মেঘ পরশে বর্ষণ পর্ব ২+৩

#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২+৩ ||

রাগ করে দুপুরে ভাত খেলো না মেঘা। যদিও অতগুলো কাজ করার পর প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো কিন্তু তারপরেও রাগ করেই ভাত খায়নি সে। সেকারণেই বিকেলের দিকে মাথাটা প্রচন্ড ধরে গিয়েছিলো। হয়তো থিতিয়ে যাওয়া খিদে থেকেই। হাত পাগুলোও কাঁপছিলো একটু একটু। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, না খেয়ে থাকলে এ বাড়ীতে কারো কিছু যাবে আসবে না। তারপরেও খায়নি মেঘা। আসলে ওর খেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে আছে। যতবারই শ্বাশুড়ী আম্মার সন্দেহভরা চোখটা মনে পড়ছে ততবারই কষ্টে কান্না পেয়ে যাচ্ছে ওর। কোনো দোষ না করেও আজ শ্বাশুড়ীর দৃষ্টিতে সে ব্যাভিচারিনী। তিনি সরাসরি একথা না বললেও তাঁর ইঙ্গিত ছিলো স্পষ্ট। তাছাড়া কথাটা বলার পর তিনি একবারের জন্যেও স্যরি হননি। এমনকি সেই দুপুরের পর থেকে ওর সামনেই আর আসেননি তিনি। এমনিতে আরশ ঘুম থেকে ওঠার পরপর তিনি প্রতিদিন বিকেলে মেঘার ঘরে চলে আসেন। নাতিকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন অনেকক্ষণ। খেলাধুলা করেন ওর সাথে। মেঘা অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরী করে নিজেও খায় শ্বাশুড়ীকেও দেয়। অবশ্য ছুটির দিনে কিছুটা ব্যাতিক্রম থাকে। সেদিন মেঘা ঘর ঝাড়ে, কাপড় ধোয়। আর এই পুরোটা সময় আরশ দাদীর কাছে থাকে। গত একটা বছর ধরে এমনই হয়ে আসছে। কারণ বুয়া নেই মেঘার। বুয়া রাখবে কী করে। মেঘা আধাবেলা বাসাতেই থাকেনা। তার উপর তিন জায়ের যে আচরণ তাতে বুয়া একদিনও টিকবে না। কথায় কথায় খুঁত ধরে তারা। পরশ বেঁচে থাকতেই তো ওদের সাথে পারা মুশকিল ছিলো। আর এখন তো অসম্ভব। তারচে কষ্ট করে নিজের কাজ নিজে করে এটাই ভালো। যদিও মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠে মেঘা। সত্যিই তো, এভাবে আর কদিন। ভাবির কথা মনে পড়ল। তিনি বেশ কয়েকবার ওকে নতুন করে জীবন শুরুর কথা ভাবতে বলেছিলেন কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া পায়নি মেঘা। পরশ এখনও মনের মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে। তারচে বড় কথা তার আরশের কী হবে। সৎ বাবা নিশ্চয়ই আরশকে সহজ ভাবে নেবেন না। তাছাড়া ওর শ্বাশুড়ী ওর ধারেকাছে কাউকে ঘেঁষতে দিতে রাজী নন। এ কারণেই পরশের ফ্ল্যাটের কাগজপত্র থেকে শুরু করে ওর ডেথ সার্টিফিকেট সহ আরো যা আছে সব নিজের কাছে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এই একটা ব্যপারে তিনি তার তিন ছেলের সাথে হাত মিলিয়েছেন। তার ধারণা মেঘা এসব কাগজপত্র পেলেই সব বেচা কেনা করে উড়াল দেবে।

ভাবতে গিয়ে দু’চোখ জ্বালা করে উঠলো মেঘার। গালে সুড়সুড়ি অনুভব করে হাত দিতেই সেখানে পানির উপস্থিতি পেয়ে বুঝলো কাঁদছে সে। অমনিই ফোন বাজল। হাতে নিয়ে দেখলো ভাবির ফোন। যথাযথ সময়েই ফোন করেছে ভাবি। কারো সাথে কথা বলে বুকটা হালকা করতে ইচ্ছে করছে ওর। দ্রুত রিসিভ করে কানে ঠেকালো,
-” বলো ভাবি।” ভেজা স্বর মেঘার। ভাবির কানে বাজলো। থমকে গিয়ে বললেন,
-” কাঁদছিলি নাকি ? ”
মেঘা জবাব না দিয়ে নাক টানলো। ওপাশ থেকে ভাবি বললেন, ” কী হয়েছে বল তো ? ”
-” কী আর হবে। সবই আমার ভাগ্য।”
-” ভাগ্য তো জানি। ঘটনা কী সেটা বল।” ভাবির কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না মেঘা। দুপুরের ঘটনা আদ্যোপ্যান্ত খুলে বললো। বলতে গিয়ে আরেকবার কেঁদে ফেললো সে। ভাবি নিরবে সব শুনে বললেন,
-” তোর শ্বাশুড়ী আসলে ঠিক সন্দেহ করেনা, সে ভয় পায়। তুই না পর হয়ে যাস।”
-” উনি স্পষ্ট বলেছেন যে ছ্যামড়া তোমার ঘরে কেন ? ”
-” এটা তার কথা বলার ধরণ। তাছাড়া পুরোনো দিনের মানুষ তো।”
-” আমার এ বাড়ীতে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করেনা ভাবি। কিন্তু কোথায় যাব বলো। তোমরা ঢাকায় থাকলে তোমাদের কাছে চলে যেতাম।”
-” ওটা কোনো সমাধান হতো না। সে যাই হোক, তোর রিএক্ট করা উচিত ছিলো।”
-” করেছি তো। আম্মাকে বলেছি যে, আপনার কী মনে হয় আমি ডেকে এনেছি? ”
-” এই রিএকশন না। কড়া রিএকশন। কারণ তোর বড়জা এটা ইচ্ছে করে ঘটিয়েছে। তুই কী বুঝতে পারছিস না এটা ? নইলে সব জেনেশুনে সে তার ভাইকে পাঠাবে কেন তোর বাথরুমে ? এই প্রশ্নটা তোর তাকে করা উচিত। তুই যদি আজ নিরবে সব মেনে নিস তাহলে আরো বড় ঝামেলার জন্য অপেক্ষা কর। সে কাল আরেকজনকে পাঠাবে তো পরশু….!’
-” আমি কী করব তাহলে ? ” ভাবিকে থামিয়ে দিয়ে বললো মেঘা।
-” কী করবি মানে ? ” সরাসরি গিয়ে জিজ্ঞেস করবি। তুই পুরো ব্যপারটা খোলাসা করে বুঝিয়ে দে যে এটা তোর জন্য সম্মান হানিকর। আর তার এই কাজটাতে তুই রাগ করেছিস। এতে তোর শ্বাশুড়ী আর জা দুজনই সাবধান হবে। তোর জা আজ এটা ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় করলেও পরের বার করার সাহস পাবেনা। কিন্তু আজ একেবারে কিছু না বললে সে তোকে দুর্বল পেয়ে আবার এরকম করার সাহস পাবে আর দোষ তোর উপর ফেলবে।”

