#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#শেষপর্ব
৫৯।
দুদিন পর,
সকাল সকাল বেডরুমের দরজায় নক করার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় পক্ষীর, উঠতে যেয়ে দেখে তার গায়ে শক্তভাবে জড়িয়ে আছে আরিজের পুরুষালি হাত। মাথাটা একটু বালিশ থেকে উঠিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সবেমাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে, একটু অবাকই হয় সে। ধীরেধীরে আরিজের হাত নিজের দেহ থেকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। মাথা ও শরীরে ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলতেই দেখে তার শাশুড়ি নয়ন্তিনী দাঁড়িয়ে।
“মা, আপনি এত সকাল সকাল আসলেন যে… কিছু লাগবে?”
“না, তুমি ড্রইংরুমে যাও। আমি আরিজকে নিয়ে আসছি।”
নয়ন্তিনীর কথায় আর কিছু না বলেই ড্রইংরুমে চলে যায়। সেখানে পৌঁছাতেই দেখে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা গায়ে মাথা নত করে বসে আছেন। খুব বেশি ঝুঁকে থাকায় চেহারা বুঝা যাচ্ছে না, তবুও কেন যেন যুবতীর তাকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। লোকটা মাথা উঠাতেই পক্ষী বিস্মিত হয়।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
“বাবা, তুমি…?”
এতদিন পর মেয়ের আলতো গলা শুনে চোখ দুটো ছলছল করে উঠে আসলাম দেওয়ানের। মনে মনে,
“ইশ! কতদিন পর মেয়েটার আওয়াজ শুনলাম, কলিজাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”
কিন্তু মুখে তেমন কিছুই বললেন না। বরং, এগিয়ে যেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
“কেমন আছিস রে মা? বাবার উপর এত রাগ যে কলটা অবধি ধরিস ন! এত রাগ আমার মার! যা হওয়ার হয়েছে তোকে বাড়ি নিতে এসেছি আমি, বাড়ি চল।”
এতক্ষণ ভেজা চোখে মমতাময় চাহনিতে বাবার কথা শুনছিল যুবতী, কিন্তু শেষ বাক্যটি কানে আসতেই চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে তার। দৃঢ় গলায় শুধালো,
“না, না, আমার মতো অপয়া মেয়ে তোমাদের এত পবিত্র বাড়িতে কী করে পা রেখে! তাছাড়া তোমার বউ-মেয়ে কি মানবে বলো? আমার মতো অপয়াকে মানে আপদকে এত কষ্ট করে নিজেত ঘাড় থেকে নামিয়েছে, এরপর আমাকে দেখলে তারা ঠিক সহ্য করতে পারবে না। তার চেয়ে বরং তুমি এসেছো, আমি রান্না করি খেয়ে-দেয়ে বেড়িয়ে যাও।”
পক্ষীর কথাবার্তায় খাণিক রসিকতার ছোঁয়া থাকলেও তা যে তীব্র তাচ্ছিল্যের সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে আসলাম দেওয়ান, তবে বেশ অবাকও হন। মেয়েটাকে দেখেছে ছোটবেলা থেকে ধীর স্বভাবের, যার নেই রাগ বা প্রতিবাদ দেখানোর আগ্রহ, বরং নীরবে সবটা মেনে নেওয়ার প্রবণতাই বেশি। আজ সেই মেয়ে কিনা এভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
আনমনেই ভাবে সে,
“ভাগ্যের নির্মম পড়িহাসে আজ সত্যিই আমার মেয়েটার ব্যক্তিত্ব তীব্র হয়েছে, নাহলে আগে ছিল এক ব্যক্তিত্বহীন নারী। ছোটবেলা আপন মানুষদের নিকট লাঞ্ছিত হতে হতে নিজেকে নিজেই নিচু করে দেখছিল এতদিন, এখন ভাগ্য তাকে লড়তে শিখিয়েছে।”
