যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -১৮+১৯

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

এলোমেলো পায়ে হাসপাতালে প্রবেশ করে মোহ। যেন সে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে পড়েছে তার। এমন অসতর্কতার সাথে চলার কারণে এবার এক মানবের সাথে ধা/ক্কা লেগেই গেল তার। কিছুটা দূরে সরে এসে নিজেকে সামলে মোহ তড়িঘড়ি করে বলল,
“সরি, সরি। খেয়াল করিনি।”

এবার মোহ দেখতে পেল তার সঙ্গে ধা/ক্কা লাগা সেই ব্যক্তিটিকে। গাঢ় নীল পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তিটিকে চিনতে সামান্যতমও ভুল হলো না মোহের। নেত্রপল্লব জুড়ে বিস্ময় ছেয়ে গেল তার।
“আপনি?”

শৌভিক হালকা ভ্রু কুঁচকায়। একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মোহকে। তবেই চিনতে পারে।
“ওহ আপনি! কেমন আছেন? আপনার বাবা কেমন আছেন?”

“জি, ভালো। আপনি সেদিন কোথাও উধাও হয়ে গেলেন কিছু না বলেই! এত বড়ো উপকার করলেন আমার অথচ আমার নামটুকুও আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছেন। আমার বাবাও বারবার আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছিল। আমি তো কিছুই বলতে পারছিলাম না। এমনকি ধন্যবাদ জানানোরও সুযোগ দিলেন না।”

শৌভিক স্বভাবসুলভ হাসল। নরম গলায় উত্তর দিলো,
“ধন্যবাদ দিয়ে আমার এত বড়ো উপকারকে ছোটো করে দেওয়ার দরকার আছে? নেই তো। তাই ধন্যবাদ দিতে আসবেন না প্লিজ। আর সেদিনের এত তাড়াহুড়োর জন্য খুবই দুঃখিত। আমার ছেলেপেলেদের পুলিশ অনেক মে/রেছে তো সেই জন্য তাদের নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আজ তো ওদেরই খোঁজ নিতে এলাম এখানে। আর আমার নাম জানতে চেয়েছিলেন না? আমি শৌভিক মীর। বর্তমানে বাবাকে রাজনীতিতে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আপনি?”

“আমি মোহ আনবীর।”

শৌভিক এবার কী যেন মনে করে খানিকটা অস্থির হয়ে বলল,
“আপনার বাবার গায়েও কি কোনোভাবে পুলিশ হা/ত তুলেছে?”

মোহ দ্রুত জবাবে বলল,
“না না। উনারা বাবাকে কিছু করেন নি।”

শৌভিক স্বস্তি পেল কিছুটা। আগের ন্যায় শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“হাসপাতালে দেখে এই কথাটা মনে হলো আমার।”

“তেমন কিছুই না। আসলে গতকাল সরোয়ার সাহের উনার ছেলে এক্সি/ডেন্ট করেন। উনাকেই দেখতে এসেছি।”

মোহের এই কথাটি শুনে একটু বিভ্রান্ত হয় শৌভিক। সেটা তার মুখশ্রীতেই ফুটে ওঠে। তা আন্দাজ করতে পেরে মোহ ফের বলে,
“আসলে গতকাল আমি উনাকে সাহায্য করি। তাই আজকে দেখতে আসা।”

“ওহ হো! আপনি পারেনও বটে দেখছি। মানতে হবে মন অনেক বড়ো আপনার। যাগগে, খবরটা আমিও শুনেছিলাম। তাহলে এখানে যেহেতু এসেছি তাই তাকে দেখে যেতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন দেখা হয়না এমনিতেই আমাদের।”

মোহ মৃদু হেসে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন।”

