#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ চল্লিশ
মনের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা, অবিশ্বাস নিয়ে তুলতুল টলতে টলতে বাড়ির ভেতর ঢোকে। সোফায় তিয়াস বসে আছে ল্যাপটপ নিয়ে, তাওহীও পাশে বসে আছে। তুলতুলকে এমন বিধস্ত অবস্থায় দেখে তিয়াস ওঠে তুলতুলের কাঁধে হাত দিয়ে বলে
-” তুলু কি হয়েছে? কান্না করছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?” তুলতুল তিয়াসের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলে
-” না কিছু হয়নি।”
-” তাহলে তুই কান্না করছিস কেন?”
-” ওই একটু মাথা ব্যাথা করছিল। কিছুক্ষন ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। আমি রুমে যাচ্ছি।” বলে তুলতুল আর কিছু না শুনে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। আর তিয়াস চিন্তায় পরে যায়। এমনিতেও তার মাথায় কম চিন্তা ঘুরছে না। রাফসান আর তুলতুলের সম্পর্ক নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। এজন্য সে দুইদিন চুপ করে ভেবেছে যে কোনটা তুলতুলের জন্য ভালো হবে। রাফসান কি আসলেই সঠিক তুলতুলের জন্য নাকি তার উচিত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে দুজনের সম্পর্কের লাগাম টেনে ধরা! কোনোটাই সে ঠিক করতে পারছে না। আর এখন তুলতুলকে এই অবস্থায় দেখে তার মোটেও ভালো লাগছে না। তুলতুল যে তাকে সত্যি বলে নি সেটা সে নিশ্চিত। তাহলে কি সে রাফসানের কারনে না অন্য কারনে কাঁদছে? যদি রাফসানের জন্য তুলতুলের এমন অবস্থা হয় তো রাফসানকে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। তিয়াস চিন্তিত ভাবে তুলতুলের রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে সোফায় বসে। নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।
তুলতুল রুমে ঢুকে বারান্দার দরজা ঘেঁষে বসে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ওঠে। তার জীবনে কি এমনটা না হলে হতো না? কেন বারবার সে এত আঘাত পায়? ক্লান্ত সে, প্রচুর ক্লান্ত। বুকের ভেতর অসহনীয়, অবর্ণনীয় ব্যাথা করছে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার! নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে গলাটা কেউ চেপে ধরে রেখেছে। একদিকে তার বোনের মৃত্যু রহস্য আরেকদিকে তার ভালোবাসার মানুষ। মানুষটাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে, অপরাধ বোধ হচ্ছে। লোকটিকেই তো তার বোন নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতো। কেন রাফসান এমন করলো! সে তো তার বোনকে অনেক ভালোবাসতো। তার বোন নিজের প্রত্যেক টা অনুভূতির কথা তাকে বলতো। সেই একই অনুভূতি একই মানুষের প্রতি সে নিজের ভেতর কিভাবে লালন করবে? ওই মানুষটার ভরসায়ই তো সেদিন বিকালে কাউকে না বলে তার বোনকে একা যেতে দিয়েছিল। বোনের অনুভূতি শুনে মানুষটা সম্পর্কে শুনে কখনো মনে হয়নি যে সে কখনো ঠকাতে পারে! না দেখে, না জেনে ওমন একটা অচেনা মানুষকে সে বিশ্বাস করেছিল তার বোনের ভালোবাসা, অনুভূতি আর ভরসা দেখে। ভেবেছিল হয়তো তার বোন ভালো থাকবে, হয়তো সঠিক লোককেই পেয়েছে জীবনে! কিন্তু সেই বিশ্বাসের বিনিময়ে কি পেলো? তার বোনের লাশ! সে মূহুর্তে তার নিজেরও মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কেন সে না জেনে অচেনা অজানা মানুষের সাথে তার বোনকে যেতে দিয়েছে কারো অনুমতি না নিয়ে? কেন সে আটকায়নি? অপরাধ বোধে ভোগে সে এখনো। আর আজতো আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। যায় জন্য সবকিছু হয়েছে তাকেই সে নিজের মনে প্রানে ভালোবেসেছে। সব থেকে বড় কথা মানুষটা তার বোনের ভালোবাসা ছিল। সে কিভাবে তাকে ভালোবাসতে পারে? এটা কি অন্যায় না? এটা জেনেও যে তার বোনের মৃত্যুর কারন ওই লোকটা! কেন এমন হলো তার সাথে? কে দিবে এই প্রশ্নের উত্তর তাকে? অবশ্য তার নিজেরও কম দোষ না। কেন সেদিন সে তিয়াসাকে