#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা কারও ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠে পাশে তাকালো। অর্ক তার দিকে চুলে ফুল গুঁজে দেয়। চোখে চোখ পড়লো। হলো প্রথম শুভ দৃষ্টি মিলন।
অর্ক সে চোখে ডুবেই বলল, “তোমার শাড়ির সাথে রঙে মিলেছে তাই লাগিয়ে দিলাম।”
প্রভা চোখ নামিয়ে নিলো। অর্ক উঠে দাঁড়ালো। জলে প্রভার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, “তোমার পছন্দের রঙ কী হলুদই?”
প্রভা মাথা নাড়িয়ে বলল, “পছন্দের কোনো রঙ নেই।”
“কেন?”
প্রভা জলের থেকে সে নকল সাদা শাপলাটি হাতে তুলে নিলো। সে শাপলার দিকে তাকিয়েই বলল, “যার নিজের জীবনই বেরঙা তার আবার পছন্দের রঙ হয়? যদি তবুও একটি বাছাই করতে হয় তাহলে সাদা বলব, রঙবিহীন।”
“সাদাতে যে কোনো রঙ মিশাও তা রঙিন হয়ে যাবে।”
প্রভা শাপলাটি পানিতে আবার রেখে বলল, “তাহলে কালো। কালোর সাথে কোনো রঙ মিশালে তার রঙ পাল্টায় না। রঙিন হয় না। কালো রঙটা সবসময়ই মানুষের পছন্দ অথচ তা মানুষের রঙ হলে অপছন্দ করে। আমার সাথে এই রঙ মিলে।”
অর্ক মাথা নাড়িয়ে বলল, “উঁহু, তোমার রঙ হওয়া উচিত হলুদ।”
প্রভা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
অর্ক উওর দিলো না। মৃদু হেসে চলে গেল সেখান থেকে।
.
.
ঝিনুকের ঘুম ভাঙে সকালে সৈকতের বুকে। সে ঘুম ঘুম কন্ঠে চোখ খুলে সৈকতকে দেখে বলে, “আমি কি আবার ঘুমে পড়ে গিয়েছিলাম?”
আবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখল তারা বিছানাতেই। ঝিনুক একবার ভাবল সৈকতকে বকা দিবে। কিন্তু ওর ঘুমন্ত চেহেরা দেখে থেমে গেল। আধশোয়া হয়ে একগাল হেসে সৈকতের গাল টেনে বলল, “ইশশ আমার জামাইটা কী কিউট! একদম হিরোদের মতো হ্যান্ডসাম।”
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শুধু কর্মকাণ্ডগুলো না কিউট হয় আর না হিরোদের মতো হয়।”
ঝিনুক সৈকতের কপালের চুলগুলো সরি একখানা ভালোবাসার পরল আঁকল তার কপালে। আর বলল, “জানো, তোমাকে অনেক মনে পড়ে আমার। এই ঘরের সব দেয়ালে আমাদের যেন আমাদের লুকোচুরি প্রেমের গল্প লেখা, আজও মনে পড়ে সে দিনগুলো। এই শহরজুড়ে আমাদের স্মৃতির সাম্রাজ্য, আজও সে স্মৃতিগুলো উঁকি মারে মনে চাদর থেকে। তোমার আমার প্রেমের গল্প এই হৃদয়ের এক খাঁচায় বন্দী রেখেছি। সে প্রেমের পাখি বন্দী থাকুক না সে খাঁচায়। কেন বারবার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি কর যেখানে সে প্রেমপাখিটি আবারও উড়াল দিতে চায়?”
