মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৩৯

#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ঊনচল্লিশ

রাফসান উদ্ভ্রান্তের মতো হসপিটালে পৌঁছালো। এতক্ষণ সে থম মেরে রোবটের মতো ছিল। তুলতুলও তার সাথে এসেছে। রাফসান এসে আবিরকে দাঁড়ানো পায়। সে আবিরের কাঁধে হাত দিয়ে অস্থির হয়ে বলে

-” আবির দাদী কোথায়? কেমন আছে এখন? আমি দাদীকে দেখবো?”

-” ভাই শান্ত হোন। দাদীকে অটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” আবিরের কন্ঠ ভেজা। বোঝা যাচ্ছে সে কান্না করেছে। এখন রাফসানেরও চোখ ভিজে আসছে। সে থিয়েটারের কাঁচের দিকে এগিয়ে সেখানে চোখ রাখলো। ডাক্তারদের জন্য তার দাদীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। রাফসানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সবকিছুই তো তার শেষ হয়ে গেছে এবার কি তার একমাত্র আপনজন, আশ্রয়স্থল ও হারিয়ে ফেলবে? দাদীই যে তাকে ভরসা দেবার একমাত্র মানুষ। তাকে যদি হারিয়ে ফেলে তো রাফসান এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে। আপনজন বলে আর তার কেউ থাকবে না, থাকবে না আগলে রাখার মতো কেউ। কিভাবে বাঁচবে সে? এই চারবছরে আপনজনদের ছাড়াই ছিল। কেউ ছিল না তার, তারপরেও মনকে শান্তনা দিতে পারতো যে সে একবারেই একা নয়, আপনজনহীন নয়, তার দাদী তো আছে। কিন্তু এখন? দাদীকে হারানোর কথা ভাবলেও বুক কাঁপে। রাফসান ধীর পায়ে এসে হাসপাতালের করিডোরের বেঞ্চটাতে এসে বসে মাথা নিচু করে দু’হাতে মুখ লুকালো। তুলতুলেরও কান্না আসছে, কিন্তু সে কান্না করতে পারছে না। সেও যদি কান্না করে তো রাফসান আরো ভেঙে পড়বে। রাফসানের দাদীকে তুলতুল নিজের দাদীর মতোই ভাবতো। এ দুইমাসে তার কাছে গিয়ে তার সাথে কত গল্প করেছে, তাকে জ্বালিয়েছে, ফোনে প্রতিনিয়ত কথা বলেছে, আলাদা একটা মায়া জন্মে গিয়েছে মানুষটির প্রতি। তুলতুল নিজের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেলে রাফসানের দিকে এগিয়ে গেলো। রাফসানের কাঁধে হাত দিতেই রাফসান তাকে জড়িয়ে ধরলো।

-” তুলতুল! দাদীকে ঠিক হয়ে যাবে তো? বলোনা? আমার দাদী আবার আমার সাথে কথা বলবে তো? আবার আমাকে বকবে, শ্বাসন করবে তো?” তুলতুল বুঝতে পারছে রাফসান কাঁদছে। সে কখনো রাফসানকে কাঁদতে দেখে নি। কখনো মাথায় আসে নি যে এই শক্তপোক্ত মানুষটাও এভাবে কাঁদতে পারে। সে এমনিতেও কারো কান্না দেখতে পারে না, তাতে তার নিজেরও কান্না পায়। এখন রাফসানকে কান্না করতে দেখে সে নিজে নিঃশব্দে কান্না চোখের পানি ফেলে রাফসানের মাথায় হাত দিয়ে বলে

-” আপনি ভয় পাবেন না, দাদী ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ! দেখুন কান্না বন্ধ করুন আপনি কান্না করেছেন তার জন্য, এটা শুনলে দাদী রাগ করবে। তাই কান্না অফ করুন।” কিন্তু রাফসান কিছু না বলে তুলতুলকে ধরে বসে রইল। তুলতুলও আর কিছু বললো না। কিছু সময় নীরবতাই শ্রেয়। আধাঘন্টা পরে ডাক্তার বের হয়ে এলো অটি থেকে। জিজ্ঞেস করলো পেশেন্টের বাড়ির লোক কোথায়? রাফসান ধড়ফড় করে উঠে ডাক্তারের সামনে গিয়ে বলে

-” দাদী? আমার দাদী ঠিক আছে তো? তার কিছু হলে কিন্তু আমি সবাইকে শেষ করে দেবো!”

