মৈথিলী পর্ব শেষ

#মৈথিলী–৩

শেষ পর্ব

” ওই তিনদিন মিথিলাকে আমি যা দিয়েছিলাম, সেটা আপনি তাকে গত ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনে দিতে পারেননি…”

সাজ্জাদ কঠিন মুখে তাকিয়ে আছে। সাজিদ জানালায় বাইরে দেখতে উদাস গলায় কথা বলছে।সাজ্জাদ মাথা ঠান্ডা রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তুঅনেক দিন পর রক্ত বলকে বলকে উঠছে। এই শয়তানের জন্য তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। মিথিলার মতো এতো চমৎকার একটা স্ত্রীকে হারিয়েছেন শায়ন হারিয়েছে তার মাকে..কিছু অভাব কোন অর্থ দিয়ে পূরণ হয় না। এই অভাবও পূরণ হয়নি, ।ইচ্ছা করছে হাতের কাছের পাথরের ফুলদানিটা ছুড়ে রক্তাক্ত করে মারেন শয়তানটাকে । কিন্তু শরীরের দুর্বলতা সায় দিচ্ছে না। সাজিদ সাজ্জাদের অস্থিরতা উপভোগ করতে করতে বলল,
“আহা আপনার শরীর খারাপ এতো উতলা হবেন না সাজ্জাদ সাহেব। ধৈর্য ধরেন, শুরু থেকে বলছি শুনেন মিথিলাকে যারা তুলেছিল ওরা কেউ প্রফেশনাল ছিল না। আমার বাবার ফ্যাক্টরির পুরান বিশ্বস্ত লোক ছিল ওরা। আমাদের পরিবারের অনেক অবদান ছিল ওদের জীবনে । আমার একটা ডাকে তারা ছুটে এলো। তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করলাম কিভাবে করে আপনার বাড়ির সম্মান আর ভবিষ্যৎকে তুলে কচলে ফেলতে হবে। কাজটা পরিকল্পনা মাফিক এতো চমৎকার এক্সিকিউট হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। ওরা আপনার স্ত্রী আর পুত্রকে নির্দিষ্ট বাড়ির ভাঙা চিলেকোঠায় রেখে দিলো। আমার নির্দেশনা ছিল আমি না আসা পর্যন্ত কেউ নতুন কোন পদক্ষেপ নেবে না। তারা নেয়নি। আপনার ছেলে শায়ন মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে কান্নাকাটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ।তাকে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম আপনার স্ত্রীর ঘরে! ঘুমন্ত, একা হাত-পা বাধা অসহায় , আলুথালু অবিন্যস্ত শাড়ি , অথচ এই ধুলামলিন পরিবেশেও ফুটে উঠেছে কী অপার সৌন্দর্য। ভরা বর্ষার নদীর মতো যৌবন! ”
“স্টপ ইট! আমি আর শুনতে চাইছি না! “সাজ্জাদ থমথমে গলায় বললেন।
” শুনতে হবে সাজ্জাদ সাহেব, আমি যখন এতো দূর থেকে কষ্ট করে এসেছি আপনাকে সেই সব দিনের সব কথা আমি পুঙখানুপুঙখ ভাবে বর্ণনা না করে ত যাবো না। কিসে শুনতে বাধছে আপনার? স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা না নিজের পুরুষত্বের অহমে আঘাত? তা আঘাতটা পেলেন কেন কারণ জানবেন না? সেই রাতে সারা ঘরে অদ্ভুত নীরবতা, আমার সামনে মূর্তিমান একজন অপ্সরী, গোটা পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে। হঠাৎ করে আমার ভেতরের পশুটা জেগে উঠলো সাথে নিজের ক্ষমতার অনুভবটাও। বুকের মাঝে বিচিত্র এক লিপ্সা ভরা আক্রোশ।আমার বোনটাকে দশজনের সামনে নির্মম ভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে চিকন গলি ধরে পালালেন। তাকে হারিয়ে আমরা আহত হয়ে পড়ে রইলাম আর আপনি শালা একাই এই সৌন্দর্যের আনন্দ নিয়ে যাবেন? না হতে পারে না! আমি ভেতরের ক্রোধের আগুনে ঘি ঢেলে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
আমার পায়ের শব্দে ততক্ষণে সে জেগে গেছে। ভয়ার্ত অভিব্যক্তি দুটো চোখে, মুখে অস্ফুট গোঙানি, বাধা দুটা হাত নাড়াতে চাইছে, আমার চোখে তখন নেশা ধরেছে..আমি দর্পিত পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ সে চিলেকোঠায় রাখা আয়নায় চোখ আমার পড়ে গেল। এক ঝলকের মধ্যে আমি যেন আমায় নয় আপনার চেহারা দেখলাম। আপনার মানুষ রূপি পশুর মতো চেহারাটা।যার উপরটা ফেরেশতার মতো সুন্দর ভেতরটা হায়নার মতোই ক্রুর আর ধূর্ত। অসহায় ঘরে একটা মেয়েকে দূর্বল পেয়ে অপমান করে আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্যটা আমি খুঁজে পেলাম না।উল্টো মিথিলার চোখে আতঙ্ক আর ঘৃণা দেখে মনে হলো নিজেকে আরও নিচে নামিয়ে ফেলছিলাম। সে আমার দিকে চেয়ে হাত পা বাধা অবস্থায় কাঁদছিল চোখে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য কাতর অনুনয়। ওই টানা টানা কালো চোখের পানির দিকে তাকানোই কাল হলো…।তখন হঠাৎ নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগলো।মনে হলো প্রতিশোধ একটা বাহানা নিজেই জানতাম না কী ভয়াবহ নোংরা একটা পশু আমার মাঝে বাস করে। আর আমি কি না আপনাকে শাস্তি দিতে উদ্যত!

