#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৪||
সুরমা বাসায় পা রেখেই আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। প্রথমেই ফোন করলেন নেহালের বাবাকে। মেঘার সাথে বলা সমস্ত কথা জানিয়ে বর্ষণের নামে দেয়া মেঘার মিথ্যে অপবাদের কথাও জানালেন স্বামীকে। তার পরামর্শ শুনে তখনই সরাসরি গেলেন মেঘার ঘরে ।
মেঘা মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। কাপড়ও ছাড়েনি। এরকম একটা সময়েই সুরমা ওর দরজা খুলে ঘরে ঢুকে তীব্র স্বরে বলতে লাগলেন, ” এই মেয়ে, তুমি আমার ভাইয়ের নামে অতবড় মিথ্যা বললা কেন সেদিন ?
-” কী মিথ্যা বলেছি ভাবি ? ”
-” বলো নি যে বর্ষণ তোমাকে টাকা দেয়, সাহায্য করে ? গিফট দিতে চায় ? তোমাকে ফোন করে কথা বলে…এসব ? ”
-” ‘ফোন করে কথা বলে’ এ কথা কখন বললাম ? ” মেঘার দু চোখ বিস্ফোরিত হল।
-” ঐ তো যা বলেছ তার মানে করলে তো ঐ রকমই দাঁড়ায়।” বলে উঠলেন সুরমা ।
মেঘা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝতে পারল সে আসলে ভুল করে সাপের লেজে পারা দিয়ে ফেলেছে। এই সাপ এখন ওকে দফায় দফায় ছোবল মারবে। মেঘা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
-” শুধু এটুকু বলেছি বলেই তার এত সম্মানে লাগল ভাবি ! আর একজন বিধবার ঘরে ঢুকে তাকে না বলে তার বাথরুম ব্যবহার করার সময় উনি এটা ভাবলেন না যে এতে ঐ বিধবার সম্মানে লাগবে কী না ? বা তার সম্পর্কে কে কী ভাববে ? উনি আমার ঘরে এসে দোষ করলেন না আর আমি কথাটা বলে দোষ করে ফেললাম ? ” মেঘার গলা ধরে এল। নিজেকর বড় অসহায় মনে হল ওর।
সুরমা তীব্র কণ্ঠে বললেন,
-” তারমানে তো এটা স্পষ্ট যে, তুমি ইচ্ছে করে বর্ষণের নামে মিথ্যে বলেছে ? ”
-” না, ভাবি। মিথ্যে আমি বলিনি। তবে হ্যাঁ, তথ্যটা অন্যভাবে পেশ করেছি। আপনার হয়ত মনে আছে, আমার আরশের জন্মদিনের পরের দিন উনি এ বাড়ীতে এসেছিলেন। আরশ তখন আম্মার কাছে ছিল। আর সেদিন আমি বাসায় ছিলাম না। পরে আম্মার কাছেই শুনেছি উনি আরশকে কোলে নিয়ে ওর হাতে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেই টাকা আম্মাকে তখনি ফেরত দিয়ে বলেছিলাম যেন ওনাকে বলে দেয় যে আমি জন্মদিন পালন করিনা। আম্মা ঐ টাকা ফেরত নেননি বরং আমাকে বলেছেন , থাক্, আদর করে দিয়েছে যখন রেখে দাও। আমি সেই টাকার রেফারেন্সটাই এমনভাবে টেনেছি যেন আপনার মনে সন্দেহ জাগে আর আপনি বুঝতে পারেন যে কারো প্রতি সন্দেহ জাগিয়ে তোলাটা কতটা অন্যায়। হতে পারে কাজটা আমি ঠিক করিনি। কিন্তু আমি মিথ্যে বলিনি ভাবি। আর আপনি তো আমার প্রতি আম্মার সন্দেহ জাগিয়ে তুলতেই চাচ্ছিলেন, তাই না ? ”