-” রিলাক্স মিস্টার! আপনার দাদী ঠিক আছে। এক্সিডেন্টে ওনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন কিছুটা, আর ব্লাডলস হয়েছে অনেকটা। ব্লাড দেওয়া হয়েছে। আট ঘন্টার ভেতর জ্ঞান ফিরে আসবে। চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু মেন্টালি কোন প্রেশার ক্রিয়েট করবেন না। এটা ওনার জন্য ঝুকিপূর্ণ হতে পারে। কিছুক্ষণ পরে ওনাকে কেবিনে দেওয়া হবে। ধন্যবাদ!” বলে ডক্টর মুচকি হাসলো। রাফসানের ওপর থেকে যেনো অনেক বড় পাথর নেমে গেলো। কিন্তু চিন্তা যায়নি এখনো।

-” থ্যাঙ্কিউ! থ্যাঙ্কিউ ভেরি মাচ…” রাফসান আরো কিছু বলতো কিন্তু ডক্টর তাকে কিছু না বলে মুচকি হেসে বললো

-” ধন্যবাদ দিতে হবে না মিস্টার। এটা আমাদের দায়িত্ব। টেক কেয়ার ওকে?” বলে ডক্টর রাফসানের কাঁধে হাত দিয়ে চলে গেলো। আর রাফসান জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তুলতুলের দিকে এগিয়ে গেলো।
.

রাফসান তার দাদীর হাত ধরে বসে আছে। তার জ্ঞান ফিরেছে৷ কিন্তু রাফসান কোন কথা না বলে হাত ধরে চুপ করে হাতের সাথে মাথা ঠেকিয়ে আছে। তা দেখে রাফসানের দাদী বললো

-” তুই এমন কইরা আছোস ক্যান? কানতাছিস, নাকি? ওই মাথা উঠা মাইয়া মানষের মতো কানতে বইছে।”

-” উফফ! দাদী, কোথায় কান্না করছি?”

-” তাইলে চুপ কইরা আছোস ক্যান? ভয় পাইছিস যে আমি মইরা যাবো? এত তাড়াতাড়ি তোরে রাইখা যাইতাছি না। অনেক কিছু দেখার বাকি আছে এহনো। আল্লাহ যেনো আমারে সেই পন্ত বাঁচায় রাখে।”

-” আমিন! বুড়ি হয়েছে কথা বাদ দাও। এমনি অসুস্থ তারওপর বকবক করছো। এখন একটু চুপ থাকো।” রাফসানের দাদী কথা বলতে গেলে রাফসান আবার চুপ করতে বলে। আর তার দাদী রাগী ভাবে তাকিয়ে চুপ করে রইল। রাফসান তুলতুলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তুলতুল জেদ করছিল এখানে থাকবে বলে কিন্তু সে ধমক দিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই সকালে বের হয়েছে মেয়েটা, বেশি দেরি হলে হয়তো তার বাড়ির লোক টেনশন করবে। আর হসপিটালেও তুলতুলকে রাখতে চাইছিল না রাফসান। তুলতুল কেমন যেনো করছিল। তাই তাকে সে আবিরের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। আটঘন্টা শুধু শুধু এখানে থাকা তো কম কথা না।

.

তিয়াস পেছন থেকে গিয়ে ছেলেটির হাত থেকে দিয়ার হাত ছাড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। পেছনে ছেলেটি হাবার মতো দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আর দিয়া চেচাচ্ছে

-” আরে সমস্যা কি আপনার? এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? কি হয়েছে? উফফ কথা বলছেন না কেন শুনি?”

