#মৈথিলী–২
” তোমার ফ্যামিলি কখনো রাজি হবেনা মিথি,আমাদের  কোর্ট ম্যারেজ ছাড়া উপায় নেই, ”
 যেদিন এই কথাটা শুনলাম, নিজের মনে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আসলেই উপায় নেই।সাজ্জাদ তার নিজের যাদুকরী সত্তা দিয়ে আমায় দখল করে নিচ্ছিলো। আমি ওর প্রেমে  প্রায় দিশাহারা হয়ে যাচ্ছিলাম ।  তাকে পাওয়া আমার জীবনের  একমাত্র উদ্দেশ্য  হয়ে যাচ্ছিল। আমার আজন্ম   ডাক্তার হবার স্বপ্ন, পড়াশোনা সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছিলো।   বাড়িতে বাবা নিজের হসপিটাল ডিউটি আর ক্লিনিক নিয়ে  ব্যাস্ত, তার সাজ্জাদের ব্যাপারে আপত্তি ছিল না কিন্তু আমার স্কুল শিক্ষিকা  মা তার লব্ধজ্ঞান আর কঠিন  সংগ্রামের অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবনকে বিবেচনা করতে জানতেন।  তিনি দারুণভাবে আপত্তি করলেন।  সাজ্জাদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি,  তার ব্যাক্তিত্ব কিছুই তাকে তেমন মুগ্ধ করতে পারল না তিনি আরও খোঁজ খবর করলেন।  ঈশ্বরদীতে সাজ্জাদের বাড়িতে লোক পাঠালেন ।  যা খবর আসলো  তার যুক্তিতে আমি কোন ভাবেই এই ছেলের সাথে সংসারে সুখী হতে পারবো না। সংসার শুধু দুটা মানব মানবীর একসাথে থাকা নয় দুটা আলাদা পরিবারে সংস্কৃতির  সংমিশ্রণ।  ঠিকভাবে তাল-মেল নাহলে অশান্তি অবধারিত ।  সাজ্জাদের পরিবারের অবকাঠামোই নাকি আমার সাথে মানানসই নয়।  ওদের পরিবারে মেয়েরা কেউ তেমন উচ্চ-শিক্ষিত নয়, অল্প বয়সে বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে….ছেলেরা যে বাড়িতে মা বোনদের শক্ত অবস্থানে দেখে অভ্যস্ত না , তারা ভবিষ্যতে নিজেও স্বৈরাচারী হয়  । তখন  আমার মাথায় আসছিলো না এইসব তথ্যের  সাথে সাজ্জাদের তুলনা হচ্ছে কেন?  সাজ্জাদ অবশ্যই এমন নয়। সেতো আমার মেধা পড়াশোনার বিষয়কে প্রশংসা করে। আমার তখন  মনে হচ্ছিল মায়ের এইগুলা খোড়া যুক্তি। আমার আর সাজ্জাদকে দুরে রাখার চেষ্টা মাত্র । সেই সময় শরীরে নবপ্রেমে উদ্ভুত জোয়ার চোখে আবেগের চশমা।  আমার উপর আইনজারী হলো সাজ্জাদকে নোটিশ দিয়ে দেয়া হলো  আমার যাওয়া আসায় প্রহরা বাড়ানো হলো।   আমিও হলাম বিদ্রোহী একদিন কলেজ থেকে ফিরতি পথে আর বাবার পাঠানো গাড়িতে না উঠে সাজ্জাদের অপেক্ষারত বাইকে উঠে বসলাম।  নিজের সমগ্র বিশ্বাস, মর্যাদা, স্বপ্ন সবকিছু একত্রে চোখ বন্ধ করে সাজ্জদের হাতে তুলে রওনা দিলাম অজান্তের উদ্দেশ্য।  লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো কিনা জানতাম না শুধু সঙ্গীটা যেন আজীবন পাশে থাকে, এইটুকুই চাওয়া ছিল।
 বিশ্বাস করবে শায়ন , আজ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও  সেই মুহূর্তের কথা ভাবলে বার বার ক্ষোভে  মাথা কুটে মরতে ইচ্ছা করে। সেই সময়ে একটাবার যদি  বাবা মায়ের কথাগুলো ভাবতাম,  আমার স্বপ্নগুলোর কথা ভাবতাম একবার ফিরে চাইতাম আমার মেডিকেল কলেজের ফেলে আসা চৌকাঠের দিকে.কীভাবে আমার কাছে সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল? আজও প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি কেন আমি এতো বোকা? দেবতা আর অসুরের মুখোশের পার্থক্য কেন করতে পারলাম না?… 
শায়ন এতোটুকু পড়ে থেমে গেল।  ভেতর ভেতর রাগ উঠছে। মহিলার স্মৃতি বলতে এখন কিছু শায়নের মনে বেঁচে নেই। রাগ জেদ আর ক্ষোভের ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলেছে সব কিছু। তবু ছোট কালে  মাঝেমধ্যে চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভেসে উঠতো, একটা মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে বলা কথা..