সুরমা বিস্ময়ের আতিশায্যে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন মেঘার কথা শুনে। মেয়েটাকে এতদিন সহজ সরল মেয়ে বলেই জানতেন তিনি। কিন্তু এই মেয়ে যে এতো ত্যাঁদোড় তা সুরমার জানা ছিলো না। কঠিন স্বরে বললেন, ” ওরেব্বাবা…! ভালোই তো। আমার ভাইয়ের টাকাও নিলে আর বদনামও করে ফেললে। তা ভাল কাজের এই বুঝি প্রতিদান ? ”
-” কে বলেছিল তাকে এত ভাল কাজ করতে ? আপনি চাইলে টাকাটা এখনও ফেরত নিতে পারেন ভাবি। ”
মুখটা শক্ত হল মেঘার। পার্সটা টেনে নিয়ে তা থেকে এক হাজার টাকার নোটটা বাড়িয়ে ধরল সুরমার দিকে।
-” এবার মন থেকেই বলছি। এতো ভাল কাজ করতে মানা করবেন আপনার ভাইকে। আল্লাহ আমাকে না খাইয়ে রাখেন নি। ”
সুরমা কয়েক সেকেন্ড টাকাটার দিকে তাকিয়ে থেকে ছোঁ মেরে হাতে নিয়ে বলল, – ” আমার ভাইয়ের এমন কোনো দায় পড়েনি। আর আমারও কোনো দরকার পড়েনি যে তোমার সম্পর্কে আম্মাকে ওসব বলে সন্দিহান করব। তুমি কী মনে করো, এসব বললে আম্মা তোমার সম্পত্তি আমাদের দিয়ে ফেলবে না । যত ঢঙ্গের কথা। হুঁহ্..! ”
-” সম্পত্তি দেবে না কী করবে সেসব আপনি জানেন ভাবি। আমি ওসব বলিনি। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে, আপনি আম্মার মনে সন্দেহ ঢুকাতে চাচ্ছেন এবং এটা স্পষ্ট। কারণ আপনিও জানেন যে , আমার আশেপাশে কাউকে আম্মা সহ্য করতে পারেন না। তাছাড়া উনি পুরোনো দিনের মানুষ। যে কোন কিছুতে চট করে সন্দেহ করেন।”
-” হমম…আশেপাশে কাউকে সহ্য করতে পারেনা। আবার অফিসে যাবার জন্য তো ঠিকই ছেড়ে দিয়ে রেখেছে। এসব পেট বানানো গল্প অন্য কোথাও শুনিয়ো।” আরো কিছু বলতে গিয়েও কী ভেবে চেপে গেলেন সুরমা। তারপরেই হনহন করে বেরিয়ে এলেন তিনি।
এর পরের দিন থেকেই মেঘা টের পেল বড়জা তাকে এড়িয়ে চলছেন। দেখা হলেও কথা বলছেন না মেঘার সাথে। এমনিতে মেঘা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাসাতেই থাকেনা। কিন্তু বাসায় ফেরার পর থেকেই তার শুরু হয়ে যায়। গত দুদিন ধরে এসবই চলছে। মেঘা সন্ধ্যার পর এসে রান্নাঘরে ঢুকলে দুজনের দেখা হলেও চোখ মেলান না সুরমা। প্রথম দিন মেঘা সম্পর্কটা সহজ করে নিতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু অপরদিক থেকে সাড়া না পেয়ে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। পারতপক্ষে সুরমার সামনে সে পড়তে চায়না। ভেতর থেকেই কেন যেন সমঝোতার ইচ্ছেটা আর কাজ করেনা। এর প্রধান কারণ মহিলার মধ্যে নম্রতার ছিঁটেফোটা নেই। এই মহিলা ওকে দেখলেই অপমানজনক আচরণ করার চেষ্টা করেন। যার ফলে মেঘা সরে সরেই থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দুজনের মধ্যেই সম্পর্কটা শীতল হতে হতে এখন জমে বরফ হবার যোগাড়। মেঘা বুঝতে পারছে না কিভাবে এই বরফ গলাবে। একসময় নিজেকেই অভিসম্পাত করল ধৈর্য না ধরে সুরমার সাথে সমানতালে টেক্কা দেবার জন্য। এই মহিলা যে একটা ঝামেলা পাকানোর তালে আছেন তা বুঝতে আর বাকী নেই মেঘার। মেঘার শত সতর্কতা সত্ত্বেও ওর কাজে খুঁত ধরা চাই তার।