“তুমি ওকে স্পর্শ করনি? তুমি সত্যি তাকে স্পর্শ করনি?ইউ লায়ার ” সাজ্জাদ হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

সাজিদ ঘুরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসলো, ” হায়রে কপাল! বুড়ো কালে আপনার এখনো এই প্রশ্ন? আপনার মতো মানুষদের হিসাব আজও এক জায়গায় আটকে থাকে। কী করার বলেন আপনারা নিজেদের দিয়ে মানুষ বিচার করেন যে।সব সময় আপনার মর্জি চলেছে । কিন্তু আমি বললাম না, আপনার আর আমার মধ্যে কিছু পার্থক্য মিথিলার কাছে প্রমাণ করতে ইচ্ছা হচ্ছিল।চিৎকার না করার শর্তে ওর মুখের বন্ধন খুলে দিলাম, ছেলেকে ওর কাছে ফিরিয়ে দিলাম। সে অবাক হলো, আমার ভেতর দয়া দেখে হাতে পায়ে ধরলো। আমি তাকে আর কিছুই বললাম না বাচ্চাকে খাবার খাওয়াতে বলে সোজা চলে এলাম। আমার নিযুক্ত লোকদের উপর নির্দেশ দিয়ে এলাম যেন তাদের সেবায় কোন ত্রুটি না থাকে। নিয়মিত খাবার দেওয়া হয় যত্ন নেওয়া হয়। সেই দলের মধ্যে দুইজন মহিলা ছিল তারা মিথিলা আর শায়নের দায়িত্ব নিল। যদিও প্রতিশোধের আগুন তখনও বুকের মাঝে জ্বলছে নিজের বোকামিতে নিজেই ধিক্কার জানাচ্ছি। তাদেরকে বলে দিলাম যেন কমসেকম তিনদিন এই দুইজনকে আটকে রাখে।এরপর সময় মতো মুক্তিপণ নিয়ে নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দেয়। ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বউ আর বাচ্চা নিখোঁজ। মুলত আমি আমার স্ট্র‍্যাটেজি বদলে ফেললাম। আমি আপনাকে আঘাত দেব ঠিক তেমন ভাবে যেভাবে আপনি দিয়েছিলেন আমাদের তিথিকে। আপনার আত্মবিশ্বাস আপনার অহমকে গুড়িয়ে ফেলব। আপনার তখন সদ্য নাম যশ হয়েছে। মাত্র লব্ধ করা সামাজিক সম্মান যেটা রক্ষা করতে আপনি সর্বদা মরিয়া। এই ঘটনার পরে আপনি সত্যি সত্যি ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। মনে পড়ে? ”
সাজ্জাদের চোখের স্মৃতির পর্দা নেমেছে, সদ্য প্রাপ্ত প্রমোশনের খুশির উল্লাসের মুহূর্তে এই ধাক্কা এসেছিল। সেই সময় পারলে একে একে সব বন্ধুদের দাঁড় করিয়ে দেয় বিচারের কাঠগড়ায়। সাজ্জাদের উন্নতি দেখে কে ছিল না ঈর্ষান্বিত? সবার মনেই সাজ্জাদের মতো জীবন পাবার জন্য গোপন লালসা ছিল। কার কালো নজর লেগে গেল? শায়নের চিন্তায় নাওয়াখাওয়া সব শেষ তার সাথে জুড়েছে ঘরের সম্মান। পুত্র হারার শোক দশজনকে বয়ান করা গেলেও স্ত্রী নিখোঁজ হবার বোঁঝা নেওয়া মুশকিল হচ্ছিল । ব্যাপারটা সাবধানে গোপনে আগাতে হচ্ছিল। এদিকে ঘটনা শত চেষ্টা করেও যেন লুকিয়েও লুকাচ্ছে না। ছেলের সাথে যেহেতু মা ছিল মানুষ অন্য ইঙ্গিত করে কথা বলতে লেগেছিল। বিয়ের ছয় বছর অতিবাহিত মিথিলার একটা সন্তান হবার পরেও রূপে কোন ঘাটতি ছিল না। সাজ্জাদ খেয়াল করেছিল তার স্ত্রীকে নিয়ে চেনা জানা সব যুবা-পুরুষের চোখের কোনায় মুগ্ধতা থাকতো। কথায় কথায় মিথিলা বলতো কোন আজেবাজে ফোনের কথা। সাজ্জাদের কলিগ বন্ধুদের হাল্কা ঠাট্টাগুলো কেন যেন মনে পড়েছে, স্কুল ফিরতি পথে বখাটেদের মন্তব্য যার অভিযোগ করেছিল মিথিলা। এই সব কিছু কি এই ঘটনার জন্য দায়ী? কে জড়িত এসবের পেছনে? ঘুরেফিরে মিথিলার উপরই রাগ উঠে যাচ্ছিলো। নিশ্চয়ই সে সাহস দিয়েছে নয়তো বিনা কারণে এভাবেই কেউ তুলে নিয়ে যায়?আচ্ছা এটা কী পরিকল্পিত? একাধিক চিন্তা একসাথে গিঠ লাগিয়ে দিচ্ছিলো সাজ্জাদের মাথায়।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শায়নের চিন্তায় সাজ্জাদ পাগল প্রায়।