#মহুয়া
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব:১৯
প্রিয়তি একমনে রিদুর দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। রিদু চেকবুকটা মাঝখান থেকে ছিড়ে বলল,
” যেদিন আমাকে ক্ষমা করতে পারবে সেদিন তোমার থেকে হেল্প নেয়ার কথা ভাববো। ”
প্রিয়তি মনে মনে ভেংচি কেটে বলল,
” ঢঙ।
রাতে খাবার পর রিদু গিটারটা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো। মাঝে মাঝে গিটারে টুং টাং সুর তুলে গান করতে পছন্দ করে রিদু। আজ মনটা ভালো না। তাছাড়া প্রিয়তি খুশি হবে ভেবে গিটার বাজিয়ে গান তুলল,
ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে নোটবুক নেই কাছে,
তিন নম্বর ভূতের গলি এটুকুই মনে আছে ।
ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে নোটবুক নেই কাছে,
তিন নম্বর ভূতের গলি এটুকুই মনে আছে ।
আর মনে আছে তুমি বলেছিলে রোজ সন্ধ্যার পরে,
এলো চুলে তুমি হাঁটাহাঁটি করো তোমার বাড়ির ছাদে ।
ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে নোটবুক নেই কাছে,
তিন নম্বর ভুতের গলি এটুকুই মনে আছে ।
দেখেছো? আমার স্মরণ শক্তি? সব কথা মনে আছে।
অলিতে গলিতে, দেখা পরিচয়,
ঠিকানার লেনদেন ।
হৃদয়ের কোন, ঠিকানা থাকেনা
কথাটা কি বুঝলেন?
এ কথা জেনেও, হাঁটাহাঁটি করি
ভূতের গলিটা খুঁজি।
তোমার দেখা, পেয়ে যাবো আমি
হঠাৎ করেই বুঝি!
ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে নোটবুক নেই কাছে,
তিন নম্বর ভূতের গলি এটুকুই মনে আছে।
গান শেষে রিদু রুমের দিকে তাকালো। ভাবছে প্রিয়তি গানটা শুনে কেমন রিয়াক্ট করবে তা দেখবে। কিন্তু রিদু হতাশ হলো। কারণ প্রিয়তি শুয়ে আছে। রিদু ধীরে করে ওর কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করল জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু হতাশ রিদুর মনটা এবার কিঞ্চিৎ খারাপও হলো। ভেবেছিলো প্রিয়তি শুনবে গানটা। হয়তো এতে ওর মনটা ভালো হবে। কিন্তু প্রিয়তি তো গান শোনেইনি। রিদু আরও হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আর এদিকে ঘুমের ভান ধরে মনে মনে দুষ্টু হাসি হাসছে প্রিয়তি। দাঁতে দাঁত চেপে, ঠোঁটে ঠোঁট টিপে নিজের হাসি থামাবার যথেষ্ট চেষ্টা করছে ও।
প্রিয়তি মনে মনে ভাবলো,
” এই গান শুনিয়েই প্রেমাকে প্রেমের জালে ফেলেছিলে না রিদুর বাচ্চা রিদু? বিয়ের পর আমাকেও কম পাগল করোনি। পলেটিক্স করো পলেটিক্স? খুব ভালো করে জানো মেয়েদের পছন্দের জায়গা কোনটা। বদ লোক প্রেমার সাথে প্রেম পর্যন্ত মেনে নিতাম, কিন্তু বাচ্চা ও মাই গড! প্রেমা যে এখন শুধু আমার বোন নয় বরং তোমার কারণে আমার বড় সতীনও হয়েছে। রিদু তোমাকে তো ছাড়তে পারব না। সে সাহস আমার নেই। এদিক থেকে আমিও আর পাঁচটা বাঙালী মেয়ের মত পতিভক্ত, আবার অসহায়ও বলতে পারো। সত্যি বলতে অসহায়ই বেশি। নিজের পরিবার বলতে বর্তমানে কেউ নেই। তোমার পরিবারকেই আপন মানি। যাবার মত কোনো স্থান নেই আমার। কিন্তু তা বলে এত সহজে মাফ করবো না তোমায়। হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করেন। তিনি পারলে মানুষ কেন পারবে না! কিন্তু সবাই এটা কেন ভুলে যায় তিনি সৃষ্টিকর্তা, পরম করুনাময়, দয়ালু। তার তো দয়া মায়া, মমতার শেষ নেই। এ জন্য বান্দার চোখের জল তিনি সহ্য করতে পারেন না, ক্ষমা করে দেন খুব দ্রুত। কিন্তু আমরা তুচ্ছ মানুষ বুদ্ধি কম, মায়া, ধৈর্য্য কম তাই ক্ষমা করলেও তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে তবে ক্ষমা করব।”
কয়েক মিনিট কাটার পর প্রিয়তি ভাবলো, চোখ মেলে দেখবে রিদু কী করছে? তাই ধীরে ধীরে চোখ মেলে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। কারণ রিদু ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মিট মিট হাসছে। রাগে প্রিয়তির গা জ্বলে যাচ্ছে। রিদু বেশ শব্দ করে হেসেই প্রিয়তির কপালে খুব ঠেসে চুমো খেয়ে বলল,
” জান কেউ গভীর ঘুমে থাকলে তার চোখ এমন পিটপিট করে না। ঠোঁটে চাপা হাসি থাকে না। আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলে? যে প্রিয়তি সামান্য শব্দে ঘুমাতে পারে না, সে গিটারের শব্দ শুনে, জোরে গান শুনেও সে দিব্যি ঘুমাচ্ছে বিষয়টা অবাক করা নয় কী?”