-” আমার হবু বউ হয়ে অন্য ছেলেদের হাত ধরতে লজ্জা করে না? কত সাহস তোর! একদম শেষ করে দেব আজকে। আমি মানা করিনি তোকে সেদিন যে কোন ছেলের সাথে মিশবি না?” তিয়াস টেনে দিয়াকে বাইকের সামনে দাঁড় করায়। ধমক দিয়ে বাইকে উঠতে বলে। দিয়া মুখ কালো করে বাইকে উঠে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে

-” শিমুল ভাইয়া আপনি বাড়ি চলে যান। আমি পরে চলে যাবো..” দিয়া কথা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই তিয়াস বাইক জোরে টান দেয়। আর দিয়া ভয় পেয়ে তিয়াসকে শক্ত করে ধরে চেচিয়ে বলে

-” সমস্যা কি আপনার? তখন থেকে পাগলের মতো করছেন কেন? আরেকটু হলে আমি পড়েই যেতাম!”

-” ভালোই হতো। বেয়াদব মেয়ে! তুই আবার কথা বলছিলি ছেলেটার সাথে? কেন?”

-” আজব তো! কথা বলবোনা কেন? উনি আমার বোনের দেবর হয়। আমি উল্টো পাল্টা বিহেভ করলে নিশ্চয়ই আমার বোনকে কথা শুনতে হবে। আর আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম বলে সে আমার হাত ধরেছিল। আপনি কি না কি ভেবে টেনে নিয়ে আসলেন হবু বউ হবু বউ করতে করতে। বিরক্তিকর!” দিয়া বিরক্ত হয়ে বললো। আর তিয়াস দাঁত কিড়মিড় করে বললো

-” তুই পড়ে গেলে ওই ছেলের কি? ও কেন তোর হাত ধরবে? আমি পেছনে ছিলাম না? আমিকি তোর পড়ে যাওয়া দেখে না ধরে খিকখিক করে হাসতাম? তাহলে ঐ ছেলে কেন তোকে ধরবে?”

-” সে কি এতটা ভেবেছে নাকি? একটা মানুষ পড়ে যাচ্ছে তাই…. ওয়েট ওয়েট আপনি কি জেলাস ফিল করছেন? ওয়াও!” বলে দিয়া মুখ হা করে তিয়াসের দিকে তাকালো। আর তিয়াস কথার পিঠে কথা বলে উঠে

-” অফকোর্স আম জেলাস! আমার বউকে আমার সামনে… তিয়াস আর বললো না লুকিং মিররে দিয়ার মিটমিট করে হাসি দেখে। সে চোখ রাঙিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বললো

-” মেজাজ খারাপ করবি না কিন্তু! আমি হাসার মতো কি বলেছি?” দিয়া এতে জোরে হেসে দিয়ে পেছন থেকে তিয়াসের থুতনিতে হাত দিয়ে মিররে তাকিয়ে বলে

-” ব্যাপার কি তিয়াস মশাই? প্রথমে তো আমাকে দেখতেই চাইতেন না। আর এখন দুইদিনের ভেতরে বিয়ে করে নিতে চাইছেন, আবার কারো সাথে দেখলেও জেলাস ফিল করছেন। কিন্তু কেন? ভালোটালো আবার বাসলেন নাকি?” দিয়ার কথায় তিয়াস তার থুঁতনি থেকে দিয়ার হাত সরিয়ে বলে

-” আর একটা কথা বলবি তো তোকে আমি দেখে নেব! আর দূরে সরে বস, একদম ঘেঁষে বসবি না।” তিয়াসের কথায় দিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তিয়াসের থেকে দূরে না সরে আরো বকবক করতে লাগলো। আর তিয়াস চোখ মুখ কুঁচকে বাইক চালাতে লাগলো।

