#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
৯.
১ মাস আগের কথাঃ
“ফারহান, ফারহান, আমি এসে গেছি” বাংলোতে প্রবেশ করেই ডাক ছাড়ল রাইয়্যান।
সোফাতে গা এলিয়ে দিতেই বানু খালা ওর জন্য শরবত নিয়ে আসল। এই বানু খালা পরিচারিকা হলেও ওদের দুই ভাইয়ের কাছে মায়ের মত। ওদের বাবা ব্যবসার কাজে সবসময় দেশেবিদেশে দৌড়ে বেড়াতেন, আর সাথে ওদের মাকেও দৌড়াতে হত। কারণ বাবা মাকে ছাড়া এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে পারতেননা। এজন্য ছোটবেলা থেকে ওদের দেখাশোনা বানু খালাই করতো। খালা বোবা, অবশ্য কানে শুনতে পায়। জন্ম থেকে বোবা না, ছোটবেলায় কি এক দুর্ঘটনায় বাকশক্তি হারিয়েছে।
“কিগো খালা, ফারহান কই? এতবার ডাকছি সাড়া দিচ্ছেনা”
কালকে থেকে বের হয়নি ঘর থেকে, ইশারায় জানাল খালা।
“কি! আবার!! এই ছেলেটা আর বদলালোনা। দাঁড়ান, আমি বের করে আনছি গুহামানব কে” এই বলে সিঁড়ির দিকে এগোল রাইয়্যান।
মু’তাসিম বিল্লাহ রাইয়্যান, খান গ্রুপের কর্ণধার, বর্তমানে দেশের লিডিং ইয়াং বিজনেসম্যানদের মধ্যে অন্যতম। সেরা বললেও অত্যুক্তি হবেনা, তবে ক্যামেরার সামনে থাকতে পছন্দ করেনা বলে সাধারণ মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয় নামটা।
খান গ্রুপের গোড়াপত্তন করেছিলেন মরহুম বাবা আফসার উদ্দীন খান। তিনিও ছিলেন সেসময়ের সেরা একজন ব্যবসায়ী। এখনো সৎ এবং সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তার নাম ব্যবসায়ী মহলে প্রশংসা এবং সম্মানের উচ্চারিত হয়।
বারো বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে খান গ্রুপকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাঁর বড় ছেলে রাইয়্যান। এত কম বয়সে সফলতার সাথে এতবড় ব্যবসা সাম্রাজ্য পরিচালনা করা হয়ত কঠিন, কিন্তু সেটা যে অসম্ভব না, সেটাই প্রমাণ করেছে সে এই বারো বছরে।
মা-বাবাকে একসাথে হারিয়ে এতটা শক্ত থাকা হয়ত সম্ভব ছিলনা। কিন্তু ৮ বছর বয়সী ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ১৬ বছর বয়সেই বড় হতে হয়েছে রাইয়্যানকে। কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে বিশাল দায়িত্ব।
তবে আনন্দের কথা হল, ব্যবসার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুল থেকে সোজা বাবার অফিসে চলে আসতো রাইয়্যান, দেখতো বাবা কেমন দক্ষতার সাথে একের পর এক বিজনেস এবং প্রবলেম ডিল করে। এ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত সম্রাট হিসেবে সবসময়ই নিজেকে কল্পনা করতো ও। তাই কল্পনাটা সময়ের অনেক আগেই সত্যি হয়ে গেলেও সমস্যা হয়নি ওর। একই সাথে যেমন পড়ালেখা করেছে, তেমনি পরিচালনা করেছে ব্যবসা আবার দেখাশোনা করেছে ভাইয়েরও।
এই বিশাল দুনিয়ায় ওরা রচনা করেছে দুই ভাইয়ের ছোট্ট একটা পৃথিবী, যেখানে একজন আরেকজনকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। এত আদর দিয়েছে রাইয়্যান ভাইকে, যেন ছেলেটা কোনদিন বাবা-মার অভাব বুঝতে না পারে। বেশি আদরে বাঁদর না হলেও বেশ লাই পেয়ে গেছে ছেলেটা। সব চাওয়া মুহূর্তেই পেয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড ইমোশনাল আর জেদি। আর ওর রাগ আর জিদের কাছে অসহায় রাইয়্যান।