প্রিয়তি রাগে অপর পাশে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। মনে মনে বলল,
” পাজিটা আমার সব কিছু জানে। বদ কোথার!”
রিদু প্রিয়তির অপর পাশে গিয়ে মুখোমুখি শুয়ে বলল,
” ভালোবাসি।”
প্রিয়তি বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল,
” তো এখন আমি কী করব? রাত দুপুরে নাচব?”
দুষ্টুমি করে রিদু বলল,
” নাচতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। তাছাড়া কাল তোমার অতি প্রিয় বোন তিথির বিয়ে। তাও আবার তোমার দেবরের সাথে। সেলিব্রেশন তো বানতাহে বস!”
তিথির বিয়ের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে প্রিয়তির। তিথির জন্য নয়, প্রিয়মের জন্য। যতই প্রিয়মকে বোঝাক তিথিকে ভুলে যেতে কিন্তু ভাই তো, তার কষ্টটা বোঝে ও। ভালোবাসে যে নিজের ভাইকে খুব। ছোটবেলা থেকে প্রিয়তির সবচেয়ে বেশি ভালো প্রিয়মই বেসেছে। আজ রিদুর সাথে সব ঠিক থাকলে রিদুর সাথে কথাগুলো শেয়ার করত। কিন্তু পারছে না। প্রিয়তি মনে মনে বলল,
” বাবা মা যদি শুধু প্রেমার দিকটা না ভেবে আমার আর ভাইয়ার দিকটাও মাঝে মাঝে ভাবতো, তবে আমাদের দুজনার জীবনটা হয়তো সুন্দর হতো। নিজেদের চাওয়া পাওয়াগুলো পূরন হতো।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রিয়তি। না চাইতেও চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কিছু তরল। রিদু তা দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
” কী হয়েছে?”
প্রিয়তি ভেবেছিলো কিছু বলবে না কিন্তু মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে। না বললে বুকটা আরও ভার হবে। তাই ধীর গলায় বলল,
” প্রিয়ম ভাইর জন্য খারাপ লাগছে। আজ বাবা মায়ের কারণে আমরা দু ভাই বোন কম পেরেশানীতে ভুগিনি।”
রিদু কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমার কী মনে হয় জানো প্রিয়তি? তোমাকে তোমার বাবা মা কুুড়িয়ে পেয়েছে।”
” মানে?”
” না মানে প্রেমার আচরন তো এমনি তোমার বাবা মায়ের সাথে খাপে খাপ মিলে। প্রিয়ম ভাইরটাও হালকা মিলে। তবে তুমি বিপরীত তাই সন্দেহ হয়, তাদের মেয়ে তো তুমি!”
প্রিয়তি বেশ রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
” আমার তোমার সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে।”
তারপর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল।
২৪!!
সকাল থেকে তিথি আর রকিবের আকদের টুকটাক আয়োজন চলছে। রিদুর পরিবার সব রকিবদের বাড়িতে। রিদু অফিস গেছে, ও সন্ধ্যায় আসবে। প্রিয়তি কাজ করতে গেলে রকিবের মা ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন এক জায়গায়। কোন কাজ না পেয়ে প্রিয়তি বসে বসে নকশী পিঠা কাটতে লাগল। রকিব আজ ছুটি নিলেও কিছু কাজে সকালে থানায় যেতে হয়েছে।
তিথির বাসায় তেমন আয়োজন নেই। ওর কয়েকজন বান্ধবী আর কয়েকজন আত্মীয়। তিথির দুই মামা মামি। আর তিথির এক খালা। যদিও আপন না কবে সম্পর্ক খুব ভালো। তিথি বান্ধুবীদের সাথে বসে গল্প করছে। তখন ওর কল আসল। অচেনা নাম্বার। তিথি ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলার পর প্রিয়ম বলল,
” তিথি আমি প্রিয়ম।”
তিথি খানিক নার্ভাস হলেও বলল,
” জি।”
” একটু ছাদে আসবি? জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্য।”
” বাড়িতে কত লোক। এখন কিভাবে যাবো?”
” প্লিজ না করিস না। প্লিজ। আমি তো চলে যাবো এখন। প্লিজ আয়।”
কিছু একটা ভেবে তিথি বলল,
” আচ্ছা।”
চলবে________