দিয়ার হাত ধরে তিয়াস আস্তে আস্তে হাঁটছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিছু চিন্তা করছে। কিন্তু দিয়া তিয়াসের মুখ দেখে বুঝতে পারছে না তিয়াস কি ভাবছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে একটা বট গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। এরিয়া টা পার্কের মতো। আশেপাশে ফুল আর নানারকম গাছের সমাহার। পাশে ছোট একটা লেক, কিছু কাপল লেকের পাড়ে বসে আছে। আশেপাশে বাদাম, বুট, ফুচকা ওয়ালা রয়েছে। তারা যে বট গাছের নিচে আছে সেটার চারপাশে সিমেন্ট দিয়ে গোল করে বসার জায়গা করা। সবমিলিয়ে পরিবেশটা মোটামুটি ভালোই লাগলো দিয়ার। দিয়া তিয়াসকে বসতে বলে কিন্তু তিয়াস বসবে না দেখে দিয়াও বসলো না। সে তিয়াসের পাশে এসে দাঁড়ালো। নীরবে আশপাশ দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিয়াস দিয়ার দিকে তাকালো। তারপর গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করলো

-” রাফসান আর তুলতুলের সম্পর্কের ব্যাপারে তুই জানতি তাইনা?” দিয়া চমকে তিয়াসের দিকে তাকালো। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সে চোখে ভয় স্পষ্ট। এমন সময় তিয়াস এই প্রশ্ন করতে পারে দিয়া তা চিন্তা করে নি। তার থেকেও বড় কথা তিয়াস জানলো কিভাবে? সে কি তুলতুলকে রাফসানের সাথে দেখেছে নাকি তুলতুল নিজে বলেছে? নাকি অন্য কারো কাছ থেকে শুনেছে? দিয়া কি উত্তর দিবে এখন? তিয়াসকি মেনে নিবে ওদের সম্পর্ক?আর এভাবে কেন তার জানার কথা বলছে? দিয়ার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ভয়ে মনে হয় এখনি সে হার্ট ফেল করবে। দিয়ার নিশ্চুপ থাকাতে তিয়াস বললো

-” তাহলে জানতি তুই ওদের ব্যাপারে। গুড, ভেরি গুড!”

-” আসলে তেমন কিছু না…

-” তেমন কিছু না তো কি? বল আমাকে আমি ভুল বলছি? বল! রাফসান আর তুলুর মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। আমি যা ভাবছি সব মিথ্যা। কিরে চুপ করে আছিস কেন? এই তাকা আমার দিকে। আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি কিনা? হুম?”

-” সত্যি ” দিয়া মিনমিন করে বললো। এখন যদি সে মিথ্যা বলে অন্য কিছু বোঝাতে যায় তাহলে হিটে বিপরীত হবে। তুলতুল আর রাফসান ঝামেলায় পড়তে পারে। এর থেকে সত্যি বলাই শ্রেয়। ভালো যখন দুজনে বাসতে পেরেছে তো সব পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে পারবে। আর যদি না পারে তো বুঝতে হবে সেখানে কখনো ভালোবাসা ছিল না। দিয়া জোরে একটা শ্বাস নিয়ে তিয়াসের হাত ধরে বললো

-” আপনি প্লিজ ওদের কিছু বলবেন না৷ তুলতুল আপনাকে নিজে থেকেই বলতো। প্লিজ ওদের ভেতর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। রাফসান ভালো না হলেও একেবারেই খারাপ না। সে তুলতুলকে অনেক ভালোবাসে। আমি দেখেছি, আপনি ভরসা করতে পারেন। রাফসান তুলতুলকে আগলে রাখবে।” দিয়া ঠান্ডা স্বরে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু তিয়াসের দিকে তাকিয়ে তার ভয় হচ্ছে। তিয়াস চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে আছে।

-” শুধু ভালোবাসলেই হয় না দিয়া। তাকে নিরাপত্তাও দিতে হয়। রাফসানের নিজের জীবনেরই কোন নিরাপত্তা নেই তাহলে আমার বোনকে কিভাবে নিরাপত্তা দেবে? কিভাবে আগলে রাখবে?”