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। প্রতি সপ্তাহের মত আজও মেঘা সাত সকালেই নিজের রান্না সেরে ফেলেছে। কারণ আজ ভাসুররা সব বাড়ীতে। জুম’আর দিন। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হবে পানি গরম পর্ব। এরা কোন ভাই গরম পানি ছাড়া গোসল করতে পারেনা। পরশও এমনই ছিল। ফলে দেখা যেত প্রতি জুমাবারে একটু পর পর গোসলের জন্য পানির হাঁড়ি উঠবে আর নামবে। তাছাড়া আজ মেঘার জমানো কাপড় ধোয়ারও দিন। যার কারণে সে সকালবেলাতেই রান্নার ঝামেলা শেষ করেছে। শ্বাশুড়ী আম্মার খানাদানা মেঘার সাথেই। জোহরের আযানের পরপরই তার সামনে খাবার দিতে হয়। তাই ছুটির দিনেও ঝুঁকি নেয়না মেঘা। এমনি দিনে রান্না করেই রেখে যায়, শ্বাশুড়ী নিজ হাতে নিয়ে খান কিংবা যে কাউকে বললে সে বেড়ে দেয়। একমাত্র ছুটির দিনেই মেঘা নিজ হাতে সব করে। আজও সে সেভাবেই সব করেছে।
রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে বেরোনোর পরপরই রান্নাঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসতে শুনল মেঘা। সুরমা ভাবি তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন। নিজের ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসে বড়জা’র চেঁচামেচি শুনল মেঘা। অথচ ঘটনা সামান্যই। হাঁড়ি ধরার কাপড়টা সম্ভবত মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়েই একদফা চেঁচালেন তিনি। মেঘার উদ্দেশ্যে অকর্মা, ছোটলোক রান্নাঘরের নিয়ম জানেনা, হাড়ি ধরার কাপড় ফ্লোরে রাখে, ফ্লোর মোছার কাপড় উপরে রাখে…এসব বলে বেশ অনেকক্ষণ গজগজ করলেন সুরমা। তার সাথে আজ খোলাখুলিই একমত প্রকাশ করল বাকি দুইজা। সেজ জা জানালো তার এসবে শুচিবায়ু মতো আছে। সে একটার কাপড় দিয়ে অন্যটা করে না। তার সব কাজের কাপড় আলাদা। এবং এসব সে বাপের বাড়ী থেকেই শিখে এসেছে। মেজ জা’ও জানাতে ভুললেন না যে তারও অভ্যাস নেই এরকম নোংরামী করার। স্বাভাবিক ভাবেই অভিযোগের তীর মেঘার দিকেই আসে। তারপরেও সরাসরি স্পষ্ট করে দিয়েই সুরমা বললেন, ” শোনো, ওরকম দু’পাতা লেখাপড়া করলেই কেউ বিরাট সংসারি হয়ে যায় না। এর জন্য চাই পরিবারের আদব।”
-” একদম ঠিক বলেছেন ভাবি। আমার আম্মারা তো…!”
কান বন্ধ করে জা’দের কথাগুলো শুনে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেঘা। অমনিই শ্বাশুড়ী আম্মা ঘরে ঢুকে বললেন, -” তিন কাউয়া চিল্লায় কেন ? কী করসো বৌমা ?”
