মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -৩২(সমাপ্ত)

মেঘদিঘির পাড়ে – ৩২ (অন্তিমপর্ব)
মালিহা খান

৭১.
বাহিরে মাত্র ভোর হচ্ছে। ব্যাকুল রজনীর কালচে আঁধার কাটিয়ে মধুর আসমানি রঙে ছেঁয়ে যাচ্ছে মেদিনী। ঝুমঝুমি কুহেলির পালে আশপাশ ধবধবে সাদা। সূর্য উঠেনি। একটা মেঘ ভেদ করা বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি পূবাকাশে দৃষ্টিগোচর হবে হবে করছে।
করিডোরে তখন ঠান্ডাতর বাতাবরণ। সায়নের বিশাল অগ্নিময় বুকটায় আদুরে ওম পেয়ে কোমলমতী ইভা কেমন কুঁকরে কুঁকরে যাচ্ছিলো। যত ঠান্ডা বাড়ছিলো সে যেনো ক্রমশই ঢুকে পড়তে চাইছিলো বুকটার ভেতর। সর্বচেষ্টায় লুকিয়ে নিতে চাইছিলো নিজেকে। শক্ত থেকে কঠিনরুপে জাপটে ধরছিলো মানুষটাকে।
সায়নের ঘুম ভেঙে গেলো। ইভা সাংঘাতিক জোরে খামচেছে বাম কোমড়ের শার্ট। পাতলা শার্ট ছাঁপিয়ে মাঝারি দৈর্ঘ্যর নখগুলোতে চামড়া কাটার উপক্রম। মেয়েটা কি দুঃসপ্ন দেখছে? ভয় পাচ্ছে ঘুমের মধ্যে?

সায়ন আস্তে করে হাতের উপর হাত রেখে নরম করে টেনে শার্ট থেকে ছাড়িয়ে নিলো। নিজের তালুতে মাপ দিলো তুলনামূলক বেশ ক্ষুদ্রকায় মেহেদিরাঙানো মোলায়েম হাতটাকে। জ্বলজ্বলে পাথরের আংটিটায় কিছুক্ষণ বৃদ্ধাঙ্গুল বুলালো। ঘুমের মধ্যেই শিথিল হয়ে গেলো ইভা। জোরালো সত্তা ছেড়ে আলুলায়িত হলো শরীর। সায়ন হাত মুঠোয় ধরে রেখে বাইরে তাকালো। পাখির কিচিরমিচির কানে আসছে। ভোর দেখা হয়না তার। কাজ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল ন’টা- দশটা পর্যন্ত অন্ধকার করা ঘরের বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমিয়েই কাটায় সে। লিথিশা ফুপিকে ফোন করে রাতেই জানিয়েছিল একবার। এরপর আর কথা হয়নি।
সায়ন চোখ ফেরালো। নেওয়াজ সাহেব পাশে নেই এখন। সে সেভাবেই বসে রইলো। ইউসুফ কোথা থেকে যেনো টানতে টানতে নিয়ে এলো বিভাকে। ধপ করে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। বিভার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। কেউ যেনো মুখজুড়ে আচ্ছামতন উষ্মার মলম লেখে দিয়েছে। জ্বালাপোঁড়ায় স্ফুলিঙ্গের মতো ইউসুফের দিকে চেয়ে আছে।

সায়ন বিহ্বলচোখে বললো,”কি হলো?”

-“কি আর হবে? একা একা হাসপাতাল ঘুরতে বেরিয়েছিল।৷ তারপর আর চিনেনা কিছু। ইভাকে দেখো কি সুন্দর একফোঁটা বিরক্ত না করে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। এর চোখে একবার ঘুম দেখেছো?”বিভার দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে ইউসুফ ফোঁস করে শ্বাস ফেললো।

-“আপনি চুপ করবেন? আমি কিন্ত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি।”চোখ বুজে মাথাটা পিছের দেয়ালে এলিয়ে দিয়ে মেঘস্বরে বললো বিভা।

সায়ন অপ্রস্তুত হাসলো। ইউসুফ চমৎকারভাবে কথা ঘুরিয়ে বললো,

-“তুমি আর কতক্ষণ ওকে ধরে রাখবে?”

