#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৭
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অফিসের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। কারও অপেক্ষা কিংবা গাড়ির জন্য নয়; জিদ্দে! জেদটা নিজের ওপর নাকি আহনাফের ওপর ঠিক বুঝতে পারছে না। চাকরিটা হতে হতেও যেন হলো না। মাছের মতো পিছলে গেল! যাবেই না বা কেন? একই তো ইন্টার্ভিউ মানে তার কাছে অন্যতম আ’ত’ঙ্ক। অন্যদিকে আহনাফের পলকহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আ’ত’ঙ্ক মনের ভেতর চাপা রাখতে পারলেও আহনাফের দৃষ্টি এড়িয়ে চলা যাচ্ছিল না। যার দরুণ জানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেনি। উলটো তুতলিয়েছে। এসির মাঝেও ঘেমেছে। যাচ্ছে তাই বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে গেল। বারবার মনে হচ্ছিল কখন ওখান থেকে বের হবে। আর এখন বাইরে এসে মনে হচ্ছে কেন বোকার মতো কাজটা করে ফেলল। কেন একটু স্ট্রং থাকতে পারল না। অনেকক্ষণ যাবৎ বাইরে এসে এসব ভাবার পর ক্লিয়ার মনে হচ্ছে, জেদটা আসলে আহনাফের ওপরই হচ্ছে। মনে মনে সে আহনাফের পিণ্ডি চটকাচ্ছে।
‘তুমি অফিস থেকে বেরিয়েছ আমায় জানাওনি কেন?’
অর্ষা পেছনে ফিরে তাকাল। শামীমকে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার। এখন লজ্জাজনক কথাটা সে শামীমকে কী করে বলবে?
‘ইন্টার্ভিউতে কী বলল?’ জানতে চাইল শামীম।
অর্ষা নতমুখে জানায়,’মনে হয় না চাকরিটা হবে।’
‘কেন?’
‘আমি কোনো প্রশ্নের উত্তরই ঠিকঠাকমতো দিতে পারিনি। খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম।’
শামীম কয়েক সেকেণ্ড নিশ্চুপ থেকে বলল,
‘আচ্ছা মন খারাপ কোরো না। আমার তো পরিচিত অনেক স্যার আছে এখানে। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস নিল। কিছু বলল না। শামীম হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,
‘আমি অফিসে যাচ্ছি। তুমি বাসায় চলে যাও। রিকশা ঠিক করে দেবো?’
‘না,না। আমি যেতে পারব। আপনি ভেতরে যান।’
শামীম মৃদু হেসে বলল,’ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর টেনশন কোরো না কেমন।’
স্মিত হাসল অর্ষা। শামীম ফের অফিসের ভেতর চলে যাওয়ার পর অর্ষাও আর দাঁড়াল না সেখানে। এখন সে হাঁটছে। খালি রিকশা অনেক আসছে, যাচ্ছে তবে রিকশায় উঠতে ইচ্ছে করছে না একদম। নিজের বাসায় যাবে নাকি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবে বুঝতে পারছে না। অনেক দোটানায় ভুগে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল বাসাতেই যাবে। আগামীকাল তো সবার সাথে এমনিতেও দেখা হবেই। আজ বরং একটু ঘুমানো যাক। সকল দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম মেডিসিন হচ্ছে ঘুম। অনেকদিন বাদে একটা শান্তির ঘুম হবে আজ।
অর্ষা বাড়িতে ফেরার পর ওমর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় প্রথমে। বাবাকে সংবাদটা জানাতে খারাপ লাগলেও মিথ্যে বলার উপায় নেই। ওমর রহমান মুচকি হেসে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। এক জায়গায় না এক জায়গায় চাকরি হয়ে যাবে দেখিস। এখন রেস্ট কর।’
‘আমি এখন ঘুমাব আব্বা। মাকে বলবে আমায় যেন না ডাকে।’
‘খাবি না নাকি?’
‘ঘুম থেকে উঠে খাব। ঘুম হয় না অনেকদিন।’
‘আচ্ছা মা। তাহলে এখন খেয়ে ঘুমা।’
বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে অর্ষা ফ্রেশ হয়ে অল্পকিছু খেয়ে নেয়। সব চিন্তা এক সাইডে রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে।
.
.