যেতে দিয়েছিল! কেন অচেনা কাউকেই বিশ্বাস করেছিল! আর কেন বা সে রাফসানের সামনে পরেছিল! কেন তাকেই ভালোবেসেছিল! ভুল সব ভুল! ভুল করেছে সে, সব তার দোষ। তুলতুল ডুকরে কেঁদে উঠে। নাহ শান্তি পাচ্ছে না সে। সব কিছুই অসহ্য লাগছে, যন্ত্রণাময় লাগছে। মাথা ভেতর মনে হয় তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বা কিছু সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলছে তার চিন্তা, ভাবনা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। তুলতুল মাথা চেপে ধরে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর উঠে ঝাপসা চোখে ড্রয়ার থেকে তিয়াসার ছবি বের করলো। সেটা নিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ছবিতে তিয়াসা আর তুলতুল রয়েছে। তুলতুল দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে আর তিয়াসা পেছনে তার মাথার সাথে মুখ লাগিয়ে তুলতুলের গাল একটা হাত দিয়ে টেনে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ছবিটা দেখে তুলতুলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তিয়াসা আর তুলতুলের ভেতর সবসময় ভালো বন্ডিং ছিল। একে অন্যের কথা দুজই শেয়ার করতো। তেমনি তিয়াসা তুলতুলকে আগলেও রাখতো। তুলতুল কোন কিছু বললে তা সাথে সাথে গ্রান্টেড হয়ে যেত। তিয়াসা তুলতুলকে নিজের ভালোবাসা সম্পর্কে সবই বলেছে। কিন্তু কখনো তার সাথে পরিচয় করায় নি। কারন রাফসানের জীবন সম্পর্কে সে জানতো। এটাও জানতো রাফসানের আশেপাশে যারা থাকবে তাদের নিজের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই কখনো চাইলেও তুলতুলকে রাফসানের সাথে পরিচয় করায় নি। কখন কার না কার চোখে পড়ে যাবে আর তার বোনের ক্ষতি করে দিবে। তিয়াসা কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবতো না তাই রাফসানের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পরেও জীবন নিয়ে ততটা ভয় পেত না। কিন্তু নিজের পরিবারের ওপর আচ আসে এমন কোন কাজ কখনো করতো না। তুলতুলকে সে রাফসানের কথা বলেছে কিন্তু কখনো তার পুরো নাম বলেনি। তিয়াসা রাফসানকে রাফু বলেই ডাকতো, তুলতুলকেও সে সেটাই বলেছে। তাই তুলতুলের সামনে রাফসান থাকা সত্ত্বেও সে বুঝতে পারে নি। তুলতুল একমনে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
-” আপুরে বলনা আমি এবার কি করবো? কেন এমন হলো? আর কেনই বা তুই চলে গেলি? তুই থাকলে এমন কিছুই হতো না। আর আমিও রাফসানকে ভালোবাসতাম না। তাকে কখনো পাবো না আমি জানি। পরিবারের কেউ জানলে কখনো মেনে নেবে না আমাদের সম্পর্ক। আর না আমি মেনে নিতে পারছি। নিজেকে অপরাধী লাগছে। মনে হচ্ছে সব আমার জন্য হয়েছে। সেদিন তোকে যেতে না দিলে কখনো এমন হতো না। আমার মনে হচ্ছে আমি তোর কাছ থেকে তোর ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিয়েছি। রাফসানের মন থেকে তোকে সরিয়ে নিজে অস্তিত্ব গেড়েছি তার মনের ভেতর তাই মনে হচ্ছে। কি করবো আমি এখন? লোকটাকে ভুলে যাবো? কিন্তু কিভাবে? আমার যে একথা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। তাকে আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মন বলছে সে তোর মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি আপনাকে ভালোবাসি! বিশ্বাস করি আপনাকে! আমি জানি আপনি আপুকে কিছু করেননি। কিন্তু পারছি না। আমার মন চাইলেও মস্তিষ্ক তা মানতে পারছে না। মস্তিষ্ক মনটাকে বড্ড স্বার্থপর বলছে। কিন্তু কি করবো? পারছি না মনকে মানাতে। এতে যে তোর প্রতি অন্যায় করা হবে। আপুরে বলনা আমি কি করবো। কথা বলছিস না কেন? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আর মনে হয় তার সাথে আমার দেখা হবে না। শেষ করে দিয়েছি যে সব আমি। আপুরে তুই কেন আমার পাশে নেই?” বলে তুলতুল আবার অঝোরে কান্না করতে লাগলো। একসময় সেভাবে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে।
.
