝে না।

রিক বলল

মা থাক না। আর বকো না।

মুনা চা নাশতা নিয়ে এল। বলল

এ কিরে নীরু তুই দাঁড়িয়ে আছিস এখনো? যাহ বোরকা খুলে আয়।

নীরা যেতে যেতে শুনলো নওফুজ সাহেব বলছেন

এসব কি করে হলো বাবা? সাড়তে কতদিন লাগবে? আমি শোনামাত্র ছুটে এলাম। আমার মেয়েটা এত বোকা।

রিপ উত্তরে বলল,

না তেমন কিছু হয়নি।

নীরা যেতে যেতে ব্যঙ্গ করলো

নাহহ টেমন কিচু হয়নি। এর শোধ তুলে নেবে সে।
সবাই শুধু তার দোষ দেখে।

*********

বোরকা পাল্টে কোমরে গুঁজা শাড়ির আঁচল মেলে দিল। ঘর থেকে বেরুতে যাবে তখনি রিপের মুখোমুখি পড়ে গেল। ডান হাতটা গলার সাথে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঝুলানো। নীরা ব্যান্ডেজ থেকে চোখ তুলতেই রিপ তার দিকে এগিয়ে এল। নীরা দ্রুত তিন চার পা পিছিয়ে গিয়ে বলল

আমি কি ভয় পাচ্ছি নাকি?

রিপ কপাল ভাঁজ করে ড্রেসিং টেবিল থেকে তার চাদর নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল

তুমি আমাকে ওইদিন মুখ বেঁকিয়েছ নীরা!

নীরা তার দিকে ফিরে তাকালো। বাহ সেদিন তাহলে নীরাকে দেখেছে!

হ্যা তো?

কি অদ্ভুত! স্বীকারও করছে।

চাদরটা জড়াতে গিয়ে অসুবিধে হচ্ছে রিপের। নীরা গিয়ে চাদরটা কেড়ে নিল। বলল

কোথায় যাবেন?

কাজ আছে

চাদরটা জড়িয়ে দিতে দিতে নীরা নাকের অগ্রভাগ ফুলিয়ে অধিকারবোধ দেখিয়ে বলল

এবার নিজ থেকে ফিরে এসেছি। এর পরের বার ফিরে আসব না।

রিপের ঠোঁটের কোণার বিচ্ছুরিত হাসিটা নীরার বেশিক্ষণ দেখার সৌভাগ্য হলো না। রিপ যেতে যেতে বলল

তোমার অভাবটাও নিয়ে যেও পরের বার। ব্যস। একটা ফোনও যাবে না।

*********

অনেকদিন পর আদির কল পেয়ে রিপ বাকহারা হয়ে পড়েছে। ফোন কানে দিয়ে দুইবন্ধু অনেকক্ষণ চুপটি করে থাকলো। শেষমেশ আদি নিজ থেকে জানতে চাইলো

কেমন আছিস? হাতের কি অবস্থা? এক্সিডেন্ট কি করে হলো?

হয়ে গেল। বিপদের কি হাত পা আছে? তোরা কেমন আছিস? পরী মা? ইশু?

সবাই ভালো আছে। মিষ্টি বার-বার তোর কথা বলে কাঁদছিল সিরিয়াস কিছু হয়েছে কিনা এই ভেবে। ও পাশে আছে কথা বল।

ইশা ফোন নিয়ে বলল

রিপদা বেশি আঘাত লেগেছে? আমি কাল আসবো তোমাকে দেখতে। এখন কেমন আছ?

ভালো আছি। চিন্তা করিস না। ঠিক হয়ে যাবে। কাল কি পরীকে নিয়ে আসবি?

ইশা আদির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলো। বলল

আসলে উনি…

আদিকে দে।

ইশা আদিকে ফোনটা দিয়ে দিল। বলল

হ্যা বলছিলাম যে কাল তুইও আয়। তাহলে আমরা..

তুই হসপিটালে এলে আমাকে ফোন দিস। কাজের চাপে আছি তাই যেতে পারব না। মিষ্টি যাবে রেহানকে নিয়ে। আবার চলে আসবে। তুই এখন আপাতত রেস্টে থাক ঔষধ ঠিকঠাক খাহ। নীরা কেমন আছে?