সৈকত একটু নড়ে চড়ে উঠতেই ঝিনুক আগের মতো শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
সৈকত চোখ খুলে দেখে ঝিনুক তার বুকের মাঝারে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। সে আলতো করে ঝিনুকের কপাল থেকে গালে পর্যন্ত আঙুল ছোঁয়াল। পরে বলল, “ইশশ পরী, ঘুমন্ত অবস্থা কেমন পরী পরী লাগে তোমায়। শুধু জাগলেই ডাইনীদের মতো ব্যবহার কর। আহ তুমি যদি তোমাকে স্লিপিং বিউটি হতে আর সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে কী ভালোই না হতো। আমি তোমাকে কিস করে একদমই উঠাতাম না। পাশে বসে শুধু দেখতাম তোমায়, নাহয় উঠলেই চাপর চাপর শুরু করে দিতে।”
ঝিনুকের প্রচন্ড রাগ উঠলো তারপরও সে চুপ করে শুয়ে রইল। সৈকত যখন আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো তখনই চোখ খুলে এমন ভান করল যেন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। হাই তুলে চোখ খুলে সৈকতের দিকে তাকিয়ে তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো। ঝিনুক বলল, “তুমি বিছানায় কী কর? তোমাকে না বলেছি নিচে ঘুমাতে?”
“আমার ঠান্ডা লাগছিলো। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে তো তোমারই সেবা যত্ন করতে হতো। তাই ভাবলাম তোমাকে কষ্ট না দেই।”
“সেবাযত্ন মাই ফুট। তোমাকে নদীর মধ্যে ছেড়ে আসতাম।”
ঝিনুক ভেংচি কেটে বিছানা থেকে নিচে নামতেই সৈকত বলল, “এক মগ কফি দেও না।”
ঝিনুক সৈকতের দিকে তাকিয়ে মুখের প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল, “কয় চামচ চিনি নিবেন স্যার?
” দেড় চামচ।”
“আর বিষ?”
সৈকতের হাসি মুহূর্তে উড়াল দিলো। সে একটু কেশে বলল, “লাগবে না।”
ঝিনুক বলল, “গুড বয়। আসছে নবাবজাদা আমাকে হুকুম দিতে। সাহস কত বড়!”
ঝিনুক ফ্রেশ হয়ে বাহিরে যেতেই ডাইনিং রুমে তার খালুকে পায়। খালু খবরের কাগজ পড়ছিলো। সে ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গতকাল পরিশের গিটার ভেঙেছ?”
ঝিনুক মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলল না। প্রভা বলল, “থাক না বাবা। নেও নাস্তা খাও।”
প্রভার বাবা খবরের কাগজ নামিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকালো তার দিকে। তারপর ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এমন কেন করেছ?”
অর্ক রুমে এসে এমন বৈঠক দেখে একটু অবাক হলো। টেবিলের কাছে এসে সালাম দিল প্রভার বাবাকে। তিনিও সালামের উওর দিলেন। অর্ক ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কাঁদোকাঁদো চেহেরা নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আংকেল?”
“বল না মেয়েটা গতরাতে পরিশের পছন্দের গিটার নষ্ট করে ফেলেছে। কোনো কাজ তো পারেই না সব কাজ নষ্ট করে।”
“থাক না আংকেল, বাচ্চা মানুষ।”
খালু আবারও গম্ভীর গলায় বললেন, “কোন দিক থেকে ওকে বাচ্চা মনে হয়। সব ভুল মাফ করা যায় না। পরিশের সবচেয়ে পছন্দের গিটার ছিল। এইটা যে কেউ করুক, শাস্তি পেতেই হবে।”
“সরি খালু ভুল আমার ছিলো।” ঝিনুক সৈকতের কন্ঠ শুনে অবাক হয়। সামনে তাকিয়ে সৈকতকে দেখে। সৈকত সামনে এগিয়ে এসে ঝিনুকের পাশে দাঁড়ায়। বলে, “আমার হাত থেকে ভুলে পড়ে গিয়েছিলো খালু। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।”
ঝিনুক অনেকটা ভয় পায়, খালু যদি সৈকতকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়। তাই নিজের ভুল স্বীকার করাই উচিত ভাবল সে। কিছু বলতে যাবে তখনই খালু বলল, “আরে ভুলেই তো করেছ সমস্যা কি?”
