মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৪২

#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ বিয়াল্লিশ

তুলতুল তার রুমে বসে পড়ছে। পরীক্ষার তো আর বেশিদিন নেই। রাতের বেলা খাবার খেয়ে রাফসানের সাথে একটু কথা বলার পর তাকে পড়তে বসতে বলেছে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও পড়তে বসেছে, রাফসানকে বকতে বকতে। পরে আবার ভাবে, লোকটা তার ভালোর জন্যই বলছে। শুধু প্রেমে পাস করলেই হবে না পড়ালেখায়ও পাস করতে হবে। তাই ভেবে মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসলো। তুলতুল একবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলে আশেপাশে কোন ধ্যান-ধারনা থাকে না তার যতক্ষণ না পযন্ত পড়া শেষ হবে। পড়তে পড়তে কত রাত হয়েছে তা তুলতুলের খেয়াল নেই। পড়েতে পড়তে মনে হলো বারান্দার দিকে কোন কিছুর শব্দ হচ্ছে। সে পড়া বাদ দিয়ে একটু এদিক সেদিক তাকালো। তারপর ঘড়ি দেখে রাত ১ টা বেজে ৪৫ মিনিট হয়ে গেছে। মানে দুটো বাজতে চললো। সে এতক্ষণ পড়েছে? বাপরে! তারপর রাফসানের কথা মনে পড়লো। তাকে তো বলেছিল দেড় ঘন্টা পড়ে ফোন দিবে তখন রাত দশটা বাজে। দেড় ঘন্টা তো কখন পেরিয়ে গেছে। লোকটা নিশ্চয়ই তাকে অনেকগুলো ফোন দিয়েছে। আর ফোন ধরেনি বলে হয়তো রেগেও রয়েছে। ইশশ, কি যে করে সে একটু মনে রাখবে না! সে ফোন খুঁজে কিন্তু পায় না। পড়ে টেবিলের ছড়ানো বই গুলো কোনরকমে এদিক সেদিক সরিয়ে বইয়ের নিচে চাপা পড়া ফোন বের করলো। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। সেকি লোকটা তাকে একবারও ফোন দেয়নি? আর সে এতকষ্ট করে যুদ্ধ করে ফোন খুঁজে বের করলো! ধুরর সব বৃথা! তেমন সময় সে আবার বারান্দার থেকে শব্দ পেলো। বারান্দার দরজা বন্ধ। তুলতুল ভয় নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে শব্দ তীব্র হচ্ছে। এতরাতে সে কি দরজা খুলে দেখবে? খোলা উচিৎ নয়। তারপরও কেন সম্মোহিতোর মতো দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

দরজায় কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলো কিসের শব্দ কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দ কমে গেলো। কিছুক্ষণ পরে যখন শব্দ পেলো না তখন তুলতুল ভাবে হয়তো সবঠিক হয়ে গেছে। তাই সে দরজা খুলে চাবি দিয়ে, কারন দরজায় এপাশ থেকে তালা সিস্টেম করে দিয়েছে তিয়াস। কিন্তু খোলার সাথে সাথে ভয়তে দুপা পেছনে গিয়ে বুকে হাত দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। দরজা খোলার সাথে সাথে কেউ আচমকা ‘ভাউ’ শব্দ করেছে। তুলতুলের সামনে একটা অবয়ব আস্তে আস্তে প্রকটিত হয়ে তার চেহারা দেখা দিল। তুলতুল তা দেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর ধপধপ পা ফেলে গিয়ে কয়েকটা কিল লাগালো। আর রাফসান তার হাতের মার থেকে বাঁচতে বলছে

-” আরে কি হয়েছে মারছো কেন?”

-” আপনি খুব খারাপ! এভাবে কাউকে ভয় দেখায়? জানেন আমি কত ভয় পেয়েছি?” বলে তুলতুল ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাফসান বুঝলো বেশি হয়ে গেছে। এমনি ভূতে ভয় পায় আর তার এখন এমন ভাবে ভয় দেখানো উচিত হয়নি। রাফসান তুলতুলকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” সরি সরি আর ভয় দেখাবো না। ভুল হয়ে গিয়েছে মহারানী! আর কাঁদবেন না এখন দয়া করে।” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল নাক টেনে বলে

-” আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন? আর বলেছিলেন না ফোন দিবেন? দেন নি তো!”

