যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -০৯+১০

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৯
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
অর্ষা ওষুধগুলো সরিয়ে রেখে দিল। কে না কে দিয়েছে সেটা না জেনেই সে কেন ওষুধ খেতে যাবে? সে ওষুধ খেল বাড়িতে গিয়ে লাঞ্চ টাইমে। যাওয়ার পথে নিজের টাকায় ওষুধ কিনে নিয়ে গিয়েছিল। চাকরির কথা শুনে বাড়ির প্রত্যেকেই ভীষণ আনন্দিত। শুধুমাত্র বন্ধুমহল ব্যতীত। আগের মতো আর আড্ডা দেওয়া হবে না, দেখা হবে না, কথা হবে না। এসব নিশ্চয়ই আনন্দ হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। তবে বাস্তবতাকেই বা কী করে উপেক্ষা করা যায়? সেই অবকাশ তো নেই। মুশকিল হলো রাফিকে পড়ানো নিয়ে। এখন আর তার পক্ষে রাফিকে পড়ানো সম্ভব নয়। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে ফিরে দোনামোনায় ভুগছিল কথাটা কীভাবে জানাবে ওদের। ফোনে নাকি সরাসরি গিয়েই বলবে। অবশেষে ভাবল কষ্ট করে এতদূর যাওয়ার চেয়ে ফোনে বলা ঢের ভালো।

সে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ আহনাফের নাম্বারে কল করে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে আহনাফ সালাম দিল,

‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়া আলাইকুমুস-সালাম। আমি অর্ষা বলছিলাম।’

‘নাম্বার সেইভ করা ছিল।’

অর্ষা নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। হঠাৎ করে তার কথা বলা যেন বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো আহনাফের থমথমে গলার স্বর শুনেই এমনটা হচ্ছে। অপরপ্রান্ত থেকে আহনাফ নিজেই নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করল,

‘আজকে রাফিকে পড়াতে আসেননি কেন?’

অর্ষা প্রথম দিকটায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘কারণটা কি আপনি জানেন না?’

‘না, জানান।’

অর্ষার মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে তবুও ঠাণ্ডা থেকে বলল,

‘আমি এখন চাকরি করি। পড়ানোর সময় নেই।’

‘আপনার অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়। আপনি সন্ধ্যায়ও পড়াতে পারেন।’

‘আমি এত প্রেশার নিতে পারব না। আপনি রাফির জন্য নতুন টিচার নিন।’

‘আপনি বলার পূর্বেই আমি নতুন টিচার খুঁজেছি।’

‘তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল।’

‘কে বলল সমস্যা মিটেছে?’

‘নতুন টিচার পেয়ে গেলে সমস্যা আর রইল কীভাবে?’

‘রাফি নতুন কোনো টিচারের কাছে পড়বে না। সে আপনার কাছেই পড়বে।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল অর্ষা।

‘এত অবাক হওয়ার কী আছে? এত টিচার বদলালে বাচ্চাদের তো আর পড়া হয় না। স্বাভাবিক একটা বিষয়।’

‘আপনি ও’কে বুঝিয়ে বললেই হবে।’

‘দেখুন, বোঝানো সম্ভব হলে এতক্ষণ আপনাকে এত কথা বলতাম না। আপনি শিক্ষিত মানুষ; আশা করি অল্প কথাতেই বুঝবেন। এবং শিক্ষিত মানুষের চিন্তা-ভাবনাও সর্বদা অন্যরকম হয়। আমি এটাও আশা করব কথাগুলো আপনি ভেবে দেখবেন।’

অর্ষা কয়েক সেকেণ্ড থম মেরে বসে থেকে বলল,

‘ঠিক আছে আমি ভেবে জানাব।’

আহনাফ আর কিছু না বলেই কল কেটে দেয়। এই বিষয়গুলো অর্ষার মেজাজ তুঙ্গে তুলে দেয়। মুখের ওপর ফোন রেখে দেওয়াটা কোন ধরণের ভদ্রতা?

সকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। সে অর্ষার থমথমে রাঙা মুখটির দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,

‘কী হয়েছে?’

অর্ষা রাগান্বিত স্বরে বলে,

‘হয়েছে আমার মাথা!’

‘যাহ্ বাব্বাহ্! আমি আবার কী করলাম? আমি ওপর কেন চটে যাচ্ছিস?’

