#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_২
#পর্ব_২
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
প্রচণ্ড এক থা’ প্প’ড়ে স্তব্ধ বনে গেছে রিয়াদ। গালে হাত দিয়ে সে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সকালের দিকে। পাশে থাকা বন্ধুরাও বেশ অবাক সকালের এমন আচরণে। বেশ কয়েকদিন ধরেই সকালকে বিরক্ত করছিল ওরা। প্রতিদিন চুপ থাকলেও আজ আর চুপ থাকতে পারল না।
সকালের চোয়াল শক্ত। সেও আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘এতক্ষণ তো মুখ দিয়ে খুব গান আসছিল। এখন গান গাইছিস না কেন?’
সন্ধ্যার অন্ধকার দিনের আলোকে গ্রাস করেছে বহু পূর্বেই। সকাল অংক করতে গিয়ে দেখে কলমের কালি শেষ। বাড়িতে এক্সট্রা কলমও নেই। দোকান বাড়ি থেকে কাছেই বিধায় সে নিজেই কলম কিনতে বের হয়েছিল। আর তখনই প্রতিদিনের মতো রিয়াদ ও তার বন্ধুরা সকালকে দেখে গান গাওয়া শুরু করে। এক কথায় উ’ত্য’ক্ত করে। রাস্তার ধারে লোকজন হাঁটাচলা করছে। রিয়াদ পালটা আক্রমণ করতে গিয়েও যেন করতে পারছে না। সেই সময়ে গলির মুখে অর্ষাকে দেখা যায়। সে সকালকে দেখেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে সকালকে জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী হয়েছে?’
সকাল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ওদের গান গাওয়ার শখ মিটাচ্ছি। প্রতিদিন আমাকে দেখলেই বিরক্ত করে।’
অর্ষা এবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কিরে কলিজা কি খুব বড়ো? মেয়ে দেখলেই গলার সুর বেড়ে যায়?’
ছেলেগুলো নিরুত্তর। অর্ষা বলল,’নেক্সট টাইম থেকে মেয়ে দেখলেই গান গাওয়া বন্ধ করিস। নয়তো থা’প্প’ড়ে কান গরম করে ফেলব।’
এরপর সকালকে নিয়ে অর্ষা বাড়িতে চলে আসে। মেজাজ ঠাণ্ডা হলে সকাল অর্ষাকে জিজ্ঞেস করল,
‘রাফিকে পড়াতে কেমন লাগল?’
অর্ষা হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। তার চোখ বন্ধ। অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। সে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
‘বিরক্তিকর!’
‘সেকি! কেন?’
‘কেন মানে? ওটা বাচ্চা নাকি রোবট? কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে।’
সকাল হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে বলে,’যখন ফ্রি হয়ে যাবে তখন দেখিস কত মিশুক।’
‘আমার আর দেখে কাজ নেই।’
‘মানে কী?’
অর্ষা শোয়া থেকে উঠে বসল। ওড়নার সেফটিপিন খুলতে খুলতে বলল,
‘মানে আমি আর রাফিকে পড়াতে যাচ্ছি না।’
‘এমন করিস না আপু! রেজাল্ট খারাপ হবে ওর।’
‘হোক। তাতে আমার কী? বাচ্চাকে নিয়ে আমার যতটা না সমস্যা; তার চেয়ে বেশি সমস্যা বাচ্চার মামাকে নিয়ে।’
‘আহনাফ ভাইয়ার কথা বলছিস?’
‘হু।’
‘সে আবার তোকে কী করল?’
‘আরে রাফিকে পড়াতে গিয়ে আমার ঘুম চলে এসেছিল। টেবিলের ওপর মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। তুই তো জানিস, আমার কান আবার পাতলা। কেউ আসছে শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে একটা বই হাতে নিলাম। মানে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমি ভীষণ মনোযোগ দিয়ে বইটা দেখছি। ঘুমের মধ্যে আর খেয়াল করিনি যে, আমি উলটো ধরেছি। উনি আসলো। চুপচাপ কয়েক সেকেণ্ড থেকে যাওয়ার আগে বলল, বই উলটো করে ধরেছেন। সোজা করে ধরে পড়ুন। এভাবে লজ্জা দেওয়ার কোনো মানে হয়?’