“বাবু এই যে দেখ,  শেষ নলা এইটুকু খেয়ে নে বাবা, শেষ বাংলাদেশ!”
”  বাবু ঠান্ডা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটছিস! দাঁড়া..
 “ইনশাআল্লাহ  দেখ তোমার বাবা আমাদের নিতে আসবে, এই শয়তানগুলো আমাদের কিছু করতে পারবে না…উপরে আল্লাহ আছে  ”
কী তীব্র ভয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে ছিল সেদিন।  বুক কাঁপছে!  শায়ন সাবধানে নিজেকে সামলাচ্ছে। তার সামনে বসা মেয়েটা ঝাল ফুচকা খাবার পরে স্প্রাইটের বোতলে মুখ দিয়েছে। শায়নের সাথে চোখাচোখি হলো,
“চিঠি পড়া শেষ?
“পড়তে ইচ্ছে করছে না এটা নিয়ে যাও ”
মেয়েটি মুখভঙ্গি শক্ত করে ফেললো,  আমাকে তুমি করে ডাকার অনুমতি আমি দেই নি মিস্টার শায়ন।তবে  চিঠিটাকে  যত অবহেলা করছেন এটা লেখার পেছনে আপনার প্রতি আবেগের কিয়দংশ মনে হয় না আপনি ডিজার্ভ করেন। ”
“চিঠিটাতে মিথ্যায় ভরা ”
“তাহলে সত্যিটা কী শায়ন? এতোদিন আপনি যা জানতেন?  সত্যির কিন্তু  অনেক ভার্সন আছে। অনেক ধরনের রূপ আছে একেকজনের সত্যি একেক রকম।  এতোদিন আপনি আপনার মহান বাবার ভার্সনটা শুনেছেন এখন সেই মহিলার ভার্সন শোনেন।তাতে তো ক্ষতি নেই! ”
“সময় নষ্ট করতে আমার ইচ্ছে করছে না ”
মেয়েটা হঠাৎ  ঝুঁকে এলো শায়নের দিকে, ” মিস্টার শায়ন, মানুষটা এখন আর বেঁচে নেই। এই চিঠি শেষ করার মাত্র দুই দিনের মাথায় ঘুমের মাঝে  সে চলে যায়। মিথ্যা লেখে আপনাকে প্ররোচিত করে তার কিছু লাভ হতো না।  তার শুধু মাত্র দায়বদ্ধতা ছিল আপনার উপর যার কারণে এতো লম্বা চিঠি।  তবে বাদ দিন  এতো ভালোবাসা আপনি মনেহয় ডিজার্ভই করেন না! ”
সে ক্ষোভ নিয়ে শায়নের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গেল,, শায়ন শক্ত করে ধরে রইল কাগজ গুলো।
” মিস  মৈথিলী,  আমি চিঠিটা এখনো শেষ করিনি”
*******
” আপনার স্ত্রীকে যেদিন প্রথম দেখি, ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরছিলো।   সাধারণ সুতি তাতের সবুজ শাড়ি,মেদহীন ছিপছিপে গড়ন সংসারের কাজে কিছু ক্লান্ত, ঘামার্ত চেহারা কোন  প্রসাধন ছাড়া।  তবু এতো স্নিগ্ধ এতো সুন্দর সাথে ফুটফুটে বালক …” সাজিদ ঘুরে তাকালো সাজ্জাদ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে তার দৃষ্টি পুরোটা উপভোগ করে সাজিদ আরও  বলল