মেঘা দীর্ঘশ্বাস চেপে মাথা নাড়ল। কোনো জবাব দিলো না। শ্বাশুড়ী গলা খাদে নামিয়ে বললেন, ” আজকা আর ঘরের বাইরে যায়ো না কিন্তু । ”
-” কেন মা ? ”
-” কামাইল্লা অর শ্বশুরবাড়ীর সবাইরে দাওয়াত দিসে। হেরা সবাই দুপুরে খাওয়া দাওয়া করব এইহানে । আমারেও অগো সাথে খাইতে কইসে। তুমি আমার লিগা দুপুরে রাইন্দো না।”
-” কিন্তু আমি তো সব রেঁধে ফেলেছি মা।” বলেই মেঘা সাথে সাথে বলল,” আচ্ছা, সমস্যা নেই। ফ্রিজে রেখে দেব। আচ্ছা, ওরা কী দুপুরের আগেই আসবে আম্মা ? ”
-” এই তো, জুম্মা পইড়াই আইসা পড়ব। তুমি কাপড় চুপড় যা ধোওনের আছে, তাড়াতাড়ি ধুইয়া ছাদে মেইল্লা দিয়া আসো। আমি আরশরে রাখি। যাও, জলদি করো।”
শ্বাশুড়ীর কথা শুনে মেঘা দ্রুত কাপড়ের বহর নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। আজকের কাপড় একটু বেশিই। গত কয়েকদিনে আরশ দুইটা চাদর নষ্ট করেছে। ওর নিজেরও থ্রি পীস সেট আছে চারটা। আম্মার শাড়ী দুইটা। আরশের একগাদা তো আছেই। যত দ্রুত সম্ভব হাত চালিয়ে কাপড়গুলো পিটিয়ে ধুয়ে শেষ করল মেঘা। দ্রুত কাজ করতে গিয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসার যোগাড় হয়েছে ওর। তারপরেও শেষ করতে পেরে খুশি লাগছে। এখন ছাদে মেলে দিয়ে গোসল সেরে ডোর লক করে আরশকে নিয়ে বসে থাকবে। সন্ধ্যের আগে আর বেরুবে না। সিদ্ধান্ত নিল মেঘা।
ধোয়া কাপড় নিয়ে দ্রুত ছাদে উঠেই বড়সড় ধাক্কা খেল বেচারী। সুরমা ভাবির দুই বোন দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এক কোণে। তারা মেঘাকে দেখে সরু চোখে তাকাল। তবে মেঘা সেসবের মধ্য দিয়ে গেল না। তার সমস্যা সুরমা ভাবির সাথে। তার বোনদের সাথে না। সে হেসে সালাম দিয়ে ভ্রু নাচাল।
-” কী খবর আপুদের ? কেমন আছ তোমরা ? ”
-” ভাল।” ছোটবোনটা জবাব দিলেও অপরজনের মুখ পুরোপুরিই গোমড়া। ছোট জন তবু সৌজন্যতার হাসি দিল।
ব্যাপারটা মেঘার কাছে খারাপ লাগলেও সে কিছুই বোঝেনি এমন ভান করে ছাদে কাপড় মেলতে মেলতে হালকা কয়েকটা কথা বলে সৌজন্যালাপ চালিয়ে গেল। হাজার হোক ওরা এ বাড়ীর অতিথি। মেঘা অন্তত তার পক্ষ থেকে অসম্মান দেখাবে না। তাছাড়া নিজেদের পারিবারিক সমস্যার জেরে বাইরের কারো সাথে মুখ ভার করে থাকা মেঘার ধাতে নেই।
কাপড় মেলা শেষ হলে বালতি নিয়ে নেমে যাবার আগে ফের বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরল মেঘা। সিঁড়িঘরে পা রাখতেই বর্ষণের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। ওড়না দিয়ে নিজেকে আগে থেকেই জড়িয়ে রেখেছিল কিন্তু আধাভেজা কাপড়ে এভাবে বর্ষণের সামনে পড়ে যাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো না। ক্ষণিকের জন্য প্রবল ইচ্ছে হলো বালতিটা মাথার উপর বসিয়ে নিচে নেমে যায়। কিন্তু চিন্তাটা নিতান্তই হাস্যকর।
থতমত ভাব কাটিয়ে উঠে দ্রুত পাশ কাটাতে গিয়েও আটকা পড়ে গেল মেঘা। কারণ বর্ষণ ইচ্ছাকৃত ভাবে সিঁড়ির পুরোটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা কিছু না বলে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।
