যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -২০+২১

##যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০

ঘরের মাঝে থাকা প্রিয় জানালার পাশ ঘেঁষে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে মোহ। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে জট পাকানো মস্তিষ্ক স্বাভাবিক করার পরিচালনা করছে সে। এখনো মাথা থেকে সকালে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়টি সরতে চাইছে না। আঁটকে আছে সেই রাস্তার মোড়েই, সেই ফলের দোকানেই। সেই পরিচিত এবং নি/কৃষ্ট মুখ ভেসে উঠছে বারংবার। মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় বসে আপনমনে খেলতে থাকা ইথানের দিকে দৃষ্টিপাত করল মোহ। ইথানের ছোট্ট মুখটার সাথে সেই মুখটার বিস্তর মিল আছে বলতে হবে। তবে সেই সঙ্গে রয়েছে আকাশপাতাল পার্থক্যও। সেই চেহারায় মোহ খুঁজে পায় নিকৃ/ষ্টতা এবং ভয়া/বহতা এবং ইথানের ছোট্ট চেহারায় খুঁজে পাওয়া যায় সুবিশাল মায়া।

সকল ভাবনার অন্ত ঘটলো আজহার সাহেবের ডাকে। বাবার এমন অস্থির হাক পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল মোহ। বিচলিত মনে বাহিরে এসে আজহার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”

আজহার সাহেব মৃদু হেসে শান্ত গলায় বললেন,
“না, না। কে আবার নতুন করে কী বলবে!”

মিসেস সুফিয়াও রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন বসার ঘরে। আজহার সাহেবের কথা শুনে তিনি ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন,
“তো এভাবে ডাক দাও কেন? ভালো করে ডাকা যায় না? যেভাবে মেয়েটাকে ডাকছিলে আমারই তো অন্তর কেঁপে উঠেছিল।”

“এখনই তোমার এই অবস্থা! আমি এখন যা বলব তা শুনে তারপর কী হবে বলো?”

মিসেস সুফিয়া এবং মোহ দুজনেই খানিকটা বিস্মিত হলো আজহার সাহেবের এমন হেয়ালিতে। মোহ উৎসুক হয়ে শুধাল,
“কী হয়েছে বাবা?”

“স্বচ্ছ এসেছিল আমার স্কুলে।”

স্বচ্ছের নাম শুনেই ভেতর থেকে বাহির অবধি এক আতঙ্কের শিহরণ বইলো মোহের। মানুষটাই এমন যার নাম শুনে মাথায় ঝামেলা শব্দটি ছাড়া অন্য কিছু আসে না। মোহ কম্পিত গলায় আবারও জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”

“স্কুলে এসে ও যা কাণ্ড করল! আমাদের ভাবনার বাহিরে এসব। সকলের সামনে অডিটোরিয়ামে আমাকে নির্দোষ বলেছে সে। শুধু তাই নয় নিজে থেকে বাবার হয়ে ক্ষমা চেয়েছে ছেলেটা। ছেলেটার কাণ্ডে আমি হতভম্ব।”

“উনি ওই হাতেপায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে তোমার স্কুলে গিয়ে এই কাণ্ড করে এসেছে?”

মোহের মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথায় চকিতে তাকালেন মিসেস সুফিয়া। মোহের দেরিতে বোধগম্য হলো তার একথা বলা উচিত হয়নি। মিসেস সুফিয়া দেরি না করে কঠোর গলায় প্রশ্ন করলেন,
“তুই কীভাবে জানলি ওই ছেলের হাতেপায়ে ব্যান্ডেজ?”

মোহ প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইল।
“আসলে মা…”

“কথা ঘুরাবি না। সত্যি বল।”

“আহ! মেয়েটাকে সবসময় এমন জেরা করো কেন সুফিয়া?”

আজহার সাহেবের কথায় মিসেস সুফিয়া চোখ গরম করে তাকালেও মোহ এবার বাধ্য মেয়ের ন্যায় সত্যি বলার সিদ্ধান্ত নিলো।
“মা, সেদিন যে ইথানের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে মার্কেটে যেতে চেয়েছিলাম আর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন আমি ওদিকে যেতেই পারিনি। স্বচ্ছ এক্সি/ডেন্ট করেছিলেন। আর সাহায্য করার কেউ ছিল না। আমি উপায় না পেয়ে উনাকে হাসপাতাল অবধি নিয়ে যাই। তুমি যদি রাগ করো তাই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলাম। সরি, মা।”

আজহার সাহেবও নিজের স্ত্রীকে কিছু বলতে না দিয়ে তালে তাল মিলিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ ঠিকই আছে। আমার মা যা করেছে ঠিকই তো করেছে, মোহের মা। কেন শুধু শুধু রাগছ!”