পুরো ঘটনা শুনে সকালের হাসি দেখে কে! হাসতে হাসতে কী যেন বলছে। কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে অর্ষা। সে সকালকে আর না ঘাঁটিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। কিছুতেই সেই সময়টুকুর কথা সে ভুলতে পারছে না। এমনভাবে প্রথমদিনই যে অপদস্থ হতে হবে এটা সে কল্পনাতেও ভাবেনি। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেছিল। আহনাফ অবশ্য কথাটি বলেই চলে গেছিল। যত যাই হোক, অর্ষা আর যাবে না। ঐ মানুষটার মুখোমুখি সে কিছুতেই হতে পারবে না।
ফ্রেশ হয়ে এসে সে নিজেই চুলোয় চা বসাল। এক কাপ কড়া চা না খেলে তার মাথা ধরা সহজে ছাড়বে না। সেলিনা বেগম রান্নাঘরের লাইট জ্বলতে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
‘কী করছিস?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ষা। মায়ের প্রশ্ন শুনে দরজার দিকে একবার তাকাল। থমথমে মুখে বলল,
‘চা করছি। খাবে?’
‘আমি খাব না। তোর বাবার জন্য বানা।’
অর্ষা আর কিছু বলল না। সেলিনা বেগম তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সম্ভবত তিনি কিছু বলতে চাচ্ছেন। অর্ষা নিজেও এটা বুঝতে পারে। জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু বলবে?’
তিনি বললেন,’না।’
পরক্ষণেই আবার কাচুমুচু হয়ে বললেন,’তুই কি রাগ করে আছিস?’
‘রাগ করব কেন?’
‘আসলে রুহুলটা তো এমনই! তুই তো জানিস…’
মাকে থামিয়ে দিলো অর্ষা। মুখপানে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার এত সাফাই গাইতে হবে না, মা। তোমাদের ছেলে তোমরা যা ভালো বোঝো করবে। আমার কী তাতে?’
‘তুই তো কথাটা রাগ করে বললি।’
‘মোটেও না। আমি কথাই বলি এভাবে।’
কথা বলতে বলতে অন্য চুলায় দুধও গরম করে নিয়েছিল অর্ষা। একটা গ্লাসে দুধ ঢেলে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা সকালকে দিয়ে আসবে?’
সেলিনা বেগম হাত বাড়িয়ে গ্লাসটি নিলেন। মেয়ের রাগ সম্পর্কে অবগত সে। রুহুলের মতো চেঁচামেচি করে না। তবে রাগের কমতি নেই। যাকে বলে নিরব রাগ। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি চলে গেলেন। চা বানিয়ে এক কাপ চা ওমর রহমানকে দিয়ে নিজের কাপটি নিয়ে রুমে চলে গেল অর্ষা। বিছানায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দিলো।
হায়ার ম্যাথের জটিল অংক কষছিল সকাল। বোনের উপস্থিতিতে বলল,
‘আপু আমায় চা দিলি না কেন?’
‘সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তোর। চা খেয়ে রাত জাগা যাবে না। যেটা খেলে কাজে লাগবে সেটাই খা।’
সকাল কিছু বলল না। চা শেষ করে অর্ষা শুয়ে পড়ল। চোখের ওপর হাত রেখে সকালের উদ্দেশ্যে বলল,
‘শোন, রাস্তাঘাটে সাবধানে চলবি। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে একা বের হবি না। কিছু প্রয়োজন হলে আব্বাকে বলবি। রিয়াদ যদি কিছু বলে তাহলে তোর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমাকে এসে জানাবি।’
সকাল এই প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলল না। সে বলল,
‘তুই কি এখন ঘুমাবি?’
‘হু।’
‘খাবি না?’
‘না। মা ডাকতে এলে বলবি, আমার ক্ষুধা নেই। এখন পড় তুই।’
সকাল অর্ষার কথা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করল। পড়া শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে ফজরের আজানের সময়। অর্ষা হাই তুলতে তুলতে ধাক্কাধাক্কি করছে তাকে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে দু’বোনে একসাথে নামাজ আদায় করে নেয়। ওমর রহমান মসজিদে গেছেন নামাজ আদায় করার জন্য। সকাল নামাজ শেষ করে পড়তে বসে। অর্ষা চলে যায় রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করার জন্য। সেলিনা বেগমকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
ভাত চড়িয়ে দিয়ে তিনি আনমনে তরকারি কাটছিলেন। অর্ষা রাতের এঁটো থালা-বাসনগুলো ধুয়ে ফেলে। আড়চোখে সে মাকেও লক্ষ্য করছিল। না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলে,
‘কী ভাবছ?’
