#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ একচল্লিশ
রাফসান গাড়িতে বসে আছে। সে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। বাড়ির ভেতর যাবে কি না! কিন্তু আজ হোক কাল হোক তাকে তো সত্যিটা জানাতে হবে।
-” নাহিদ গাড়িটা একটু পেছনে নিয়ে দাড় করা।” রাফসান ড্রাইভারকে গাড়ি পেছাতে বলে।
-” ঠিকাছে ভাই। ”
রাফসান ড্রাইভারকে গাড়ি কিছুটা পেছাতে বলে। কারন আগে ভাবসাব বোঝা দরকার তারপর যাবে ভেতরে। গাড়ি পেছনে নিয়ে থামালে সে পেছনের সিটে গিয়ে সামনের সিটের ওপর দুপা উঠিয়ে সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোয়া নাক মুখ দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে সে তিয়াসার বলা কথা গুলো চিন্তা করে। তিয়াসা বলেছিল ‘ রাফু ভালোবাসায় ভয় থাকতে নেই। ভয় পেলে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসলে ভয়কে জয় করতে হয়। ‘ আসলেই কি সে ভয় পাচ্ছিল? নাহ সে ভয় পাচ্ছে না, একদম না। কিন্তু মনের ভেতর একটা খচখচানি রয়ে গেছে যে সবকিছু শোনার পর রিয়াকশন কেমন হবে! তুলতুল মানবে তো? পাবে তো তাকে রাফসান? নাহ সে কি ভাবছে এসব! পাওয়ার সাথে ভালোবাসার কোন সম্পর্ক নেই। তুলতুলকে পাওয়ার জন্য সে ভালোবাসেনি।এমন নয় যে তাকে পেলেই শুধু ভালোবাসবে না পেলে নয়। বরং না পেলেও সারাজীবন ভালোবাসবে। তাকে পাবে কি পাবে না এই হিসেব করে রাফসান ভালোবাসেনি। তাই এমন ভাবনা সে ভাবতে পারে না।
রাফসান নিজেও কখনো ভাবেনি সে তুলতুলকে ভালোবাসবে। তার জীবনে দ্বিতীয় বার আবার ভালোবাসা আসবে, এবং তাকে খুব ভালোবাসবে। উহুম ভাবেনি, একদমই ভাবে নি। তুলতুলের প্রতি তার যে ভালোবাসাটা জন্ম নিয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। সে নিজেও কখনো চায় নি এমন হোক। কিন্তু কিভাবে যেনো মনের ভেতর মেয়েটা ঢুকে সব অনুভূতি গুলো নিয়ে নিয়েছে। তুলতুলকে প্রথম যেদিন দেখেছে রাফসান তখনই তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কারন তুলতুলের চোখ দুটো তার বড্ড পরিচিত। তুলতুলের চোখগুলো একদম তিয়াসার মতোই। মুখের আদলটাও হালকা আসে। কিন্তু গায়ের রংটার জন্যই পার্থক্য বোঝা যায়। রাফসান গাড়ি থেকেই কিছুক্ষণ তুলতুলের ওই চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর যখন ঘোরে চলে যাচ্ছিল তখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার কে না কে তার সাথে সে তিয়াসার চোখের মিল পাচ্ছে। তাই সেদিন রেগে তুলতুলের গলায় রিভলবার চেপে ধরে। কিন্তু পর মূহুর্তে তার মনে হয় মেয়েটার কি দোষ এখানে, তাই সে তুলতুলকে ছেড়ে দেয়। দেওয়ার আগে হুমকিও দেয় যেন তার সামনে না আসে। কিন্তু কি হয় এতে? কিছুই হয় না। তার সামনে আসা বারন থাকলেও সে চোখ বুঁজলেই তুলতুলের চোখ দুটো তার সামনে ভাসতো। তখন নিজের ওপরই রাগ হতো। দ্বিতীয়বার যখন দেখা হয় তার সাথে তখন তুলতুল তার গাড়ির কাচ ভাঙে। তখনই মনে হচ্ছিল মেরে দিক কিন্তু তার চেহারা দেখে আর পারে নি। সেদিন তাকে গুলিও করে। কিন্তু কেন যেন ফেলে যেতে পারেনি ওই অবস্থায় তাই আবিরকে হাসপাতালে দিয়ে আসতে বলেছিল। এও বলেছিল মেয়েটা যাতে তা না জানে।