ফারহানের সবথেকে পছন্দের কাজ হচ্ছে, একা থাকা। নিজের ঘরে কারো সাথে কথা না বলে ল্যাপটপ আর ফোন নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারে ছেলেটা। বাইরে থেকে শতবার ডাকলেও নিজের ইচ্ছে না হলে বের হয়না ও। ঘরে থাকা ছোট ফ্রিজ আর কাবার্ড সবসময় খাবার জিনিস ভর্তি থাকা লাগে ওর। কারো সাথে কথা না বলে আর শুধু ফ্রিজের খাবার আর চিপ্স-চকলেটে-বিস্কিট খেয়ে মানুষ কিভাবে বাঁচতে পারে বুঝে আসেনা রাইয়্যনের। তাই ও ফারহানের নাম দিয়েছে গুহামানব।
অবশ্য এর পেছনের রাইয়্যানেরও দোষ কম নেই। এদিক ওদিক ব্যবসার কাজে রাতদিন ছোটাছুটি করতে হয় ওকে। ভাইয়ার থেকে আলাদা থাকতে গিয়েই এই অদ্ভুত অভ্যাস তৈরি হয়েছে ফারহানের। কিন্তু সুখের কথা হল, রাইয়্যান ফিরে আসলে সাথে সাথেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে ও। এজন্য এয়ারপোর্টে নেমেই আগে ফারহানকে কল দেয় রাইয়্যান, নিচে এসে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে ছেলেটা।
কিন্তু আজকে গাড়িতে ওঠার পর থেকে এতবার কল দিল, রিসিভ করেনি ফারহান। মনে হয় এবার একটু বেশিই রেগে আছে, যাই সামনাসামনি গিয়েই রাগ ভাঙাই, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবছিল রাইয়্যান।
খান টি এম্পায়ার, খান গ্রুপের টি এস্টেট। এখানকার বাংলোতেই কেটেছে দুই ভাইয়ের শৈশব-কৈশোর। তাই বড় হয়েও এখানকার মায়া কাটাতে পারেনি কেউই। ঢাকাতে নিজেদের অনেকগুলো বাড়ি এবং ফ্ল্যাট থাকলেও ফারহানকে এখান থেকে নড়ানো যায়নি। এ বছর এইচ এস সি দেয়ার পর অনেক চেষ্টা করে শাবিপ্রবিতেই ভর্তি হয়েছে ছেলেটা। কিন্তু এই গুহাপ্রীতির জন্য ক্লাস করানো যাচ্ছে ছেলেটাকে দিয়ে, সেটা নিয়ে চিন্তিত রাইয়্যান। এবার সময় নিয়ে ওর সাথে কথা বলবে, এই চিন্তা করে এসেছে রাইয়্যান।
বিশাল একটা ডুপ্লেক্স বাংলো ওদের। উপরতলায় তিনটা বিশাল ঘর আর মাঝখানে একটা ফ্যামিলি গ্যাদারিং এর স্পেস। নিচতলায় ছোট ছোট কয়েকটা রুম, কিচেন আর ড্রয়িংরুম। এর মধ্যে একটা ঘরকে আবার পারিবারিক লাইব্রেরী বানিয়েছিলেন আফসার উদ্দীন খান। বছর বছর রাইয়্যান শুধু সেটাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। দুই ভাইয়ের কারোই বইয়ের প্রতি তেমন নেশা নেই। ফারহান তাও মাঝে মাঝে একটা দুইটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে, কিন্তু রাইয়্যান ধারেকাছেও যায়না। ওর ব্যবসাই নেশা, আর সেটাই পেয়েছে পেশা হিসেবে, আর কি লাগে!
উপরতলার দুই ঘর এখন দুই ভাইয়ের, আরকটা তালাবন্ধ থাকে। ফারহানের ঘরটা পড়ে সবার শেষে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিল রাইয়্যান।
“ফারহান, দরজা খোল ভাই, আমার ওপর রাগ করে থাকিসনা প্লিজ!”
“স্যরি বলছি, কান ধরছি, এরপর আর জীবনেও এতদিন তোকে ছেড়ে থাকবোনা, ডাকলেই ছুটে চলে আসব, ভাই আমার, প্লিজ দরজা খোল” এবার পুরো এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, ভাবল রাইয়্যান।
“কিরে, বিশ্বাস করলিনা আমার কথা, সত্যি বলছি, প্রমিস করছি তোকে, আমি তোর কথা শুনবো, শুনতে পাচ্ছিস তুই, ফারহান, এই ফারহান!”
