#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ একুশ
-” কি সুন্দরী বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? পড়া পারো নি বুঝি?” বলে রাফসান মিচকে হাসি দিল। তুলতুলকে কান ধরে বাইরে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার অনেক হাসি পাচ্ছে। যেখানে তার মুখ সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে, কেউ কখনো তাকে মুচকি হাসতেও হয়তো দেখেনি এই চার বছরের ভেতর৷ আর এই মেয়েটির সামান্য কারনে তার হাসি পায়। সে নিজেই অবাক হয় এটা ভেবে। যতটা রাগ নিয়ে সকালে বের হয়েছিল তার একফোঁটাও এখন নেই, মেয়েটির এমন অবস্থা দেখে সব রাগ উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মেয়েটিকে জ্বালাতে ইদানীং তার অনেক ভালো লাগে। এখন যেমন লাগছে। তুলতুলের চেহারায় রাগের ছাপ স্পষ্ট, মুখ লাল হয়ে আছে, চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে রাফসানের দিকে। ফাজিল লোক তাকে দেখে কেমন করে হাসছে, আবার সুন্দরী বলছে ব্যঙ্গ করে। এতোদিন তো দেখা হলেই ধমকি দিত, চিৎকার করতো, দুইদিনে আবার কি হলো যে কথা এত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নাকি এর পেছনেও কোনো মতলব আছে। তুলতুলকে ভাবুক দেখা গেলো। তুলতুল রাফসানের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকালে রাফসান একটু হাসে
-” বেবি ওই লুক টা আবার দাওতো ওইযে একটু আগে দিলে যখন তোমাকে স্যার বের করে দিল। ক্লাসের বাইরে এসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে কানে হাত দেয়া আবার স্যার চলে গেলে টুপ করে হাত নামিয়ে কেউ দেখেছে কিনা সেটা দেখতে লজ্জিত ভাবে এদিক ওদিক তাকানো। আবার স্যার আসলো কিনা এটাও চোখ বড় বড় করে দেখা। ওয়াও কি সুন্দর লাগছিল দৃশ্যটা জানো? জানবে না তো। কিন্তু আমি জানি লাজুক চোরের মতো লাগছিল বেবি।” বলে তুলতুলের নাকে এক আঙুল লাগিয়ে আবার দ্রুত সরিয়ে ফেলে।
রাফসানের কথা গুলো শুনে তুলতুল হা করে রাফসানের মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। রাফসানের কথা শুনে তার মাথা থেকে সব আউট হয়ে যাচ্ছে। আর রাফসান তুলতুলের এমন অবস্থা দেখে বলে
-“উফফ! দ্যাট লুক।”
-“আপনি ঠিক আছেন? না মানে মাথায় কি বারি খেয়েছেন?” তুলতুল ওভাবেই প্রশ্ন করলো। তুলতুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছে। রাফসান তার সাথে এধরনের কথা কখনো বলেনি। তার মনে হচ্ছে রাফসানের কিছু হয়েছে। এজন্যই এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে।
-” রাফসানের মাথায় বারি দিবে এতো সাহস কার?আর আমি ঠিকই আছি পিচ্চি।”
তুলতুলের চট করে রাফসানের আগের কথা মনে পড়ে গেলো। ও রাগী ভাবে রাফসানকে বললো
-” এই আপনি আমাকে বেবি ডাকছেন কেন? আমি আপনার কোন জন্মের বেবি? একদম বেবি ডাকবেন না বলে দিলাম। আর লাজুক চোর কি হ্যাঁ? আমি কোন চুরি করছিলাম না যে আমাকে এটা বলবেন।”
-” কাম ডাউন। তুমি যে রাফসানের সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে এখনো দাঁড়িয়ে আছো সেটা অবাক করার বিষয়। আর তুমি আমার বেবি হতে যাবে কোন দুঃখে। তুমি তো বাচ্চা একটা মেয়ে দেখে বেবি বললাম। আর সেটা বলেই ডাকবো।” রাফসান ভ্রু নাচিয়ে বললো।
-” আপনি কিন্তু….