বাবার কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হয় পক্ষী। চলে যাওয়ার জন্য বিপরীত দিকে ঘুরবে তখনই বয়সের ছাপ পড়ক হাত বাড়িয়ে দেয় কেউ। সে জানে এই হাতটি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালোবাসাময় পুরুষের হাত, তার বাবার হাত। ছোটবেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এভাবেই হাত বাড়িয়ে দিতেন সে, এ কথা মনে পড়তেই চোখে এক বিন্দু অশ্রুজল জমা হয়।
“মা রে বাবা নাহয় একটা ভুলই করেছি, তুই কি পারিস না আমায় ক্ষমা করতে, পারিস না? আর আমি তো তোকে মন থেকে ওসব বলিনি, তোকে রক্ষা করার জন্যই বলেছি। যদি ঐদিন তুই বিয়ে না করতি, তাহলে পুরো পাড়ায় রটে যেতো বিয়ের দিন তোর স্বামী মারা গেছে, সবাই তোকেই দোষারোপ করতো এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য, যেতে আসতে লোকের কথা শুনতি। আর বাহিরের কথা নাহয় বাদ দিলাম, তোর জন্মদাত্রী আর বোন তোকে শান্তি দিত কী…! আমি জানি আমি হাসপাতালে প্রথমকে দেখতে যাওয়ার পর তোর সাথে কী কী করেছে তারা। বিশ্বাস কর আমার রুক্ষতা শুধু তোকে এই বিয়ে করিয়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতেই ছিল, বিশেষ করে তোর আপন নামক শত্রুদের হাত থেকে।”
বাবার কাতর কণ্ঠে আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না পক্ষী, বাবার বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় নয়ন্তিনী বেগম এবং আরিজ। তাদের দেখে স্বাভাবিক হয় পক্ষী ও আসলাম দেওয়ান।
আরিজ ও নয়ন্তিনীর সাথে বেশ খাণিক ক্ষণ ধরে কথোকথন চলমান আসলাম দেওয়ানের। পক্ষী রান্নাঘরের বাবার প্রিয় নাস্তা আলু পরোটা আর গরুর গোশত ভুনা করতে ব্যস্ত।
কথাবার্তার এক পর্যায়ের আসলাম দেওয়ান নয়ন্তিনী বেগমকে প্রস্তাব দেন,
“বলছিলাম কী ভাবি, বিয়ের তো অনেকদিন হলো কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারিনি। তয় আজ কিন্তু আমি মেয়ে আর জামাইকে সহ আপনাদের নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই এসেছি।”
“তা আর বলতে ভাই, আপনি ওদের নিয়ে যান। তবে আমরা আসতে পারছি না, আমার বড় বউটার শরীর আবার খুব খারাপ বুঝলেন।”
“সে কী কথা তাহলে আমার ঐ মেয়েকেও নিয়ে চলেন। ইনশা আল্লাহ কোনো অসুবিধা হতে দিবো না।”
নয়ন্তিনী বেগম নাকোচ করে উঠেন।
“আরে না ভাই সাহেব, বউমার শরীরের এমন অবস্থা যে কোথাও যেতে পারবে না, আবার ঘরও একা সামলাতে পারবে না। তার চেয়ে বরং ওরা যেয়ে আসুক, আমরা নাহয় পরেই যাবো।”
“আচ্ছা, ভাবি। যা আপনি বলেন।”
সেদিন দুপুরেই খাবার-দাবার খেয়ে পক্ষী ও আরিজকে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন আসলাম দেওয়ান। পক্ষীর যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারে না।
অপরদিকে নায়লা দেওয়ান আজ চরম ব্যস্ত রান্নাঘরে, নতুন জামাই বাড়ি আসবে তাই কোনো ত্রুটি রাখতে চান না তিনি। রান্নার সময় চুলোর তাপে তার বয়স্ক গা বেয়ে ঘাম ঝরছে, তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন দুই বাড়ি পরে থাকা রহিমা খালা। ইলিশ মাছেটা আলতো করে ঝোলে রাখতেই বেল বেজে উঠে ঘরের।
“দারোয়ানকে লেবু আনতে পাঠিয়েছিলাম, উনিই এসেছে। যা তো নিতু, গেটটা খুলে দে। ”