দেড় দিনের মাথায় এলো মুক্তিপণের জন্য টেলিফোন কল। সন্তানের সুরক্ষায় যেকোনো মূল্যে আপোষ করতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সাজ্জাদ । হাজার হলেও তার রক্ত নিজের ছেলে, ভালোবাসার নিখাদ আঁধার। তার জন্য সাজ্জাদ সব কিছু করতে পারে । কিন্তু মিথিলার পরিবারকে জানিয়ে হয়েছিল ঝামেলা। তারা পুলিশকে খবর দিয়েছিল, গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তা আত্মিয়ো হওয়ায় তারা দ্রুত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু সাজ্জাদ ছেলের নিরাপত্তা আগে বুঝেছিল। কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি। দুইদিনের মধ্যে তার প্রায় সব এফডি ভেঙে ফেলেছিল। টাকা গুছিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে পাবার কয়েক ঘন্টা আগে আগেই একটা খবর পেল। মিথিলা আর শায়নকে গোয়েন্দা পুলিশ জুরাইনের পুরাতন একটা বাড়ির চিলেকোঠায় উদ্ধার করে ফেলেছে । শায়নের দিকে তাকিয়ে সাজ্জাদের বুক ভরে এলো, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। চোখের কোনায় মিথিলাও নজরে পড়েছিল তৃষ্ণার্তের মতো সেও তাকিয়ে ছিল হয়তো। কিন্তু সাজ্জাদ ছেলের মাঝেই নিজের সব সুখ খুঁজে পেয়েছিল। আজ হঠাৎ অনেক অনেক দিন পরে সেই মুহুর্তের জন্য সাজ্জাদের বুকটা হু হু করে উঠলো, সেই সময় মিথিলার হাতটাও ধরা দরকার ছিল। এটা আগে কেন সাজ্জাদ সাহেব বুঝতে পারলেন না।
“বলেছিলামনা সাজ্জাদ সাহেব, তাকে আমি সেই সুখ দিয়েছি যা আপনি ছয় বছরেও দিতে পারেননি, জানেন সেটা কী? তার নারীত্বের সম্মান ”
*******-*-
” জানো শায়ন,
সেই আধা পাগল লোকটা আমাদের কেন বন্দী করলো কোন ক্ষতি ছাড়া এভাবেই বা কেন পালালো তখন কিছু জানতে পারিনি।আমাদের নিয়মিত খাবার দেয়া হতো, বাইরে থেকে তার আওয়াজ শুনতাম দূর থেকে আমাদের দেখে চলে যেতো তবু ভয়ে জমে যেতাম সে আসলে। আমার সব আশঙ্কা ভয় আর প্রশ্ন গুলো ম্লান হয়ে গেল যেদিন আক্ষরিক ভাবে মুক্তি মিললো।
তোমাকে নিয়ে সেদিন থানা থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে এসে মনে হলো যেন স্বর্গে চলে এসেছি। এই বাড়িকে কখনো ভেবেছিলাম বন্দীর খাচা। যেখানে আমার সব স্বপ্ন আশা তোমার বাবাকে ঘিরে সব আকাঙ্ক্ষা গুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই বাড়ির চার দেয়ালে তোমার বাবার সাথে কলহের মাঝে কখনো কখনো কী অভিমান হতো । আমার ফিরে আসার পরে সেদিন দারুণ ভাবে অপরাধবোধ হচ্ছিল। নিজের প্রিয় সাজানো সংসারে ফিরে আমার আবেগে চোখে পানি চলে এসেছিল। তার সাথে সত্যি গর্ব হচ্ছিল তোমার বাবার জন্য। মানুষটাকে শুধু শুধু স্বার্থপর ভাবতাম অথচ আমাদের জন্য সে নিজের জমানো সেভিংস ভেঙে ফেলেছে । মানুষটার কন্ঠ কড়া হলেও আমাদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা আছে এই ভেবে অদ্ভুত শান্তি লাগছিল।
আমি তোমার বাবাকে নিয়ে এতো আপ্লূত ছিলাম যে আমার প্রতি কারো বাকা নজর চোখেই পড়ছিলো না ।খেয়ালই করিনি ওর বোনেরা আত্মিয়োরা কেউই আমার সাথে কথা বলছে না। আমার সাথে যতটুকু কথা বলছে আমার মা বোনেরাই বলছে। সেদিন আম্মু আমায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু আমি রাজি হলাম না।আমি কোথায় যাবো? এইই তো আমার আসল ঠিকানা যেথায় আমার ভালোবাসার মানুষ । নিজ ঘরে ফিরে একান্তে আবেগ যেন সামলাতে পারলাম না, জড়িয়ে ধরেছিলাম সাজ্জাদকে। সে নিজেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিল,অবাক হয়ে দেখলাম তার মুখে কেমন বিব্রত ভাব। শুধু বলল, ” তুমি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও পরে কথা হবে..”