-” আপনি আগের কথা চিন্তা করুন। রাফসান তো অনেক বার তুলতুলকে বাঁচিয়েছে। যেখানে কেউ খোঁজ দিতে পারে নি সেখানে রাফসান তাকে খুঁজে বের করেছে। তাহলে কেন এটা ভাবছেন যে সে তুলতুলকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।” দিয়া নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তিয়াসকে বোঝানো। কিন্তু তিয়াস মনে হয় তার কথা বুঝতে চাইছে না।

-” দিয়া দুইদিন দেখে সেই ভরসায় আমি আমার বোনকে রাফসানের হাতে সারাজীবনের জন্য তুলে দিতে পারি না। এই ভেবে যে সত্যি তুলতুলের কিছু হবে না। সে নিরাপদে থাকবে। তার পেছনে এমনিতেও কম শত্রু নেই। আবার রাফসানের সাথে থাকলে কি হবে বুঝছিস? তুই আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানিস দিয়া। এখন তুই যদি এখানে আমার আর তোর সম্পর্কের কথা বলিস যে, কেন আমি তোকে নিজের জীবনে জড়িয়েছি? তাহলে বললো যে, আমি আমার পুরনো জীবনে পুরোপুরি ফিরে যায় নি। যেটুকু গিয়েছি তা নিজের পরিবারের স্বার্থে। তাছাড়া কেউ আমাকে এখন চেনে না। তিয়াস বলে কেউ যে ফিরে এসেছে বা তার যে কোন অস্তিত্ব আছে তা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। আর এই কয়েকজন থেকে তোকে আর পরিবারকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমাকে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। তারা তোদেরকে কখনো ছুতেও পারবে না। কিন্তু রাফসান? তাকে সবাই এখন এক নামে চেনে। শত্রুর শেষ নেই। জানা, অজানা, সামনাসামনি এমনকি গোপনেও অনেকজন আছে যারা রাফসানের অনিষ্ট চায়। আর রাফসানকে পরাস্ত করতে হলে তার পরিবারের দিকে নিশ্চয়ই মানুষ হাত বাড়াবে। আর এই অনিশ্চয়তার ভেতর আমি আমার বোনকে ঠেলে দিতে পারি না৷ বুঝেছিস? এই ব্যাপারে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।” দিয়া তিয়াসকে বোঝানোর জন্য তার হাত ধরে কিছু বলতে চায় কিন্তু তিয়াস তার হাত সরিয়ে তাকে আসতে বলে সে চলে যায়।

.

একদিন পর তুলতুল রাফসানের বাড়িতে যায়। রাফসানই তাকে নিয়ে এসেছে। তুলতুল পাগল হয়ে গিয়েছে দাদীর সাথে দেখা করার জন্য। সে কেমন আছে? কিভাবে হয়েছে? কে করেছে? প্রশ্ন করে রাফসানের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। তাই সে আজকে নিয়ে এসেছে তুলতুলকে। তুলতুল গাড়ি থেকে নেমে কিছু না বলে দৌড় দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকে। রাফসান তুলতুলের দূরন্তপনা দেখে হাসে। তুলতুল সোজা গিয়ে রোমানা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে। তিনি খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল। তুলতুলকে এভাবে জাপ্টে ধরতে দেখে সে হেসে ফেলে। মেয়েটা এ কয়দিনে তার মনে জায়গা করে নিয়েছে।

-” কিরে দাদুমনি কেমন আছিস?”

-” এতক্ষণ ভালো ছিলাম না এখন ভালো আছি। তোমার অসভ্য নাতি আমাকে তোমার কাছে নিয়েই আসছিল না।” তুলতুল রোমানা চৌধুরীর পাশে বসে বলে।

-” বাহ, বাহ, কি সুন্দর! আমার দাদীর কাছে আমার বদনাম করা হচ্ছে?” রাফসান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে। শুনে তুলতুল ভেংচি কাটে। রোমানা চৌধুরী রাফসানকে বলে

-” বদনাম না সত্যি কথা বলতেছে। মেয়েটা আমারে দেখতে চাইছে আর তুই ওরে আনোস নাই ক্যান?”