সে যতই চাইতো তুলতুলকে এড়াতে ততই তুলতুল তার সামনে এসে পড়তো। কিন্তু তার মনে হঠাৎ করে একটু অনুভূতির জন্ম নেয় সেদিন থেকে, যেদিন সে আহত, ড্রিংকস করা অবস্থায় গাছের শিকড়ের ওপর পড়ে ছিল। আর তুলতুলকে মারতে চাওয়ার পরও তুলতুল ভয় নিয়েই তার পায়ের ক্ষত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। যতক্ষণ পাশে ছিল ততক্ষণ রাফসানের মনে হচ্ছিল তার পাশে আপন কেউ আছে। আর যখন সেই অন্ধকার রাতে মেয়েটি মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন তাকে একধরনের শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল। সে বুঝতে পারে তুলতুলের প্রতি না চাইতেও তার অনুভূতি তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। কারনে অকারনে মেয়েটার তার সামনে চলে আসতো। দোকানে তাকে দেখে ভয় পাওয়া, মাকড়সা দেখে তার হাত ধরে ঝুলে পড়া, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা, কাঁদো কাঁদো মুখ সব কিছু তাকে ভাবাতো। রাতে চোখ বুঁজলেই এসব ভেসে উঠতো তার চোখের সামনে। তার সাথে আরেকটা মুখ ভেসে উঠতো সেটা তিয়াসার চেহারা। দুজনের চেহারায় মিল রয়েছে কিছুটা আর চোখ দুটো প্রায়ই একরকম। তাই সে খোঁজ নেয় তুলতুলের সম্পর্কে। যখন জানতে পারে তুলতুল তিয়াসার বোন তখন যেনো তার মাথায় বাজ পড়ে। তার মনেই ছিল না তিয়াসার একটা ছোট বোন ছিল। তিয়াসা বেঁচে থাকতে তো তাকে বলেছিল তার বোনকে যেনো দেখে রাখে। অথচ সে কি করেছে? তাকে মৃত্যুর মুখেও ফেলেছিল। তার আর তিয়াসার ওপর যখন আক্রমণ হয় তখন সেখানেই তিয়াসার মৃত্যু হয় আর রাফসানের নিঃশ্বাস চলছিল তখনো। আবির এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর তিয়াসার লাশকে তার বাড়িতে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। রাফসান কোমায় ছিল তিনমাস। এরপর জ্ঞান ফিরলেও তার কথা বলা বা চলাফেরার শক্তি ছিল না। মানসিক ভাবেও অসুস্থ ছিল। সময় লোগে যায় তার সুস্থ হতে। যখন কিছুটা সুস্থ হয় তখন তিয়াসার বাড়ি যায় তখন বাড়িটা সিলগালা অবস্থায় পায়। তখন তার পাগলপ্রায় অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তিয়াসাকে হারিয়েছে কিন্তু সে তিয়াসার কথাও রাখতে পারেনি। চারবছর পর যখন পেয়েছেই তখন আগলে রাখা তো দূর খারাপ বিহেভ করেছে। এভাবেই চলছিল সবকিছু। তার হঠাৎ করেই একদিন তিয়াসার ডায়েরির কথা মনে হয়। তিয়াসা যে ডায়েরি লিখতো তা সে জানতো। সে ডায়েরি টি তিয়াসার চিহ্ন, অনুভূতি, ভালোলাগা হিসেবে তার কাছে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। যেহেতু তার কথা তুলতুল ছাড়া আর কেউ জানতো না তাই ডায়েরি তুলতুলের কাছেই থাকবে। কিন্তু তা নেবার কোন উপায় খুঁজে পায় না। পরে