বড়ভাবির সাথে কথা বলার পর থেকে মাথাটা ভার হয়ে আছে। ভাবির কথাগুলো নিরেট সত্যি। মেঘা আজ যদি এটা নিয়ে সাউন্ড না করে তাহলে এরা পেয়ে বসবে ওকে।মেঘার মনে পড়লো। মাত্র কিছুদিন আগেও সেজ ভাবির ঘরে গেস্ট বেশী আসায় উনি অর্ধেক গেস্ট মেঘার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রিল্যাক্স করার জন্য। সেদিন ব্যপারটা অন্যরকম ছিলো বলে মেঘা গা করেনি। কিন্তু আজ তো বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। এরপর নিরব থাকাটা অন্যায় হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে উঠে বসলো মেঘা। কয়েক সেকেন্ড নিরবে বসে থেকে ভাবলো কিছু। হয়ত সাহস সঞ্চয় করলো। কারণ সে জানে সে যুদ্ধে নামতে যাচ্ছে আর ওর প্রতিপক্ষ একটা জোট। পক্ষান্তরে সে একদম একা। আজ তো আম্মাকেও পাশে না মনে হয়। সে আজ ওদের দলেই। থাক্, মেঘা একাই লড়বে।যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন। মেঘা উঠে বাইরে চলে এলো। বড়জা’কে আগে রান্না ঘরে খুঁজতে হবে। এসময়উনি রান্নাঘরেই থাকেন। মেঘার ধারণা সত্যি।
রান্নাঘরে উঁকি দিতেই বড় জা’কে পেয়ে গেলো। শান্ত ভঙ্গিতে সরাসরি চার্জ করলো তাকে মেঘা। ইচ্ছে ছিলো মেজাজ সামলে কথাটা বলবে কিন্তু বলতে গিয়ে চাপা ক্ষোভটা প্রকাশ পেয়ে গেল।
– ” ভাবি ? আপনি নাকি আপনার ভাইকে আমার বাথরুম ব্যবহার করতে বলেছিলেন?”
সুরমা ছেলেমেয়ের জন্য পাস্তা রান্না করছিলেন। না বোঝার ভান করে তাকালেন তিনি।
-” কিসের কথা বলছো বৌ..? ”
এই এক নতুন ঢং হয়েছে তার। মেঘা না ডেকে বৌ ডাকা। যেন তিনি জা নন, শ্বাশুড়ী। মেঘাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া যে তুমি সেদিনের বৌ। মেঘা দমে না গিয়ে সমান তেজে বললো, ” কিসের কথা বলছি তা আপনি ভালোই জানেন ভাবি। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি আপনার ভাইকে আমার বাথরুম ব্যবহার করতে বলেছিলেন কেন ? সে কেন আমার রুমে ঢুকবে ? ”
-” কার কথা বলছো, বর্ষণ ? ” ভাবি বিস্মিত হলেন মেঘার বলার ভঙ্গি দেখে।
-” বর্ষণ না বজ্রপাত তা জানি না। তিনি আমার রুমে ঢুকবেন কেন সেটা জানতে চাচ্ছি। একজন ভদ্রমহিলার রুমে যে না বলে ঢুকতে হয়না এই ম্যানার্সটা কী আপনার ভািকে শেখান নি ? ” মেঘার কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়ল। এটা মেঘার একটা দুর্বল দিক। সহজে রাগে না তবে রেগে গেলে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। বড়ভাবি বাঁকা চোখে তাকালেন। তবে রাগলেন না। খুবই হার্ডনাট। মেঘা ভাবলো। এই মহিলা মানুষের মাথা ফাটিয়ে ফেলবে কিন্তু বারি মারার আগে চেহারা এতটুকু কুঁচকাবে না। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারদের মত। এই মুহূর্তেও কত সংযত। অথচ মেঘাকে সে ঠিকই সুযোগ মতো ধরবে। তা ধরুক। মেঘা আজ ভয় পাবেনা। কেন তারা এমন করছে ওর সাথে তা জানতে হবে মেঘার। সে এ বাড়ীর আশ্রিতা না যে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করবে। এ বাড়ীতে সুরমা ভাবির যতটুকু অধিকার আছে ঠিক ততটুকু অধিকার তার নিজেরও আছে।
সুরমা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-” ভাব তো এমন করছো যেন বাড়ী লিখে দেয়া হয়েছে তোমার নামে ? ”
-” লিখে দিতে হবে কেন। আমার রুম আমার ব্যক্তিগত। কারণ ওতে আমি থাকি। আর এটা আমার স্বামীর ঘর। স্বামীর ঘরে বৌ’রা লেখাপড়া ছাড়াই থাকে। এখন আপনি যদি মনে করেন যে লেখালেখি ছাড়া ঐ রুম আমার অধিকারভুক্ত না তাহলে বড় ভাইয়াকে বলে আমার অংশ আমার হাতে তুলে দেন। আমি আমার মত করে শান্তিতে থাকি।” রাগে এক গাদা কথা বলে হাঁপাতে লাগলো মেঘা।
বড় ভাবি বিস্ময়ে এবার বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মেঘা এভাবে কথা বলতে পারে। তিনি কোনো জবাব না দিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