রাফসান তুলতুলের চোখ মুছে দিয়ে বললো

-” এইতো একটু হাওয়া বাতাস খেতে বের হয়েছিলাম। তারপর তোমাকে দেখার ইচ্ছে হলো তাই ফোন না দিয়ে ডিরেক্ট চলে আসলাম। কেন তুমি আমাকে দেখে খুশি হওনি?”

-” খুশির থেকে বেশি ভয় পেয়েছি। হুহ!” তুলতুল ভেংচি কেটে বললো। তা দেখে রাফসান শার্টের হাতা কনুই পযন্ত গোটাতে গোটাতে তুলতুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তা দেখে তুলতুল ভড়কে গিয়ে বললো

-” আপনি এ.. এভাবে এগোচ্ছেন কেন? দূরে যান। হুঁশ!” তুলতুল এমন ভাবে বললো যেনো সে মুরগি বা কাক তাড়াচ্ছে। আর রাফসান এগোতে এগোতে বললো

-” ভেংচি কাটতে মানা করেছিলাম না? তারপরও কেন আমার সামনে ভেংচি কেটেছো?”

-” তাতে আপনার কি?” বলে তুলতুল আবার ভেংচি কাটলো। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুখে হাত দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে দরজা খুলার আগেই রাফসান তাকে ওয়াশরুমের দরজার সাথে লাগিয়ে তার দুপাশে হাত দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো। আর তুলতুলের মুখ হা হয়ে গেছে তার বুক ধড়ফড় করছে। রাফসান তুলতুলের গাল চেপে ধরে বললো

-” এখন বুঝাই তোমাকে আমার কি?” রাফসান তুলতুলের গাল এমন ভাবে ধরেছে যাতে ব্যাথা না পায়। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় ও রাখেনি। দুই দাঁতের পাটির ফাঁকে গালে চেপে ধরেছে। চোয়াল দাঁতের ভেতর ঢুকে গেছে আর মুখ মাছের মতো হয়ে গেছে। সে শুধু ঠোঁটই নাড়াতে পারছে। কথা আর বলতে পারছে না। তুলতুলকে দেখতে এখন ফানি কিউটি বাচ্চা লাগছে। রাফসানের হাসি পেলেও হাসলো না। সে তুলতুলের গাল ছেড়ে মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো

-” যাও, বাচ্চা মানুষ দেখে কিছু বললাম না এবার, পরের বার যেনো না দেখি।”

-” ওফ্ফ! মনে হচ্ছিল চোপড়া ভেঙে মুখের ভেতর ঢুকে গেছে। গুন্ডা কোথাকার!” তুলতুল নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো। আর রাফসান অবাক হয়ে বললো

-” কিসের চোপড়া? চোপড়া কি?” রাফসানের কথায় তুলতুল দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো

-” চোয়াল ভেঙে মুখের ভেতর ঢুকে গেছে।” রাফসান অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বললো

