মায়াবতী কাঞ্চনা পর্ব -০৬

#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৬

ব্যর্থ পথিকের মতো চোখের অশ্রুগুলো লুকানোর চেষ্টা করলো সেলিম।সিড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো শেফালীর।রান্নাঘরেই ধোয়া-মোছা করছিলেন তুমি।চারদিকে তাকিয়ে অশ্রুগুলো সংবরন করে শেফালীকে বললেন-

ও বাড়ি এতো মানুষ কেন চাচী?আজ’ই কি বিয়ে?

হাতের প্লেটগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে শেফালী বললেন-

না বাজান,বিয়া না।তয় কহিনুর বুবু কইলো আইজ নাকি কাঞ্চনারে আংটি পড়াইতে আইবো।

বুকের ভেতরটা কেমনা চি*ন চি*ন করে উঠলো সেলিমের।নিজের রুমে যেতে যেতে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বের করলো –

ওহ!

তুমি কিন্তু চাইলেই সুজন মির্জার উপরে কেস করতে পারো।

ভ্রু কুচকে পিছনে তাকালো সেলিম।শেফালি কাজ করতে করতে পুনরায় বললো-

দেহ বাজান।এই দুনিয়ায় কেউ কেউওর না।তোমার এই ভালোমানুষি কেউ দেখবো না।সবার সামনে শক্ত হও দেখবা মানুষেও তোমারে সম্মান করবে। তারা তোমারে কোনো ফয়সালা না দিয়াই মাইয়া বিয়া দেতাছে।তুমি এহনো কাঞ্চনার স্বামী।হেই মাইয়া নিজের তেজ নিয়া চইলা গেছে। না হে তালাক দিছে আর নাতো তুমি।তার পুরা পরিবার আইজ কতগুলো বছর ধইরা লাপাত্তা।আইজ এতো বছর পর বাড়ি আইসা তোমারে কোনো ফয়সালা না দিয়াই হেরা মাইয়া বিয়া দেওয়ার লাইগা উইঠ্যা পইর‍্যা লাগছে।ক্যা,পাইছে ডা কি হ্যারা।এই এত্তগুলো বছরের মধ্যে যদি তুমি বিয়া করতা তাইলে তো তারা কবে কেস কইরা দিতো।

থেমে, তুমি আমার কথা শোনো বাজান,গ্রামে সালিশি দাও।এইভাবে জীবন চলে না।একটা সিদ্ধান্ত নিয়া তারপর নতুন কইরা বিয়া করো।তোমার হেই বান্ধবী সুবর্না তো বাড়িই…….

আর বলতে দিল না সেলিম।তার আগেই কঠিন চিত্তে বলে উঠলো-

চাচী,আজকে আমি বাড়িতেই আছি।রান্না করে নিবো।আপনি যেতে পারেন।

থমথম করতে করতে চলে গেলেন শেফালী বেগম।আর সেলিম ধীর পায়ে রুমের মধ্যে ঢুকে গেল।চোখ জলছে ভীষন।শরীর ভীষন ব্যাথা করছে।গায়ে জ্বর উঠেছে।সেভাবেই না খেয়ে পড়ে রইলো বিছানার মাঝখানে।

_____________
_____________
রাত আটটা।নির্জন নিরিবিলি ধানক্ষেত।বর্তমানে তা ভরে উঠেছে বর্ষার পানিতে।তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে অজস্র শাপলা। বাড়ি থেকে বের হয়ে ক্ষেতের পাশে গিয়ে দাড়ালো সেলিম।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই চোখে পড়লো এক মানবীয় ছায়া।

কাঞ্চনা।হাত পাচেক দুরেই আম গাছের সাথে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে বিশাল বিলের বুকের দিকে।ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সেলিম।না চাইতেও দাড়ালো গিয়ে তার পিছনে।পিছনে কারো অস্তিত্ব পেতেই দুম করে পিছু ফিরলো কাঞ্চনা।সেলিমকে দেখামাত্রই আবারো মনযোগী হলো নিজের ধ্যানে।

বিয়ে যখন করবেই তখন এতো বছরে করলেই পারতে।বাড়ি এসে করার কি দরকার ছিল?

গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বললো সেলিম।কাঞ্চনা নিরব।মেনে নিতে পারলো না সেলিম।এই দাম্ভিকতা, এই তেজের জন্যেই আজ দুজনের পরিণতি এমন।ডানহাত মোচড় দিয়ে ধরে বসলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তাল সামলাতে না পেরে সেলিমের বুকের সাথে ধাক্কা খেল কাঞ্চনা।হাত মোচড়ালো কিন্তু ছাড়াতে পারলো না।তৎক্ষনাৎ অপর পাশ থেকে শুনতে পেল।

এই তেজ অন্য কাউকে দেখাতে পারো না।যখন বিয়ের আগেই অন্যপুরুষ হাত ধরে জড়াজড়ি করে।তখন কোথায় থাকে এই আত্নসম্মান?(ক্ষোভ নিয়ে বললো সেলিম)

কাঞ্চনা বেশ ভালোই বুজতে পারলো সেলিমের রাগের কারন।তারপরেও নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস করে বললো-

আপনিও তো অনধিকার চর্চা করছেন।আপনার কোনো অধিকার নেই আমার হাত ধরার।

পুনরায় আরো জোরে ঝাপটে ধরলো কাঞ্চনাকে।দাতে দাত খিচিয়ে বললো-

অধিকার আছে আমার।তোর উপর খাটানো সকল অধিকার আছে আমার।ভুলে যাস না আমি তোকে তালাক দেইনি আর নাতো তুই দিয়েছিস।