-“আম….যতক্ষণ ঘুমাবে।”

ইউসুফ একচোট হাসলো। আলগোছে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,

-“ওর ঘুম জানো? ডেকে তুলো। এদের দুজনকে একটুপর বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি আর চাচাই নিয়ে যাবে খুব সম্ভবত।”

ফোন বের করে সে দেয়ালে হেলান দিলো। দৃষ্টি ফোনে ডুবে যেতেই সায়ন সচেতনচোখে তাকালো তার দিকে। পরণে একটা ফিনফিনে পাতলা কাপড়ের হাফহাতা ধবধবে টি-শার্ট। পুরুষহাতের ঘন লোমগুলো ঠান্ডায় সটান দাড়িয়ে আছে। ফর্সা সুঠাম মুখের নাক চোখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেছে।
সায়ন চোখ ঘুরিয়ে বিভার দিকে তাকালো। কৃষ্ণবর্ণা অবিকল ইভার মতো দেখতে মেয়েটা নিশ্চিন্তে চোখবুজে রেখেছে। কোমড়ের প্রায় নিচপর্যন্ত চলে যাওয়া বাদামীরঙের লেদারের জ্যাকেটটা যেনো তাকে দু’হাত মেলে বাঁচিয়ে নিচ্ছে পৌষের অসহনীয় আক্রমণ হতে।
সায়ন চোখ ফেরালো। বিকট ঠান্ডায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নিজের একমাত্র গরমপোশাকটুকু দিয়ে দেয়া তার মোটেও বোন বোন আদর লাগলোনা।

সরফরাজ এলো। ব্যস্ত কন্ঠে জানালো, সায়ন আর নেওয়াজ সাহেব আপাতত বিভা ইভাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে। তাদেরকে বাসায় নামিয়ে সায়ন চলে যাবে। তারও তো বিয়ে, ইভার একার নয়তো।
সে থাকবে হাসপাতালে, তন্দ্রাকে আরো তিন-চারদিন এখানেই ভর্তি থাকতে হবে। অন্য উপায় নেই। মেয়েটার শারীরিক অবস্থা ভালো না। প্রচুর ব্লাড গিয়েছে ডেলিভারির সময়।
সন্ধ্যায় মাগরিবের আগে আগেই সে একমূহূর্ত বাসায় যাবে। বিয়ে পড়ানোর সময়টুকু থেকেই আবার চলে আসবে। তন্দ্রার মা,বাবা আসছে। তারা এখানে থাকবে ওইসময়টায়। জাহানারা আর ইউসুফ দুপুরের দিকে বাসায় যাবে। তন্দ্রার মা-বাবা অন্যগ্রামে থাকেন। তাদের আসতে খানিক সময় লাগবে।
তার গোছালো পরিকল্পনায় কেও কোনো কথা বললোনা।
হড়হড় করে কথাগুলো বলেই সামান্য দূরে যেয়ে ব্যগ্র হয়ে ফোন কানে চাপালো সরফরাজ।

নড়েচড়ে উঠলো সায়ন। শত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইভার তুলোনরম বামগালটায় বারদুয়েক হাল্কা করে থাপ্পড় দিলো। দাম্ভিক পুরুষালি কন্ঠ খাদে নামিয়ে ডাকলো,

-“ইভা? এই ইভা? উঠো।”

ইভার প্রগাঢ় ঘুমে সামান্যতম চিড় ধরাতে পারলোনা সেই নিচু আহ্বান। খানিক মোচড়ামুচড়ি করে সে আরো লেপ্টিয়ে গেলো। মিশে গেলো। সায়ন হাঁফ ছাড়লো। হাতদিয়ে ইভার দু’গাল চেপে মৃদু এদিক ওদিক দুলিয়ে বললো,”এই মেয়ে উঠো।”

এতক্ষণে ইভার হুঁশ ফিরলো যেনো। ঘুমের রাজ্য থেকে ফেরত এসে সে সহসাই কিছু বুঝে উঠতে পারলানা। ইউসুফ মাথার পাশে আলতো চাটি মেরে শুধালো,”এই তোর না আজকে বিয়ে?”