০৪.৩৫ মিনিট
ভূ’মি’ক’ম্পে সবকিছু উলটে-পালটে যাচ্ছে। ভে’ঙে-চূড়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। কী অদ্ভুত! ভূ’মি’ক’ম্প হলে এমন অনুভূতি হয় নাকি? পরক্ষণে অর্ষার হুঁশ এলো আসলে ভূ’মি’ক’ম্প নয়; বরঞ্চ সকাল তাকে ধাক্কাচ্ছিল। আর সে ভেবেছে ভূ’মি’ক’ম্প হয়েছে!
বিরক্ত হয়ে উঠে বসে অর্ষা। রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
‘ঘুমাচ্ছিস যে! রাফিকে প্রাইভেট পড়াতে যাবি না?’
‘ক’টা বাজে?’
‘প্রায় পাঁচটা বাজতে চলল।’
‘বলিস কী! এত?’
সকাল হাসি চেপে বলল,
‘হুম। ওঠ এখন।’
ঘুমে ঢুলুঢুলু জড়োসড়ো অর্ষার একদম ইচ্ছে করছে না সাধের ঘুম ছেড়ে উঠতে। আলসেমি জেঁকে ধরেছে তাকে। তবুও না গিয়েও তো উপায় নেই। সে মিনিট চারেক আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠল। হাই তুলতে তুলতে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সবে মাত্র ৪:১০ বাজে। সকাল শুধু শুধু এসে ঢপ মারল। আশেপাশে তাকিয়ে সকালকে পাওয়া গেল না। সে রাগে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
‘আস্ত বে’য়া’দব একটা!’
একমনে ভাবল আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে কিনা। তবে ভাবনাটি তাকে প্রত্যাখান করতে হলো। কেননা এখন আবার শুয়ে পড়লে পরে আর উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই আর না শুয়ে ফ্রেশ হয়ে, আস্তে-ধীরে রেডি হয়ে নিল। যাওয়ার পূর্বে সকালকে পাওয়া গেল বাবা-মায়ের রুমে। সে সকালের মাথায় চা’টি মে’রে বলল,
‘তোর বে’য়া’দ’বি’র শাস্তি।’
সকাল হাত দিয়ে মাথা ডলতে ডলতে অর্ষার চলে যাওয়া দেখছে।
__________
রাফিদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির বাগানে আহনাফকে দেখতে পেল অর্ষা। আহনাফও তখন বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য এগুচ্ছিল। অর্ষার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায় আহনাফকে দেখে। ইন্টার্ভিউয়ের কথা মনে পড়লেই রাগে শরীর রিরি করে উঠছে। চোয়াল শক্ত করে সে আহনাফকে দেখেও না দেখার ভান ধরে এগিয়ে যায়।
রেণু দরজা খুলে দুজনকে একসাথে দেখে। অর্ষা আহনাফের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আহনাফ তখনও অর্ষাকে দেখতে পায়নি। সে আগে আগে ভেতরে প্রবেশ করে। পেছন থেকে শুনতে পায় রেণু বলছে,
‘কী হইছে? মন খারাপ নাকি?’
আহনাফ অবাক হয় কিছুটা। তাকে দেখে কি মনে হচ্ছে তার মন খারাপ? সে উত্তর দেওয়ার জন্য পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল অর্ষাকে। আর বুঝতেও পারল উক্ত প্রশ্নটি তার জন্য নয়; বরঞ্চ অর্ষার জন্য ছিল।
অর্ষা একবারও তাকাচ্ছে না আহনাফের দিকে। সে রেণুর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। বলল,
‘না, মন খারাপ না। ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই মনে হয় এমন লাগছে। রাফি কোথায়?’
‘ওর ঘরে আছে। আপনে যান।’
অর্ষা এবারও আহনাফকে পুরোপুরি এড়িয়ে রাফির রুমে চলে গেল। এতে অবশ্য আহনাফ বেশ ভড়কে যায়। সে নিজের রুমের দিকে যাবেই ঠিক এমন সময় অর্ষাকে আবার ফিরে আসতে দেখা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ।
অর্ষা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
আহনাফ শান্তস্বরে বলল,’বলুন।’
অর্ষা আশেপাশে একবার তাকাল। রেণু কিংবা অন্য কেউ নেই এখন এখানে। সে গোপনে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘আপনি ওভাবে তাকিয়ে কেন ছিলেন?’