-” ও তাই? সব দোষ এখন আমার তাইনা? তোমার ইনি যে রাত্রি বেলা বায়না ধরেছে তো রাত্রি বেলা তাকে এখানে এনে তার পরিবারকে কি জবাব দিতাম? তোমরা দুজন তো শুধু আমার দোষই খুঁজে পাও। ধুরর! বলে রাফসান হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।” তা দেখে তুলতুল আর রোমানা চৌধুরী মুচকি হাসে।

-” দাদী আপনি ঠিক আছেন তো এখন?”

-” হুম একদম ভালা আছি। আবির আর রাফসানের মতো নাতি আর তোর মতোন নাতবউ পাইয়া কেমনে খারাপ থাকি?” রোমানা চৌধুরীর কথায় তুলতুল লাজুক হাসলো। আরো কিছুক্ষন রোমানা চৌধুরীর সাথে তুলতুল গল্প করলো। তারপর রোমানা চৌধুরী তুলতুলকে বলে

-” দেখোতো রাফসান্নায় কই আছে। রাগ কইরা তো চইলা গেলো। যাও রাগ ভাঙায়া আসো।” দাদীর কথায় তুলতুল একটু লজ্জা পেল। তারপরও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

-” দাদী আপনি বেশি হাঁটাচলা করতে যেয়েন না। সাবধানে থাকবেন কিন্তু।” তুলতুল বলে। রোমানা চৌধুরী মুচকি হাসে। তুলতুল বের হয়ে এসে রাফসানের রুমের দিকে যায়। রাফসানের রুমে ঢুকে তুলতুল রাফসানকে পায় না। ওয়াশরুম আছে হয়তো। তুলতুল রাফসানের রুম ঘুরে ঘুরে দেখে। এরআগেও একদিন রাফসান তাকে তার রুমে নিয়ে এসে দেখিয়েছিল। পুরো রুম শুভ্রতায় ঘেরা। রুমের সবকিছুই হোয়াইট কালারের। রুমের মাঝখানে বেড, তারপাশে একটা বক্স টেবিল, তারওপরে ল্যাম্পসেড আর কিছু ফটোফ্রেম রাখা যা উল্টে রাখা। বেডের ওপরের দেয়ালে রাফসানের বড় করে বাঁধানো ছবি রয়েছে, রুমের ডানপাশে জানালা রয়েছে যেখান দিয়ে দিনের আলো আর বাতাস প্রবেশ করছে। তাছাড়া সোফা, কাবার্ড, বড় ডিজাইনিং মিরর, টিভি রয়েছে রুমটাতে। আরো কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। তুলতুল থাই গ্লাস সরিয়ে বেলকনিতে যায়। বেলকনিটা বেশি ভালো লাগে তুলতুলের। এখানে দাঁড়িয়ে সামনের বিশাল এরিয়া, বাগান, রাস্তা চোখে পড়ে। বেলকনিতেও কিছু ফুলের গাছ, বসার দোলনা রয়েছে। তুলতুল ফুলগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে রুমে চলে এসে বিছানায় বসে। তার চোখ যায় টেবিলে রাখা ফটোফ্রেম টার ওপরে। এটা কেন উল্টো করে রাখা? সে কৌতুহলী হয় ছবিতে কে আছে জানার। কিন্তু কারো জিনিস এভাবে দেখা ঠিক নয়।