খালুর হাসি উজ্জ্বল মুখ দেখে ঝিনুক হা করে তাকিয়ে রইল। উনি আরও বললেন, “একটা গিটারে কী আসে যায়, এমনিতেই তো ও বাংলাদেশের বাহিরে৷ আসার আগের সেম একটা গিটার কিনে দিব। তুমি যে এমন কিছু ইচ্ছা করে করবে না তা তো আমি জানিই। ভালো কথা আজকে ইন্টারেস্টিং একটা খবর পেয়েছি নাস্তা করে চা নিয়ে কথা হবে।”
“আরে খালু আমার কাছেও মশলাদার কতগুলো খবর আছে। একদম জমবে আড্ডা। শুধু একটা সমস্যা আমি চা বাদ দিয়ে দিয়েছি এখন কফি খাই।”
“তাই নাকি? তাহলে আমিও আজ কফি ট্রাই করে দেখব নে। ঝিনুক আমাদের দুইজনের জন্য কফি করে দিও।”
ঝিনুক হা করে একবার তার খালুর দিকে তাকায় আবার সৈকতের দিকে। আবার তার খালামণি ও প্রভার দিকে। তাদের চোখে মুখেও বিস্ময়।
সৈকত ঝিনুকের পাশ কাটিয়ে চেয়ারে বসতে যেয়ে বলে, “সৈকতের জাদু থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। প্রমাণ পেলে এইবার?”
সৈকত যেয়ে বসল খালুর পাশের চেয়ারে। খালু অর্ক দিয়ে তাকালো। আগের মতো গম্ভীর গলায় বলল, “অর্ক তোমার যদি সমস্যা না হয় তাহলে কি আজ আমার ফুফুর সাথে দেখা করে আসতে পারবে প্রভাকে নিয়ে? উনি অনেক বয়স্ক তাই বিয়েতে আসতে পারে নি। কিন্তু তোমাদের দেখতে চেয়েছে।”
অর্ক মৃদু হেসে বলল, “অবশ্যই আংকেল।”
.
.
ঝিনুক কাজ প্রভাকে তৈরি করে দিয়ে রুমে এলো। তার ছোট মা বলেছিল সুন্দর মতো সাজিয়ে দিতে। যাদের বাড়িতে যাচ্ছে তারা যেন মনে না করে প্রভার দ্বিতীয় বিয়ে দেখে এমন ভাবে এসেছে। কথাটা অনেকটা আজব লাগলেও ঝিনুক কিছু বলল না।
রুমে এসে দেখে তার ফোনে কার যেন ফোন এসেছে চারবার। আননোউন নাম্বার। কল ব্যাক করে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। ওপাশ থেকে এক পুরুষের কন্ঠ, “ঝিনুক বলছ?”
“জ্বি আপনি কে?”
“আমি অর্ণব। আজ ভার্সিটি আসোনি যে?”
“আমি একটু দূরে আছি তাই। কিন্তু আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?”
“অঞ্জলির কাছ থেকে। তোমাকে দেখি নি তাই বলে—-”
অর্ণব থেমে গেল ঝিনুকের কথা শুনে, “এইটা কোন ধরনের ফাইজলামি?”
সৈকত হঠাৎ করে এসে ঝিনুককে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুইহাত তার পেটে আবদ্ধ করে। আর তার চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। ঝিনুক চমকে উঠে। বলে “এইটা কোন ধরনের ফাইজলামি?” তারপর তার মনে উঠে ফোনে অর্ণব আছে তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “ঘরে বাচ্চা আছে তো। দুষ্টামি করছিলো।” ঝিনুক তার আরেক হাত দিয়ে সৈকতের হাত সরানোর চেষ্টা করে।
সৈকত আরও শক্ত করে ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে আর তার গলায়, ঘাড়ে নাক মুখ ঘষতে শুরু করে। ঝিনুক আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। নিশ্বাস হচ্ছে ঘন। অর্ণব ওপাশ থেকে বলল, “ও আচ্ছা। তাহলে কবে আসছ?”
