#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪
“তাজ্জব ব্যাপার তো, মিস মাহি! চড়ুইয়ের হাতের লেখা তোমার সাথে কীভাবে মিলে গেল। আবার তুমি গড়গড় করে পড়ছ, মনে হচ্ছে কবিতা মুখস্থ বলছ?”
নির্বিকার কণ্ঠে বললেন ধ্রুব স্যার। আমতা-আমতা করল মাহি। তার কথায় অস্পষ্টতার ছাপ। উপস্থিত ক্লাসের সবাই তখন উদ্বিগ্ন। বুকে হাত গুজলেন। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই মাহি বলে উঠে,
“স্যার, আমি তো অনুমানের বসে বলেছি। বইটা যেহুতু ওর, চিঠিটাও ওর হবে।”
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন, “মিথ্যা বলতে জানতে হয়, মিস্ মাহি। গুছিয়ে রাখতে হয়। তুমি এতবড় মিথ্যাবাদী এখনো তৈরি হওনি। পরশুদিন যখন চড়ুইয়ের চশমা ভেঙেছিলে, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি চাইলে তখনই তোমাকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু কাজ পড়ে যাওয়ায় সম্ভব হয়নি।
এবার বলো, তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া যায়?”
ভীত হল মাহি। অনুরোধ করল স্যারের নিকট, “প্লীজ স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো করব না।”
“সেদিনও তুমি চড়ুইকে কথা দিয়েছিলে, কিন্তু কথা রাখোনি। এবার রাখবে তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি চাইলে তোমাকে ভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করতে পারি। কিন্তু আমি তোমার মত না। তবে তোমার মত স্টুডেন্টকে আর পড়াব না। প্রয়োজনে তোমাদের ক্লাসই করাব না। বেরিয়ে যাও।”
শেষ কথাটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন তিনি। কেঁপে উঠলাম ক্লাস। তৎক্ষণাৎ বেল বেজে উঠল। ধ্রুব স্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাহির দিকে তাকিয়ে ক্লাসের ইতি টেনে বেরিয়ে গেলেন। একগাল হাসলাম আমি। চোখ টিপলাম মাহিকে। আর কোনো টিচার পেল না, শেষে ধ্রুব স্যারকে ধরলেন আমার জন্য। হা! হা! হা!
.
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বসে ছিলাম। বন্ধুদের সাথে গান গাইছি। আমার এই আনন্দ সহ্য হয়নি ধ্রুব স্যারের। তাই জুনিয়র দ্বারা ডাক পাঠিয়েছেন, তিনি লাইব্রেরীতে আছেন। আমাকেও যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি ব্যাগ সমেত অগ্রসর হলাম সেদিকে। তিনি লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। যেন পড়ে আর রাখবে না। আমার দিকে না চেয়েই বললেন,
“আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে। সময় অপচয় না করে পড়তে শুরু করো।”
আমি এগোলাম। বসলাম স্যারের সামনের বেঞ্চিতে। কৌতূহলী স্বরে বললাম, “আপনি তো আমার দিকে তাকাননি, তাহলে জানলেন কীভাবে আমি এসেছি? আপনার মাথার পেছনে অদৃশ্য কোনো চোখ আছে না-কি?
বইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই জবাব দেয়, “চোখ থাকার দরকার পড়ে না, আমার মস্তিষ্ক একটু বেশিই প্রখর। ছোট খাটো জিনিস নজরে এসে যায়। বই বের কর।”
আমি সৌজন্য পূর্ব হাসি দিয়ে বই এগিয়ে দিলাম। তিনি গাঢ় সবুজ রঙের কলম দ্বারা কিছু লাইনে দাগ কাটলেন। গাঢ় সবুজ রংটা তার প্রিয় রং। বেশিভাগ সময়ই তাকে এই রঙের শার্ট পড়তে দেখা যায়। ফিরিয়ে দিয়ে পড়তে বললেন। আমি পড়ায় মনোযোগ স্থাপন করলাম। পড়ার মাঝপথে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল মেঘময় আকাশে। মেঘগুলো জড়ো হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। যখন তখন মাটি কম্পিত করতে পারে জলধারায়। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব স্যার তখনও নিকটে বসে আছেন, তবে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। আমাকে তড়িগড়ি করে উঠতে দেখে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“কোনো সমস্যা? উঠে পড়লে যে।”
“আকাশে দেখুন মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে। বাড়িতে যাবো।”
“বসো, আগে পড়া। বৃষ্টি হলে থামলে বাড়িতে যাবে। আমি পৌঁছে দিবো।”
উপায়হীন হয়ে বইয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। কিন্তু আমার ছটফটে মন সে কি মানবে আমার বারণ? যা ক্রমাগত জানালার বাইরে উঁকি দিচ্ছে। কাশি দিয়ে বললাম, “তেষ্টা পেয়েছে, পানি খাবো।”
আরো কিছু বলার পূর্বেই বোতল এগিয়ে দিলেন তিনি। ছোট বোতল। আমি দ্রুত সম্পূর্ণ পানির বোতল ফাঁকা করে ফেললাম। পুনরায় বললাম, “পানি খাবো।” এবার তার চেয়ে বড় বোতল এগিয়ে দিলেন। উদ্যমহীন হয়ে বসে রইলাম। নিশ্চয়ই পানির ট্যাংক নিয়ে এসেছে। দুই ঘণ্টার পূর্বে ছাড়বেন না। বৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও না।
ঘণ্টাখানেক অতিবাহিত করলাম পড়তে পড়তে। কোমর ব্যথা করছে বিধেয় একটু উঠে হাঁটাচলা করলাম লাইব্রেরীতে। তিনি নিশ্চেষ্ট। ওষ্ঠদ্বয় পুঁটি মাছের ন্যায় নড়ছে। কোমর ব্যথা করে না বুঝি। কী দিয়ে তৈরি।
আগমন ঘটল রাহাত স্যারের। আমাদের একত্রে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। অতঃপর দ্রুত কণ্ঠে বললেন,
“তোরা এখানে, আমি কখন থেকে খুঁজছি। তাড়াতাড়ি বাড়িতে চল।”
ধ্রুব স্যারের সোজাসাপ্টা উত্তর, “আমি খুঁজতে বলেছি? বাড়িতে মানে কী হ্যাঁ। দেখছিস না, পড়াচ্ছি। এখন যাওয়া যাবেনা।”
“আকাশের অবস্থা দেখেছিস, বৃষ্টি এলো বলে। ভার্সিটি ছুটে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণে সবাই চলেও গেছে, আমরা বাদে।”
ধ্রুব স্যার হাতের করতল মেলে দিয়ে চাবি বললেন। রাহাত স্যার বিরাগী হয়ে চাবি দিয়ে দিলেন এবং দ্রুত বাড়িতে যেতে বললেন। কিন্তু ধ্রুব স্যার, সে তো নিশ্চল। বাকহীন। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পড়ার মনযোগী হলাম। বিলম্বে বৃষ্টি আরম্ভ হল। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে শ্রবণের বারোটা বাজাচ্ছে। পানির শব্দ ছাড়া কিছুই কর্ণদ্বয়ে যাচ্ছে না। ধ্রুব স্যারের টনক নড়ল। জানালার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখলেন। বন্ধ করে দিলেন, দরজাও বন্ধ করলেন ভেতর থেকে। বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। শব্দ অস্পষ্ট হল। বইয়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আওড়ালাম,