আমি বুঝলাম, তখন বাড়ি ভরা মানুষ। সবাই তোমাকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিল আমি আমার ক্লান্ত শরীর আমার চেনা প্রিয় বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলাম।টানা তিনদিনের চিন্তা ভয়ে বিধ্বস্ত শরীরে সামান্য শক্তি ছিল না।নিজের ঘরের নিরাপদ সুখের আশ্রয়ে আমি ডুবে গেলাম শান্তির ঘুমে। আমার সেই ভ্রমে ভরা স্বপ্ন ভাঙলো মাঝরাতে, কানে এলো চাপা গলায় কিছু কথোপকথন, তোমার বাবার আর তোমার ফুপুদের।
“ওকে সাথে করে আনলি কেন? এই ঝামেলা সামলাতে পারবি?
তোমার বাবার গলা,-“আরে পুলিশ ওদের একসাথে উদ্ধার করসে আমি কী করবো?আনতে হইসে।”
“কাজটা ঠিক হয় নাই। এইখানে অনেক ঘাপলা আছে তোর বউ এতো সাজগোছ করে স্কুলে যাইতো নজর ত পড়বেই, নাহলে দেখ তারা শায়নকে তুলতে চাইলে শায়নকেই উঠাতো তোর বউকে তুলল কেন?তলে তলে কিছু অবশ্যই ছিল ”
” আর না থাকুক তবু এই বউ নিয়ে তুই সংসার করতে পারবি? ভেবে দেখতো তিন দিন একদল সন্ত্রাসীর সাথে…তারা কী এমনেই ছেড়ে দিসে?শায়ন বলল তাকে নাকি তার আম্মুর কাছ থেকে আলাদা রাখসিল”
“তার গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন নাই এই বিষয়টাও সন্দেহজনক, হয়তো বা জোর করেনি স্বেচ্ছায়… ”
আমি শুনছিলাম তোমার বাবা বলছে, ” আমি ওকে ফিরাতে চাই নাই কিডনাপারদের বলসিলাম যে আমি শুধু আমার ছেলেকে ফেরত চাই। ছেলের মায়ের ব্যাপারে আমার দায়িত্ব নাই।আমার তাকে লাগবে না। ওদের সাথে ডিল হয়ে সারতে পারেনি একঘন্টার মধ্যে পুলিশ উদ্ধার করে ফেলেছে দুজনকে। ”

“যাক যেভাবেই হোক, ওকে ওর বাবার বাড়ি পাঠা। কাল কোর্টে সাক্ষী দিয়ে আর ফেরত যেন না আসে। শায়নের এমন মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো ”
ঘরের আধার কোনায় আমি দাঁড়িয়ে থেকেও মনে হচ্ছিল গুড়িয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছি। আমার ভেতরকার বিশ্বাস, মর্যাদাবোধ যেন শত খন্ডে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমায় কোন সাগরের অতলে চেপে ধরে আছে, দমবন্ধ হয়ে আসছিল আমার। বেঁচে থাকা শক্তি দিয়ে কোন ভাবে ফিরে আসি নিজের ঘরে। যে ঘরটা নিজের বলার অধিকারটুকু আমি হারিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছিলো না বেঁচে থাকতে। কিন্তু আমার পরিস্থিতি এমন ছিল যে আত্মহত্যা করার মতো সাহসটাও ছিল না কারণ সেই সময়ে আমার নিজের জীবনের মাঝে আরেকটা জীবন বেড়ে উঠছে। তোমার বাবা যার ব্যাপারে অবগত ছিল না।
যদিও সংসার আরও মজবুত করে গড়ার জন্য এই নতুন জীবনের পরিকল্পনা তারই ছিল। মূলত সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো তারই কুক্ষিগত ছিল আমার এগুলো নেবার কোন অধিকার ছিল না। আমি আসলে ওর ব্যাক্তিত্বের কাছে কেমন যেন ম্লান হয়ে পড়ছিলাম ওকে দিনে দিনে ভয় পেতে লেগেছিলাম। ভয়ের থেকে যে ভালোবাসা তৈরি হয় সেটা শুদ্ধ হয় কিন্তু ভালোবাসার মধ্যে ভয় ঢুকে গেলে সে ভালোবাসা শুদ্ধ থাকে না।