হঠাৎ প্রশ্ন শুনে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘রুহুল রাতে বাড়িতে ফেরেনি।’
‘ফোন করোনি?’
‘করেছে তোর বাবা। ফোন ধরেনি।’
‘এত চিন্তার কী আছে? চলে আসবে সকালে।’
তিনি ফ্যালফ্যাল করে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা এত কঠোর স্বভাবের কেন? বাইরে থেকে যেমন কঠোর, ভেতর থেকেও কি তাই?
রুহুল বাড়িতে এলো সকাল আটটায়। সঙ্গে তার বন্ধু তোফায়েল। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েই তোফায়েল অর্ষার নাম ধরে ডাকতে থাকে। অর্ষা বের হয়ে আসে বারান্দায়। অবিন্যস্ত রুহুলের দিকে দৃকপাত করে তোফায়েলকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে ভাইয়ার?’
তোফায়েল ও-কে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল,’রাতে আমার বাসায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।’
রুহুলকে শুইয়ে দিয়ে কপালে হাত রাখল অর্ষা। শরীর প্রচুর গরম। গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে সে তোফায়েলের দিকে তাকাল। শান্ত কিন্তু কঠিনভাবে বলল,
‘ড্রিঙ্কস করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।’
তোফায়েল আমতা-আমতা করে।
‘না মানে, আসলে এক বন্ধুর জন্মদিন…’
‘জন্মদিনে ম’দ্য’পা’ন করা লাগে আমি জানতাম না।’
‘তুমি ভুল বুঝছ অর্ষা।’
‘তাহলে সঠিকটা আমায় বুঝিয়ে দিন।’
তোফায়েল চুপ করে রইল। অর্ষা বলল,’আপনাদের মতো বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই আমার ভাইটা খারাপ হয়েছে। কথায় আছে না, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ? খারাপ সঙ্গ পেয়েই খারাপ হয়েছে।’
তোফায়েল মাথা নিচু করে রেখেছে। অর্ষাও আর কিছু বলল না। ঘুমন্ত রুহুলের দিকে একবার তাকিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
___________
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল আশিক, দিদার আর রেশমি। গেইট থেকেই ওদেরকে দেখা যাচ্ছিল। ভেতরে ঢোকার সময় আহিলের সাথে দেখা হয়ে যায় অর্ষার। আহিল একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। যেন সে কস্মিনকালেও অর্ষাকে দেখেনি কখনও। আহিল যতটা পারছিল এই গ্রুপটা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিল। অপরদিকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অর্ষা নিজেও ঠিক এটাই করছিল। তবে আশিক, দিদার, লামিয়া, রেশমি এবং জুঁইকে এড়িয়ে চলা ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। আশিক তো পারে না শুধু আহিলের গলায় ঝুলে যেতে। বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে সে। উপরন্তু অর্ষাও পারছে না কিছু বলতে। অর্ষা, আহিল এমনভাবে দুজন দুজনের দিকে তাকায় মনে হচ্ছিল ওরা একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বী।
দুটো ক্লাস করে ওরা ক্লাসে বসে আছে। স্যার সম্ভবত আসেনি নাকি আসবে না বুঝতে পারছিল না। রেশমি তখন আশিককে বলে,
‘আশিক একটা কবিতা শোনাও।’
খুশিতে গদগদ হয়ে যায় আশিক। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘তুমি আমি ফুলের কাঁটা
মা দেখলে মারবে ঝাঁটা,
বন্ধু তুই সরে দাঁড়া;
মায়ের রাগে আমি দিশেহারা।’
কবিতা শুনে শুধু যে রেশমি হাসল তা নয়, যারা যারা শুনেছে প্রত্যেকে হেসে ওঠে। আহিল চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘এসব উদ্ভট কবিতা তোমার মাথায় আসে কী করে?’