চেঁচিয়ে বলেন তিনি। কিন্তু ছোট মেয়ের কী আর সেদিকে ধ্যান আছে, সে নিজের সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। মেয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নায়লা। শাড়ির আচলে মাথা ঢেকে হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছতে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে যান তিনি। আজ কতটা দিন পর তার চোখের বালি চোখের সামনে ফিরে এলো, তবে আজ চোখের বালি নয় বরং মাথার তাজের চাইতেও প্রিয় লাগছে। মন চাচ্ছে জড়িয়ে নিতে সন্তানকে বুকের মাঝে, এতে যদি মনের পোড়ন কমে।
তিনি কিছু বলবে তার পূর্বেই পক্ষী বলে উঠে,
“বাবা আমার শরীরটা খারাপ লাগছে আমি ঘরে গেলাম। আরিজেরও নাকি মাথা ব্যথা করছে, গাড়িতে বলছিল।”
“তবে তোরা যা, আমি তোদের ব্যাগ পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
তখনই পিছন থেকে আরিজ আসতে আসতে বললো,
“তার দরকার পড়বে না আঙ্কেল, আমি নিয়ে এসেছি।”
পক্ষী আর কিছু না বলে মায়ের দিকে একপলকও না তাকিয়ে পাশ কেটে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। পক্ষীদের ছোট্ট তিন ঘরের ফ্লাটটা আরিজের বাড়ি অর্থাৎ পক্ষীর বর্তমান ঠিকানের কাছে কিছুই না। তবুও পক্ষী এক আলাদা ভালো লাগা অনুভব করছে এই বাড়িতে এসে। হয়তো এটাই নিজের বাড়িতে পা রাখার শান্তিময় অনুভূতি।
আরিজ পক্ষীর ঘরে আসতেই বিস্মিত হয়। ভাবে,
“এমন কোনো মেয়ের ঘর হয়! ড্রেসিংটেবিলের উপর একটা বেবি পাউডার, কিছু কাজল ও কমদামী পেন্সিল লিপস্টিক ছাড়া কিছু নেই। অবশ্য আরেকটা জিনিস আছে, তা হলো গুটি কয়েক আতর। এর জন্যই ঘরটায় এত মোহনীয় সুবাস।”
পক্ষী ঘরে ঢুকেই হিজাব আর বোরখা খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। এই ঘরটাকে দেখে মনে হচ্ছে আজই কেউ পরিষ্কার করেছে, আবার তার পছন্দের চাদর, ফুলদানীতে প্রিয় সাদা গোলাপ ফুল। কে করলো এগুলো সে জানে না, ক্লান্ত মস্তিষ্কের তা ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
স্ত্রীকে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে মৃদু হাসে আরিজ। দরজাটা ভিড়াতে ভিড়াতে বিড়বিড় করে বলে,
“মেয়েটা একটুও জার্নি নিতে পারে না।”
দরজা লক করে সে নিজেও বিছানার অপরপাশে শুয়ে পড়ে। একটু পর আলতো হাতে পক্ষীর মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে,
“বেশি খারাপ লাগছে? মাথাব্যথা করছে নাকি?”
পক্ষীর মাঝে তখন তন্দ্রাভাব, তন্দ্রাবেশেই আরিজের দিকে ঘুরে তার বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“একটু একটু, তবে এখন ভালো লাগছে। এভাবে মাথাটা টিপে দিন না!”
আরিজের মনে তীব্র ভালো লাগা ছেয়ে যাচ্ছে পক্ষীর স্পর্শে, তার ঘুম জড়ানো কণ্ঠে। ধীরেধীরে গোটা পক্ষীটাকেই নিজের অস্তিত্ব করে ফেলেছে সে। যুবতীকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে সে। কোনো এক মুহূর্ত দুজনেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
এদিকে নায়লা বেগমের মন সন্তানকে হারানোর ব্যথায় কাতর। আজ এতদিন পর দেখা হওয়ার পরও কথা বলা তো দূরে থাক তার দিকে তাকালোও না, যদিও তিনি এসবের যোগ্য নিজের কর্মের জন্য, তবে মন মানছে না নায়লা দেওয়ানের।
রাত দশটা বাজতেই পক্ষীর ঘরের দরজার কড়া নাড়ে কেউ। পক্ষী তখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে, তাই আরিজই যেয়ে দরজা খুলে। তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়স্কা এক নারী, তাকে চিনে না সে।
জামাইকে দেখে মুচকি হেসেই নায়লা বলেন,
“বাবা, খেতে এসো পক্ষীকে নিয়ে। আমি খাবার দিয়েছি।”