ঘরের ভেতর সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। আয়না ভেঙে চারপাশে কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভয়ংকর অবস্থা রুমের ভেতর। রাফসান বেলকনিতে পড়ে আছে। সূর্যের আলো মুখের ওপর পড়েছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায় সে। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থেকে উঠে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে রোদের তাপ বাড়ছে। তাই মনে হচ্ছে রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে নিজের মাথা চেপে ধরে, ভার হয়ে আছে। মাথা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্লোরে একভাবে অনেকসময় শুয়ে থাকার কারনে পিঠ, ঘাড়, বাহু ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। সে কিছুক্ষন বসে থেকে উঠে রুমের ভেতর যায়। রুমের ভেতর এমন লন্ডভন্ড দেখে তার কালকে কথা মনে পড়ে যায়। মূহুর্তেই রাগ মাথায় চড়ে বসে। সবকিছু ডিঙিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। মাথা ঠান্ডা করা দরকার তার। কালকে তুলতুল চলে যাওয়ার পর সে আর রুম থেকে বের হয়নি। রাগ হচ্ছিল কেন মেয়েটা তাকে বিশ্বাস করলো না? তার ভালোবাসার প্রতি কি একটুও ভরসা নেই? সে বলার পরও বিশ্বাস করলো না। একদিকে রাগ অন্যদিকে তুলতুলকে হারানোর ভয়, তুলতুলের ভুল বোঝা তাকে ঘিরে ধরে। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হয় কি করবে ভাবতে ভাবতে। আর না পেরে রাগের চোটে রুমের সবকিছু ভেঙে ফেলে, চিৎকার করে। সাউন্ডপ্রুফ রুম হওয়ায় রুমের বাইরে আওয়াজ যায় না। অশান্তি নিয়েই সে কড়া ডোজের অ্যালকোহল নেয়। কিন্তু কিছুতেই শান্ত পায় না। তারপরও থেমে না থেকে বিয়ার, হুইস্কি, ওয়াইন এনে মিশিয়ে একেরপর এক গিলতে থাকে। একপর্যায়ে আর না পেরে ওভাবেই পড়ে থাকে অশারের মত। কিন্তু জ্ঞান হারায় না। মাথার ভেতর ভনভন করছে তার, আশেপাশের কোন অনুভূতিই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মাথার ভেতর সবকিছু ফাঁকা লাগে। শূন্যতা বিরাজ করে তার ভেতর। চোখ দুটো সিলিং এর দিকে আবদ্ধ। শান্তি লাগছে এখন তার, কোনকিছু অনুভব করার শক্তি ধীর গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। হার্ট বিট হচ্ছে খুব ধীরে। এর থেকেও ভালো হতো যদি সারাজীবনের জন্য তার হৃদপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে যেত। রাফসান মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে। বন্ধ চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। দিন পেরিয়ে রাত হয়, রাত পেরিয়ে সকাল হয় সে ওভাবেই পড়ে থাকে।
রাফসান শাওয়ার নিয়ে বের হয়। নেভি ব্লু রঙের শার্ট গায়ে জড়িয়ে হাতের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে নেয়। কাল ভাঙচুর করার সময় হাতে লেগে হাত কেটে গিয়েছে। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ আসছে। রাফসান উঠে দরজা খুলে দেয়। আবির রুমের ভেতর ঢুকে জিনিসপত্র ফ্লোরে এভাবে ভেঙেচুরে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। সে রাফসানকে জিজ্ঞেস করে
-” ভাই কি হয়েছে সব ঠিক আছে তো? মানে রুমের এমন অবস্থা কেন?”