ইভা আধখোলা ঢুলুঢুলু চোখটাই কুঁচকে নিলো। ভারি বিরক্ত হয়ে চোখ কচলাতে হাত দিতে হঠাৎই কেমন চমকে উঠলো। বিদ্যুৎবেগে নিজের অবস্থানটা বুঝে ছিঁটকে সরে গেলো। আশেপাশে বাবাসহ ভাইদেরকে দেখে আকস্মিক লজ্জায় তার সারা গা ঝাঁঝড়া হয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে এলো। মোমের মতো গালদুটোয় যেনো নয়াবসন্তের আগুনলাল কৃষ্ণচূড়ার গুঁড়ো মেখে দিলো কেও।
এত লাজ সামলাতে ইভা হিমশিম খেলো। দ্রুত মাথায় ওড়না ঠিক করলো।
সায়ন বিরবিরিয়ে আওড়ালো,

-“ঘুমিয়েই তো ভালো ছিলে।”

ইভার কান অবধি পৌঁছোলোনা কথাটা। সে তারাতারি কপাল বেয়ে নেমে আসা অবাধ্য চুলের গুঁছি কানের পিছে গুঁজে কোঁণায় চেপে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।
ইউসুফ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তার। বললো,

-“ঠিকাছে তো, শান্ত হ। কিছু হয়নি।”

সায়ন উঠে দাড়ালো। শার্টের কুঁচকানো জা’গা সোজা করার ভঙ্গি করে কলার ঠিক করলো। দাম্ভিক গলাটা গমগম করে জিজ্ঞেস করলো,

-“এখনই বেরোবো আমরা?”

৭১.
মেঘের রাজ্য হতে একছ’টা সোনাবরণ রোদ এসে পড়েছে রাস্তার মাঝবরাবর। ভোরসকালে ঝাড়ুদার রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে। দেদারসে ধূলো উড়ছে। রাস্তার ধারেই পার্ক করা ছিলো গাড়িটা। ইউসুফ একহাতে পেছন জড়িয়ে বিভার মুখটা নিজের বুকতলায় লুকিয়ে তাকে গাড়ির পিছে নিয়ে বসালো। মেয়েটার ধূলোয় শ্বাসকষ্ট হয়। দরজা আটকে দেবার আগে বললো, “বসো, চাচা আর ইভা আসুক। বাড়ি যেয়ে আগে একটু ঘুমিয়ে নিবে। সারারাত ঘুমাওনি।”

বিভা চেয়ে রইলো। উওর দিলোনা। ইউসুফ দরজা আটকে সোজা হয়ে দাড়ালো। সায়ন কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
-“আপনার মতলব আমার সুবিধার লাগছেনা ভাইয়া।”

ইউসুফ একমুহূর্ত থমকালো। ঠোঁটের কোঁণে একটা বাঁকানো চওড়া হাসি দাগ কাটলো। সেও ফিসফিস করেই বললো,
-“আমার মতলব সুবিধার নয়ও সায়ন।”

নেওয়াজ সাহেব আর ইভা এলো। ইভার পিপাসা পেয়েছিলো। নেওয়াজ সাহেব মেয়েকে পানি খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ির কাছে এসে মেয়েকে ভেতরে বসতে বলে ইউসুফের সাথে কি কথায় যেনো ব্যস্ত হলেন নেওয়াজ সাহেব। ইভাকে গাড়ির দরজা খুলে দিতে দিতে সায়ন কাঁধের কাছে ফিসফিসালো,

-“মেহেদীর রং তো বেশ গাঢ় ইভা, আমি বোধহয় তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসবো।”

ইভা কেঁপে উঠলো। লজ্জায় খাঁ খাঁ গলায় বললো,

-“আহ্: বাবা পাশে।”