আশিক চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে,’কী বলছ ব্রো! এগুলো উদ্ভট নয়, অ্যামাজিং বলো।’
‘অ্যামাজিং নয় বরং অ্যামাজন বলা যায়।’
আশিক দমে গেল না। মুচকি হেসে আহিলের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘রাগ করে না সন্টু টোনা
এনে দেবো কাপড়ের ঝোলা,
কাপড়ের ভেতর আমের বাটি;
তোমায় দেবো আমের আঁটি।
রাগ করলে তাও দেবো না
দেবো তোমায় সুড়সুড়ি।’
কবিতা শুনে আহিলের অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। অর্ষা এবার আর হাসি লুকিয়ে রাখতে পারল না। সে নিজেও আশিকের প্রসংশা করল হাসতে হাসতে। এবং বলাই বাহুল্য, এত অল্প সময়েই ক্লাসের সবাই আশিককে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। আহিল এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল অর্ষার বিরক্ত হয়ে থাকা মুখখানা। কিন্তু যেই না তাকে এখন হাসতে দেখল, রাগে শরীর জ্বলে গেল তার।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বাকি ক্লাসগুলো করে। খুব চেষ্টা করছিল নিরব থাকার। ওদের সাথে কোনো রকম বাক্যবিনিময় না করে বোবা হয়ে থাকাকেই সে ঢের ভালো বলে মনে করে। ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আহিল কেটে পড়ে। ওদিকে অর্ষাও তাড়া দেখিয়ে বিদায় নিয়ে নেয়।
বাসায় ফিরে দেখে রুহুলের জ্বর তখনও কমেনি। কাঁথা গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। জ্বর না এলে এই সময়ে ভু্লেও তাকে বাড়িতে পাওয়া যেত না। বাড়িতে ঠিকমতো খায়ও না। সকালে হালকা নাস্তা করে সেই যে বের হয়, তারপর আর কোনো খোঁজ-খবর নেই। বাড়ি ফেরে রাত করে। এভাবে ভবঘুরে হয়েই তার দিন কাটছে। বিছানায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অর্ষা। তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। দরজায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দৃশ্যটি দেখেন সেলিনা বেগম। রুহুলের ঘুমন্ত মুখটা দেখে অর্ষার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সে রুদ্ধশ্বাসে বলে,
‘কেন এভাবে বদলে গেলি ভাইয়া? আগের মতো হয়ে যা না!’
রুহুল ঘুমের ঘোরেই নড়েচড়ে ওঠে। নিজেকে সামলে নেয় অর্ষা। ঘুম ভাঙার আগেই তড়িঘড়ি করে সে নিজের রুমে চলে যায়। একবার পেছনে তাকালেই দেখতে পেত সেলিনা বেগম তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রয়েছে।
অর্ষা দুপুরে গোসল করে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গতকালের মতো আজও তার ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সকাল কলেজ থেকে ফিরেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিয়েছে। তার মেজাজ খারাপ হলেও সকালকে ধমকে দিতে পারল না। শুধু মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
‘চাকরিটা হয়ে গেলেই আমি আর ও-কে পড়াতে যাব না।’
সকাল দাঁত বের করে হেসে বলল,’ঠিক আছে।’
খিটখিটে মেজাজ নিয়ে রেডি হয়ে অর্ষা বেরিয়ে পড়ে। সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পথ থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠে নিজের নাম শুনে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। রিকশা থেকে নেমে একটা মেয়ে ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে। ব্যাগটা বেশ বড়োসড়ো। মেয়েটা কাছে আসার পর একটু অবাকই হলো অর্ষা। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘মুন!’
মুন অর্ষার হাই স্কুলের ফ্রেন্ড ছিল। একসাথে ওরা ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছিল। সেই সময়টা ছিল প্রজাপতির রঙিন ডানার মতো। হাসি-আড্ডা সব মিলিয়ে সুন্দর অতীত ছিল। সময়ের বিবর্তনে বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ কমে এসেছে। বেশিরভাগ বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তারা প্রত্যেকেই এখন সংসার, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। তবে মুনের বিষয়টা এখানে আলাদা। এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্টের পর হুট করেই মেয়েটা উধাও হয়ে যায়। মাস খানেক পর ওর বাবা-মা’ও গ্রামে চলে যায়। মুনের যেই নাম্বারটি অর্ষার কাছে ছিল সেই নাম্বারে বারংবার ফোন করেও মুনকে পাওয়া যায়নি। কারণ নাম্বারটি বন্ধ ছিল। আজ দুই বছর পর মুনকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে অর্ষার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহও সে খুঁজে পাচ্ছে না। এটা অনাগ্রহ নাকি অভিমান সেই প্রশ্নও রয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্বেই হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে মুন। খুশিতে আহ্লাদিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছিস?’