বর্ষণ খানিক ইতস্তত করে বলল, ” কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আপনাকে এখানে পেয়ে গিয়ে ভালোই হল। আসলে ঐ দিনের ব্যপারটার জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। বিশ্বাস করুন, পুরো ব্যপারটা আমার অগোচরে ঘটে গেছে। আমি জানতাম না যে ওটা পরশ ভাই এর রুম। ”
-” না, না… ঠিক আছে।” বলে গ্রাম্য মহিলাদের মত ওড়নায় মুখ ঢেকে সংকুচিত হয়ে গেল মেঘা। বুকের ভেতর ড্রাম পিটছে। কোনোভাবে যদি সুরমা ভাবি কিংবা আম্মা ওকে বর্ষণের সাথে কথা বলতে দেখে ফেলে তাহলেই হয়েছে। আজই কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে ওর।
-” ইয়ে, আমি যাই..?” বলে বালতি এগিয়ে পথ করে নিতে চেয়েও দ্বিতীয়বারের মত ব্যর্থ হল মেঘা। একইসাথে যারপরনাই বিরক্তও হল। এই ছেলেটা কী ওকে বিপদে ফেলতে চায় ? এরা এমন কেন কে জানে। বিপদ বুৃঝতে চায় না। আর বুঝবে কেন। যত ঝামেলা তো যাবে তার উপর দিয়ে। বর্ষণের তো আর কিছু যাবে আসবে না।
নইলে সে নিজেই বুঝত যে মেঘার জন্য এটা কত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে !
বর্ষণ তখনও অন্য চিন্তায় মশগুল। মেঘার তৎপরতা ওর চোখে পড়ল না। সে তার মত বলে চলল, ” আপার কাছে শুনলাম আপনি আমার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা, দিয়েছেন ঠিক আছে। কিন্তু এটা কেন মনে হল আমি আপনাকে করুণা করতে চাচ্ছি ? আমি তো আরশকে মামা হিসেবেও দিতে পারি, তাই না ? ”
-” দেখুন, আপনি আরশের আপন মামা নন। ” একান্ত বাধ্য হয়েই ফোঁস করে উঠল মেঘা। কারণটা সম্ভবত চাপা রাগ। একে তো ছেলেটা ওর জীবনে নতুন সমস্যা তৈরী করেছে। এখন আবার পথ আটকে কৈফিয়ত দেয়া হচ্ছে। এটা ভাবছেনা যে তার এই আচরণ মেঘার জীবনে কত বড় ঝড় তৈরী করতে পারে। বর্ষণ ম্লান হাসল।
-” আপন না হলে বুঝি কিছু দিতে নেই ? ”
-” তা থাকবে না কেন ! তবে সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আপনি যে উপলক্ষে দিয়েছেন সেটা আমি পালন করিনা। মানে জন্মদিন।”
-” ওহ্…আচ্ছা। আমি সেটা জানতাম না। আপা বলল….!”
-” বৌমা…?” সিঁড়ির নিচ থেকে কোহিনূর বেগমের কণ্ঠ পেয়ে দৃশ্যতই চমকে উঠল মেঘা। কী করবে ভেবে না পেয়ে কান্ডজ্ঞানহীন একটা কাজ করে বসল সে। বালতি দিয়েই বর্ষণকে রীতিমত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের যাবার পথ তৈরী করে নিল বেচারী। তারপরেই ভীতা হরিণীর মতো করে নিচে ছুটল সে। এদিকে বর্ষণ বালতির গুঁতা খেয়ে বাহুতে হাত রেখে বিস্ময়াহত চোখে মেঘার যাওয়া দেখল। পরক্ষণেই মনে পড়ল ওটা আপার শ্বাশুড়ীর গলা। আপনমনেই মাথা নাড়ল সে। আরেকটা ভুল হয়ে গেল। বেচারী ভয় পাবে না কেন। বুড়ি দেখলেই তো আবার সন্দেহ করবে। আসলে নিজের কথাগুলো বলার এতোটাই তাগিদ বোধ করছিল যে পারিপার্শ্বিকতা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল বর্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ধীর পায়ে ছাদে উঠে গেল সে।
======
সন্ধ্যা পর্যন্ত মেঘা বাইরে পা দিলো না ভুলেও। যেন সে বাড়ীতেই নেই। অথচ বাড়ীতে একটা রমরমা অনুষ্ঠান চলছে। দুপুরে খাবারের সময় কোহিনুর বেগম মুখ থমথম করে সবার সাথে বসলেও বিকেলে চুপ থাকতে পারলেন না। বড় বৌমা কে একা পেয়ে ক্ষীণ স্বরে বলেই ফেললেন,