 ” তাদের দেখে আমার ভেতর অদ্ভুত একটা ঈর্ষা আর ক্ষোভে সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল জানেন?  আপনি সত্যি অনেক লাকি ছিলেন!  যেমন দারুণ  তরতর করে এগিয়ে যাওয়া কেরিয়ার ; তেমনি সুন্দরী স্ত্রী, ফুটফুটে ছেলে। একেবারে পারফেক্ট একটা লাইফ। অথচ আমাদের অবস্থা দেখেন,  আব্বা ততদিনে স্ট্রোক করে পঙ্গু, আম্মা পরপারে,   আমাদের জীবনটা ছিন্নভিন্ন করে কেউ এমন সুখে থাকতে পারে ভাবতেও বুকে কেমন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যেত! কী ভাগ্য  ছিল আপনার, একেবারে যেন রাজ কপাল ”
সাজ্জাদ চুপ করে রইলেন। আসলেও সেইসব দিনগুলো আজ মনে হয় যেন স্বপ্নে দেখা দিন। সাজ্জাদ তার পরম কাঙ্ক্ষিত মানুষকে এতো সহজে নিজের করে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। কাজী অফিস থেকে ফিরে  বন্ধুর বাড়িতে বাসরের রাতে অর্ধেক রাত ঘুমন্ত  মিথিলাকে শুধু দেখেই পার করেছিল। গাঢ় অন্তরঙ্গতার আগে কেন যেন  বিশ্বাসই হচ্ছিল  না যে  ব্যাপারটা  বাস্তব। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এরপর সব কিছু যেন যাদুর মতো সহজ হতে শুরু করলো।  মনে হতে লাগলো সাজ্জাদের জন্য এসবই প্রাপ্য ছিল সেই শুধু শুধু কঠিন ভেবেছিল ।  বিয়ের পর সত্যি সত্যি  সাজ্জাদের নিয়তির মোড় ঘুরে গেল, বা  সাজ্জাদ  সেভাবে নিজের বুদ্ধিতে ঘুরিয়ে নিল।  মিথিলাকে নিয়ে কিছু দিন  গা ঢাকা দিয়ে ফিরে এসে দারুণ একটা সুখবর শুনলো ।  তার নামে বিশাল  মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির থেকে একটা এপয়েন্টমেন্ট লেটার।  ইন্টারভিউ আগেই দেয়া ছিল কিন্তু বড় হোমড়াচোমরা ছাড়া চাকরিটা হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। শুরুতে  কিছু ট্রেইনি জবে একটু চেপেচুপে থাকল।
কিন্তু  সাজ্জাদ চৌকস,  স্মার্ট, সুপুরুষ তার সাথে বেশ কিছুটা ধূর্তও ছিল।  তার সাথের একই ব্যাচের কলিগদের কাজের ক্রেডিট গুলো সাবধানে নিজের নামে ক্যাশ করতে শিখে ফেলেছিল । অতএব  দ্রুত নজর কেড়ে নিলো উর্ধ্বতনের।  নতুনদের মধ্যে সাজ্জাদের উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বন্ধুদের চোখের কোনায় ঈর্ষা ঝিকমিক করে,।  সাজ্জাদের পাশে রূপবতী স্ত্রী, পকেটে টাকা, দারুণ ক্যারিয়ার।  লাইফ যখন সেট হবার পথে,তখন শুধু  একটা জিনিস খোচাচ্ছিল  সেটা হলো মিথিলার মেডিকেলের পড়াশোনা।
 তখনই পরিবারে একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল।। ফুপাতো ভাই নয়নের ডিভোর্স হয়ে গেল।  ভাবির উপর অপবাদটা বেশ জোড়ালো , অতি পড়াশোনায় ধরাকে সরা জ্ঞান করতো। বিয়ের সময় সবাই বলেছিল এতো শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে নেই। সাজ্জাদের বড়বোন সাজ্জাদকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলেন।  