মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -শেষ পর্ব

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#অন্তিম
জাওয়াদ জামী

সাইফের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তিয়াসা। সাইফ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে।
” টুনির মা, তোমার পরীক্ষার পর আমরা হানিমুনে যাব বুঝেছ। অফিস থেকে একমাস ছুটি নিব। সেই একটামাস শুধুই তোমার হবে। আমরা তুরস্ক যাব। তোমার ইচ্ছেমত গোটা তুরস্ক ঘুরব। ”
তিয়াসা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাইফের দিকে। ওর ও যে খুব ইচ্ছে তুরস্ক ঘুরে দেখার। তুরস্ক তিয়াসার কাছে স্বপ্নের দেশ। আজ আবার সাইফ তুরস্ক যেতে চাচ্ছে বিষয়টি কি কাকতালীয়!
” সত্যিই আপনি আমাকে নিয়ে তুরস্ক যাবেন? আমার খুব ইচ্ছে হয় তুরস্ক যাবার। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পড়াশোনা শেষ করে একটা জব করব তারপর টাকা জমিয়ে তুরস্ক ঘুরব। গোটা তুরস্ক চষে বেড়াব। ” তিয়াসার চোখেমুখে খুশির ঝলকানি।
” জানিতো, আমার বউয়ের স্বপ্ন কি সেজন্যই প্ল্যান করেছি তুরস্ক যাওয়ার। বউয়ের খুশি দেখতে সব পুরুষই চায়। ”
” আপনি কিভাবে জানলেন! ” খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে তিয়াসা।
” ইট’স ম্যাজিক। ” গালভরা হাসিতে উদ্ভাসিত সাইফের মুখ।
” সেই ম্যাজিকটা কি একবার বলুননা প্লিজ প্লিজ প্লিজ। ” তিয়াসার বাচ্চামিতে হেসে উঠে সাইফ৷
” মনে আছে আমাদের রিসিপশনের দিন তোমার এক ফ্রেন্ডের সাথে আমার পরিচয় করিয়েছিলে? হিমি তোমার বেস্টফ্রেন্ড। আমি তার নাম মনে রেখেছিলাম। তারপর যখন বুঝলাম একটু একটু করে তোমার মায়ায় জড়াচ্ছি তখন একদিন তোমার ফোন থেকে ওর নম্বর নিয়েছিলাম। এরপর একদিন ওর সাথে যোগাযোগ করি। ধীরে ধীরে তোমার সম্পর্কে যাবতীয় কিছু ওর থেকে নিয়েছি। ” তিয়াসা কথা বলার অবস্থায় নেই সাইফের কথা শুনে। এই লোক বলে কি! আর একেই কিনা সে এতদিন ভেজা বিড়াল ভেবে এসেছে! কি সাং*ঘা*তি*ক, কি সাং*ঘা*তি*ক! তিয়াসার মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্নের উদয় হয়।
” আমাকে রায়হান নামের একজন পছন্দ করত। সে বিভিন্ন রোমান্টিক স্ট্যাটাস দিত তার আইডিতে। আবার আমাকেও রোমান্টিক ম্যাসেজ পাঠাত। কিন্তু হঠাৎ করেই সব বন্ধ করে দেয়! আপনি কি জানেন কেন? ”
” বাহ্ আমার বউকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম, বউ আমার দেখছি তারচেয়েও বেশি চালাক। না বলতেও অনেককিছুই বুঝে নিয়েছে। কথা হল গিয়ে, আমার বউকে নিয়ে অন্য একজন রোমান্টিক বুলি আওড়াবে এটা কেমন করে মেনে নিই! তাই আরেকদিন তোমার অগোচরেই ফোন আরেকবার হাতে নিলাম। ম্যাসেঞ্জার ঘাটতেই রায়হান নামের একজনের ম্যাসেজ দেখে শিওর হলাম। পরে হিমিকে জিজ্ঞেস করে পুরদমে শিওর হয়েই তবে ওর পেছনে কলকাঠি নাড়লাম। তোমার নিষ্পাপ জামাই কত কাজের দেখেছ রসগোল্লা বউ আমার টুনির মা। ”
” আল্লাহ আর আমি এই আপনাকে এতদিন ভেজা বিড়াল ভেবে এসেছি! আপনিতো ছুপা রুস্তম নিকলা! আমি শুধু ভেবেছি রায়হানের হঠাৎ পরিবর্তনের কারন কি ? একদিন তো সে আমার কাছে মাফ চাইল। জিজ্ঞেস করাতে বলে, কেউ নাকি ওকে বলেছে অন্যের সম্পদে হাত দিতে নেই। সেই কেউ আপনিই ছিলেন! ” তিয়াসার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছেনা।
” ইশ, বউয়ের দুর্ভাগ্য। ভাবতেই পারেনি ভেজা বিড়াল হঠাৎই বাঘ্র রূপে উদয় হবে। আর যেটা আমার সেটা একান্তই আমার। আমার জিনিসে অন্য কেউ নজর দিবে এটা মেনে নেয়ার মত পুরুষ আমি নই। তোমার সাথে মিসবিহেভ করার সুবাদে রায়হানের কিছু পাওনা ছিল সেটাই দিয়েছি মাত্র। ”
” এই যে, আপনি আমাকে জিনিস বললেন! আমি কোন জিনিস? বদ লোক একটা। ” ফুঁসে ওঠে তিয়াসা।
” হুম, তুমি তো জিনিসই। শুধুমাত্র আমার জিনিস। যে জিনিসের ভাগ অন্য কাউকে দেয়ার কথা ভাবতেই পারিনা। ”
এভাবেই খুনসুটিতে কাটে কিছু সময়।