ঝিনুক বহু কষ্টে উওর দিলো, “ক-কয়েকদিন পর। আমি আপনাকে পরে কল দেই, ও জ্বালাচ্ছে খুব।”
“হ্যাঁ অবশ্যই।”
অর্ণব ফোন কাটতেই। সৈকত ঝিনুককে নিজের দিকে ঘুরালো। তার কাঁধের দুইপাশের গ্রিল ধরে বলল, “আমি জ্বালাই তোমাকে?”
ঝিনুক চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “খুব।”
সৈকত একটু ঝুঁকে ঝিনুক গলায় থাকা তিলটায় আলতো চুমু খেল। ঝিনুক সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। সৈকতের চোখ যেয়ে আটকালো তার ঠোঁটে। সৈকত এক ঢোক গিলে ঝিকের দিকে এগোতেই দরজা থেকে খটাখট শব্দ এলো। ওপাশ থেকে বিনুর কন্ঠ পাওয়া গেল, “ছোট মা ছোট মা আমাকে আর অদিনকে বাহিরে নিয়ে যাও না।”
ঝিনুক চোখ খুলে বিস্ময় নিয়ে তাকালো সৈকতের দিকে। এতক্ষণ যেন সে যেন অন্যরম এক ঘোরে ছিলো। সে গভীর এক নিশ্বাস ফেলে, ঝুঁকে সৈকতের হাতের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখল বিনু ও অদিন দাঁড়িয়ে আছে। সে আড়চোখে একবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল।”
সৈকত কপালে হাত রেখে বলল, “এই জালিম জামানা মেরে পেয়ারকা দুশমান। মনটা যায় পুরা পৃথিবীর উপরই একটা কেস কইরা দেই। যখনই একটু রোমেন্স করতে নিব তখনই কারও না কারও টপকায়তেই হবে। ধ্যুর!” রাগে গ্রিলে ঘুষি মারতে যেয়ে নিজের ব্যাথা পেল সৈকত।
.
.
অর্ক রুমে ঢুকে চমকে যায়। বিছানায় প্রভা বসে আছে। লাল হলুদ শাড়ি পরে। দুইহাত ভর্তি চুড়ি, কানেরদুল, ও গলায় একটি চিকন চেইন পরা। চুলে খোপা করা। সে বসে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে তার নুপুরের দিকে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “আমারও কী পাঞ্জাবি পরতে হবে না’কি?”
প্রভা অর্কের কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলল, “আপনার ইচ্ছা, তবে বিশেষ প্রয়োজন নেই।”
অর্ক দেখল প্রভার চোখের পলক ভেজা, কাজল লেপ্টে গেছে। অর্থাৎ সে কাঁদছিল। সে প্রভার সামনে গেল। প্রভার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার চোখের নিচে লেপ্টে থাকা কাজল মুছে বলল, “আজ সকাল থেকে তো আমি তোমাকে কিছুই বলি নি, বাজে ব্যবহারও করি নি। ভালোভাবেই কথা বলছি, তাহলে কাঁদছ কেন?”