ভাবে লুকিয়েই যাবে। সে বারান্দার এক্সট্রা চাবি বানিয়ে তালা খুলে তুলতুলের রুমে প্রবেশ করে। রুমের সবজায়গা খুজে কিন্তু পায় না। তাছাড়া অন্ধকার থাকার কারনেও খুঁজতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু তুলতুলের ঘুমের ভেতর কথা বলায় তার খোঁজায় ব্যাঘাত ঘটে। দেখে তুলতুল ঘুমের ভেতর কাঁদছে। সে তার মাথার পাশে বসে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আনমনে হাত বুলায় তুলতুলের মাথায়। তারপর তুলতুল যখন ছটফট করছিল তখন তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বের হয়ে যায় দ্রুত। এরপরেও সে একদিন যায় ডায়েরির খোঁজে কিন্তু সেদিন তুলতুলের ঘুমন্ত মুখ দেখে আঁটকে গিয়েছিল। বাচ্চাদের মতো মুখ করে ঘুমিয়ে ছিল। চেহারা ছিল মায়া ভরা। সে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে চেয়ে ছিল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল। হার্ট বিট করছিল অস্বাভাবিক ভাবে। আবার সেই প্রথম বারের মতো অনুভূতি হচ্ছিল। সে তুলতুলের গালে হাত বুলায় সে কারনে তুলতুল জেগে যায়। সেদিন তুলতুলকে সে জাপ্টে ধরে রুমে দিয়ে কোনরকমে বের হয়েছিল। তুলতুলের মায়াবী চেহারা, ভয় নিয়ে কথা বলা, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা, ছলছল চোখ, কলেজ ড্রেস পরে কান ধরে লজ্জিত ভাবে এদিক ওদিক তাকানো, তার সাথে তর্ক করা, তুলতুলকে কোলে নেওয়া, তুলতুলের তাকানো সবকিছুকেই মনে হচ্ছিল সে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসছিল। কিন্তু বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারে যখন নাইম তুলতুলকে ক্লাস রুমে আটকে রাখার পর সে গিয়ে দেখে। তার সেই অবস্থা তাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল? কেন এমন হচ্ছিল? ভালোবাসতো তাই বুঝি! নিজের অনুভূতি বোঝার পর অপরাধ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু ততদিনে তার মনের ভেতর মেয়েটা এমন ভাবে গেঁড়ে বসেছে যে সে দূরে থাকতে পারে নি। আবার ভালোবেসেছে সে। ভয় ছিল শুধু সত্যি টা জানলে কি তুলতুল তাকে মেন নিবে! সে নিজেই বলতে চেয়েছিল তাতে বোঝাতে পারতো কিন্তু তার আগেই তুলতুল জেনে গিয়েছে। রাফসান চোখ বুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সিগারেট ফেলে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকে। যে মানুষগুলো জীবনে সবকিছু হারায়, তাদের জীবনে ভালোবাসা এলে তারা তাদের সবটা দিয়ে তা আগলে রাখে। রাফসানও তেমন তুলতুলকে আগলে রাখতে চায়। হারাতে চায় না। সে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তুলতুলের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজায়। আফসা বেগম দরজা খুলে দেয়। রাফসান তাকায় তার দিকে। তার একমেয়ে তার জন্যই হারিয়েছে আরেক মেয়েকে কি আর তার কাছে দিয়ে হারাতে চাইবে? আফসা বেগম রাফসানকে চিনতে না পেরে বলে
-” কে আপনি? কাকে চাচ্ছেন?”