তানিশা গোসল সেরে এসে দেখল সাদিফ একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে পূর্নতার হাসি।
” এবার উঠুন। গোসল সেরে নিন। তূর্ণা চলে আসবে। আজ দুপুরে সবাই একসাথে খাবেন৷ তারাতারি উঠুন। ”
” উহু, আরেকটু থাকতে দাওনা বউ। সারাদিন, সারা মাস অফিসের কাজেই তো কাটাই। মেয়েদের সময় দিতে পারিনা। একটা দিন অন্তত মেয়েকে দু-চোখ ভরে দেখতে দাও। ”
” মেয়েকে দেখার আরও অনেক সময় পাবেন এবার উঠুন। আর এক মুহুর্তও বিছানায় নয়। তূর্ণা এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে কোন প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিবেন? মেয়ে বড় হচ্ছে এই কথা মাথায় রেখে যা করার করবেন। ”
” আমার ছোট্ট প্রিন্সেস দেখেছ , তোমার মাম্মা দিনদিন নি*ষ্ঠু*র নারীতে পরিনত হচ্ছে! আমার ওপর একটুও মায়াদয়া করেনা। শুধু দুরদুর করে। এই কষ্ট কাকে দেখাই বলত প্রিন্সেস? ”
তানিশার ধাক্কাধাক্কিতে সাদিফের আর শুয়ে থাকা হলনা।

তূর্ণা রুমে এসে তার পাপাইকে এই অসময়ে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। দৌড়ে এসে পাপাইয়ের কোলে উঠে। সাদিফ মেয়েকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টুমিতে মাতে। এরপর মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে দেয়। ততক্ষণে ছোট মেয়েও উঠে গেছে। তানিশা ছোট মেয়েকে খাইয়ে ওকে নিয়ে নিচে আসে। জামিল চৌধুরীও ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। সাদিফ তূর্ণাকে নিয়ে নিচে আসলে বাবাকে খাবার টেবিলে দেখতে পায়। হেসে বাবার পাশে এসে বসে।
” সাদিফ, তুমি এসময় আজ বাসায়! তোমার শরীর ঠিক আছে? ” জামিল চৌধুরী ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।
” আমি ঠিক আছি বাবা। আজ অফিসে কাজের ততটা চাপ ছিলনা। তাই বাসায় এসেছি। ” বাবার কাছে আসল কারন বলতে না পেরে মিথ্যার আশ্রয় নেয় সাদিফ।
অতঃপর জামিল চৌধুরী দেখলেন কার ছোট ছেলেও আজ বাসায়। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার আজ মনে হচ্ছে এতদিনে এই সংসার পূর্ণ হয়েছে। তার দুই ছেলেই সংসারে থিতু হয়েছে। মেয়ের মত দুইটা ছেলের বউ পেয়েছে। তাদের অবসর কাটানোর জন্য দুইটা পুতুল এসেছে। একজীবনে আর কি চাই। আনন্দে জামিল চৌধুরীর চোখে পানি আসে। শায়লা চৌধুরী স্বামীর মনের কথা আন্দাজ করে খুশিতে কেঁদে দেন। সত্যিই আজ তারা পূর্ণ। সকল সুখ তাদের কাছে ধরা দিয়েছে।