‘বেশি কথা বলবি না সকাল। তুই যা নিজের কাজ কর। আর আমাকে ঘুমাতে দে। সকালে অফিস আছে আমার।’

অর্ষা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। সকাল ভেংচি কেটে বলে,

‘ইশ! আসছে আমার অফিসওয়ালী।’

কথাটা শুনতে পেয়ে অর্ষা একটা বালিশ ছুড়ে মারে সকালের দিকে।
.
.
প্রভাতে নিজেকে কিছুটা আলাদাভাবে তৈরি করে অর্ষা। অফিসে তো আর যেনতেনভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। গেইটের কাছে যাওয়ার পর দেখা হয়ে যায় শামীমের সাথে। অর্ষা আগ বাড়িয়েই জিজ্ঞেস করে,

‘ভালো আছেন ভাইয়া?’

শামীম পিছু ফিরে অর্ষাকে দেখে একগাল হেসে বলে,

‘আরে অর্ষা যে! ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমিও ভালো আছি। সাদা ড্রেসে তোমায় সুন্দর লাগছে।’

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’থ্যাঙ্কিউ।’

শামীম মুচকি হাসল। বলল,

‘আচ্ছা তুমি ভেতরে যাও। আমি একটু পর আসছি।’

অর্ষা মাথা দুলিয়ে সায় দিল। পায়ে ব্যথা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে কষ্ট হবে বিধায় সে লিফ্টে ওঠে। তার কিছুক্ষণ পরই আহনাফ লিফ্টে ওঠে। একটাবার ফিরে তাকায়ওনি। এমন একটা ভাব করে যেন চেনেই না। আন্তরিকতার ‘আ’-ও মনে হয় না এই লোকটার ভেতর এতটুকু পরিমাণ রয়েছে। অর্ষা মাঝে মাঝে ভেবেই পায় না, লোকটা এরকম আত্ম-অহংকারী কেন? রাগে গজগজ করতে করতে আহনাফের থেকে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,

‘আমি আগে লিফ্টে উঠেছি। আমি আগে বের হব। তুই ব্যাটা তোর ভাব নিয়া থাক।’

লিফ্ট কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে আসার পর অর্ষাই আগে বের হয়। সে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার পর কারও কণ্ঠে নিজের নাম শুনে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে পিছু ফিরে তাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকা আহনাফের সাথে ধাক্কা খায়। এখানে ভুলটা অর্ষারই ছিল বিধায় সে তড়িঘড়ি করে বলে,

‘স্যরি, স্যরি! আমি খেয়াল করিনি।’

আহনাফ মুখে তো কিছু বলল না তবে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল,’ইট’স ওকে।’
সে চলে যাওয়ার পর অর্ষা দাঁড়িয়ে থাকে। মিজান ডেকেছিল। হাস্যোজ্জ্বল স্বরে মিজান জিজ্ঞেস করে,

‘আর ইউ ওকে?’

অর্ষা মাথা নাড়ায়। মিজান ফের জিজ্ঞেস করে,

‘এখন শরীর কেমন আছে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আচ্ছা যাও তাহলে নিজের কেবিনে।’

‘জি আচ্ছা।’

অর্ষার সারাদিন কাটে অফিসের ব্যস্ততায়। নতুন নতুন নিজেকে একটু মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও আশেপাশের মানুষদের সহায়তায় কাজ কিছুটা হলেও তার কাছে সহজ বোধ হচ্ছে। এতকিছুর মাঝেও সে ভাবছিল রাফিকে তার প্রাইভেট পড়ানো উচিত কিনা। কদাচিৎ ইচ্ছেশক্তি থাকলেও মন চাইছে না বাড়তি কোনো প্রেশার নিতে। সে ছুটির পর আনমনে তখনও ভাবছিল কী করবে! বাড়িতে ফিরে যাবে নাকি রাফিকে পড়াতে যাবে। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল সে রাফিকে পড়াতে যাবে। এতে তো অল্প কিছু বাড়তি টাকাও পাচ্ছে সে। তবে মন্দ কী?