এতকিছু বলার পরেও দরজা না খোলায় খারাপ আশংকা উঁকি দিল রাইয়্যানের মনে। একা একা থাকে, কত কিছুই তো হতে পারে। আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। তাও কোন সাড়া না পেয়ে মনে হল দরজা ভাঙতে হবে। খালাকে পাঠাল ম্যানেজারকে ডেকে আনতে। আর নিজে কাঁধ দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। একা একা সম্ভব হলনা। ম্যানেজার আসার পর দুইজন মিলে বেশ কয়েকবার জোর ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলল দরজা।
ভেতরে বিছানায় চোখ পড়তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাইয়্যান। কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে ফারহান। ম্যানেজারকে বলল, “আপনি যান”। তারপর নিজে এগোল ভাইয়ের দিকে।
ম্যানেজার সিঁড়ির মুখে পৌঁছাতেই পারেনি, রাইয়্যানের চিৎকার শুনতে পেল, ঘুরে দৌড় দিল ফারহানের ঘরের দিকে। গিয়ে দেখল রাইয়্যান ফারহানকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চিৎকার করছে।
“ভাই, চোখ খোল ভাই, আমার উপর এত অভিমান করছিস কেন? আমি তো এসেছি, কিরে, এই ফারহান, চোখ খোলনা” এগুলা বলে হাত দিয়ে ফারহানের মুখে বাড়ি দিচ্ছে রাইয়্যান, কিন্তু ফারহান কোন সাড়া দিচ্ছেনা।
ম্যানেজার তাড়াতাড়ি ফারহানের গায়ে হাত দিতেই দেখল, বরফের মত ঠাণ্ডা। মুহূর্তেই যা বোঝার বুঝে গেল।
“স্যার, এক্ষনি ছোট সাহেবকে হসপিটালে নিতে হবে” উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ম্যানেজার, যদিও সে বুঝে গেছে, আর কিছুই করার নেই।
“এ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, জলদি গাড়ি বের করতে বল ড্রাইভারকে” এতবড় ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটল রাইয়্যান।
***
ডাক্তার যখন জানাল যে, আত্মঘাতী পরিমাণে ঘুমের ঔষধ খেয়েছে ফারহান এন্ড হি ইজ নো মোর…. রাইয়্যান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা। ও চিন্তাই করতে পারছিলোনা, ফারহানের এমন কি দুঃখ কষ্ট থাকতে পারে যে ও আত্মহত্যা করবে! ডাক্তার ওকে মিথ্যা বলছে, অন্য হসপিটালে নিবে ও ফারহানকে, ওর কিছু হতেই পারেনা….. এইসব বলে হাসপাতালে বিশাল একটা হাঙ্গামা করেছে রাইয়্যান। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে কোনভাবে বুঝিয়ে শান্ত করেছে ওকে।
ফারহানকে ওর আরেক প্রিয় স্থান পাহাড়ের ঝর্ণার পাশে কবর দেয় রাইয়্যান। সপ্তাহে অন্তত একবার এই ঝর্ণায় গোসল করতে আসতো ও। রাইয়্যান এখানে থাকলে দুই ভাই মিলেই আসতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতো দুজনে। ফারহানের আবদারে এই পাহাড়ের উপরে বনের মধ্যে একটা চালাঘর তৈরি করে দিয়েছে রাইয়্যান। গুহাপ্রীতি চরমে উঠলে এই ঘরে এসে বাস করতো ও। বর্ষাকালে তো পুরো বাসস্থান বানিয়ে ফেলতো। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে নাকি ওর খুব ভাল লাগে। কিন্তু রাইয়্যানের এ কাজটা একদম পছন্দ ছিলনা। কারণ এই জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না, কোন খোঁজ নিতে পারতোনা ও ফারহানের।
কবর দেয়ার পর সেই চালাঘরে এসে পুরো দুইদিন পড়ে ছিল রাইয়্যান। সারাটাক্ষণ শুধু নিজেকে দোষারোপ করেছে। আমার অবহেলার জন্যই এমন হয়েছে, আমি আমার ভাইকে সময় দিইনি বলে জানতে পারিনি ওর মনে এত কষ্ট জমে ছিল, আমি ব্যবসার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভাইকে অবহেলা করেছি, আমি একজন অযোগ্য বড় ভাই, এসব ভেবে ভেবেই চোখের পানি ফেলছিল রাইয়্যান। কিন্তু আসল ঘটনা জানার পর চোখের পানি শুকিয়ে সেখানে স্থান করে নেয় অপরিসীম ক্রোধ।
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
১০.
