সুমন গতকাল তার দ্বিতীয় ছোবল মেরেছে। ব্যাংক আজকে অ্যাকশানে যাবে। আর সুমনই কাজটা ইনিশিয়েট করিয়েছে। আমি নিশ্চিত, ম্যানেজার সাহেব ওপরের অর্ডার যে কথাটা বলছেন, সেটা সুমনই। ব্যাপারটা হয়তো অফিশিয়াল লেটারের মাধ্যমে জানাতো, বাট… প্রাইম মিনিষ্টারের অফিসের অর্ডার। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার তাই অফিশিয়াল পথে যাননি। গতকাল রাতে উনি যেটা করেছে, তা হচ্ছে, নিজে ফোন করে দয়া করে ডিটেলসটা শুধু জানিয়েছেন। বললেন সম্ভব হলে আজকেই যেন আমি দেখা করি।
পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের এই ফ্ল্যাট আর গাড়ীটা কেনার সময় কিছু লোন নিয়েছিল শাহেদ। কতটাকা, মাসে মাসে কত শোধ দিত, কিছুই আমি জানি না। আসলে জানতেও চাইনি, আর এসব যেহেতু আমি বুঝব না, তাই ও বলেওনি। ব্যাপারটা নির্বিঘ্নেই চলছিল। সম্ভবতঃ ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কিংবা বেতন থেকে ইন্সটলমেন্টের টাকা চলে যেত। ফলে এতোদিন লোন নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। শাহেদ রিলেটেড ঘটনাটা ঘটে মাসের প্রথমে। ফলে গত মাসটা আর এই মাসটা দেয়া হয়নি। যদিও এ মাসের আজ বার তারিখ। তারপরও এমাসকেও ওরা ডিফল্টার হিসেবে ধরে নিয়েছে।
কি করব? শোধ দিব কিভাবে? আমার নিজের অ্যাকাউন্টে যা ছিল, তা দিয়ে কোনরকমে চলছি। আর তাছাড়া, আমি তো জানিই না, কিভাবে কি করতে হয়। এসব কাজ তো আসলে শাহেদ নিজেই দেখাশোনা করত, তাই আমার শেখার দরকার হয়নি কখনও। এতোদিন মিসেস শাহেদ হওয়া এঞ্জয় করেছি, আর আজ? আজ সেই নিষ্কর্মা জীবনের কনসিকোয়েন্স ফেস করতে হচ্ছে।
আজ সকালে ক্লাস ছিল। কোনরকমে শেষ করে সোজা ছুটলাম প্রিন্সিপ্যালের অফিসে। পার্সোনাল রিজন বলে ছুটি চাইলাম। তিথির বরও ওখানে ছিল। উনিও রিকমেন্ড করে দিলেন, ফলে সমস্যা হল না। গাড়ীতে বসেই শেলিকে ফোন লাগালাম। শেলিকে আসলে অনেকদিন ফোন করা হয়নি। চাকরী করা নিয়ে সেদিনকার আলাপে ও যে কথাগুলো বলেছিল, ভাল লাগেনি। ভেবেছিলাম, ও স্যরি বলে, ফোন করবে। করেনি। তাই আমিও আর যোগাযোগ রাখিনি।
আজও হয়তো করতাম না, বাট উপায় নেই। বাধ্য হয়েই করলাম। ব্যাঙ্কের ব্যাপারগুলো একটু বুঝে নিতে চাইলাম। বার দুয়েক রিং হওয়ার পরে শেলি ফোনটা ধরল
— বল
ঠান্ডা গলা। মনে হচ্ছে রেগে আছে। এনিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন না। শেলিকে যে করেই হোক, হাতে রাখতে হবে। নরম গলায় বললাম
— কি রে, এখনও রেখে আছিস?
— না, রাগবো কেন? কেমন আছিস?
মনে হল, একটু নরম হল। কখন আবার বিগড়ায়, তাই আসল আলোচনায় আসলাম। কিছুটা সহানুভূতি পেতে তাই বললাম
— ভাল না। জানিসই তো…
এবার অনেকটাই স্বাভাবিকভাবেই কথা বলল। কিছুটা উৎকন্ঠাও। বলল
— আবার কিছু করেছে?
ব্যাংকের ব্যাপারটা খুলে বললাম। শুনে বলল,
— এটা কোন ব্যাপার না। ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করে লোন রিসিডিউল করতে বল, করে দেবে। এতোদিন যেহেতু রেগুলার কিস্তি দিয়েছিস, সমস্যা হওয়ার কথা না।
শুনে কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। এরপরে দ্বিতীয় রিকোয়েষ্টটা করলাম। যেভাবে হোক, সুমনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার। সুমন শুধু লাপাত্তা না, ফোনও ধরছে না। কি যে চাইছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। যদি কিছু করতে পারে, শেলির বরই পারবে। ও যদি ওর বরের মাধ্যমে সুমনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারে, তাহলে একবার অন্ততঃ সুমনকে রিকোয়েস্ট করে দেখতাম।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললাম
— অত্যাচার তো চলছেই।
— এখন কি বলছে?