-” আসসালামুআলাইকুম। আন্টি আমি রাফসান।” রাফসানের কথা শুনে আফসা বেগমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে বলে
-” বাবা ভেতরে আসো। দেখছো আমি চিনতেই পারি নি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তুমি এসেছো আমি খুশি হয়েছি।” তারপর সে এদিক ওদিক তাকিয়ে তিয়াসকে ডাক দেয়। রাফসান তার খুশি দেখে মলিন ভাবে হাসে এখন যতটা খুশি সত্যিটা জানার পরও কি এমন খুশি থাকবে? কখনোই না। তিয়াস এসে রাফসানকে দেখে অবাক হয় কিন্তু তা প্রকাশ করে না। রাফসানের আসার কারন ভাবতে থাকে। কাল তুলতুল কান্না করতে করতে এসেছে। আর আজ রাফসান তাদের বাড়িতে এসেছে। একটার সাথে আরেকটার কোন সম্পর্ক নেই তো? তারপরেও মুখে হাসি ফুটিয়ে সে রাফসানকে বলে
-” আরে রাফাসান নাকি? সে যে আমার বাড়িতে এসেছে তা তো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এসো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-” এই দেখো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বাবা বসতো।” আফসা বেগম বলে।
-” আন্টি আপনি ব্যস্ত হবেন না৷। আমি ঠিক আছি।” বলে রাফসান সোফায় বসে। তিয়াসও আরেকটা সোফায় বসে। রাফসান চারপাশে চোখ বুলায় এই আশায় যে তুলতুলকে একটু দেখতে পাবে কিন্তু সে আশাহত হয়। আফসা বেগম তুলতুলকে ডাক দেয়। কিন্তু তিয়াস বলে
-” মা ওকে ডেকো না। ভালো লাগছে না তাই ঘুমিয়েছে।” আর আফসা বেগম রান্না ঘরে চলে যায়। মেহমান এসেছে নাস্তা দিতে হবে। রাফসান তুলতুলকে যাও একটু দেখার আশা করছিল তাও ব্যর্থ হলো। তিয়াস রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে
-” তা রাফসান কি মনে করে হঠাৎ এতদিন পরে? আমার জানা মতে রাফসান কারো বাড়িতে দলবল ছাড়া যায় না। কিন্তু আজ একা দেখছি? কোন দরকার আছে নাকি?”
-” অনেকদিন তো বটেই, প্রায় চারবছর পরে। আর দরকার ছিল তাই এসেছি। কিছু বলার ছিল। আঙ্কেল কোথায়?” তিয়াস এটাই আশা করছিল যে রাফসান কিছু বলতে এসেছে। হয়তো তুলতুলের ব্যাপারে বলতে এসেছে। তাই তার বাবাকে খুঁজছে। তিয়াস হেসে বললো
-” বাবা রুমে আছে। চলে আসবে এখনি, কাজে যাবে।” রাফসান আর তিয়াস টুকটাক কথা বলতে লাগলো। কিন্তু রাফসানের মনে অন্য কিছু চলছে। কিছুক্ষণ পর আফসা বেগম নাস্তা দিয়ে গেলেন। তিনি তুলতুলকে বাচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা ও প্রকাশ করলেন। রাফসান তার সাথে হাসি মুখেই কথা বলেছে। কিছুক্ষণ পর তফিজ আহমেদ ড্রয়িং রুমে আসে। তাকে দেখে রাফসান সালাম দেয়। তফিজ আহমেদ রাফসানকে আগে থেকেই চিনতেন। তিনিও মেয়েকে বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানায়। তিনি তিয়াসের পাশে বসে বলে
-” হ্যাঁ বাবা কি বলবে বলো।”
-” জানিনা সত্যিটা জানার পর আপনারা কি রিয়াক্ট করবেন, কিন্তু সত্যি টা জানানো উচিত।” রাফসানের কথায় তফিজ আহমেদ আর তিয়াস চিন্তিত হয়ে যায়। কি এমন বলবে রাফসান? রাফসান বড় করে একটা শ্বাস নেয়। তারপর বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে তিয়াসার সাথে সম্পর্ক সবকিছু শুরু থেকে বলতে থাকে। এমনকি তুলতুলের সাথে দেখা হওয়ার পরবর্তী কাহিনিও বলে দেয়। সে যে তুলতুলকে ভালোবাসে আর তুলতুল যে তাকে ভালোবাসে সেটাও বলে। সবকিছুর জন্য রাফসান ক্ষমা চায়। রাফসান সব বলার পরে তফিজ আহমেদ আর তিয়াসের দিকে তাকায়। তারা পাথরের মতো বসে আছে। রান্নাঘরের সামনে আফসা বেগম পানির গ্লাস নিয়ে আসছিলেন এসব শুনতে শুনতে কখন তার হাতের গ্লাস পরে ভেঙে গেছে তা খেয়াল করে নি। চোখ দিয়ে তার পানি পড়ছে। তাদের দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা খুব বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। স্বাভাবিক এটা। তিয়াসার মৃত্যুর কারন জানার জন্য তারা কম চেষ্টা করে নি। তিয়াস সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে অপরাধী ভেবে। তাদের সংসার তছনছ হয়ে গিয়েছে ওই একটা মৃত্যুর কারনে। আর যার জন্য হয়েছে সে এতবছর পরে নিজে এসে বলছে তাই তারা শকট হয়েছে। তফিজ আহমেদ চোখের চশমা খুলে চোখের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। আর তিয়াসের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে হচ্ছে রাফসানকে এখন মেরে ফেলার। সে রেগে উঠে কিছু বলতে গেলেই তফিজ আহমেদ তাকে থামায়। তিয়াস হাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করছে। তফিজ আহমেদ নিজেকে সামলিয়ে শান্ত ভাবে রাফসানকে জিজ্ঞেস করে
-” তুলতুল জানে একথা?”