-” কাজের লোককে এগুলো পরিষ্কার করতে বল। আর সবকিছু রিসেট কর। আমি আসছি।” বলে ওয়াচ হাতে পরতে পরতে সে রুমের বাইরে চলে যায়। আর আবির দ্রুত বাইরে এসে বলে
-” ভাই এমন সময় কোথায় যাচ্ছেন? কোন কাজ তো নেই। ব্রেকফাস্ট করে যান।”
-” যাচ্ছি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে। খাওয়ার সময় নেই। যা বললাম তাই কর।” বলে রাফসান বের হয়ে যায়। গাড়ির সিটে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে। আজ তার গাড়ি চালানোর ইচ্ছা নেই একদম। রাফসান কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। জীবনটা তার এলোমেলো, বড্ড এলোমেলো। গোছাতে গোছাতে ক্লান্ত সে। এবার তো তার পাশে নিজের কাছের মানুষকে চাই, একটা ভরসার হাত চাই, যে সকল পরিস্থিতিতে তার পাশে থাকবে, তার শক্তি হবে। ক্লান্তির সময়ে কাউকে চাই, জীবনে চলার পথে কাউকে খুব করে চাই যাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবে, যার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে হবে। আর সেই একজন মানুষ হচ্ছে তুলতুল। যাকে নিয়ে সে বাঁচতে চায় এই নশ্বর পৃথিবীতে। আর সবার মতো প্রিয় মানুষকে নিয়ে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। বাচার মতো করে বাঁচতে চায়। কিন্তু আদৌও কি তার ইচ্ছে পূরণ হবে? তুলতুল কি কখনো তাকে মেনে নিবে? সব অনিশ্চয়তা, দ্বিধা তাকে ঘিরে ধরে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতীতের স্মৃতি গুলো তাকে তাড়া করছে। সিটে গা এলিয়ে তার অতীত নিয়ে ভাবতে থাকে।
তিয়াসার আর তার সম্পর্কটা স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়। তিয়াসাকে রাফসান দেখেছিল ক্লান্ত কোন এক সন্ধ্যা বেলা। কিছু লোকজনকে পিটিয়ে তার লোকের হাতে লাঠি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে সে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে গাড়ির দিকে এগোতে গিয়ে থমকে যায়। কিছুটা সামনে এক রমনীর মুগ্ধ দৃষ্টি নিজের ওপর দেখে সেই মুগ্ধ দৃষ্টির চোখে আঁটকে যায়। বুকের ভেতর অকারণেই কেঁপে ওঠে। রাফসান বোঝে না কেন তার বুক কাঁপছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। কই কোন মানুষকে মারার সময় তো তার এমন ভাবে বুক কাঁপে না, হৃদপিণ্ড ধুকপুক করে না। এইতো কিছুক্ষণ আগেও তো কতগুলো মেরে আসলো সাহসিকতার সাথে। কই তখন তো তার এমন কিছুই মনে হয়নি তাহলে এখন হচ্ছে কেন? সে মেয়েটির চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার দিকে আগায়। এতে বুঝি মেয়েটির হুঁশ আসে। রাফসানকে একনজরে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে লজ্জা পায়। দ্রুত চোখ নামিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আর রাফসান সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতের ঘুম উবে যায় তার সেই চোখের চাহনির কারনে। আবিরকে খোঁজ করতে বলে মেয়েটির সম্পর্কে। ছেলের এই উদাসীনতা রাফসানের মা টের পায়। রাফসানকে জিজ্ঞেস করলে সে তার মাকে বলে দেয়। আবির মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজ এনে দেয়। মেয়েটির নাম তাহিয়াতুল তিয়াসা, সে সময়ের বড় দলের লিডার তিয়াসের বোন। বাবা বিজনেস ম্যান! মেয়েটি তাদের ভার্সিটিতে পড়ে।