গভীর রাতে বিচার সভা বসল। মেঘার ডাক পড়লো সে সভায়। মেঘা জানতো যে এরকমটা হবে। সে মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত ছিলো। আজ এই সুযোগে সে তার স্বামীর অংশ চেয়ে নেবে। এভাবে থাকতে রাজী নয় সে। এরা মানুষ নামের কলঙ্ক। মেঘার সরলতার সুযোগে এরা মেঘাকে অপদস্থ করতে চায়। মেঘা সে সুযোগ দেবে কেন। সে পরশের অংশ নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। থাকবেনা সে এদের সাথে। আর এটা চাওয়ার অধিকার আছে মেঘার। তাছাড়া যারা ওর সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তাদের সে কীভাবে বিশ্বাস করবে। মেঘা এদের মোটেই বিশ্বাস করেনা। ওর বড়ভাবিও ফোনে তখন বলে দিয়েছেন। তুই সাহস করে প্রসঙ্গটা তুলবি। তোর দাবী পেশ করবি। তারপর তোর ভাইয়াকে নিয়ে আমি ঢাকায় এসে পাঁচজন ডেকে পরশ ভাইয়ের অংশ আলাদা করার কথা বলব।

জামার উপর বড় হিজাব চাপিয়ে জড়ানো পায়ে বেরিয়ে এলো মেঘা। আরশকে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছে ঘরে। মজলিসে এসে শ্বাশুড়ীকে আগে থেকেই সবার সাথে বসে থাকতে দেখে কিছুটা দমে গেল মেঘা। তারমানে আজ আম্মাও ওর পক্ষে নেই। মৃদু স্বরে ভাসুরদের সালাম দিলো মেঘা। বড় ভাসুর সালামের জবাব নিলেন কিনা বোঝা গেলো না। তবে কেউ ওকে বসতে বললো না। বড়ভাসুর সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন।
খাঁকারি দিয়ে বললেন, ” তুমি কী বলেছ সুরমাকে ? ”
মেঘা মুখ নামিয়ে বললো, ” ভাবিকে যেটা বলেছি সেটা তো ভাবি আপনাকে বলেছে ভাইয়া। আমি বারবার একই কথা রিপিট করতে চাচ্ছিনা। তবে দ্বিতীয় যে কথাটা আমি বলেছি সেটা আবারও বলছি। আমাকে আমার স্বামীর অংশ বুঝিয়ে দিন। প্লিজ। আমাকে আমার অংশ বুঝিয়ে দিন, আমি আলাদা হয়ে যাব ভাইয়া…!”
-” তোমার স্বামীর অংশ মানে ? আমাদের বাড়ী কী ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে নাকি ? ”
-” না হয়েছে তাতে কী ভাইয়া ! একদিন তো হবে। আপাতত, আমাকে সেপারেট করে দিন। পরে ভাগে যা পাবো তাই নেবো। পশ্চিম দিকের সিঙ্গেল ফ্ল্যাটটা তো ছোট। আমি নাহয়….!”
-” এটা তোমার বাপের বাড়ী না যে ফটাফট কথা বলছো। ঐ ফ্ল্যাট আম্মার নামে। তাছাড়া তুমি কে ভাগ চাওয়ার ? আজ পর্যন্ত তোমার বড়জা একদিনও এসব কথা মুখে আনেনি আর তুমি কিনা এখনই ভাগ চাও ? সাহস আছে বলতে হবে ! ”
-” এতে সাহসের কী দেখলেন ভাইয়া ? আমার স্বামীর অংশ কী আমি চাইতে পারবো না? ”
-” একশবার পারতে যদি তুমি স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে। ” রীতিমত গর্জে উঠলেন বড়ভাসুর কামাল। মেঘা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
তিনি বলতে লাগলেন, ” কিছু বলিনা বলে ভেবোনা আমরা বোবা। শুধু তোমার কারণে আমার কলিজার টুকরা ভাইটা অল্প বয়সে মরে গেলো। সব জানি আমরা কিন্তু ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ ছিলাম। তোমার কারণেই আমার ভাইটা…!” ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন কামাল। বাকি দুই ভাই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মেঘার মনে হলো, নাটকটা তাহলে এভাবে সাজানো হয়েছে ?

চলবে…..

#মেঘ_পরশে_বর্ষণ

৩||
শ্বাশুড়ী আম্মা পুরো সময়টা ধরেই নিরব ছিলেন। তিনি এবার মুখ খুললেন, ” এত কথার দরকার নাই। ওর জায়গা ওরে বুঝায়া দে। ও ওর মতো থাকলে থাইক না থাকলে চইলা যাইক। ”

কথাটা যেন পুরো ঘরে বাজ ফেলল। প্রায় সাথে সাথেই হৈ হৈ করে উঠলো ভাসুরের দল। সুরমা মুখ ঝামটে বলে উঠলো, ” যা বলছেন ভেবে বলছেন ? আন্দাজে একটা কথা মনে আসলো আর বলে দিলেন ? নাকি ছোট বঊ রে এখনও বিশ্বাস করেন অনেক ? সে সারাদিন কই যায় কী করে সব জানেন আপনি ? কাদের সাথে মিশে কেমনে চলে খবর রাখেন ? আমরা সবই জানি। হুঁহ্…! আমার দেবর মরছে ঠিক। কিন্তু তার শরীরে কোন ভাজ পড়তে দেখসেন ? ”

মেঘার বিস্ময় মাত্রা ছাড়ালো ভাবির এ কথায়। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো সুরমার দিকে। ভাবতেই পারেনি যে আঘাতটা এদিক দিয়ে আসবে। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইলো মেঘার। কী বলবে ভেবে পেলো না সে।
বড় ভাসুর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ” তোমার মাথা খারাপ হলেও আমাদের হয়নি। কোনো জায়গা বুঝায়া দেওয়া দেওয়ি নাই। তোমার ছোট ছেলের বউরে যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই নাই এটা তার সাত কপালের ভাগ্য। ওর নামে বহুত বদনাম আছে। আমার মুখ খুলায়ো না।”