-” তোমাকে দাদীর সাথে একরুমে বন্দী করে রাখতে হবে। দেখতে হবে দুইজন কত ধরনের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে সারাদিন। যা অন্য মানুষ মাথামুণ্ডুও বুঝে না।” বলে তুলতুলের হাত ধরে বাইরে বের হয়ে আসলো।
রাতের আবহাওয়াটা অনেক ভালো লাগছে তুলতুলের। আবছা আলো আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। মৃদুমন্দ বাতাসে তুলতুলের খোলা চুল উড়ছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। সাথে কিছু উড়ো মেঘ আছে। তা মাঝে মাঝে চাঁদকে ঢেকে দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে আবার সরে গিয়ে আলোকিত করছে। তুলতুল চাঁদের দিকে তাকালো। তার মনে হচ্ছে আকাশের বুকে থাকা চাঁদটা বুঝি হাসছে, তার হাসিতে আকাশও খুশি। আবার যখন মেঘে ঢেকে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে আকাশের খুশিও মলিন হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে মৃদু ফুলের সুবাস আসছে। বারান্দার সামনে বাউন্ডারির সাথে কামিনী ফুলের গাছ রয়েছে সেখান থেকেই সুবাস আসছে। পুরো গাছে থোকায় থোকায় সাদা রঙের কামিনী ফুটে আছে। রাফসান গাছ থেকে একটা ফুলের থোকা ছিড়ে তুলতুলের কানে গুঁজে দিল। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল। তুলতুল তাকালো রাফসানের দিকে। সে মৃদু হাসলো।
রাফসান তুলতুলকে নিয়ে এককোণায় থাকা আমগাছের কাছে এলো। তারপর গাছের সাথে হেলান দিয়ে তুলতুলকে তার সাথে লাগিয়ে দাঁড় কারালো। সে তুলতুলের দিকে তাকালো। খোলা চুল, কানে একথোকা শুভ্র ফুল গোজা, কান্নার কারনে লাল হয়ে যাওয়া চোখ মুখ, চোখের পাপড়িগুলো ভেজা, পরনে আকাশি রঙের জামা সবমিলিয়ে রাফসানের কাছে তুলতুলকে মোহনীয় এক শুভ্রতায় ঘেরা মায়াবতী লাগছে। সে মুগ্ধ, ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। তুলতুল রাফসানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। যে চোখে তার জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে।

রাফসান তুলতুলের তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বামহাত নিয়ে অনামিকা আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিল। তুলতুল তা বুঝতে পেরে তার হাতের দিকে তাকালো দেখলো ডায়মন্ডের সিম্পল ডিজাইনের একটা আংটি। সে কিছু বলার আগেই রাফসান তার হাত নিজের কাছে এনে বললো

-” আজকে থেকে আমি তোমার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। তোমাকে বিয়ে করবোই করবো। এই হাতের আঙুলসহ আংটির কসম।” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর নিজেকে সামলিয়ে কিছু বলবে কিন্তু এবারও রাফসান তাকে কিছু বলতে দিল না। সে বললো

-” খবরদার এখন বলবে না, ডায়মন্ড, দামী, কমদামী, সিম্পল, গর্জিয়াছ, কেন এনেছেন, কি দরকার ছিল? হ্যানোত্যানো..! ” তুলতুল রাফসানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো

-” এটা কেমন প্রপোজ? আর আমি এই কথা গুলো কেন বললো? ভালোবাসার মানুষের ভালোবেসে দেওয়া সবকিছুই প্রিয়। সেটা যদি দামী নাহয় তাহলেও প্রিয়। তাহলে আপনি এমন ভাবলেন কেন?”

-” প্রথম প্রশ্নের উত্তর, এটা রাফসানের স্টাইলে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।”

-” দ্বিতীয় টা?”

-” মুভিতে প্রায়ই দেখতাম, এখন নয়! আগে, বেশিরভাগ আংটি পড়ানোর পর নায়কা মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে থাকে তারপর পড়ানো হয়ে গেলে কান্না করে জড়িয়ে ধরে। বাকিরা আমার বলা প্রশ্ন গুলো করে। কিন্তু আমি রিং পড়ানোর পড়ে তুমি শুধু হাতের দিকে তাকালে, মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে ঝাঁপিয়ে পড়লে না আমার বুকে তাই ভাবলাম পড়ের টাই হয়তো বলবে। এজন্য আগেই আমি বলে দিলাম। শুনতে ভালো লাগে না। কিন্তু তুমি দুটোর একটাও করলে না। আমি হতাশ।” রাফসান মন খারাপের ভান করলো। আর তুলতুল খিলখিল করে হেসে উঠলো রাফসানের কথা শুনে। রাফসানও মুচকি হেসে তুলতুলের কপালে কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে ধরে রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর তুলতুলের কিছু মনে পড়ায় সে সরে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো

-” আচ্ছা আপনি অঙ্গীকার দিলেন তাহলে আমারও তো অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া উচিত আপনার কাছে তাইনা?” রাফসান প্রতিত্তোরে কিছু না বলে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইল সে কি করে দেখার জন্য। তুলতুল তার হাতের চাবির রিং থেকে বড় রিংটা আলাদা করে রাফসানের হাত টেনে পড়িয়ে দিল। তারপর বললো

-” আমি অঙ্গীকারবদ্ধ। মানে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।” তারপর রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো

-” আপনি কাঁদবেন না?” রাফসান তুলতুলের কথা শুনে হেঁসে উঠলো। রাতের নিস্তব্ধতায় সে হাসি চারপাশে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে দূরদূরান্তে গিয়ে ফিরে আসতে লাগলো। রাফসান হাসি থামিয়ে নিজের হাতের আংটির ওপর ঠোঁট ছোয়ালো।

-” গ্রহনযোগ্য” বলে রাফসান তুলতুলকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরলো। আর তুলতুল চুপটি করে রাফসানের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ শুনছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে রাফসানকে ধরে রাখলো। রাতের এই নিস্তব্ধতা, নীরবতায় সবকিছু থেমে থাকলেও থেমে নেই ঘড়ির কাঁটা আর তাদের দুজনের অনূভুতি।

বন্ধ চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। যা যন্ত্রণা আর কষ্টের বের হয়ে এসেছে। তুলতুল হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল। চোখ বন্ধ করে কয়েক সপ্তাহ আগের সেই রাতের স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছিল। কতটা আবেগ, ভালোবাসাময় অনুভূতি ছিল। আর অনুভুতিও কতটা বাস্তব ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। তুলতুল যেনো এখনো রাফসানের হৃদপিন্ডের সেই ধুকপুক শব্দ অনুভব করতে পারছে। তুলতুল নিজের হাতের সেই আংটিটার দিকে তাকালো। সে পারেনি আংটিটা হাত থেকে খুলতে। রাফসানের দেয়া চিহ্ন এটা। মানুষটাকে তো কখনো আর দেখবে না, তার দেওয়া এই চিহ্ন টা নাহয় তার সাথে থাকলো। তুলতুলের অস্থির লাগছে। রাফসানের কাছে ছুটে চলে যেতে মন চাচ্ছে। কিন্তু তিয়াসার কথা মনে পড়লে নিজেকে সামলে নিচ্ছে। তুলতুল বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। অথচ টিভি চলছে। রাফসান দেখা করে যাওয়ার দুইদিন পরে তারা তাদের চারবছর আগে যে বাড়িতে থাকতো সেটায় চলে এসেছে। তিয়াস বাড়ির টা কিনে নিয়েছে। কারন কোম্পানির পাওয়ার অব এটর্নি পাওয়ার পর সে নিজে বিজনেস শুরু করে। বাবাকে জানায় নি প্রথমে, কয়েকমাস পরে জানিয়েছে। বিজনেসের অবস্থা ভালো, প্রফিট ও ভালো হয়েছে। তাই বাড়িটা যাদের নামে ছিল তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে। কারন এই বাড়িতেই জড়িয়ে আছে তাদের শৈশব কৈশোরের স্মৃতি, তিয়াসার স্মৃতি, মান, অভিমান, ভালোলাগা সবকিছুই এ দোতালা বাড়িটাকে ঘিরে। তুলতুলরা এবাড়িতে এসেছে সাতদিন হয়ে গিয়েছে। এ সাতদিনে রাফসানের দেখা পায়নি তুলতুল। দেখতেও চায় না, ভুলে যেতে চায়। কিন্তু তা আদৌও পারে না, ভুলে যাবে ভাবলে যেনো তার স্মৃতি গুলো আরো ঘিরে ধরে। আর তাকে আবেগি করে তোলে। হঠাৎ করে লাইট অন করার শব্দ হলো।

তুলতুল কাঁথা নামিয়ে বেলকনির দিকে তাকাতেই চমকে গেলো। রাফসান দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তুলতুল কাঁথা ফেলে উঠে বসলো। আর রাফসান দ্রুত এসে তুলতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর তুলতুল রাফসানকে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। ধাক্কাধাক্কিতে রাফসান বিরক্ত হয়ে তুলতুলকে বললো