প্রভা একটু দূরে সরে গেল অর্ক থেকে। বলল, “আমি আপনার জন্য কখনোই কাঁদি নি।”
কথাটা যেন সুঁইয়ের মতো বুকে লাগল অর্কের।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা একটু দূরে সরে গেল অর্ক থেকে। বলল, “আমি আপনার জন্য কখনোই কাঁদি নি।”
কথাটা যেন সুঁইয়ের মতো বুকে লাগল অর্কের।
অর্ক আশেপাশে তাকাতে শুরু করল। বলল, “আমিও তাহলে পাঞ্জাবি পরে আসছি।”
অর্ক তার ব্যাগ থেকে একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। বের হয়ে আয়নার সামনে হাত দিয়েই চুল আঁচড়ে নিল। আর মানিব্যাগ ও গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, “আসো।”
প্রভা উঠে রুম থেকে বের হতে নিলো তখনই আচমকায় অর্ক তার খোঁপার কাটা খুলে দিলো। ঝরঝরে পরল তার ঘন কালো কেশ। পিছনে তাকিয়ে মুখটা মলিন করে বলল, “এইটা কী করলেন? আমার খোঁপা করতে অনেক সময় লেগেছিল।”
অর্ক আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে প্রভার চুলের একপাশে হাত দিয়ে সিঁথি কেটে ঠিক করে দিলো। আর বলল, “এখন বেশি ভালো দেখাচ্ছে।। আমি বাহিরে যেয়ে গাড়ি বের করছি। তুমি আসো।”
অর্ক সেইখান থেকে চলে গেল। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করে প্রভার। প্রভা আসে কিছু মুহূর্ত পর। সে চুলে আবারও খোঁপা করেছে। তবে এইবার অনেকটা এলোমেলো তার কেশ।
অর্ক কিছু না বলেই গাড়ি চালু করল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলেছিলে তুমি বিনয়কে ঘৃণা করে এখন অথচ তার পছন্দের খোঁপা ঠিকই আজও কর।”
প্রভা তাকিয়ে রইলো জানালার বাহিরের দিকে উদাসীন মনে। বলে, “খোঁপা ওর পছন্দের ছিলো না। আমি খোলা চুলে কেউ দেখুক তা শুধু অপছন্দের ছিলো।”
“আজও ওর পছন্দ অপছন্দের এত চিন্তা?”
“না, শুধু অভ্যস্ত হয়ে পরেছি। অভ্যাস একবার লেগে গেলে ছুটতে চায় না। তা মানুষের হোক, জিনিসের হোক কিংবা অনুভূতির।”
অর্ক অবাক হয়ে একপলক প্রভার দিকে তাকালো। আবার সামনে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “অনুভূতির কীভাবে?”
“মানুষ সুখের অভ্যস্ত হয়ে গেলে দুঃখ তাদের সহ্য হয় না এবং যারা দুঃখে অভ্যস্ত তাদের সুখ দেখলে ভয় লাগে।”
প্রভা বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক যুগ আগে এইসব রাস্তা তার চেনা ছিলো যা আজ অচেনা হয়ে পড়েছে। সবকিছু কত দ্রুত বদলে যায়!
.
.
বিকেল হয়ে এলো। ঝিনুক ছাদের বর্ডারে বসে আছে।তার পরনে একটি গাড় লাল স্কার্ট যেখানে কালো রঙের কাজ ও কালো রঙের টপ। সাথে লাল রঙের একটি স্কার্ফ পরা। সে তাকিয়ে আছে তার পায়ের আলতার দিকে। পাঁচ মিনিট হলো দিল। অথচ এখনই পা ডুবিয়ে দিলো পুকুরের জলে। তার আঁকা লাল আলতা মুহূর্তে মিশে যাচ্ছিলো পানিতে। ঝিনুক তা দেখছিল মগ্ন হয়ে। আর সে মগ্নতায় অতীত কথা মনে পড়ল তার।
অতীতে এই পুকুরটা ছিলো না। কিন্তু ছাদে বসে সে প্রায়ই আলতা মাখত পায়ে। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিলো না। সে যখন আলতা মাখছিল তখন তার খালামণি ডাক দিয়ে বলল, “ঝিনুক তুই কী ছাদে? নিচে আয় তো।”
ঝিনুক একবার তার আলতোভরা পায়ে তাকাল। আবার তা রেখেই উঠে চলে গেল নিয়ে যেয়ে কেউ বসে আছে তার খালুর সাথে। পর্দা লাগানো দেখে চেহেরা দেখতে পেল না। রান্নাঘরে যেয়ে খালামণিকে জিজ্ঞেস করল, “কে এসেছে খালামণি?”