কোন সুইসাইড নোট বা এমন কোন কিছু পাওয়া যায়নি ফারহানের ঘর থেকে, যাতে জানা যায় ওর এমন কাজের কারণ। শুধু ১২ ঘন্টা আগে ফেসবুকে দেয়া একটা স্ট্যাটাস এমন ছিল, “ভালবাসা আর অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেনা, এমন বোকা মানুষের কি বেঁচে থাকার অধিকার আছে?” এটা জানার পর দেয়ালে মাথা ঠুকেছে রাইয়্যান, কেন ও এতসময় ধরে ফেসবুকে ঢুকেনি, অন্তত স্ট্যাটাসটা দেখলে কিছু একটা আঁচ করতে পারতো!
কিন্তু এতেই বুঝতে পারে রাইয়্যান, এর পেছনে একটা মেয়ে দায়ী, আর মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। খোঁজার সূত্র হিসেবে প্রথমেই মনে আসে ফেসবুকের কথা। কিন্তু আইডি ডিএক্টিভেট করে দিয়েছে ফারহান।
তখন ওর এক এক্সপার্ট বন্ধুর সাহায্যে ফারহানের আইডি হ্যাক করে রাইয়্যান। আর্কাইভড মেসেজ এর মধ্যে পায় “শুভ্র অপরাজিতা” নামক একটা আইডির সাথে ফারহানের কনভারসেশন। শেষের কয়েকটা মেসেজ থেকেই বোঝা যায়, এটাই সেই মেয়ে। মেয়েটার লাস্ট মেসেজ ছিল,
“আমাকে তুমি ভুলে যাও, ফারহান। আমি তোমার যোগ্য না। আমি তোমার সাথে কখনওই সিরিয়াস ছিলামনা। ফেসবুকে প্রেম করতে কেমন লাগে, সেটা জানার কিউরিসিটি থেকে আমি তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, তুমি এতটা সিরিয়াস হয়ে যাবা। আমি তাই সরে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে ভুলে যাও, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আই এম রিয়েলি সরি।“
এরপর আর কোন মেসেজ পাঠায়নি ফারহান, মেয়েটা সম্ভবত ওকে ব্লক করে দিয়েছিল। এখনো নিচে উঠে আছে, “You can’t reply to this conversation”
রাগে মাথা গরম হয়ে যায় রাইয়্যানের। সাথে সাথে নিজের ফেসবুক থেকে মেয়েটাকে সার্চ দেয়, কিন্তু বুঝতে পারেনা কোনটা, কারণ এই নামের অনেক আইডি আছে ফেসবুকে।
তখন ওই মেয়েটার সাথে ফুল কনভারসেশন প্রিন্ট আউট করে রাইয়্যান। এরপর অপরিসীম ধৈর্যের সাথে পুরোটা পড়ে মেয়েটার পরিচয় উদ্ধার করে ও।
মেয়েটার নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা, দারুন নাজাত মহিলা মাদ্রাসায় ফাযিল প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ফোন নাম্বারও পায়, কিন্তু বন্ধ। ঠিকানা না পেলেও ফোন নাম্বার দিয়ে ঠিকানা খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগেনা ওর। আরো খোঁজখবর নেয় রাইয়্যান, মেয়েটা হাফেযা, আশেপাশের কেউ কোনদিন মুখ তো দূরের কথা হাতটাও দেখেনি ওর। রাগে আগুন হয়ে যায় রাইয়্যান। ছি! মুখ দিয়ে ঘৃণার সাথে বেরিয়ে আসে শব্দটা।
মেয়েটা যদি এখনকার দিনের মডার্ন মেয়েগুলোর মত হত, বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করত, রাতদিন ছেলেবন্ধুদের সাথে আড্ডা মারত, কাপড় চেঞ্জ করার মত ছেলে চেঞ্জ করত, তাহলেও হয়ত মেনে নেয়া যেত। ঠিক আছে, মেয়েটা খারাপ, শিক্ষার অভাব আছে বলে ধরে নিতাম, ভাবল রাইয়্যান। কিন্তু যে মেয়ে উপরে খুব ভাল মেয়ে সেজে থাকে সবার সামনে, আর গোপনে গোপনে ফেসবুকে প্রেমের অভিনয় করে, প্রেমিকের সাথে স্টাইলিশ ছবি আদানপ্রদান করে, তার উপর জাস্ট ঘেন্না ধরে গেল রাইয়্যানের। হ্যাঁ, অনেকগুলো ছবি পেয়েছে রাইয়্যান, সেগুলো হাই কোয়ালিটির প্রিন্ট করিয়েছে ও, যাতে চিনতে কোন অসুবিধা না হয়।