মেঘা স্তম্ভিত, স্তব্ধ। নির্বাক নিরুত্তর হয়ে বসে রইলো মিনিট খানেক। জা আর ভাসুরেরা তাদের তুবড়ী ছুটিয়ে চলেছে। মেঘা মুখ নামিয়ে বসে থাকতে থাকতেই শুনলো শ্বাশুড়ী বলছে, ” আহা, আমি অর দুই আনা বুঝায়া দিতে কইসি। আমার আরশের সম্পত্তির কথা কই নাই। আরশ আমার কাছেই থাকবো। পরশের বউ গেলে যাইক গা। আমি আমার নাতির ভাগ কারো হাতে দিমু না। ”

কোহিনুরের বক্তব্য ধরতে পেরে বাকিরা এবার শান্ত হয়ে এল। যদিও মেঘার অংশ তাকে বুঝিয়ে দেবার ব্যপারে তাদের মত নেই কিন্তু মেঘার জন্য উপযুক্ত জবাব হয়েছে ভেবে সবাই ঠান্ডা মেরে গেল এবার। মেঘা শ্বাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনারা আসলে মানুষ না, পাষান। আমাকে একা আর অবলা পেয়ে উল্টা পাল্টা ভয় দেখিয়ে ভাবছেন আমি দমে যাবো ? আচ্ছা, ঠিকআছে। আমিও দেখে নেব। কোর্ট এই নাবালকের সম্পত্তির দায়িত্ব কাকে দেয়।” বলেই মেঘা ঝড়ের বেগে উঠে এলো সেখান থেকে।
এদিকে সবার মুখে যেন তালা পড়ে গেছে। মেঘা বেরিয়ে যাবার পরপরই মেজজা বিড়বিড় করে বললেন, ” এবার তোমরা বসে বসে দেখো তার আসল রূপ। আমি তো একে আগেই বুঝেছি। পরশের সামনে আলাভোলা সেজে থাকতো। ভাবখানা সতী সাবিত্রী। আর এখন তার মেজাজের টেম্পারেচার দেখো। তোমাদের সবাইকে ঠিকই কাচারি দেখাবে এই মেয়ে। ”

-” আরে দুর, এসব টেম্পারেচার, এক মিনিটে নামানো যায়। কাচারি কী আমরা চিনিনা?” মেজভাসুর বলে উঠলে কামাল ধমক দিয়ে ছোটভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ” এসব বাজে কথা রাখ আর মনু উকিলের সাথে কথা বলে দেখ, আরশের সমস্ত সম্পত্তি আম্মার নামে ট্রান্সফার করা যায় নাকি।”

=====

নিজের ঘরে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মেঘা। রাতেই ফোন দিলো ভাবিকে। রেহানা সব শুনে বললেন, ” এটা একটা ভালো কথা বলেছিস তুই। আরশ আর তোর অংশ বুঝে নিয়ে সাইড হয়ে যাওয়াই ভালো। তোর শ্বাশুড়ী পুরোনো দিনের মানুষ। তার মানসিকতা একটু খুঁতখুঁতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত একটা বছর সে তোকে সামলে রেখেছিলেন এদের কাছ থেকে। কারণ তিনি তোকে পছন্দ করেন। সেটা যে কারণেই হোক। কিন্তু এখানে তোর সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাজেই তিনি ছেলেদের সাথে একমত হবেন এটাই সাধারণ যুক্তি। তোর মনে পড়ে, তোর বিয়ের পরপর তোর চাকরী নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তোর শ্বাশুড়ী ? কারণ তার মনে সবসময় এই সন্দেহ দানা বেঁধে থাকতো যে তুই ওখানে ব্যাটাদের ধাক্কা খেয়ে কাজ করিস, যেটা তার পছন্দ না। কিন্তু তারপরেও তখন পরশ ছিল বলে ব্যপারগুলো সে ছেলের উপর ছেড়ে দিতেন। এখন তো পরশ ভাই নেই। তোর জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তােকে কাজ করার অনুমতি দিতে তিনি একরকম বাধ্য হয়েই রাজী হয়েছেন। তাছাড়া তোর এমন কোন অবলম্বনও নেই যেটা আঁকড়ে ধরে বাঁচবি। দুনিয়াতে তোর আপন বলতে আছি আমরা। তোর ভাইয়া নিজেরই শতেক জ্বালায় ব্যস্ত। চাকরী আজ আছে তো কাল নাই। আমাদেরই হিমশিম অবস্থা। তাই বলি কী, লড়াই করে হলেও নিজের সবকিছু বুঝে নে। এরা তোর সাথে এমনই করবে। তোকে বদনামে ফেলতে পারলে ওদেরই লাভ। কাজেই যা করবি বুঝে শুনে কর। আচ্ছা, ভালো কথা। তোর কোন কলিগ না আছে যার বোন লইয়ার ? ঐ যে একবার বোনকে নিয়ে তোর জন্মদিনে এসেছিলো আমাদের বাসায় ! ”
-” হ্যাঁ, মাহবুবা। কিন্তু ও তো কবেই চাকরী ছেড়ে চলে গেছে।”
-” চলে গেছে তাতে কী হয়েছে। ফোন নম্বর তো আছে। ফোন করে কথা বল। তোর সাথে তো ভালো খাতির ছিলো। ”
-” আচ্ছা, দেখি। কিন্তু ভাবি। কোট কাচারী করতে গেলে তো অনেক টাকা পয়সা লাগবে। ভাইয়া কী কিছু দিতে পারবে আমাকে ? ”
-” আরে না তোর ভাইয়া। তুইও কী বলিস। সে কোত্থেকে এত টাকা দেবে ?”
-” ওহ্….! ” মেঘা পুরোপুরিই দমে গেল এবার। ম্লান সুরে বললো, ” তো ভাইয়া এসব শুনে কী বললো তোমাকে ? আমার এখন কী করা উচিত ? কোর্ট কাচারী করলে ভাল হবে সেটা?আমি তো একা।”
-” আরে তোর ভাইয়াকে এসব জানিয়েছি নাকি ? সে তার নিজের জ্বালাতেই বাঁচেনা তার উপর এসব চিন্তা মাথায় ঢুকালে বেচারার প্রেসার বেড়ে যাবে। ”
-” কিন্তু ভাইয়া ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই ভাবি। কিছুটা তো আভাস দিতে পারতে। এতবড় সিদ্ধান্ত আমি একা কীভাবে নেই ? যদি ভুল কিছু হয়। তাছাড়া কোর্টের খরচও তো আমার একার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব না। এত টাকা কোথায় পাবো আমি ? ”
-” তোর ভাইয়ার সব কথা জেনেও এভাবে বললে কষ্ট লাগে রে…! তাছাড়া, তোর গহনাগুলো আছে কী কাজে। ওগুলো বিক্রি করে দে। ওগুলো তো তুই আর এমনিতেও পরবিনা। আজ বিপদের দিনে সেগুলো কাজে না এলে ওসব গহনা পোটলা বেঁধে রেখে কোনো লাভ আছে ? কোনদিন দেখবি ওরা ঘুমের ঔষধ খাইয়ে আলমারি খুলে নিয়ে গেছে সব। তারচে ওগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়ে মামলা চালা আর বাকি টাকা ব্যাংকে রেখে দে। মাসে মাসে রিটার্ণ পাবি কিছু। এখন তো বসে বসে খালি খালি যাকাত দিতে হচ্ছে। তখন উল্টো টাকা পাবি। লাভ কী। বরং পঞ্চাশ লাখ টাকার সম্পত্তি হাতে পেয়ে যাবি। পঞ্চাশ লাখ আয়ের জন্য পঞ্চাশ হাজার ব্যয়….,এটা তো তোকে করতেই হবে। যাই হোক, রাখি রে। সকালে তোর ভাইয়ার অফিস আছে। ”