“বিনয়ের পরিচিত একজন, তুই বোধহয় চিনিস না। আগে প্রায়ই বিনয়ের সাথে আসতো। আজ অনেক বছর পর এলো।” খালামণি এক ঝিনুকের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও বলল, “এইটা নিয়ে ড্রইংরুমে দিয়ে আয়।”
ঝিনুক গেল ড্রইংরুমে। সেখানে যেয়ে দেখে একটি ছেলে কথা বলছে খালুর সাথে। মুখ দেখতে পেল না। ঝিনুক সামনে এগিয়ে ট্রে টা টেবিলে রেখে মুখ তুলতেই দেখে ছেলেটা সৈকত। সাথে সাথে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল।সে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো।
সৈকত তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিল। সে খালুকে বলল, “আংকেল এইসবের প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেও এখন চলে যাব। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”
“আরে না কিছু খেয়ে যাও। এতটুকু সময়ের জন্য আসলে হয় না’কি?”
“আরেকদিন আংকেল। আজ যাই। আচ্ছা আংকেল আপনার নাম্বারটা দেওয়া যাবে? আজ বাসা খুঁজে পাই নি। যদি নাম্বার থাকতো তাহলে খুঁজতে সমস্যা হতো না। এছাড়া বিনু প্রায়ই আপনাদের কাছে আসার জেদ করে, ভাবি তো ব্যস্ত থাকে তাই মাঝেমধ্যে আমি নিয়ে আসতে পারতাম।”
“অবশ্যই।” বলে খালু ফোন বের করল। সৈকত আবারও বলল, “আংকেল আপনি তো ব্যস্ত মানুষ যদি ফোন না ধরতে পারেন? ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিলে সুবিধা হতো।”
ঝিনুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। কত সুন্দর মতো নিজের কাজ বের করে ফেলল!
খালু বলল, “একটু দাঁড়াও আমি লিখে আনছি।”
খালু যেতেই ঝিনুক সৈকতের সদিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি পাগল না’কি? আসলে বাসায় এসে পড়েছেন নাম্বার নিতে?”
“অফকোর্স সুইটহার্ট, তোমারও জানা উচিত সৈকত কোনো চ্যালেঞ্জে পরাজিত হয় না। আর হ্যাঁ রাতে কল দিব, তুমিই ধরবে।”
“ওহ হ্যালো, আমি আপনার কথা মানবো কেন? আমি ধরব না, যখন খালু ধরবে তখন বুঝবে।”
হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলো ঝিনুক।
সৈকত বলল, “ঠিকাছে তাহলে খালু ধরলে আমি বলব তোমার আমার প্রেম চলে তাই আমি কল দিয়েছি।”
ঝিনুক তার হাতের ভাঁজ খুলে অবাক হয়ে তাকালো সৈকতের দিকে। রাগী কন্ঠে বলল, “আপনার সাথে আমার কবে থেকে প্রেম চলে?”
“চলে না তো কী হয়েছে? চলবে। ফোন ধর, নাহলে পরে বুঝবে।”
“একদম না। আমি ফোন ধরবই না। দেখি কী করেন।”
বলেই চলে গেল ঝিনুক। অথচ রাতে সে অপেক্ষা করল ফোন এলো না।
ফোন এলো দুইদিন পর। অবাক করার বিষয় হলো সেদিনও ঝিনুক অপেক্ষা করছিলো। রাতে ফোন এলো। দুই রিং বাজতেই ফোন উঠিয়ে নিলো ঝিনুক। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ এলো। সৈকত বলল, “অপেক্ষা করছিলে তাই না?”
ঝিনুক প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল, “একদম না।”
“তুমি গত দুইদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলে।”
খালামণির দরজা দিয়ে বের হতেই ঝিনুক ফোন নিচে নামিয়ে নিলো। সে জিজ্ঞেস করল, “ঝিনুক কে ফোন করেছে রে?”