-” তোমাকে কিন্তু এই অবস্থায় খারাপ লাগছে না, বরং কানে ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভালোই লাগছে। কিন্তু স্যার তো ঠিক করে নি পিচ্চি সুন্দরী একটা মেয়েকে এভাবে একা একা বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে। নাহ! একদমই ঠিক করে নি। তার উচিত ছিল আরেকজনকে বাইরে পাঠানো, যাতে গল্প করে সময় কাটাতে পারো। তো কোন স্যার ক্লাসে? একটু কথা তো বলতে হয় তাই না?” তুলতুলকে বলতে না দিয়ে রাফসান বলে।
তুলতুল রাফসানের কথা শুনে ভীতু গলায় বললো
-“দেখুন স্যারের সাথে আপনার কথা বলার দরকার নেই। আপনি আপনার কাজ করুন। আমি এভাবেই ঠিক আছি।” তুলতুলের এবার ভীষণ ভয় লাগছে। এই রাফসান ব্যাটা ওর জন্য যদি আনিস স্যারকে কিছু বলে তো স্যার প্রতি ক্লাসেই রাগে তুলতুলকে পিটাবে। তখন তুলতুলের কি হবে? নাহ, এটা হতে দেয়া যায় না। এই গুন্ডা আজকে একটু বেশিই করছে।
-” তা বললে তো হবে না। আমি তো আামার কাজ করবোই। কিন্তু তার আগে একটু স্যারকে দর্শন করে আসি।” বলে রাফসান যেতে লাগবে তার আগেই আনিস স্যার বের হয়ে এসে আশেপাশে না তাকিয়ে তুলতুলকে বলে
-“সমস্যা কি তোমার? তোমার জন্য শান্তিতে ক্লাসও নিতে পারবো না নাকি? ক্লাসে তো মনোযোগ নেই কোন ভাবনায় ডুবে থাকো তা নিজেই জানো। এখন ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছি তারপরও লজ্জা নেই। আরেকজনকে নিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর শুরু করে দিয়েছে। তোমার জন্য ক্লাসের অন্যরা মনোযোগী হতে পারছে না৷ নিজে পড়তে চাও না দেখে কি অন্যদেরও পড়তে দিবে না? কলেজে আসো কি করতে তুমি? চেহারা দেখাতে? পরীক্ষায় কি পাশ করবে? এভাবে করলে তো মনে হয় ফেলই করবে। শুধু শুধু আমাদেরকে কথা শুনতে হবে। কাল থেকে কলেজে আর কষ্ট করে আসতে হবে না। ” বলে পাশে তাকিয়ে থতমত খায়। রাফসানকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পায় আনিস স্যার। আগেই রাফসানকে দেখলে সে এতো কিছু বলতো না। রাফসান এই কলেজের ট্রাস্টি। তার কথা ছাত্র/ছাত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাদের সাথে খারাপ বিহেব বা তাদেরকে হার্ট করে কথা বলা যাবে না। এতে তাদের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। প্রথমে বুঝাতে হবে তারপর যদি কথা না শুনে তখন ব্যবস্থা নিতে হবে বা অভিভাবক কে ডাকতে হবে। কিন্তু সে তো একে না বুঝিয়েই বকাঝকা করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আবার এখানে এসে আবার রাফসানের সামনে বকতে শুরু করেছে। আনিস স্যার একটা ঢোক গিলে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো
-” স্যার আপনি ভালো আছেন? আজকে কি এখানে কোনো কাজ ছিল?”
-” হুম আমি তো ভালো আছি কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুক্ষন পরে একজন ভালো থাকবে না। আর রাফসান কাজ ছাড়া অকারণে কোথাও যায় না। তো কি যেন বলছিলেন মেয়েটিকে মি. আনিসুজ্জামান সাহেব?” রাফসান শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো। সে তুলতুলের দিকে তাকায়ে দেখে কান্না করছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর সেটা হাতের তালু দিয়ে মুছে মাথা নিচু করে রয়েছে। তুলতুলের এখন জোরে জোরে কান্না করতে মন চাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই টিচার এতোকিছু বললে মন খারাপ হবে তারপর আবার অন্য একজন লোকের সামনে সেটা আরো লজ্জাজনক আর কষ্টকর। ক্লাসের কারো সামনে কিছু বললে হয়তো তার খারাপ লাগতো কিন্তু কান্না আসতো না। তুলতুল পড়ালেখায় মাঝেমধ্যে ফাঁকিবাজি করলেও সে খারাপ ছাত্রী নয়। তার রোল সবসময় এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকে। তারপরও আজকে সামান্য কারনে স্যার তাকে অপমান করলো আরেকজনের সামনে।
-” না স্যার তেমন কিছু না। ওই একটু বকছিলাম পড়া পারেনি তো তাই। আপনি ভাববেন না৷ আপনি এখানে রোদের ভিতর দাঁড়িয়ে কেনো চলুন, প্রিন্সিপাল স্যারের কেবিনে চলুন।” আনিস স্যার কোনোরকমে বললো।
-“আরে প্রিন্সিপালের কক্ষে যাওয়ার জন্যই এসেছি। তারআগে আপনি কি বলছিলেন তার উত্তর নেবেন না? তো আপনি বললেন ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ায় ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন। এর আগে কি আপনি ওকে বুঝিয়ে বলেছেন? যে তুমি ক্লাসে কেন অমনোযোগী হচ্ছো? এতে তোমারই রেজাল্ট খারাপ হবে, ইত্যাদি এগুলো কি তাকে বুঝিয়েছেন? কেনো অমনোযোগী সেটা কি আপনি ওকে জিজ্ঞেস করেছেন? উত্তর চাই। কি হলো চুপ করে কেনো আছেন? জানি করেন নি। আর এখানে কেউ চিৎকার করছে না যে ক্লাসের ভেতর শব্দগুলো যাবে আর অন্যদের ডিস্টার্ব হবে। আপনি দরজার সামনে এসে হালকা কথার আওয়াজ পেয়েছেন। তাই আর কোন কিছু বিচার বিবেচনা না করে মেয়েটিকে ঝাড়লেন। এটা কি আদৌও সঠিক? আর গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর এগুলো কোন ধরনের কথা? আর কলেজে কেউ চেহারা দেখাতে আসে না। এটা জ্ঞান অর্জনের জায়গা। আর একজন ভদ্র ঘরের মেয়েকে আপনি চেহারা দেখাতে আসে বলে কি ইঙ্গিত করছেন? আপনি হয়তো ততটা ভেবে বলেন নি। কিন্তু ওদের ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়বে। আর আপনি নিজে টিচার হয়ে একজন ছাত্রীকে বলছেন সে যেনো আর কলেজে না আসে কেনো?” এরপর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে এই তোমার রোল কত?
