#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী
সাইরাও বেশ কয়েকবার সাদিফকে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু কোন সদুত্তর পায়নি। বিধায় আর প্রশ্ন না করে বাচ্চাদের তৈরী করিয়ে এবং নিজেও তৈরী হয়।
সাদিফ পুরো ফুলবাবু সেজে বাবা-মা’র সাথে তাদের রুমে কথা বলছে। তানিশা মেয়েকে তৈরী করাচ্ছে। এরপর সে তৈরী হবে।
তানিশা তৈরী হয়ে সাইরার কাছে আসে। তূর্ণাকে দাদা-দাদীমার কাছে পাঠিয়ে নোয়েলকে কোলে নিয়ে নিচে নামে। রহিমা খালা আর ড্রাইভার মিলে ওদের ব্যাগগুলো গাড়িতে তোলে। তানিশা আর সাইরার কোলে নিরো, নোয়েল থাকায় বাধ্য হয়ে বয়স্ক মানুষদের দিয়ে তারা ব্যাগ বহন করায়।
শ্বশুর-শ্বাশুড়ির রুমে এসে দেখল তূর্ণা দাদুর গলা ধরে কোলে বসে আছে। আর তার দাদুও হাসিমুখে দুর্বল হাতে নাতনিকে ধরে রেখেছেন। সাদিফ বিছানায় বাবা-মা’ র পাশে বসে কথা বলছে। ওদের ভেতরে আসতে দেখে শায়লা চৌধুরী বিছানা থেকে নেমে নাতি-নাতনিদের আদর করে দেয়।
” সাদিফ এখন বেরিয়ে পর বাবা। এগারোটা বেজে গেছে। আর দেরি করিসনা। বউমা তুমি সবাইকে দেখে রেখ। বাচ্চাদের এদিক-সেদিক যেতে দিওনা। আর গেলেও তোমরা সাথে থেকো। ”
তানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। কিন্তু ও বুঝতে পারছেনা যাচ্ছেটা কোথায়!
ওরা বাবা-মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। শায়লা চৌধুরী গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।
ড্রাইভার চাচা আজ গাড়ি চালাচ্ছেন। সাদিফ উনার পাশে তূর্ণাকে কোলে নিয়ে বসেছে। আর পেছনে সাইরা, তানিশা বসেছে নিরো,নোয়েলকে কোলে নিয়ে। সাদিফ মেয়ের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত তবে মাঝেমাঝে চাচার সাথেও কথা বলছে। পেছন থেকে তানিশা তার একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষকে দেখতে ব্যস্ত। মেয়েকে ছাড়া যে কিছুই বোঝেনা। তানিশার মাঝেমধ্যে আফসোস হয় এই মানুষটার থেকে মেয়েকে এতদিন দূরে রাখবার জন্য।
ওদের গাড়ি ঢাকা ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। হাইওয়ে দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দে ছুটে চলা গাড়িগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে ওদের গাড়ি। কিছুক্ষণ থেকেই তানিশার মনে কিছু একটা বারবার খোঁচাচ্ছিল। আরোও কিছুক্ষণ যাবার পর সে নিশ্চিত হয়ে যায় ওরা কোথায় যাচ্ছে। এ যে তার অতি পরিচিত পথ। যদিও সময়ের ব্যবধানে অনেককিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তবুও এ পথ ভুলবার নয়। তানিশার চোখে আনন্দের অশ্রুরা জমা হচ্ছে একটু একটু করে।
” কদম তলী যাচ্ছি আমরা! ” তানিশা ধীরে বললেও সাইরার কানে কথাটা ঠিকই পৌঁছে গেছে। যদিওবা সাইরা ভাইয়ের বিয়ের দিন গেছে সেখানে কিন্তু সে অনেকদিন আগে তাই তার রাস্তাঘাট কিছুই পরিচিত লাগছেনা।
” ভাইয়া, আমরা কদম তলী যাচ্ছি? ”
সাদিফ মাথা নাড়ায়।
” পাঁজি লোকটা, আমাকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলনা! শুধু নিজের মর্জি মত চলবে! ”
” ভাবি আমি সব শুনতে পাচ্ছি কিন্তু। ভাইয়াকে বলে দিব, তুমি তাকে পাঁজি বলেছ। ” সাইরার মুখে হাসি।
” আমি কি ভুল কিছু বলেছি। সে শুধু পাঁজি নয় মহা পাঁজি। আমাদের নিয়ে কদম তলী যাবে, আগে বলবেনা! প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ দিয়েছে! ”
” আমার লক্ষ্মী ভাবিটা, বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য মেয়েদের কোন প্রস্তুতি লাগেনা বুঝেছ? মেয়েদের জন্য বাবার বাড়ি একটা খোলা মহল বুঝেছ? তোমার যখন খুশি যেতে মানা নেই। কিন্তু কথা হল, ভাইয়া এর মধ্যে আমাকে জড়াল কেন বলত? ”
” কেন তোমাকে জড়ালে কি হবে! তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছ, এতে আমাদের কত ভালো লাগছে জানো। আর তাছাড়া এই গুল্টুমুল্টুদের ছেড়ে থাকতে আমারও ভালো লাগেনা। ”