সাজিদ নামক মানুষটার প্রতিশোধের কারণে আমার জীবনে ঝড় বয়ে গেলেও আমার কেন যেন তার উপর রাগ হয়নি। উল্টো আজ তাকে আমার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করে। আমার নিজের অস্তিত্বের আসল মূল্য সে ঘটনার পর থেকেই জানতে শুরু করেছিলাম। এর আগে নিজের স্বপ্নগুলোকে এক একটু করে বলি দেবার পেছনে অজান্তেই আমি তোমাকে দায়ী করতাম। কিন্তু এক সময় আমি বুঝতে পারলাম এর পেছনে আমার নিষ্পাপ সন্তান নয়, দায়ী আমি নিজে। আমার দোষ অন্ধের মতো আমার সন্তানের বাবাকে বিশ্বাস করে যাওয়া। তার দেওয়া সোনার খাঁচায় নিজেকে রেখে ধন্য মনে করতে থাকা।দিনের পর দিন নিজের সাথে নিজের সুখী হবার অভিনয় করে যাওয়া।আমার মেধা আমার চিন্তা আমার স্বপ্ন সবই মূল্যহীন। মূলত সাজ্জাদের কাছে, আমি একটা শুদ্ধ সুন্দর দেখতে লাগা পুতুল ছাড়া কিছু ছিলাম না। যার দায়িত্ব ছিল তাকে শারীরিক সঙ্গ দেওয়া, তার সন্তানকে জন্ম দেওয়া, তার জন্য রান্না করা, তার ঘরদোর গুছিয়ে রাখা, বাচ্চাকে বড় করা, সব ভাবে তার প্রতি একনিষ্ঠতা ধরে রাখা। আর এই সব দায়িত্ব পালনের আগে শারিরীক শুদ্ধতা খুব জরুরি। যেটা তার চোখে আক্ষরিক ভাবে আমি হারিয়েছিলাম। তার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যে তার একটা কথায় আমি আমার আরামের জীবন ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম। আমার ছয় বছরের একনিষ্ঠ ভালোবাসা, ত্যাগ তিতিক্ষার মুল্য আজ নির্ধারিত হচ্ছে আমার শারীরিক শুদ্ধতা দিয়ে। যেটা যদি দূর্ঘটনাবশত আমি সত্যিই হারাতাম তবুও কী সেটায় আমার দোষ থাকতো? এতোটুকুও বিশ্বাস সম্মানবোধ আমি আমার নিজের স্বামীর মনে অর্জন করতে পারিনি? এই ব্যার্থতাতো আমারই ; কী করে ভাবলাম পরিচ্ছন্নতা প্রিয় মানুষটা যে কিনা বিছানার একটা ভাজ উঠা পছন্দ করতো না সে তার অশুচি স্ত্রীর দেহকে কখনো স্পর্শ করবে? বিশ্বাস কর বাবা নিজেকে এতো তুচ্ছ মনে হচ্ছিল যে তোমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তুমিও তারই সন্তান, তুমিও একসময় আমাকেই ঘৃণা করবে আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে।আমি তখন এই অপবাদ কীভাবে সহ্য করবো?…

শায়ন চিঠি পড়তে পারছেনা তার চোখ দুটো বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সামনে একটা মেয়ে বসে আছে তার সামনে অশ্রু লুকানোর মতো ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে। নির্লিপ্ত থাকার এই লড়াই বোনের সামনে শায়ন আজ হেরে যাবে নাকি সন্দেহ হলো।
*****
“সন্দেহজনক অপরাধীদের কোর্টে চালানের দিনে আমি ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলাম। ওরা যারা মিথিলাকে তুলেছিলো আমার কথাতেই তুলেছিলো ওদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমার ছিল। আমি খুব ভালো ক্রিমিনাল লওইয়ার নিযুক্ত করলাম তাদের জন্য যিনি প্রমান করবেন যে তারা কিডন্যাপের সাথে জড়িত না।ব্যাপারটা নেহাৎ কাকতালীয়। পুলিশ তাদের রিমান্ডে নেবার জন্য প্রস্তুত প্রাথমিক জিজ্ঞাসায় কিছু জানা যায়নি। তবে রিমান্ডে নিলেই সত্যি বের হয়ে আসবে। তখন বাদী বিবাদী সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। বাদী পক্ষ থেকে মিথিলা যাকে আপনি বোরখা পরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, সে তার মুখের অবগুণ্ঠন খুলে ফেলল।অনেক দিন পরে তার সুন্দর মুখটা আমি আবার দেখলাম কিন্তু মুক্ত হয়েও কষ্টে ডোবানো সমস্ত শক্তি নিঃশোষিত ।এরপর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে যা করলো তা আরও বিস্ময়কর। সে তার সাক্ষী বয়ান করতে গিয়ে আসামী সনাক্ত করতে অস্বীকার করে বসে। বলে সে নাকি এদের কাউকে চেনে নাএবং এই মর্মে সাক্ষী দেয় যে সে নাকি স্বেচ্ছায় নিজ থেকেই বাড়ি ছেড়ে ছেলে নিয়ে তিনদিন তার কোন গোপন অনুরাগীর বাড়িতে ছিল। তাকে কেউ জোর জবরদস্তি করেনি।সে এই দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায় তাই এমন করেছে । সে নাকি তার স্বামীকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না।
