#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২
“আপনি তো ভারী সুবিধাবাদী লোক!”
ভ্রু দুটো কুঞ্চিত করে আঁখি দুটো ছোটো করে স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে কথাটি বলল মোহ। স্বচ্ছ সরল মনে জানতে চাইল,
“কেন?”
“কেন মানে? আপনি মোটেও আমার বা আমার বাবার উপকার করেননি সেটা খুব ভালো জানেন। যা করেছেন সেটা আপনার বাবার ঘৃণিত কাজের প্রায়শ্চিত্ত বলা যায়। আর আমি আপনাকে ফর্মালিটির জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছি বাবার কথায়। আর আপনি কিনা এর বদলে অন্যকিছু চাওয়ার পরিকল্পনা করছেন?”
স্বচ্ছ বিস্তর হাসল এবার। খানিকটা ভাব নিয়ে প্রতিত্তোর করল,
“যাই হোক না কেন! আমার আসল পরিচয় তো সেই বাপের ছেলেই। তাই সবখানে সুবিধা খুঁজতে হয়।”
“হুমম তাই তো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সেই মন্ত্রীর বড়ো ঘাড়ত্যাড়া ছেলে আপনি।”
“এই ঘাড়ত্যাড়া কাকে বললে?”
স্বচ্ছের রুক্ষ স্বরের জবাবে মোহ চাপা সুরে বলল,
“যাকে বলেছি তার গায়ে ইতিমধ্যে লেগে গিয়েছে এবং সে বেলুনের মতো ফুলছে।”
“উপকার করতে এসে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছো?”
মোহের হাসি পেল এবার। তবে হাসল না। মুখে গাম্ভীর্য ভাবটা বজায় রাখল। হঠাৎ উদয় হলো নার্সের। হাতে ইনজেকশনের সিরিজ। আর ছোটো বতলে মেডিসিন। তা দেখেই স্বচ্ছের চোখমুখ জড়িয়ে এলো। খানিকটা অবাক কণ্ঠে বলল,
“আরে আজ তো আমার ডিসচার্জ করে দেওয়ার কথা। আবার ইনজেকশন কেন?”
নার্স কিছুটা বাধ্য মেয়ের ন্যায় বলল,
“আসলে স্যার আপনার পায়ে তো গুরুতর নিয়ে আপনি বেরিয়ে গেলেন কাল। এত দ্রুত ওভাবে নড়াচড়া করা ঠিক হয়নি আপনার। এতে ক্ষত জায়গা শুকিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আজকে দেখলাম সামান্য সমস্যা বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই আমার স্যারকে জানানোর পর এই ইনজেকশন পায়ের কাছে দিয়ে দিতে বলল। ইনফেকশন এড়াতে হবে স্যার। আপনার বাবা এমনিতেই বলে গিয়েছেন আপনার যাতে কোনোরকম সমস্যা না হয়।”
“তাই বলে ইনজেকশন নিতে হবে?”
স্বচ্ছের কণ্ঠে উদ্বেগ বেশ ভালোমতো বুঝতে পারল মোহ। নার্স মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“জি, স্যার।”
স্বচ্ছের চেহারায় এবার দৃশ্যমান হলো একটু জড়োসড়ো ভাব। মোহ মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল,
“আপনার কি কোনো সমস্যা ইনজেকশনে? ভয় পান?”
মোহের এই জিজ্ঞাসায় অপ্রস্তুত হলো স্বচ্ছ। তবে সংকোচের সহিত সাহস নিয়ে বলল,
“আরে না, না। এসব ছোটোখাটো জিনিসে কে ভয় পায়?”
“হুম। ভয় না পেলে ভালো। ইনজেকশন দিয়ে নিন দ্রুত।”
নার্স নিজের কাজ সম্পাদন করতে স্বচ্ছের নিকট এগিয়ে ইনজেকশনের সিরিজে মেডিসিন ভরতে লাগল। স্বচ্ছ তা মনোযোগ দিয়ে দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে নড়েচড়ে বসল। মোহের দিকে নরম দৃষ্টিপাত করে বলল,
“সৌমিত্র কোথায়? নেই আশেপাশে?”
মোহ সহজ গলায় উত্তর করল,
“মনে হয় না। কোনো দরকার?”
স্বচ্ছ হাসার ভান করে বলল,
“না। কোনো দরকার নেই।”
“স্যার, একটু নড়াচড়া বন্ধ করে ঠিক হয়ে বসবেন? পা এগিয়ে দিলে ভালো হয় এদিকে।”
নার্সের কথায় স্বচ্ছ খানিকটা চমকে সোজা হয়ে পা মেলে বসে। উপায়ন্তর না পেয়ে খুবই নিচু স্বরে মোহকে ডাক দিয়ে বলে,
“আমার পাশে একটু বসবে?”