মোহ এবং শৌভিক চলতে শুরু করে। উদ্দেশ্য স্বচ্ছকে দেখতে যাওয়া।

একদিনেই একাধারে শুয়ে-বসে থেকে যেন শরীরে জং ধরে গেছে স্বচ্ছের। একহাতে আয়না তুলে নিজের বাম ঠোঁটের পাশে ফোলা এবং লাল জায়গা দেখছে সে। টনটন করে ব্যথা করছে সেখানে। এমন সময় সে উপলব্ধি করল তার কেবিনে কেউ এসেছে। আয়না রেখে দরজার পানে তাকিয়েই যেন চক্ষু জুড়ালো তার। স্বচ্ছ খেয়াল করল সাদা রঙে মোহকে বেশ মানায়। তবে সে ভাবেনি মোহ আজও আসবে। সে বুঝতে পারল তার মন প্রশান্তি লাভ করছে। তবে সেই প্রশান্তি এক নিমিষেই উড়ে গেল কোথায় যেন তার জীবনের সবথেকে অপছন্দের মুখটি দেখে। চোখমুখের ভঙ্গি আপনাআপনি পাল্টে এলো শৌভিককে দেখে। তার এখনো মনে আছে শেষ যখন ভোটের পর তার বাবা ভোট জিতে যায় তখন শৌভিকের কিছু তিক্ত কথায় তার এবং শৌভিকের জটিল কথা কাটাকাটি হয়। আজ শৌভিক এখানে কেন? এই প্রশ্ন যখন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন মোহের মলিন কণ্ঠ কানে পৌঁছায়।
“কেমন আছেন আপনি? শরীরের ব্যথা কমেছে?”

তপ্ত শ্বাস ছাড়ল স্বচ্ছ। বালিশে নিজের শরীর এলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কমেছিল একটু। কিন্তু মনে হচ্ছে আবার বেড়ে যাবে।”

“কথাটা যে তুমি আমাকে মিন করে বললে সেটা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি ব্রাদার। বাট আমার ক্ষমতা এত বেশি নয় যে আহিয়ান স্বচ্ছের শরীরের ব্যথা বাড়াব। আমি জাস্ট জানতে এসেছি আমার প্রতিপক্ষ কেমন আছে!”

কথাটা বলে স্বচ্ছের পাশে আরাম করে বসল শৌভিক। মোহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দুজনের রেষারেষি দেখছে। তার মনে হচ্ছে এমন দুজনের মুখোমুখি হওয়াটা ভুলই হয়ে গিয়েছে। স্বচ্ছ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। যেন পণ করেছে কিছুতেই শৌভিকের মুখটা দেখবে না। কাঠকাঠ গলায় সে বলল,
“মিস মোহ লোকটাকে বলে দাও আমি ভালো আছি। আমার খবর নেওয়া শেষ হলে যেন চলে যায়।”

“হুমম। রিল্যাক্স চলেই যাচ্ছি। আজকাল ভালো মানুষের ভাত নেই।”

শৌভিক যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। মোহের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমার খোঁজখবর নেওয়া বোধহয় উনার পছন্দ হচ্ছে না। আমি বরং যাই। ভালো থাকবেন।”

দুজনের এমন বিদ্বেষ দেখে তব্দা খেয়ে রইল মোহ। শৌভিক চলে যেতে নিলে তার পিছু যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। স্বচ্ছের কাছে সে নিজেই শৌভিককে এনেছিল। তাই তার মনে হলো স্বচ্ছের ত্যাড়া কথার জন্য ক্ষমা চাওয়া জরুরি। তবে তার ভাবনা মাটি করে দিয়ে স্বচ্ছ মোহকে কঠিন গলায় হাক দেয়,
“এই মেয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

মোহ ঘাড় ঘুরিয়ে উদ্ভট চাহনি দিয়ে বিমূঢ় হয়ে বলল,
“আমিও আপনার খোঁজই নিতে এসেছিলাম। আপনি বললেন আপনি ভালো আছেন। তাই চলে যাচ্ছি।”

স্বচ্ছ এবার কণ্ঠে আরো কাঠিন্য এনে বলে,
“এটা কোনো খোঁজ নেওয়া হলো? এখানে এসো। ভালো করে খোঁজ নিয়ে যাও আমার।”

বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোহ। তার হাসি পাচ্ছে তবে পারিবারিক সমস্যাগত কারণে হাসিটা আসছে না ঠিকঠাক। এই প্রথম সে কাউকে দেখল নিজের খোঁজ নেওয়ার জন্য এত জোর খাটাতে। স্বচ্ছ নামক এই অদ্ভুত মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেও কূল কিনারা পায় না মোহ। সে বাধ্য মেয়েও মতো এসে টুলে বসে চুপটি করে। দুজন বেশ সময় ধরে নীরব থাকে। কিছুটা সময় নিয়ে স্বচ্ছ উসখুস করার পর প্রশ্ন করেই ফেলে,
“আচ্ছা এই শৌভিক তোমার কে হয়? তোমার পরিচিত কেউ?”