-” মেঘারে খাইতে ডাকো নাই ঠিক আছে। তয় একবাটি খাওন তো তুইলা দিতে পারতা বউ। সারাবাড়ির সবাই আমরা পোলাও খাইলাম। বিধবা বউটা সাদা ভাত খাইল। এইটা কী ঠিক করলা ? হাদীসে আছে, প্রতিবেশী যেন তোমার খাওনের গন্ধে কষ্ট না পায় তাই তারে দিয়া খাও। আর এইটা তো আমার ঘরের লোক। ”
সুরমা চাপা স্বরে গর্জে উঠল এবার।
– ” এইসব হাদিস আপনেরে যে বউ শুনায় সেই বউরে গিয়া শুনান গিয়া আম্মা। সাথে এইটাও শুনায়েন যে বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। বেয়াদ্দবের হদ্দ তো আনসেন একটা। আপনে জানেন, আমার মুখের উপর টাকা ফিরায়া দিসে সে। বলছে সে এসব? দুনিয়ার কথা শুনাইসে।”
কোহিনুর বেগম থমকে গেলেন। সুরমা তীব্র তীর্যক ভাষায় বলে চলল, ” কোন ছোটলোক বাড়ী থেকে যে এই ছোটলোকের ঝি রে নিয়া আসছেন আম্মা। বড়দের আদবই জানেনা। ঐ সব হাদীস অরেই গিয়া শুনান। আমরা ওর মত নকল দ্বীনদারী দেখাই না।” বলে সুরমা মুখ ঝামটে বেরিয়ে গেলে কোহিনুর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপরেই ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন। বুকের ভেতরে অজানা এক কষ্ট হচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে বমি করে খাবারগুলো ফেলে দিতে। তার আদরের নাতিটা পোলাও পেলে থাবা বসিয়ে দেয়। সেই কলিজার টুকরা নাতিটার মুখে একদানা খাবার না দিয়ে নিজে উদরপুর্তি করলেন সবার সাথে। এই কষ্ট যে কতটা ভারী তা দাদী না হলে কেউ জানবে না।
====
চোখটা একরকম লেগে এসেছিল মেঘার। ডোর লক করে আরশকে নিয়ে সেই যে ঘুমিয়েছিল তারপরে আর হুঁশ ছিল না। একদম মড়ার মত ঘুমিয়েছে। উঠে বসে উদভ্রান্তের মত ঘড়ির দিকে তাকাল মেঘা। দাঁতে জিভ কেটে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে অযু করল। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই বিরক্ত হল। ঘুমিয়ে টুমিয়ে চেহারার কী অবস্থা হয়েছে। চোখ দুটো ফুলে বিশ্রী দেখাচ্ছে। দ্রুত আসর আদায় করেই মনে পড়ল ছাদে কাপড় রয়েছে। ওগুলো নামাতে হবে। পরক্ষণেই এও মনে পড়ল বাড়ী ভর্তি মেহমান। এখন ছাদে যাওয়া মানে কারো না কারো মুখোমুখি হওয়া। তাছাড়া ঐ বদমাশ ছোকরাটাও তো আছেই। সব জেনে শুনেও ঢং করতে আসে। ফাত্রা একটা। থাপ্পড় মেরে দাঁতগুলো ফেলে দিতে পারলে জানটা ঠান্ডা হত। হিরো স্টাইলে রাস্তা আটকে কথা বলার ভন্ডামী ছাড়িয়ে দিত বেয়াদবটার। ইচ্ছে করে অকাজ করবে আর বোনকে দিয়ে কথা শোনানোর ব্যবস্থা করবে। ইতর কোথাকার।
বিমর্ষচিত্তে আকাশের দিকে তাকাল মেঘা। আকাশটাও ওর মনটার মতোই বিষন্ন। বৃষ্টি না এসে যায়। তাহলেই হয়েছে। অতগুলো কাপড় সব ভিজে যাবে। ইস্, পন্ডশ্রম হবে তখন। যদি সত্যিই ভিজে যায় তাহলে অতগুলো কাপড় কোথায় শুকাবে মেঘা।
আচমকা ঠকঠক শব্দে বুকটা ধড়াস করে উঠে ভাবনা জাল বিচ্ছিন্ন হল। সাড়া না দিয়ে আরেকবার টোকার অপেক্ষা করতেই ফের জোরে জোরে ধাক্কানোর শব্দে এবার সচকিত হল মেঘা। সন্তর্পনে জানতে চাইল, -” কে…?”