“হ্যাঁ আমি তো শুধু শুধুই রাগি। তোমরাই সব ঠিক কাজ করো। আমি যা করি সব ভুল।”

ক্রোধ ঝেড়ে কথাটা বলে গটগট করে রান্নাঘরে চলে গেলেন মিসেস সুফিয়া। উনার কাণ্ডে বাবা-মেয়ে চোখাচোখি করল। তারপর মিটমিটিয়ে হাসল।
“তোমার মা রাগারাগি করলেও আমি তোমার উপর রাগটা দেখাতে পারছি না। স্বচ্ছ আজ যে কাণ্ড করল সে কাণ্ডে আমার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত আমি বুঝতে পারছি না। তবে আজকে ওর যা করেছে তা দেখে মনে হয়েছে ও মন থেকে আমাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছে। ক্ষমা চেয়েছে মন থেকে তাও ওর বাবার হয়ে। অন্যায়টা আদেও ও করেনি। অনুতপ্ত হয়েছে বাবার তরফ থেকে। আমার সম্মান খানিকটা ফেরানোর চেষ্টা করেছে। আমি তাতে অস্বস্তিতে পড়লেও পরবর্তীতে মনে হয়েছে সে একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। যেটা আমি তখন লজ্জায় পড়ে দিতে পারিনি।”

মোহাবিষ্ট হয়ে কথাগুলো শুনছিল মোহ। স্বচ্ছ নামক পুরুষটির কথা এই মুহূর্তে মুগ্ধ হয়েই শুনতে ইচ্ছে করছে তার। মানুষটা এত কিছু কেন করল জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। তার জায়গায় অন্যকেউ হলেও বুঝি কাজটা তিনি করতেন? যদি করত তাহলে খুশি হবে মোহ। কেননা, সে চায় অনুতপ্ত বোধ সকলের প্রতি একই থাকুক। আজহার সাহেব আরো বলেন,
“হয়ত সে আমার সম্পূর্ণ সম্মান ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবেনা। তবে তার এ কাজের পর আমার নামে আর একটাও কটু কথা কানে আসেনি।”

“তাই উনি তোমার কাছ থেকে ধন্যবাদ পান। তাই না বাবা?”

“ঠিক তাই।”

“কাল যাবে আমার সাথে হসপিটালে উনাকে দেখতে?”

মোহের কথায় আজহার সাহেব তৎক্ষনাৎ বারণ করে দিলেন,
“না, না। আমার সময় হবে না। স্কুলে যেতে হয় ওই সময়। তাছাড়া সবথেকে বড়ো কথা অস্বস্তির ব্যাপার আছে একটা। তাই বলছিলাম যে মোহ মা তুমি এই কাজটা আমার হয়ে করে দিলে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম।”

মোহ তার বাবার কথায় অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“বাবা তুমি কী বলছ বলো তো! আমি কাল যাব উনাকে ধন্যবাদ দিতে তুমি না বললেও। এভাবে বলো না।”

আজহার সাহেব একটা মৃদু হাসি দিলেন। তারপর চললেন রান্নাঘরের দিকে। উদ্দেশ্য, স্ত্রীর রাগ ভাঙানো।

মোহ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ছুটে এলো। বড়ো বড়ো শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ-ত্যাগ করে ফোন হাতে নিলো তড়িঘড়ি করে। কললিস্ট থেকে খুঁজে বের করল, ‘স্টোরহাউস ওফ ইগো” নামটি। নিঃসন্দেহে এই নামের ব্যক্তিটি স্বচ্ছ। তবে এই নামটি মোহের কাছে আজ বেমানান লাগল। দ্রুত মানুষটিকে কল দিতে গিয়ে মনে পড়ল সে সেদিনই এক্সি/ডেন্ট করেছিল। তার ফোন হয়ত তার কাছেই নেই। খানিকটা নিরাশ হয়ে ফোনটা আগের স্থানে রাখল মোহ। ইথান দৌড়ে এসে বসল তার কোলে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে উঠল সে। কখন সে পরদিন হবে! কখন সামনাসামনি হবে স্বচ্ছের।