গোল গোল আঁখি দুটো সরু করে স্বচ্ছের পানে তাকায় মোহ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়,
“তেমন কেউ তো হন না। শুধু যতটুকু চিনলাম বুঝলাম উনি ভালো মানুষ। বাবাকে ছাড়াতে সাহায্য করেছেন উনি।”

‘উনি ভালো মানুষ’ এইটুকু কথা শুনে যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল স্বচ্ছ। ফট করে চোখ গরম করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কেন আমি ভালো মানুষ না?”

সীমাহীন বিস্ময়ের সঙ্গে স্বচ্ছের প্রশ্নের মুখোমুখি হয় মোহ। একপ্রকার স্বচ্ছের এই কথায় থতমত খায় সে। একটা শুঁকনো ঢক গিলে বলে,
“আমি কী করে জানব আপনি কেমন মানুষ।”

মোহের কথায় কেমন যেন বিশ্রী রাগ হয় স্বচ্ছের তবে তা প্রকাশ করতে পারে না। মনে হয় যেন ভেতর থেকে কিছু একটা খিঁচে ধরছে তাকে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“তা জানবে কেন! শৌভিকের চরিত্র সম্পর্কে ঠিকই জানা আছে।”

মোহের কানে ঠিকঠাক পৌঁছায় না স্বচ্ছের সেই কথা। সে অতি আগ্রহের সাথে জানতে চায়,
“হ্যাঁ তো বলুন আপনার খোঁজ কীভাবে নিতে পারি?”

স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকাল এবার। বলল,
“আমি কীভাবে জানব? এটা তোমার দায়িত্ব।”

“আমি যে বললেন আমি ভালো করে খোঁজ নিতে পারিনি। এখন যদি খোঁজ ভালো করে না নেওয়ার অপরাধে আবার জেলে ঢোকানো হয় আমার পরিবারকে?”

মোহের কথার ভাঁজে স্বচ্ছকে দেওয়া খোঁচা স্পষ্ট অনুভব করতে সক্ষম হলো স্বচ্ছ। খুবই বাজে এক অনুভূতি জাগল মনে। জ্বলে গেল ভেতরটা। মোহের পানসে মুখটির দিকে মনোযোগের সহিত তাকাল সে। মুখে সজীবতার কমতি লক্ষ্য করল। আবারও বুঝি কিছু হয়েছে? স্বচ্ছ এবার বিনীত সুরে শুধাল,
“তোমাকে সরি বলেছিলাম আমি। তুমি ক্ষমা করেছিলে আমায়। দরকার পড়লে তোমার বাবা, তোমার পুরো পরিবারের কাছে ক্ষমা। দরকার পড়লে শাস্তি দাও। কিন্তু এভাবে কথা বলো না। খারাপ লাগে, লজ্জা লাগে, ছোটো লাগে নিজেকে। আচ্ছা, কিছু কি হয়েছে আবারও? কেউ কিছু বলেছে?”

মোহ তাচ্ছিল্য করে মলিন সুরে বলল,
“আর কিছু হওয়ার তো বাকি নেই। আমি কি এখন যেতে পারি? আসলে আমার ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় হয়ে আসছে। আজ অনেকগুলো ইন্টারভিউ দিতে হবে।”

“চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ। বাবা এত অপমান নিয়ে চাকরি করবে কিনা তার তো ঠিক নেই। নিজেদের সংসার চালাতে হবে তো।”

মোহের কথাটা এবার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলল স্বচ্ছের। মোহ তখন ধীরে টুল ছেড়ে উঠছে মাত্র। তৎক্ষনাৎ তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বসিয়ে দিলো স্বচ্ছ। অনেকটা জোর গলায় প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? আমায় খুলে বলো প্লিজ!”

মোহ এবার হা-হুতাশ করছে কেন মুখ ফসকে এসব কথা বলে ফেলল এই ভেবে। সে হাত নিজের হাত টেনে নিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না।”

“যদি না বলেছ তাহলে হাত ছাড়ব না।”

মোহের হাত আলগা করে দিলেও পরক্ষণেই শক্ত করে ধরে বলল স্বচ্ছ। মোহ কপাল জড়িয়ে বলল,
“জোর খাটাচ্ছেন?”