সাইরা একমাস পর বাবার বাড়িতে এসেছে। ওর ছেলে-মেয়েও বড় হয়েছে। রাতুল অফিস থেকে সরাসরি এই বাসায় আসে। একসাথে রাতের খাবারের পর বসে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় রাতুলের পক্ষ থেকে সারপ্রাইজ প্যাকেজ ঘোষণা করে সাইরা। ওদের জন্য একটা ট্যুরের আয়োজন করেছে রাতুল। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে সাতদিনের ঘুরার পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী অফিস থেকে ছুটিও নিয়েছে সে। সাইফ – সাদিফ বোনের এরূপ আমন্ত্রণ ফেলতে পারেনা। ওরা রাজি হয়। তিয়াসা আনন্দে লাফালাফি করছে, ওর যে সামনে পরিক্ষা সেটা ভুলেই গেছে। তানিশা কখনোই সাদিফের মতামতের বাইরে যায়নি আজও গেলনা। জামিল চৌধুরী ও শায়লা চৌধুরীও ওর লিষ্টে ছিল। কিন্তু তারা না করে দেয়। কারন ছেলে, মেয়ে, জামাই মিলে এই প্রথম কোথাও বেড়াতে যাবে তাই তারা বুড়ো-বুড়ি এর মধ্যে জড়াতে চাননা।

পনের দিন পর বান্দরবান এসেছে সবাই। তিয়াসা আনন্দে এদিকসেদিক ছুটোছুটি করছে। ওর সাথে আছে নিরো, নোয়েল আর তূর্ণা। এখানে এসে সাইফকে একদমই পাত্তা দিচ্ছেনা। এদিকে বেচারা সাইফ নির্জনে একটু বউয়ের সান্নিধ্য পেতে চাচ্ছে । কিন্তু বউয়ের আদর এখন তার কাছে অমাবস্যার চাঁদের ন্যায় মনে হচ্ছে। অনেকবার ইশারায় তিয়াসাকে কাছে ডেকেছে কিন্তু সে মেয়ে শুনলে তো। বাধ্য হয়ে সাইফকে বাচ্চা সহ তিয়াসার সিকিউরিটি হতে হয়েছে।
সাদিফ ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে একহাতে তানিশাকে জড়িয়ে হাঁটছে।
সাইরা-রাতুল ওদের থেকে একটু দূরে কিছু নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে।
” বউ ও রসগোল্লা বউ, আমার টুনির মা। যাদের বাচ্চা তাদের কাছে দিয়ে একটু আমার সাথে ঐ পাহাড়ের আড়ালে চলনা। ” সাইফের আকুতি তিয়াসার মন গলাতে পারেনা।
তিয়াসা ভেংচি কেটে ওর মত চলতে থাকে।
” বেচারা সাইফ এই বান্দরবান এসেই তোর বউ তোকে চিনছেনা, তুরস্ক গেলে কি করবে ভেবে দেখছিস একবারও! তোকে কোন ক্ষেতের মূলা যে বানাবে চিন্তা করে দেখ। ” কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে তিয়াসার পিছু পিছু হাঁটছে সাইফ।#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#বোনাস_পর্ব
জাওয়াদ জামী