বিস্মিত হলেও তা প্রকাশ না করে ধীর পায়ে গিয়ে স্বচ্ছের পাশে বসে মোহ। নার্স ইনজেকশনের সিরিজ স্বচ্ছের পায়ের কাছে ধরতেই স্বচ্ছ ফের আবদার করে বলে ওঠে,
“মিস মোহ! তোমার হাতটা আমি কিছুক্ষণের জন্য ধার করতে পারি প্লিজ?”
মোহের স্বচ্ছের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না। আশ্চর্যান্বিত হয়ে কিছু বোঝার আগেই তার ডান হাতে টান পড়ল। স্বচ্ছের পেশিবহুল হাতের মাঝে আটকা পড়ল তার চিকন হাতখানা। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল চোখ খিঁচে বন্ধ করে রয়েছে লোকটি। চোখেমুখে কী আতঙ্ক! যেই না ইনজেকশনের সুঁই স্বচ্ছের পায়ের চামড়ার স্তর ভেদ করল তৎক্ষনাৎ না বুঝেই মোহের চিকন ও কোমল হাতটা বেশ নিজের শক্তি দিয়ে চাপ দিয়ে ফেলায় মোহের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আকস্মিক চিৎকার। নার্স ইনজেকশন দেওয়া শেষ করতেই চিৎকারে চমকে উঠল। তার নিজেরও বুঝতে সময় লাগল আসলে সে ভুল মানুষকে সুঁই লাগিয়ে বসল না তো! কাজ শেষ হতেই সহজভাবে মোহের হাত আলগা করে দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বসল স্বচ্ছ। নার্স চলে গেল। মোহের হাতের মৃদু ব্যথায় অন্য হাত দ্বারা ঘষতে থাকল আর রাগান্বিত দৃষ্টিপাত করতে থাকল স্বচ্ছের পানে। স্বচ্ছের হাবভাব এমন যেন সে কিছুই করেনি। আঁড়চোখে মোহের এমন ভঙ্গি দেখে স্বচ্ছ সহজ গলায় প্রশ্ন করে বসে,
“কী হয়েছে? এমন মঞ্জুলিকা লুক দেওয়ার মানে কী?”
“ইনজেকশনে ভয় পান আগে বললেই হতো।”
স্বচ্ছ এবার এমনভাবে তাকাল যেন মোহ অতি বিস্ময়ের কিছু বলে ফেলেছে। বেশ সুন্দরভাবে অস্বীকার করে বলল,
“ভয়? কীসের ভয়! আমি ভয় পাব কেন?”
মোহের নেত্রপল্লব সরু হলো এবার। অকপট হয়ে বলে উঠল,
“ওহ আচ্ছা! সাহসী বীরপুরুষ! একটু আগে তাহলে কেন আমার হাত ধরেছিলেন?”
স্বচ্ছ গলা খাঁকারি দিয়ে কিছুটা থেমে বলল,
“ওহ হো! তোমার মনে হলো আমি ভয়ে হাতটা ধরেছিলাম? স্টুপিড গার্ল৷ আমি আসলে পরীক্ষা করছিলাম তোমার ধৈর্যশক্তি কতটা। বলতে হচ্ছে, তোমার ধৈর্যশক্তি কিন্তু বেশ!”
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহ। একটা মানুষ কীভাবে সুন্দর করে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটা স্বচ্ছকে না দেখলে হয়ত মোহ আজ বুঝত না। এই স্বচ্ছের অযাচিত প্রতিভার বিপরীতে মোহের প্রক্রিয়া কী হওয়া উচিত মোহ ঠিক করতে পারল না। সব মিলিয়ে ফিক করে হেসে দিলো মোহ। তার হাসিতে চুপসে গেল স্বচ্ছের মুখ। তেতে বলে ওঠে,
“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কোথায়? সবসময় এত হাসতে হয় কেন? আমি বয়সে তোমার সিনিয়র হই। সিনিয়রদের সামনে এত হাসতে নেই৷ কম হাসবে। ভদ্র আচরণ করবে।”
মোহের হাসি আটকানো গেল না। সে হাসি মুখ করেই বলল,
“সিনিয়রের বাচ্চা কর্মকাণ্ড দেখলে হাসি পেলে তো আটকানো যায় না তাই না বলুন! আর চোখের সামনে যখন ঘাড়ত্যাড়া বাঘ থেকে সোজা নিচু সুরে ডাকা ভেজা বেড়ালে রূপান্তরিত হয় তখন হাসিটা আটকানো একপ্রকার অসম্ভব!”
স্বচ্ছ কপট রাগ নিয়ে বলল,
“বাচ্চা, বাঘ, বেড়াল আর কত বলবে! মানুষের কী ভয় করতে পারে না? তোমরা মেয়েরা না হয় তেলাপোকা, আরো অনেক পোকামাকড় দেখে ভয় পাও। আমিও তো মানুষ নাকি! আমি না হয় ইনজেকশন দেখে ভয় পেলাম।”
“আপনি কি দুনিয়ার সব মেয়েকে টেস্ট করে দেখেছেন? আমি তেলাপোকা দেখে ভয় পাইনা মি. স্বচ্ছ।”
স্বচ্ছ অবাক হয়ে শুধাল,
“সত্যি ভয় পাও না?”