নিশ্চুপ কাঞ্চনার চোখ দিয়ে টুপ করে অশ্রু ঝরে পড়লো।এই জোরটা সে আরো বছর কয়েক আগেও খাটাতে পারতো।তাকে ফেরাতে পারতো। কিন্তু ফেরায়নি।

আমার ঠিক দোষটা কোথায় ছিলো বলতে পারো কাঞ্চনা?তোমার জেদের কারনে আজ আমাদের পরিনতি টা দেখো-না তুমি সুখে আছো আর না তো আমাকে সুখে রেখেছো।না জেনে,না বুঝে,পরিস্থিতিকে না ঘাটিয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আজ এই পরিনতি তোমার।কিন্তু তুমি কি করলে?আমাকে দায়ী বানালে।পুরো গ্রামের কাছে চরিত্র*হীন বানালে।একদম একাকীত্বের মধ্যে ঠেলে দিলে।
থেমে,
কই একবার খোজ তো নিতে পারতে আমার।নাও নি।একবার আমার কাছে আসতে পারতে,আসো নি।আচ্ছা তোমার কি আমাকে একবার ও দেখতে ইচ্ছে করেনি?
সদ্য বাবা-মা-স্ত্রী, নিজের চরিত্র সবকিছু হারিয়ে গ্রামের সবার লাঞ্ছনা সয়ে কি করে ছিলাম আমি।রান্না করা,সংসার চালানো,পড়াশোনা করা,দোকান চালানো,নিজেকে মানষিক ভাবে সামলানো আমার কাছে সহজ ছিল না কাঞ্চনা।অসুস্থ হয়ে মরে গেলেও খোজ নেওয়ার কেউ ছিল না।দিনের পর দিন জ্বরে কাতরে মরেছি,খোজ নেওয়ার কেউ ছিল না।এতটা স্বার্থপর কি করে হতে পারলে?

থেমে,তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে।

স্বার্থপর তো তুমি নও ,স্বার্থপর আমি।আমরা সেলিমরা সবসময় স্বার্থপর হই।আমরা তো তোমাদের মতো চিৎকার করে,লোক জড়ো করে কাদতে পারি না।আর নাতো আমাদের কান্না দেখে সমাজ দূর্বল হয়।আমরা বুকে পাহাড় সমান কষ্ট/যন্ত্রনা/ব্যথা চেপে রেখে কঠিন চিত্তে তাকিয়ে থাকি।সমাজের চোখে হই পাষান/অমানুষ/চরিত্রহীন।
তোমরা কাঞ্চনা’রা কাদলে সমাজের কাছে হও নিরীহ,আর আমরা সেলিম’রা হই ঠাট্টার পাত্র।

কাঞ্চনা অবিরাম ভাবে সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সব সময় নিরব/শান্তভাবে সবকিছু সয়ে যাওয়া মুখটায় আজ যেন কথার বুলি ফুটেছে। মনের মধ্যে জমানো সমস্ত অভিমান যেন আজ মুখের মাধ্যমে লেপে দিচ্ছে কাঞ্চনার শরীরে।
লোমশো হাতটা ছুতেই শিউরে উঠলো।হাতটা অস্বাভাবিক ভাবে গরম।জ্বর ভেবে কপালে হাত দিতেই দু-কদম পেছনে সরে যায় সেলিম।অস্পষ্ট স্বরে কাঞ্চনার গলা দিয়ে বের হয়-

আপনার গায়ে অ-অনেক জ্বর।

তেজি কন্ঠে বলে ওঠে সেলিম।

দরকার নেই‌।যখন গুলি খেয়ে জ্বরে ভুগে রাতের পর রাত একটা অন্ধকার রুমে কাতরে মরেছি,তখন কপালে এরকম একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ খুব দরকার ছিল ।আফসোস তখন পাইনি।এখন আর দরকার নেই।অভ্যাস হয়ে গেছে একা থাকার।

থেমে,
শেফালী চাচিকে রেখেছি কেন জানো?যাতে হূট করে মরে গেলে লাশটা অন্তত পায়।এমন যেন না হয় ,দিনের পর দিন ওই বদ্ধ ঘরেই আমার লাশ পচতে থাকে।

শব্দ করে কেদে দিল কাঞ্চনা।সেলিম হাসলো‌।কাঞ্চনার থুতনি ধরে নিজের দিকে তাকালো।শান্ত কন্ঠে বলল-

তুমি কি ভেবোছ?এসব কথা আমি তোমাকে বলে দূর্বল করার চেষ্টা করছি।তোমার বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছি?নাহহ!আমি শুধু তোমার থেকে সামান্য দয়া চাইছি।প্লিজ!চলে যাও এখান থেকে,অনেক দূরে ,আমার দৃষ্টিসীমানার বাইরে ।গিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে কর।আমি কিচ্ছু বলবো না।এখানে থেকে আমাকে আর পুড়িও না।
আর হ্যা,দু-তিন দিনের মধ্যেই তোমার ভাইয়ের দেওয়া টাকাসহ ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে।

চলবে?

বার্তা:আপনারা অনেক আগে থেকেই জানেন,আমার নিজস্ব কোনো ফোন নেই।মায়ের ফোন ব্যবহার করি।হঠাৎ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকায় কালকে গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি।এমনকি আজকেও এক কাজিনের ফোন দিয়ে লিখেছি।পর্ব ছোট হওয়ার কারনে দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here