রাফসানের মনে ভালোবাসা জন্ম নেয়। যেন মেয়েটি তাকে না চাইতেও ভালোবাসতে বাধ্য করে। রাফসান তিয়াসার দিকে নজর রাখতো, সে সামনে থাকলে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। তাও যেনো তাকিয়ে থাকতে সে ক্লান্তি বোধ করতো না। কিন্তু সবকিছুই তিয়াসার অগোচরে। তিয়াসা যখন তখন রাফসানের আশেপাশে থাকতো, লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতো, আবার চোখে চোখ পড়ে গেলে লজ্জায় সরে পরতো। রাফসান তা দেখে মুচকি হাসতো। কখনো তার কাছে ধরা দিত না। সেও জানতো তিয়াসা তাকে ভালোবাসতো। এভাবেই চলছিল ভালো কিন্তু কিছুদিন সে তিয়াসার মুখ মলিন দেখতো, চোখ ছলছল করে তার দিকে তাকাতো, মুখ বেদনার ছাপ। রাফসানের বুকের ভেতর ধক করে উঠে। সে ঠিক করে পরেরদিনই তিয়াসাকে জিজ্ঞেস করবে এই লুকোচুরি খেলা আর খেলবে না। কিন্তু পরেরদিন তিয়াসার দেখা পায় না সে। নিজেকে বুঝ দেয় চলে আসবে। কিন্তু যখন সপ্তাহ পার হয়ে যায় তিয়াসার দেখা পায় না তখন সে পাগল হয়ে যায়। ঘুম, খাওয়া দাওয়া সব বাদ দিয়ে শুধু তিয়াসাকে দেখার অপেক্ষা করে। সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও তিয়াসার একটু খবর পায় না। সে জানে তিয়াসা তার বাড়ি তে নেই। তিয়াসও ভার্সিটিতে আসতো না বেশি। সে এতে আরো বেশি উন্মাদের মতো হয়ে যায়। দিন পনেরো পরে তিয়াসা ভার্সিটিতে আসে। তখনই সে টেনে নিয়ে তাকে মনের কথা বলে। সেদিন থেকেই শুরু হয় তার আর তিয়াসার সম্পর্ক। একসাথে পথচলা শুরু হয় তাদের। সময়গুলো কেটে যেতে লাগে। তিয়াসা ছিল শান্ত প্রকৃতির, বুদ্ধিমতী ও ম্যাচুয়ার। সে খুব ভেবচিন্তে কাজ করতো। শুধু রাফসানের ব্যাপারটায় নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। আর সে চায়ও নি নিয়ন্ত্রণ করতে। তিয়াসা তার ছোট বোন তুলতুলকে ছাড়া আর কাউকে রাফসান সম্পর্কে বলেনি। কারন সে সময় তার বিয়ে বা সম্পর্ক এসব কিছুই মেনে নিত না তার পরিবার। কেবল অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো। আর তিয়াসও সে সময় রগচটা স্বভাবের ছিল। তাই তিয়াসা আর কাউকে বলেনি। তিয়াসা আর রাফসানের সম্পর্ক ভালোভাবেই চলছিল। রাফসানের মায়ের পর যদি আর কেউ তাকে বুঝতো সে হলো তিয়াসা। তার ব্যাপারে সবকিছুই জানতো, তাকে ভারসা দিত। এরপর থেকে রাফসান আস্তে আস্তে দলবল বাড়ায় আগে এসবের সাথে বেশি সংযুক্ত ছিল না সে কিন্তু সেসময় সে একদম পাকাপোক্ত ভাবে গ্যাংস্টার হতে চায়। আর বাবা প্রভাবশালী লোক হওয়ায় বেশি কষ্ট করতে হয় না। এতে আস্তে আস্তে তার শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রাফসান তা পাত্তা দিত না। রাফসানের এক বিকালের কথা মনে পড়ে। সে আর তিয়াসা তখন একটা খোলা জায়গায় হাঁটছিল। রাফসান তিয়াসার হাত ধরে ছিল। সে হঠাৎই তিয়াসাকে প্রশ্ন করে বসে