মেঘা স্তব্ধ হয়ে পুরো কথাটা শুনলো। ভাবি ফোন রাখার কথায় ধ্যানভঙ্গ হলো ওর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আচ্ছা ঠিক আছে। রাখো। তবে ভাইয়াকে আমার ব্যপারটা জানিও। হুট করে বললে ভাইয়াই রাগ করবে তাকে জানাইনি বলে। তুমি বললে আমি সরাসরি ভাইয়াকে ফোন করে বলতে পারি। তুমি আবার কী না কী ভাবো।”
-” আরে না না। তোর ফোন করে বলার দরকার নেই। ও আমি সময়মতো বলে দেবনে। ওটা নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর ভাইয়ার মুড বুঝে কথাটা বলব আমি। তুই হুট করে ফোন করলেই বরং ও টেনশন করবে বেশী। ”

ফোন রেখে চুপচাপ বসে রইলো মেঘা। ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে ওর চোখ থেকে। ভাবির কথায় এখানে ঝগড়া বাঁধিয়ে তো মনে হচ্ছে বিপদেই পড়া গেল। এজন্যেই লোকে বলে সব মহিলাদের বুদ্ধি নিতে নাই। গত দুই বছরে এ বাড়ীর শত প্রতিকূলতা সহ্য করে এসেছে মেঘা। পরশ মারা যাবার পরের মাসগুলোতেও ঝামেলা দানা বাঁধতে পারেনি মেঘার সহনশীলতার কারণে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কাজটায় বোকামী হয়ে গেল। তাছাড়া ভাবির টোনটাও কেমন যেন চেঞ্জ বলে মনে হচ্ছে ওর কাছে। তিনি বিকেলে বললেন এক কথা, এখন বলছেন আরেক কথা। যেই না ঝামেলা ভাইয়ার দিকে গেল অমনি তার টোন বদলে গেল। মেঘার গহনা গুলোর দিকে আঙ্গুল তুললেন তিনি। মেঘা জানে ভাবি ওর গহনার যাকাত দেয়া পছন্দ করেন না। কিন্তু মেঘা নিজে ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাংকের রিটার্ণ খাওয়ার পক্ষপাতি না। সন্দেহজনক টাকা পেটে ঢুকাতে চায় না সে। এ নিয়েও ভাবির রাগ। তার মতে মেঘার চাকরীর পয়সাও নাকি হালাল না। মেঘা তার সাথে এসব তর্কে যায় না। দ্বীন পুরোটা মানতে পারবে না বলে কিছুই মানতে পারবে না এটা তো কোন কথা না। যতটুকু সহজ আর সম্ভব ততটুকু মানতে সমস্যা কী। মেঘা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ভাবি ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি অবলম্বন করছেন। তিনি সবটাতেই থাকবেন কিন্তু ভাইয়াকে থাকতে দেবেন না। খুলনাতে বসে কলকাঠি নাড়বেন আর তার কথায় মেঘা নিজের ঘরে আগুন লাগাতে থাকবে।

দুই হাঁটুর ভাঁজে মুখ রেখে এবার কেঁদে ফেলল মেঘা। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করার পর মনটা শান্ত হয়ে এলে বিছানা থেকে নেমে ঘড়ি দেখল একবার। আর কিছুক্ষণ পরই ফজরের আযান হয়ে যাবে। এখন ঘুমিয়ে লাভ নেই। উঠে গিয়ে অযু করে জায়নামাজে বসতেই শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো ওর।

নামাজ শেষে মনটা অনেকটাই শান্ত হয়ে এল। নিজ হাতে চা বানিয়ে খেলো মেঘা। মনে পড়ল এ সময় আম্মাও নামাজের জন্য ওঠেন। বাকি লিকারটুকু ছেঁকে নিয়ে চা বানিয়ে আম্মার রুমে চলে এলো।