“জী, আসছি। তবে আপনাকে ঠিক চিনলাম না।”
কথাটা শুনে লজ্জিত বোধ করেন নায়লা দেওয়ান, মেয়ের জামাই কিনা তাকে চিনা না! লজ্জিত মুখেই বলেন,
“আমি তোমার শাশুড়ি, মানে পক্ষীর মা।”
এবার আরিজও লজ্জায় পড়ে।
“সরি আন্টি, আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”
“না, না, ঠিক আছে। আমি চললাম, তুমি পক্ষীকে নিয়ে খেতো এসো।”
বলে দরজা ভিড়িয়ে দেন তিনি। আর আরিজ পিছনে ঘুরেই দেখে পক্ষী উঠে বসে আছে, হয়তো তাদের কথোপকথনের আওয়াজেই ঘুম ভেঙেছে মেয়েটার।
“পক্ষী তোমার বাবার কথা তো সবসময় বলতা, মায়ের কথা তো একদিনও বলোনি। আমি কিনা কী ভেবেছিলাম, আল্লাহ! ভেবেছিলাম আমার শাশুড়িই নাই।”
ছন্নছাড়া ভাব নিয়েই বলে উঠে যুবতী,
“আসলেই নেই। কখনো কখনো কিছু মানুষ জীবনে থেকেও থাকে না। ”
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এই কথাটি শুনে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠলো এক নারী, তিনি আর কেউ না নায়লা দেওয়ান। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই প্রস্থান করেন সেখান থেকে।
পক্ষীর কথার আগা-মাথা কিছুই খুঁজে পেলো না আরিজ। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই পক্ষী ঘর থেকে ওড়না নিয়ে বেরিয়ে গেল বাথরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
আরিজ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“আজব!”
__
আজ দুই দিন হয়েছে দেওয়ান পরিবারে থাকছে পক্ষী এই দুদিনে নায়লা দেওয়ান অসংখ্য বার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু পক্ষী খুব সচেনতার সাথে তাকে উপেক্ষা করছে। অপরদিকে নিতু বাবা-মাকে বড় বোনকে এত গুরুত্ব দিতে দেখে ভিতরে ভিতরে হিংসের আগুনে পুড়ছে। সবচেয়ে বেশি পুড়ছে পক্ষীকে আরিজের মতো সুদর্শন পুরুষের পাশে যত্নে, ভালোবাসায় থাকতে দেখে। তার নিকট ব্যাপারটা এমন, আরিজের মতো সুদর্শন ও বিত্তবান পুরুষের সাথে পক্ষী কী করে থাকতে পারে, যেখানে পক্ষীর চাইতে সে অনেকগুণ সুন্দর।
বর্তমানে রাত প্রায় নয়টা, রাতের খাবার খেয়ে ছাদে এসে আপনমনে হাঁটাচলা করছে পক্ষী। পক্ষীদের বাসাটা দুইতলা, দুই তলাতেই তারা থাকে, নিচের দুটো ফ্লাট ভাড়া দেওয়ার। দুইতলার একপাশে ফ্লাট অপরপাশে ছাদ হওয়ায়, ছাদটা বারান্দার মতোই হয়ে উঠেছে তাদের নিকট। আনমনেই ভাবছে,
“মা কী সত্যি আমায় ভালোবাসে যে আমার আগুপিছু ঘুরছে! মায়ের ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত হৃদয় কী সত্যি তৃপ্তি পেতে চলেছে!”
কথাটা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠে তার। এর মাঝেই ছাদে উপস্থিত হয় নিতু, সম্মুখের নারীটিকে দেখে একপলকেই রাগ উঠে যায় তার। ঝাঁঝালো গলায় বলে,
“কী ভেবে হাসছিস যে মা তোকে ভালোবাসে! ইশ! কত গাঁধা তুই! আরে মেয়ে বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে না তোর, বড় বাড়ির বউ তুই। তাই তোর সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে চাচ্ছে। মার কাছে তুই এখনো ঐ পা মুছার ত্যানার যোগ্যতাই রাখিস। ”
একটু থেমে,
“তবে বলতে হয়, তোর কপাল আছে এক নাগর উপরে যেতে না যেতেই আরেকটা জুটিয়ে ফেলেছিস। মানে কেমন মেয়ে তুই প্রেমিক মরতে না মরতেই আরেকজনের গলায় ঝুলে গিয়েছিস। মনে একটু অশান্তি বা কষ্টও নেই ছেলেটার জন্য! ছিহ!”