তুলতুল দেখবে কি দেখবে না এই নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে। কিন্তু কৌতুহলের জন্য সে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ছবিটা দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। তুলতুল হাত বাড়িয়ে ছবিটা হাতে নেয় তারপর ছবি ঘুরাতেই যেন তার দুনিয়া থমকে যায়। সে কি সত্যি দেখছে এটা? তিয়াসার আর রাফসানের হাসি মুখের একটা ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। রাফসানের কাঁধে মাথা রেখে তার বাহু ধরে তিয়াসা বসে আছে, আর রাফসান তার দিকে তাকিয়ে আছে। তুলতুলের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। রাফসান কে, তাকে কেন বাঁচাতো, তার চেহারা কেন দেখতে চাইতো না, কেন তাকে সামনে আসতে মানা করতো সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। সে হুঁশ জ্ঞান হীন ভাবে স্তব্ধ হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে তার মাথায় একটু একটু করে সত্যিটা ধাক্কা দেয়। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে তার। সবই কি ধোঁকা ছিল? সবকিছুই? এরভেতরই রাফসান ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল হাতে বের হয়। তুলতুলের দিকে নজর পড়ে নি এখনো। সে টাওয়ালটা রাখার পরে বিছানায় বসা বিধস্ত তুলতুলের ওপর নজর যায়। রাফসান চমকে যায়। একটু আগেও তো মেয়েটা হাসছিল এই একটু সময়ের ভেতর কি হলো যে এখন কান্না করছে? সে তুলতুলের দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু তুলতুলের হাতে ফটোফ্রেম দেখে চমকে যায়। সাথে ঘাবড়েও যায়। এজন্যই মেয়েটা কাঁদছে। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলতুলের হাত থেকে ছবিটা সরিয়ে তুলতুলের মুখে হাত দিয়ে অস্থির হয়ে বলে

-” তুলতুল তুমি যা ভাবছো তা সত্যি নয়। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু…”

-” কিন্তু কি মিস্টার রাফসান? কেন এমন করলেন আপনি? কেন?” তুলতুল রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে আর্তনাদ করে বলে। চোখ দিয়ে তো অনবরত পানি পড়ছে। সাথে তার কন্ঠে ফুটে উঠেছে বেদনা। রাফসান তুলতুলের কাছে গিয়ে তাকে ধরে বলে

-” আমাকে বলতে দাও। বিশ্বাস করো আমি..

তুলতুল আবারও রাফসানকে ধাক্কা দেয়। তারপর তাকে ঝাঁকিয়ে বলে

-” বিশ্বাস করতে বলছেন? এটা দেখার পরও বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে? আপুর সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল কেন বলেন নি আমাকে? কেন ধোঁকা দিয়েছেন? কি করেছিল সে? আর কেনই বা আমাকে নিজের সাথে জড়ালেন?”

-” তুলতুল আমি কাউকে ধোঁকা দেই নি। আর তোমাকে আমি কোন প্লান করে জড়াইনি। ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় আমি।” রাফসান তুলতুলকে বোঝাতে চাইছে কিন্তু তুলতুল বুঝতে চাইছে না। তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে সে চিৎকার করে বলে

-” সত্যি ধোঁকা দেননি? তাহলে কেন সেদিন আপু ফিরে আসে নি? আপনার সাথেই তো গিয়েছিলো তাই না? তাহলে কেন লাশ হয়ে ফিরে এলো? কেন মেরে ফেলেছেন আমার আপুকে? কি করেছিল সে? পাগলের মতো আপনাকে ভালোবাসতো তাহলে কেন তার ওরকম পরিণতি হলো? কেন? তারপর আমাকে জড়িয়েছেন নিজের জীবনে। এজন্যই আমার ব্যাপারে সবকিছু জানেন আপনি তাইনা? প্রথম দিকে দেখতে পারতেন না আমাকে দেখে আপনার অন্যায়ের কথা মনে পড়তো, আর এরপরে আপনি অন্য প্লান শুরু করে দিয়েছেন না? আপুকে নিয়ে যে খেলা খেলেছেন আমাকে নিয়েও সেই খেলা খেলতে চাইছেন তাইনা? এজন্যই আমাকে নিজের প্রতি দূর্বল করতে বাঁচাতে যেতেন? ভালো বিহেব করতেন? ব্যাস আপনার সাফাই আমি শুনতে চাচ্ছি না।” তারপর তুলতুল আবার ভেঙে পড়ে সে কান্না করতে করতে বলে

