#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
ধানমন্ডি ৩২। গাড়ি এসে থামলো কাংক্ষিত রেস্টুরেন্টের সামনে। ছোটখাটো এরিয়া জুড়ে শৌখিনতায় ঘেরা সুন্দর আড্ডা দেওয়ার স্থান! স্বপ্নিলের পছন্দ হলো জায়গাটা। সন্ধ্যায় এদিকটায় ভীড় থাকার কথা হলেও কাকতলীয়ভাবে আজ খুব একটা ভীড় নেই! গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে রাহিতার জন্য দরজা খুলে দিলো স্বপ্নিল। সে গাড়ি থেকে নামতেই স্বপ্নিল বলে,
—ডোন্ট ওয়ারি, আমি জানি এটা তোমাদের ফ্রেন্ডসদের পার্টি। ভেতরে যাবোনা আমি।
রাহিতা চমকায়। ভেতরে যাবেনা তবে এতদূর এলো কেন? দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—তাহলে শুধু শুধু এতদূর এলেন যে?
—কে বলেছে শুধু শুধু এলাম? তোমায় রাখতে এসেছি। এটা কি আমার…
—ওহ! এটাও নিশ্চয়ই আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাই না?
রাহিতার কথায় থেমে যায় স্বপ্নিল। সে তো এখন দায়িত্বের কথা বলতে চায়নি। সে তো অন্যকিছু বলতে চেয়েছিলো। স্পষ্ট বুঝে রাহিতা এখনো সেই একি বিষয়টা নিয়ে অভিমান করে বসে আছে! এ অভিমানি মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে ও? স্বপ্নিল কিছু বলতে চায়৷ বলার জন্য মুখ খোলে কিন্তু এরই মাঝে বাধা দেয় রাহিতার ফোন। কর্কশ শব্দে বেজে উঠে রিংটোন। তামান্না ফোন দিয়েছে লক্ষ্য করে ফোন কেটে দেয় রাহিতা। স্বপ্নিল কিছু বলার পূর্বেই বলে,
—আমার ফ্রেন্ড কল দিয়েছে। আমি ভেতরে যাবো এখন। আপনি কি করবেন এতক্ষণ?
—হ্যাঁ, তুমি ভেতরে যাও। এখান থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে আমার এক ফ্রেন্ডের রেস্টুরেন্ট। আমি ওর সাথে দেখা করবো। তুমি কখন বের হবে তার আগে আমায় কল দিয়ো, আমি চলে আসবো।
—আচ্ছা, ঠিক আছে।
স্বপ্নিলের থেকে বিদায় নিয়ে রাহিতা প্রবেশ করে ভেতরে। যতক্ষণ না ওর অবয়ব কাচের দরজার ওপাশে মিলিয়ে যায় ততক্ষণ সেদিকে চেয়ে রয় স্বপ্নিল। এরপর হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে গাড়িতে ঢুকে সে নিজেও চলে যায় বন্ধুর রেস্তোরার উদ্দেশ্যে!
রাহিতা যেতেই ওকে দেখে এগিয়ে আসে বন্ধুরা। দেখা গেলো সে সবার লেটে এসেছে, তাই এতক্ষণ কেক কাটার আগে ওর জন্যই অপেক্ষায় ছিলো সবাই। তাই ওকে আসতে দেখে একপ্রকার ছুটে গেলো সব ওকে নিয়ে আসার জন্য! রেস্টুরেন্টের এই এক কর্ণার পুরোটাই বুক করেছে তামান্না, ওর সব ক্লোজ বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য। পার্টি বেলুন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে টেবিল, সেখানেই রাখা আছে কেক। যথারীতি সবার উপস্থিতিতে কেক কাটা হলো, সবাই একে-অপরকে কেক খাইয়ে দিলো৷ পার্টি স্প্রে এনে সবার উপর ছড়িয়ে দিয়ে বেশ মজাও করা হলো! সবাই এক এক করে তামান্নাকে কেক খাইয়ে দিচ্ছিলো। তামান্নার থেকে কেক খাওয়া শেষ করে রাহিতা নিজেও একটা কেকের পিস তুলে নেয় হাতে। এরপর সেটা রিমিকে খাওয়ানোর জন্য এগিয়ে দিলো এবং দেখা গেলো রিমির খাওয়া শেষ হতেই ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিবিড়। উদ্দেশ্য মোতাবেক রাহিতার হাতে কেক খাওয়ার জন্য মুখ সামান্য হা করলো। নিবিড়কে দেখে মনে মনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয় রাহিতা, তবুও ভদ্রতার খাতিরে মুখের হাসি বহাল রাখলো। কোনোরকম খাইয়ে দিলো ওকে। এবার নিবিড় যেয়ে কেক নিয়ে এলো। রাহিতার দিক এগিয়ে এসে ওকে খাওয়ানোর জন্য হাত বাড়াতে ধরতেই রাহিতা তড়িঘড়ি করে বললো,
—আমি অনেক খেয়েছি, নিবিড়। আমি আর খাবোনা। তোমরা খাও।
—আরে রাহি, এটা কোনো কথা? কয় পিস-ই বা খেয়েছো? আরেকটু খেলে কিচ্ছু হবেনা। খাও তো!