কথাগুলো শুনে পক্ষীর রৌদ্রোজ্জ্বল মুখশ্রী অন্ধকারে ছেয়ে যায়, তীব্র বেদনা তাকে গ্রাস করতে শুরু করে।
“সত্যিই তো সারা জীবন যেয়ে বদলায়নি, সে হঠাৎ করে বদলালো কী করে! তাও আবার বিয়ের পরই! এরা সবাই আসলে স্বার্থপর, আমি নিজেও তাই। ”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে সে। আরিজ পক্ষীর খোঁজে ছাদে এসে তাকে কাঁদতে দেখে ভিষণ অবাক হয় সে, সেই সাথে চিন্তিত।
দ্রুতো কাছে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে পক্ষী, কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বললে আমাকে বলো, কেঁদো না প্লিজ।”
এখন খুব করে যুবতীর দরকার ছিল কারো বুকে আশ্রয় পাওয়ার, সেই আশ্রয় হয়েই আরিজ এলো। তার বুকে মাথা এলিয়ে দিয়েই কাঁদছে সে। বেশ কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেলে পক্ষী কাঁপা গলায় বলে উঠে,
“কেউ আমাকে ভালোবাসে না কেনো? কেন ঘৃণা করে আমায় কিংবা কাছে আসলে শুধুই স্বার্থের জন্যই! এতোটাই যদি খারাপ হই আমি তাহলে মরি…”
আর বলতে পারে না সে না তার আগেই আরিজ প্রণয়ের অগ্নি বর্ষণ করে তার দু’ঠোঁটে। এই অগ্নিততাপে পুড়ছে-জ্বলছে আজ পক্ষী, তবুও তার কষ্ট নেই। বরং, এ যেন শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার ক্ষততে।
___
ছাদ থেকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে আরিজ পক্ষীকে। যদিও তাতে পক্ষীর তীব্র নাকোচ ছিল, ছোটাছুটিও করছিল, কিন্তু পারেনি পুরুষটির পেটানো শরীরের সাথে। আর ভাগ্যও হয়তো তাদের সাথে ছিল তাই ছাদ থেকে আসার সময় বা ফ্লাটে ঢুকে ঘরে যাওয়ার সময় কোনো লোকচক্ষুর সম্মুখে পড়েনি তারা।
পক্ষী খাটে বসিয়ে তার মুখটা অশ্রুসিক্ত আলতো করে মুছে দিচ্ছে আরিজ, সাথে নিচু গলায় ধমকানো তো আছেই।
“কাঁদতে কাঁদতে মুখটা একদম কালো বানিয়ে ফেলেছে! এগুলো কোনো কাজ! আরে বাবা, ছোটো বাচ্চা নাকি যে কেউ কিছু বললেই কাঁদবে!”
এমনিতেই যুবতী ছাদের ঘটনার পর তার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক তাকাতেও পারছে না লজ্জায়, তার উপর এমন ধমকানো। নত মাথায় বাম পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে মেঝে খুঁটছে সে। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর মুখ ভেজা গামছা দিয়ে মুছিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়ে শোয় সে। তবে এবার বালিশে নয় পক্ষীর কোলে মাথা রাখে সে।
“এই যে কন্যা মায়াবতী পক্ষীরাণী, পক্ষীরাজের চুলগুলো একটু টেনে দেন তো। তার যে বড্ড বেশি পক্ষী নামক তৃষ্ণা পেয়েছে। ”
পক্ষীর মুখশ্রীতে লজ্জার মাঝেই আলতো হাসি ফুটে উঠে আরিজের। হঠাৎই সে উঠে দাঁড়িয়ে পক্ষীকে দাঁড় করায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
“পক্ষীরাণী এ পক্ষীরাজ যে তোমায় খুব করে চায়, খুব করে ভালোবাসে, তা কী তুমি বুঝো না? হবে আমার সবসময়ের জন্য? শুধু এই পৃথিবীর নয় পরকালেরও সঙ্গী হবে আমার?”
পক্ষী এতক্ষণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয় ছিল, পক্ষী কোনো এক ঘোরেই হ্যাঁ বলে উঠে। সেদিনের শুভরাত্রিতেই পূর্ণতা পায় এই বিবাহ সম্পর্ক, তবে আদৌ কী মনের পূর্ণতা পেয়েছিল?
