মেঘদিঘির পাড়ে – ১৭
মালিহা খান
৩৪.
আচ্ছন্ন বিকেল। সূর্যের তেজী আলোও মোলায়েম হয়ে আসে এসময়টায়। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা নামার ঘ্রান তীব্রতা পায়। একটাসময় হারিয়ে যায় বিকেল। সূর্যের কঠিনতা নমনীয়তায় ডুবতে ডুবতে শেষমেষ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। অথচ লালচে সুন্দরী আকাশটায় তখন গোটা একটা দিনের স্মৃতি। একটা দিন!
ইটরঙা সিঁড়ি ঘাটে বসে থাকা যুবতীর শুভ্র ওড়নার আচঁলে কতকগুলো সাদা নয়নতারা ঠাঁই পেয়েছে। নিজের দীর্ঘ বিঁনুনির ভাঁজে ভাঁজে সেই নয়নতারাদের গেঁথে দিতেই খুব মগ্ন হয়ে রয়েছে যুবতী। নিশব্দ পাড় ঘিরে রাখা সবুজ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একটু পর পর চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে বা কাঁকের দলের একটু পরপর ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া, নরম বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা।
তার ঠি ক পাশেই সামান্য দুরত্বে ধবধবে শার্ট গায়ের চোখা নজরের পুরুষটি একাগ্র নয়নে তাকেই দেখে চলেছে কখন থেকে। দৈবাৎ হাওয়া ওড়নায় আচঁল উড়িয়ে দিলো। নয়নতারারা গিয়ে ভেসে গেলো দিঘির জলে। মগ্ন যুবতী চকিতে ধ্যান ভাঙলো। অস্ফুটস্বরে ‘আ..আ…’ করতে করতে কোনরকম হাতের থাবায় দু’টো ফুল বাঁচাতে পারলো সে। শান্তনিরব নিশ্চুপ হয়ে ফুলদুটো গেঁথে নিলো বিঁনুনির শেষপ্রান্তে।
এরপর পাশে বসা পুরুষটির দিকে চেয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো,”
-“কেমন লাগছে?” কি রিনরিনে কন্ঠ। প্রিয়র চোখে একটু প্রশংসা শোনার অভিপ্রায়ে কাতর হচ্ছে গোপনে।
সায়নের তন্ময় মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলোনা বিন্দুমাত্র। সে চেয়ে রইলো, যেভাবে সে চেয়ে ছিলো এতক্ষণ, অনেকক্ষণ। যেনো কতদিন দেখেনি। কতকাল, কতমূহুর্ত, কতদিবস।
তখন ঝুঁকে যাওয়ায় ইভার সামনের কাঁটা চুল কানের পিছ থেকে খুলে গেছে। সায়ন হাত বারিয়ে পালকের চেয়েও নরম স্পর্শে চুলগুলো জায়গামতো গুঁজে দিতে দিতে বললো,
-“বলতে পারবোনা, তুমি লজ্জা পাবে।”
ইভা বহুকষ্টে যতটুকু লজ্জা চেপে প্রশ্ন করেছিলো, বিধ্বংসী উওরে তাও আর দীর্ঘস্হায়ী হলোনা। চোখের পলক বারবার পড়লো। মসৃন গাল অদ্ভুত লাজুকতায় ভরে উঠলো। সায়ন চুল গুঁজেই হাত সরিয়ে নিলো। দিঘির জলে চাইলো। বর্ষা শেষ। শাপলাও নেই। সচ্ছ পানি।
আংটি পরানোর মাস পেরিয়েছে। ইভার পরিবার আদরের মেয়ের বিয়েটা তারা অতো সাদামাটা করে দিতে চান না। আরো প্রায় দু’সপ্তাহ পর নির্ধারণ হয়েছে বিয়ের তারিখ। সেই অপেক্ষাতেই কাটছিলো দিন। কাজের চাপে তারও অবসর হয়না গ্রামে আসার। তবু সে যে আসেনি এমন না! মেয়েটাকে যে কবে একবারে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। কবে?
সে একা মানুষ। মা, বাবাহীন জীবন। ছোট থেকে একাকীত্ব চিরসঙ্গী হলেও আজকাল কেবল সেই অভ্যস্ত জীবন থেকে অন্যভস্ত হতে ইচ্ছে করে।
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হঠাৎই নিজের বা’হাতের তালু মেলে ধরে অদ্ভুত নরম স্বরে বলল,
-“তোমার হাতটা দাও..”