সাদিফ ওদের কথা শুনে হেসে দেয়।
বিকেলে ওরা কদম তলী পৌঁছায়। তানিশা গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সেই চিরপরিচিত বাড়ির দিকে। কতদিন পর পা রাখল এখানে! ঠিক আগের মতই আছে বাড়িটা।
তানিশা একবার বাড়ির দেয়াল ছুঁয়ে দেখছে তো আরেকবার ছুঁয়ে দিচ্ছে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অনর্গল।
সাইরা এসে তানিশার কাঁধে হাত রাখে। তানিশা সাইরার স্পর্শ পেয়ে হুঁশে এলো। এতক্ষণ দিব্যি ভুলে ছিল ওদের! চোখ মুছে গেইটে নক করে অপেক্ষায় থাকে । একটু পর ভেতর থেকে ধুপধাপ আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে কেউ আসছে। একসময় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে খুলে যায় গেইট।
” আপুউউউ! ” তিয়াসা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে বোনকে। এদিকে তিয়াসার চেঁচামেচিতে বাড়ির অন্যরাও বেড়িয়ে আসে। গেইটের বাইরে তানিশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়েশা খাতুন আনন্দে কেঁদে দেয়। কতদিন পর মেয়েকে দেখলেন তিনি! তিয়াসা ওদের ভেতরে নিয়ে আসে। এ বাড়ির সবাই তূর্ণাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা। ওদের অবস্থা দেখে সাদিফ মনে মনে হেসে দেয়। একদিন ও নিজেই মেয়ের জন্য এমন উতলা হয়ে ছিল।
তিয়াসা, তৃষ্ণা ,তানিম এখন আর আগেরমত সেই ছোটটি নেই। তিয়াসা পাব্লিক ভার্সিটিতে পড়ছে। তৃষ্ণা সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ুয়া। আর তানিম এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে।
তৃষ্ণা সাইরাকে নিয়ে রুমে আসে। সাইরার ব্যাগ খাটের পাশে রেখে নোয়েলকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। সাইরাও ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
তানিশা,সাদিফ দাদির ঘরে বসে আছে। তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেননা। তানিশা দাদির এমন অবস্থা দেখে কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে। সাদিফেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। শেষবার যখন ও এখানে এসেছিল তখনও তিনি সুস্থ ছিলেন। মানুষের জীবনটাই এমন, যার কোন নিশ্চয়তা নেই।
” বোইন, তুমি এতদিনে আসলা! একবারও আমগোর কথা মনে পরে নাই? আমার এই ভাইয়ে কত কাঁনছে তোমার লাইগা। বেচারা যখন-তখন ছুইটা আইছে তোমার খোঁজ পাওনের লাইগা। তোমার বাপ-মায়েও কম কাঁন্দেনি। ”
দাদির কথার কোন জবাব নেই তানিশার কাছে। সাদিফ উনার মাথায় হাত রেখে শান্তনা দেয়।
” দাদি আপনাকে আর চিন্তা করতে হবেনা। আপনার নাতনি এসে গেছে। এবার আপনি সুস্থ হয়ে উঠেন। আপনার নাতনির বাড়ি যাওয়া বাকি আছে এখনো। নাতনির মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরতে বাকি আছে। ” সাদিফের কথাগুলো শুনে ম্লান হাসে বৃদ্ধা।
” ভাইগো, তোমরা এহন পরিপূর্ণ হইছ। সারাডা জীবন এম্নেই থাইকো। আমার বইনডারে আর দূরে যাবার দিওনা। দেও ময়না পাখিডারে আমার কাছে দেও। ”
তানিশা মেয়েকে ওর দাদির কাছে দেয়। বৃদ্ধা পরম মমতায় তূর্ণার চোখমুখের হাত বুলায়।
আয়েশা খাতুন ব্যস্ত হয়ে পরেছে মেহমানের আপ্যায়ন। তিয়াসাও মাকে সাহায্য করছে। সাইরা ফ্রেশ হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বিছানায় বসে আছে।
তানিশা দাদির সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সাইরার কাছে আসে। ঘরে এসে দেখে সাইরা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমাচ্ছে। তানিশা ওদের না ডেকে বেরিয়ে যায়।
সাদিফকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে তানিশা চিন্তিত হয়ে কপালে হাত রাখে। তানিশার স্পর্শে সাদিফ চোখ মেলে চায়। সামনে তানিশাকে দেখে হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। তানিশার বুকে মাথা রেখে চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। তানিশাও সাদিফের চুলে বিলি কাটছে।
” এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। মা খাবার তৈরী করেছে। ”
” এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছেনা বউ। খুব টায়ার্ড লাগছে। মাকে বলে দিও আগে একটু ঘুমিয়ে পরে খাবো। ”
” না খেয়ে ঘুমাবেন এখন! একটু কিছু মুখে দিয়ে তারপর ঘুমান। ”
” উহু, কথা না বলে একটু ঘুম পারিয়ে দাওতো।
আমি ঘুমালে তুমি সাইরাকে নিয়ে খেয়ে নিও। ”
” সাইরাও বাচ্চাদের নিয়ে ঘুম দিচ্ছে। ”
” তাহলে তুমি জেগে আছো কেন! আমার সাথে তুমিও ঘুমাও। ” বলেই সাদিফ তানিশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তানিশা বেশ বুঝতে পারছে এই লোক এখন ওকে ছাড়বেনা। তাই বাধ্য হয়ে সাদিফের ঘুমের অপেক্ষা করে।
সাদিফ ঘুমালে তানিশা ওর বাঁধন ছাড়িয়ে উঠে যায়। আয়েশা খাতুন খাবার নিয়ে বসে আছেন। তূর্ণা ওর খালামনিদের সাথে আছে। তানিম বোনদের সাথে ঘ্যানঘ্যান করছে তূর্ণাকে কোলে নিতে। কিন্তু ওরা দিচ্ছেনা। তাই তানিম মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। তানিশা ওদের একনজর দেখে মায়ের কাছে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আয়েশা খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদছেন। তানিশার চোখেও পানি।
মাগরিবের আজানের সুমধুর শব্দে সাইরা জেগে উঠে। আর সাদিফকে তুলেছে তূর্ণা। সাইরা অজু করে নামাজ আদায় করে। সাদিফকে আজ অলসতায় পেয়েছে আজান শুনেও মেয়েকে বুকের ওপর বসিয়ে শুয়ে থাকে। তানিশা অজু করে এসে সাদিফকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রেগে যায়। সাদিফ কাঁচুমাচু করে উঠে বসে। তানিশার চোখ রাঙ্গানো দেখে অজু করতে যায়।
নামাজ আদায় করে ওরা একসাথে খেতে বসে। সারাদিনের জার্নিতে কারো খাওয়া হয়নি তাই সবাই ক্ষুধার্ত। কথা না বলে সবাই খেয়ে নেয়।
খাওয়ার পর সাদিফ তানিমকে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে যায়। সাইরা বাচ্চারা তিয়াসা,তৃষ্ণার কাছে আর তূর্ণা ওর নানুর সাথে খেলছে। সাইরা উঠানে হেঁটে হেঁটে গাছের ফুলগুলো দেখছে। কত রকমের জবা ফুটে আছে! কয়েকরকম কন্টকমুকুটও আছে। গোলাপ গাছও আছে বেশ কয়েকটা। সাইরা অবাক হয়ে দেখছে, একটা গ্রামের বাড়ির পরিবেশও এত সুন্দর হতে পারে!
এ বাড়ির সবার মধ্যে কত মিল! কত সুখী এরা। আসলে সুখী হতে অনেক টাকার দরকার পরেনা। সুখি হতে প্রয়োজন সুন্দর মন আর মিলেমিশে থাকার প্রবনতা। ওর মন সুন্দর ছিলনা বলেই কি সুখী হতে পারেনি? রাতুল ওর হয়েও হলনা শুধু ও মিশতে পারেনি বলেই কি? কত প্রশ্ন জমা হয় সাইরার মনে। কিন্তু উত্তর জানা নেই ওর।
তানিশা বারান্দা থেকে সাইরার উদাসীনতা বুঝতে পেরে উঠানে আসে। সাইরার হাত ধরে নিয়ে উঠানের এক কোনে পেতে রাখা মাচায় বসে।
” সাইরা, দুঃখ-কষ্ট কারো কখনো চিরস্থায়ী হয়না।দিনের পর যেমন রাত আসে তেমনি কষ্টের পরই সুখ ধরা দেয়। রাত যতই অন্ধকারে ছেয়ে থাকুক দিনের আলো ফুটতেই সে আঁধার কেটে যায়। তেমনি তুমি আজ কষ্ট পাচ্ছো ঠিকই কিন্তু দেখবে একদিন সুখ তোমার পায়ে এসে লুটোপুটি খাবে। শুধু আমি একটা কথাই বলব, তোমার ভাইয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে চলো। একটা মেয়ের ভরসাস্থল দুই জায়গায়, একটা স্বামীর বুক আরেকটা বাবা-মা। স্বামীর বুকে কোন ঘাটতি থাকলেও বাবা-মার কাছে মেয়ের জন্য ভালোবাসার কোন কমতি থাকেনা। আল্লাহ কোন না কোন দিক দিয়ে মেয়েদের পরিপূর্ণ করেই দেন। তুমি যেমন বর্তমানে স্বামীর ভালোবাসার কার্পন্যতায় ভুগছো, ঠিক তেমনি বাবা-মার ভালোবাসায় পূর্ণ আছো। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আর ভাইয়ার সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখো দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার সুখ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। ”
সাইরা তানিশাকে যতই দেখে ততই অবাক হয়ে যায়। এই মেয়েটা কি করে পারল সব ভুলে যেতে!
চলবে…