“যদি তাই মনে করো তবে তাই।”

“আমার বাবা পুরো এক রাত জেলে ছিলো। বিষয়টা পুরো পাড়ায় ছড়ানোর সাথে সাথে বাবা যেই স্কুলে পড়ান সেখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই বাবাকে নিচু মনের ভাবছে, অপরাধী ভাবছে। কোনো কোনো স্টুডেন্টের অভিভাবক অভিযোগ করেছে যে বাবা স্কুলে পড়ালে সেখানে আর বাচ্চাকে পড়াতে পাঠাবে না। আমার বাবা এমন একজন মানুষ যার চরিত্রে সামান্যতম দাগ ছিল না। মধ্যবিত্ত হলেও সবসময় তাকে সবাই সম্মান করে চলত। সবসময় মাথা উঁচু করে হেঁটেছেন। সেই মাথা নিচু হয়ে গিয়েছে। তার দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র আমার কারণে। হয়ত সরকারি স্কুলে প্রমাণ ব্যতীত বাবাকে বের করে দিতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। তবে তাকে নিয়ে যেই আলোচনা, যেই অসম্মান এটা সইতে পারবে না কখনো। হয়ত নিজেই চাকরি ছেড়ে দিবে। বাবাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। খুব ভালো হতো যদি সব আগের মতো করতে পারতাম।”

কথাগুলো বলার সাথে সাথে মোহের কঠিন গলা আস্তে আস্তে ভেঙে আসা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছে স্বচ্ছ। বিমূর্ত হয়ে স্থির বসে রইল সে। মুখে এলো না মোহকে শান্তনা দেওয়ার কোনো শব্দ। স্বচ্ছ শান্তনা দিতে জানে না। আলগা করে দিলো মোহের হাত। মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্বচ্ছ। মোহ নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে আগের ন্যায় শক্ত গলায় বলে উঠল,
“উঁহু, করুণা আমার পছন্দ নয়। আমি চাই না আপনি আমাকে সহানুভূতি দেখান। এটা আমার পছন্দ না।”

স্বচ্ছ প্রতিত্তোরে কোনো শব্দ বলল না। নিশ্চুপ রইল। যেন সে নিজেও অপরাধী। তার ধূসর বর্ণের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকল। জ্বালাতন হতে থাকল চক্ষুদ্বয়ে বারংবার। মোহ নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার পরিবারের কাউকে দেখছি না যে। কেউ নেই আপনার সাথে?”

স্বচ্ছ বড়ো বড়ো কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ভেতরের সমস্ত অনুভূতি দমিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ছিল তো। সৌমিত্র আর ফারাহ সারারাত ছিল। আর কিছু গার্ড ছিল। ওদের বাহিরে থাকতে বলে দিয়েছি। বিরক্ত লাগে। ফারাহ একটু বাড়ি গিয়েছে ফ্রেশ হতে। সৌমিত্র খেতে গিয়েছে একটু আগেই।”

“আমি তাহলে আসি।”

স্বচ্ছ মুখে কিছু বলল না। ইশারায় সম্মতি দিতেই একটি বার মোহ স্বচ্ছকে দেখে প্রস্থান করল দ্রুত। তার যাওয়ার পানে হাফ ছেড়ে তাকিয়ে রইল স্বচ্ছ। তার দম বন্ধ হবার অনুভূতি হচ্ছে। শ্বাস যেন নিষ্ঠুরের মতো রোধ করছে কেউ।

নিজের দলের ছেলেপেলের খোঁজ-খবর, দেখা-সাক্ষাৎ করে সবে মাত্র বের হলো শৌভিক। গরম পড়েছে বেশ। ঘামে ভিজে গেছে পরনে পাঞ্জাবি। দ্রুত পা চালিয়ে এই লোক সমাগমের বাহিরে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সে। হঠাৎ তার সূক্ষ্ম নজরে আটকায় এক দৃশ্য। একটা মেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে এদিকে। পেছন থেকে একটা ছেলে অর্থাৎ এক ওয়ার্ডবয় তাকে দেখেই হাতে ঝাড়ু নিয়ে মেঝে পরিষ্কার করার ভান ধরে দ্রুত মেয়েটির দিকে এগোতে থাকল। ছেলেটির অভিপ্রায় বেশ ভালো করে বুঝতে পারে শৌভিক। দ্রুত সেদিকে হেঁটে যেতেই মেয়েটিকে ছুঁইয়ে ইচ্ছে করে হালকা ধা/ক্কা দেয় ওয়ার্ডবয়। মেয়েটি ঘুরে ওয়ার্ডবয়কে দেখে। ওয়ার্ডবয় মুহূর্তেই কিছুই না জানার ভান করে বলে,
“দুঃখিত ম্যাডাম। মেঝে পরিষ্কার করছিলাম। খেয়াল করিনি।”