“ডাউট আছে?”
“তা অবশ্য নেই।”
মোহ একটি আত্মবিশ্বাসী হাসি দিলো।
হসপিটাল থেকে মোহ বেরিয়েছে মিনিট দশেক হলো। খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে কোনোরকমে বেড থেকে পা দুলিয়ে বসে ছিল স্বচ্ছ। সৌমিত্র এলো হুড়মুড়িয়ে। হাতে চিপসের প্যাকেট। সেখান থেকে আয়েশ করে চিপস খেতে খেতে বসল ভাইয়ের মুখোমুখি। চিপস খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল,
“কথা হলো?”
“তোকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে কে বলেছিল বল তো?”
সৌমিত্রের কান টেনে ধরে রুক্ষ গলায় বলল স্বচ্ছ। সৌমিত্র ব্যথায় চোখমুখ জড়িয়ে নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে বলল,
“আরে ভাই কারণ তো বলেছিলাম আমি। এটা কিছু হলো? যার জন্য চুরি করছি সেই আমাকে চোর ভেবে ধরে পে/টাচ্ছে!”
“তোর এই চুরি করার চক্করে আমার মানসম্মান সব গেছে রসাতলে।”
সৌমিত্র বহু চেষ্টার পর নিজের কান ছাড়াতে সক্ষম হওয়ার পর দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে চরম অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন ভাই! তোমার মানসম্মান কে ছিনিয়ে নিলো? মিস. মোহ?”
স্বচ্ছের চোখমুখে এবার দেখা গেল ক্রোধের লাল আভা। কটমট করে সৌমিত্রের কাঁধ ছোঁ মে/রে ধরতে গেলে সরে যায় সৌমিত্র।
“আমি অসুস্থ থাকার এডভান্টেজ নিচ্ছিস? একবার ভালো করে হাঁটতে দে। তারপর তোকে এবার হসপিটালে ভর্তি করাব।”
সৌমিত্র দাঁত কেলিয়ে বলল,
“আরে ভাই, ভাই! ছোটো মানুষ তো দুষ্টু/মি করবেই বলো। বড়ো হিসাবে তোমাকে একটু মানিয়ে নেওয়া উচিত। এখনি মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস করে ফেলো ভাইয়া। নয়ত পরে কিন্তু বউয়ের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে না।”
স্বচ্ছ বেশ ভালোভাবে বুঝল সৌমিত্রের সাথে কথা বাড়ানো মানে সেই কথার অন্ত ঘটবে না। সে দৃঢ় শ্বাস ফেলে ঠাণ্ডা করল মেজাজ। হাত পেতে বলল,
“আমার সিম তোর কাছে না? দে তো। সাথে তোর ফোনটাও দে।”
সৌমিত্র কোনো বাহানা ব্যতীত স্বচ্ছের সিম আর নিজস্ব ফোন ধরিয়ে দিলো। স্বচ্ছ বিলম্ব না করে নিজের সিম সৌমিত্রের ফোনে নিজের সিম সেট করে ফেলল।
সবজির বাজারে এসে নামলো মোহ। কিছু সবজি নেওয়ার আছে তার। ভাড়া মিটিয়ে বাজারে ঢুকতেই মেসেজের টোন বেজে উঠল ফোনে। হাতেই ফোন ধরে রাখায় অন স্ক্রিনে নিজের দেওয়া সেই মজার নাম ‘স্টোর হাউজ ওফ ইগো’ দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে ওপেন করল মেসেজ। মেসেজে লেখা কথায় চক্ষু সঙ্গে সঙ্গেই চড়কগাছ হলো তার। আঁখি দুটো সরাতে পারল না ফোন থেকে। মেসেজটি ছিল, “পরেরবার থেকে কাউকে ধন্যবাদ দিতে হলে এভাবে সেজেগুজে ধন্যবাদ দিতে যেও না। সবাই তো আর আহিয়ান স্বচ্ছের মতো ভালো মানুষ নয়। হতে পারে, যাকে ধন্যবাদ দেবে সেই মানুষটা ধন্যবাদের বদলে তোমায় চেয়ে বসল। মানুষটা আমি জন্য বেঁচে গিয়েছ।”
বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার পর চোখ বুঁজে হাসিতে মেতে উঠল সে। মেঘ থেকে বেরিয়ে সূর্যের তেজহীন কিরণ এসে পড়ল তার মুখে। জ্বলজ্বল করে উঠল হাসিখানা তার। এই লাস্যময়ী হাসি বোধহয় ইগো ভর্তি মানুষটার জন্যই ফুটেছে।
মানুষজনের চেঁচামেচি শুনে ধীর পায়ে হাঁটা ধরল মোহ। ওষ্ঠযুগল থেকে হাসি রেখা এখনো দেখা যাচ্ছে। একটা দোকানে থেমে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে টাকা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে মুদির দোকানের দিকে হাঁটা দিলো সে। সামনে দোকানগুলো দেখতে পেতেই প্রথম দোকানে পরিচিত মুখ দেখে চক্ষুদ্বয় স্থির হয় তার। মানুষটির দিকে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলে উঠল,
“মামা! কেমন আছেন?”