— ঐ একই জেদ, ওকে ভালবাসতে হবে। এবার টাইম লিমিট দিয়েছে।
— মানে?
— মানে ছয় মাসের মধ্যে ওকে ভালবাসতে হবে।
— এটা আবার কি আবদার? আমার তো মনে হয়, আসলে চাইছে অন্য কিছু।
— না রে। প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। অফারও করেছিলাম।
— কি বলল?
— ঐ, আমার ভালবাসা চায়। কি যে করি?
— আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, বরকে। কিছুই বলতে পারল না। আসলে সুমন ভাইয়ের এতো ওপর মহলে যোগাযোগ, বুঝতেই তো পারছিস, এমন কথা জানতে চাওয়া যায় না।
— আমি যে কি করি। কার কাছে হেল্প চাইব, বুঝতে পারছি না। ফ্যামিলিতে কাউকে কিছু বলতে পারছি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলছি, দেশের বাইরে গেছে।
— কেন? যা ঘটেছে, তাই বলবি।
— পাগল হয়েছিস? কি বলব? ইয়াবা কেসে পুলিশ ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার করেছে? তারপরে কি হবে ভাবতে পারছিস? এই ফ্ল্যাটে আর থাকতে পারব?
বড় একটা নিশ্বাস ফেলার আওয়াজ পেলাম। এরপরে বলল
— তোর ইন ল’দের কি বলেছিস?
— ঐ একই, বিদেশে গেছে, ট্রেনিংয়ে।
— উনাদের তো বলতে পারতি। উনাদের ফ্যামিলির ছেলে।
— তারপরে কি হত জানিস? উনারা খোঁজ করলেই বেরিয়ে যেত সুমন আমার এক্স, আর ও শাহেদকে ফাঁসিয়েছে। তখন? সব জানাজানি হলে প্রথমে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। কি যে হবে, আমি তো ভাবতেও পারছি না।
— দেখ, কি হয়।
— আচ্ছা শোন, একটা হেল্প করতে পারবি?
— আমার বর মনে হয় না হেল্প করবে।
— একটু বলে দেখ না। একটু যদি সুমনের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেয়।
— অ্যাপয়েন্টমেন্ট কেন? তুই ফোন কর।
— করেছিলাম, আনরিচেবল আসছে।
— ঠিক আছে। বলে দেখি।
এরপরে আর তেমন কথা হয়নি। ‘মনে করে বলিস’ টাইপ রিমাইন্ডার আর ‘ কি হয় জানাস’ টাইপ অনুরোধ দিয়ে কথা শেষ করলাম। ব্যাঙ্কে পৌঁছে ম্যানেজারের রুম কোনদিকে, জানতে চাইলাম। এরপরে সোজা ম্যানেজারের রুমে গেলাম। এর আগে কখনও আসিনি। ইনফ্যাক্ট বাইরের কোন কাজেই কখনও আসিনি। আজই প্রথম।
ম্যানেজার সাহেব রুমেই ছিলেন। গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। উনি বেশ বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন
— কেমন আছেন?
— এই তো। চলে যাচ্ছে।
— চা বলি?
— নো থ্যাঙ্কস। আমি আসলে…
এরপরে কি বলব, খুঁজে পেলাম না। কিভাবে এসব ব্যাপার ডিল করতে হয়, জানিও না। বেশ অস্বস্তি নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উনি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন
— দেখুন, ইউজুয়ালি এতো দ্রুত আমরা অ্যাকশানে যাই না, বাট… বোঝেনই তো…
— এখন আমি কি করতে পারি।
ভদ্রলোক একটা বিস্তৃত হাসি দিলেন। বলল
— মিস্টার শাহেদ এখন কোথায়? আই মিন… উনার সম্পর্কে কিছু রিউমার শুনছি।
বুঝতে পারলাম, আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আর বোধহয় লুকিয়ে রাখতে পারব না। আর সব জানাজানি হলে… নাহ আর ভাবতে পারছি না। কোন রকমে মিথ্যাটাই আবার আউড়ালাম
— উনি বিদেশে একটা ট্রেনিংয়ে গেছেন। চলে আসবেন
কথাটা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। বললেন
— তাই?
— জ্বি। উনি ফিরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন যদি একটু কনসিডার করেন।
ভদ্রলোক বিগলিত টাইপ একটা হাসি দিলেন। মনে হচ্ছে রাজী হবেন না। এরপরে বললেন
— দেখুন, অনেস্টলি স্পীকিং, আমার হাত খুব বেশি অপশান নেই। আমাদেরও তো ওপরে জবাব দিতে হয়…
— লোন যারা নিয়েছেন, তাদের কোন সমস্যা হলে ব্যাপারটা আপনারা তো কনসিডার করেন, করেন না? রিশিডিউল করেন না?
