মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৭

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ সাত

–কি! এতো কিছু হয়ে গিয়েছে আর আমি এখন জানছি? তুই হাসপাতাল থেকে এসেছিস পাঁচ দিন। এর ভেতর আমি চারদিনই তোর সাথে দেখা করতে এসেছি। আর তুই আমাকে আজ বলছিস ঔ রাফসানের কান্ডকারখানা। এতোদিন কতোকিছু জিজ্ঞেস করেছি তুই কিছুই বলিস নি। দিয়া মুখ ফুলিয়ে বললো।

–রাগ করিস না দিয়া। দেখ আমার মন ভালো ছিল না তাই বলিনি। ঐ ঘটনা গুলো আমি ভুলতে পারছি না। কিছুক্ষন পর পর সেই গুলির শব্দ, রক্ত, আর ঐ লোকটির মৃত্যু চোখের সামনে ভাসে। আমি কি করব বলতো?
–থাক বুঝতে পেরেছি। তোর ভেতর ঘটনাটি গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। স্বাভাবিক ওরকম একটা ঘটনা ভুলে যাবার মতো না।
–হুম
–আচ্ছা তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে কে রাফসানের লোক কেউ?
–তুই পাগল হয়েছিস ঐ বজ্জাত গুন্ডা আমাকে মেরে ফেলতে পারলে বাঁচে। আর ওর লোকেরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। হুহ।
–আচ্ছা কেউ তো ঝামেলার পর আর ওখানে যাবে না ভয়তে তাহলে তুই বলছিস কোনো লোক ওখানে গিয়ে তোকে দেখেছে তার পর হাসপাতালে ভর্তি করেছে। কিভাবে?

–জানিনা। কিন্তু ঔ গুন্ডার লোকজন নেয়নি। আমাকে ওখানে ফেলে চলে গিয়েছে। আর ও রাসান লোকটিকে বলছিল ও না মারলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। শয়তান ব্যাটা।

–তুই কি বাড়ির কাউকে বলেছিস একথা?

–না, বলিনি। তাহলে আমাকে আর বের হতে দিবে না। আর কলেজে যাওয়া ও হবে না। শুধু জানে রাফসানের লোকেরা যেখানে দাঙ্গা করেছে ওখানে ফেঁসে গিয়েছিলাম।

তুলতুল আর দিয়া কথা বলছে এমন সময় তিয়াস রুমে প্রবেশ করলো। দিয়া তা দেখে একদম চুপসে গিয়েছে। কারন তিয়াস তাকে একদম দেখতে পারে না। কখনো ভালোভাবে কথা বলে না। সবসময় ত্যাড়া কথা বলে। তাকে বলে দিয়েছে সে যেনো কখনো তিয়াসের সামনে না যায়। তাই দিয়াও কখনো পারতপক্ষে তিয়াসের সামনে যায় না। তিয়াস রুমে দিয়া কে দেখে ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। দিয়া এটা দেখে ভয়তে তুলতুলকে বললো –
— তুই থাক আমি আজ আসি। এই বলে দ্রুত বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। তুলতুল ডাকলেও আর তাকায় নি। তুলতুল ভাইয়ের দিকে রাগ করে তাকায়। কিন্তু তিয়াস সেটাকে পাত্তা না দিয়ে তুলতুলের পাশে বসে বলে-

–বল তোর কি অবস্থা। হাঁটতে পারবি একটুও।

–হুম পারবো। তবে কোমরে হালকা ব্যাথা করে এখনো।

–এবার বল কাহিনি কি। এতোদিন জোর করিনি তুই অসুস্থ বলে আজকে বলতে হবে কি হয়েছিল যে তুই কলেজ থেকে ওদিকে চলে গিয়েছিলি।

— ভাইয়া আমি… তুলতুল আমতা আমতা করছে। ভাইকে মিথ্যা বলতে পারবে না ধরা পড়ে যাবে। কিছুদিন পরও হয়তো এমনিও জেনে যাবে। তুলতুল যে কয় বার মিথ্যা বলেছে তিয়াস প্রতিবারি তা ধরে ফেলেছে। সাথে সাথে না ধরলেও পরে কিভাবে যেনো সব জেনে যায়। মানে মিথ্যা বলার কোনো সুযোগই নেই। তুলতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব বলতে শুরু করে। তিয়াস সব কিছু শুনে কিছু সময় চুপ করে থাকে। এরপর বলে- তোর আর বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। পরে কি থেকে কি হয়ে যাবে।

তুলতুল তো কান্না শুরু করেছে। সে এজন্য কিছু বলতে চায় নি। তুলতুল বলে- ভাইয়া তুমি ঔ খারাপ লোকের জন্য আমার কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিবে। আমি তো কিছুই করি নি তাহলে কেনো?
— তোকে আমি দুষ্টুমি করতে মানা করেছি কিন্তু তুই শুনিস না। কেন রাফসানের গাড়ির কাচ ভেঙে ছিলি।রাগলে এমনি ওর মাথা ঠিক থাকে না। কি থেকে কি করে বসে। একজন কে হারিয়েছি। তোকে আর হারাতে চাই না বোন কেনো বুঝিস না। মা- বাবা তোকে চোখে হারায়। সব সময় তোকে নিয়ে চিন্তা করে। তুই যখন হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে ছিলি তখন মা তো কান্না করতে করতে শেষ। আর বাবার কথা নাই বললাম। এমন করিস না। তিয়াস তুলতুলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথা গুলো বললো।