-” সমস্যা কি? একটু চুপচাপ থাকা যায় না?” তুলতুল চিৎকার করে বলে

-” কেন এসেছেন এখানে আপনি? কেন আমার আর আমার পরিবারের পিছে পড়েছেন? কি চাই আপনার? টাকা,পয়সা, বাড়ি গাড়ি সবই তো আছে। কতমেয়েও তো আপনার পিছে ঘোরে। তাদের থেকে একজনকে বেছে নিলেই তো হয়। তাহলে আমার পেছনে কি জন্য পড়ে আছেন? নাকি… ”

-” চুপ, একদম মুভির ডায়লগ দিবি না। কোন সাহসে তুই আমাকে চরিত্রহীন বলতে যাস?” রাফসান তুলতুলের মুখ চেপে ধরে বললো। কিন্তু তুলতুল রাফসানের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বললো

-” সমস্যা কি আপনার? কথা শেষ করার আগেই আবোলতাবোল ভেবে বসেন। কখন আপনাকে চরিত্রহীন বললাম? বলছিলাম, নাকি প্রতিশোধ নিতে চান! আর আপনি কি বুঝলেন?”

-” এই তোর ওপর আমি কিসের প্রতিশোধ নিবো? আর চরিত্রহীন বলিস নি তো এটা কি? কতমেয়েরা টাকার লোভে আমার আগে পিছে ঘোরে তাদের থেকে বেছে নিয়ে টাইম পাস করে আবার অন্যের কাছে যাওয়ার কথা বলছিস। তোর কত মেয়ে বলার ধরনেই তো এটা বুঝায়! বেয়াদব!” রাফসান তুলতুলের মুখ আবার চেপে ধরে বললো। রাগ উঠে গেছে তার।

-” ছাড়ুন আমাকে! আমার বোনের খুনিকে চোখের সামনে দেখতে চাই না।” তুলতুলের কথায় এবার রাফসানের রাগ আরো বেড়ে গেলো। রাগে গা জ্বলছে। সে চিল্লিয়ে বলে

-” কতবার বলবো তোকে আমি তিয়াসাকে খুন করিনি! কতবার? তোর পরিবার নিশ্চয়ই আমার সেদিনের কথা গুলো বলছে? তাহলে তুই কোন সাহসে বলছিস?” রুম সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় বাইরে আওয়াজ যাচ্ছে না। তুলতুল বললো

-” আমি বিশ্বাস করি না। কি প্রমাণ আছে আপনি নিজেকে নির্দোষ করতে এটা বলছেন না?” ব্যাস, তুলতুলের এই কথা শুনার পর রাফসান দাঁত কিড়মিড় করে বলে

-” আমি যদি খুন করেই থাকতাম তাহলে কোনদিন তোর পরিবারকে বলতাম না। আবার বলছিস নির্দোষ প্রমাণ করা। সত্যিই যদি তিয়াসাকে আমি মেরে থাকতাম তো কোনদিন ওর ছবি আমার কাছে রাখতাম না, না তোর পরিবারকে কিছু বলতাম, আর না তোর কাছে সাফাই দিতাম।” বলে রাফসান নিচে বসে হ্যাঁচকা টানে তুলতুলকে নিজের কোলে বসিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে একটা ভিডিও প্লে করলো। তুলতুল প্রথমে ছোটাছুটি করলেও ভিডিও দেখে চুপ হয়ে যায়। ভিডিওর একপর্যায়ে তুলতুল কান্না করতে থাকে। একটা সিসি টিভি ফুটেজের কিছু অংশ সে তুলতুলের সামনে ধরেছে। ফুটেজ টি সেদিনের যেদিন রাফসান আর তিয়াসার ওপর আক্রমণ করা হয়। পেছনের বিল্ডিংয়ের এককোণে লাগানোয় সেটা বোঝা যায় নি। আর আকারেও ছোট ছিল। তাই শত্রুরা তা সরাতে পারে নি। কিন্তু আবির জায়গাটা ভালোভাবে দেখার সময় তার চোখে পড়ে সেটা তখনই সে ফুটেজটা সংগ্রহ করে রাখে। ফুটেজটিতে যখন তিয়াসাকে আগুন জ্বালানো তেলের ট্রাংক এর দিকে ধাক্কা দেওয়া হয় তখন তুলতুল ফুপিয়ে কেঁদে উঠে রাফসানের শার্ট আঁকড়ে ধরে। রাফসান ভিডিও টা বন্ধ করে ফোন সরিয়ে রেখে তুলতুলের মাথায় হাত বুলায়। সে ফুটেজটা দেখাতে চায়নি তুলতুলকে জানতো সেটা দেখলে তুলতুল ভেঙে পড়বে। কিন্তু তুলতুলের সন্দেহর জন্য দেখাতে হলো, নাহলে ভবিষ্যতেও হয়তো তাকে সন্দেহ করতো নাহয় মনের ভেতর খচখচানিটা থেকে যেতো।