সাজ্জাদের মনে পড়ছে সেই সময়ের কথা।কোর্টে সেই সময়ে বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল মিথিলার দিকে।তার ভেতর প্রশ্ন দ্বিধা সব কিছু কেমন জড়িয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
” তুমি এইগুলা কী বলছ? এসব…
“তোমার কাজ সহজ করে দিলাম সাজ্জাদ। এখন আমায় ত্যাগ করতে তোমার সুবিধা হবে”
মিথিলার শীতল কণ্ঠে কিছু ছিল সাজ্জাদ তখন বেশিক্ষণ তার চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মিথিলার ঠান্ডা মাথায় দেওয়া সাক্ষীর কারণে পুলিশ এই কেস হেরে যায় আর সন্দেহজনক আসামীরা মুক্ত হয়ে যায়।
“কী অদ্ভুত বিচার ভেবে দেখেন, যাকে আপনি তার অশুচিতা অপবিত্রতার জন্য ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন সে আপনাকে সেই সুযোগ দিলো না। উল্টো এক অর্থে আপনার সো কল্ড সোশ্যাল ডিগনিটিকে লাথি মেরে চলে গেল। গেলো ত গেলো যাবার আগে থাপ্পড় দিয়ে গেল, আপনার পুরুষত্বের উপর প্রশ্ন তুলে গেল । হৃদয় ভাঙার কতটা কষ্ট কতটা হতাশা থাকলে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে আপনি জানেন? ও ভেঙে গুড়িয়ে যেত যদি সময় মতো ওকে নিয়ে আমি ক্যানাডায় না ফিরতাম।কোর্টের ঝামেলা মিটে যাবার পরও নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। আমার সব অপরাধ স্বীকার করার পরও মিথিলা কোন প্রতিক্রিয়া করলো না ওর ভেতরটা তখন মৃতপ্রায়। জীবনের নতুন সফরে মিথিলার মাই আমায় দায়িত্ব দিয়েছিল লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। সেই থেকে দীর্ঘ দিন প্রবাসে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ওকে কাছে থেকে দেখেছি ওকে জেনেছি বুঝেছি… । তাই আজ একটা প্রশ্ন করি,আপনি ছয় বছর তার সাথে সংসার করেছেন ভালো ভাবে চিন্তা করে বলেন ত, আপনি তার পায়ের নখের যোগ্য ছিলেন?
” গেট আউট সাজিদ! আমি এর আগে তোমার কোন ক্ষতি করে ফেলি গেট আউট!
সাজিদ হাসলো, “যাচ্ছি সাজ্জাদ সাহেব, তবে তথ্য দিয়ে যাই, আপনি যে সারাজীবন একা থেকে নিজের ছেলের কাছ থেকে সমস্ত সমবেদনা আদায় করে নিয়েছেন,এটা আপনার মহত্ব ছিল না আপনার হিপোক্রেসি ছিল। আপনি অলরেডি একছেলের বাবা ছিলেন দাম্পত্য সম্পর্কে আপনার আর আগ্রহ ছিল না, তবে আপনার টাকা ছিল। টাকা থাকলে জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর সমস্যা না। আপনি সেই ব্যাবস্থা করেছিলেন বিয়ের ঝামেলায় আর গেলেন না। সবাই ভাবতো আহা কতো একনিষ্ঠ স্বামী ছিল। মানুষের সিম্পেথি উপভোগ করলেন, সাথে ছেলের দিকে খেয়াল করলেন । নিজেকে ভালো বানিয়ে মুল ঘটনাকে রঙচঙে করে ছেলেকে বুঝিয়েছেন। তার চোখে তার মাকে খারাপ বানিয়েছেন । তবে এখন এগুলো আর বোধহয় ধোপে টিকবে না। আপনার ছেলে আসল সত্যিটা এতোক্ষণে জেনে গেছে যে তার বাবা কতটা কাপুরুষ কতটা নির্লজ্জ ছোটলোক…।সন্তানের চোখে আপনি নিচে নেমে গেছেন মিথিলা মারা যাবার আগে তেমন ব্যাবস্থা করে গেছে। আর এই সত্যটা তাকে কে জানিয়েছে জানেন? থাক, ওটা নাহয় নাই বলি,আপনার সহ্য হবে না। ”

“শ্যাট আপ ইউ স্কাউন্ড্রেল, আই সে গেট আউট বৌ মা বৌমা কে আছিস…”
তনিমা ছুটে আসছে, নার্স মেয়েটা এসে সাজ্জাদকে ধরেছে। শায়ন কোথায় শায়ন ওকে একটু খবর দাও, সাজ্জাদের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে..