সায়ন যেনো শুনেও শুনলোনা লাজুকলতার বুলি। আরো নিবিড় হয়ে বললো,

-“তোহ কিহ্? বিকেলেই তো বউ হচ্ছো।”

___________
পরিশিষ্ট:
পৃথিবীতে তখন গ্রীষ্মের দুর্দান্ততা। রাতের শহর কিছুটা নিস্তার পেলেও তম্রিস কেটে প্রভাতপ্রহর আরম্ভ হতেই দাপুটে ঊষাপতির অরুণরাঙা আলো বিস্ফোরিত হয়ে পাতাল পর্যন্ত নেমে আসে। ঝলসানো রোদ্দুরে শহরের ইটপাথর পর্যন্ত হাহাকার করে উঠে।

ঘর্মাক্ত জবজবে শরীরে দীর্ঘ ঘুমে ভাঙন ধরলো সায়নের। ব্যালকনির গ্লাস সরানো। রোদে সয়লাব মেঝে। জানলার কাছে এক অপরূপা রৌদ্রস্নাতা দাড়িয়ে আছে। অন্যমনস্ক বাইরে চেয়ে হাতের কাঠের চিরুনিতে নিজের বিশাল কেঁশের বাহার গুঁছিয়ে নিচ্ছে। সায়ন শুকনো গলায়ই ঢোঁক গিললো। চোখ বুজে সদ্য ঘুম ভাঙা বসে যাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-“এসি বন্ধ করেছো কেনো?”

বছরকয়েক আগের এক গোধূলী বিকেলে হঠাৎ সাক্ষাৎ পাওয়া অষ্টাদশী ভীতু মেয়েটি নয় বরং বাইশ বছর বয়সী নিজ অঙ্গনারূপী পরিপূর্ণ রমণীটি ঘাড় ফিরালো। কন্ঠে কপট স্ত্রীসূলভ রাগের আভাস টেনে বললো,

-“এসি বন্ধ করিনি৷ চেয়ে দেখেন। জানলা খুলেছি বলে সব বেড়িয়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে ক’টা বাজে দেখেছেন? উঠুন। বাহাদুরও আপনার থেকে আগে উঠে যায়।”

পুরুষটি হাসলো। চোখ সরিয়ে হাই তুললো। নিজের অগোছালো চুলের ঝাঁকে আঙুল চালাতে চালাতে মৃদুগলায় ফোঁড়ন কাটলো,

-“বাহাদুর সারারাত ঘুমায়।”

সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে চেঁচামেচি হলো খুব,

-“সকাল সকাল অসভ্যতামি করবেন না। উঠেন। জানি তো কেনো উঠছেন না।”

সায়ন মুখের অসহ্যকর গা জ্বালানি হাসিটা বজায় রেখেই উঠে বসলো। ইভা চুলে বিনুনি বেঁধে এগিয়ে এলো। চিরুনিটা বেডসাইড টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো।
সায়ন বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনে ডুবেছে।

-“উঠুন, ঘর গোছাবো। আমরা কখন রওনা দিচ্ছি?”

ফোন নামালো সায়ন। ইভাকে টেনে কাছে বসালো।
সতেজ মুখটায় চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মগ্ন হয়ে, বিবশতায় ছুঁইয়ে। এরপর কিছুক্ষণ। সময়টা কাটলো খুব ব্যক্তিগতভাবে।
শ্রান্ত সায়ন কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিয়ে নিশ্চল গলায় বললো,
-“এতো ব্যস্ত কেনো?”

ইভা মিষ্টি হাসলো। দূরত্বের নিবিড়তা গাঢ় করে খুব প্রনয়ী কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়ে ফিসফিসিয়ে শুধালো,
-“কারণ আপনি গতমাসেও আমাকে বাড়ি নিয়ে যাননি। ব্যস্ত ছিলেন, এখন আমারও ব্য-স্ত-তা।”

সায়ন হেসে ফেলে। ইভা চটপট উঠে দাড়ালো। সায়নের এলোমেলো চুলগুলো আঙুল ডুবিয়ে আঁচরে দিয়ে বললো,

-“হয়েছে, যান এবার।’

সায়ন নামতে নামতে বললো,

-“বাহাদুর কোথায়? বাড়ি নেই?”