আচমকা অর্ষার এমন প্রশ্নে আহনাফের অবাক হওয়ার সীমা রইল না। সে বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চাইল,
‘হোয়াট! কখন? কোথায়? কীভাবে তাকিয়ে ছিলাম?’
‘সকালে। অফিসে। কেমনভাবে জানি! আপনার জন্যই আমার চাকরি হয়নি।’
আহনাফ এবার কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,
‘আমার জন্য নয়; বলুন যে আপনি একটা গা’ধী! কিচ্ছু পারেন না তাই চাকরি হয়নি। আপনি রাফিকে পড়ান কী করে?’
‘আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।’
‘আপনি নিজেই সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন।’
‘আমি কোনো সুযোগ করে দিইনি। আমি শুধু সত্যিটা বলেছি। আপনি মানুন কিংবা না মানুন, স্বীকার করুন আর না করুন; সত্যি এটাই যে আপনার ওরকমভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যই আমি চাকরিটা পেলাম না।’
‘এখন সব দোষ আমার চোখের?’
‘না, আপনার তাকানোতে।’
‘আমার তাকানোতে কী ছিল? আমি তো নরমালি তাকিয়ে ছিলাম। সবার বেলাতেই তাকাই।’
‘ওদের কারও চাকরিই নিশ্চয়ই হয়নি?’
‘আপনার মতো গা’ধা কিংবা গা’ধী যারা; তাদের হয়নি।’
‘ফের অপমান করছেন।’
‘ফের সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘শুধু শুধু আমাকে ব্লেইম করছেন। আমি বলছি তো, আপনার অন্যরকম ভাবে তাকানোর জন্যই আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।’
‘কেন? আমার চোখ, দৃষ্টি কি আপনাকে উত্তর দিতে বারণ করেছিল?’
‘সম্ভবত।’
‘সম্ভবত মানে? সম্ভবত কী?’
‘সম্ভবত বারণ করেছিল।’
‘তাই? কী করে শুনি?’
‘অত কিছু আমি জানি না। কিন্তু আপনার উচিত আমাকে স্যরি বলা।’
‘কোন সুখে?’
‘সুখে নয়। দুঃখে। আপনার জন্য আমার চাকরি হয়নি। এজন্য আমার প্রতি আপনার দুঃখবোধ হওয়া উচিত। ঠিক এ কারণেই আপনি এখন আমাকে স্যরি বলবেন।’
‘অসম্ভব! কখনও না।’
‘আশ্চর্য! কেন বলবেন না?’
‘কারণ আমার কোনো ভুল নেই। আর হ্যাঁ, তাও যদি আপনার কথাগুলো মেনে নিই; তাহলে আপনার ভাষ্যমতে স্যরি আমার বলা উচিত নয়।’
‘তবে কার বলা উচিত?’
‘আমার দৃষ্টির। এই নিন, আমার চোখের দিকে তাকান। তখন যেভাবে আমার দৃষ্টি আপনাকে উত্তর দিতে বারণ করেছিল, এখন সেভাবেই আবার স্যরি বলবে।’
অর্ষা আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে দু’সেকেণ্ড পরই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আহনাফ বলল,
‘কী হলো? চোখ সরিয়ে নিলেন কেন? স্যরি শুনবেন না?’
অর্ষা চোখ-মুখ পাকিয়ে বলল,’আপনি অসম্ভব রকম ফাজিল!’
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৮
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
রাফি তার গোল গোল চক্ষুদ্বয়ে ভারী বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। রাগে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল অর্ষা। আহনাফের সাথে আর কোনো রকম তর্ক না বাড়িয়েই চলে এসেছে। তখন থেকেই রাফি অর্ষার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। অর্ষা এতক্ষণ নখ দিয়ে টেবিল খুঁটছিল বলে রাফির তাকানো খেয়াল করেনি। এবার চোখাচোখি হতেই গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল,
‘কী হয়েছে?’
রাফি মুচকি হাসল। হয়তো এই প্রথমই সে অর্ষার সামনে হেসেছে। এতে অবশ্য অর্ষা কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বৈকি!
রাফি হেসে বলল,’রাগলে তো তোমাকে দারুণ লাগে।’
ছোটো এক বাচ্চার মুখে এমন প্রশংসার বাণী শুনে অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘তোমায় কে বলল আমি রেগে আছি?’