*****
” জানো শায়ন, তুমি কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলে যেদিন ওই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে গেলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমায় আদর করে দেই। তোমার কাছ থেকে আলাদা হচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল হৃদয়টা কেউ যেন ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।ভেতর থেকে আমি আর্তনাদ করে কাঁদছি বাইরে থেকে আমার চোখ যেন কাঁচের পাথর। প্রাণপণে মন শক্ত করে বেরিয়ে এসেছি সেবাড়ির চৌকাঠ থেকে । আমার আরেক সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেটা প্রয়োজন ছিল। যা কিছু ঘটেছিল এই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব যতই বৈধ হতো, হয়তো কখনো তার বাবার স্বীকৃতি পেতো না। আমায় মেনে নিলেও হয়তো তাকে এই পৃথিবীতে আসার অনুমতিই দেওয়া হতো না । কিন্তু ততদিনে আমার মাঝে বিদ্রোহী সত্তা জেগে উঠেছিল। আমার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো আমি নিজের ঝুঁকিতে নেবার জন্য তৈরি ছিলাম।একটা বাচ্চার দায়িত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে সাজ্জাদের ঘাড়ে ফেলে, দর্প নিয়েই আমি তার ঘর ছাড়লাম,। ভালো মতো বুঝে-শুনে আমার সর্বনাশের মূলহোতা সাজিদের সাথেই দেশ ছাড়লাম।
না! আমি এই কর্মের জন্য কখনো কোনভাবেই নিজেকে দোষী মনে করি না। আমি যদি সত্যি কোন অপরাধ থেকে থাকে সেটা তোমার কাছে। আমি তোমার দোষী আমি তোমার বাবার আক্রোশের হিসাব নিতে তোমাকে বঞ্চিত করেছি… ।
না বাবা,হয়তো এই অপরাধবোধে পরবর্তী জীবনে আমি কারও সঙ্গী হইনি।সম্পর্ক, অঙ্গিকার,বিশ্বাস, মর্যাদা এই সব শব্দগুলো আমায় কেন যেন আতঙ্কিত করতো। ছেড়ে আসা পথে আমার নতুন করে হাঁটতে ইচ্ছা করেনি।
কাউকে স্বামীর স্থান দিয়ে ভালো বন্ধু হারাতে চাইনি। আমার বেচে থাকার অবলম্বন ছিলে শুধু তুমি আর মৈথিলী। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তুমি মুরগির ঝোল দিয়ে আমার হাতে ভাত খেতে চেয়েছিলে। বিশ্বাস করবে আমি বাকি জীবনে কখনো তা মুখে দিতে পারিনি।
বাবাগো, এমন একটা রাত নেই যে রাতে আমার তোমার কথা মনে হয়নি।তোমার গায়ের গন্ধ তোমার ভাঙা ভাঙা কথা, তোমার ফোকলা দাঁতের হাসি, তোমার দুষ্টামিগুলো প্রতিটি দিন আমায় কাঁদাতো। তোমার প্রতিটা জন্মদিনে আমি নফল রোজা রাখতাম। তোমার প্রিয় খেলনা তোমার প্রিয় রঙের জামা কিনে কিনে কবার্ড ভরে দিতাম। মৈথিলীর ঘুমন্ত মুখটায় সব সময় আমি তোমায় খুঁজতাম। ও বেড়ে উঠেছে তোমার গল্প শুনে শুনে যে তার ভাইয়া এমন তার ভাইয়া তেমন.. । অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না। তোমাদের দুজনের বড় হবার কথা ছিল একসাথে। পাবার কথা ছিল ভাইবোনের খুনসুটি ভরা আনন্দের এক শৈশব। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমার হৃদয়ে দুটো ছিন্ন টুকরো পৃথিবীর দুই প্রান্তে বুকের মাঝে তীব্র কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছে। এর দায়ভার আমি কাকে দেব?