ইভা প্রশ্নচোখে তাকায়। সায়নের মেলে রাখা হাতের দিকে একবার দেখে আবার সায়নের মুখের দিকে তাকালো। হাতের উপর সময়মতো হাতটা না পেয়ে সহসাই ভ্রু কুঁচকালো সে। হাল্কা স্বরেই খানিক জোর দিয়ে বললো,”দাও?”
-“কেনো?”
-“দাওনা।”
অধৈর্য শোনায় সায়নের কন্ঠ। উপেক্ষা করবার মতন আবদার নয়। ইভা এদিক ওদিক তাকায়। যদিও এদিকে কেউ আসবেনা। এই ঝোপজঙ্গলের দিকে কেউ আসেনা। তারউপর সন্ধ্যা নামবে একটুপর। গ্রামের ভৌতিক বিশ্বাসগুলোর জন্য হলেও এদিকে কেও পা মাড়াবেনা। লাজুকগোছে সে হাত এগিয়ে দেয়।
-“কেউ দেখলে?”
নিজের পুরুষালি রুক্ষ হাতের মধ্যে পেলব হাতটা জড়িয়ে নিতে নিতে সায়ন বললো,
-“কে দেখবে? তোমার ভাই না বাড়িতে নেই? সে ছাড়া আর কেও সমস্যা করতে আসবেনা। নিশ্চিত থাকো।”
ইভার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে হাতের পিঠে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের কপাল ঠেকালো সায়ন। কি উষ্ণতায় ভরা শীতল স্পর্শ। কন্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোতে চায়না। তবু একটু স্বাভাবিক হবার জন্য কোনরকমে উচ্চারণ করলো,
-“আপনি সারাক্ষণ ভাইজানের সাথে লেগে থাকেন কেনো?”
সায়ন তাকায়না। ক্ষীণ, জড়ানো কন্ঠে উওর দেয়,
-“আমি না, তোমার ভাইজান লেগে থাকে।”
ইভা আর টু’শব্দটি করলো না। সূর্যের আলো বেশ ঢলে পড়লো। হলদে আভা ক্রমশ লালচে হয়ে উঠলো।মাথা ঝুঁকিয়ে হাতে কি আদরে কপাল ঠেকিয়ে রাখা সায়নের দিকে নরম চোখে চেয়ে রইলো ইভা। প্রচন্ড লজ্জায় হাত পা কাঁটা দিয়ে উঠলেও সে একবারের জন্যও হাত ছাড়তে বললোনা।
সেভাবে কতোসময় কাটলো জানেনা সায়ন। যখন সম্ভিৎ ফিরলো তখন বেশ অবাক হয়ে বললো,
-“তোমার দেখি পশম দাড়িয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছো? আমি হাত ধরেছি বলে?”
ইভা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। মিনমিন করে বলে,”না..নাহ্।”
সায়ন কি যেনো দেখে তার লাজুক মুখে। অত:পর খুব ধীরগতিতে হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে যেতেই চমকে তাকায় ইভা। সায়ন এক ভ্রু উঁচিয়ে গাঢ় কন্ঠে বলে,
-“দিবো?”
ইভা আৎকে উঠে। প্রায় চিৎকার করে উঠে,”না..নাহ্।”
সায়ন সরবে হেসে ফেললো।
-“আস্তে! মজা করছিলাম। শান্ত হও।”
রসিকতা বুঝে ফেলতেই ভ্রু কুঁচকিয়ে দিঘির জলে দৃষ্টি আটকায় ইভা। বিশাল সূর্যটা বোধহয় দিঘিতেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে প্রায়ান্ধকার হয়ে আসছে আশপাশ। ইভা জলে ডুবিয়ে রাখা পা নাড়িয়ে মোহাচ্ছন্ন বলে,
-“মেঘদিঘিকে দেখুন, ও এতে সুন্দর কেনো? আকাশ এতো সুন্দর কেনো?”
-“কিহ্? কি বললে?”
সায়নের তাড়াহুড়োর প্রশ্নে তাল কেটে যায় ইভার। ঘাড় বাঁকিয়ে শূন্য কন্ঠে বলে ,”কি বললাম?”
সায়ন আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে?
-“কি যেনো নাম বললে?”
-“মেঘদিঘি।”
-“মেঘদিঘি? এটার নাম? শুনিনি তো।”
ইভা ঈষৎ জড়োসড়ো হয়ে উওর দেয়,”আমি রেখেছি।”
-“তাই নাকি?”