-” না পুরোটা জানে না। আমার কাছে তিয়াসার ছবি দেখে সে ভুল বুঝে কাল চলে এসেছে।”
-” স্বাভাবিক, সে তার বোনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর। তারপর আবার সে তোমাকে ভালোবাসে। ওকে বোঝানো এত সহজ হবে না।”
-” বাবা কি বলছো? কে বোঝাবে ওকে? আমি কখনোই এই মানুষটার হাতে আমার বোনকে তুলে দেবো না। একবোনকে হারিয়েছি আরেক বোনকে কিছুতেই হারাতে পারবো না। আজ থেকে ওর সাথে তুলতুলের দেখা হবে না। কোনদিনই হবে না। আমি হতে দেবো না।” তিয়াস বলে ওঠে সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তফিজ আহমেদ তিয়াসের কথার পিঠে কিছু না বলে রাফসানকে বলে
-” আমার যে এটা শুনে কষ্ট হচ্ছে না বা তোমার প্রতি একদমই রাগ হচ্ছে না এমন কিন্তু নয়। রাগ হচ্ছে প্রচুর রাগ হচ্ছে মনে হচ্ছে তোমাকে গিয়ে কষে দুইটা থাপড় মারি কিন্তু তা আমি করছি না। তুমি তিয়াসাকে খুন করো নি কিন্তু তুমিও প্রত্যক্ষ ভাবে দোষী না হলেও পরোক্ষভাবে দোষী। তিয়াসাকে হারিয়ে আমার পরিবারে সব শান্তি চলে গিয়েছে। ওই একটা জীবনই সবকিছু তছনছ করে চলে গেছে। কিন্তু দেখো তুমি আমার আরেক মেয়ের পেছনে পরেছ। ওর জীবনের কি নিশ্চয়তা আছে যে তোমার হাতে তুলে দিলে সে নিরাপদে থাকবে। পুরনো ঘটনা আবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে তোমার কাছে? একমেয়ে হারিয়ে তুলতুল এখন আমাদের সম্বল। ওর দিকে তাকিয়ে তিয়াসাকে হারানোর কষ্টটা একটু হলেও ভুলে যাই। তাকে আমি কোন বাছবিচার ছাড়া এমন কারো হাতে তুলে দিতে পারি না যার জন্য আমার বড় মেয়েকে হারিয়েছি। বলো, তুলতুলকে ভালোবাসো? তার জন্য কি করতে পারবে?” রাফসান এতক্ষণ মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনছিল কিন্তু একথায় মাথা তুলে তফিজ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলে
-” ভালোবাসি, তুলতুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওর জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো। মানুষ একভুল বারবার করে না। আপনারা যেমন মেয়ে, বোন হারিয়েছেন আমিও তেমন নিজের ভালোবাসা হারিয়েছি। তাকে নিজে চোখে তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছি। হারানোর যন্ত্রণা আমি চারবছর ধরে ভোগ করেছি। আর হারাতে চাই না। তার জন্য আমাকে যা করতে হয় করবো।” রাফসানের কথা শুনে তফিজ আহমেদ কিছু বলার আগেই তিয়াস উঠে রাফসানের কলার ধরে।