— সরি ভাইয়া। আমি আর এমন করবো না।৷ কিন্তু তুমি কি রাফসান কে চেনো? তোমার কথায় মনে হচ্ছে তাকে তুমি চেনো।

–হুম চিনি। আমার দুই বছরের জুনিয়র ছিল ভার্সিটিতে। অনেক হাসিখুশি ছিল তখন। সবাইকে সম্মান করতো। ওর বাবা অনেক প্রভাবশালী লোক ছিল তারপরও কখনো অহংকার করতো না। মারামারি তখন ও করতো দলবল ছিল কিন্তু এখনকার মতো না। কেউ অন্যায় করলে শাস্তি দিত। জানিনা কি এমন হয়েছে চার বছরে হঠাৎ করে রাফসান থেকে গ্যাংস্টার রাফসান হয়ে গিয়েছে।

–এই চারবছরে আমাদের জীবন ও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে তাই না ভাইয়া কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি। তিয়াস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিন্তু কিছু বললো না।
— আচ্ছা ভাইয়া তুমি বললে রাফসান অন্যায় সহ্য করতো না মানে খারাপ লোককে শাস্তি দিত। তাহলে অতগুলো নির্দোষ মানুষকে কিভাবে মারতে পারে সে?
— নির্দোষ কোনো লোককে মারেনি। তুই যে লোকের কথা বললি রাসান। ও অবৈধ ভাবে ড্রাগ সাপ্লাই করে, মেয়ে আর শিশুদের পাচার করে ঔ গ্যাঙের সাথেও জড়িত। আরো অনেক খারাপ কাজ করে বেড়ায়। হয়তো এগুলো নিয়েই রাফসানের সাথে দন্দ লেগেছে। কিন্তু আমি বুঝলাম না রাফসান কেন তোর সাথে এমন করলো ছোট একটা বিষয় নিয়ে।ওকে মেয়েদের সবসময় এড়িয়ে চলতে দেখেছি। যাইহোক তখনকার রাফসান আর এখনকার রাফসানের সাথে আকাশ- পাতাল তফাৎ। জানিনা শুধু অন্যায় করে যারা তাদেরই শুধু শান্তি দেয় নাকি নির্দোষ রাও ওর কবলে পড়ে। কিন্তু তুই সাবধানে থাকবি। কাউকে এখন আর বিশ্বাস করি না।আর তোকেও আমি হারাতে চাই না।

তিয়াস তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো।তুলতুল সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

.

রাফসান দেয়ালে তিনটি ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তৃতীয় ছবিটা নিয়ে তাতে হাত বুলায়। ছবিটি নিয়েই কিছুদূর পিছিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। আবির রুমের দরজা খুলে এটা দেখে আবার মুখ কালো করে চলে যায়। তার রাফসান ভাইয়ের জীবন কি এভাবেই চলে যাবে? সে যে এতে কিছুই করতে পারছে না।
রাফসান পাশ থেকে একটা ক্যান নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে দূরে ছুড়ে মারে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছবিটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষন চুপকরে থেকে বলতে শুরু করে –
-আমাকে একা করে গিয়ে ভালো আছো তাই না। খুব খুশি তুমি তাইনা আমার এ অবস্থায়। খুশি দেখেই তো আমাকে এ অবস্থায় দেখেও আসছো না। ভালো ভালো। জানতো সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সবাই কেউ নেই, নেই কেউ। আমাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে সবাই চলে গিয়েছে। প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছো তোমরা সবাই। হা হা হা
রাফসানের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষন থেমে আবার নিজে নিজে বলতে থাকে-
আবার জীবনটা না থমকে গেছে। চারবছর আগেই থমকে গেছে। সেখান থেকে আমি আর একটু আগাতে পারি নি। দেখো একটুও পারি নি। মরে গেছি আমি, মায়া,মমতা, ভালোবাসা সব মুছে গেছে। হা হা হা। যে মানুষের কষ্ট দেখলে দৌড়ে যেত সে এখন মানুষের আর্তনাদেও ঘুরে তাকায় না। নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছি আমি নিষ্ঠুর। রাফসানের গলা ধরে এসেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তারপর ও ছবিতে হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো-
— মনে আছে তোমার সেই গানটা যেটা তুমি প্রায় শুনাতে? মনে আছে? আমি বলছি। রাফসান ভাঙা গলাই গাইতে লাগলো
“জানি তুমি আসবে না ফিরে
বাসবে না ভালো আমাকে..”
হা হা হা আমার জীবনের কথা হয়ে দড়িয়েছে এখন। রাফসান পাগলের মতো করতে লাগলো। নিজের মতো কথা বলে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। কিছু সময় পড়ে এমনি নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here