কোহিনূর ঘরের দরজা লাগান না। কারণ রাত বিরেতে শরীর খারাপ করলে তখন কে তাকে দেখবে আর কে দরজা খুলবে, তাই দরজা ভেজানোই থাকে।
মেঘা দরজায় হালকা টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই কোহিনূর কিছুটা চমকে উঠলেন তবে মুখোভাবে তা প্রকাশ পেলো না। মেঘা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মৃদু স্বরে বলল, ” আমাকে ক্ষমা করে দেবেন আম্মা।”
কোহিনূর মেঘার দিকে তাকালেন। বোঝার চেষ্টা করলো মেঘার কথাটা। মেঘা সেদিকে না তাকিয়ে বলে চলল, ” এ বাড়ীতে আমার সত্যিকারের আপনজন একমাত্র আপনি। তাছাড়া বিয়ের পর থেকে আপনার দিক থেকে কখনও কোন আঘাত আমি পাইনি। গতকালকের ঘটনাটায় আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছেন এটা আমার জন্য কতটা কষ্টের তা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু বিশ্বাস করুন আম্মা, আমি আজ পর্যন্ত সেধে কথা পর্যন্ত বলিনি ভাবির ভাইয়ের সাথে। তাছাড়া আপনার কী মনে হয়, বড় ভাবির ভাইকে আমি ঘরে ডেকে এনে নোংরামী করব ? আমার কী নিজের মানসম্মান নেই ? এও কী সম্ভব ? এরকম করতে চাইলে তো আমি বাইরেও করতে পারি। সব বাদ দিয়ে ভাবির ভাইকেই ডাকব কেন আপনিই বলুন। যেখানে সুরমা ভাবি নিজেই আমার সাথে লেগে থাকেন দিনরাত। তার ভাইকে কী আমি আমার রুমে ডাকবো নিজের মানসম্মান খোয়াতে ? আপনিই বলুন ? আপনার বুদ্ধি বিবেচনা তো আমার চেয়ে অনেক বেশী।”

কোহিনুর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, ” শুন মেঘা। তোমারে আমি সন্দেহ করিনাই। তয় আমি চাইসিলাম বিষয়টা নিষ্পত্তি হোউক। সুরমার ভাই তোমার ঘরে কেন গেসে সেটা নিয়া কথা উঠুক, সবাই জানুক। কিন্তু তুমি ঐ কথা না তুইলা সয় সম্পত্তির দিকে চইলা গেলা। কামটা কী ঠিক করসো ? ”

-” না, ঠিক করিনাই আম্মা। এটা আমার ভুল হয়েছে। ” বলে মনে মনে নিজের ভাই বৌ উপর আরেকবার বিতৃষ্ণা জন্মাল। গরম মাথায় সেই ওকে উসকে দিয়ে স্থান কাল পাত্রের বিবেচনা ভুলিয়ে দিয়েছে। মেঘা সুর নরম করে বলল ,” এর জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই আম্মা। অন্তত আপনি যে আমাকে ভুল বুঝেন নি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। বাকিদের নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে ভাবির ভাই কাজটা ভালো করেনি। তার উচিত হয়নি বোনের ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে আমাকে অপদস্থ করা। লোকটাকে পেলে আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম! ”

-” কুনু দরকার নাই। বর্ষইন্যা দুইন্যার চ্যাংড়া। অর লগে কথা কওনের কাম নাই। অরে দেখলে দরজা দিবা। ছ্যামড়া দুই দিন পরপরই বোইনের বাড়ি আইসা ভাত খাইতে বইয়া যায়। লাগে যেমুন আমার চাইলের আড়ত আছে। বড় পোলার শালা লাগে দেইখা কিছু কইতেও পারিনা। যাই অউক। তুমি এইটা নিয়া আর কথা বাড়ায়ো না। আমি কামাইল্লারে থামাইতাসি। তয় সুরমার থেইকা তুমি সাবধান থাইকো। সে তোমারে সহ্য করতে পারেনা। নাইলে এতবড় অঘটন ঘটাইত না। ও কেন তোমারে সইহ্য করতে পারেনা হেইডাও আমি বুজি। কিন্তু কওনের কিছু নাই। তাই তোমারেই সাবদান থাকতে অইব।”

-” আমি আর কিভাবে সাবধান থাকব আম্মা। আপনি তো দেখেন আমি কারো সামনে সহজে যাই না। বর্ষণ যে এ বাড়ীতে আসে। কোনদিন ওর সামনে পড়িনি। কেবল ভাইয়ার ছেলের রেজাল্টের দিন দেখা হয়েছে। ভাবিও তো সব জানে। জেনেশুনেও বাসায় এতোগুলো বাথরুম থাকতে ভাবি তার ভাইকে আমার বাথরুম পাঠালো। এতেই তো স্পষ্ট হয়, যে সে আমাকে বদনাম করতে চায়।”

-” আচ্ছা, বাদ দাও এখন এসব কথা। চা খাইয়া শুইয়া পড়ো গিয়া। চোখ দুইটা তো গর্তে বইসা গেছে এক রাইতেই।” বলে শ্বাশুড়ী আম্মা নিজের মত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেঘা নি:শব্দে নিজের ঘরে চলে এল। মাথার মধ্যে চলছে বিচ্ছিন্ন ভাবনা। কোনোটারই কূল কিনারা মিলছেনা। বর্ষণকে সে ভালো জানতো। বড় ভাবির মুখেই খুব নাম শুনেছিলো তার। কিন্তু আজ প্রমান হলো সেও তার বোনের মতোই কূটচালের লোক।