-“উহু, খেলতে যেতে দেইনি। ঘরেই আছে।”

সায়ন অলসগোছে তোয়ালে কাঁধে নিলো। ঘর গুছিয়ে ইভা বেরিয়ে এলো। ছিমছাম সাজানো ফ্ল্যাটটা সে একমূহুর্তের জন্যও অগোছালো হতে দেয় না। সায়ন কাজে গেলে সে আর বাহাদুর পুরো একা। গ্রীষ্মকাল চলছে। স্কুল, ভার্সিটি বন্ধ। তার আর বাহাদুরের বেকার সময় কাটে। সারাদিন এটা ওটা করে কাটে। সকাল-বিকেল দু’বেলা বাহাদুর সামনের মাঠটায় খেলতে যায়। তখন সে একেবারেই একলা। বছরদুয়েক আগে শহরে এসেছে। বিয়ের পর দু’বছর নিজের বাড়িতেই ছিলো৷
বিশে পা পড়তেই অধৈর্য পুরুষকে আর মানানো গেলো না। সে বগলদাবা করে ইভাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইভা কথা দিয়েছিলো বাহাদুরকে। সে তাকে একা রেখে আসবেনা। তথাপি বাহাদুরকেও সঙ্গে নিয়ে এলো।

ইভা হাসলো। তার নিজেরো কি মন টিকতো? উহু!
_

গভীর ঘুমের মধ্যে আচমকা মুখের উপর তীব্র রোদের ঝলকানিতে মুখ থেকে শুরু করে সকাল সকাল মেজাজটাও ঝলসে উঠলো ইউসুফের। চোখমুখ বিশ্রিভাবে কুঁচকে চরম ধমকে বললো,

-“এ্যাই মেয়ে, পর্দা দাও।”

বিভা পর্দা দিলোনা। উওরও দিলোনা। উল্টো চূড়ান্ত অবাধ্যতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পর্দাটা আরো পাশে চাপিয়ে দিয়ে নির্বিকার হয়ে নিজের ভেজা চুল মোছায় মনোযোগ দিলো। ইউসুফ তেজী চোখে একবার তাকালো মেয়েটার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,

-“বিভা! ঘুমাচ্ছি আমি। পর্দা টানো।”

বিভা ফিরে তাকালো,

-“দিব্যি তো খ্যাকখ্যাক করছেন। ঘুমাচ্ছেন আর কোথায়?”

-“বিরক্তিকর।”

-“আপনিও।”

-“মুখে মুখে তর্ক করবেনা।”

-“মুখ ছাড়া তো তর্ক করা যায়না। হাতে হাতে তর্ক করি তবে? শিখিয়ে দিন।”

ইউসুফ বালিশে মাথা চেপে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। রাগ লাগছে তার। বিভার মাথাটা চিবিয়ে খেতে পারলে ভালো লাগতো। স্বস্তি মিলতো। পিঠভর্তি উত্তপ্ততর রোদ লাগছে। চোখ বুজলো ইউসুফ। পাগলের সাথে কথা বলে লাভ নেই। মেয়েটা এজন্মে তার কথা শুনলোনা আফসোস!
আজন্ম আফসোসের মাঝেই পিঠের উপর ঠান্ডা পানির ফোঁটার টুপটুপ অস্তিত্ব টের পেলো ইউসুফ। মুখের বালিশ সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিভাকে ঝুঁকে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে বললো,

-“ভিজাচ্ছো কেনো?”