-” চার।” তুলতুলের খারাপ লাগছে এখন এগুলো শুনতে। তার স্যার যেমনই হোক না কেনো কেউ তাকে কথা শুনাচ্ছে তার জন্য এটা তার মোটেও ভালো লাগছে না। সে এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাফসানের চোখ রাঙানি দেখে আর সাহস হয়নি।
-” তো চার রোল যার তাকে আপনি বলছেন ফেল করবে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না? যার রোল চার সে হয়তো প্রতিদিন ক্লাসে অমনোযোগী থাকে না। তো আজকে যখন অমনোযোগী ছিল আপনার তো এর কারনটা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। তাকে বুঝানো দরকার ছিল আর যেনো এমন না করে। আমি অনেক খারাপ মানুষ। ন্যায় অন্যায়ের ধার ধারি না। কিন্তু এই পড়ালেখার ব্যাপারে অন্যায় হলে কাউকে ছাড় দেই না। আপনি শিক্ষক মানুষ। আপনাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু তা না করে আরো উল্টো পাল্টা কথা বলছেন যাতে আপনার কথা শুনেই তারা পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমি আজ প্রথম দেখছি না। আপনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আর কোনো শিক্ষক এর ব্যাপারে তো পাইনি। তারা দায়িত্ব নিয়ে সঠিক ভাবে পালন করে। তো আজকে সব হিসাব হয়ে যাক কি বলেন? চলুন প্রিন্সিপালের কক্ষে।” রাফসান মুচকি হেসে বললো। আর এদিকে আনিস স্যারের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আজকে তার খবর আছে।
তুলতুল এখনো বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন ক্লাসে গেলে সবাই অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবে। যেহেতু আনিস স্যারের ক্লাস শেষ হয়নি তাই ভয়ে কেউ বের হবে না। রাফসান আর আনিস স্যার প্রিন্সিপালের রুমে গিয়েছে। ওখানে কি হচ্ছে কে জানে? তার চিন্তা হচ্ছে। তুলতুল দেখলো প্রান্ত কলেজে বাইক নিয়ে ঢুকছে। হঠাৎ প্রান্ত কেন কলেজে আসলো। তুলতুল এগিয়ে যায়। প্রান্তর কাছে গিয়ে বলে
-“ভাইয়া তুমি এখানে কি হয়েছে?”
-” তুলু ব্যাগ নিয়ে আয়। আজকে আর ক্লাস করতে হবে না। আমি তোদের ক্লাস টিচার কে বলে দিয়েছি। আগে যা পড়ে বলছি।” প্রান্ত বলে। তুলতুল দৌড়ে গিয়ে ক্লাস থেকে ব্যাগ নিয়ে আসে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। ও এসে বাইকে ওঠে প্রান্তকে বলে কি হয়েছে?
-” চাচী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। প্রেশার লো ছিল অনেক। এখন ঠিক আছে। ডাক্তার দেখিয়েছিল। তুই চিন্তা করিস না।” প্রান্ত আর কিছু বলার আগেই বাইক থামিয়ে ফেলে। তুলতুল সামনে তাকায়। দেখে অনেক গুলো লোক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে অনেক গুলো গাড়ি রাখা। তুলতুল এভাবে এদের দেখে অবাক হলো যে তাদের পথ আঁটকিয়েছে কেন এরা? ওদের দলের একজন বললো
-” বস এটাই রাফসান। আমি কলেজে এই মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। এখন আমাদের আসার খবর শুনে ভয়ে বাইক নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে।”
তুলতুল অবাক হয়ে প্রান্তর দিকে তাকালো। দেখে রাফসানের মতো সাদা শার্ট পড়ে আছে। হেলমেটের সামনে গ্লাস কালো হওয়ায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। এতে ওরা প্রান্তকে রাফসান ভাবছে। প্রান্ত হেলমেট খুলতে যায়
চলবে….