সে বাসায় না গিয়ে আগে রাফিকে পড়াতে যায়। নতুবা একবার আলসেমিতে পেয়ে বসলে রাফিকে পড়ানো হবে না। রাফিকে পড়াতে পড়াতে আহনাফ বাড়িতে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,

‘মিস অর্ষা।’

রাফি এবং অর্ষা দুজনেই দরজার দিকে দাঁড়ায়। দুজনেই একসাথে সামনেও এগিয়ে আসে। অর্ষা বলে,

‘জি?’

‘আপনি সাদা রঙ আর পরবেন না।’

অর্ষা হতবিহ্বলের ন্যায় প্রশ্ন করল,

‘কেন?’

‘আপনি এমনিতেই শুভ্রতার প্রতিক। শুভ্র রঙে আরও শুভ্র লাগে। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমি চোখ ফেরাতে পারি না।’

কথাটুকু মনে মনে বললেও সরাসরি বলতে পারল না আহনাফ। তার আত্মসম্মানবোধ কণ্ঠের মাঝে অদৃশ্য এক বাধা প্রদান করেছে যেন। উত্তরের প্রতিক্ষায় অর্ষা তখনও আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েক সেকেণ্ড পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আহনাফ নিজেও দৃষ্টির লাগাম টানল এবং কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর ব্যতীতই সেখান থেকে চলে গেল। হঠাৎ তার এমন প্রস্থানে হকচকিয়ে গেল অর্ষা। যারপরনাই অবাক হয়েছে সে। লোকটাকে তার ভীষণ অদ্ভুত মনে হয়। সাদা রঙ পরাতে নিষেধাজ্ঞা! কেন? কে সে নিষেধ করার? তার ভাগিনাকে না হয় প্রাইভেটই পড়াই! তার মানে তো এই নয় যে তার কেনা আমি। তবে আমার প্রতি এত নিষেধাজ্ঞা জারি করার হেতু কী? মনে মনে নানারকম প্রশ্নের ভাণ্ডার মেলে বসলেও এর একটির উত্তরও অর্ষার কাছে নেই। উপরন্তু তাকে চিন্তা-ভাবনাগুলোকে স্থির রাখতে হলো। রাফি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রয়েছে। তার উপস্থিতি টের পাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে অর্ষা।

অর্ষা মৃদুস্বরে বলল,

‘পড়তে চলো।’

রাফির কোনো নড়চড় হলো না। সে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, এখনও সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখে-মুখে গাম্ভীর্যতার ছাপ। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে তার আহনাফের কার্বনকপি মনে হয়। হবেই না বা কেন? আহনাফের বাতাস লেগেই তো ছেলেটার এই অবস্থা। হাভভাব, কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুতেই আহনাফের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় অর্ষা। সে পূণরায় নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে আটকে রেখে বলল,

‘কী হলো? চলো।’

‘তুমি মামার দিকে ওভাবে রাগী দৃষ্টিতে কেন তাকিয়ে ছিলে?’

অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কথা বলার সময় কিছুটা তুতলিয়ে যায়।

‘ক…কী! কখন?’

‘মামা বলে, মিথ্যা বলার সময় মানুষের কথা আটকে যায়। তুমিও এখন মিথ্যা বলছ। আমি স্পষ্ট দেখেছি, তুমি মামার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে।’

‘তোমার মামা তো কতকিছুই বলে বাবা! কিন্তু মোটেও আমি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম না। আমার তাকানোটাই বোধ হয় ওরকম।’

রাফি কিছু বলে যাচ্ছিল, অর্ষা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,

‘আর কোনো বাড়তি কথা নয় এখন। দ্রুত পড়তে চলো। তোমায় পড়িয়ে আমায় আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।’

রাফির অপেক্ষা না করে অর্ষা নিজেই আগে টেবিলের কাছে চলে গেল। তার প্রায় সাথে সাথেই রাফিও এলো। এখনও তার মুখ গম্ভীর। অর্ষা বিশেষ পাত্তা দিলো না। বলা বাহুল্য, সে এড়িয়ে যেতে চাইছে। এত গম্ভীর স্বভাব-টভাব তার পছন্দ নয়। বাচ্চাদের হাসিতে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। হাসতে না পারলে অন্তত কাঁদ! কত বাচ্চারা কাঁদলেও কিউট লাগে। কিন্তু না, এই ছেলে মনে হয় কাঁদতেও পারে না। আস্ত একটা রোবট! ছোটো রোবট। বড়ো রোবট হচ্ছে তার মামা আহনাফ মিজবাহ!