-“কই ভিজাচ্ছি?”বিভার ঠোঁটে আকর্ণ হাসি। অদ্ভুত মিষ্টতা।

মুখোমুখি থাকায় ইউসুফের মুখের উপর পানির ফোঁটা পড়লো। ইউসুফ দিরুক্তি করলোনা। বিভা এমন মনোযোগী হয়ে তাকালো যেনো ইউসুফের নাক, চোখ পরিমাপ করে খাতায় লিখে আজই কোথাও জমা দিতে হবে। ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গালে হাত রেখে নিচু কন্ঠে বললো,

-“আমাকে সারাক্ষণ বিরক্ত না করলে হয়না?”

-“কই বিরক্ত করি?”বিভার ঠোঁটে তখনও হাসি। বিশাল হাসি। ইউসুফ তন্ময় হয়ে ভাবে। এই মেয়েটাকে সে কত কাঁদিয়েছে। কত অবহেলা করেছে। কত কত কষ্ট দিয়েছে। চন্চল স্বভাবকে দুমড়ে মুচড়ে প্রাণহীন বানিয়ে ফেলেছিলো। মেয়েটার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, খাওয়ার অনিয়ম হয়ে গিয়েছিলো। কিচ্ছু বাদ রাখেনি। তবু মেয়েটা কেমন যেনো, সে সাথে থাকলেই যেনো তার আর কিচ্ছুটি চাইনা। দিনশেষে তার বুকে মাথা রাখতে পারলেই যেনো সমস্তশান্তি কাজলকালো সর্বনাশা চোখদুটিতে।

ইউসুফ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“তুমি হাসলে আমার বিষন্ন সকালেও উচ্ছলতা আসে। তুমি হাসলে আমার কঠিন হৃদয়েও বিদ্যুৎ খেলে। তুমি হাসলে আমার বেরঙে বিকেলেও রঙিন তুলির আঁচর লাগে। তুমি হাসলে আমার পৃথিবী হাসে প্রাণবন্তা।”

ছটফটে বিভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“প্রাণবন্তা? আপনি বানালেন নাকি নামটা?”

ইউসুফ চুপি চুপি এড়িয়ে গেলো প্রশ্নটা। মেয়েটাকে যে সে মনে মনে কতনামে ডাকে জানলে পাগলটা খুশিতেই মরে যেতো।
ইউসুফ ধীরগলায় বললো,

-“তোমার আমার উপর রাগ লাগেনা বিভা? আমি না তোমাকে কত কষ্ট দিলাম? কত কাঁদালাম?”

বিভা দ্বিগুন হেসে বললো,”আমাকে সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছে যে, আমার প্রানখোলা হাসির কারণও একমাত্র সে।”

ইভা শহরে গেছে তখন খুব সম্ভবত মাসদুয়েক পেরিয়েছে। সরফরাজ হঠাৎ একদিন জানালো সে বিভার জন্য ইউসুফকে পছন্দ করেছে। ছোটবোনের বিয়ে হয়ে গেছে এখন সে বিভার বিয়েও সেড়ে ফেলতে চায়। বাপ-চাচারা আপত্তি করলো মাসখানেকের মতো। বাড়িতে অশান্তি, কলহ, ঝগড়াঝাঁটি, মনমালিন্য চললো। সবটা গেলো সরফরাজের উপর দিয়ে। সে কি বোনকে জোর করে বিয়ে দিবে নাকি? অত:পর বিভা জানালো সে তার ভাইজানের উপর কিছু বলবেনা।
সরফরাজের অনড়, একরোখা সিদ্ধান্তের কাছে হেরে গিয়ে শেষমেষ ওজর উঠিয়ে নিলো তারা।
এক সুন্দর শুক্রবারে হুট করেই তাদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হলো। বাড়ির মানুষ আজও জানেনা ভেতরের কথা। দুটো অন্তরের অন্তস্তলের অনুভূতি। সবাই জানে ভাই পছন্দ করে বোনকে বিয়ে দিয়েছে। আর কিছুই নয়।

ইউসুফ বিভার প্রাণোচ্ছল চোখদুটোতে চাইলো। ছোট্ট শরীরটা হাতের বাঁধনে বিশাল বুকের সাথে শক্ত করে আটকে নিলো। হাল্কা গলায় বললো,