হঠাৎ মোহের উপস্থিতি আশা করেন নি সাইফুল সাহেব। তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মলিন হাসলেন।
“এইতো ভালো মোহ মা। তুমি কেমন আছো? তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? দুলাভাই কেমন আছেন? কয়দিন ধরে কিছু কাজের চাপে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
“সবাই ভালো আছে। কিন্তু কীসের কাজের চাপ মামা? আমি যতদূর জানি ফ্যাক্টরিটা আর নেই তাহলে?”
সাইফুল সাহেব নিরস হাসলেন। গম্ভীর গলায় উত্তর করলেন,
“আমার সংসার তো চালাতে হবে নাকি! তাই যতটুকু পেয়েছি তা দিয়ে নতুন কিছু শুরু করার চেষ্টা করছি।”
নিজের মামার এই অযাচিত দুঃখের কথা ভেবেই বুক চিরে যেন তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো মোহের। দোকানী সাইফুলকে এক কেজি ডাল হাতে তুলে দিলেন। সাইফুল সেটা হাতে নিয়ে হাসি মুখে বললেন,
“চলো যেতে যেতে কথা বলি?”
মোহ সম্মতি জানিয়ে মামার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। ভালো মন্দ কথা বলার মাঝে মোহ খেয়াল করল তারা প্রায় বাজারের বাহিরের দিকে চলে এসেছে৷ তৎক্ষনাৎ চলা থেমে গেল মোহের।
“মামা! আর কিছু নেবেন না?”
” না রে মা। আর কী নেব? যা নেওয়ার নিয়ে ফেলেছি।”
মোহের দৃষ্টি পড়ল সাইফুলের ব্যাগের দিকে। চাল, ডাল, তেল আর মশলা ছাড়া তেমন কিছু দেখা যাচ্ছেনা। অথচ মোহ খুব ভালো করে জানে সাইফুল বাজারে এলে সবসময় এত বাজার করত যে পরে তার স্ত্রী আফিয়া বকাবকি করতে থাকেন। সেই মানুষটা এত কম বাজার করল সেটা হজম হলো না মোহের৷ সে সরাসরি বলে বসল,
“টাকাপয়সার কমতি পড়েছে তাই না মামা?”
সাইফুল ভড়কালেন প্রথমে। স্বীকার করতে চাইলেন না। তবে পরক্ষণেই ভাবলেন তার সামনে মোহ দাঁড়িয়ে। যে সত্যি কথা না শোনা অবধি দম নেওয়ার মেয়ে নয়। তাই সহজ গলায় স্বীকারোক্তি দিলেন উনি।
“কী করব বলো! হাতে যা পুঁজি ছিল সেটা নতুন ব্যবসায় লাগাতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে হাতে বেশি টাকা আসছে না। আমি যে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছি।”
মোহ মামার অসহায় এই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না বেশিক্ষণ। দৃষ্টি নামিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ভেতরে এক অদম্য সাহস জুগিয়ে উঠল একটু একটু করে। ফট করে বলে ফেলল,
“যার কারণে এত অসহায়ত্ব তাকে তো তার জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, মামা।”
সাইফুল চকিতে তাকালেন। মোহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাস্তায় নিবদ্ধ। মনে মনে কাউকে চরমভাবে গ্রাস করছে সে। সাইফুল আমতা আমতা করে বললেন,
“মোহ তুমি…”
“মোহ হার মানে নি। শুধু অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার। যাতে সেই শান্ত পরিস্থিতিতে সে আবার ঝড় তুলতে পারে। আমাদের জীবনে তো ওই মন্ত্রী সাহেব অনেক ঝড় তুলেছে। এবার তার আ;ঘা/ত তার দিকেই ফিরিয়ে দেওয়ার সর্বস্ব প্রচেষ্টা করব আমি। আমার বাবাকে বিনা আ;ঘাতে যেভাবে ভেতর থেকে মা/রার চেষ্টা করেছে তাকে আমি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নেই। আমি এতটাও দয়ালু নারী নই।”
মোহের কণ্ঠে স্পষ্ট জেদ। সাইফুল সাহেব বিলম্ব না করে বললেন,
“মোহ! আমার মনে হয় সবখানে সব বিষয় নিয়ে জেদ দেখিয়ে লাভ নেই। হিতে বিপরীত হতে সময় লাগবে না। বুঝতে হবে, আমাদের বিপরীতে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনি মন্ত্রী। আমরা আমজনতা। আমার মনে হয়, ভালো এটাই হবে আগের সব ভুলে নতুন করে শুরু করা। ভুলতে হবে আমাদের জীবনে এই খারাপ দিন এসেছিল।”
মোহ জবাব দিলো না। কর্ণপাত করল শুধু। মোহের মৌনতা দেখে সাইফুল সাহেব ভেবে বসলেন মেয়েটা হয়ত উনার কথা বুঝেছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
“এখন ভীষণ রোদ। বেশি সময় বাহিরে থেকো না। অটো ডেকে দিই। বাড়ি যাও।”
মোহ কথা ব্যতীত মাথা ঝাঁকাল শুধু। অবশেষে তাকে অটোতে তুলে দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করলেন সাইফুল সাহেব।
বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে খানিকটা। অতঃপর স্মরণে এলো বাহিরে সে একটি সাদা গাড়িও দেখেছে। অদম্য কৌতূহল ও সামান্য ভীতি নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে মোহ। বসার ঘরে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মোহ খুঁজে পেল সোফায় বসারত ব্যক্তিটিকে।
চলবে…#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩
“আপনি আমার বাড়িতে?”
অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে প্রতাপ নিয়ে সোফায় বসারত সরোয়ার সাহেবের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করে বসল মোহ। সরোয়ার সাহেব কিছুটা সময় চুপ করে রইলেন। যেন মোহের প্রশ্ন উনার কানে আসেনি। অপরদিকে বিষয়টি জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে মোহ। সরোয়ার সাহেব এবার গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন,
“বড়োদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই কায়দাও তোমায় তোমার মা-বাবা শেখায় নি? মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির এই এক সমস্যা! মা-বাবা এটাও শিখিয়ে দেয়না যে বড়োদের কীভাবে সম্মান করতে হয়।”
মোহ অনড় হয়ে কঠোর জবাব দিল তৎক্ষনাৎ,
“শিখিয়েছে তো অবশ্যই। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার বাবার মতো শিক্ষা আপনি সন্তানদের কখনোই দিতে পারবেন না। কিন্তু সম্মান জিনিসটা মন থেকে আসে, মন্ত্রী সাহেব।”
মোহের একেকটা জবাব যেন ধারা/লো অ/স্ত্রের ন্যায় বিঁধল সরোয়ার সাহেবের গায়ে। তবে তিনি প্রকাশ করলেন না। মেয়ের এমন কাঠকাঠ কথাবার্তায় মিসেস সুফিয়া দ্রুত কাছে এসে মেয়ের হাতের বাহু চেপে ধরে দৃষ্টি দিয়ে ধ/মক দিলেন মেয়েকে। মায়ের দৃষ্টির ইশারা বুঝে নিজেকে খানিকটা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল মোহ। তবে সরোয়ার সাহেব এবার বললেন,
“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ। এসে শুনলাম তুমি বাহিরে গিয়েছ। তাই ভাবলাম এসেছি যখন দেখা করেই যাই।”
“হঠাৎ আমার জন্য এত প্রতিক্ষা? এবার কি আমাকে জেলে বা ফাঁ/সিতে ঝুলানোর প্ল্যানিং আছে?”
সরোয়ার সাহেব বিস্তর হাসলেন এবার। অতঃপরই মুখটা ভার করে বললেন,
“তুমি কি জানো আমার একটা অর্ডারে শুধু তুমি কেন তোমার পুরো বংশের খোঁজ পাওয়া যাবে না? কিন্তু এমনটা করব না আমি। সামনে ইলেকশন। আমি চাইনা তোমার মতো এত তুচ্ছ একটা মেয়ের জন্য আমার ইলেকশনে কোনো সমস্যা তৈরি হোক।”
“তাহলে এই তুচ্ছ মেয়ের বাড়িতে প্রবেশ করার কারণ কী?”
“কারণ একটাই। আমার ছেলে।”
সরোয়ার সাহেবের সহজ উত্তর। তবে এই উত্তরের মানেটা ঠিক বোধগম্য হলো না মোহের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল তার। ভাবুক হয়ে উঠল বেশ।
“মানে? ঠিক বুঝলাম না।”
“বোঝাচ্ছি তোমাকে। আজকাল একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি আমার ছেলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছ। আমি তোমাকে আমার ছেলের আশেপাশে দেখতে চাইনা।”
সরোয়ার সাহেবের কথায় কিছুটা সময় থম মে/রে দাঁড়িয়ে রইল মোহ। বেশ মনোযোগ দিয়ে বিস্ময়ের সাথে দেখতে লাগল তার সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে। এই মানুষটির ছেলের প্রাণ বাঁচাতে সে সাহায্য করেছিল। কিছু না হলেও হয়ত সামান্য ধন্যবাদ প্রাপ্য ছিল মোহের। কিন্তু উল্টে যেন নিজেই দো/ষী সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে মোহ। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে মোহ বলতে শুরু করল,
“আমি কোনোকালেই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার ছেলের সামনে যাইনি। পরিস্থিতি আমাকে টেনেছে। যেমন উনার এক্সি/ডেন্টের পরেও আমাকেই সাহায্য করতে হয়েছে।”
সরোয়ার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ভঙ্গিতে বললেন,
“এসব বাহানা আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। তোমার শ্রেণির মেয়েদের আমি হারে হারে চিনি। কিন্তু মনে রাখবে, আমার ছেলেকে আমি ফাঁসতে দিচ্ছি না। তোমার সামনে আমি দাঁড়িয়ে। দূরে থাকো স্বচ্ছের থেকে।”
সরোয়ার সাহেবের কথার মানে বুঝে সমস্ত শরীর যেন রি রি করে উঠল মোহের। নিজের ক্রোধ সামলে ওঠা গেল না আর। তাচ্ছিল্যের সহিত বলল,
“কৃতজ্ঞতা নামক শব্দ যেন আপনার সম্পূর্ণ জীবনেই নেই। জেনে রাখা ভালো, কৃতজ্ঞ হলে কেউ ছোটো হয়ে যায় না। আপনার ছেলেকে ফাঁসাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
মোহের কণ্ঠ শুনে ঘর থেকে দৌড়ে এলো ইথান। হুড়মুড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সহিত বলতে লাগে,
“মাম্মা এসেছে! মাম্মা এসেছে!”