গলার আওয়াজে বোধহয় কিছুটা উষ্মা চলে এসেছিল। ম্যানেজার সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকালেন। দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম, নিজের পায়ে কুড়াল মেরে ফেলেছি। উনি আর কোন হেল্প করবেন না। বললেন
— দেখি…
বুঝলাম, সুমন বেশ ভালভাবেই ছোবল মেরেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এরপরে জানতে চাইলাম, কত দিতে হবে। উত্তরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বুঝে গেলাম, ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ী, কোনটাই রাখতে পারব না।
কি করব ভাবতে ভাবতে ফিরছিলাম, এমন সময় তিথির কথা মনে পড়ল। ওর বর তো জানে সুমনকে কোথায় পাওয়া যাবে। তিথিকে ফোন লাগালাম। ধরল
— কি রে, হঠাৎ?
— কেন করতে পারি না?
— পারবি না কেন? আগে তো কখনও করতিস না, তাই বললাম।
— স্যরি বললে হবে?
— না। পার্টি দিতে হবে। চাকরীর জন্য একটা পার্টি তো দিলি না।
— আচ্ছা দেব। আচ্ছা শোন… মানে সুমনকে কোথায় পাওয়া যাবে, জানিস কিছু?
— কেন, তোরও কোন কাজ পড়েছে? না…
— কাজ আছে, বল না।
— কফি হাউজটা চিনিস? সাতাশ নম্বরের।
— হ্যা।
— ওখানে সন্ধ্যা সাতটার পরে থাকে। অন্ততঃ দেশে, আই মিন, ঢাকায় থাকলে, ওটাই উনার ডি ফ্যাক্টো অফিস।
মনে হল প্রাণ ফিরে পেলাম। দেখা করলে কিছু একটা ব্যাবস্থা অন্ততঃ হবে।
বাসায় ফিরলাম। লিফটে উঠতে যাব এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। সুমন করেছে। থ্যাঙ্ক গড। লিফটে আর উঠলাম না। ফোনটা রিসিভ করলাম। আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সুমন শুধু একটা কথা বলল
— ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের প্যানারোমা লেডিস হোস্টেল, ওখানে চলে যাও।
— কেন?
কোন উত্তর দিল না। অবাক হয়ে ফোনটা সামনে নিয়ে এলাম। লাইন কেটে দিয়েছে। রিং ব্যাক করলাম। আনরিচেবল। কি খেলা খেলছে সুমন আমার সাথে? এবার সত্যিই অবাক হলাম। এতোদিন ভেবেছিলাম, ও প্রতিশোধ নিচ্ছে, এখন মনে হচ্ছে অন্য কিছু। ও আসলে আমার কাছে কিছুই চায় না। জাস্ট আমাকে শেষ করে দিতে চায়। লিফট আসল। উঠে টপ ফ্লোরের বাটনটা চাপলাম। লিফটে মিসেস মিত্র ছিলেন। উনি জানতে চাইলেন
— কি ব্যাপার, আপনার ফ্ল্যাটে শুনলাম পুলিশ এসেছিল?
মুখটা ফ্যাকাশে হওয়া আটকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। কোন রকমে বললাম
— কৈ না তো?
মহিলা বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন
— আপনি কিছুই জানেন না?
এবার সত্যিই অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম
— মানে?
মহিলা এবার সত্যিই অবাক হলেন। বললেন
— কিছুক্ষণ আগে যে আপনার বাসায় পুলিশ এসেছিল, আপনাকে জানায়নি?
মাই গড। ব্যাঙ্ক তাহলে একেবারেই সময় দেবে না? মিসেস মিত্র নেমে গেলেন। আট তলায়। বুকের ভেতরে তখন হাতুড়ির বাড়ি শুরু হয়ে গেছে। কি করেছে সুমন। বাসায় ইয়াবা রেখিয়েছে? এবার কি আমাকে অ্যারেস্ট করাবে? কিন্তু তাহলে লেডিস হোস্টেলের কথা বলল কেন? তাহলে কি? ও গড…। লিফটের দরজা খুলে গেল। আমাদের ফ্লোর। লিফট থেকে বেরিয়ে এলাম। বুঝে গেলাম, সুমন কেন লেডিস হোস্টেলের কথা বলেছিল। বাসায় নতুন একটা তালা লাগিয়েছে। দরজায় একটা নোটিশ ঝোলানো। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লোন পে না করার অপরাধে আমাদের ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করেছে। এ কারনেই তাহলে পুলিশ এসেছিল?
মাথা টলছে। মনে হচ্ছে পড়ে যাব। এমন সময় কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরল। বুঝতে পারলাম শক্ত একটা কাঁধে আমার মাথাটা এলিয়ে যাচ্ছে। কাঁধে কেউ হাত রাখল। বুঝতে পারলাম, এটা পুরুষালী ছোঁয়া। জ্ঞান হারাতে হারাতে মানুষটাকে চিনতে পারলাম। এরপরে আর মনে নেই।
চলবে…
-রাজিয়া সুলতানা জেনি