-” কি মনে করিস তুই নিজেকে? তুই মিষ্টি কথা বলবি আর আমরা সব কষ্ট ভুলে আমার বোনকে তোর হাতে তুলে দেবো? যাতে ওকেও হারিয়ে ফেলি তাই না? সেগুড়ে বালি। এটা আমি কখনো হতে দেবো না। তুলতুল তোকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না কিন্তু আজকের পর থেকে তুই আর তুলতুলের দেখা পাবিনা। যদি দেখা করার চেষ্টা করিস তো তোকে দেখে নেবো। চারচার টা বছর আমার বোনের মৃত্যুর কারন খুঁজেছি। পাইনি কোন কারন কেন মরতে হলো তাকে? রাগে অভিমানে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। এই তুই জানিস আমার পরিবারের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল? না জানিস না, তিয়াসাকে হারিয়ে পরিবারের কি অবস্থা হয়েছিল। এখন যখন সব কিছু ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করছে তাহলে তুই কেন এসে হানা দিয়েছিস? আর তুলতুল তিয়াসার বোন জেনেও কোন সাহসে ভালোবেসেছিস? ওকে তুই কখনো পাবি না। বুঝেছিস? যেভাবে এসেছিলি সেভাবেই বের হয়ে যা।”
রাফসান তার কলার থেকে তিয়াসের হাতটা সরায়। তার যে রাগ হচ্ছে না তা নয়। প্রচুর রাগ হচ্ছে কিন্তু তারপরও মুচকি হেসে তিয়াসকে বলে
-” মিস্টার তিয়াস আহমেদ! আমার ভবিষ্যৎ শালা সাহেব। আপনি বোধ হয় আমার সম্পর্কে খুব ভালো করে জানেন। আমি আগের রাফসান নই যে দয়ালু, বিনয়ী, পরোপকারী। এই রাফসানের সাথে আগের রাফসানের কোন মিল নেই। তুলতুলকে ভালো যখন বাসি তখন তাকে নিজের কাছে রাখতে আমার বেশি কিছু করা লাগবে না। শুধু আমি চাইনি যে তুলতুল কষ্ট পাক বা তার পরিবারের অমতে আমার কাছে থাকুক। তাই আপনাদেরকে সব জানিয়ে অনুমতি নিয়ে নিজের জীবনে তুলতুলকে আনতে চেয়েছি। তাই বলে এই না যে আপনারা যা খুশি তাই করবেন আর আমি মেনে নেব। রাফসান যা বলে তাই করে। আমিও দেখি কিভাবে আপনি আমার কাছ থেকে তুলতুলকে দূরে রাখেন। সরি আঙ্কেল আপনার সামনেই এমন রুড বিহেভ করার জন্য কিন্তু আমার কিছু করার নেই। শালা বাবু একদম বেশিই বলছিন। পারলে আমার থেকে তুলতুলকে আলাদা করে দেখবেন। সবকিছু একদম শেষ করে দেবো। তুলতুল মানুক আর না মানুক ও আমি ছাড়া অন্য কারো হবে না। কথাটা মাথায় রাখবেন। বায়, সময়মতো আমি তুলতুলকে নিজের করে নেবো। আর হ্যাঁ ওর নিরাপত্তা নিয়ে টেনশন করবেন না নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি ওকে রক্ষা করবো।” বলে রাফসান নিজের শার্টের কলার ঠিক করে।
তুলতুল এতক্ষণ বারান্দার দাঁড়িয়ে ছিল। কান্না করতে করতে তার অবস্থা খারাপ। রাফসান এসেছে সেটা তার কন্ঠ শুনেই বুঝেছে। তাই রুমের দরজা লাগিয়ে সে বারান্দায় চলে এসেছে। লোকটার কন্ঠ বেশিক্ষণ শুনলে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না। বেহায়া মন তাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে যাবে। তুলতুলের তিয়াসা হারিয়ে যাওয়ার পরেরদিন সকালের কথা মনে পড়ে। তিয়াসাকে খুঁজে না পেয়ে তার পরিবারের অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। তুলতুল সারারাত কেঁদেছে। সকালে তার মা তাকে এসে কয়েকটা থাপ্পড় মারে সাথে কথা শুনায় কেন সে তাদের অনুপস্থিতিতে