-” আচ্ছা তোমার কখনো ভয় করে না আমাকে নিয়ে? এই যে আমি এমন মারপিট করে থাকি মাঝে মাঝে দেখা যায় প্রয়োজন পড়লে খুনও করি। এতে তো আমার শত্রুর শেষ নেই। এসবের কারনে যদি আমাকে হারিয়ে ফেলো বা আমার সাথে সম্পর্ক করার জন্য যদি কেউ তোমার ক্ষতি করতে যায় তখন?” তিয়াসা রাফসানের কথায় মুচকি হাসে।
-” রাফু ভালোবাসায় ভয় থাকতে নেই। ভয় পেলে ভালোবাসা যায় না। আমি ভয় পাই না এমন নয় পাই তবে তা কখনো আমার ভালোবাসার উর্ধ্বে নয়। ভালোবাসলে ভয়কে জয় করতে হয়। আর আমি কি জানি না যে তুমি এসবে সাথে জড়িত? সব জেনে তারপরই তো তোমাকে ভালোবেসেছি তাইনা! তাহলে একথা বলছো কেন? আর আমার নিজের ভাই এসবের সাথে যুক্ত তো আমি ভয় কেন পাবো? নিজেকে প্রটেক্ট করতে আমি জানি তাই নিজের সম্পর্কে ততটা ভয় হয়না, আর তোমার কথা বলছো তোমাকে আমি বিশ্বাস করি আমি জানি আমার রাফু তিয়াসার ভালোবাসার মানুষেকে যত্নে রাখবে। সে সব প্রতিকূল অবস্থায় মানিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া তুমি তো কাউকে ইচ্ছে মতো মারছো না। যারা অন্যায় করে শুধু তাদেরকে শাস্তি দেও। আমার ক্ষতি হবে দেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও অন্যায়কারীকে ছেড়ে দেবে তা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার পাশে থাকবো। আর যদি নাও থাকি তাহলেও কখনো ভেঙে পড়বে না। নিজেকে সব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিবে। আর আমার পরিবারের একটু খেয়াল রাখবে বেশি না। বিশেষ করে তুলুকে একটু বেশিই আবেগী ও তাই। ” রাফসান একথা শুনে রাগ করে বলে
-” ধুর আমি কি বললাম আর সে কি বললো! ভালোলাগে না কিন্তু। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা একদম ভাববে না। যেতে দেবো না কোথাও।” জবাবে তিয়াসা মুচকি হেসে রাফসানের হাত জড়িয়ে ধরেছিল। আরো কতশত ভালোবাসার স্মৃতি রয়েছে, কত মান অভিমানের স্মৃতি রয়েছে। যা রাফসানের মনের কোণে বন্দি করা। রাফসান আর তিয়াসার সম্পর্কের একবছর পেরিয়ে যায় এভাবেই। রাফসানের জন্মদিনের দিন তিয়াসা রাফসানের সাথে কোন কথা না বলে শুধু বের হতে বলে বিকেলে। সেদিন বিকেলে তিয়াসা একটা লাল রঙের শাড়ি পড়ে এসেছিল। সাজগোজ ছিল হালকা। রাফসানের প্রিয় রং ছিল লাল। রাফসান হা করে ছিল তিয়াসার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিন সে তিয়াসাকে নিয়ে হাত ধরে কোন গন্তব্য ছাড়া হেঁটেছে, তার সাথে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ফুচকা খেয়েছে। ক্ষুনসুটি ময় ঝড়গা করেছে। একে অপরের চোখের চাহনিতে যত না বলা কথা বলেছে। রাফসানের কাছে ততক্ষন পযন্ত সেটা সবথেকে আনন্দের দিন ছিল। যে তার জন্মদিনে প্রিয় মানুষটাকে এভাবে পেয়েছে। সন্ধ্যার একটু আগে তারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। কারন রাফসান দুপুরে কিছুই খায়নি শুধু ফুচকা খেয়ে কতক্ষণ থাকবে তাই তিয়াসা জোর করে তাকে নিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টটা রাফসানের ছিল। কিন্তু রাফসান প্রিয় মানুষের সাথে থাকায় আর সে খুব খুশি থাকায় আশেপাশের কিছুই খেয়াল করেনি। দুজন লোক যে তাদেরকে ফলো করছিল তা সে ঘুর্নাক্ষরেও টের পায়নি। খাওয়া শেষে তিয়াসা রাফসানকে বলে মুচকি হেসে
-” গিফট চাই?”