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ঘুরে ওরা এসেছে খাগড়াছড়ি। প্রথমেই রিসোর্টে এসে পূর্ব থেকে নির্ধারন করে রাখা রুমে উঠে। কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে, লাঞ্চ সেরে বের হয় রিসাং ঝড়নার উদ্দেশ্যে। তানিশা ছাড়া সবাই ঝরনার পানিতে দাপাদাপি করে। তানিশার ছোট বাচ্চা থাকায় ও ভেজেনি শুধু ঝরনার স্বচ্ছ জলরাশিতে পা ভেজায়। তিয়াসা, সাইরা নানান ভঙ্গিমায় সেলফি নেয় আবার সাইফকে দিয়েও ছবি তোলায়৷ খাগড়াছড়ির অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখে সবাই পুলকিত হয়। সন্ধ্যার পর ওরা রিসোর্টে ফিরে। অনেক ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত থাকায় ডিনার সেরেই সবাই ঘুমিয়ে পরে।
এদিকে সাইফ,রাতুলের সাতদিনের ছুটি শেষ। তাই ওরা অফিসে ফোন করে তিনদিনের ছুটি বাড়িয়ে নেয়। আর সাদিফ তো নিজেই সিইও তাই তার ছুটির নেয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু অফিসে জানিয়ে দেয় দুইদিন পর ফিরবে।
পরদিন সকালে ওরা নাস্তা শেষে আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে বের হয়। অনেক চড়াই-উৎরাই, পাহাড়ি রাস্তা, সিঁড়ি বেয়ে ওরা পৌঁছায় আলুটিলা গুহার সন্নিকটে। সকলের হাতে মোটা লাঠি। ওরা গুহার নিকট পৌঁছালে সাইফ আর রাতুল মিলে মশালের ব্যবস্থা করে। সাদিফ তিতিক্ষাকে একহাতে ধরে রেখছে আরেক হাতে তানিশাকে। আর তানিশা হাতে মশাল রেখেছে। তূর্ণা মশালের বদলে ওর বাবার ফোনের টর্চ অন করে নিজের কাছে রেখেছে৷ তিয়াসা আর সাইরাও নিজেদের হাতে মশাল নিয়ে গুহায় প্রবেশ করে। সাইফ আর রাতুল নিরো-নোয়েলকে একহাতে কোলে নিয়েছে আরেক হাতে মশাল ধরে রেখেছে। স্যাঁতস্যাঁতে গুহার ভেতর প্রবেশ করতেই মেয়েদের গা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছে। ওদের পায়ের নিচ পানির ধারা। পিচ্ছিল গুহায় হাঁটতে ওদের বেশ কষ্টই হচ্ছে। অনেক সময় লাগিয়ে ওরা অন্ধকার গুহা পাড়ি দেয়। গুহার বাইরে এসে তিয়াসা হাঁফ ছাড়ে।
গুহার আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ওরা রওনা দেয় হাতিমাথা পাহাড়ে স্বর্গের সিঁড়ির উদ্দেশ্যে। বিশাল পাহাড়ের গায়ে সরু লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে। পাহাড়টা দেখে মনে হচ্ছে একটা হাতির মাথা। এত উঁচু সিঁড়ি বেয়ে তানিশার উঠা সম্ভব নয়। তাই সাদিফ ওকে নিয়ে নিচেই থেকে যায়। তূর্ণা যায় ওর চাচ্চুর সাথে।
এত দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ওরা ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু পাহাড়ের উপরে পৌঁছে ওদের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! মেঘমালা এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর! ঝিরিঝিরি হিম বাতাসে মনে দোলা দিচ্ছে। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য অন্য কোথাও থেকে খুব একটা উপভোগ করা যায়না। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়! পাহাড়ের গায়ে ছায়াবীথি শীতল করে রেখেছে পরিবেশকে। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকে। ওরা সেখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটায়। আদিবাসীদের জীবনযাপন খুব কাছে থেকে উপভোগ করে।