রাফিকে পড়ানোর মাঝেও তার মনটা বারবার কেমন জানি খুঁতখুঁত করছিল। বারবার আহনাফের নিষেধাজ্ঞা তার মনে প্রশ্ন তুলছিল। সাদা পোশাকে কী সমস্যা? তাকে কি মানায়নি? সে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে রাফিকেই জিজ্ঞেস করল,

‘আচ্ছা রাফি, সাদা ড্রেসে আমাকে কেমন লাগছে?’

রাফি কবিতা লিখছিল। প্রশ্ন শুনে একবার অর্ষার দিকে তাকাল। ফের লেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

‘জানি না।’

অর্ষার কৌতুহল ভর্তি মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিড়বিড় করে সে বলল,

‘বড়ো রোবটের বাচ্চা ছোটো রোবট!’#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১০
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় আজ কলেজে যায়নি সকাল। একপাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার প্রতিও এসেছে চরম অরুচি। জ্বরটর আসবে কিনা কে জানে। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছে বাড়ির মেইন দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকাডাকি করছে। ঘোরের জন্য কণ্ঠ বুঝতে পারছে না। তবে এতটুকু ঠাওর করতে পারছে কণ্ঠটি কোনো ছেলের। রুহুল ভাইয়া এসেছে কী? ভাইয়া তো বাড়িতে ফেরে না অনেকদিন হলো। কোনো যোগাযোগও রাখেনি এতদিন। কতবার সবাই ফোন করে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে! কিন্তু বরাবরই সকলকে ব্যর্থ হতে হয়েছে। সে যা হোক, এতক্ষণ ধরে বাইরে থেকে ডাকছে কেউ দরজা কেন খুলে দিচ্ছে না? বিরক্তিতে সে আর শুয়ে থাকতে না পেরে টলমল অবস্থায় হেলতে-দুলতে নিজেই আসে দরজা খোলার জন্য।

দরজা খুলে সে রুহুলকে দেখতে পায় না। ঘোলাটে দৃষ্টিতে অন্য এক অপরিচিত যুবককে দেখে তার ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। কুঁচকানো ভ্রুঁ আরও কিছুটা কুঁচকে সে জানতে চায়,

“কে আপনি?”

উত্তর আসে যুবকটির ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বর থেকে,

“আমি আহিল। অর্ষার বন্ধু। অর্ষা আছে?”

“না। আপু তো অফিসে। কোনো দরকার?”

“দরকার তো ছিল!”

“তাহলে ফোন করুন।”

“করেছিলাম। ফোন ধরছে না।”

“তাহলে দুঃখিত। আর কোনোভাবে হেল্প করতে পারলাম না।”

এমন কটমটে কথার প্রেক্ষিতে আহিল জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। সকালের চোখে-মুখে বিরক্তের ভাঁজ দেখেও তার মনে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। মূলত সে এসেছিল অর্ষার সাথে জবের বিষয়ে কথা বলতে। এমন করুণ পরিস্থিতিতে তার নিজেরও একটা জব ভীষণ প্রয়োজন। সে সকালকে আর বিরক্ত না করে বলল,

“ঠিক আছে, আমি আসছি এখন।”

সকালের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আহিল সেখান থেকে প্রস্থান করে। সকালও দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
.
.
সন্ধ্যায় ডুবুডুবু অবস্থা চারদিকে। আবছা অন্ধকারেও আকাশ মেঘে তলিয়ে আছে। এই বুঝি বৃষ্টি শুরু হবে হবে ভাব! অথচ অফিসের ভেতর থেকে একবিন্দু পরিমাণ বাইরের অবস্থা বোঝা যায় না। আজ পাঁচটার বদলে ছয়টায় ছুটি হয়েছে বলেই সন্ধ্যে নেমে পড়েছে। সন্ধ্যা তো আর সময় আটকে বসে থাকবে না! অর্ষা অফিসের বাইরে এসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। কাজের জন্য ফোন হাতে নেওয়া হয়নি। ভুলবশত সে ফোনটাও সাইলেন্ট করে রেখেছিল। আহিল বেশ কয়েকবার তাকে ফোন করেছে দেখে কিছুটা অবাকও হয়েছে সে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আহিলকে কলব্যাক করে অর্ষা। এমনিতে আজ গাড়িটাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হাঁটা ছাড়া গতি নেই। সামনে থেকে যদি কোনো রিকশা বা সিএনজি পেয়ে যায় তাহলে সেটাকে বোনাস-ই ধরা শ্রেয়। এজন্য শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করতে চায় না সে।

ওপাশ থেকে আহিল ফোন রিসিভ করল। প্রথমে স্বাভাবিক বাক্য আদান-প্রদান করার পর অর্ষা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

“আসলে কাজের জন্য ব্যস্ত ছিলাম। ফোন দিয়েছিলি খেয়াল করিনি। ফোনও সাইলেন্ট করা ছিল।”

আহিল অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলল,

“সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তুই এখন কোথায়?”

“অফিস থেকে বের হলাম। টিউশনিতে যাব।”

“অফিস করে আবার টিউশনিও করিস?”

“হু, ঐ একটা বাচ্চাকেই পড়াই।”

“তুই কি হাঁটছিস?”

“কেন বলতো?”

“নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত চলছে তাই। শোন, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার প্রয়োজন নেই। টিউশনি শেষ করে বাসায় গিয়ে একটা নক করিস।”

“সমস্যা নেই তো! তুই বল না কী বলবি।”

“সমস্যা আছে। দুর্ঘটনা কখনও বলে-কয়ে আসে না। আমি ফোন রাখছি। সাবধানে যাবি।”

অর্ষা আর জেদ না ধরে বলল,

“ঠিক আছে।”

অর্ষা ফোন রাখার পর খেয়াল করল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। একটা গাড়িও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। গাড়ির জানালার কাচ নেমে যেতেই আহনাফের মুখটি দৃশ্যমান হলো। সে শীতল দৃষ্টিতে অর্ষার পানে তাকিয়ে রয়েছে। গাড়ির দরজাটি হালকা মেলে দিয়ে ম্রিয়মাণ স্বরে আহনাফ বলল,

“উঠে আসুন।”

অর্ষা হাভাতের মতো একটা প্রশ্ন করে বসল,

“কোথায়?”

আহনাফের ঠোঁটের কোণে তখন এক চিলতে মৃদু হাসির ঝিলিক দিয়ে উঠল যেন। সেই হাসিটা না নিভিয়েই বলল,

“কোলে নিশ্চয়ই নয়! গাড়িতে উঠুন।”

অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। সেই সাথে কিছুটা বোধ হয় মুগ্ধতারও রেশ লেগেছে। উঁহু! কিছুটা নয়। অনেকটা মুগ্ধতার মাঝে সে আকন্দ বুদ হয়ে রয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে হঠাৎ ওঠা তপ্ত রৌদ্রের তেজি উত্তাপের বদলে মিষ্টি উত্তাপ পেয়ে। মানুষটা হাসলে তাকে এতটা সুন্দর, আবেদনময় লাগে?

অর্ষা অবিশ্বাস্য ঘোরের মাঝে বলে ওঠে,

“সুন্দর!”

“কী?” ভ্রুঁ উঁচু করে জানতে চায় আহনাফ।

অর্ষা পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,

“ওয়েদার! আজকের ওয়েদারটা সুন্দর। ভাবলাম হেঁটেই যাই।”

“মাঝপথে বৃষ্টিতে পেয়ে বসবে। তখন আর ঠাণ্ডা না লাগিয়ে সে যাবে না। এসময় অসুস্থ হওয়াটা কি ঠিক হবে?”

“তাও ঠিক!”

“উঠে আসুন। অবশ্যই গাড়িতে!”

কথাটা বলে ফের মুচকি হাসি প্রদান করল আহনাফ। এই ছেলের সমস্যা কী? আজ কি সে তার হাসিতেই ফাঁসাবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছে নাকি? বিনা বাক্যব্যয়ে অর্ষা উঠে বসল। গাড়ির দরজা লাগানোর পরপর জানালার কাচও তুলে দিল আহনাফ। অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে থাকা অর্ষা চোরের মতো আড়চোখ আহনাফকে দেখছে। দুজনের মাঝখানে দূরত্ব রয়েছে বেশ। আহনাফ তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু অর্ষা তো কোনোভাবেই নিজের মনকে, চোখকে আটকে রাখতে পারছে না। ব্যস্ত রাখতে পারছে না। তার বুকে দামামা চলছে। অচেনা, অদৃশ্য দামামা! বুকে কাঁপন ধরে। এমন কেন হচ্ছে আজ হঠাৎ? শুধুমাত্র এক হাসিতেই তুই কুপোকাত হয়ে গেলি অর্ষা? ছি, ছি! কেউ জানলে মান-সম্মান আর রইবে না। এসব তোকে মানায় না, না, না! এমন হাজারও শব্দের বাণী দ্বারা সে নিজেকে আবদ্ধ রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে ব্যস্ততার বাহানা ধরে সে নিজেও ফোন নিয়ে বসে থাকে। অযথাই হাতের আঙুল দ্বারা ফোনের স্ক্রিনে নিউজফিড স্ক্রল করছে। ধ্যানজ্ঞান তো রয়েছে সব অন্য স্থানে। বলতে অসুবিধা নেই, কেমন যেন এক অন্য রকম ভালোলাগা, খুশির ঢেউও তুলছে প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষটিকে আজ ভালো লাগছে। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশিই!

গাড়ি যখন আহনাফদের বাড়িতে পৌঁছে যায় তখনও অর্ষা ঘোরের মাঝে প্রতিহতমান। ধরিত্রীতে সে আছে কিনা সন্দেহ। সামান্য গলা খাঁকারি দেয় আহনাফ। অর্ষার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা। তবু তো অর্ষার সম্বিৎ ফিরল না। সে তো তখনও জানালার কাচ ভেদ করে তাকিয়ে রইছে বাইরে। বৃষ্টিধারা যে এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে না সেটা ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। তাহলে এত মনোযোগ দিয়ে দেখছেটা কী? উঁহু! দেখছে না। ভাবছে সে। স্বপ্নের রাজকুমারকে নিয়ে!

“শুনছেন? নামবেন না?”

আচানক ভয়ে কম্পিত হয়ে ওঠে অর্ষা। বুকে থুথু দেয়। বুকে থুথু দিলে সত্যিই ভয় কেটে যায় নাকি এটা মনের প্রচলিত একটা ভুল ধারণা তা বোধ করি অর্ষার মতো অনেকেরই উত্তরটি অজানা।

ঘোরে আবদ্ধ হয়ে আটকে থাকা হতচকিত অর্ষা আরও একবার লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল,

“নামছি।”

রাশেদ একটা ছাতা নিজের মাথায় ধরে অন্য ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ গাড়ি থেকে নামার পর ছাতাটি সে আহনাফের হাতে তুলে দিল। আহনাফ ছাতা নিয়ে অপেক্ষারত প্রিয়জনের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অর্ষার জন্য। দুজনে একই ছাতার নিচে। অল্পটুকু পথ মাত্র একসাথে এতটা কাছাকাছি, পাশাপাশি চলা তবুও মনে হচ্ছে সময়টা অনন্তকাল। এখানেই যদি থমকে যেত!

কলিংবেল চেপে ধরে রাশেদ। দু’তিনবার টিংটিং শব্দ তোলার পর রেণু দরজা খুলে দেয়। সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ভাইজান আপনের আইতে আইজ দেরি হইল ক্যান? ভাবিজান কখন থেইকা আপনের জইন্য অপেক্ষা কইরা আছে।”

রেণুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকালো। অর্ষার মনে হলো এই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শব্দটি তার বর্মে বর্মে হচ্ছে। সূর্যকিরণের মতো তার ঝলমলে প্রস্ফুটিত হাসিটুকু বর্ষার বৃষ্টিস্নাতের সাথে ধুয়ে মুছে রঙহীন পানির সঙ্গে একত্রিত হয়ে যাচ্ছে যেন।

আহনাফ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

“শশী এসেছে?”

রেণু তার ঝলমলে মুখখানা দুলিয়ে উপর-নিচ সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা বুঝতে পারছে না অচেনা এক নারীর আগমনে তার বুকে শীল বেঁধার মতো কষ্ট কেন হচ্ছে? মস্তিষ্কের মাঝে প্রশ্নের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কে এই শশী? রেণু কেন তাকে ভাবিজান বলে সম্বোধন করছে? নাহ্ এই হৃদযন্ত্রণা সহনশীল মাত্রায় থাকছে না যে আর! অবাধ্য মনটা বারবার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে,’কে এই শশী?’

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here