-” আজকে এমনিতেও অনেক পেয়েছি। আরেকটু পেলে ক্ষতি নেই। ” তিয়াসা রাফসানের কথায় উঠে তার হাত ধরে বলে
-“তাহলে মশাই চলুন।” রাফসান সেদিন বাইক নিয়ে এসেছিল। রাফসান তিয়াসাকে নিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে। আশেপাশে তখন মৃদু অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাতাসে তিয়াসা শাড়ির আঁচল একটু উড়ছিল। সে রাফসানের পিঠে মাথা রেখে সেই স্নিগ্ধ সন্ধ্যা দেখছিল। এমন এক সন্ধ্যায় তো রাফসানকে দেখেছিল সে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে রাফসান হঠাৎ বাইক থামানোতে। সে রাফসানকে জিজ্ঞেস করার আগেই সামনে চোখ যায়। সামনে অনেকগুলো গাড়ি রাখা। সেখানে কতগুলো লোক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি ভালো না দেখে রাফসান আবিরকে ফোন দেয়। তারপর বাইক ঘুরিয়ে চলে যেতে নেয় কিন্তু পারে না। লোকগুলো বাইকের চাকায় গুলি করে আর তিয়াসার বাম হাতের বাহুতে গুলি করে। রাফসান তৎক্ষনাৎ বাইক থামিয়ে তিয়াসার হাত নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। রক্ত ধরছিল প্রচুর। আর তা দেখে লোকগুলো বিশ্রী হাসে। রাফসান ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বলে
-” ভালো চাস তে এখান থেকে কেটে পড়। সেটা তোদের জন্য ভালো হবে।
সেখান থেকে এক লোক বলে ওঠে
-” আরে মামু আমাগো ভালো আমরা দেইখা নিমুনে। আগের তোমারটা ভালোটা দেখি।” বলে তিয়াসার দিকে বিশ্রী ভাবে তাকায়। তিয়াসা শাড়ির আঁচল টেনে নিজেকে ঢেকে নেয়। আর রাফসানের মাথা খারাপ হয়ে যায় সে রিভলবার বের করে লোকটার দিকে গুলি ছোড়ে। মূহুর্তেই শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে পার। কিন্তু রাফসান এতোগুলো লোকের সাথে একা পারে না। এরা আটঘাট বেঁধেই রাফসানের ক্ষতি করতে এসেছে। রাফসান প্রানপন চেষ্টা করে। রাফসান যখন ওদের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত তখন একজন তিয়াসার মাথায় রিভলবার ধরে। আর রাফসানকে বলে
-” এই শালা হাতের থেকে ওটা ফেল। একটু নড়বি তো তোর জানের মাথার এপাশ থেকে ওপাশে গুলি চলে যাবে। রাফসান থেমে যায়। লোকটি হেসে বলে
-” তুই আর তিয়াস সেই বাড় বেড়েছিস। এটাতো তিয়াসের বোন তাইনা? ঐ শালাও মজা বুঝবে। বলে তিয়াসার শাঠির আঁচলে হাত দিতে যায়। কিন্তু তিয়াসা লোকটা পেছনে পায়ে লাথি দিয়ে তাকে ঝুকিয়ে থাপ্পড় মারে।
-” সাহস কি করে হয় তোর আমার গায়ে হাত দেওয়ার?” তিয়াসা বলে। রাফসান তিয়াসাকে বলে