কথাটি শেষ হওয়া মাত্র লোকজনের তোয়াক্কা না করে নিজের শক্ত হাতে থা;প্পড়টা মে/রে দেয় শৌভিক ওয়ার্ডবয়। বেশ জোরেশোরে শব্দ হয়। গালে টনটন করে ব্যথা করে ওঠে ছেলেটির। গালে হাত দিয়ে আহাম্মকের মতো চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে ওয়ার্ডবয়। ফারাহও বোকা বনে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শৌভিক ওয়ার্ডবয়ের শার্টের কলার শক্ত করে টেনে ধরে বলে,
“হাসপাতালে কাজ করতে আসিস নাকি মেয়েদের স্পর্শ করতে আসিস?”

ফারাহর বোধগম্য হলো শৌভিক হয়ত ছেলেটিকে ভুল বুঝছে। সে আশেপাশে লোকজনকে দেখে নিয়ে চাঞ্চল্যতার সঙ্গে বলল,
“আপনি ভুল বুঝছেন। এই লোকটা শুধু ফ্লোর পরিষ্কার করতে গিয়ে ভুলে ধা;ক্কা দিয়ে ফেলেছে।”

“এ বিষয়ে কতটুকু জানেন আপনি? নিজ চোখে দেখেছিলেন ও কতক্ষণ ধরে ফ্লোর পরিষ্কার করছিল? আপনাকে দেখেই ও ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে এখানে এসেছে। না জেনে কোনো কথা বলবেন না। এখনি আমি একে দিয়ে সব স্বীকার করাব।”

শৌভিকের সোজাসাপ্টা উত্তর। সে ওয়ার্ডবয়ের শার্টের কলার আরো জোরে চেপে ধরল। আশেপাশে ইতিমধ্যে লোক জমা হতে শুরু করল। শৌভিক সরাসরি হুমকি দিয়ে বলল,
“স্বীকার করবি? নাকি আমাকে সিসিটিভি ক্যামেরা অবধি দেখার কষ্ট করতে হবে? যদি তা করতে হয় তোর পরিণাম খুব একটা ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”

এবার দেরি না করে নিজেকে বাঁচাতে হাতজোড় করল ছেলেটি। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আমার ভুলে হয়ে গেছে। আমি ইচ্ছা করে উনার সাথে একটু ফাইজলামি করতে চাইছিলাম। আর হবে না এমন।”

নরম ফারাহ এবার জ্বলে উঠল ওয়ার্ডবয়ের এ কথা শুনে। এবার নিজে টেনে ধরল ওয়ার্ডবয়ের শার্টের কলার। রাগে কটমট করে বলল,
“এতক্ষণ ভোলাভালা ভেবে ছেড়ে দিচ্ছিলাম আর তুই কিনা এমন ফাজিক বের হলি! অসভ্য কোথাকার। জানিস আমি কে? তোকে এখনি নাস্তানাবুদ যদি না করেছি!”

ওয়ার্ডবয়ের গালে দুটো চ/ড় কষিয়ে দিতে দিতেই ওকে ধম/কাতে এবং মা/রতে সবাই এগিয়ে এলো। তৎক্ষনাৎ সে ফারাহর পায়ের কাছে পড়ে আকুতি করে বলল,
“এ জীবনে আর কোনো মেয়ে মানুষের সাথে এমন করব না। এবারের মতো আমাকে ছেড়ে দেন। আমার চাকরি চলে যাবে। আমাকে মাফ করে দেন।”

কোমড়ে হাত দিয়ে রাগে ফুঁসছিল ফারাহ। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,
“ফারাহ নরম মনের মেয়ে বলে ছাড় দিলো তোকে। আমার চোখে সামনে আর এক সেকেন্ড থাকবি তো গণধোলাই খাওয়াব। এখনি দৌড় লাগাবি পেছনে তাকালেই মা/ইর।”

ছেলেটিকে আর পায় কে! কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে জান হাতে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল সে। রাগটা আস্তে আস্তে নামতে থাকল ফারাহর। সামনাসামনি খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা শৌভিককে লক্ষ্য করে ধন্যবাদ বলার জন্য উদ্যত হতেই শৌভিক মৃদু হেসে বলে,
“আমি এসবের জন্য ধন্যবাদ নিতে পছন্দ করি না। নিজের সেফটি নিজে বুঝে নেবেন। এত সরল হবেন না আবার এত ঝালও হবেন না। মিডিয়ামে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।”