‘কেউ বলেনি। তোমায় দেখেই বুঝেছি।’
অর্ষা নিরুত্তর। রাফি বলল,
‘সত্যিই রাগলে তোমায় ভীষণ ভালো লাগে। তুমি অবশ্য এমনিতে সুন্দরী আছো। কিন্তু রাগ করলে বেশি সুন্দর লাগে।’
‘রাফি তুমি কি জানো তুমি একটা ইঁচড়েপাকা?’
‘ইঁচড়েপাকা মানে কী?’
‘অকালপক্ব।’
‘অকালপক্ব মানে কী?’
অর্ষার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘পড়ো চুপচাপ!’
ধমক খেয়ে রাফি কয়েক পলক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘আমায় কেউ কখনও বকে না। তুমি কেন বকো?’
‘কেউ বকে না বলেই তো এমন ইঁচড়েপাকা হয়েছ। আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ পড়ো।’
অর্ষার কড়া কড়া কথা শুনে রাফি চুপ হয়ে যায়। মুখটা কেমন যেন চুপসে গেছে। সে মাথা নত করে লিখছে এখন। মূলত অর্ষা অনিচ্ছাতেই আহনাফের ওপর রাগ রাফির ওপর ঝেড়ে ফেলেছে। মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই মেজাজ কিছুটা শান্ত হয় অর্ষার। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে অনুতপ্ত হয়। আরও বেশি আহত হয় রাফির শুকনো মুখটা দেখে।
অর্ষা রাফির বাম হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘রাগ করেছ? আসলে মেজাজটা খারাপ ছিল তো!’
রাফি বড়োদের মতো শুকনো মুখে বলল,
‘ইট’স ওকে।’
পড়ার মাঝখানে সে আর কোনো কথা বলেনি। সময় শেষ হতেই সে দৌঁড়ে চলে যায়। অর্ষা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ড্রয়িংরুমে রেণুকে দেখে থেমে যায়। আশেপাশে রাফি নেই লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,
‘রাফি কোথায়?’
‘দেখলাম তো দৌঁড়াইয়া গেল। মনে হয় খালাম্মার কাছে গেছে।’
অর্ষা বুঝে গেল রেণু আহনাফের মায়ের কথা বলছে। অর্ষা বলল,
‘আচ্ছা আমি তাহলে আসছি।’
‘বসেন একটু।’
‘কোনো দরকার?’
‘আগে বসেন।’
অর্ষা সোফায় বসার পর রেণু রান্নাঘরে ঢোকে। ফিরে আসে খিচুড়ির প্লেট নিয়ে। প্লেটটি অর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘গরম গরম ভুনাখিচুড়ি। খেয়ে বলেন তো কেমন হইছে।’
অর্ষা নাকচ করে। সে খাবে না। রেণুও নাছোড়বান্দা। অবশেষে রেণুর অনুরোরত স্বর শুনে অর্ষাকে খাওয়ার জন্য রাজি হতে হয়। খাওয়ার মাঝে গল্প করতে করতে অর্ষা অবাক করা এক সত্য কথা জানতে পারে। সে এতদিন ভাবত রাফি আহনাফের বোনের ছেলে। কিন্তু আজ জানল রেণুর ছেলে।
অর্ষার বিস্মিত মুখ দেখে রেণু মুচকি হেসে বলে,
‘প্রথম প্রথম সবাই ভাবে রাফি এই বাড়ির পোলা। আহনাফ ভাইজান ওরে ওমনেই পালছে।’
‘আপনার হাজবেন্ড কোথায় তাহলে?’
‘হেয় বিদেশ থাকে। বিয়ের আগে থেইকাই আমি এই বাড়িতে কাম করি। বিয়ের এক বছর পর হেয় বিদেশ চইলা যায়। তখন থেইকা রাফিরে নিয়া আমি এই বাড়িতেই থাকি।’
‘উনি আসেন না?’
‘আসে। পাঁচ বছর পরপর।’
অর্ষা প্লেট রেখে রেণুর হাত থেকে পানির গ্লাস নিল। পানিটুকু পান করে বলল,
‘আজ তাহলে আসি আপু।’
‘আচ্ছা আপা।’
_________
‘এত মানুষ ম’রে তুই ম’র’তে পারস না? তুই ম’র’লেও তো আমি একটু শান্তি পাই। আল্লাহ্ কি তোরে কৈ মাছের জান দিছে? এ’ক্সি’ডে’ন্ট হইল তবুও ম’র’লি না ক্যান?’