-“আমার জীবনে দুটো আশ্চর্যের ঘটনা আছে। এক. আমার মতো গম্ভীর পুরুষকে একটা চঞ্চল মেয়ে অসম্ভব ভালোবেসেছে। দুই.সেই চঞ্চল মেয়েটাকে আমি পেয়ে গেছি।”

বিভা চোখে চোখ ধরে রাখতে পারলোনা। নামিয়ে নিলো। খানিকবাদে ইউসুফের কানের পাশে ভীষণ ফিসফিসিয়ে বললো,

-“আপনার জীবনের তৃতীয় আশ্চর্যজনক ঘটনাটাও বোধহয় আসতে চলেছে পাষাণ পুরুষ। সাবধানে ধরুন আমাকে।”

ইউসুফ সেকেন্ডদুয়েক কোনো ‘রা’ করলো না। করতে পারলোনা। কথার অর্থ বোধগম্য হলো। আশ্চর্যতা ভর করলো পুরুষচোখে। হতবিহ্বল হয়ে তারা চেয়ে রইলো শ্যামলকৃষ্ণ লালিমাক্ত নারীমুখে।
_

তন্দ্রা বেরোলো। শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে। শাড়িটা একদম নতুন। ভাঁজ খুলে মাত্র পরেছে। কুঁচির দিকটা সমান হচ্ছেনা। ফুলে ফুলে আছে।
সরফরাজ হাঁটুগেড়ে মেঝেতে বসা। ঘাড় কাত করে কাঁধের সাথে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে দু’হাতে মেয়ের ফ্রকের ফিতা বেঁধে দিচ্ছিলো। তন্দ্রা বেরোতে সে চোখ তুললো। একটু দেখে কষ্টকরে চোখ নামাল। তার মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকে দেখছে।
ফ্রকের ফিতে বাঁধা হতেই সে দু’হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো বাবার। ইঙ্গিত কোলে তোলার। সরফরাজ একহাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে উঠে দাড়ালো। কথা শেষে কানের থেকে ফোন নামিয়ে মেয়েকে মৃদুগলায় জিজ্ঞেস করলো,”মাকে সুন্দর লাগছে না মা?”

মেয়ে অভ্যস্ত। বাবাকে চুমু খেয়ে বললো,

-“খুব সুনদল লাগতে বাবা। মাকে সবতময় সুনদল লাগে।”

তন্দ্রা ফিরে তাকালো। বাপ-মেয়েকে তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করে নিয়ে সরফরাজকে উদ্দেশ্য করে শাসিয়ে বললো,
-“আপনি কি বলেন ওর সামনে এসব?”

-“কি বলি?”

-“চুপ। বিরক্ত করবেন না। আমার কুঁচি মিলছেনা।”

সরফরাজ মেয়েকে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। ছোট্ট মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-“ওর জানা উচিত, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর নারীটিই ওর মা। তাই না মামনি?”

মেয়েটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে একেবারে সচ্ছভাবে বলার চেষ্টা করলো,

-“তুমি বাবাকে বকবে না মা।”

তন্দ্রা কুঁচি ছেড়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
-“বাপের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখাবি না ফাজিল মেয়ে, তোর জন্মের সময় তোর বাপ কাছে ছিলোনা।”

সরফরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েকে চুমু খেয়ে ক্লান্ত গলায় বললো,

-“তুমি আর কতোদিন আমাকে এটা নিয়ে কথা শোনাবে তনু? চারবছর হয়ে গেলো।”

তন্দ্রার চোখে জল এসে পড়েছে। দুঃখের জল। এই বিষয়টা উঠলেই সে কেঁদে ফেলে। তবু বলে।

তন্দ্রা একহাতে জল মুছে উওর দিলো,
-“যতদিন ইচ্ছে ততদিন শোনাবো। দোষ করেছেন, এখন কথাও শুনতে চান না। আপনি…আপনি খুব..।”তন্দ্রা বলতে পারলোনা। হাতের তালুতে চোখ ডলে আবার জল মুছলো।

-“আচ্ছা শুনিও তনু, তোমার যত ইচ্ছা তত কথা শুনিও। কেঁদোনা শুধু। হুঁশ। মেয়ে কি ভাববে? বাবা শুধু মাকে কাঁদায়?”