জেনে ভালো লাগলো যে আজ তুমি সফলতার সাথে পুরাকৌশলে ডিগ্রি নিয়েছ আজ তুমি কারো স্বামী। হয়তো কোনো একদিন কারো বাবা হবে। অনেক অনেক দোয়া তোমার ভবিষ্যতের জন্য। মায়ের অধিকারে নয় শুধু একজন নারী হবার অধিকারে তোমাকে কিছু কথা বলি, যেকোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর সম্মানবোধ। এটা থাকলে তুমি কখনো তাকে তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাচ্ছিল্য করবে না। প্রত্যেকটা মানুষ শুধু মানুষ হবার কারণে কিছুটা সম্মান প্রাপ্য হয় তাকে সেই সম্মান দিও। কাউকে আপন করতে হলে কখনো বদলে দিতে বা আটকে রাখতে চাইবে না। বদলে দিয়ে বা শেকল পরালে তুমি তার শরীর ত জয় করবে তাকে নিয়ে সুখী কখনো হতে পারবে না। চতুষ্পদ জন্তুদের পোষ মানানো যায় মানুষকে ভালোবেসে জয় করতে হয়। দায়িত্ব পালনের জন্য কখনো ভালোবেসো না ভালোবাসার জন্য দায়িত্ব পালন করো। মনে রেখো শরীরে আঘাত করলেই নয়, হৃদয়ে আঘাত করলেও রক্তপাত হয়। এতো রক্ত ঝরিয়ো না যে কারো বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই চলে যায়। ভালোবাসার সফরে কিছু মানুষ সঙ্গীকে ছেড়ে যায় আবার কিছু মানুষ নিজের অযোগ্যতায় তাদের ধরে রাখতে পারে না। আমি দোয়া করি এমন বাস্তব তোমার জীবনে কখনো না আসে তুমি সব সময়….
” রিপোর্ট এসে গেছে “মৈথিলীর কথায় শায়ন চিঠি থেকে মুখ সরালো। মৈথিলীর মুখে শোক আর তীব্র বিতৃষ্ণার মিশেল।
” খুবই ডিস এপয়েন্টিং! ” মৈথিলী আক্ষেপ নিয়ে বলল। শায়ন চমকে তাকালো তবে কী..?মৈথিলী ঢাকা মেডিকেল কলেজের রিপোর্টটা শায়নের দিকে বাড়িয়ে বলল
” নিন আপনিও পড়েন, আপনার আর আমার ডি এন এ রিপোর্ট। পড়ে ভালো লাগতে পারে, এটা আপনার মায়ের সতীত্বর আক্ষরিক প্রমাণ।তবে আমি হতাশ। জানেন আমি মনে মনে আশা করেছিলাম যেন এতোটা পবিত্র সে না হোক,একটু ভুল যেন তাকে স্পর্শ করে অন্তত আমার শরীরে ওই জঘন্য মানুষটার রক্ত না থাকে যার অহংকারের জন্য এতো গুলো জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।
শায়ন চুপ করে রইল। তার রিপোর্ট খুলে দেখিতে ইচ্ছা হচ্ছে না। নিজের মৃমৃত নির্দোষ মাকে আর অপমান করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
মৈথিলী স্বগতোক্তি করলো,” আমি সত্যি চাইছিলাম আমার শরীরে যেন তারই রক্ত থাকে যিনি আমার নাম রেখেছেন। যাকে আমি ছোটবেলা থেকে মনে মনে বাবা হিসেবে কল্পনা করে এসেছি।সাজিদ আঙ্কেল, যে আমায় মানুষকে সম্মান করতে শিখিয়েছে জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, ভেতর থেকে শক্ত হতে শিখিয়েছে। আমার মা যার নিখাদ ভালোবাসাকে কখনোই…
শায়নের মোবাইল ফোন বেজে উঠেছে তনিমার আওয়াজ, ” হ্যালো শায়ন বাসায় এসো প্লিজ বাবার শরীর খুব খারাপ করছে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে ..”
” যেখানে মন চায় নাও আমি মিটিংয়ে… ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠলো শায়ন। তনিমা হতভম্ব, শায়ন দ্রুত নিজেকে সামলাচ্ছে, কোমল গলায় বলল, ” তনু স্যরি, একচুলি আমি একটা জরুরি কাজে নিউ মার্কেটে একজনের সাথে, তুমি বাবাকে নিয়ে হসপিটালে যাও আমি কাজ সেরে সোজা সেখানেই আসছি কেমন? ”
শায়ন ফোন রাখতে রাখতে খেয়াল করলো তার সামনের চেয়ার ফাঁকা। মৈথিলী বিদায় নিয়ে গেট পার হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে,হাতের মায়ের লেখা সেই অমূল্য চিঠি। ভিড়ের মাঝেও একা তবুও কতো দৃঢ় শক্ত তার পদক্ষেপ।
শায়নের মনে হলো একবার ছুটে যায়, হাত ধরে বলে, ” মৈথিলী চল আপু বাসায় চল। কিন্তু কেন যেন সাহস হচ্ছে না কারণ আজ মৈথিলীর কাউকে দরকার নেই।
(সমাপ্তি)
#শারমিন_আঞ্জুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here