বউ আবার ডাক্তার হয়ে গেলে এমন দূর্দশা ভাইয়ের হতে কতোক্ষণ? মেয়েদের এ-ই  উড়ো তেজ হাতের মুঠোয় রাখা খুব জরুরি।  বড়পা যুক্তি দেখালেন , ” এখন তোর মাশাল্লাহ কম কামাই নেই  বউয়ের কামাই খাবি নাকি?এতো পড়ানোর দরকার কী?  শোন এই সব নারী-স্বাধীনতা, মেয়েদের চাকরির চিন্তা করে সেসব পুরুষ যারা আসলে যথেষ্ট  কামাই করতে পারেনা। তলে তলে বউয়ের কামাই খায় উপরে উপরে বড় বড় বুলি আউড়ে মহান সাজে।  তোর ত দরকার নাই।  আর পড়লে পড়ুক নরমাল কিছু,ডাক্তার হতে হবে কেন?  যাই বল বাপু এই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার মার্কা মেয়েগুলো সংসারী হয় না। বেশি শিক্ষিত হয়ে চাকরি করে তেজ দেখায় ঝামেলাই বাড়ে। ”
 বড়পার কথা সাজ্জাদ ফেলে দিতে পারলো না।   তাছাড়াও মিথিলার প্রাইভেট মেডিকেলে খরচ বেশি। নিজ থেকে বিয়ে করায় মিথিলা পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন তারা দায়িত্ব নেবে না।  সাজ্জাদের  সামর্থ্য যে একেবারে ছিল না তা নয়। টিউশনির জমানো টাকা,  বিয়ের আগে টুকটাক ব্যাবসায় করা লভ্যাংশ সবই রক্ষিত  ছিল। সেটা সাজ্জাদ বউয়ের পড়াশোনার জন্য নিশ্চয়ই  গচ্ছিত রাখেনি,।  এগুলো নিয়ে  ভবিষ্যতে আরও বড় পরিকল্পনার জন্য ছিল। তবুও মিথিলাকে বোঝানো মুশকিল,  মধুময় সময়ের রেশ কাটেনি। শরীর চুম্বকের কাছে ছুটে যায় লৌহ শলাকার মতো।এই দূর্বলতাতেই হয়তো তখনও, সামান্যতম সংসারজ্ঞান না থাকা  মিথিলার  অনেক আহ্লাদী মুখ বুজে সহ্য করা লাগছিল  ।
  আবেগ রেখে তখন কিছুটা প্রেকটিকাল হলো।   মিথিলার পরিকল্পিত চিন্তার মাঝে সাজ্জাদের ইচ্ছায় বাস্তবতা ঢুকে গেল খুবই সাবধানে ।ফলশ্রুতিতে একদিন সকালে মিথিলা মুখ থমথমে করে  একটা নতুন খবর দিল। সাজ্জাদ শুনে  প্রয়োজনের চাইতে বেশি উচ্ছ্বাসিত হয়ে গেল।সে  দারুণ খুশি এই সুখবরে! মিথিলাও খুশি কিন্তু তার সাথে কিছুটা আশাহত।তবে ভেতর ভেতর এটাইতো  চাইছিল সাজ্জাদ, সে সময় নিয়তিও সাহায্য করলো তাকে। পড়াশোনার চাপ, মেহেমান সংসারের দায়-দায়িত্ব,  দূর্বল শরীরে মিথিলা অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার দিয়ে দিলেন বেড রেস্ট। সাজ্জাদের ইচ্ছা পূরণের পথে বাধা রইল না কোন।অনাগত সন্তানের কথা ভেবে হলেও  মেডিকেলের পড়াটা ইস্তফা দিতে হলো। সাজ্জাদ বেশ কিছু  আবেগের কথা  গুছিয়ে রেখেছিল মিথিলাকে বোঝাতে। তবে মিথিলা বেশি ঝামেলা করলো না শান্তভাবেই মেনে নিলো। অস্বীকার করার উপায় নেই সেসময় স্ত্রী হিসেবে মিথিলা আসলেই দারুণ লক্ষ্মী ছিল!