ইথান এবং তার কথা শুনে উৎসুক হলেন সারোয়ার সাহেব। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ছোট্ট ইথানের দিকে। আরেকবার তাকালেন মোহের দিকে। মোহ চুপচাপ ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে থাকতে পারলেন না সরোয়ার সাহেব৷ প্রশ্ন করে ফেলেন,
“তোমার ছেলে?”
মোহ সহজ কণ্ঠে বলল,
“জি। ও আমার ছেলে। কেন? কোনো সমস্যা?”
“সমস্যা তো একাই৷ তুমি সন্তানের মা। কী করে ভাবো একটা সন্তানের মা হয়ে আমার ছেলেকে ফাঁসানোর কথা? দেখো, সহজভাবে বোঝাই! আমি তোমার বাড়িতে এসেছি শান্তভাবে কথা বলতে। আমি শুধু চাই স্বচ্ছকে ওর মতো ছেড়ে দাও। ওর ত্রিসীমানায় আমি তোমার ছায়া দেখতে চাইনা। আমার সহজ কথা!”
মোহ আরো কিছু বলতে চাইলেও এবার মুখ খুললেন আজহার সাহেব। অতি শান্ত গলায় বললেন,
“মন্ত্রী সাহেব, আপনি তো অনেক কথাই বললেন! এবার না আমি কিছু কথা বলি৷ আপনি প্রথমেই আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমার মেয়েকে আমি সর্বদা স্পষ্টভাষী হিসেবে গড়ে তুলেছি। আপনি যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করছেন। সেসব আমার মেয়ের চরিত্রে নেই৷ আপনার ছেলে আপনার কাছে যতটা দামী। আমরা গরীব হলেও আমার মেয়ে আমার কাছে ততটাই দামী। মোহ চাইলেও কখনো আপনার পরিবারের মতো একটা অগোছালো, শৃঙ্খলা বিহীন পরিবারের সদস্য হতে দেব না। আর মোহের শিক্ষাতেও এসব নেই।”
সরোয়ার সাহেব এবার এমনভাবে হাসলেন যেন আজহার সাহেব কোনো মজার কথা বলে ফেলেছেন। এবার সরোয়ার সাহেব ভার গলায় বললেন,
“এইযে এতসব লেকচার দিলেন। এটা সব মেয়ের বাবাই দেয়। কিন্তু শেষমেশ তাদের মেয়ে একই তালিকায় নাম লেখায়। আমার ধৈর্য শক্তির পরীক্ষা নেবেন না দয়া করে। আমি শেষবারের মতো বলছি, যদি আপনার মেয়েকে সত্যিই সামান্যতম শিক্ষা দিয়ে থাকেন আমার ছেলের পেছনে পড়তে দেবেন না।”
নিজের বাবার শিক্ষায় আঙ্গুল তোলার যন্ত্র/ণায় বাকরুদ্ধ হয়ে চোখ বুজল মোহ। মাঝে মিসেস সুফিয়া কঠিন গলায় বলে উঠলেন,
“ও যাবে না আপনার ছেলের কাছে। ও কখনো আর স্বচ্ছের সাথে যোগাযোগ রাখবে না। বিষয়টা আমি দেখব।”
মোহের মায়ের কথায় আজহার সাহেব এবং মোহ দুজনের চোখ বড়ো হয়ে এলো। পরক্ষণেই নিস্তেহ হলো মোহ। মা হিসেবে তার মা যা করছে ঠিকই করছে সেটাই উপলব্ধ হলো তার৷ সরোয়ার সাহেব আলতো হাসলেন। নরম সুরে বললেন,
“আপনি তো ওর মা। আশা করছি আপনি কথাটা রাখবেন। এতেই আপনার সহ আপনার পরিবারের
সবার মঙ্গল।”
আর বিলম্ব করলেন না সরোয়ার সাহেব। আস্তে-ধীরে সোফা থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন সদর দরজা দিয়ে। উনার প্রস্থানের সাথে সাথে আজহার সাহেব মিসেস সুফিয়াকে গম্ভীর গলায় ধমক দিলেন।
“তুমি ওই লোকটার কথায় সায় জানিয়ে আমার মেয়েকে ছোটো করলে মোহের মা?”