“আজ যা হয়ে যাক না কেন, পড়াবেনই। আমিও তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি।
________
বৃষ্টির হিম জলধারা ছাতার উপর ঝমঝমিয়ে পড়ছে। অতঃপর গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাঝে মাঝে দু এক ফোঁটা শরীরের উপর পড়ছে। ভিজে গেছে খানিকটা। পানিতে হাঁটার ফলে খ্যাচ খ্যাচ শব্দ হচ্ছে জুতায়। একই ছাতার নিচে দু’জনে সামনের দিকে অগ্ৰসর হচ্ছি। অনেক কষ্টে একটা ছাতার জোগাড় হয়েছে। ধ্রুব স্যারের গাড়ি সকালে সমস্যা হয়েছে, তাই মেকানিকের কাছে রেখেছে। রাস্তাঘাটে যানবাহন নেই, হাতেগোনা রিক্সাও নেই। এরজন্যই বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সব ঝামেলা একসাথে। ধ্রুব স্যারের উপর রাগ হচ্ছে, কি দরকার ছিল এতক্ষন পড়ানোর। ধ্রুব স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে যাচ্ছিলাম। হয়ত প্রকৃতির সহ্য হয়নি। হুট করে হোঁচট খেয়ে ধপাস করে পড়লাম রাস্তায়। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় আমি হতভম্ব। বৃষ্টির পানিতে ডুবে ছিল রাস্তা। যার ফলশ্রুতিতে ভিজে জবুথবু হয়েছি। যেভাবে রাস্তার উপরে পড়েছিলাম, সেভাবেই রয়েছি। আমার এই অবস্থায় না তুলে উল্টো রাগ ঝাড়লেন তিনি,
“চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটছিলে? আশ্চর্য। দেখতে পারছ, পানি। তবুও হাঁটার ঢক নেই।”
আমি নাক ফুলিয়ে ধীরে ধীরে উঠলাম। এর এরুপ কথা মোটেও প্রত্যাশা করিনি। ভিজেছি তবে ব্যথা পাইনি। কেন যে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য গলিতে ঢুকলাম। জুতা পড়তে গিয়ে দেখলাম, ছিঁড়ে গেছে। পড়ার উপযুক্ত নেই। এমনিতেই ছেঁড়া ছিল। আজ বিপদের দিনে এমন করবে বুঝতে পারিনি। ধ্যাত, ভালো লাগে না।
‘চলুন’ বলে আমি হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুব স্যার নিজের জুতা খুলে পড়তে বললেন। কিন্তু আমার পায়ের মাপ তুলনামূলক ছোট। বিনিময়ে নোংরা পানি সালোয়ারে ভরে যাবে। আমি পড়লাম না।
ধ্রুব স্যার প্রত্যুত্তর করলেন না। মাথার উপর ছাতা ধরলেন, যাতে ঠান্ডা না লাগে। কিছুটা দূর এগোতেই পানির মাত্রা বেড়ে গেল। পারাপারের জন্য ইটের ছোট ছোট টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে। জুতা থাকলে পানি দিয়ে হেঁটে যেতাম। কিন্তু পানিতে বিষাক্ত কিছু থাকতে। ইতোমধ্যে ধ্রুব স্যার পানিতে নেমে গেছেন। হাত ধরলেন আমার। আশ্বাস দিয়ে হাঁটতে বললেন। আমি মুচকি হাসলাম। দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে পেরিয়ে এলাম পথ। পুরোপুরি বাড়ির কাছে এলেন না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভেতরে যেতে। আমি একা একাই অগ্ৰসর হলাম। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পূর্ব অবধি দাঁড়িয়ে রইলেন। চেয়ে রইলেন বাড়ির দিকে। আমি নিজের কক্ষে পৌঁছালাম। স্যার এখনও দাড়িয়ে আছেন কি-না যাচাই করতে ব্যালকেনির দিকে পা বাড়ালাম। তিনি যায়নি, পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু দৃষ্টি ব্যালকেনির দিকে। হয়ত জানতেন, আমি আসব ব্যালকেনিতে। দূরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বললেন। দূর থেকে শোনা গেল না স্পষ্ট। তবে আমাকে ফ্রেশ হতে বলেছে, এর ব্যাপারে নিশ্চিত। শরীর থেকে নোংরা গন্ধ আসছে। নিজেরই গা গুলিয়ে উঠছে, ধ্রুব স্যার কেমনে সহ্য করেছেন এমনটা। আমি হাত নাড়িয়ে ভেতরে এলাম। জামা কাপড় নিয়ে ছুটলাম ওয়াশরুমে। চুল পরিষ্কার করতে হবে। ঠান্ডা লাগবে না, আশা করা যায়। #মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫
“তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করো, নাহলে একটা বেতের বাড়িও নিচে পড়বে না।”
টেবিলের বেতের আঘাত করে তীব্রতর কণ্ঠে বললেন। অকস্মাৎ কেঁপে উঠলাম। চোখের পলক স্থির থাকল। আজ বেত নিয়ে হাজির। এর হাত থেকে মুক্তি নেই। জিভ দিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিলাম। আমি মলিন হয়ে পড়তে শুরু করলাম। পা জোড়া টেবিলের নিচে দুলছে পড়ার তালে তালে। তিনি সরু দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করলেন। অতঃপর দিলেন এক ঝাড়ি,
“পা নাচানো বন্ধ করে পড়, নাহলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো ইডিয়েট।”
“আপনি কি জানেন, আপনি দেখতে অনেক সুন্দর? সুন্দর মানুষের মন একদম ভালো হয়না। সবসময় আমাকে বকে, একটুও ভালোবাসে না।”
ভ্রু কুঁচকে স্মিত হেসে বললেন, “প্রথমত আমি জানি, আমি দেখতে সুন্দর, সুদর্শন যুবক। দ্বিতীয়ত, সুন্দর মানুষের মন অন্যদের মনকেও সুন্দর করতে সচেষ্ট থাকে। তৃতীয়ত, পড়ার সময় পড়া আর ভালোবাসার সময় ভালোবাসা।”
এমন প্রতুক্তি মোটেও প্রত্যাশা করিনি। ‘ভালোবাসার সময় ভালোবাসা’ বলি কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছিস? ভালো লাগে না।
হাতের উপর প্রখর আঘাত পড়তেই দহনে প্রজ্বলিত হল। থেমে গেল পা। আমি বইয়ের ভেতরে মন স্থির করে পড়তে লাগলাম। ধ্রুব স্যার সন্তুষ্ট হলেন না। দড়ি দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে দিলেন পা। নড়াচড়া বন্ধ। পড়তে বলে নিশ্চল ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। নিজের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত অনুভব করলাম। প্রবল ক্ষোভ নিয়ে পড়তে লাগলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আমি পড়া বন্ধ করলাম না। ধ্রুব স্যার এলেন না। গভীর রাত হয়েছে, তবুও তার দেখা পেলাম না। হুট করে মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম। আমি চমকে উঠলাম। জানালা থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছি, ফলস্বরুপ, জানালা বন্ধ করার চেষ্টা বৃথা। তৎক্ষণাৎ বৃষ্টি শুরু হল। রেলিংয়ের ওপর টিপটিপ শব্দে জলধারা পতিত হচ্ছে। সেই বিন্দু কণাগুলো পড়ছে এসে মুখে। ভিজে যাচ্ছি আমি। পা জোড়া চেয়ারের সাথে বাঁধা থাকায় নড়তে ব্যর্থ আমি। ধীরে ধীরে নড়ার চেষ্টা করতেই বিকট শব্দে নীচে পড়লাম। বিনিময়ে পানির ধাঁচ যথারীতি ভিজিয়ে তুলছে আমায়। হিম হয়ে আসছে দেহ। দরজার দিকে দৃষ্টি মেলালাম। ধ্রুব স্যার এলেন না। অশ্রু গড়াল। তিনি আসবেন না। কক্ষনো তাকে ক্ষমা করব না, কক্ষনো না। জ্ঞান হারালাম সেখানে। যখন জ্ঞান ফিরল ধ্রুব স্যারকে নজরে এল সর্বপ্রথম। আমাকে তোলার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছে। পরক্ষণেই ঝুঁকে কোলে তোলার প্রয়াস করলেন। আমি চেয়ারের হাতল ধরলাম। কিছুতেই তার কোলে উঠব না। তিনি আমাকে পড়বেন তো। আমি পড়ব।
আমি নিজে নিজেই উঠলাম। মাথা ভার হয়ে আছে ঠান্ডায়। ভেজা জামা পড়নে। চোখজোড়া আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ধ্রুব স্যারের চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে ফেললাম বই দিয়ে। ধ্রুব স্যার আমার এরুপ প্রতিক্রিয়া দেখছে বেশ বিরাগী হলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