ব্যস…এতটুকু বলেই একপ্রকার হাওয়ার বেগে লোকজনের ভিড়ে হারাল লোকটি। হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে ফারাহ। কী বলে গেল সেই মানব? ভাবনার মাঝে দেখা মিলল সৌমিত্রের। ফোনে কথা বলতে বলতে হেলেদুলে আসছে সৌমিত্র। আশেপাশে এত লোক সমাগম দেখে কল কেটে ফারাহর নিকটে এসে প্রশ্ন করল,
“কী ব্যাপার? কী হয়েছে এখানে? তুই কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছিস নাকি?”

“সবসময় আমিই সবকিছু করি নাকি? আসলে একটা ওয়ার্ডবয়ের ইনটেনশন খারাপ ছিল। ফ্লোর পরিষ্কার করার নাম নিয়ে আমায় ধা;ক্কা দিয়েছিল। একটা লোক তাকে ধরিয়ে দিয়েছে।”

রাগে কপালে বেশ কয়টা ভাঁজ পড়ে সৌমিত্রের কপালে। কপালের উপরের রগগুলো দপদপ করে জ্বলে ওঠে তখনি। আশেপাশে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে বলে,
“কোথায় সেই ইডিয়ট? দেখা কোন ওয়ার্ডবয়। একবার দেখিয়ে দে শুধু। আমি ব্যবস্থা করছি।”

ভাইকে রাগতে দেখে তার হাতের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে শান্ত করতে আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“সৌমিত্র ভাই, তোমার বোন কি এতই কমজোর যে নিজে কিছু করতে পারে না? যা করার আমি করেছি। তোমায় এত হাইপার হতে হবে না। আই এম স্ট্রং গার্ল। ইউ নো!”

“তুই সিউর এই ব্যাপারে?”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর। ওই ছেলেটা কখনো ওর বউয়ের দিকেও তাকাবে না দেখো।”

সৌমিত্রের রাগ নিমিষেই গলে যায়। সময় লাগে না তার রাগ পড়তে। ফারাহ বলে,
“শুধু স্বচ্ছ ভাইকে কথাটা জানানোর দরকার নেই। এই অবস্থায় ছেলেটার সাথে মা/রামা/রি করতে চলে যাবে।”

সৌমিত্র সায় দিয়ে স্বচ্ছের কেবিনের দিকে এগোয়।

“তুই নিশ্চিত উনি ওই স্কুলেই পড়ান?”

অনেকটা সন্দিহান হয়ে কানে ফোন ধরে জানতে চাইল স্বচ্ছ। ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
“হ্যাঁ রে বাবা। একবারে রাইট ইনফরমেশন দিচ্ছি তোকে। উনি ওই স্কুলেরই টিচার।”

“ওকে, বাই।”

বন্ধুর মুখের উপর ফোন কেটে দিয়ে হাফ ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় স্বচ্ছ। দরজা খোলার শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসামাত্র বুঝতে পারে তার ভাইবোনের আগমন। ফোনে একবার সে দেখে নেয় সময়। সৌমিত্রের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে স্বচ্ছ দ্রুত আদেশ করে,
“আমি এখন একটা জায়গায় যেতে চাই। নিয়ে যেতে সাহায্য কর আমাকে। এখনি যাব আমি।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। রাত জেগে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে লেখা। সামান্য অগোছালো লাগতে পারে।]#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯

গাড়িতে খানিকটা চিন্তিত মুখেই বসে আছে সৌমিত্র। পাশে বসে থাকা স্বচ্ছের গম্ভীর মুখভঙ্গির কারণ কিছুতেই বুঝে উঠছে না সে। একটা সময় সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
“ভাই, আজকেই কি এই স্কুলে যাওয়া খুব দরকার? তোমার পায়ে লাগা আছে। তুমি এখনো ঠিক করে সেরে উঠতে পারো নি। কয়দিন করে এখানে আসলে হতো না? ডক্টর কতবার করে মানা করল বাহিরে না আসতে এই কন্ডিশনে।”