শিমলা বেগমের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা আচরণ এবং তিরস্কার শুনেও আহিল চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে প্রতিটা কথার জবাব দিতে। কিন্তু পারে না। এর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে গেলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। দমে যায় সে। এভাবে যে কতবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও ফিরে এসেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে ভাবত একদিন হয়তো শিমলা বেগম থেমে যাবেন। কিন্তু না! আহিলের নীরবতায় তার তিরস্কারের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। খুব ইচ্ছে করে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। সেই উপায়টাও নেই। সে চলে গেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে দেখবে কে? শিমলা বেগম কতটা ডে’ঞ্জা’রা’স সেটা তার থেকে ভালো আর কে জানে! এসব ভেবেই মনে মনে একটা ভারী শ্বাস নিল আহিল। শরীরে এখনও বেশ ভালো রকম ব্যথাই আছে বলে বাড়ির বাইরে যায়নি। আশিক, দিদার অনেকবার বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিল। আহিল দেয়নি। এই বাড়ির ঠিকানা দিয়েই বা কী হবে? বন্ধুরা তো নূন্যতম সম্মানও পাবে না এখানে। এছাড়া সে চায় না তার তিক্তময় জীবনটার কথা বাড়ির বাইরের কেউ জানুক। একটা শক্ত খোলসে সে যেমন নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে, বাইরের মানুষগুলোও সেই শক্ত আবরণটাই শুধু দেখুক। ভেতরের ক্ষ’তে না হয় একটু একটু করে দ’গ্ধ হোক সে।
.
.
রাত ১০টার দিকে শামীমের কল আসে। ফোন চার্জে দিয়ে শুয়ে ছিল অর্ষা। হয়তো এর মাঝে ঘুমিয়েও পড়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ রিং হওয়ার পরও অর্ষা উঠছে না দেখে সকাল ফোন নিয়ে অর্ষাকে ডাকে।
‘আপু তোর ফোন।’
‘কে ফোন করেছে?’ ঘুমঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে অর্ষা।
‘শামীম ভাইয়া।’
অর্ষা এবার ফোন হাতে নেয়। রিসিভ করে হু, হা, আচ্ছা এসবই বলে। ফোন রাখার পর সকাল জিজ্ঞেস করে,
‘কী বলল?’
‘চাকরিটা হয়ে গেছে! কাল সকালে অফিসে যেতে বলল।’
‘তোর না বলে চাকরি হয়নি?’
‘আমি তো এটাই ভেবেছিলাম।’
‘তুই তো সবসময় শুধু বেশি বেশি ভাবিস। বাই দ্য ওয়ে, চাকরি হয়েছে শুনে খুশি না হয়ে মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?’
‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম আমার চাকরিটা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না অবশ্য! এজন্য রাফির মামার সাথে আজ ঝগড়া করেছি।’
সকাল অবাক হয়ে বলল,
‘কী! কেন?’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাহিনি খুলে বলল। সকাল কপাল চাপড়ে বলে,
‘মেয়েরা দুই লাইন বেশি বুঝে জানতাম। কিন্তু তুই তো চার লাইন বেশি বুঝিস। যাই হোক, স্যরি বলে দিস।’
‘স্যরি বলব কেন? সে আমার সাথে মিজবিহেভ করেছে।’
‘কিন্তু ঝগড়ার শুরুটা তো তুই-ই করেছিলি তাই না?’
‘তা ঠিক।’
‘কাজেই স্যরিটাও তোরই বলা উচিত।’
‘স্যরি বলব বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
অর্ষা মৌন রইল। যার অর্থাৎ সে স্যরি বলবে। আর তার মৌনতাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। পরেরদিন অফিসে গিয়ে সে জবে জয়েন করে। তবে একটা জিনিসই তার মাথায় ঢুকছে না সে চাকরিটা পেল কী করে? কোনো প্রশ্নের উত্তরই সে ঠিকমতো দিতে পারেনি। অথচ তবুও তার চাকরিটা হয়ে গেছে। মিরাকল! তার কাজ সে বুঝে নেওয়ার পর অপেক্ষা করছিল আহনাফকে খুঁজে পাওয়ার।শামীম তখন আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো সমস্যা আছে?’