মিসেস সুফিয়া নেত্রপল্লব বড়ো বড়ো করে ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন,
“তো কী করব? তোমাদের বাপ-মেয়ের এই বেশি বেশি কাণ্ড দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। যদি পরিবারটাকে বাঁচাতে চাও তাহলে আমার সাথে সায় দাও। মোহকে বড়ো দেখানো প্রয়োজন নাকি মোহের প্রাণ? ওই লোকটার ক্ষমতার আন্দাজ করতে পারো তুমি? আমার কাছে আমার মেয়ের জন্য যা ভালো মনে হয়েছে তাই করেছি। এ নিয়ে আমি কারোর মতবাদ শুনতে চাইনা।”
আর কারোর কথাবার্তা না শুনে হনহনিয়ে নিজ ঘরে চলে গেলেন মিসেস সুফিয়া। এতসব কাণ্ড দেখে ইথান খানিকটা অবাক হয়েই মাকে সরল মনে প্রশ্ন করে,
“নানুমনি রেগে গেল কেন মাম্মা?”
মোহ নিজেকে ধাতস্থ করে ছেলের জন্য হাসি ফুটিয়ে স্নেহের সহিত কোলে তুলে নিলো।
“কিছু না বাবু। আমি ভুল কাজ করেছি তাই রাগ করেছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাহলে তো তোমার সরি বলা উচিত নানুমনিকে।”
“হ্যাঁ বলব তো। খেয়েছ কিছু? দেখে তো মনে হচ্ছে না খেয়েছ। চলো খাইয়ে দিই।”
নিজেকে ব্যস্ত করতে ইথানকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ধাবিত হলো মোহ।
আজকের সকালের ঘুমটা এক অন্যরকম স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ভাঙল মোহের। স্বপ্নে দেখেছিল সে আজ সেই ধূসর এবং গভীর স্বচ্ছ সমুদ্রের ন্যায় লোচনের চোখজোড়ার মালিক স্বচ্ছকে। ওই মানুষটার চোখের অভ্যন্তরে আছে যেন গ্রাস করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই ভয়ে তার চোখে চোখ রাখেনা মোহ। যদি সেই গ্রাস গহ্বরে ডুবে যায়? যদি বাঁচিয়ে নিতে না পারে নিজেকে? তাহলে যে সারাজীবন সেখানে ডুবে থাকতে হবে। সাংঘাতিক সেই চোখজোড়ার মালিক যে ইনজেকশন দেখে ভয় পাবে সেটা ভাবনার বাহিরে ছিল মোহের। সেই ভীতু চেহারা স্বপ্নে দেখেছে ভেবেই হেসে ফেলে সে আনমনে। চোখ কচলাতে কচলাতে একা একা কথা আওড়াতে থাকে।
“এত বড়ো একটা লোক নাকি ইনজেকশনেও ভয় পায়!”
কথাগুলো নিজে নিজে বলা মাত্র মুখটা চুপসে গেল তখনি। নিজের প্রতি অজস্র ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তার। গতকালকেই এই মানুষটা তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আর আজকেই কিনা তার কথা মনে করে হাসছে? কথাটা ভাবলেই চোখমুখ শুঁকিয়ে যায় ওর। তৎক্ষনাৎ শুনতে পায় মায়ের প্রশ্ন।
“কোন লোক ইনজেকশনে ভয় পায়?”
মোহ থতমত খেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। পুরোনো ওয়ারড্রব থেকে মোহের সমস্ত জামাকাপর ব্যাগে তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত মিসেস সুফিয়া। সেই সঙ্গে তুলে নিচ্ছেন ইথানেরও জামাকাপড়। মোহ কোনোরকমে উত্তর দিলো,
“স্বপ্ন দেখছিলাম মা। কিন্তু তুমি কী করছ? আমার আর ইথানের জামাকাপড় ব্যাগে তুলছ কেন?”
“জামাকাপড় কখন ব্যাগে গোছায়?”
“কোথাও যাওয়ার জন্য। আমরা সবাই কোথাও যাচ্ছি নাকি?”
মোহের প্রশ্নে মিসেস সুফিয়া গম্ভীর উত্তর করলেন,
“আমরা সবাই না তুই আর ইথান যাচ্ছিস গ্রামের বাড়ি।”
মোহ আশ্চর্য হয়ে শুধায়,
“কিন্তু কেন?”
“কারণটা তুই নিজেই মোহ। আমি চাইনা তুই স্বচ্ছের সাথে যোগাযোগ কর। এখানে থাকলে কে বলতে পারে ওই ছেলেটার সঙ্গে আবার যদি দেখা হয়ে যায়। তাই কালকেই তোর জন্য বাসের টিকিট কেটে এনেছিলাম। আমি আর তোর বাবাও যেতাম। কিন্তু তোর বাবার তো চাকরি আছে। কিন্তু আমরাও তোর মামার বাড়ি যাচ্ছি। তোর মামি টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মিনি স্ট্রোক করেছে৷”
“তাহলে আমিও যাই তোমাদের সাথে। গ্রামের বাড়ি কেন পাঠাচ্ছো? আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই?”