নিবিড়ের কথায় এবার অসহায়ের ন্যায় রিমির দিক তাকায় রাহিতা। বান্ধবীর ইশারা বুঝে সে সাহায্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। নিবিড়ের হাত রাহিতার মুখের কাছে আসার আগেই দুজনের মাঝে হুট করে ঢুকে যায় সে। ফলস্বরূপ নিবিড়ের কেক রিমি খেয়ে নেয়৷ হুট করে এহেন ঘটনায় চমকে উঠে নিবিড়। সবকিছু বুঝে উঠতে খানিকটা সময় লাগে তার। যখন বুঝতে পারে ব্যাপারটা তখন রিমির আচরণে বেশ বিরক্ত হয়। ওর বিরক্তিকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয় রিমির জ্বা’লাময়ী হাসি! সেদিক চেয়ে কটমট করে সে বলে,
—এটা কি হলো, রিমি? আমি তো রাহিকে কেক খাওয়াচ্ছিলাম। তুমি মাঝখানে এলে কেন?
—ওমা! আমার বান্ধবীর কেক-ই তো খেয়েছি। এটাতে এভাবে রিয়েক্ট করার মানে কি, নিবিড়? রাহির মানেই আমার কেক। আমি খেলে কি এমন হবে?
নিবিড়কে রাগিয়ে দিতে অবুঝের ন্যায় প্রশ্ন করে রিমি। সেদিক চেয়ে দাতে দাত চেপে সে উত্তর দেয়,
—তুমি একটা অসহ্যকর!
—হ্যাঁ, আর তুমি মনে হয় খুব সহ্য’কর?
চোখ পাকিয়ে বলে রিমি। ওর কথায় রাগ চেপে নাক ফুলিয়ে গজগজ করতে করতে অপরদিকে হাটা শুরু করে নিবিড়। ওর যাওয়ার দিক চেয়ে রাহিতাকে চোখ মারে রিমি। ওকে দেখে হেসে হেসে ফেলে রাহিতা। এরা দুজন পারেও! কোনো কথা হলেই ঝগড়া শুরু! ওর ভাবনার মাঝেই তামান্না এগিয়ে এসে ওদের দিকে।
—রাহি, রিমি তোরা দুজন এখানে কি করছিস? জলদি আয়। ওখানে আমরা সবাই গ্রুপ ফটো তুলবো এখন!
কথাটা বলেই দুজনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তামান্না৷ যথারীতি সবার হৈ-হুল্লোড়, হাসি-ঠাট্টায় বার্থডে পার্টি শেষ হয়ে যায়। রাত এখন ১০টা ছুই ছুই৷ স্বপ্নিলের নাম্বারে দু’বার কল করেছে রাহিতা৷ কিন্তু সে ফোন ধরেনি। দশ মিনিট হলো স্বপ্নিলের অপেক্ষা করছে রাহিতা। না ফোন ধরলো, না কলব্যাক করলো। এখন নিরুপায় রাহিতার কাছে চুপচাপ অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় রইলোনা কোনো। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো সবাই। তামান্না যাওয়ার আগে রিমিকে লিফট দিতে চাইলো দু’বার কিন্তু রাহিতা স্বপ্নিলের নিতে আসার কথা বলে সুন্দরভাবে মানা করে দিলো। রিমি ওর সাথে ছিলো এতক্ষণ কিন্তু বারবার বাসা থেকে ফোন আসায় শেষমেশ সে নিজেও চলে গেলো। এখন রেস্টুরেন্টের বাহিরে খুব বেশি মানুষ নেই। আর দু-একজন বন্ধু আছে ছেলেরা যারা নিজেদের বাইক বা গাড়ি নিয়ে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে এ সবকিছু দেখে মনে মনে স্বপ্নিলের প্রতি বেশ বিরক্ত হচ্ছে রাহিতা। আর সেই বিরক্তিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে ঘটলো নিবিড়ের আগমন। চলে যেতে নিয়েও রাহিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে হেটে এলো। কপালে ভাজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
—তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবেনা?
—নাহ। আজ সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।
এবার বিরক্তি না দমিয়ে ত্যাড়া উত্তর দিলো রাহিতা। ওর কথা গায়ে না মেখে হেসে ফেললো নিবিড়।
—আরে, রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম!
—আমায় নিতে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তাই অপেক্ষা করছি দাঁড়িয়ে। তুমি বাসায় যাও।
—ওহ তাই বলো। আমার তাড়া নেই। তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো যখন চলো তোমায় কোম্পানি দিই। একা একা বোর ফিল করছো নিশ্চয়ই?