-” ভালোবাসি বলেছিলেন তাইনা? কেন বলেছিলেন? কেন আমাকে আপনার প্রতি এতো দূর্বল করলেন? কি এমন করেছিল আমি আর আমার পরিবার যে আপনি আমাদের জীবনটা শেষ করে দিলেন? কিসের প্রতিশোধ নিচ্ছেন বলুন? আর আমিই কিনা আপু যাকে ভালোবাসতো তাকেই ভালোবেসেছি, আপুর খুনিকে ভালোবেসেছি? এরথেকে কি আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল না?” এতক্ষণ রাফসান কোন কথা বলেনি বলেনি বলতে তুলতুল তাকে বলতেও দেয়নি আর শুনতেও চায়নি। কিন্তু একথার পর সে চুপ করে থাকতে পারে না।

-” তুলতুল ভালোভাবে কথা বলো। এতক্ষণ যা নয় তাই বলেছো দেখে এটাও মেনে নেব তা নয়। তিয়াসাকে আমি ভালোবাসতাম, বাসি এবং ভবিষ্যতেও বাসবো। তাকে আমি খুন করিনি। আর তোমার কথা বলছো? তোমাকেও আমি ভালোবাসি, মানুষের মনে দুজনের জন্য ভালোবাসা থাকতে পারে। তিয়াসা আমার অতীত, তাকে আমি কখনো ভুলতে পারবো না। কিন্তু এটাও সত্যি যে আমি তোমাকেও ততোটাই ভালোবাসি। এটা আমার কোন প্লান ছিল না, আর না আমি তোমাকে ফাঁসিয়েছি।” তুলতুলের গা, হাত-পা কাঁপছে। সে রাফসানের থেকে দূরে সরে বললো

-” আর কত মিথ্যা বলবেন? এতোকিছুর পর এখনো নাটক করছেন? ভালোবাসার দোহায় দিচ্ছিন এটা আপনার ভালোবাসা? আপনি জানতেন না কিছু? আপনি যদি আপুকে কিছু নাও করে থাকেন তারপরেও কিভাবে আমার সাথে জড়ালেন? ভাবলেন কিভাবে যে আপু যাকে ভালোবাসে তাকে আমি ভালোবাসবো? একটুও মনে হয়নি সত্যি জানলে আদৌও আমি আপনাকে মেনে নেব কিনা? নাকি সত্যি টাকে চাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন?”

-” তুলতুল তুমি..

-” ব্যাস! শেষ সব শেষ। আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, স্বপ্ন সব শেষ। আজকের পর থেকে আমার সামনে আসবেন না আপনি। বুঝেছেন? আপুর মৃত্যুর কারন ধোঁয়াশা ছিল আর আছে। কিন্তু আপনি যদি আপুকে মেরে থাকেন তার শাস্তি আপনি পাবেন। কিন্তু আমার সাথে আপনার সম্পর্ক এখানেই শেষ, এটাই শেষ দেখা আপনার সাথে আমার। কখনো আমার সামনে যাবেন না আপনি। যদি নির্দোষ ও হন তবুও যাবেন না। কারন আপনি আপুর ভালোবাসা, সেই ব্যক্তি আপনি যাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেছে হয়তো জীবটাও দিয়ে দিয়েছে। আপনাকে আমি ভালোবাসতে পারি না। একদম পারি না। তাহলে যে আপুর সাথে অন্যায় হবে।” তুলতুল কান্না করে সরে যেতে যতে বললো। রাফসান অপেক্ষায় ছিল তুলতুলের কথা শেষ হওয়ার যেন তাকে সবকিছু বোঝাতে পারে। সে তার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু তুলতুল চিৎকার করে উঠে দেখে থেমে যায়।

-” একদম আমার কাছে আসবেন না। তাহলে কিন্তু আমার নিখোঁজ হওয়ার কারনটাও আপনি হবেন। ” রাফসান থেমে যায় তুলতুলের কথায়। আর তুলতুল চোখ মুছে দৌড়ে রুমের বাইরে চলে যায়। রাফসান আটকাতে গিয়েও আটকাতে পাটে না। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাত মুঠ করে। চোখ দিয়ে তারও পানি পড়ছে।

চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here