“রং নাম্বার খালামণি।”
খালামণি আবার ভিতরে চলে গেল। টেলিফোনটা ছিলো তার রুমের দরজার কাছেই। সে টেলিফোন উঠিয়ে নিজের রুমে গেল। দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলল, “এইবার বলুন।”
“মিথ্যা বললে কেন?”
ঝিনুক উওর দিলো না। সৈকত আবারও হেসে জিজ্ঞেস করল, “আজ রাত কথা বলতে পারি?”
“একদম না, আমার ঘুম আসছে।”
অথচ ঝিনুক ফোন রাখল না। কানের কাছে ধরেই রইল। ফোনের ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কলেজে উঠেছ তাই না? কলেজ কেমন লাগছে?”
এভাবেই কথা চলতে থাকলো। কতক্ষণ? ঝিনুক সময় তো দেখে নি।
.
.
জায়গাটা ঢাকার বাহিরে ছিলো বিধায় পৌঁছাতে সময় লেগেছিলো। প্রভার আত্নীয়রা অনেক আপ্পায়ন করল অর্কের। কিন্তু প্রভাকে কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে সেখান থেকে আসার সময় থেকেই।
রাস্তায় গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। অর্ক নিচে নেমে দেখে টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে। আশেপাশে শুধু ক্ষেত, পুকুর ও গাছপালা। আরেকটু সামনেই কয়টা চায়ের দোকান ছিলো। অর্ক সেখানে যেয়ে সাহায্য চাইল। একটা ছেলেকে পাঠানো হলো মেকানিক আনতে। ফেরত এসে দেখে গাড়িতে প্রভা নেই। ফোন দিয়ে দেখে ফোন গাড়িতেই। অবশ্য তার বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ল না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো কিছুটা দূরত্বে এক হলুদ লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পারে। অর্ক সেখানে যেয়ে পাশে দাঁড়ালো প্রভার। প্রভা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাফ করবেন না বলে এসে পরেছি। চলুন ফেরত যাই।”
প্রভা যেতে নিলেই অর্ক তার হাত ধরে নিলো। মুহূর্তখানিক পর ছেড়েও দিল।বলল, “গাড়ি ঠিক হতে সময় লাগবে। এখানো মেকানিক আসে নি। ততক্ষণ এখানেই দাঁড়াই।”
প্রভা আগের জায়গায় আবার দাঁড়ালো। তাকিয়ে রইল পুকুরটার দিকে। অর্ক তাকালো প্রভার দিকে। আবার সামনে তাকালো। অর্ক বলল, “তুমি আবারও কান্না করেছ?”
প্রভা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। অর্ক মৃদু হাসলো। মেয়েটা হয়তো জানেই না ও চোখ, গাল মুছলেই ওর চোখগুলো মুছে যায় না। ও পলকগুলোতে ওর চোখের নোনাজল তখনও আটকে থাকে।
অর্ক প্রভার দিকে ফিরে তাকালো। সামনে এগোল। চোখে চোখ রাখল।
প্রভা সে মুহূর্তেও বুঝতে পারছিলো না অর্ক কী করতে চাচ্ছে। শুধু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। কেননা, আজ পর্যন্ত কেউ তার হাসিটাও খেয়াল করে নি এই মানুষটা কান্না লক্ষ্য করল কীভাবে?
অর্ক প্রভার খোঁপার কাঁটা খুলে দিলো আবারও। পুকুর পারের মিষ্টি ঘ্রাণের হাওয়া এলো তীব্র বেগে। মুহূর্তে প্রভার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। সে সময় যখন সূর্যোস্তের কমলা আভা তার উপর এসে পড়ছিল তখন যেন অর্কের মনে হচ্ছিলো অসময় তার জীবনে বসন্ত এসে পড়েছে, আবারও।
চলবে……
[