‘আপাতত নেই।’
শামীম হেসে ফেলে। হেসে বলে,
‘আচ্ছা কোনো সমস্যা হলেই আমাকে জানিও। ফোন দিও।’
‘ঠিক আছে।’
অর্ষার কাজ রিপোর্ট করা। সে কম্পিউটার ঘেটে আগের রিপোর্টগুলো দেখতে থাকে।
‘আপনি কি এখানে নতুন?’
অর্ষা পিছু ফিরে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘জি।’
‘আমি আপনার সিনিয়র স্যার। আমার নাম মিজান। কোনো রকম সমস্যা হলে আমায় জানাবেন।’
‘জি স্যার।’
‘আপনার নাম কী?’
‘অর্ষা।’
‘আচ্ছা কাজ করুন।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়াল। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আজ কলেজে যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া হবে না। বন্ধুদের সাথে দেখাও হবে না। একটা টেক্সট করে গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া উচিত। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে গ্রুপে ম্যাসেজ করে রাখে। হঠাৎ তার পানি পিপাসা পায়। তার কাছে কোনো পানির বোতল নেই। সে পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করে পানি আনতে যায়। লাইন ক্রস করে যাওয়ার সময় একটা মেয়ে স্লিপ খেয়ে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে অর্ষা কাছে থাকায় সাপোর্ট হিসেবে মেয়েটা অর্ষাকে টেনে ধরে। এদিকে অপ্রস্তুত অর্ষা আচানক এমন ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে নিজেও পড়ে যায়। এমনভাবে পড়েছে যে হাঁটুতে আর ডান হাতের কনুইতে ভীষণ ব্যথা লেগেছে। আশেপাশে থাকা কয়েকজন অর্ষা এবং সেই মেয়েটাকে ধরে তোলে। কিছুটা দূরে মিজান দাঁড়িয়ে ছিল। সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে। সেই মেয়েটাকে একটু বকাঝকাও করে। ব্যথায় অর্ষার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মিজান জিজ্ঞেস করল,’খুব বেশি ব্যথা পেয়েছ?’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,’না, তেমন না। ঠিক আছি।’
অর্ষা পানি না নিয়েই নিজের ডেস্কে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে একজন এসে বলে যায় আহনাফ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সে কোনো রকম পা টেনে টেনে আহনাফের কেবিনে যায়। দরজায় নক করে বলে,
‘আসব?’
আহনাফ মুখ তুলে একবার তাকাল। কয়েক সেকেণ্ড মৌন থেকে বলল,
‘আসুন।’
অর্ষা ভেতরে গিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আহনাফ বলল,
‘বসুন।’
অর্ষা বসল। আহনাফ হাতের ফাইলটা বন্ধ করে কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে অর্ষা বলল,
‘স্যরি।’
আহনাফ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুচকে বলল,’স্যরি! কিন্তু কেন?’
‘না জেনেই কাল আপনাকে অনেক কথা শুনিয়েছি তাই।’
মৃদু হাসল আহনাফ। বলল,’আমি কিন্তু আসলেই আপনাকে চাকরিটা দিতাম না। শামীমের রেফান্সেই আপনাকে নেওয়া।’
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অর্ষার। ঠাণ্ডা মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,
‘ব্যাটা বদ!’
‘যাই হোক, চাকরি যখন হয়েই গেছে তখন কাজটা মন দিয়ে করবেন আশা করি।’
‘আমি আমার বেস্টটাই দেওয়ার ট্রাই করব ইন-শা-আল্লাহ্।’
‘গুড। এখন আপনি আসতে পারেন।’
অর্ষা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। পেছন থেকে আহনাফ জানতে চায়,
‘আপনার হাতে-পায়ে কী হয়েছে?’
অর্ষা পিছু ফিরে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘হা-ডু-ডু খেলতে গিয়ে পড়ে গেছি।’
বিস্ময়ে হতবাক আহনাফের মুখের দিকে আর না তাকিয়েই অর্ষা বের হয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কনুই লাল হয়ে আছে। সে হাতে অল্প অল্প পানি নিয়ে কনুইতে দেয়। জ্বা’লা-পোড়া-ও করছে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে গিয়ে দেখে ডেস্কের ওপর মলম এবং ব্যথার ওষুধ। সাথে একটা কাগজ; যেখানে লেখা রয়েছে,
‘ফর ইউ।’
চলবে…
[