—এমন কিছুই না, নিবিড়। আমার অসুবিধে নেই। অনেক রাত হয়েছে। তুমি চলে যাও।
—রাত হয়েছে এজন্যই তো আছি। তুমি না হয় ফোন দিয়ে শুনো কতদূর। বেশিদূর না থাকলে আমি তোমায় ড্রপ করতে পারবো ইফ ইউ ওয়ান্ট…
—তার কোনো দরকার নেই। ওকে নিয়ে যাওয়ার মানুষ এসে গেছে। ইউ মে লিভ নাও।
রাহিতা কিছু বলার আগেই স্বপ্নিলের ভারী কণ্ঠস্বর কানে আসে ওদের দুজনের। চমকে পেছন ফিরে তাকায় দুজন। এর মধ্যে স্বপ্নিলকে এ সময় এখানে দেখে যেন যারপরনাই অবাক হয় নিবিড়। যে বিস্ময়ের রেশ স্পষ্ট লেগে ওর চোখেমুখে। নিজেকে সামলে কোনোমতে সুধায়,
—আপনি? সেদিন যে ভার্সিটিতে এসেছিলেন ওই ভাইয়া না? আপনি এখানে কি করছেন?
নিবিড়ের প্রশ্নে আড়চোখে রাহিতার দিক তাকায় স্বপ্নিল। সে এখনো গম্ভীরমুখে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে আছে। ওর মুখ দেখে যা বুঝার স্বপ্নিলের বুঝা হয়ে গেছে। তাই রাহিতার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবিড়ের উদ্দেশ্য ঠান্ডা গলায় বলে,
—তোমায় উত্তর দিতে বাধ্য নই আই গেস।
স্বপ্নিলের কথায় খানিকটা অপমানবোধ করে নিবিড়। সেদিক পাত্তা না দিয়ে রাহিতার কাছে এগিয়ে ওর হাত ধরে স্বপ্নিল বলে,
—চলো। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।
স্বপ্নিলের কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রাহিতা। এমনভাবে বলছে যেন ওর জন্য দেরি হলো। অথচ স্বপ্নিলের জন্যই তো এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো ওকে! পুরনো রাগ মাথাচাড়া দিতেই মুহুর্তে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সে স্বপ্নিলের থেকে। তারপর নিজেই রে’গেমেগে হনহন করে এগিয়ে যায় রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে। বিচলিত স্বপ্নিল রাহিতার পিছু পিছু ছুটিছিলো। এমন সময় নিবিড় বাধা দেয় ওকে। বলাবাহুল্য এতক্ষণ দুজনের সবকিছু নীরবে পর্যবেক্ষণ করছিলো সে। এদের দুজনের মাঝে কিছু যে চলছে এ বিষয়ে নিবিড় আপাতত নিশ্চিত। তাই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে অবশেষে জিজ্ঞেস করে বসে,
—আচ্ছা ভাইয়া, আপনারা দুজন কি ডেট করছেন?
পথে বাধা পেয়ে প্রচুর বিরক্ত হয় স্বপ্নিল। তার মধ্যে নিবিড়ের এমন বোকা প্রশ্ন শুনে রাগটা বেড়ে যায় তরতর করে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে উত্তর দেয়,
—না। এখন সরো সামনে থেকে।
—না মানে? কিন্তু আপনাদের দেখে তো মনে হলো আপনাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক..
—হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে তো! উই আর ম্যারিড। আমি ওর হাজবেন্ড।
—হোয়াট? কিন্তু সেদিন না রাহি বললো..
—সেদিন ও যা বলেছে সেটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্যি হচ্ছে রাহি আমার বউ। হয়েছে সব জানা? হ্যাপি? নাউ এক্সকিউজ মি! আমায় যেতে দাও এখন।
এবার নিজ হাতেই নিবিড়কে সরিয়ে দিয়ে খানিকটা চেচিয়ে বলে ওঠে স্বপ্নিল। এদিকে রাহিতা বিবাহিত জেনে যেন আকাশ থেকে পড়ে নিবিড়! মেয়েটা বিয়ে করেছে? কবে? কই সে তো জানলোনা কখনো। রাহিতা কোনোদিন বলেওনি ভার্সিটিতে! শেষমেশ ও কিনা এতদিন একটা বিবাহিত মেয়েকে পছন্দ করে এসেছিলো? মনে মনে বড্ড হতাশ হয় নিবিড়।
এদিকে গাড়িতে বসা রাহিতার কাছে যেতে যেতে রাস্তা পার হয়ে কি মনে করে যেন থেমে যায় স্বপ্নিল। এক পলক পিছন ফিরে থমকে থাকা নিবিড়ের দিক তাকিয়ে ওর উদ্দেশ্যে শীতল কণ্ঠে বলে,
—আমি বুঝছি তুমি কি ভাবছো এখন, কিন্তু রাহিকে লাইন মেরে লাভ নেই আর। শি ইজ নট ফর ইউ। ওর থেকে দূরে থাকবে সবসময়।
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম। ঈদের পর ফিরে এলাম। কেমন আছেন সবাই? আশা করি সবার ঈদ খুব ভালো কেটেছে! ❤️