কী দারুণ  স্বপ্নের মতো কাটছিলো দিনগুলো। সাজ্জাদ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনকার সময়ে ঈর্ষণীয় বেতন স্কেল, ইন্সটলমেন্টে নতুন গাড়ি,  ঢাকার অদুরে জমির বুকিং, সাইড বিজনেস আরও বড় কোম্পানিতে আরও বড় পোস্টের অফার। মিথিলা তখন ব্যাস্ত ছেলেকে পরিচর্যায়, সংসারে, রান্নাবান্নায়, মেহমানদারীতে। সাজ্জাদের অনুরোধে প্রাইভেটে ডিগ্রি ভর্তিও হয়েছিল। আসলে কি, সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষায় বউয়ের  কিছু ডিগ্রিধারী হওয়াটাও জরুরি ছিল ।  মিথিলা তাতেও আপত্তি করেনি। অবশ্য তার আর উপায়ও ছিল না। বাবু হবার পরে শায়নের নানা নানি যদিও তাদের মেনে নিয়েছিলেন তবে মিথিলা কোন একটা রহস্যময় কারণে তাদের সাথে বেশি অন্তরঙ্গতা দেখাতো না।  মিথিলা না বললেও সাজ্জাদ জানতো তার স্ত্রীর পরিবারের সাথে অধিকার আব্দারের অদৃশ্য তারটা ছিড়ে গিয়েছিল । দাম্পত্যে একেবারে খিটমিট যে লাগতো না তা নয়,  পরিচ্ছন্নতা প্রিয় সাজ্জাদের রুচির বাইরে গেলে,  গ্রামের আত্মিয়োরা এলে, বা বোনেরা টুকটাক কথায় হয়তো মিথিলা  প্রতিক্রিয়া দেখাতো। বোনদের অভিযোগ  মিথিলা বড়লোকের  আদুরে মেয়ে সামান্য ঠাট্টা,  কী ঠেস দেয়া কথা হজম করতে পারতো না, তর্ক করতে পছন্দ করে। মিথিলার অভিযোগ ছিল  বোনেরা নাকি তার দোষ ধরতেই বাড়ি আসে তার বোঝতে চায়  রান্নাবান্নায় বাবু পরিচর্যায় সে কতটা ব্যার্থ ।সাজ্জাদ কথাগুলো শুনেও শুনতো না। সব কথার গুরুত্ব দিতে নেই।
  তবুও বলা যায় মিথিলা খুশিই ছিল থাকবে নাইবা কেন? কর্বাড ভরা  নতুন শাড়ি, জুতো, দামী গহনা, থাকার জন্য  ভালো জায়গায় বাড়ি, উপযুক্ত মান সম্মত আহার  সুখী হবার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা সাজ্জাদ করেছিল! গাঢ় গভীর অন্তরঙ্গতায় কোন খাদ ছিল না  মিথিলা ত খুশিই ছিল। তবুও ঈর্ষার কালো  নজর যেন এড়ানো গেল না। সেই ভয়াল দিনটা এসে উপস্থিত হলো যেদিন সাজ্জাদের সাজানো গোছানো পৃথিবীটা নড়ে উঠেছিল।সকালে অফিস যাবার বেলায়  মিথিলা হঠাৎ বলেছিল  ” আমার শরীর খারাপ লাগছে, তুমি তো গাড়ি নিয়ে গেছ,  বাবুকে স্কুল থেকে তুমি আনতে যেতে পারবে?  ”
“আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড?  আজ  গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেক্ট প্রেজেন্টেশন উল্টাপাল্টা হলে চাকরি যাবে ! ঘরে বসে আরামে এসির বাতাস খাও বোঝ কত ঘাম ঝরাচ্ছি? সি ই ওর বউ হইতে ইচ্ছা নাই নাকি? ”