তুলতুলের কান্নার শুব্দ থেমে গেছে অথচ কান্না বন্ধ করে নি। নিরবে কাঁদছে। কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে রাফসানের থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে

-” চলে যান আপনি। আপনি খুন না করলেও আপনি দোষী। আর আপু আপনাকে ভালোবাসতো, আমি আপু যাকে ভালোবাসতো তাকে ভালোবাসতে পারি না। আপুর সাথে অন্যায় হবে তাহলে।” রাফসান শান্ত দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকালো। হ্যাঁ সে জানে সে দোষী। অপরাধবোধ তার ভেতরেও কাজ করে। এজন্যই সে তুলতুলের থেকে দূরে থাকার জন্য একমাস দূরে থেকেছিল ভালোবাসে বোঝার পর। তুলতুলের পরিবারকে জানানোর পরেও এককয়দিন অপরাধবোধে ভুগছিল। তার মনে হচ্ছিল সে অন্যায় করছে, এজন্য নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছিল। তুলতুলের সামনেও আসে নি। কিন্তু পারেনি। আজ তার মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই সবকিছু ভুলে ছুটে চলে এসেছিল। যতই নিজেকে দোষী ভাবুক সে তুলতুলকে ছাড়া থাকতে পারবে না। রাফসান শান্ত ভাবেই তুলতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর একহাতে থুঁতনি চেপে ধরে বলে

-” এমন ভাবে বলছো যেনো তোমার বোন জীবিত অবস্থায়ই আমি তোমার সাথে জড়িয়েছি। আর তিয়াসাকে ঠকাচ্ছি। কেন তিয়াসার সাথে অন্যায় হবে একথা বলছো? তোমার আপু চলে গেছে। এরপর কি আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারি না? বা আর কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? ভালোবাসলেই তার সাথে অন্যায় হবে? এ কেমন কথা! এমন নয় যে আমি তিয়াসাকে ভালোবাসিনি বা ভালোবাসি না এখন। এখনো বাসি ভালো। তিয়াসা একটা কথা বলেছিল জানো? কখনো যদি সে না থাকে তাহলে যেন ভেঙে না পড়ি, মানিয়ে নেই যেন সবকিছু। আর তার পরিবারের যেনো খেয়াল রাখি। সে আমাকে ভালো থাকতে বলেছে, মানিয়ে নিতে বলেছে, কাউকে ভালোবাসতে মানা করেনি। তাহলে কেন তার প্রতি অন্যায় হবে? তাহলে কোথায় পেয়েছো আমাকে ভালোবাসা যাবে না?” রাফসানের কথা শেষ হতেই তুলতুল বললো

-” অন্য কেউ ভালোবাসুক আর না বাসুক কিন্তু আমি ভালোবাসতে পারি না।”

-” ঠিকাছে, বুঝিয়েছি বোঝো নি। আর বোঝাতেও চাই না। আর জোর করবো না কখনো, সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার কাছে আসবো না কিন্তু তোমাকে আবার না আমার কাছে আসতে হয়।” রাফসান শান্ত ভাবে বললো। সে এখন কোন রাগারাগি করছে না। কিন্তু কথাটা শুনে তুলতুলের কান্না আসলো। কিন্তু সে ঢোক গিলে কান্না আটকালো। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছে। কতকাছে রাফসান তার কিন্তু তারপরেও যেনো মনে হচ্ছে কত দূরত্ব। যা কখনো শেষ হবে না। রাফসান তুলতুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

-” পিকা, পিকা, পিকায়ায়া, পিকা পিকা পিকা পিই, পিক্কা!”