“সিদ্রাতুল মুনতাহা, ইউ হ্যাভ টু সাফার এন্ড আই উইল মেক শিওর দ্যাট ইউ সাফার টু ডেথ” সবকিছু জানার পর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রাইয়্যান।
তারপর কয়েকদিন ধরে প্ল্যান করেছে, কিভাবে কি করবে ও। তারপর একদিন সকালে ভাইয়ের কবরের কাছে এসে জানিয়েছে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। তার পরদিন সকালেই কিডন্যাপড হয় সিদ্রা।
*****
ফিরে আসছি বর্তমানেঃ
ঝর্ণা পাড়ের ওই ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েকটা দিন। সেদিনের পর পুরো নিশ্চুপ হয়ে গেছে সিদ্রা। শুধু একবার খালাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওইটা সত্যি উনার ভাইয়ের কবর?” মাথা ঝাঁকিয়েছিল খালা। আর ইশারায় বলেছিল, ও আত্মহত্যা করেছে।
আর একটা কথাও বলেনি সিদ্রা, বলে লাভ কি। ভাইয়ের আত্মহত্যার জন্য উনি আমাকে দায়ী করছেন, অথচ আমি ছেলেটার নাম পর্যন্ত জানিনা, ভাবছিল সিদ্রা। কিন্তু আমি এর মধ্যে কিভাবে ফেঁসে গেলাম, সেটা তো কিছুতেই মাথায় ঢুকছেনা। আর মাথায় ঢুকিয়ে কাজ নেই, এই লোক কিছুতেই বুঝবেনা, পালানোই এখন একমাত্র অপশন, ভেবেছে ও। এরপর থেকে সারাদিন সারারাত পালানোর পরিকল্পনা করে চলেছে সিদ্রা।
খালা ওকে কয়েকবার কাজ করার কথা বলেছে, লোকটা নাকি করাতে বলেছে ওকে দিয়ে, কানে তুলেনি সিদ্রা। বুঝে গেছে ও, খালা ওকে জোর করতে পারবেনা, তাই শুধু নিজের প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হত ও।
এত শান্তিতে দিনগুলো কাটানোর পেছনে ছিল লোকটার অনুপস্থিতি। লোকটা মনে হয় দূরে কোথাও থাকে, ভেবেছে সিদ্রা। কয়েকদিনের জন্য এখানে আসে, আবার কয়েকদিনের জন্য যায়।
আর খালাও যে মাঝমাঝে ঘন্টাখানেকের জন্য কোথাও একটা যায়, সেটা সিদ্রা বুঝতে পেরেছে। কারণ সেসময় অনেকবার ডেকেও খালার সাড়া পাওয়া যায়না। কয়েকদিন একই ঘটনা ঘটার পর নিশ্চিত হয়েছে ও। চাল-ডাল, তরিতরকারি আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ওই সময় নিয়ে আসে বলে মনে হয়েছে ওর। তার মানে আশেপাশে নিশ্চয় লোকালয় আছে কিন্তু সেটা কোনদিকে সেটা সিদ্রা বুঝতে পারেনি। সেটা জানলে ওর পালানোর পরিকল্পনাটা একটু সলিড হত। ওই লোকটা এবার ফিরে আসার আগেই পালাব আমি, ঠিক করেছে সিদ্রা।
খালা এখন মাঝে মাঝে এসে ওর কাছে বসে থাকে। সুখের বিষয়, এখন আর আগের মত পাথর মুখ করে না থেকে কথা বলে ওর সাথে, অবশ্যই ইশারায়। আর অবাক ব্যাপার হল, ও এখন খালার কথা অনেকটাই বুঝতে পারে। খালাকে নামাজ পড়া শিখিয়েছে সিদ্রা। শেখানো বলতে কোন ওয়াক্তে কত রাকাত আর কিভাবে নামাজের ভেতর উঠাবসা-অঙ্গভঙ্গি করতে হয় এটুকুই। ওর ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে, যেহেতু খালা বলতে পারেনা, সেহেতু তার নামাজ এগুলো দিয়েই হয়ে যাওয়ার কথা। এখন মাঝে মাঝে আল্লাহ্ বলানোর চেষ্টা করে খালাকে দিয়ে।
সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ভোররাতে উঠে প্রথমবারের মত দরজা খোলা পেল সিদ্রা। আমি প্রতিদিন ডাকি দেখে মনে হয় আজ খালা ইচ্ছে করে খুলে রেখেছে। পা টিপে টিপে খালার ঘরে উঁকি দিল সিদ্রা। কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে খালা। আস্তে করে দরজাটা টেনে বাইরে থেকে আটকে দিল সিদ্রা। বেশ, আবার যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন আজ আর ভুল করবনা। পালাব আমি, একটু শুধু আলো ফুটুক।
খালা অবশ্য ওকে বেশ কয়েকবার বলেছে, এখান থেকে পালানো অসম্ভব। যেদিক দিয়েই পালাতে যাক, স্রেফ মারা পড়বে। মারা যাওয়ার কথাটা গলায় পোঁচ দেয়ার ভঙ্গিতে দেখিয়েছে খালা, যেন কেউ ওকে খুন করবে। কিন্তু তাতে দমেনি সিদ্রা, আমি তো পালাবই, তাতে মারা পড়লে পড়ব।
কোনদিক ধরে পালাবে, সেটা তো ঠিক করাই আছে। ঝর্ণার দিক পাহাড়ে ঘেরা, ওদিকে গিয়ে লাভ নেই, আর লোকালয় যেদিকেই হোক, সেদিন গাছে বাঁধার জন্য যেদিকে নিয়ে গেছিলো, সেদিকে হওয়ার চান্স কম। তাহলে বাকি দুইদিকের যেকোন একদিকে যেতে হবে ওকে। রান্নার জায়গায় পানির বোতল দেখেছিল দুইটা। বোতল দুইটাতে ঝটপট পানি ভরে নিল। তারপর জীবনের সবথেকে তাড়াতাড়ি ফযরের নামাজ আদায় করল সিদ্রা। চারপাশ আবছা হয়ে উঠছে, আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিল। খালা জেগে উঠার আগে যতদূর যাওয়া যায়, ততই ভাল।
অন্ধকার রাস্তায় বারবার হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছে সিদ্রা। বোতল দুটোকে ওই ছেঁড়া শাড়িটার মধ্যে পুটলির মত বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে, তাতে একটু সুবিধা হচ্ছে। আর বুদ্ধি করে খালার স্পঞ্জের স্যান্ডেলগুলো পরে এসেছে, এতে করে পায়ে কাঁটা বিধে যাবার ভয় নেই। আস্তে আস্তে আলো বাড়ছে, দৃষ্টি পরিস্কার হতেই গতি বাড়াল সিদ্রা। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে অনভ্যস্ত পায়ে আর কত দ্রুত হাঁটা সম্ভব।
কতক্ষণ ধরে হাঁটছে জানেনা সিদ্রা। এর মধ্যে এক বোতল পানি শেষ করে ফেলেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, পা দুটো আর চলছেনা। উত্তেজনার চোটে খাবারের কথা মনে পড়েনি ওর। আর পড়লেইবা, খাবার দাবার সব খালার ঘরে থাকে, নিতে গেলে স্রেফ ধরা পড়ে যেত। আর পারলনা সিদ্রা, বসে পড়ল একটা গাছের নিচে। আমি নিশ্চয় ভুল পথে এসেছি, ভাবল সিদ্রা। খালার যাওয়া আসা করতে তো এত সময় লাগেনা। কটা বাজে এখন! সূর্যের তাপ আর আলো থেকে মনে হচ্ছে দশটা এগারোটা মত বাজার কথা। এতক্ষণ ধরে হাঁটছি, কোন ফলমূলের গাছও চোখে পড়লনা, এ কেমন বন!
একটু আরাম করে, এক ঢোক পানি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করল সিদ্রা। লোকালয় কখন পাবো, ঠিক নেই, পানিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু ক্ষুধায় আর ক্লান্তিতে ওর হাঁটার গতি যে অনেক কমে গেছে, বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। পা টেনে টেনে শরীরটা কোনরকমে এগোচ্ছে ও। অপেক্ষা, কখন পেরোবে বনের সীমানা, কখন দেখবে লোকালয়!
অবশেষে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছল সিদ্রা, শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ধপ করে পড়ে গেল সিদ্রা। দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসল ওর।
(চলবে)