পায়ে অতিরিক্ত চাপ পড়াতে সেখানে টনটনে অসহ্যকর ব্যথা উঠেছে স্বচ্ছের। বালিশে ঠেস দিয়ে চোখ বুঁজে হাতের বাহু কপালে ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছে সে। দরজা খোলার শব্দ পেয়েও খুলল না তার চোখ দুটো। দেখা গেল না ঘোলাটে মণি দুটো। একসময় নিজের লাগা পায়ে হঠাৎ জ্বলে অতিরিক্ত ব্যথা করে উঠল স্বচ্ছের। ছটফটিয়ে উঠে বসল স্বচ্ছ। বুঝতে পারল কেউ তার পায়ে হাত দিয়ে চাপ দিয়েছে। সামনের মানুষটিকে হাসতে দেখে আরো ক্ষেপে গেল সে।
“হোয়াট দ্যা হেল ইয়ার! এমনি আধম/রা হয়ে পড়ে আছি। দেশে ফিরেই আমাকে পুরো মা/রার ট্রাই করছিস?”

আরিদ্র এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। রাগে গজগজ করতে করতে অন্যদিকে তাকাল স্বচ্ছ। আরিদ্র হাসতে হাসতে স্বচ্ছের পাশে বসে তাকে আলিঙ্গন করে বলল,
“আমার জানের প্রাণের ভাইকে মা/রতে পারি বল? আমি শুধু পরীক্ষা করছিলাম এক্সি/ডেন্টের পর তুই কতটা মজবুত আছিস।”

“পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার একটা নড়ে যাওয়া হাড়টা ভেঙে ফেলেছিস মনে হচ্ছে।”

এই কথা বলার পর স্বচ্ছ নিজেও হেসে উঠল এবার। আরিদ্র হোসাইন স্বচ্ছের একমাত্র মামাতো ভাই। যার জীবনের বিগত পাঁচ বছর কেটেছে লন্ডন শহরে। আজ হঠাৎ তার আগমনে খানিকটা অবাক হয়েছে স্বচ্ছ। আরিদ্র স্বচ্ছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল আরেকবার। তারপর প্রশ্ন করল,
“তারপর বল! এমন আধম/রা অবস্থা কী করে হলো তোর?”

“বাইক এক্সি/ডেন্ট! আর কী? যাই হোক, হঠাৎ তোর দেশের কথা মনে পড়ল কী করে?”

আরিদ্র মাথা নাড়ায়। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে,
“দেশ না রে, দেশ না। ব্যাপারটা হচ্ছে বিয়ের। মায়ের ডাক পড়ল বিয়ের জন্য। তাই চলে এলাম।”

“ওহ তাই বল। তাও ভালো। আমি তো ভেবেছিলাম তুই বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাবি।”

স্বচ্ছের কথায় আরিদ্র রসিকতা করে বলল,
“আরে ধুর। দেশী মেয়ের মাঝে যা আছে সেটা পুরো পৃথিবীর মেয়ের মাঝেও পাওয়া যাবে নাকি!”

স্বচ্ছ হালকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি ওসব বুঝিনা। তুই-ই ভালো জানিস।”

“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তুই তো কখনো টেস্ট করিস নি। আমি তো করেছি নাকি! সব জেনেই বলছি কথাটা।”

স্বচ্ছ আরিদ্রের হাতে চাপড় মে;রে বলল,
“তুই এখনো ভালো হলি না।”

চলবে…

বি.দ্র. অজস্র ক্লান্তি নিয়ে এর চেয়ে বেশি লিখতে পারিনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১

“আরে আরিদ্র ভাই! কী চমক দেখালে! সোজা লন্ডন থেকে দেশে আবির্ভাব ঘটল তোমার কীসের চক্করে?”

সৌমিত্রের বিস্ফো/রিত কন্ঠ। বাহিরে থেকে ভাইয়ের কেবিনে ফিরেই আরিদ্রকে দেখে নেত্রপল্লব হয়েছে বড়ো বড়ো। আরিদ্রও সৌমিত্রকে দেখে এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করে হেসে বলল,
“বিয়ের চক্কর, ব্রাদার।”

“এট লাস্ট বিয়ে করছ তবে?”