মেয়েটা মুখ গোল করে অনুকরণ করলো সরফরাজকে।

-“বাবা মাকে কাঁদায়।”

তন্দ্রা হেসে ফেললো। কান্নায় লাল হয়ে,আসা মুখটায় বিস্তৃত হাসিটা অদ্ভুত মোহনীয় ঠেকলো। সরফরাজ মেয়েকে বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে কাছে এলো। হাটুভেঁঙে মেঝেতে বসে পড়ে বললো,”দেখি, কি মিলাতে পারছোনা? উপরটা ধরো, আমি করে দিচ্ছি।”

তন্দ্রা দু’কদম পিছিয়ে বললো,”উহ! লাগবেনা। আমি পারবো।”

সরফরাজ চোখ তুলে তাকালো। তার নিরব শাসনে পিটপিট করে যতটুকু পিছিয়েছিলো গুনে গুনে ঠিক ততটুকুই এগিয়ে এলো তন্দ্রা। বিছানায় বসে তাদের চরম দুষ্টু মেয়েটা তখন খিলখিল করে হাসছে।
________________
তখন সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা। ঝিমধরা অন্ধকার বাহ্যজগতে।
গ্রামজুড়ে লোডশেডিং হয়েছে। কোথাও কোনো বাতি জ্বলছেনা। একহাত দূরের জিনিস দেখা মুশকিল। সরফরাজ বাজার থেকে বোনের পছন্দের জিলাপি নিয়ে এলো। বিভা সবে মোম জালাচ্ছে হলরুমে। তার চোখেমুখে আগুনবাতির মনোরম খেলা। সরফরাজকে আসতে দেখে একাধারে চেয়ে থাকা দৃষ্টিটা সরিয়ে নিলো ইউসুফ। বাহাদুর সোফার হ্যান্ডেলে উঠে বসেছে।
সরফরাজ মেয়েকে কোল থেকে নামাতে নামাতে বললো,”ইভা সায়ন কোথায়?”

তন্দ্রা পাশেই ছিলো। উওর দিলো,”ওরা ঘরে। আজকে নাকি অনেক জ্যাম ছিলো। অন্যরাস্তা দিয়ে বড্ড ঘুরে এসেছে। ইভাটা তো এসেই ঘুমে ঢলেছে। সায়ন বেচারার হাত লাল হয়ে ব্যাথা ধরে গেছে গাড়ি চালাতে চালাতে। আমার থেকে মলম নিয়ে গেলো। বিভা? দেখতো যেয়ে উঠেছে নাকি।”

বিভা মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ উপরে উঠে গেলো। খানিকবাদেই উপর থেকে সজোরে হাঁক ছাড়লো,”ওরা তো নেই ঘরে। দরজা খোলা।”

সরফরাজ ভ্রু কুঁচকালো। চিন্তিত হয়ে বললো,”ঘরে নেই? এই অন্ধকারে কই গেছে?”

তন্দ্রা থামিয়ে দিলো তাকে,

-“আহাঃ বাইরে গেছে হয়তো। ওরা কি বাচ্চা নাকি? সায়ন তো আছেই সাথে।”

ইউসুফ সন্তর্পণে বাহাদুরের কাছে যেয়ে ঘেষলো। সকলের অগোচরে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলো,”গেছে কোথায় রে দুটো?”
গরম জিলাপিতে কামড় বসিয়ে বাহাদুর পা দোলাতে দোলাতে উওর দিলো,
-“তারা দুজনে মেঘদিঘির পাড়ে যেয়ে বসে আছে।”

মেঘদিঘির পাড় তখন শান্ত, নিরব, অন্ধকারময়। ভীষণ অনূভূতিতে জর্জরিত মানুষদুটোর মাঝে মাত্র এক নিঃশ্বাস পরিমাণ দুরত্ব।

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here