মিথিলা কথা বাড়ায়নি।  সাজ্জাদ সেদিন অফিসের মিটিং শেষে মিথিলাকে ফোন দিয়ে পায়নি।  সাজ্জাদের এতে  টেনশন না একটু বিরক্ত লেগেছিল। , এটা নতুন নয়, বেশিরভাগ সময়ই ঠিক মতো ফোন তুলতো না গাছের পরিচর্যা  বা বাবুকে দেখা  গল্পের বইয়ে ডুবে থাকার মতো আজাইরা কাজে মেতে থাকতো।এই বিরক্তি নিমিষেই আতঙ্কে পরিণত হলো  বাড়িতে এসে কাজের লোকের কাছ থেকে যখন জানলো মিথিলা শায়নকে নিয়ে সকালে স্কুলে নিতে গিয়ে আর ফেরেইনি।  আশেপাশের সব জায়গায় ফোন করে খবর নেবার ফাকেই হঠাৎ এলো একটা ফোনকল! যেথায় ছিল তার স্ত্রী আর ছেলের খবর।স্কুল ফিরতি পথে কিডন্যাপড হয়েছে তারা। পাঁচবছরের ছোট শায়নের চিন্তায় মাথা ঘুরে উঠলো সাজ্জাদের!
*****
শায়ন,
তোমার মনে হতে পারে ওই একটা অনাহুত ঘটনা আজ তোমার আর আমার মাঝে শত ক্রোশ মাইল দূরত্ব তৈরি করেছে। তবে এটা সত্যি নয়, মূলত দূরত্ব তৈরি হয়েছিল একটু একটু করে ধাপে ধাপে।আমাদের জীবনে  ওই ঘটনাটা শুধু একটা  নগ্ন সত্যি উন্মোচন করে দিয়েছিল। তবে শুরুর দিকে ঘটনার আকস্মিকতায় প্রচন্ড ভয়ে আতঙ্কে  পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম।   চোখের সামনে যেন আলো ঝলমলে একটা দিন মেঘাচ্ছন্ন বিভিষিকায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তোমার স্কুল থেকে  রিক্সাওয়ালা শর্টকাট নিতে গলির পথ ধরলো, দূর্বল শরীর আর ফিরে গিয়ে  রান্না বসানোর তাড়ায় আমিও  বাধা দিলাম না। হঠাৎ পাশে থেকে আসা মাইক্রো থেকে একদল লোক ঘিরে ধরলো আমাদের রিক্সা।  তুমি ভয় পেয়ে  কী শক্ত দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলে আমায়। সেই স্মৃতি তোমার আজও মনে আছে কিনা জানিনা, বন্দুকের নলের সামনে আমরা  মা বেটা মূর্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। এরা কারা কী চায় কিছুই জানতাম না। শুধু  ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিলাম প্রচন্ড ভয়ে ভরা অনিশ্চয়তার কালো খাঁদে। কার করা ভুলে শাস্তি পেতে যাচ্ছি জানিনা তবে বিশ্বাস কর বাবা  সেই সময়ও আমার  নিজের জন্য কম তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল বেশি।আমাদের চোখ বেধে তারা কোথায় নিয়ে গেল কোন  একটা বাড়ির ফ্ল্যাটে আটকে রাখলো। শুরু হলো আমাদের জীবনের কিছু ভয়াবহ  সময়।  শায়ন তোমার কী কিছু মনে আছে? ভুলে যাও সেটাই আশা করি। এমন দমবন্ধকর সময় তোমার স্বপ্নেও যেন আর না আসে…