“স্টুপিড উঠ। জ্বর চলে আসবে।”
অব্যক্ত স্বরে বললাম, “আসুক জ্বর। মে’রে ফেলুক আমায়, তাহলে পড়তে হবে না। তবুও এখন আমি পড়ব। পড়বই পড়ব। কেউ থামাতে পারবে না।”
ধ্রুব স্যার বিচলিত হলেন। লাইব্রেরীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পদচারণ করলেন। ধৈর্যহীন হয়ে কোলে তুলে নিলেন আমায়। জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমি উঠার প্রয়াস করেও বরাবরই ব্যর্থ। ক্লান্ত শরীরে নিয়ে ধ্রুব স্যারের কাছে পাঁচ বছরের বাচ্চার ন্যায়। কাবার্ড থেকে স্বযত্নে রাখা চুরিদার বের করে দিলেন। পাল্টে নিতে বললেন। গোমড়া মুখে পাল্টে বসে রইলাম। ততক্ষণে ধ্রুব স্যার ডাক্তার ডেকে এনেছেন। এতরাতে ডাক্তার ডাকার কারণ জানতে ব্যর্থ। শরীরটা অতিরিক্ত উষ্ণ। জ্বরের লক্ষণ। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক মাথায় জ্বর পট্টি দিতে বসলেন ধ্রুব স্যার। ভেজা কাপড়ের টুকরো চোখের উপর পড়তেই চোখ মেলে তাকালাম।
“আপু তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দে, ভিজে যাচ্ছি তো।” ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল বাবুই।
ব্যাঘাত ঘটল তন্দ্রায়। বাইরে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জালানার খোলা, বিনিময়ে ফোঁটা ফোঁটা জলধারা আঁচড়ে পড়ছে মুখমণ্ডলের উপর। দ্রুত জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ধ্রুব স্যারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই বালিশের দিকে তাকালাম। একি কোথায় তিনি? আমি তো লাইব্রেরীতে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলাম। আনমনেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলাম। এতক্ষণ আমি তন্দ্রা ঘোরে নিমজ্জিত ছিলাম। এজন্যই লাইব্রেরীতে বিছানা, কাবার্ড, জামা কাপড়, ডাক্তার রাখা ছিল। এই ছেলেটা আমাকে স্বপ্নেও বিরক্ত করছে, কি ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার। কিছুদিন পর যদি আমার এই ভয়ানক দুঃস্বপ্নটাই সত্যি হয়। আচ্ছা, আমি কবে এমন পড়াচোর হলাম? আমি পড়তে যথেষ্ট ভালোবাসি।তাহলে?
আমি জীবনেও ধ্রুব স্যারের কাছে পড়ব না। প্রয়োজনে ভার্সিটিতেই যাবো না।
টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে একঢোক পানি পান করলাম। পুনরায় বালিশে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
______
এগারোটার কাছাকাছি। ধ্রুব স্যারের ক্লাস নেই। আজকে ভার্সিটিতে কোথাও থাকে দেখা যায়নি। আজকে আসার কোনোরুপ ইচ্ছে ছিলনা। ধ্রুব স্যারকে জানাতে এসেছি। কিন্তু মহাশয় হাওয়া। তাকে দেখা যায়নি। ক্লাসও নেই তার।
বন্ধুমহল সবাই একত্রে। আমার উৎকণ্ঠার কারণ জানতে তাদের আয়োজন। কিন্তু নিশ্চুপ আমি। আমার এরুপ ভাবাবেগ দেখে নিরব বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে,
“তুই কি সারাজীবন চুপ করে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিস, তাহলে থাক। আমরা বরং যাই।”
অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলি, “মামা আমার বিয়ে ঠিক করেছে?”
“কী?” [বিস্মিত কণ্ঠে একসাথে]
“চ্যাঁচামেচি করছি কেন, আশ্চর্য?”
তড়িগড়ি করে বলে আঁখি, “কার সাথে, কবে, কখন, কীভাবে?”
তৌফির দ্রুত কণ্ঠে বলে, “প্রিয়ার মত বুড়া চাচার সাথে নয়তো?”