-“হু।”
সায়ন কথা বাড়ায়না। সূর্য ডোবার আগমূহুর্তের অদ্ভুত সুন্দর আলোটা ছেঁয়ে আছে ইভার গায়ে। মুখের একপাশে। সায়ন মন ভরে দেখছিলো। ইভা হঠাৎ বলে,”বাড়ি ফিরতে হবে, আম্মা চিন্তা করবে।”কন্ঠে জড়তা। সায়নকে হাত ছেড়ে দেবার ইঙ্গিত। সায়ন হাত ছাড়েনা। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে,
-“এই আলোর কি নাম জানো?”
ইভা একপলক তাকায় সায়নের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। সায়ন অন্যকন্ঠে বলে,
-“জানোনা?”
ভীষণ লজ্জায় জর্জরিত হয়ে ইভা বলে,
-“কনে দেখা আলো।”
ওপাশ থেকে উওর আসে,
-“তবে দেখতে দাও। তাড়া কিসের!”
মেঘদিঘির পাড়ে – ১৮
মালিহা খান
প্রকান্ড সূর্যটা মেঘদিঘির অতলেই ডুব দিচ্ছে বোধহলো। অর্ধ অস্তয়মান চিত্রভানুর টলমলে জলচ্ছবিতে চোখ রেখেই ইভা বুঝতে পারলো পাশ থেকে একটা প্রবল দৃষ্টি চূড়ান্ত পর্যায়ের স্হির হয়ে তার গা ছুঁয়ে আছে। একবারেই নিরিবিলি থমকানো বাতাসটায়ও ইভা শিরশিরিয়ে উঠলো। গায়ের লোমগুলো এমনভাবে কাঁটা দিলো যেনো আচম্বিতে আশপাশটায় মাঘের শীত পড়ে গেছে। দিঘির ঠান্ডা জলে গোড়ালির উপর অবধি ডুবানো পা দু’টো চটপট উঠিয়ে নিলো সে। সামনেই ভেসে থাকা সাদা নয়নতারার দু’তিনটে ছেঁড়া পাপড়িও লেগে আছে ভেজা পায়ে লেপ্টে।
-“বাড়ি যাবো।”
ক্ষীন অস্প্রাণ মেয়েলি স্বরে পলক পড়ে গেলো ঘনিয়ে আসা চোখে। গহীন আঁকুতি। জানে, অপরপাশের মানুষটা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেনা। তার সামান্য কথারও পাহাড়সম মূল্য আছে তার কাছে। সায়ন ছোট্ট করে বলে,
-“যেতেই হবে?”
ইভা অনতিবিলম্বে উপরনিচে মাথা নাড়ায়। উওর ‘হ্যাঁ’। মাথা দুলিয়ে বলে,”আসার আগে আম্মা বলে দিয়েছে,”সন্ধ্যার আগে আগে চলে আসবি। ওসময় খারাপ জিনিস থাকে।”
সায়ন সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে আসে তার দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,”তাই নাকি?”
-“হু।”
ইভা উঠে দাড়ায়। ঢিলে বেণি থেকে গুটিকয়েক ফুল খুলে পড়ে যায় পায়ের কাছে। সে তুমুল অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকায়। আশেপাশের গাছগুলো থেকে শুকনো পাতা ঝড়েছে। জোর বাতাসের দুলুনি দিলেই ছোট ছোট প্রপর্ণে সিঁড়ি ভরে যায়। নিজের জামা ওড়না ঝেঁড়ে একবার সায়নের দিকে তাকায় ইভা। শার্টের গুটানো হাতার মোটা ভাঁজে একটা পাতা আটকে আছে। গলার কলারের কাছে দু’টো পাতা। কি ভেবে হাত বাড়িয়ে সেগুলোও সরিয়ে দেয় সে। সায়ন অবাক হয়। একটা তুলতুলে নরম হাসি অচিরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠে পুরু ঠোঁট ঘেঁষে।
-“হাসছেন কেনো?”ইভা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
-“হুম? কই না তো। আসো।”
এড়িয়ে যায় সায়ন। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বলে,
-“আচ্ছা মনে করো, এইযে আমি তোমাকে নিয়ে উঠছি। হাত ধরে রেখেছি। উঠে হঠাৎই দেখলে তোমার হাতটা আর কেও ধরে নেই। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে পাশে আমিটাও নেই। সামনে আমার গাড়িটাও নেই। এখানে আসলে আমি আসিইনি। ঝুমঝুমে অন্ধকারে তুমি তুমি একা দাড়িয়ে আছো। একদম একা…
একটা পাংশুটে রক্তশূন্য চেহারা আশা করেছিলো সায়ন। তাকে পুরোপুরি নিরাশ করে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে ইভা বললো,
-“ধুর! আমি ভূতে ভয় পাই না।”