-” পিকাচু, পিকাচুওও….” এমন অদ্ভুত শব্দ শুনে রাফসান টিভির দিকে তাকালো। টিভিতে পোকেমন কার্টুন হচ্ছে। আয়াশ পিকাচুকে তার সাথীদের সাথে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাই ইমোশনাল মিউজিক হচ্ছিল। তুলতুল আর রাফসান কথার তালে তা খেয়াল করেনি। কিন্ত টিভিতে পিকাচু তার সাথী দের সাথে না থেকে আয়াশের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আয়াশের পিছনে দৌড়ে আসতে আসতে চিৎকার করে পিকা পিকা বলে ডাকছিল আর আয়াশ তা শুনে পেছনে ফিরে পিকাচু কে দেখে তার নাম ধরে চিৎকার তার দিকে দৌড়ে যায়। নিরবতার কারনে এই চিৎকার তুলতুল আর রাফসানের মনোযোগ আকর্ষণ করে। রাফসান টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে, আয়াশ আর পিকাচু দৌড়ে এসে একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। আর ব্যাকগ্রাউন্ড সং প্লে হয়, হাম সাথ রেহেঙ্গে, হার মুশকিল মে দোস্তি.. রাফসান তুলতুলের দিকে তাকায়। তারপর এগিয়ে গিয়ে বললো

-” আমারটাও যদি এমন ভোলাভালা হতো। সব মান, অভিমান, কষ্ট ভুলে যদি আমার কাছে ফিরে আসতো! কিন্তু আমারটা অনেক ত্যাড়া! জিন্দেগীতে তা করবে না! ” বলে তুলতুলের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বেলকনির দিকে গেলো। আর যেতে যেতে বললো

-” ভালো থাকবে। জ্বালাবো না একদম। যদি কখনো মনে হয় যে রাফসানকে একটু হলেও ভালোবাসা যায়, তাকে বিশ্বাস করা যায়, ভরসা করা যায়, তাকে আঁকড়ে ধরা যায় তাহলে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করবো।” বলে চলে গেলো। আর তুলতুল মুখ চেপে ধরে কান্না করে এতক্ষণ খুব কষ্ট নিজেকে আঁটকে রেখেছে। হঠাৎ কিছু মনে হতেই সে বেলকনিতে চলে গেলো। দুতালায় রাফসান উঠলো কিভাবে? তুলতুল নিচে তাকিয়ে দেখে রাফসান বাড়ির নিচতালার ওপাশের বেলকনিতে ওপরের কিছু বাড়তি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আর নিচে মই ধরে আবির দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে ওতটুকু উঠে আর অল্প একটু পাইপ বেয়ে উঠেছে। রাফসান নিচে নামলো। আবির মই বাউন্ডারির ওপাশে রাখলো। তারপর পায়ের ছাপ গুলো ফোনের লাইট জ্বালিয়ে জুতা দিয়ে ঘষে মেটানোর চেষ্টা করলো। পেছন পাশ হওয়ায় দারোয়ান নেই। আবির আর রাফসান বাউন্ডারি পার করে ওপাশে গিয়ে মইটা গাড়ির ওপরে রেখে বাঁধলো। তারমানে মই নিয়ে এসেছিল। তারপর গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। এতদুঃখের ভেতরও তুলতুলের হাসি পেলো এইকান্ড দেখে। প্রাইভেট কারের ওপর এতবড় একটা মই বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য হবে নাকি এদের পাগল বলবে!

তুলতুল সকালে উঠলে তার মা এসে বলে যায় সে যেন রেডি হয়, তাকে দেখতে আসবে। একথা শুনে তুলতুল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here