====

সকালে রান্নাঘরে সুরমার সাথে দেখা হলো মেঘার। সুরমা প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিক। মেঘা নিজেও স্বাভাবিকই রইল। কারণ এ বাড়ীর একটা জিনিস সে বুঝে গেছে । এরা ভেতরে যতটাই কুটিল থাক না কেন, বাইরে ততটাই ভদ্র আর শান্ত । মুখোশধারী একেকটা। এদের সাথে মুখোমুখি লাগতে গেলে মান ইজ্জত সব খোয়াতে হয়। আবার একেবারে চুপ করে থাকলেও বিপত্তি বাঁধিয়ে দেয়। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘা হঠাৎ বলে উঠল, ” আই এ্যাম ভেরী স্যরি ভাবি।”
সুরমা থমকে গিয়ে তাকালেন মেঘার দিকে তবে চোখের রাডারে সে কম্পন ধরা পড়লো না।
মেঘা মুখ নামিয়ে বলল, ” আমি জানি আপনি কেন রাগ করেছেন। কারণ বর্ষণের কথা আমি সবাইকে বলে দিয়েছি তাই।”
সুরমা এবারও কোন জবাব দিলেন না। তিনি সহজে মুখ খোলেন না। কিন্তু যখন খোলেন তখন প্রতিপক্ষের হাল খারাপ করে দেন। মেঘা বলল,
-” কাজটা আমার উচিত হয়নি। আমার উচিত ছিল চুপচাপ ওর টাকাটা ফেরত দিয়ে দেয়া। আসলে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি তখন।”
-” কিসের টাকা ? ” আস্তে করে বললেন সুরমা। চোখে সতর্কতা।
-” বর্ষণকে জিজ্ঞেস করলেই পাবেন। আসলে এটা আমারই বোঝা উচিত ছিল যে বর্ষণ আপনার অনুমতি না নিয়েই আমাকে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু ভাবি, এভাবে কী কাউকে সাহায্য করা যায়। এরচে বরং সরাসরি আপনার মাধ্যমে দিলেই বরং ভাল হত। আমিও ভুল বুঝতাম না।”
-” কী বলছো এসব। বর্ষণ কেন তোমাকে টাকা দিতে যাবে ? ”
-” কেন দিতে চায় তা জানিনা কিন্তু বর্ষণ নিজের মুখেই বলেছে, সে আমাকে সাহায্য করতে চায়। আমার কষ্ট ওর সহ্য হয়না। আর এটা করতে সে নাকি কাউকে পরোয়া করেনা। বিশ্বাস না হয় ওকেই জিজ্ঞেস করুন।”
-” ওকে জিজ্ঞেস করব কেন ? তুমি কী ভেবেছ, আমি বোকা ? আমি বোকা না। আমি ভালোই বুঝতে পারছি এগুলো সব তোমার চালাকি। আমার ভাইকে ফাঁসানোর চেষ্টা।”
সুরমা নিজের ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে দেখে মেঘা ম্লান হাসল।

– ” সবারই মানসম্মানের ভয় আছে ভাবি। বর্ষণকে ফাঁসানোর চেষ্টা থাকলে আরো বাজে কিছু বলতাম আমি। কারণ সবাই জানে গতকাল বর্ষণ আমার ঘরে ছিল। আমি যে ছাদে সেকথা সবাই জানে না। জানতেও চায়না। তারা আমাকে ফাঁসাতে পেরে বেশ মজা নিচ্ছে। তাই আমি যদি বদনামই হব তবে একা হব কেন, বর্ষণকে নিয়েই হব। যার কারণে বদনাম হব তাকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছেন ? তাছাড়া গতকাল আপনারা আমার নামে যে ধরণের বাজে কথা বলেছেন তাতে কিন্তু আপনার ভাইই আটকা পড়ে যায়। একটা বাজে মহিলার ঘরে তো একজন ভালো ছেলে কখনও যায়না, তাই না ? একটা বাজে ছেলেই যায়। আমি যদি এখন সবাইকে বলে দেই বর্ষণ আমাকে নিয়মিত টাকা দিচ্ছে ? তখন কিন্তু আপনার সম্মানটাই যাবে। শুনেছি, বর্ষণের জন্য পাত্রী দেখছেন। বিয়ে ভাঙানীতে এসব কথা খুব কাজে আসে। বিয়ের পর আপনার ভাইয়ের নতুন শ্বশুরবাড়ীর কানে গেলে তো আরেক ঝামেলা। কাজেই বর্ষণকে বলবেন, আমার ঘরে যেন না আসে। আর আমাকে যেন টাকা না দেয়।” বলে মেঘা নিজের ঘরে চলে গেল। সুরমা হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ত্রস্তে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

====

-” হ্যালো, কে সুরমাপা?”
-” হ্যাঁ। তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে। বাসায় কখন আসবি ? ”
-” এখনই আসি। আমি তো তোমার বাসার কাছাকাছিই আছি। আসবো ?”
-” আরে না না…! এ বাড়ীতে আসার দরকার নেই। আমিই বাসায় আসছি, তুই বাসায় যা।”
ফোন রেখে দ্রুত মায়ের বাড়ীর উদ্দেশ্যে বেরুলো সুরমা। বর্ষণের হাবভাব ভালো লাগল না। বলামাত্রই আসার জন্য লাফ দিয়ে রাজী হবার মানে কোন ঝামেলা আছে। বাকি দুই জা টের পেলে খোঁচাতে বাকি রাখবেনা। ইস্, কী অবস্থা। বর্ষণটা একটু দুষ্ট এটা ঠিক। তাই বলে এক বাচ্চার মায়ের সাথে ? ইসসস, ছি ছি…শেষ পর্যন্ত এত নিচে নামল বর্ষণটা। সুরমারই ভুল হয়েছে। বর্ষণকে পাঠানো একদম উচিত হয়নি। আর মেঘার কথা যদি সত্য হয় তবে তো সর্বনাশ। বর্ষণকেই আগে থামাতে হবে।

বাপের বাড়ী এসেই ভাইকে ধরল সুরমা।
” এ্যাই, তুই মেঘাকে টাকা দিয়েছিস কেন ? তোর এত কিসের খাতির ওর সাথে শুনি ? এজন্যেই বুঝি, বাড়ী গেলে শুধু আরশের কথা জানতে চাস? ” সুরমা নিজের টেম্পার ধরে রাখতে পারলেন না। যা বলবেন ভেবেছিলেন তার উল্টোটাই বলে বসলেন।