-” বৌমা….! আমি, খুলো…!”
শ্বাশুড়ীর কণ্ঠ পেয়ে দ্রুত দরজা খুলে অবাক হলো শ্বাশুড়ীর হাতে ভাঁজ করা কাপড়ের বিরাট টাল দেখে। তারচেয়ে বেশী অবাক হল শ্বাশুড়ীর পেছনে সুরমা ভাবির ছোট বোনটাকে দেখে। যে মেঘার সালামও নিয়েছিলো আবার কথার জবাবও দিয়েছিল। মেঘা কোনো কিছু ভাবা বা বলার আগেই মেয়েটা বলে উঠল, ” বৃষ্টি আসছে ভাবি। আপনার সব কাপড় ভিজে যাবে দেখে তাই বর্ষণ ভাইয়া আমাকে বলল, এসব ভাঁজ করে আপনাকে দিয়ে আসতে।”
কথাটা শুনে হাসার বদলে ঢোক গিলল মেঘা। চকিতে শ্বাশুড়ীকে এক পলক দেখে নিলো। তার হাবভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা কাপড় রেখে চলে গেল। মেঘা কাতর স্বরে বলল, ” বিশ্বাস করুন আম্মা, আমি কাউকে কিছু করতে বলিনি ।”
-” জানি। ” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কোহিনূর বেগম।” নেও, কাপড় ডি উডায়া রাখো।”
মেঘা কী বলবে ভেবে পেল না। মলিনমুখে কাপড়গুলো থাক ধরে ধরে ড্রয়ারবন্দী করতে লাগল সে। পেছন থেকে শ্বাশুড়ীর নরম কণ্ঠ শুনল, ” ভাত খাইসো ? ”
-” জি, আম্মা।”
-” ওহ…! আরশে খাইসে? ”
-” জি, আম্মা।”
-” ওও..হ!” বলে খানিক ইতস্তত করে বললেন, ” বর্ষইন্নার লগে দেহা অইসে তুমার?”
শুকনো ঢোক গিলে মাথাটা নাড়ল মেঘা। যেটা হ্যাঁ এবং না দুই’ই বোঝায়। কোহিনূর কী বুঝলেন কে জানে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন, ” ছ্যাড়ার হাবভাব ভালো ঠেকতাসে না। ”
-” কেন আম্মা ? কী করেছে বর্ষণ ? ” শুকনো মুখে জানতে চাইল মেঘা।
-” কিছু করণ লাগে নাকি আবার ? ” কোহিনুর আর কথা বাড়ালেন না। চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই পেছন থেকে মেঘা বলল, ” আম্মা। বর্ষণ আমার ছোটভাইয়ের মত। বয়সেও ছোট। সম্পর্কেও ছোট। ও যা মন চায় করুক তাতে আপনার বিচলিত হবার কিছু নেই আম্মা।”
কোহিনূর মেঘার দিকে তাকালেন। কঠিন স্বরে বললেন, ” বয়সে ছোট অইলে সম্পর্ক অয়না কেডায় কইসে তুমারে ? আমগো ধর্মে নিষেধ আছে না আইনে ? ”
মেঘা পুরোপুরিই ফ্লপ খেয়ে গেল এবার। কোহিনুর ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যেতে যেতে বললেন, ” দরজাটা আটকায়া দাও। ছেমরা ঘুরঘুর করতাসে।”
চলবে…..