প্রথম সিঁড়ির এককোণায় পাশাপাশি দু’জোড়া জুতা রাখা। নোংরা জুতো নিয়ে সিঁড়ি নোংরা করা ইভার পছন্দ না। বিধায় সে জুতো খুলে খালি পায়ে বসে। ইভার জুতোগুলো খুলে রাখা দেখে সায়ন নিজেও জুতো খুলেই রেখেই পাশে গিয়ে বসেছিলো।
দু’ফিতের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে নিতে নিতেই ইভা টের পেলো ইতিমধ্যেই গা ছমছমে একটা পরিবেশ নেমে এসেছে চারপাশে। বিশাল গাছগুলো ভয়ংকর দানবের মতোন ঘিরে ধরেছে দুজনকে। আধারিয়া সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইভার হঠাৎই কি যেনো হলো। বুকটা ভারভার লাগলো। কন্ঠনালি শুকিয়ে চৌচির। ওইযে সেদিন।
মইদুল ছেলেটা যেদিন তাকে আটকেছিলো। সেদিনও এমন সন্ধ্যা ছিলো। ঘুটঘুটে আঁধার। তার ফিরতে দেরি হয়েছিলো। বহুদিন আগের কুচকুচে স্বৃতিগুলো আবারো তরতাজা হয়ে ভেসে উঠলো যেনো।
উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিলো সায়ন। ইভাকে তখনো পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,”তুমি যাও, আমি আছি এখানে। যাও।”
ইভা যায়না। সায়নের পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকে। সায়ন ফিঁতে বেঁধে উঠে দাড়ায়। অদ্ভুত কোমল গলায় বলে,”কি হয়েছে? কিছু বলবে?”
ইভা মিনমিন করে বলে,
-“দরজা পর্যন্ত দিয়ে আসেন। ভয় করছে।”
-“তুমি না ভয় পাও না?”
-“ভূতের ভয় না।” তারপরই একটু চুপ থেকে থেমে থেমে বলে,”আপনি দিয়ে আসেন, আমি একা যাবোনা।”
সায়ন দিরুক্তি করেনা। ঠোঁটের হাসি আগেই নিভে গেছে তার। উপরন্ত ইভা কি কারণে ভয় পাচ্ছে এবং কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভয় পাচ্ছে তাও তার অজানা নয়।
ছোট্ট করে বলে,”আচ্ছা আচ্ছা, আসো। দিয়ে আসছি।”
বলে ছেড়ে দেয়া হাতটা আবারো মুঠোয় টানতে যেয়েই টের পায় তার আগেই কখন যেনো খুব ভরসায় নিজের ছোট্ট মুঠো দিয়ে তার কড়াপড়া আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরেছে ইভা।
৩৫.
আগুনের রংটা নীল। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আঁচটা ধুম করে বাড়িয়ে দিলো বিভা। আগুনের নীল রংটা থেকে হলুদ হয়ে গেলো চোখের পলকে। বিভা একমনে হাসলো। পানির পাতিলটা চড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করলো পাঁচমিনিট।
ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন রাত। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকে ইউসুফের চোখজোড়া প্রথমেই যেয়ে আটকালো রান্নাঘরের উল্টোদিকে ফিরে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে, পিঠে আধখোলা হয়ে থাকা বিশাল খোঁপাটায়। একমূহুর্ত নিরব থেকে ফাঁকা হলরুমটায় চোখ বুলালো ইউসুফ। এদিক ওদিক কাওকে দেখতে না পেয়ে নিশব্দ পা দুটো এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে।
বিভার পিছে যেয়ে দাড়ালো যখন মেয়েটা তখন অবধিও পায়নি। কেবল হাতটা চুলের দিকে বাড়িয়ে দিতেই চকিতে ঘাড় ফিরালো বিভা।
ইউসুফকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালো না। হাতের আলগা ছোঁয়ায় অলকবন্ধন মুক্ত হয়ে গেছে ততক্ষণে। রেশমের মতন ছড়িয়ে পড়েছে।
আচমকা এতো নিকটে ইউসুফকে দেখতে হাতে পায়ে খিল ধরে গেলো বিভার। বোকাভম্বের মতোন তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে রইলো সে। তার প্রতিক্রিয়াকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় ইউসুফ বললো,
-“পানি দিওতো। ঠান্ডা। দু’তিনটে বরফ দিয়ে।”
বিভার হুঁশ ফিরে। এককদম পিছিয়ে যেয়ে আমতাআমতা করে বলে,
-“আপনার না কাঁশি হয়েছে? ঠান্ডা পানি খাবেন কেনো?”