সাদিফ মেয়েকে কোলে নিয়ে আশেপাশে ঘুরছে৷ চারপাশে প্রকৃতির এমন চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে তানিশা মোহিত হয়ে গেছে। পাহাড় ওকে সব সময়ই টানে। পাহাড়ের বিশালতার কাছে নিজেকে নিতান্তই ছোট মনে হয়। তানিশা যেমন প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছে তেমনি সাদিফ মুগ্ধ হচ্ছে তার রমনীকে দেখে৷ সাদিফের মনে হচ্ছে এই রমনীর সৌন্দর্যের কাছে দুনিয়ার সকল রুপ হার মেনে যাবে। প্রকৃতির এই নির্ভেজাল সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধতা নিয়ে নিজেকে উজার করে দেয় তেমনি তার রমনীও আকাশসম মায়া দিয়ে নিজেকে উজার করে দিয়েছে সাদিফের মাঝে।

সারাদিন ওরা এদিক সেদিক ঘুরে রিসোর্টে ফিরে। আগামীকাল ওদের গন্তব্য মাতাইপুখিরি, তৈদুছড়া ঝর্না এবং মানিক ছড়ি মং রাজবাড়ী।
এবং তারপর দিন সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।

তিয়াসা রিসোর্টের বিছানায় শুয়ে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে। ওর হাত-পা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সাইফ রুমে ঢুকেই দেখল তিয়াসা ছটফট করছে।
” আমার রসগোল্লা বউ, টুনির মা’র কি হয়েছে? এমন উথাল-পাথাল করছে কেন! জামাইয়ের বিরহে কি আমার বউয়ের শরীরে, মনে উথাল-পাথাল বাউলি বাতাসেরা হানা দিয়েছে! আর চিন্তা নেই বউ তোমার ঔষধ তোমার সেবায় হাজির। ”
” আসছে আধ্যাতিক গুরু। আমি হাত-পায়ের ব্যাথায় ম*র*ছি আর তিনি কিনা অন্য গান গাচ্ছেন। ” মুখ ঝামটা দেয় তিয়াসা।
” ম্যাসাজ করে দিই বউ? আমি কিন্তু খুব ভালো ম্যাসাজ করতে জানি। তুমিই সাক্ষী। ” চোখ টিপে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে সাইফ।
তিয়াসা ভালো করেই জানে এই লোকের সাথে যত কথা বলবে ততই কথা বাড়বে। আর সেও অসভ্য কথা বলতেই থাকবে৷ তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
সাইফ হুট করেই বাইরে যায়। একটু পর হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় বসে তিয়াসাকে টেনে তুলে। তিয়াসা উঠে বসলে প্যাকেট খুলে বার্গার বের করে ওর মুখের সামনে ধরলে তিয়াসা অবাক চোখে চায়। সাইফ ইশারায় খেতে বলে। তিয়াসা অল্প খেয়ে বলে আর পারবেনা। কিছুক্ষণ আগেই ডিনা৷ করেছে তাই ক্ষুধা নেই। সাইফ প্যাকেটে বার্গার রেখে পকেট থেকে পেইন কিলারের পাতা বের করে। একটা ট্যাবলেট বের করে খাইয়ে দেয় তিয়াসাকে৷ পরে তিয়াসার রাখা অবশিষ্ট বার্গার নিজে খায়। অতঃপর তিয়াসাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শোয়। তিয়াসাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তিয়াসার চোখে ঘুম নামে।

সাইরা, রাতুল ব্যালকোনিতে বসে রাত উপভোগ করছে। রাতুলের কাঁধে মাথা রেখে তিয়াসা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ভরা পুর্নিমায় দুজন মানব-মানবীর প্রেমের জোয়ার বইছে ধুলির ধরায়। রাতুল পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে সাইরাকে। সাইরা এখন তার কাছে পরম আরাধ্য নারী। যে নারী তাকে হৃদয় উজার করে ভালোবাসে। ওর একটু চাওয়ার মুল্য দিতে নিজেকে উজার করে দেয় রাতুলের কাছে। রাতুলও প্রাণভরে উপভোগ করে তার একান্ত নিজের নারীর ভালোবাসার প্রতিটি ছোঁয়া।