বর্ষণ দাঁড়িয়ে ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করছিল। সে মুহূ্তেই মুর্তি বনে গেলো। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে দুম করে ড্রয়ার লাগিয়ে দিয়ে বলল,” কীহ্…? কিসের টাকা ? ”
-” তুই ওকে কোন টাকা দিসনি?” সুরমা আরো বেশী হতভম্ব।
-” আমি উনাকে টাকা দিতে যাব কেন ? ”
-” তাহলে মেঘা যে বলল ? আচ্ছা, এসব বাদ দে। আগে বল, ওর সাথে তোর কী কথা হয়েছিলো সেদিন ? আমার শ্বাশুড়ী তোদেরকে কী অবস্থায় দেখেছিল? ”
-” হোয়াট ননসেন্স? কী অবস্থায় দেখেছে কথার মানে কী। আমি তোমার এই জা’য়ের সাথে এর আগে কখনও কথা বলেছি ? সে তো সামনেই আসেনা আমার। কথা বলব কী ! আর উনি সরে সরে থাকেন বলে আমিও কখনও ঠাট্টা করিনা ওনার সাথে।”
-” তাহলে ও যে বলল, তুই প্রায়ই ওকে ফোন করিস। এটা সেটা বলিস। গিফট দিতে চাস ? টাকা -পয়সা দিয়ে সাহায্য করিস ? ” সুরমা বিভ্রান্ত চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। বিশ্বাসের দোলায় দোদুল্যমান তার মন। একমন বলছে বর্ষণ ঠিক, আরেকমন বলছে মেঘা ঠিক। সত্যি বলতে মেঘাকে অবিশ্বাস করতে মন চাইছে না কারণ মেয়েটা অহংকারী হলেও সত্যবাদী। বিগত আড়াই বছর ধরে এ বাড়ীতে আছে সে। কখনও মিথ্যে বলতে দেখেনি ওকে সুরমা। মেয়েটাকে ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করেনা কারণ ও আসার পর থেকে শ্বাশুড়ী সংসারের সব হিসাব পাই পাই বোঝা শুরু করেছেন। আগে যেভাবে সংসার থেকে টাকা পয়সা আলু পেঁয়াজ ডান বাম করতে পারত এখন সেসব কিছুই পারা যায় না। এই মেয়েটা আম্মার সামনে সংসারের সব জট খুলে পানির মত সহজ করে দিয়েছে। এখন তার মুর্খ শ্বাশুড়ী প্রতিটা পাই পয়সার হিসাব কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেয়। একারণেই মেঘার উপর বিরক্ত সুরমা। সে চেয়েছিল মেঘাকে একটু বেকায়দায় ফেলে আম্মার চোখে ওকে খাটো করবে। কিন্তু এখানে তো পরিস্থিতি অন্যরকম জটিল। তার অগোচরে এসব হচ্ছে আর সে কিছুই জানেনা ? হায় আল্লাহ, নেহালের বাবা শুনলে রেগে যাবে ওর ওপর। আচ্ছা, বর্ষণ কী সত্যিই মেঘার প্রতি আকৃষ্ট নাকি ? কে জানে ! চ্যাংড়া ছেলে। সুন্দর নধর স্বাস্থ্য দেখলে হুঁশ হারাতেই পারে। এটা তারই ভুল । বর্ষণকে ও ঘরে পাঠানো উচিত হয়নি। একদম না।

সুরমা আপোষের সুর তুললেন, ” আচ্ছা, এসব বাদ দে। মেঘা কী বলতে কী বলেছে। আমি আজই গিয়ে ওকে সাইজ করব। আমার ভাইয়ের নামে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার মজা টের পাবে সে। এখন বুঝতে পারছি। এসবই ওর চালাকি। ঐ যে আমি তোকে ওর ঘরে পাঠিয়েছি যে, এটা তার শোধ। আমাকে তোর বিয়ে ভাঙার হুমকি দেয়। সবাইকে বলে দেবার ভয় দেখায়। এখন বুঝতে পেরেছি এসবই আমাকে আটকানোর পাল্টা চাল। মাগো, কী শয়তানি বুদ্ধি। আর দেখতে কী আলাভোলা।”
-” তার আগে বলো, সে এটা কেন বলেছে ?” বর্ষণের কপালে ভাঁজ স্পষ্ট। ” এমনি এমনি নিশ্চয়ই বলেনি। অবশ্যই এটা নিয়ে তোমাদের বাসায় কিছু হয়েছে! তাছাড়া তোমার শ্বাশুড়ী যে কী পরিমাণ রেস্ট্রিকটেড মহিলা তা আমি ভালই জানি। তিনি আমাকে বেরোতে দেখেছেন পরশের ঘর থেকে। নিশ্চয়ই তিনি ঝামেলা করেছেন। আর সম্ভবত তুমি তাকে সাপোর্ট করেছ, নইলে সে খামোকা আমাকে এ্যাটাক করবে কেন, তুমিই বলো ? তার সাথে তো আমার কোন শত্রুতা নেই তাই না! ” বর্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করল।
সুরমা তেতে উঠল, ” আরে, এই মেয়ে কী কম নাকি ? তুই কতটুকু জানিস ওর সম্পর্কে ? দুনিয়ার চালু মেয়ে। চাকরী করে খায়। ও কী সোজা মেয়ে ?আমার শ্বাশুড়ীকে দিনরাত কু-বুদ্ধি শেখায়। টাকা পয়সার হিসাব শেখায় আর ঐসব শুনে বুড়ি তোর দুলাভাইকে সন্দেহ করে। আজ সকালেই আমাকে রান্নাঘরে ঢুকে যা তা বলল তোর নামে। বলে আপনার ভাইকে ম্যানার্স শেখান নি ? সে কেন আমার ঘরে ঢুকলো….এসব যত আজেবাজে কথা।”
-” আচ্ছা, আপা একটা কথা আমাকে আগে বলো। তুমি কী জানতে সে বাসায় আছে ? ”
সুরমা নির্বাক। বর্ষণ বিস্ময়াহত। সে তার এই বোনটিকে খুব অন্যরকম জানত। কথার আগে চোখে পানি আসে বলে ওকে নরম মনের ভাবত। সে এত জটিল মনের কবে হলো বুঝতে পারছেনা যদিও। তবে পুরো ব্যপারটা বর্ষণ এখনও ঠিক ধরতে পারছেনা। অনুমানে মনে হচ্ছে বেশ বড় ধরণের ঝামেলা হয়েছে ঐ বাড়ীতে। নইলে মেঘার রাগারাগি পর্যন্ত ঠিক আছে। এটা তার পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু সে বর্ষণকে ব্লেম দেবে কেন ? বর্ষণ তার কী করেছে ?
বোনকে নিরব দেখে বর্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” দোষটা আসলে আমারই। সে বাড়ী থাক বা না থাক। তার ঘরে আমার যাওয়া উচিত হয়নি। আর তুমি আমাকে এটাও বলোনি যে ওটা পরশ ভাইয়ের ঘর। তোমাদের বাড়ীটা এমনিতেই একটা গোলকধাঁধা। কোনটা কার ঘর ঠাহর করা যায় না। ইস্, না জানি উনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন।”
-” ওর ভাবাভাবিতে তোর কী যায় আসে ? ”
-” এতদিন যেতো আসত না, এখন তো যাচ্ছে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here