হুম ভালো।

ওকে নিয়ে বেড়াতে আসবি।

আসবো। তুই কবে আসবি এখানে? ভুলে গেলে চলবেনা এটাই তোর শ্বশুরবাড়ি।

আদি ফোঁস করল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল

জানি।

*************

রাতের খাবারটা খেয়েদেয়ে চলে গেলেন নওফুজ সাহেব। নীরাকে বলে গেলেন জামাইয়ের যত্ন করতে। তাদের পর এই মানুষটাই তার ভবিষ্যৎ। এবং উনার বিশ্বাস ছেলেটা ছাড়া নীরাকে আর কেউ অতটা ভালো রাখতে পারবে না। মেয়ের এত অবুঝ হলে চলে না। নীরা বাবার সাথে হ্যা’এ হ্যা মিলালো। বাবাকে চলে যেতে দেখে মন খারাপ হলো। যদিও সবাই অনুরোধ করেছে সকালবেলা যেতে উনি থাকতে চাইলেন না মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে।

নীরা পুরো রুমটা ভালো করে ঝাড়ু দিল। বিছানার বেডশীট পাল্টালো। বালিশের কভার পাল্টালো। সবগুলো ওয়াশিং পাউডারের পানিতে চুবিয়ে রাখলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা কাপড় দিয়ে মুছলো। টেবিল মুছলো। বইয়ের রেকটা পরিষ্কার করলো। কই একটু সরেছে এর ভেতর ঘরটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে রেখেছে লোকটা। রিপ এসে তাকে টুলের উপর দাঁড়িয়ে মাকড়সার জাল পরিষ্কার করতে দেখলো ঝাড়ু দিয়ে। বলল

কি করছো এসব?

ঘরটা পঁচিয়ে রেখেছেন।

দুদিন ধরে ঝাড়ু দিইনি তাই।

জানি। আপনারা বিছানা ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি বেডশীট গুলো ধুঁয়ে ঘুমাবো।

কাল সকালে ধুঁতে পারবে।

নীরা তার দিকে চোখ ফিরে চাইলো। টুল থেকে নেমে সামনে এসে রসিয়ে রসিয়ে বলল

এখন ধুলে কি সমস্যা? বউ ছাড়া ঘুম আসছে না? আহারে এই চারদিন ঘুমের অভাবে এত শুকিয়ে গিয়েছেন?

রিপ হতভম্ব চোখে চেয়ে থাকলো। নীরা আবারও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রিপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। বলল

তুমি কি আমার এক্সিডেন্টে খুশি হয়েছ?

নীরাকে আরেকটু রাগিয়ে দেয়ার জন্য হয়ে কথাটা সে বলেছিল কিন্তু সেটা উল্টো হয়ে যাবে কে জানতো?

নীরা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকার বেশকিছুক্ষণ পর ফুঁপিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো

আপনি আমাকে এটুকু চিনলেন? আমি ভাবলাম আপনি আমাকে একটু হলেও বুঝেন এজন্য মায়ের মতো বকেননি। আর এখন দেখছি আপনি আরও ডেঞ্জারাস। আমার সম্বন্ধে এটা ভাবলেন কি করে আপনি?

রিপ শোয়া থেকে উঠে এগিয়ে এসে বলল

আমি মজা করেছি নীরা।

নীরা সরে গেল। বলল

থাক। দিনশেষে সব দোষ আমার হবে সেটা আমার জানা আছে।

রিপ বলল

আচ্ছা আমি সরি। তুমি কেমন কেমন হয়ে যাচ্ছ নীরা।

আমি ঠিকই আছি। আমারই হয়েছে সব জ্বালা। এখানে থেকেও শান্তি নেই, গিয়েও শান্তি নেই।

নীরা যেতে চাইলে রিপ তার হাতটা বাম হাতে খপ করে ধরে ফেললো। নীরা হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার সময় রিপের ডান হাতে লাগতেই সে আঃ সূচক শব্দ করে উঠতেই নীরা আঁতকে উঠলো।

কি হয়েছে?

রিপ ব্যাথাবিদুর চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল

কিছু হয়নি। হয়ে যেত।

নীরা চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল

আপনি আমাকে ছুঁবেন না।

রিপ প্রশ্ন করলো,

কখন?

যখন তখন।

আমি তোমাকে ছুঁই না। দেখি।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here