“একদমই না। বিয়ে জিনিসটা খুবই ঝামেলার। সবদিক থেকে অসুবিধার। বউ ঘরে আসলে সারাজীবন ওই একটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বাকিদের দিকে চোখ তুলে তাকালেও বউ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। আবার যদি পরকীয়া করতে যাই তাতেও ধরা পড়ে গেলে কেস টেস খেয়ে বসে থাকতে হবে। শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি।”

সৌমিত্র নির্বিঘ্নে হেসে প্রশ্ন করল,
“তাহলে কী চিন্তা করছ?”

“দেখি মাকে ম্যানেজ করা যায় কিনা। তারপর দেশের মধ্যেই একটা লম্বা ট্রিপ দেব তোদের নিয়ে।”

স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ আরিদ্রকে সূক্ষ্ণ খোঁচা দিয়ে বলল,
“ওই কথা শুধু তোর মুখেই থাকবে। বলিসই আমাদের নিয়ে ট্রিপে যাবি। কিন্তু শেষে দেখি তোর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে তুই হাওয়া।”

আরিদ্র ঠোঁট চেপে হাসতে থাকল। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে সৌমিত্রকে শুধালো,
“তা তোর বড়ো ভাইয়ের এই অবস্থা হলোটা কী করে সৌমিত্র?”

সৌমিত্রের মাথায় বরাবরের মতো ফাইজলামি চলতে থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। সে ঠোঁট কামড়ে বলল,
“মেয়ে নিয়ে কেস!”

আরিদ্র চক্ষুদ্বয় কপালে উঠিয়ে বলল,
“বলিস কী! আমার হাওয়া ওর গায়ে লাগল কী করে?”

“আরে এটা অন্য হাওয়া।”

আরিদ্র আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,
“কেসটা কী?”

সৌমিত্র ফট করে বলে দিলো,
“লাভ কেস।”

মুখের কথা শেষ হওয়া মাত্র স্বচ্ছ তার কাছে থাকা বালিশটি ছুঁড়ে মারল সৌমিত্রের দিকে। খুব কৌশলের সাথে ধরে ফেলল সৌমিত্র। স্বচ্ছ চোখমুখ লাল করে বলল,
“আরিদ্র মোটেও ওর কথা বিশ্বাস করবি না। সবসময় আমাকে ঝামেলায় ফেলার মতলবে থাকে। বাবার সাথে ঝামেলা হয়ে মেজাজ খারাপ ছিল আমার। সেইসময় বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ এক্সি/ডেন্ট!”

আরিদ্র কথাটা শোনার পর স্বচ্ছের পানে অপ্রতিভ হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকটা সময়। অতঃপর তার নিকটে এসে বসল। আড্ডায় মেতে উঠল তিন ভাই।

মেঘলা সকালে হঠাৎ করে সাজগোজ করার তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠল মোহের মনে। ইচ্ছে করল নিজেকে একটু গুছিয়ে কারোর সামনে তুলে ধরতে। মন চাইল ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক মেখে সেই ঠোঁটের হাসি দিয়ে কাউকে ভোলাতে। যার জন্য এই সুপ্ত বাসনা সেই মানুষটির নাম স্বচ্ছ। না চাইতেও অবাধ্য মন সকল কঠোরতার বাঁধ ভেঙে কোমল নারী হয়ে উঠতে মন চাইল মোহের। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখল না সে। নিজের পছন্দের নীল রঙের সুন্দর জামা পরিধান করে বসে পড়ল আয়নার সামনে। নিজের কোঁকড়া চুলের বেণি না করে তা ছেড়ে দেওয়ার সময় ভাবল, স্বচ্ছ তাকে আবার মঞ্জুলিকা উপাধি দেবে না তো? পরক্ষণেই খোলা চুল রেখেই ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক মেখে চোখের নিচে ঘন কাজল ভর্তি করে ফেলল। চুড়ি পরতে গিয়ে দেখল সেই নীল রঙের চুড়ির বেশ কয়টাই ভেঙে পড়ে আছে। মুখটা সামান্য ভার হলো তার। তৈরি হওয়া শেষে পাশ ফিরে দেখল ইথান ঘুম থেকে উঠে বসে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকেই। মোহ অমায়িক হাসি দিয়ে নম্র গলায় প্রশ্ন করল,
“গুড মর্নিং বাবাই। কী দেখো এভাবে?”