অর্ষা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ভালো।’
‘তোর মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? রাগ করে আছিস?’
অর্ষার শরীরটা জ্বলে যাচ্ছিল। এভাবে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে এখন আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে রাগ করেছিস! নাটক! অর্ষা নিরুত্তর রইল।
‘যাচ্ছিস কোথায়?’ জানতে চাইল মুন।
অর্ষা কাঠ কাঠ গলায় বলল,’শ্বশুরবাড়ি।’
মুন অবাক হয়ে বলল,’হোয়াট! সত্যিই? তুই বিয়ে করে ফেলেছিস? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমি তো আরও তোর বাড়িতে যাচ্ছিলাম এখন।’
অর্ষা এবার নিজে থেকে প্রশ্ন করল,’কেন?’
‘সে অনেক কথা। কিন্তু এখন আমার হাতে এত সময় নেই। একটা জায়গায় যেতে হবে আগে।’ বলে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটি বের করল। তাড়া দিয়ে বলল,
‘তোর ফোন নাম্বারটা বল।’
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। মুন ফের তাড়া দিয়ে বলল,
‘কী হলো? বল।’
নাম্বার দিলো অর্ষা। অভিমানকে প্রশ্রয় দিলেও এতদিনের বন্ধুত্বকে একেবারে দূরে সরিয়ে দেওয়াটা তার পক্ষে সম্ভবপর হলো না কিছুতেই। মুন এবার নিজের সেই বড়ো ব্যাগটি অর্ষার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ব্যাগটা একটু নিয়ে যা প্লিজ! আমি ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসব। তোকে ফোন করব।’
অর্ষা কী বলবে বুঝতে পারল না। মুন অবশ্য উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েও নেই। সে অন্য একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়েছে। রিকশাটি চোখের আড়াল হওয়ার পর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অর্ষা। হাতে থাকা ব্যাগটির দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
‘কপাল!’
বাধ্য হয়ে ব্যাগ নিয়েই সে রাফিকে পড়াতে চলে যায়। রাফি গম্ভীর হয়ে বসে আছে অর্ষার সামনে। আজকে আবার কোন নাটক করবে কে জানে!
অর্ষা নিজেও একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলল,’আজকে একদম কোনো বাহানা বের করবে না। বই বের করো। আর হ্যাঁ, কাল যেই কবিতাটি পড়িয়ে ছিলাম; মনে আছে?’
রাফি গম্ভীরমুখেই উপর-নিচ মাথা নাড়াল।
‘গুড। ঝটপট কবিতাটি লিখে ফেলো।’
‘কেন? তুমি আবার ঘুমাবে?’
অর্ষা থতমত খেয়ে বলে,’ঘুমাব মানে?’
‘কালও তো আমি লেখার সময় ঘুমালে।’
‘কী আশ্চর্য! আমি ঘুমিয়েছি নাকি? চোখটা একটু লেগে এসেছিল এই যা!’
‘তুমি ফাঁকিবাজ।’
অর্ষা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,’আমি ফাঁকিবাজ?’
‘হ্যাঁ। মামা মাকে বলেছে, ফাঁকিবাজ ছাত্রের ফাঁকিবাজ ম্যাম। তোমার জন্য আমারও বদনাম হচ্ছে। সকাল ম্যাম খুব ভালো। তোমার মতো পড়াতে এসে ঘুমায় না।’
অর্ষার চোয়াল ঝুলে আছে। মুখ কিঞ্চিৎ হা। পরক্ষণেই যেন মেজাজ চটে গেল তার। একটু না হয় ঘুমই চলে এসেছিল, তাই বলে তাকে ফাঁকিবাজ উপাধি দিতে হবে?
রাগে গজগজ করতে করতে অর্ষা জিজ্ঞেস করল,’সত্যিই তোমার মামা আমায় ফাঁকিবাজ বলেছে?’
রাফি আবারও উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। উভয়সংকটে আছে সে। চলে যাবে নাকি রাফিকে পড়াবে বুঝতে পারছে না। সকালের কথা ভেবেই নিজেকে এবং রাগকে ধাতস্থ করল সে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে বলল,
‘কাম ডাউন অর্ষা। কাম ডাউন!’