সাদিফ তানিশাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। পাশে ওদের দুই মেয়ে ঘুমাচ্ছে।
” বুঝলে বউ, ভেবে দেখলাম এখন থেকে প্রতি বছর বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরব। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে মেয়েদের পরিচয় করাব। আমি, তুমি আর মেয়েরা মিলে পুরো দেশ চষে বেড়াব। ”
” শুধু আমরা কেন! আমাদের সাথে পরিবারের সবাই থাকবে। আমরাতে যত সুখ পাওয়া যাবে তারচেয়ে ঢেরবেশি সুখ আমাদের সবাই একসাথে থাকলে। আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ, হাসি, তামাশায় সবাইকে পাশে পেতে চাই। সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই আনন্দ গুলো। ”
” এজন্যই তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি বউ। আসলে সবাইকে নিয়ে একসাথে বেঁচে থাকার মত আনন্দ আর হয়না। ” সাদিফ তানিশার কপালে ভালোবাসার পরশ আঁকে।

খাগড়াছড়ি থেকে বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে মাতাইপুখিরিতে ওরা বর্তমানে অবস্থান করছে। কথিত আছে মাতাইপুখিরিতে পাহাড়ের উপরে দেবতার আশির্বাদে সৃষ্টি হয়েছিল একটি হ্রদ। হ্রদের টলটলে নীল পানি দেখেই প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে। যদিওবা সাইফ, সাদিফ, রাতুল এর আগেও এখানে এসেছে কিন্তু মেয়েরা এখানে সম্পূর্ণ নতুন। তানিশা অবাক হয়ে দেখছে প্রকৃতির এই বিস্ময়। নিজের দেশের আনাচেকানাচে এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে তা এখানে না আসলে জানতেই পারতনা। তিয়াসা স্তব্ধ হয়ে অবলোকন করেছে এই অপার সৌন্দর্য। সাইরাও ওদের ন্যায় অবাক এবং সেই সাথে পুলকিত হয়ে গেছে। উপরে আকাশ, পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিক হ্রদ এ যেন এক ভয়ংকর সৌন্দর্য! ছেলেরাও উপভোগ করছে ধরিত্রীর এই রূপ।
সবশেষে ওরা তৈদুছড়া ঝর্না, মানিক ছড়ি মং রাজবাড়ী দর্শন শেষে রাতে রিসোর্টে ফিরে।
সারাদিন ধরে বেড়ানোয় সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে। ডিনারের পরপরই যে যার রুমে যেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমের কোলে ঢলে পরে।

পরদিন সকালে উঠে যে যার ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। ওরা বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর কেনাকাটা করেছে। গোছানো শেষ হতে দশটা বেজে যায়। এরপর নাস্তা সেরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

গাড়িতে উঠে সবার মন উদাস হয়ে যায়। এই দশটা দিন সবার স্বপ্নের মত কেটেছে। এত সুখ, এত আনন্দও বুঝি এভাবে ধরা দেয় তা ওদের জানা ছিলনা। কিন্তু দিনশেষে ওরা সবাই সুখি। ওরা পেরেছে দুঃখ নামক বাধাকে জীবন থেকে দূর করে সংসার আকাশে সুখের এক চিলতে আলো বয়ে আনতে। সেই সুখের সাগরে ওরা জলকেলিতে মত্ত হতে পেরেছে। একান্ত আপন মানুষগুলোকে নিজের করে পেয়েছে। যে মানুষগুলোর সাথে কন্টক বিছানো পথেও অনায়াসে হাঁটতে পারবে মাইলের পর মাইল৷
সূর্যের অমিয় তেজকে পেছনে ওদের গাড়ি এগিয়ে চলছে সামনে। এইতো একসাথে পথচলার শুরু।
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here