__
দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও তিন মাস। এখন আরিজের সবটা জুড়েই পক্ষীর অস্তিত্ব। বিকেল বেলা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আরিজ, আজ আবার জামান ভবন ফাঁকা, সবাই নয়নার বাসায় গিয়েছে। ঘরে ঢুকে পক্ষীকে না দেখে খুব একটা অবাক হয় না আরিজ, বরং চেঁচিয়ে তাকে ডাকতে শুরু করে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই, একদম নিশ্চুপ পরিবেশ। এবার কিছুটা ভয় পায় আরিজ। পক্ষীকে খোঁজার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবে তখনই খাটে সুন্দর করে ভাঁজ করা এক চিঠি হাতে পায়।
কিছু না ভেবেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে।
“প্রিয় পক্ষীরাজ,
আমি চেয়েও পারছিলাম না তোমায় মেনে নিতে, মনে অধিকার দিতে। হ্যাঁ, মিথ্যে বলবো না আমি প্রেমে পড়েছি তোমার, অনেকটা বেশিই পড়েছি, যতোটা প্রেমে ডুবলে তোমাতেই নিঃশেষ হওয়ার ইচ্ছে জাগে ততোটা। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি পারি না তোমায় মেনে নিতে যখন মনে পড়ে বিয়ের রাতে তোমার কথাগুলো, যখন মনে পড়ে তোমার হাতে প্রণয়ের মৃত্যু যদিও তা এক্সিডেন্ট তবুও নিজেকে বেইমান মনে হয়, যখন মনে পড়ে তুমি প্রিয়া আপুর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমাকে কাছে টেনেছো তখন নিছকই নিজেকে প্রয়োজন ব্যতীত কিছুই মনে হয় না, যখন লোকজন তোমার সাথে আমাকে তুলনা করে নিচু বোধ করায় তখন লজ্জিত বোধ হয় এই সম্পর্কের জন্য। এসব কিছু আমাকে বিষধর সাপের মতো প্রতি মুহূর্ত ছোবল মারে। এখন বলতে পারো আমি তোমার কাছে কেন আসলাম তবে? আসলে কী বলো তো তোমার প্রেমানল থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারিনি কিংবা চাই-ই নাই বাঁচতে, ডুবতে চেয়েছিলাম তোমার প্রেমের গহীনে গুটি কয়েক দিনের জন্য হলেও।
তবে আমি সারাটা সময় এই সব বিষাক্ত অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে চাই না, তাই আমাদের প্রেমের চিহ্ন, অস্তিত্ব দেহে নিয়ে চলে যাচ্ছি বহু দূরে। বাদ বাকি জীবনটা নাহয় সেই প্রেমের অস্তিত্ব আমাদের সন্তানকে নিয়েই কাটালাম।
তবে হয়তো ফিরে আসবো, কোনো একদিন ফিরে আসবো হয়তো, যেদিন এই বিষধর অনুভূতিগুলো হবে মৃত। তুমি কী গণবে এই অপেক্ষার প্রহর, যার কোনো নির্ধারিত সীমা নেই? আমি কি এসে দেখবো তুমি শুধু আমারই আছো? যদি দেখি তাই তবে ভেবে নিবো আমি শুধু প্রয়োজন নয় প্রিয়জন টুকুও ছিলাম।
ইতি,
তোমার পক্ষীরাণী। ”
গোটা চিঠিটা পড়ে আরিজের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। চোখ থেকে অবিরাম ধারায় অশ্রু পড়ছে, তবুও সবটা নীরব, কোনো আওয়াজ নেই। কিছু কিছু গল্প বুঝি এমনই অসমাপ্ত! কিছু কিছু প্রেমের প্রাপ্তিতে বুঝি এমনই অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয় যার অন্ত কোথায় জানা নেই!
হ্যাঁ, কিছু কিছু প্রেমগল্প অসমাপ্তিতেই সমাপ্ত হয়, এটাই হয়তো তাদের ভাগ্যের লিখন, যেখানে প্রণয় তো আছে, তবে পরিণয় নেই।
কোথায় যেন সেই সময় গান চলছে,
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ।
আঙুলে আঙুল রাখলেও,
হাত ধরা বারণ।
__সমাপ্ত__
গল্পটা পড়ার একটা মুহূর্তেও মনে প্রশ্ন এসেছিল যে পক্ষী আসলে কী চায়? নাকি শুধুমাত্র পক্ষীর সাথে হওয়া অন্যায়, আরিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভুল নিয়েই ছিলেন? যাকগে দ্বিতীয় খণ্ড আসছে, অপেক্ষা করবেন।