তিয়াসাকে বের হতে দিয়েছে? কেন তাদের জানায় নি? তুলতুল শুনে বোবার মতো শুধু কান্না করে যায়। আফসা বেগম মেয়ে হারানোর ভয়ে রাগে তুলতুলের সাথে এমন ব্যবহার করে ফলে। তার মনে হচ্ছিল তখন রাগের মাথায় তুলতুল যদি আঁটকাতো এমন হতো না। তার অবস্থাও পাগলের মতো ছিল। সন্ধ্যার তিয়াসাকে পাওয়া যায়। কিন্তু তা তিয়াসার লাশ। তুলতুল তিয়াশাকে দেখার আগ পযন্ত চিৎকার করে কেঁদেছিল কিন্তু তিয়াসার লাশ দেখার পর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। তিয়াসার মুখের অর্ধেকাংশ পুরে গিয়েছিল। বুকে গুলির লেগেছিল। সারা শরীর ছিল রক্তাক্ত। তুলতুল জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সেদিন তা দেখে। তার বোনের সুন্দর মুখটা কি হয়েছিল সেদিন। বাড়ির সদস্যদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়, একদিকে তিয়াসা অন্যদিকে তুলতুল। পরিবার যেনো একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। তিয়াসার মৃত্যুর পরে তুলতুল মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারো সাথে কথা বলতো না,শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতো। একদিকে তিয়াসার মৃত্যু অন্যদিকে তুলতুলের অসুস্থতা পরিবারের সদস্যদের তখন কঠিন অবস্থা। তাওহী তখন দুবছরের মাত্র। তার জন্য আফসা বেগম নিজেকে কোনরকম স্বাভাবিক রেখেছিল। তফিজ আহমেদ এসব ঝামেলায় পড়ে ব্যাবসায়ের প্রতি সময় দিতে পারে না। তিয়াস তখন তিয়াসার মৃত্যুর কারন খুঁজতে ব্যস্ত। সে সময়ে ম্যানেজার বিশ্বাসঘাতকতা করে কোম্পানির দলিল, পাওয়ার অব এটর্নি নিজের নামে করে নেয়। এতে আস্তে আস্তে তাদের পরিবারে ধস নেমে আসে। আগের বাড়িটা লনের কারনে সিলগালা হয়ে যায়। তারা সবকিছু ছেড়ে বর্তমান বাড়িটায় ওঠে। কম কষ্ট করতে হয়নি তাদের। একটু একটু করে আবার সব গড়েছে। তুলতুলও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু রাফসান কে তা জানার পর বুঝি সব আবার এলোমেলো হয়ে যাবে। তুলতুল ভাবনায় বিভোর। এমন সময় গালে কারো স্পর্শ পায়।তুলতুল তাকিয়ে দেখে রাফসান। সে চলে আসতে যায় কিন্তু রাফসান তার হাত ধরে গ্রিলের সাথে লাগিয়ে মাথাটা হালকা চেপে ধরে তুলতুলের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
-” হায় বেবি!”
–
-” বাহ চেহারার তো খুব সুন্দর অবস্থা করেছো। চোখের নিচে কালি, চোখ মুখ ফোলা, লাল । বাহ সুন্দর লাগছে। পরেরবার আমি যদি এমন দেখি তো প্রথমে দুটো থাপ্পড় দিয়ে আদর করবো। যাইহোক সুন্দরী, আমার হওয়ার জন্য তৈরি থেকো। বায়, সুইটহার্ট!” বলে তুলতুলের গালে হাত বুলিয়ে গাল টেনে রাফসান চলে যায়। আর পেছনে তাকায় না । আর তুলতুল গালে হাত দিয়ে রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে….