যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -১১+১২

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অর্ষার ফোনটি বেজে ওঠে হঠাৎ। ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে সকালের ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে ওঠে,

“আপু তুই কোথায় এখন? জলদি বাসায় আয়।”

হতবিহ্বল অর্ষা চমকে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,

“কী হয়েছে?”

“ভাইয়া বাসায় কী যে শুরু করেছে! তুই এখনই আয়।”

“আচ্ছা আমি আসছি।”

অর্ষার ব্যস্ততা দৃষ্টি এড়ায় না আহনাফ, রেণু এবং রাশেদের। তারা প্রত্যেকেই অর্ষার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। ফোন রেখেই অর্ষা আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমায় এখনই বাসায় যেতে হবে।”

“কোনো সমস্যা?” জিজ্ঞেস করল আহনাফ।

অর্ষা আ’ত’ঙ্কিত মুখে বলল,

“হ্যাঁ।”

আহনাফ দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন না করে রাশেদকে বলল,

“উনাকে পৌঁছে দিয়ে আসো।”

রাশেদ সম্মতিপূর্বক মাথা নাড়াল। মুহূর্তেই যেন পরিস্থিতিটা বদলে গেল। এতক্ষণ অর্ষার মনে যেই উথালপাতাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল; এখন তা ছাপিয়ে গেছে পারিবারিক সমস্যা। মাথার ভেতর একগাদা দুশ্চিন্তা নিয়ে সে অপেক্ষা করছে কতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছাবে।

অর্ষা যখন বাড়িতে পৌঁছায় রুহুল তখন বাড়িতে নেই। বাড়ির বেহাল অবস্থা। জিনিসপত্র ভেঙেচূড়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সকাল। দাওয়ায় বসে শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন মা। বাবা খাটের ওপর নির্জীব, পাথরের ন্যায় বসে আছেন। প্রথম দিকটায় অর্ষা কথা বলার মতোন কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। সে নিঃশব্দে ভেজা পায়ে আগে এগিয়ে গেল সকালের কাছে। সকালের ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ। বোনের চোখে চোখ পড়তেই সকাল এবার বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অর্ষার বুঝতে বাকি নেই রুহুল তার রাগের অবশিষ্ট অংশ সকালের ওপরও প্রয়োগ করেছে। সকালের চেয়ে বেশি ব্যথা যেন এখন অর্ষাই পাচ্ছে। বুকটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। সকাল ভরসার স্থান পেয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরল। টলমল অশ্রুসজল নয়ন অর্ষার। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সকালের পিঠে।

সকাল কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,

“ভাইয়া একেবারে চলে গেছে আপু। আর আসবে না।”

অর্ষা কঠিনস্বরে বলল,

“না আসুক। ওর এই বাড়িতে না আসাই উত্তম।”

সেই রাতে ঘুম হলো না কারও-ই। জীবনে যত ধরণের সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে বোধ হয় পারিবারিক সমস্যা অন্যতম। যার জীবনে ফ্যামিলি প্রবলেম থাকে তার আলাদা করে কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। জীবনটাকে একটু একটু করে শেষ করতে, ডিপ্রেশনে ফেলতে এই সমস্যাই যথেষ্ট।

সকালবেলা অর্ষা অফিসে গেল না খেয়েই। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকানোর উপায় নেই। কেঁদে কেঁদে মায়ের চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। মাকে বোঝাবে নাকি সান্ত্বনা দেবে সেটাও তার জানা নেই। সে নীরব ভূমিকা পালন করছে। অথচ ভেতরে ভেতরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অসহায়ত্ব। কার কাছে সে নিজেকে ভেঙেচূড়ে বলবে? এমন কেউ যে নেই তার!
.
অফিসে এসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে। কম্পিউটারে টাইপ করছে রোবটের মতো। মন তার কাজে নেই। শুধু দৃষ্টি আর হাতটাই চলছে। যাওয়ার পথে তার এই অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে আহনাফ। অর্ষার ভ্রুক্ষেপ নেই কোনোদিকে। সে ভাবে তার অতীতের কথা। সেই অতীত সুখকর নাকি বেদনাদায়ক সেটা সে এত বছরেও ঠাওর করতে পারেনি।
.
রুহুল এবং অর্ষা ওমর বাস্তবিক অর্থে অনাথ। ওরা ওমর রহমানের পালক সন্তান। ওমর রহমানের প্রথম স্ত্রী গত হয়েছেন রুহুল এবং অর্ষাকে দত্তক নেওয়ার এক বছর বাদেই। অর্ষা আর রুহুল থাকত এতিম খানায়। বয়সের ব্যবধান দুজনের তিন বছরের। বাবা-মা নেই তাই চাচারা এতিমখানায় দিয়ে গেছিল। এতিমখানায় রাখা পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব শেষ। এরপর আর কোনো খোঁজ-খবরও রাখেনি।

ওমর রহমান নিঃসন্তান ছিলেন। কত ওঝা, কবিরাজ, ডাক্তার কত কিছুই না দেখিয়েছিলেন! কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তার স্ত্রী মা হতে পারেননি। তাই তারা একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন বাচ্চা দত্তক নেবে। একদিন এতিমখানায় গেলেন বাচ্চা দত্তক নিতে। তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পায় দুই বছরের একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে এতিমখানার বারান্দায় বসে খেলছে। হাতে একটা লাল রঙের পুতুল। মেয়েটার গায়েও লাল ফ্রক। ওমর রহমানের স্ত্রী অপলা বেগমের দেখেই ভালো লেগে যায়। তিনি কোলে তুলে নেন বাচ্চাটিকে। যখন ও-কে দত্তক নিতে যায় তখন রুহুল ছুটে আসে। সে কিছুতেই তার বোনকে নিয়ে যেতে দেবে না। অপলার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে। ছাড়ছেই না। বাধ্য হয়ে ওরা রুহুলকেও দত্তক নিয়ে নেয়। দুজনকে নিয়ে তাদের সংসার নতুন করে শুরু হয়। এতদিন বাদে সাদাকালো জীবনে যেন রঙের দেখা পেয়েছেন তারা। মানুষমুখে অপলা শুনতেন, অন্য বাচ্চা পাললে ঐ বাচ্চার উসিলায় নাকি আল্লাহ্ তাকেও বাচ্চা দেয়। সত্যি সত্যিই এক বছর বাদে সে কনসিভ করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাচ্চা হওয়ার সময় বাচ্চাসহ-ই সে মারা যান। ভেঙে পড়েন ওমর রহমান। আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই রুহুল আর অর্ষাকে আবার এতিমখানায় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বলে। নতুন করে বিয়ে করতে বলে। তিনি বিয়ে করতে রাজি না হলেও ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন কারণ ছোটো অর্ষাকে দেখাশোনা করতে পারছিলেন না চাকরির জন্য। তবে এই এক বছরে তিনি ছেলে-মেয়ে দুটোর মায়ায় পড়ে গেছেন। আধো আধো বুলিতে মেয়েটা যখন বাবা বাবা বলে ডাকে, তার বুক শান্তিতে জুড়িয়ে যায়। এক রাতে তার ভীষণ জ্বর হয়। সারা রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে রুহুল। ওমর রহমান সিদ্ধান্ত বদলানেন। যত কষ্ট-ই হোক ওদেরকে কাছ ছাড়া করবে না। তবে মা ছাড়া অর্ষাকে রাখতে তার বেশ কষ্ট হতো। তাই বাধ্য হয়েই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। যেই বছরে বিয়ে করলেন সেই বছরেই তার স্ত্রী কনসিভ করে। ওমর রহমান ভয় পেলেন, পাছে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখতে না পারে! তবে এমনটা হলো না। সকাল জন্মের পরও সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগল। কেউ বলতেই পারবে না রুহুল, অর্ষা দত্তক আনা। তবে সময়ের পরিক্রমায়, ভুল বন্ধুদের সংস্পর্শে গিয়ে রুহুল উচ্ছন্নে চলে যায়। ক্লাস এইট অব্দি পড়ে আর পড়াশোনাও করেনি। আজ সে বেপরোয়া, ভবঘুরে, বখাটেপনা করে বেড়ায়। নেশা হয়েছে তার নিত্যসঙ্গী। পরিবার কিংবা বোন কারও প্রতিই নেই কোনো টান। সৎ সঙ্গ মানুষকে যতটা ভালো পথে আনতে পারে, অসৎ সঙ্গ তারচেয়েও অধিক অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যেতে পারে; যা ব্যক্তির ধারণারও বাইরে।

বড়ো হওয়ার সাথে সাথে মানুষের মুখে মুখে ওরা শুনেছে ওমর রহমান আর সেলিনা বেগমের আপন সন্তান নয় ওরা। প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল অর্ষা এবং রুহুল। এসব আর আমলে নেয়নি। কত সুন্দর ছিল তাদের ছোট্ট সংসার। দমকা হাওয়ায় সব কেমন নড়চড় হয়ে গেল। অর্ষা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে করিডোরে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে এখন লোকজন নেই। সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। তার কান্না দেখে ফেলার মতো কেউ নেই এখানে।

“এত স্ট্রং মেয়েটাও কাঁদতে পারে?”

অর্ষা চমকে পেছনে তাকায়। তার থেকে কিছুটা দূরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহনাফ। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় অর্ষা। আহনাফ এগিয়ে আসে কথা বলতে বলতে,

“দুঃখিত এখানে আসার জন্য। আমার কেবিন থেকেই দেখলাম আপনি কাঁদছেন। গতকাল রাতে বললেন বাড়িতে নাকি সমস্যা হয়েছে। তাই কৌতুহল আটকে রাখতে পারলাম না। কী হয়েছে আমাকে বলুন।”

অর্ষা থমথমে কণ্ঠস্বরে বলল,
“কিছু হয়নি।”

কথা বলতে গিয়েই যেন তার কান্না আরও বেশি উপচে পড়ছে। প্রাণপণে চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারছে না।

আহনাফ বলল,
“আমাকে একবার বলুন, কী হয়েছে? আমি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি না?”

অর্ষা নিরুত্তর। আহনাফ নিজেও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। পরক্ষণে আরেকটু এগিয়ে যায়। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে,

“পারিবারিক সমস্যা নাকি ব্যক্তিগত সমস্যা আমি জানিনা। যদি আমায় বলা না যায়, তাহলে বলতে হবে না। শুধু আমি নিজে থেকে এতটুকুই বলব, ভেঙে পড়বেন না। আপনার নিরুত্তেজ রূপটা নয় বরঞ্চ তেজী রূপটাই আপনার ব্যক্তিত্বকে বহন করে।”

অর্ষা মুখ ফিরিয়ে তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহনাফের উপস্থিতি, তার বাক্যালাপ কান্নার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আহনাফ এবার মুখোমুখি দাঁড়াল অর্ষার। দৃষ্টি নত করে অর্ষা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আহনাফ বলল,

“জানেন, আমাদের প্রতিটা মানুষের মাঝেই কোনো না কোনো দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে। আমরা সবটা সবাইকে জানাই না। কখনও কিছুটা জানাই আবার কখনও ঐ অল্পকিছুও জানাই না। কিছু কষ্ট শুধু আমরা নিজের মধ্যে রাখতেই পছন্দ করি। কিছু কষ্ট আবার আমরা অতি যত্নে মনের মাঝে পুষি। ভেতরে ভেঙেচূড়ে গুড়িয়ে যাই। কিন্তু বাইরে প্রতিটা মানুষকে দেখাই আমরা এত সহজে ভাঙি না। দুঃখ, কষ্ট এত সহজে আমাকে কাবু করতে পারে না।”

এতটুকু বলে থামল আহনাফ। কয়েক সেকেণ্ড মৌনতা পালন করে সে অবিশ্বাস্যভাবে অর্ষার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল,

“আপনি হচ্ছেন সেই ধরণের মেয়ে, যাকে বাহির থেকে কখনও ভাঙা সম্ভব নয়। আপনি এভাবে কাঁদবেন না বাচ্চা প্লিজ!”

অর্ষা আরক্তিম দৃষ্টি মেলে আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। কী মায়া সেই মুখে!
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
দিন চারেক অতিক্রম হওয়ার পর বাড়ির অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বলা বাহুল্য বাড়ির মানুষজন নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভেতরে ভেতরে যেই তুষের আগুন জ্বলছে তার মাত্রা কমেনি এতটুকু পর্যন্ত। বিশেষ করে ওমর রহমান এবং সেলিনা বেগম রুহুলের দেওয়া আঘাত মেনে নিতে পারেননি। মেনে নিতে না পারাটাও অস্বাভাবিক নয়। যাকে নিজেদের ছেলের মতো আদর-স্নেহ দিয়ে বড়ো করেছেন তার থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয়। তবুও তাদের রুহুলের জন্য মন পোড়ে। মাঝে মাঝেই একে, ওকে ধরে রুহুলের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্ষার অগোচরে বেশ কয়েকবার করে রুহুলের নাম্বারে ফোন করেনও ওমর রহমান। কিন্তু প্রতিটাবার সেই একই কথা শুনতে হয়,’আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।’
দিনের মধ্যে কতবার এই বাক্যটি শোনেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবুও তিনি ত্যক্ত হোন না। অশান্ত মনটা একবার রুহুলের কণ্ঠস্বর শুনতে চায়। জানতে চায় ছেলেটা দূরে থাকলেও ভালো আছে।

সকাল আর অর্ষা পাশাপাশি হাঁটছে। সকালের গন্তব্য ওর কলেজ আর অর্ষার গন্তব্য ভার্সিটি। অফিস থেকে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য সে ছুটি নিয়েছে। মিজানের কাছে ছুটি চাওয়া মাত্রই সে রাজি হয়েছে। কোনো রকম দ্বিমত করেনি ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে। ছেলেটা বেশ আন্তরিক। অফিসে তার স্যার হলেও ব্যবহার আন্তরিকতার সাথেই করে। এ ক’দিন তার মনটন খারাপ দেখেও অনেকবার কারণ জানতে চেয়েছিল। অর্ষা অবশ্য জানায়নি। সে পারিবারিক বিষয়টাকে ব্যক্তিগত রাখতেই পছন্দ করে। এমনকি এ ক’দিন সে রাফিকেও পড়াতে যায়নি। আহনাফও ফোন করে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি। অফিসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। চোখাচোখি ও সামান্য পরিমাণ হাসি বিনিময় হয়েছে। অল্প কথার মাঝে আহনাফ সর্বদাই জানতে চেয়েছে,
‘মন ভালো?’
আর অর্ষা প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়েছে। এই মাথা নাড়ানোর উদ্দেশ্য তার নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। আদতে সে ভালো আছে নাকি নেই সেটা সে নিজেও জানে না।

“আপু কথা বলছিস না?”

সকালের প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে অর্ষা। মৃদু সহাস্যে বলে,

“কী কথা বলব?”

“যা ইচ্ছে বল। চুপচাপ হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। পেট ব্যথা করে।”

“তুই বল তাহলে। আমি শুনি।”

“আজকে ফুসকা খেতে যাবি?”

“কলেজে খাস না?”

“খাই। সে তো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খাই। তোর সাথে অনেকদিন হয়েছে ফুসকা খাওয়া হয় না। ঐদিক দিয়ে মুন আপুর বাসায়ও যাব। আপুর সাথেও তো অনেকদিন হয়েছে দেখা হয় না।”

“আচ্ছা ভার্সিটি থেকে ফিরি আগে। আজ রাফিকে পড়াতে যেতে হবে।”

“এতদিন যাও নি?”

অর্ষার উত্তর দেওয়ার আগে তোফায়েলের সঙ্গে দেখা হয় দু’বোনের। ওদেরকে দেখেই হয়তো তোফায়েল মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। তার মুখটা হাসিহাসি। দুজনের দিকেই একবারটি তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“কেমন আছো তোমরা?”

উত্তর দেয় সকাল। সে বলে,

“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি। কলেজে যাচ্ছ?”

“হুম।”

“তুমিও?” অর্ষাকে এবার প্রশ্নটি করল তোফায়েল।

অর্ষা কিছুটা গম্ভীর হয়েই বলল,

“জি।”

“আজ অফিস নেই?”

“আছে। ছুটি নিয়েছি।”

“জব, পড়াশোনা, পরিবার সব একসাথে সামলাও কীভাবে? কষ্ট হয় না?”

মলিন হাসে অর্ষা। শ্লেষেরসুরে বলে,

“বড়ো ভাই যদি তার দায়িত্ব পালনে অনিহা প্রকাশ করে তখন বাড়ির মেয়েকেই তো সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে তাই না?”

“রুহুলকে একটা বিয়ে করানো উচিত ছিল অর্ষা।”

“পাগল নাকি! ওর মতো ছেলের জন্য অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করতে যাব কেন?”

“নিজের ভাইকে নিয়ে এসব কী বলো!”

“নিজের ভাই বলেই বলছি। কারণ অন্যদের চেয়ে আমি ও-কে ভালো চিনি।”

“ও কিন্তু তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে।”

অর্ষা এবারও বিদ্রুপ করে হাসে। তোফায়েল বলে,

“হাসছ যে? বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“ওর ব্যাপারে কথা বলতে ভালো লাগছে না তোফায়েল ভাই। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা বরং এখন যাই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যেও।”

“শুনুন?”

“বলো।”

“আমি যদি ভুল না হই আব্বু-আম্মু আপনাকেও ভাইয়ার খোঁজ নিতে বলেছে?”

তোফায়েল কিছুটা কাচুমুচু ভঙ্গিতে বলল,

“হ্যাঁ। তোমার আব্বুর সঙ্গে দেখা হলেই বলে।”

“পাত্তা দিবেন না। যখন বলবে চুপচাপ শুনবেন শুধু। ভাইয়াকে খুঁজে বের করে খোঁজ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”

“তুমি ভীষণ কঠিন মনের মেয়ে অর্ষা!”

অর্ষা এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সে আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথাও বাড়াল না। সকালকে নিয়ে একটা খালি রিকশায় উঠে পড়ে।

ভার্সিটিতে পৌঁছানোর পর ফ্রেন্ডদের মধ্যে আজ আনন্দের ধুম পড়ে গেছে। সবাই অর্ষাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। আজ কতদিন বাদে সকলে একত্রিত হয়েছে। এই আনন্দে ক্লাস করার কথাই বেমালুম ভুলতে বসেছে সকলে। হৈ-চৈ লেগে গেছে। ছোটখাটো একটা জটলাও বেঁধে গেছে। দূর থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে ঝগড়া লেগেছে বোধ হয়। অথচ ওরা লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করে নিজেদের খুশি উদযাপন করছে।

আশিক তো তার বিখ্যাত কবিতা শুরু করে দিয়েছে,
“অর্ষা পড়েছে আসিয়া,
আজকে দিন কাটিবে হাসিয়া হাসিয়া।”

“তুই আবার কান্নাকাটি করে দিন পার করলি কবে?” বলল রেশমি।

“এই মেয়ে কাঁদব কেন? যার জীবনে এতগুলো গার্লফ্রেন্ড রয়েছে সে আবার কাঁদে নাকি?”

লামিয়া বলল,”তাহলে অর্ষার সামনে এমন ঢং করছিস কেন?”

চোখ টিপল আশিক। বলল,

“ও-কে ইম্প্রেস করছি!”

জুঁই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে বলে,

“তার মানে এখন তুঁই অর্ষাকেও পটানোর চেষ্টা করতেছিস?”

আশিক খ্যাঁক করে ওঠে। কোমরে হাত রেখে বলে,

“এই জুঁইয়ের বাচ্চার কুইকুই করার স্বভাব জিন্দেগীতে যাবে না। মেয়েরা এক, দুই লাইন বেশি বুঝে মানলাম। বাট এই মাইয়া সবসময় চার লাইন বেশি বোঝে।”

আহিল সবাইকে শান্ত করে বলল,

“হয়েছে, হয়েছে। এবার তো থাম তোরা।”

অর্ষা মাথা ধরে ঘাসের ওপর বসে পড়েছে অলরেডি। ওদের সঙ্গে থাকলে পাগল হওয়া সহজ কিন্তু ডিপ্রেশনে থাকা সম্ভব নয়। আশিক ব্যস্ত হয়ে বলল,

“হায়, হায়! অর্ষাকে কিডন্যাপ করল কে? কে কোথায় আছো, আমার বান্ধবীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। হেল্প, হেল্প!”

রেশমি আশিকের মুখ চেপে ধরে বলল,

“গাধা থাম। চেঁচাইস না আর। অর্ষা নিচে বসে আছে।”

আশিক নিচে তাকিয়ে হাসল। সেও অর্ষার পাশে নিচে বসে পড়ল। মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে,

“এখন হাতে শুধু দুটো ভাঙা থালা থাকলেই হতো বুঝলি। একদম ভরপুর ইনকাম হতো তাহলে।”

অর্ষার প্রথম দিকটায় বুঝতে একটু সময় লাগল যে আশিক কোন ইঙ্গিত দিয়েছে। আর যখন বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে আশিক উঠে-পড়ে দৌঁড় দিয়েছে। হাল ছাড়েনি অর্ষাও। সেও পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটি মাতিয়ে তুলেছে এই সদস্যগুলো। সারাদিন একসাথে থেকে হৈ-হুল্লোড় করে অর্ষা পারিবারিক যন্ত্রণার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। এক টুকরো স্বর্গীয় সুখ যেন সে বন্ধুদের মাঝে থেকে উপভোগ করতে পেরেছে। বিদায় বেলা কারও-ই মন ভালো নেই। আবার কবে দেখা হবে, একসাথে আড্ডা দেওয়া হবে এই চিন্তায় মশগুল প্রত্যেকে। অর্ষা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে,

“আমার অফিসের স্যার, বস ভালো আছে। আমি চেষ্টা করব প্রতি সপ্তাহে একদিন হলেও ক্লাস করার। এছাড়া ক্লাসে না হলেও ছুটির পর একসঙ্গে সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো।”

দিদার বলে,
“এটা দারুণ আইডিয়া। সন্ধ্যায় ভালো ভালো স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। দারুণ টেস্ট।”

অর্ষা হেসে বলে,
“ঠিক আছে। নেক্সট টাইম আমরা সবাই স্ট্রিট ফুড খাব।”

বিকেলের দিকে ক্লাস শেষ করে, ঘুরে-ফিরে সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আহিল আছে অর্ষার সাথে। দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। অর্ষা দুঃখীস্বরে বলে,

“স্যরি রে, পরে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।”

“বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছিল?”

অর্ষা নিশ্চুপ। আহিল একবার পাশ ফিরে তাকাল অর্ষার দিকে। দীর্ঘকায় শ্বাস নিয়ে বলল,

“বলবি না?”

অর্ষার কেন জানি আহিলের কাছে প্রথম নিজেকে ভেঙেচূড়ে উপস্থাপন করতে ইচ্ছে করছে। সে লুকায় না কিছু। বাড়ির খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও সে আহিলকে জানায়। আহিল এতদিন নিজেকে যেই শক্ত খোলসের মাঝে আটকে রেখেছিল, সেই শক্ত খোলসটাও সে অর্ষার সামনে ভেঙে ফেলে। নিজের নিদারুণ জীবনের প্রতিটা ঘটনা সে অর্ষার সামনে তুলে ধরে। অর্ষা একই সাথে ব্যথিত হয় এবং অবাকও হয়। সে ক্ষুণাক্ষরেও টের পায়নি আহিলের মাঝে এতটা দুঃখের বসবাস। তবুও আহিল কতটা সুন্দর করে হাসছে! এই হাসির মাঝেও যে জাগতিক দুঃখ-কষ্টের বসবাস তা এখন আর অর্ষার অজানা নয়।

আহিল যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“একটা চাকরির ভীষণ প্রয়োজন রে! এজন্যই সেদিন আমি তোদের বাসায় গিয়েছিলাম।”

অর্ষা অভয় দিল। বলল,
“তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি অফিসে গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলব। একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।”

আহিল প্রসন্নতার হাসি দিয়ে বলল,

“থ্যাঙ্কিউ রে।”

“রাখ তোর থ্যাঙ্কিউ! এত ফর্মালিটি দেখাতে হবে না। আচ্ছা শোন, এখন তোকে বাসায় নিতে পারছি না। কারণ আমি এখন একজনকে পড়াতে যাব।”

আহিল হেসে বলে,
“তোর মধ্যে কোনো ফর্মালিটি নাই। অন্য একদিন যাব।”

“অবশ্যই আসবি। আমার হাতের চা খেয়ে যাবি। আমি চা খুব ভালো বানাই।”

“নিজের প্রসংশা নিজেই করছিস?”

“বদনাম করার লোকের তো অভাব নেই।” বলেই চোখ টিপল অর্ষা।

আহিল হেসে বলল,”ফাজিল!”

এরপর সে নিজেই অর্ষাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে। রিকশায় উঠে আনমনে হাসে অর্ষা। মনটা আজ তার ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। আনন্দিত মন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিল। সাড়ে ছ’টা পার হয়েছে। রাফি আজ কেমন গম্ভীর হয়ে থাকবে কে জানে!

বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিল অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ে। তার পরণে অফ হোয়াইট রঙের একটা শাড়ি। শাড়ির ওপরে গোলাপী রঙের সুতার কাজ। মেয়েটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। মেয়েটা হাসিহাসি মুখ করে জানতে চাইল,

“আপনি?”

অর্ষা কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন বোবা বনে গেছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

“আমি অর্ষা। রাফির প্রাইভেট টিচার।”

মেয়েটি এবার উল্লাসিত ভঙ্গিতে বলল,

“ওহ আচ্ছা! আপনিই অর্ষা? আসুন ভেতরে আসুন।”

মেয়েটির এত আনন্দের কিংবা উল্লাসের কারণ কোনোটাই অর্ষার নিকট স্পষ্ট নয়। বরঞ্চ সে বিব্রতবোধ করছে। সে সহজ গলায় বলার চেষ্টা করল,

“আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

অর্ষার মুখোমুখি সোফায় বসেছে মেয়েটি। সে হাত নেড়ে নেড়ে হেসে বলে,

“আমি শশী। আমাকে আপনার চেনার কথা নয় কারণ আপনি রাফিকে পড়ানোর দু’মাস আগে থেকেই বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় ছিলাম। বাবার একটা অপারেশন ছিল তো তাই। এখন আলহামদুলিল্লাহ্‌ বাবা সুস্থ আছে। আমি দেশে ফিরেছি পাঁচদিন হবে। রেণু আপা আর রাফির কাছে আপনার এত গল্প শুনেছি যে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম আপনাকে সরাসরি দেখার জন্য।”

অর্ষার কথা আটকে গেছে। শশীর কথাটা তার মাথা থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে গেছিল। একটাবারের জন্যও তার শশীর কথা মনে হয়নি। কে এই মেয়ে, কী তার পরিচয় যাবতীয় সকল প্রশ্ন তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেছিল। আজ হঠাৎ করে যে সেই মুছে যাওয়া প্রশ্নগুলো ডালপালা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে অর্ষা ভাবতে পারেনি। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নগুলো করার অধিকার তার নেই। সে এই বাড়ির কে হয় এই প্রশ্নটি করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করে ফেলল,

“রাফি কোথায়?”

শশী তার স্বভাবসুলভ হাসি প্রদান করে বলল,
“ওর ঘরেই আছে। আপনি যান। আজ আমি আপনার জন্য চা করে আনছি।”

মৃদু হাসার চেষ্টা করল অর্ষা। তার কেন জানি অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে। রাফির রুমে যাওয়ার সময় আহনাফের সঙ্গে দেখা হয় তার। বুকের ভেতরে যেই অল্পটুকু অনল মিটিমিটি জ্বলছিল আহনাফকে দেখা মাত্রই দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল। মলিন ও করুণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে আহনাফের দিকে। কণ্ঠস্বর থেকে কথা বের হতে চায় না। অদৃশ্য এক হাত যেন তার গলা টি’পে ধরে রেখেছে। কী অসহনীয় কষ্ট!

আহনাফ প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্ষাকে পাগল করা, নজর কাড়া হাসিটা দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,

“ভালো আছেন আপনি?”

অর্ষা মাথা দোলায়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“ভালো। আপনি?”

“আমিও ভালো আছি।”

অর্ষা বলার মতো আর কিছুই খুঁজে পেল না। অথচ বলার জন্য তার ভেতর জমে রয়েছে হাজার হাজার কথা। আহনাফ কি সেগুলি বুঝতে পারে? হয়তো না। বোঝার কথাও নয়। আজকাল তো মানুষ মুখের বুলি শুনেও বোঝে না; সেখানে না বলা কথাগুলো বুঝবে কী করে? সে বেখেয়ালি নিরুদ্বেগ পায়ে রাফির রুমে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাফি ফোনে গেইম খেলছিল। অর্ষাকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। কাছে এসে বলে,

“ম্যাম তুমি এসেছ? জানো, আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি।”

অর্ষা হাসল। রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“তাই? আমিও তো তোমাকে মিস করেছি।”

“তাহলে এতদিন তুমি আসোনি কেন?”

“একটু ব্যস্ত ছিলাম।”

“এখন থেকে রোজ আসবে তো?”

“আসব।”

রাফি আজ লক্ষী ছেলের মতো পড়তে বসেছে। অর্ষার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই বাড়ির প্রতিটা আনাচে-কানাচে খুশির আলাপন। হঠাৎ এত খুশিতে খুশিতে বাড়িটি আমোদিত হয়ে কেন উঠল? শশীর পদার্পণে? অর্ষা খুব সঙ্গোপনে রাফিকে জিজ্ঞেস করল,

“শশী নামের মেয়েটা তোমার কী হয় রাফি?”

রাফি না তাকিয়েই বলল,”আন্টি।”

এই উত্তর অর্ষার মনঃপুত হলো না। সে স্পষ্ট উত্তর চায়। যেই উত্তরে সবটা পরিষ্কারভাবে জানা যাবে। কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব? কাকে জিজ্ঞেস করবে সে?

এর মাঝে শশী এসে চা দিয়ে গেল। প্রতিদিন রাফিকে যতটুকু পড়ায় আজ এরচেয়েও বেশি সময় নিয়ে পড়িয়েছে অর্ষা। তবুও সে তার সঙ্কোচ থেকে বের হয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি শশীর কথা। রাফিকে পড়ানো শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আহনাফ পেছন থেকে ডাকে।

“অর্ষা।”

অর্ষা সচকিত হয়ে তাকায়। চোখে-মুখে প্রশ্নের বাণ। সে সকল প্রশ্ন উপেক্ষা করে আহনাফ বলল,

“আমিও বের হচ্ছি। আপনাদের বাড়ির ওদিক দিয়েই যাব। একটু ওয়েট করুন আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”

অর্ষা দাঁড়াল। কিছু সময়ের মধ্যেই আহনাফ গাড়ি এনে দাঁড় করাল অর্ষার পাশে। আজ আহনাফই ড্রাইভ করছে। সে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,

“উঠুন।”

অর্ষা বিনাবাক্যে উঠে বসল। বারবার প্রশ্ন করতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। নিজে নিজে আর টিকতে না পেরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে,

“আচ্ছা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?”

আহনাফ গাড়ির আয়নায় একবার অর্ষার দিকে তাকাল। তবে সরাসরি নয়। বলল,

“জি।”

“কিছু মনে করবেন না তো?”

“কিছু মনে করলে কি জিজ্ঞেস করবেন না?”

অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আহনাফ হেসে বলে,

“মজা করলাম। বলুন কী জানতে চান?”

“আপনার আর কোনো ভাই আছে?”

“না। কেন?”

“এমনি।”

“এটা তো কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন হলো না। আপনি অন্যকিছু জানতে চান।”

অর্ষা নিশ্চুপ। জড়তা কাটিয়ে বলে,

“আপনি কখনও কাউকে ভালোবাসেননি?”

এবার আহনাফ নিশ্চুপ হয়ে যায়। কোনো কথা বলছে না। নিরবে গাড়ি ড্রাইভ করছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। একসময় সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তখন আহনাফ বলে,

“একটা কথা বলব?”

চকিতে ফিরে তাকায় অর্ষা। কিছুটা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে,

“জি।”

“আমার আসলে এখন কোনো কাজই ছিল না আপনার বাড়ির ওদিকে।”

“তাহলে আসলেন কেন?”

আহনাফ আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

“আপনাকে কিছু কথা বলতে।”

অর্ষার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। আহনাফ তাকে কী কথা বলতে চায়?

“আমি আপনার দৃষ্টির ভাষা বুঝি।” বলল আহনাফ।

সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অর্ষা। আহনাফ এটাও আয়নায় লক্ষ্য করে। এরপর বলে,

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”

অর্ষা এবার মুষড়ে যায়। দারুণ বিপাকে পড়ে গেছে সে। আহনাফ কেন তাকে এসব বলছে? তাও আবার সরাসরি!

“আমার ভুল হলে সেটাও আমায় জানাবেন।”

অর্ষা নিরুত্তর।

আহনাফ বলল,”আমি কি এই পর্যন্ত ভুল বললাম?”

“এসব কথা কেন বলছেন এখন?”

“যাতে জল বেশিদূর আর না আগায়।”

“মানে!”

“ভালোবাসা অন্যায় কিংবা দোষের নয়। তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসা অন্যায়।”

চাপা আঘাত বুকে অনুভব করে অর্ষা। আহনাফ তাকে কী বলতে চাচ্ছে বা কী বোঝাতে চাচ্ছে সেটা সে এখনও বুঝতে পারছে না। আহনাফ নিজে থেকেই বলল,

“আমি আপনার জীবনে ভুল মানুষ। আমাকে ভালোবেসে আপনার ভালোবাসা কিংবা সময়ের অপচয় করবেন না। আমি বললাম না আপনার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি? শশীকে নিয়ে আপনার সংশয়ও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি এবং আপনার সংশয়ই ঠিক।”

“এর মানে? সে আপনার স্ত্রী!”

“নাহ্! তবে হবু স্ত্রী।”

একটা সূক্ষ্ম তীর যেন অর্ষার বুকটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল তৎক্ষণাৎ। ব্যথায়, অবহেলা ও অপমানে জর্জরিত অর্ষা মূর্ছা যাচ্ছে ভীষণভাবে! এ আঘাত প্রবল অসহনীয় কষ্টের।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here