“এই মুহূর্তে ভরসা করতে পারছি না মোহ। তুই গ্রামের বাড়ি যাবি এটাই আমার শেষ কথা। আর তোর ফোনটা কোথায়?”
মিসেস সুফিয়া আশেপাশে তাকিয়ে বিছানায় বালিশের পাশে ফোন দেখতে পেয়ে দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে নিলেন। মায়ের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে মোহ এবার বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এবার ফোনটা কী করবে?”
“এটা আমার কাছে থাকবে। তুই গ্রামে পৌঁছানোর খবর আমি পাশের বাড়ির মামার কাছ থেকে নিয়ে নেব।”
মায়ের আচরণে এবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠল মোহ৷ তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তেতে উঠে বলল,
“আমি ক্লাস নাইন টেনের কোনো ছোটো মেয়ে না মা। যে আমার থেকে ফোন কেঁড়ে নিচ্ছো। আর এমন অদ্ভুত আচরণ করছ। এসব বিরক্ত লাগছে আমার।”
“লাগবেই তো তোর বিরক্ত। আমি তোর ভালো ভাবতে গেলেই বিরক্ত লাগে। স্বচ্ছের প্রতি তোর আচরণও আমার ঠিক লাগছে না। তাই এই ব্যবস্থা আমার গ্রহণ করতে হচ্ছে।”
“তুমি আমাকে সন্দেহ করছ মা? তুমি ভুলে যাচ্ছো যার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করার জন্য তুমি এসব আচরণ শুরু করেছ তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ করছিলে?”
মেয়ের কড়া গলায় বলা কথার উত্তরে মিসেস সুফিয়া জোর গলায় বলেন,
“ভুল করেছিলাম আমি, মোহ। এত কঠিন পরিস্থিতি হবে জানতাম না। তুই আমার কথাটা রাখ। এর আগেও তুই আমাকে বলেছিলি তুই এসব ঝামেলায় জড়াবি না। কিন্তু তুই কথা রাখিস নি। এবার অন্তত রাখ কথাটা। ফ্রেশ হয়ে নে। খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে নে। বেশিদিন থাকতে হবে না। অন্তত এদিকের পরিস্থিতি ঠিক হওয়া অবধি অপেক্ষা কর। কাল ওই লোক এসে তোর বাবার দেওয়া শিক্ষাকে ছোটো করে গেছে। এরপর আরো না জানি কত অপবাদ দেবে। আশা করি তুই বুঝতে পারছিস আমার কথা৷ যা ফ্রেশ হয়ে নে।”
মায়ের কথায় এবার নিশ্চুপ রইল মোহ। ভেবে দেখল, মায়ের অনেক কথাই ঠিক। মিসেস সুফিয়া চলে গেলেন রান্নার উদ্দেশ্যে। মোহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে স্থির করল মায়ের কথা রাখার।
সকাল এগারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ইথানকে কোলে নিয়ে বাসের সিটে বসল মোহ। অস্থির মনকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করল সে। এই অস্থিরতা কোন কারণে সেটা তার নিজেরও জানা নেই। অন্যদিকে চটপটে ইথানও শান্ত নেই মোটেও। প্রশ্নের শেষ নেই তার।
“মাম্মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“গ্রামের বাড়িতে সোনা!”
“ওইযে, আগের বার গিয়ে ঘুরে এলাম সেখানে?”
“হ্যাঁ।”
ইথান বেজায় খুশি হলো। অনেকদিন ঘুরতে যাওয়া হয়না৷ এবার সে ঘুরতে যাচ্ছে।
জানালার বাহির থেকে চেনা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে চকিতে সেদিকে তাকায় মোহ। হাতে বড়ো বাজারের ব্যাগ ধরে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া। সে ইশারায় মোহকে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
মোহ শোরগোলের মাঝ থেকে কিছুটা চিৎকার করে উত্তরে বলে,
“গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।”
“হঠাৎ গ্রামের বাড়ি? মানে ওই গাজীপুরের গ্রাম? কোনো বিপদ হয়েছে নাকি?”
মোহ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
“বিপদ তো অনেক। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি তোকে! ফিরে এসে সব বলব।”
“ঠিক আছে সাবধানে যাস।”
মোহ তানিয়ার প্রতিত্তোরে মৃদু হাসি দিলেই বাস ধীর গতিতে চলতে শুরু করে। মনে মনে ঠিক করে নেয় এবার থেকে স্বচ্ছ নামটি তার জন্য নিষিদ্ধ। আর কখনো দেখা হবে না তাদের। একথা ভাবতেই কেমন যেন ভার লাগে তার। মন বলে, সত্যিই কি আর দেখা হবে না?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]