-” মিনি তুমি পালাও এখান থেকে। আমার কিছু হবে না।” কিন্তু তিয়াসা কথা শোনে না। সে রাফসানকে রেখে কোথাও যাবে না। হঠাৎ করেই ওরা রাফসানের কাঁধে গুলি করে। রাফসান কাঁধে হাত দিয়ে বসে পড়ে। পরপর তিনটা গুলি তাকে করে। তার কাছে কোন অস্ত নেই যে আক্রমণ করবে। আর তিয়াসা আর্তনাদ করে উঠে। কিন্তু রাফসানের কাছে যেতে পারে না। তার আগেই তাকে ধরে ফেলে। ওরা আশেপাশে তেলের ড্রামে আগুন লাগিয়েছে। তিয়াসা চিৎকার করে কিন্তু কোন লাভ হয় না। রাফসানকে ওই অবস্থায় তারা লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। একসময় যখন তাকে মারা বন্ধ করে তখন তাদের কাছে রাফসান বলে তিয়াসাকে যেন তারা ছেড়ে দেয়। ও তো তাদের কোন ক্ষতি করে নি। কিন্তু তারা শোনে না। তিয়াসাকে তারা ছাড়ে না। রাফসানকে তারা আরো আঘাত করে। রাফসান দূর্বল, অসহায় হয়ে পড়ে। এরভেতরই তারা রাফসানের হাত পা বেঁধে ফেলেছে। একটা লোক তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে। তিয়াসা তাকে ধাক্কা দিয়ে একটা লাথি মারে। রাফসান শুধু দূর্বল ভাবে তাকিয়ে দেখছে চোখ মেলে মারের জন্য কথা বলার মতো অবস্থায়ও সে নেই। তিয়াসার আর্তনাদ গুলো তার কানে আসছে। বুকের ভেতর ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অথচ কিছু করতে পারছে না।ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তিয়াসা ছুটে গিয়ে একটা রিভলবার হাতে কয়েকজনকে শুট করে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারে না। তার বুকে এসে একটা গুলি লাগে। রাফসান গুঙিয়ে আর্তনাদ করে উঠে। সে মিনতি করে তাদের কাছে যেন তিয়াসাকে আর কিছু না করে। কিন্তু তারা ছাড়ে না তিয়াসাকে। পরপর কয়েকটা গুলি করে তাকে। রাফসানের পিঠে গুলি করে। আর তিয়াসাকে রক্তাক্ত অবস্থায় তেলের ড্রামের দিকে ধাক্কা দেয়। তিয়াসা রাফসানকে অস্ফুট স্বরে একটা ডাক দেয়। সেই কন্ঠ শুনে রাফসানের তখন মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। রাফসান অসহায়ত্ব, ব্যাথা যন্ত্রনা, প্রিয় জনকে হারানোর কষ্ট নিয়ে মাটিতে পড়ে থেকে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। সে পারেনি তার মিনিকে তার ভালোবাসা কে বাঁচাতে। অসহায় অবস্থায় শুধু চোখ মেলে দেখেছিল। তিয়াসাকে গুলি করার সাথে সাথেই সে থমকে গিয়েছিল। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তার পৃথিবী। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। তারপর আর কিছুই তার মনে নেই।
ড্রাইভারের ডাকে রাফসান স্মৃতির পাতা থেকে বের হয়ে আসে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে সামনে তাকায়। তুলতুলের বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে।
চলবে…