শায়নের চিঠির মাঝে কিছু  দৃশ্য চোখে ভাসছে। পুরাটা স্পষ্ট নয় তবু ছেড়া ছেড়া।  পাঁচবছরের বাচ্চার জন্য যে স্মৃতি ছিল দুস্বপ্নের মতো। মনে আছে  মা প্রাণপণে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো তাকে,। মায়ের কোল থেকে   শায়নকে ছুটিয়ে নিতে চাইছিল তারা, শায়ন চিৎকার করছিল,  প্রাণপণে কাঁদছিল মাও।
 ” ওগুলো তোর মায়ের নাটক ছিল বাবা,  সে একটা পচা মহিলা তোকে ভালোবাসতো না  তোকে দেখানোর জন্য আদর করতো।”
  পরবর্তী সময়ে ফুপুরা, বাবা মিলে বুঝিয়েছিল শায়নকে। তবুও এতো দিন পরে আবার যেন দৃশ্যটা মনে পড়লো।  মা চিৎকার করে কাঁদছে লোকগুলো তাকে অন্য একটা ঘরে  নিয়ে যাচ্ছ্র। মাকে ধরে রেখেছে আরেক জন মহিলা।  মায়ের কন্ঠে আতঙ্ক কাতর আকুতি।  আচ্ছা এটা যদি সত্যি নাটক না হয়ে থাকে তাহলে ওই দিন আসলে  কী হয়েছিল  মায়ের সাথে?সেইসব কথা কী মা লেখেছেন এই  চিঠিতে?   প্রায় দুই যুগ পরে শায়নের নিজের মায়ের অজানা সত্যিটা আঁচ করতে পেরে ভয়ে জমে গেল।  শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।।
“চিঠিটা পড়ে ফেলুন শায়ন !  আপনি অনেক লাকি এতোদিন  বাবার পরিচয়ে তার ছত্রছায়ায় থেকে অনেক নিশ্চয়তা আর আরামের জীবন যাপন করেছেন।  এই চিঠিতে বলা কষ্টের বয়ান আপনার নিতে পারা উচিত।
মৈথিলীর শান্ত আহবানে শায়ন চিঠিতে আবার মনোযোগী হলো,
তারা তোমার কাছ থেকে আমায় আলাদা করে দিল আমি আমার সন্তান আমার নারীত্ব হারানোর ভয়ে তখন দিশাহারা।  একজন আমার দিকে ঝুকে এস বলল ” মহিলা শুনেন আমাদের সাথে আপনি  যত ভদ্র থাকবেন আমরাও ততটা ভদ্র থাকবো। বস এসে আপনার সাথে হিসাব মেটাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেন কোন হেরিতেরি করবেন না নয়তো আপনার ক্ষতি হবে। ”
আমি বুঝে উঠতে পারলাম না আমি কার এতো বড় ক্ষতি করেছি যে এ কঠিন হিসাব দিতে হবে।  হাত পা বাধা বন্ধ ঘরের মধ্যে অন্তহীন  অপেক্ষা একজন অদেখা মানুষের জন্য।   তার সাথে তোমাকে নিয়ে চিন্তা তোমাকে ওরা কি করেছে কিছু জানি না ।  আমি এই আতঙ্ক আর নিতে পারছিলাম না প্রাণপণে আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যুর জন্য দোয়া করছিলাম।  তীব্র বিমর্ষতা আর  হতাশা আমার স্নায়ুকে এতো ক্লান্ত করে দিয়েছিল যে এই দুই চোখে ঘুম নেমে এসেছিল।  যেটা ভেঙে গেল ঘরে কারো জুতার আওয়াজে..
*****
(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম
 
             
		