রাফির দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি লেখা শুরু করো। আমি যে ফাঁকিবাজ নই, সেটার প্রমাণ এখন থেকেই পাবে তোমার মামা।’
রাফি কিছু বলল না। খাতা-কলম বের করে চুপচাপ লিখছে। রাফিকে পড়ানোর মাঝেই মুনের ফোন আসে। এই বাড়ির ঠিকানাটাই টেক্সট করে দেয় অর্ষা। রাফিকে পড়িয়ে দুজনে একসাথে বাড়িতে ফিরবে।
.
মিনিট দশেক পর আহনাফদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা থামে।রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়িটির দিকে একবার তাকাল মুন। বিশাল জায়গাজুড়ে দু’তলা ভবনের একটি সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে এবং দু’ধারে অনেক ধরণের গাছ-গাছালি রয়েছে। ফল আর ফুলের গাছই বেশি। বাড়ির ভেতর ঢুকতে যাওয়ার সময় দারোয়ান পথ আটকে জিজ্ঞেস করে,
‘কাকে চাই?’
মুন মুচকি হেসে বলল,’অর্ষার কাছে যাব।’
‘এই বাড়িতে অর্ষা নামে কেউ থাকে না।’
মুন একটু অবাক হলো। এরপর দ্বিধান্বিত মনে অর্ষার পাঠানো ঠিকানার সাথে বাড়িটির ঠিকানা মিলিয়ে নিল। না, ভুল তো হয়নি। এই বাড়িটাই। এবার সে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
‘অর্ষা এই বাড়িতেই থাকে। এইযে ও আমায় ঠিকানা পাঠিয়েছে।’
দারোয়ানও বলল,’আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।’
‘আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। এই বাড়িতেই অর্ষা থাকে।’
বাড়ির বাগানে হাঁটছিলেন জহির চৌধুরী। দারোয়ান এবং মুনের বাকবিতণ্ডা দেখে এগিয়ে আসেন এদিকে। একবার মুনের দিকে তাকালেন তিনি। এরপর দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে?’
দারোয়ান শীতল কণ্ঠে বলল,’স্যার, মেয়েটা বলছে অর্ষার কাছে যাবে। কিন্তু এই নামে তো এই বাড়িতে কেউ থাকে না। মেয়েটি বিশ্বাসই করছে না।’
জহির চৌধুরী এবার মুনকে জিজ্ঞেস করলেন,’কে তুমি?’
‘আঙ্কেল, আমি মুন। অর্ষার বান্ধবী। অনেকদিন পর ওর সাথে দেখা হয়েছে। ও-ই আমাকে ওর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।’
জহির চৌধুরী যারপরনাই অবাক হলেন এবার। অবাক হয়েছে দারোয়ানও। জহির চৌধুরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘শ্বশুরবাড়ি মানে! এটা তোমার বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি?’
‘জি। কিন্তু আপনি কে? এই বাড়ির কেউ? বাড়ির কেউ হলে অর্ষাকে কেন চিনতে পারছেন না বুঝলাম না।’
‘তুমি শিওর এটা অর্ষার শ্বশুরবাড়ি?’
‘আলবৎ!’
জহির চৌধুরী এবার একটু থমকালেন। কিছুক্ষণ আগে দুই তলা থেকে তিনি একটা মেয়েকে ব্যাগ হাতে ভেতরে ঢুকতে দেখেছেন। তাহলে কি আহনাফ লুকিয়ে বিয়েটিয়ে করে ফেলেছে? নিজের এই চিন্তা-ভাবনাকে তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। মুনকে একটু অপেক্ষা করতে বলে তিনি দারোয়ানকে পাঠালেন আহনাফকে ডাকার জন্য। দারোয়ান আহনাফকে সঙ্গে করেই ফিরে এলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আহনাফ মুন এবং বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
জহির চৌধুরী মুনকে জিজ্ঞেস করলেন,’ও-কে চিনতে পেরেছ?’
মুন আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,’না। কে উনি?’
‘আমার একমাত্র ছেলে। তোমার ভাষ্যমতে অর্ষা যদি এই বাড়ির বউ হয়ে থাকে, তাহলে অর্ষার স্বামীই এই ছেলে।’
মুন সালাম দিয়ে হাসিমুখে বলল,’আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই। ভালো আছেন?’
বিস্ময়ে হা হয়ে যায় আহনাফের মুখ। সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে মুনের দিকে। ভ্রুঁ কুঁচকে আছে তার। বিস্ময়ে অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
‘দুলাইভাই!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]