“তোমাকে। কতদিন পর এত সুন্দর করে সাজলে। অনেক সুন্দর লাগছে। আমি তো ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি।”

ইথানের পাকা কথা শুনে বড়ো বড়ো চোখ পাকালো মোহ। উৎসুক হয়ে বলল,
“ক্রাশ মানে কী জানো তুমি?”

ইথান নিজের ছোটো ছোটো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,
“হ্যাঁ জানি তো। কাউকে পছন্দ হয়ে গেলে তাকে ক্রাশ বলে।”

মোহ বিস্মিত হলো ছোটো ছেলের কথা শুনে। রাগান্বিত হবার ভান ধরে বলল,
“পাকা হয়ে গেছো না খুব? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”

“তা তো যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছো এত সাজুগুজু করে? বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে?”

মোহের চক্ষু এবার চড়কগাছ।
“বয়ফ্রেন্ড কী সেটাও জানো তুমি?”

ইথান কিটকিট করে হেসে বলল,
“হু জানি তো। বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, ক্রাশ সব জানি।”

মোহ এবার ধমকে বলে উঠল,
“তবে রে! বেশি পেকে গেছো তাই না…”

মোহের কথা শেষ হতে না হতেই ইথান দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। মোহ না পেরে হেসে দিলো এবার। আয়নায় দেখল নিজেকে। তারপর হাতের ফোন আর ঘাড়ে ব্যাগ তুলে নিলো।

“মা আমি আসছি। ইথানের খেয়াল রেখো একটু।”

কথাটা বলে সদর দরজা খুলতেই পথ আগলে দাঁড়ালেন মিসেস সুফিয়া।
“কই যাস?”

মোহ ভ্যাবাচেকা খেলো মায়ের আচরণে। নিজেকে ধাতস্থ করে বাধ্য মেয়ের মতো বলে,
“কাল বাবা বলেছিল মি. স্বচ্ছকে একটা ধন্যবাদ দিতে অন্তত।”

মিসেস সুফিয়া এবার অনুসন্ধানী চোখে মোহকে পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে নিলেন।
“সামান্য ধন্যবাদ দিতে তোকে এত সাজতে হচ্ছে? কই আগে তো এভাবে সেজে বের হস নি।”

মোহ খানিকটা বিরক্ত হলো। সেই সঙ্গে অস্বস্তিতেও পড়ল কিছুটা। বলল,
“মা! তুমিই তো সবসময় বলো একটু পরিপাটি হয়ে থাকতে। আজ যেই একটু সেজে বের হলাম তখন তোমার টিপিক্যাল মা জাতির মতো সন্দেহ শুরু হয়ে গেল?”

মিসেস সুফিয়া মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
“মায়েদের চিন্তা কেমন হয় মেয়েদের নিয়ে সেসব তুই বুঝবি না।”

“এত বুঝতে হবে না। আমি যাচ্ছি।”

মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এলো মোহ।

সৌমিত্র আর স্বচ্ছ বসে আছে কেবিনে। আজই স্বচ্ছকে ডিসচার্জ করে দেওয়ার কথা। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। তাদের দুজনেরই দৃষ্টি গেল সেদিকে। দরজা আলতো ফাঁক করতেই নীল রঙা জামা পরিহিত নারীকে দেখে ঘোলাটে চোখ দুটো স্থির হলো স্বচ্ছের। মোহের লাজুক ভাবটা হঠাৎ আজকে আঁকড়ে ধরল স্বচ্ছের হৃদয়। খিঁচে ধরল যেন বুকের ভেতর কিছু। কানে বাজল মোহের রিনরিনে কণ্ঠস্বর।
“আমি আসতে পারি?”

সৌমিত্র বরাবরের মতো মজার ছলে মোহের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিনয়ী সুরে বলল,
“আসতে অনুমতি কেন নিতে হবে ম্যাডাম? আমার ভাইয়ের জান তো আপনারই হাতে।”

থতমত খেয়ে গেল মোহ। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“মানে?”