“তোরে বলছে, ও বুড়া। তোর মারিয়া একবারে কচি মনে হয়। ওর তো চামড়া কুঁচকে গেছে। আমার বিয়েতে নিয়ে আসিস, তোরে আয়রণ মেশিন ট্রিট দিবো নে। ওটা দিয়ে ওর চামড়া সোজা করে দিস।”
তৌফিক ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে বলে উঠল, “তোর হবু বর কোন ইর নেতা। আমার মারিয়া যথেষ্ট সুন্দর, তোর সোজা করার দরকার নাই। পুলিশ জামাই পাইয়া আকাশে উঠে গেছিস। যা তোর পুলিশ জামাই কাছে। যত্তসব, থাক তোরা।”
ফাঁকা ক্যাম্পাসে লা’থি দিয়ে চলে গেল তৌফিক। আমি, আঁখি, নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। ফুঁপিয়ে উঠল প্রিয়া। অস্ফুট স্বরে বলে,
“ও তো সবসময় তাহিরকে বুড়া বলে, আমি একটু বলছি তারজন্য এভাবে বলতে পারল।”
প্রিয়ার প্রস্থান করল। আমরা তিনজনে গালে হাত দিয়ে একসাথে বললাম, “কী হলো এটা?”
.
ধ্রুব স্যার একটু দেরি করে উপস্থিত হলেন। ক্যাম্পাস অতিক্রম করে যাওয়ার সময় দৃঢ় গলায় বলেন, তার কেবিনে দেখা করতে। পুনরায় এগোলেন। তৎক্ষণাৎ মাহি এলো সেখানে। স্যারকে স্যরি বলার পূর্বেই পা পিছলে ধপাস করে পড়ল নিচে। মাহি কোমরে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে ব্যথায়। ধ্রুব স্যার গোটা ব্যাপারটা ইগনোর করলেন। মাহিকে না তুলেই নিজের কেবিনের দিকে অগ্ৰসর হল। মাহি নামের কোনো তরণী তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, বোঝার দায় নেই। স্যারের ন্যায় সুদর্শন পুরুষ এমন একটা কাজ করতে পারেন দেখে সবাই হতভম্ব।
‘সুদর্শন’ শব্দ মস্তিষ্কে হানা দিতেই কালকে রাতের স্বপ্নটার কথা দৃশ্যগোচর হল। আমি স্বপ্নে স্যারকে সুদর্শন পুরুষ বলে অভিহিত করেছিলাম। লজ্জানত হল মুখশ্রী। দ্রুত মাথায় দোপাট্টা টানলাম। তার পিছুপিছু দূর্বল পায়ে অগ্ৰসর হলাম। কিছুটা পথ দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গলা উঁচু করে বলেন,
“খাওয়া-দাওয়া করো না, তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে আবার যেতে হবে।”
.
“কী হয়েছে, তোমার চড়ুই। আমার সামনে হঠাৎ এত লজ্জা পাচ্ছ কেন আর মাথায় এতবড় ঘোমটা দিয়েছ কেন? মনে হচ্ছে, বাসর ঘরে বসে আছি।”
লজ্জায় মুখশ্রী চুপসে গেল। উপায়ান্তর না পেয়ে ঢেকে নিলাম মুখ। এখানে আর থাকা যাবে না। নত কণ্ঠে বললাম,
“স্যার, আসছি।”
“আজকে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে ডিনারে ইনভার্ট করা হয়েছে, তোমার মনে আছে।”
লহমায় লজ্জা ভঙ্গ হল। বেমালুম ভুলে গেছি। ইদানীং বিষন্নতার কারণে ভুলে যাচ্ছি, ধ্রুব স্যার ছাড়া কিছু মনে থাকে না। আমতা আমতা করে বললাম,
“মনে ছিলনা।”
সন্দিহান গলায় বললেন, “খাওয়ার কথা মনে থাকে তো?”
“না, কাল রাত থেকে কিছু খাইনি।”
“তাহলে মন কার কাছে, রাহাতের কাছে?”
“আপনি সবসময় রাহাত স্যার, রাহাত স্যার করেন কেন? মনটা আপনার কাছে ছিল। রাহাত স্যারের দোষ একদম দিবেন না।”
“কী? বুঝলাম না।” না বোঝার স্বরে।
আপনাআপনি হাত দিয়ে ঠেকলো ওষ্ঠদ্বয়ের উপর। ক্ষোভের বশে মুখ ফসকে গেছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]