ইউসুফ উওর দিলোনা। চায়ের পাতির কৌটোটা নেড়েচেড়ে একবার ফুটন্ত পানিটায় চোখ রাখলো। অত:পর কৌটোটা সামান্য শব্দ করে রেখে পূর্বের চেয়ে নিচু গলায় বললো,”ঘরে দিয়ে যাবে।”
বিভা প্রত্যুওর করতে পারেনা। রান্নাঘরের দরজায় বাহাদুরের কন্ঠে সন্তর্পণে কাছ থেকে সরে দাড়ায় ইউসুফ। হাতের ইশারায় বাহাদুরকে ডেকে দু’হাতে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে,”তাড়াতাড়ি…”বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় জাহানারার শাসনভরা কন্ঠ,”তুই আবার চা করতে এলি কেনো? এমনেই একটা ব্যাথা পেয়েছিস পায়ে। জমিলার মাকে ডেকে বললেই তো চা করে দিতো।”
ওপাশের উওরটা আর কর্ণগোচর হলোনা ইউসুফের।
বিভা যখন ঢুকলো, ক্লান্ত ইউসুফ তখন ফ্যানের নিচে বসে শার্টের বোতাম ছাড়াচ্ছে। বিভা যেতেই হাত বাড়িয়ে দিলো সে। গরম পানিভর্তি গ্লাসটা বেশ নির্বিকার গোছেই এগিয়ে রাখা হাতটায় ধরিয়ে দিলো বিভা। ইউসুফ ভ্রু কুঁচকালো একঝলক। গ্লাসে চুমুক দিয়ে গরম পানিটা গলা দিয়ে নামিয়ে বেশ ঠান্ডাস্বরে বললো,” তোমাকে না বললাম ঠান্ডা পানি দিতে।”
-“দিবোনা, এটাই খান।”
ইউসুফ দিরুক্তি করলোনা। ঢকঢক করে পানিটা শেষ করে খালি গ্লাসটা বিছানার উপর রাখলো। অথচ বিভা তখন হাত এগিয়ে রেখেছে গ্লাসটার জন্য। ইউসুফের উদ্ভট কাজে চোখেমুখে অসহ্য প্রশ্ন নিয়ে তাকালো বিভা।চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে যেনো। ইউসুফ শার্টের বোতামে হাত দিলো। তার রাগত চোখের মধ্য দৃষ্টি রেখেই দু’টো বোতাম খুলে ফেললো।
তপ্ত শ্বাস ফেলে পাশ থেকে গ্লাসটা নেয়ার জন্য ঝুঁকে যেতেই একহাতে গ্লাসটা ধরে ফেললো ইউসুফ। বিভা ঝড়ের বেগে ধমকে উঠে বললো,”কি সমস্যা আপনার?”
-“ব্যাথা পেয়েছো শুনলাম। কিভাবে?”
বিভা চোখ সরিয়ে নেয়। উওর দেয়,”ঠিক আছি আমি। গ্লাস ছাড়ুন।”
ইউসুফ আরো জোরে চেপে ধরলো গ্লাসটা। বিভা ভ্রু কুঁচকে সোজা হয়ে দাড়ালো। দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“দেয়া লাগবেনা, নিজেই রেখে এসেন। কেমন?”
বলে সে চলেই যাচ্ছিলো। ইউসুফ একটানে বিছানায় বসিয়ে দিলে আর যাওনা হলোনা। তালটা ঠিক সামলাতে পারলোনা বিভা। চরম আশ্চর্য হয়ে বললো,”কি হয়েছে?”
ইউসুফ ততক্ষণে বসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। পাগুলো কোলের উপর তুলে নিতে নিতে বললো,
-“কোথায় লেগেছে? কোন পায়ে?”
বিভা তুরান্বিত গতিতে পা’দুটো তুলে নেয় বিছানায়। হতভম্ব হয়ে বলে,
-“পাগল হয়েছেন? হাঁটুতে কেটেছে।”
ইউসুফ দুই ভ্রু উঁচায়। চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে বলে,”কেটেছে!”
বিভা চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
-“ধুরো, সরুন আপনি।”
-“কিভাবে কাটলো?”
-“পড়ে গিয়েছিলাম।”
-“কোথায় পড়ে গিয়েছিলে?”
এ পর্যায়ে এসে হঠাৎই কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায় বিভা। ইউসুফের কাঠকাঠ চোখদুটোয় দিকে চেয়ে মিনমিন করে প্রশ্ন করে,
-“আমার এমন কেনো মনেহয় আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
~চলবে~
~চলবে~
[রিচেক হয়নি]