সৌমিত্র দাঁত কেলিয়ে বলল,
“মানে ভাইকে তো আপনিই বাঁচিয়েছেন। তাই বললাম। জাস্ট কিডিং। মাইন্ড করবেন না। আসুন, আসুন।”

মোহ সৌমিত্রের পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সৌমিত্র ফের গলা খাঁকারি দিয়ে স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাই, আমি বরং বাহির থেকে ঘুরে আসি। আমার এখানে থাকলে তোমার সমস্যা হতে পারে।”

স্বচ্ছের কপালে ভাঁজ পড়ল কিঞ্চিৎ।
“কীসের সমস্যা?”

“হাড্ডি তো আমি হতে চাইনা ভাই। হলে মাংস হবো। মাংস বানাবে?”

সৌমিত্রের উদ্ভট কথা বুঝতে সময় লাগল স্বচ্ছের। তবে বুঝে ওঠামাত্র নিজের হাতে বালিশ আবার তুলে ধরল সৌমিত্রের দিকে। চিল্লিয়ে বলল,
“অসুস্থ আছি বলে বেঁচে যাচ্ছিস বারবার। সুস্থ হই তোকে নিয়ে হকি খেলব।”

সৌমিত্র শব্দ করে হেসে হাওয়ার বেগে প্রস্থান করে। মোহ বোকার ন্যায় শুনে গেল ভাইয়ের কথোপকথন। সৌমিত্র যাওয়ার পরেই শান্ত হয়ে বালিশে ঠেস লাগিয়ে আয়েশ করে বসে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মোহের দিকে। মনোযোগের সহিত একবার তাকে দেখে নিয়ে ফের চোখ ঘুরিয়ে মাথা নাড়ায় সে। তার অদ্ভুত আচরণে মোহ প্রশ্ন করে,
“এমন করছেন কেন?”

“সত্যি কথা বলব?”

মোহ বাঁকা উত্তর দিলো,
“মিথ্যে কে জানতে চেয়েছে?”

স্বচ্ছ শান্ত গলায় বলল,
“কৃত্রিমতা আমার পছন্দ নয়।”

মোহ কৌতুহলী হয়ে শুধাল,
“কার উদ্দেশ্যে বললেন?”

“হয়ত তোমার।”

মোহের মনটা খানিকটা ভারাক্রান্ত হলো। ভাবল, তাকে বুঝি খারাপ লাগছে? তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ বলে উঠল,
“তবে কৃত্রিমতা কিছু কিছু মানুষের সৌন্দর্য, মাধুর্যতা আটকাই পারেনা। এইযে যেমন তার লাজুক ভাবটা ঢেকে রাখতে পারছে না।”

মোহের মুখে দেখা গেল বিস্ময়ের রেশ। কথাটা যে স্বচ্ছ তার উদ্দেশ্যেই বলেছে সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে মোহ। তার লজ্জার পাল্লা ভারী হতে থাকল আরো। নিজের লাজ ঢাকতে হালকা কেশে সে কণ্ঠস্বর শক্ত করে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে।”

স্বচ্ছ ভ্রু উঁচিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করল মোহের দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে জানতে চাইল,
“কেন? কালকে তোমার বাবার স্কুলে গিয়ে সত্যি স্বীকারোক্তি দিয়েছি তাই?”

মোহ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। স্বচ্ছ খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসি নিয়ে বলল,
“সত্যি যতটাই তিক্ত হোক তা মানতে এবং স্বীকার করতে আমি কখনো পিছুপা হইনা এবং হবোও না। আর বাকি থাকল তোমার ধন্যবাদের কথা। এটা আমার চাইনা। সামান্য ধন্যবাদ দিয়ে আমার স্বীকারোক্তিকে ছোটো করবে না।”

“তবে আপনাকে কীভাবে ধন্যবাদ অর্থাৎ উপকার ফেরত দিতে পারি?”

স্বচ্ছ এবার দৃঢ় শ্বাস নিয়ে মোহের চক্ষুদ্বয়ের পানে চোখ রাখল। মৃদু হেসে বলে উঠল,
“কখনো এই উপকারের বদলে আমি কিছু চেয়ে বসব। সেদিন তোমায় সেটা দিতে হবে।”

চলবে….

[বি.দ্র. নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। সেসব বর্ণনা করে আপনাদের আর বিরক্ত করব না। কারণ সেসব বললেও আপনারা মানবেন না। ভুল ত্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here