স্বচ্ছ দেরি না করে চট করেই ভার মুখে উত্তর দিয়ে বসল,
“আমার কাজ আমি ভালো করে বুঝব সেটা কখন করতে হবে আর কখন করতে হবে না। তোকে ব্যস এখানে নিয়ে আসতে বলেছি তুই নিয়ে এসেছিস। বাড়তি কোনো প্রশ্ন আমি শুনতে চাইছি না।”

“সে তো ঠিক আছে ভাই। কিন্তু বাবা যদি জানতে পারে তোমার সাথে আমাকেও হসপিটালের বেডে শুইয়ে দিতে পারে।”

স্বচ্ছ তপ্ত শ্বাস ফেলে সৌমিত্রকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“বাবাকে আমি সামলে নেব। তুই আমাকে নামতে সাহায্য কর।”

সৌমিত্র আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাতে স্টিক নিয়ে স্বচ্ছের দিকে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। স্বচ্ছ একহাতে স্টিক ধরে অন্যহাতটা সৌমিত্রের ঘাড়ে রেখে অনেকটা কষ্ট করে গাড়ি থেকে নামল। তারপর সৌমিত্রের ঘাড় ছেড়ে একা একা স্টিক ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে। তার পানে কৌতূহলী নয়নে তাকিয়ে থেকে সৌমিত্র আপনাআপনি আওড়ায়,
“কী অদ্ভুত একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে আমার মা। মাথায় যখন যা আসে সেটা না করতেই হবে।”

স্কুলের প্রিন্সিপাল শফিকুল ইসলাম বেশ আরাম করেই পত্রিকা পড়ছিলেন। সেই মুহূর্তে দরজায় পিয়নের গলা পাওয়ায় বেশ বিরক্ত হলেন উনি। জবাব দিলেন,
“কী হয়েছে?”

পিয়ন কিছুটা আতঙ্কের সহিত বলল,
“স্যার, আসলে আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে। লোকটা মন্ত্রী সারোয়ার সাহেরের ছেলে স্যার।”

প্রথমে ভালো করে কথাগুলোতে মনোযোগ না দিলেও শেষ কথায় হৃদকম্পন বেড়ে গেল প্রিন্সিপালের। হম্বিতম্বি করে বলে উঠলেন,
“হায় আল্লাহ! এবার যে কী হয় কে জানে। এখন কেন আসলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আর তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না। দ্রুত যাও গিয়ে উনাকে এনে এখানে বসাও।”

পিয়ন শফিকুল ইসলামের কথা মতো তড়িঘড়ি করে চলে গেল। কিছু সময় পর স্বচ্ছ এবং সৌমিত্রকে নিয়ে এলো সাথে করে। দুজনকেই বেশ সম্মানের সহিত বসতে দেওয়া হলো। শফিকুল সাহেবও তার সামনাসামনি চেয়ারে বসে খানিকটা ইতস্ততবোধ করে বললেন,
“আমি তো জানতাম না আপনারা আসবেন। তাই কিছু আয়োজন করা হয়নি স্যার। ক্ষমা করবেন।”

স্বচ্ছ বিলম্ব না করে সোজা উত্তর করল,
“কেন? আমি কি বিয়ে করতে আসছি নাকি কোনো অনুষ্ঠানে আসছি যে আয়োজন করতে হবে?”

শফিকুল ইসলাম থতমত খেলেন স্বচ্ছের কথায়। নিজেকে ধাতস্থ করে আমতা আমতা করে শুধালেন,
“কোনো বিশেষ কারণে আমার এখানে আসা স্যার?”

“ফার্স্ট ওফ অল, আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করুন। স্যার আপনি। আমি নই। তাই আমি আপনাকে স্যার ডাকব। আর হ্যাঁ, জরুরি কারণেই এখানে আসা।”

শফিকুল ইসলাম অতি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন,
“কী কারণ?”

স্বচ্ছ এবার খানিকটা দম নিয়ে কণ্ঠস্বর নরম করে বলতে শুরু করল,
“কারণটা মি. আজহার আহমেদকে নিয়ে। আপনার হয়ত অজানা নয় যে উনাকে পুলিশ কাস্টারিতে রাখা হয়েছিল পুরো এক রাত। সেইদিনের পর থেকে উনার নামে বদনাম রটে গিয়েছে।”

“জি। আসলে লোকটা কাজই এমন করেছে যে জেলে থাকতে হয়েছে। আমরা তো জানতাম না উনি এমন। এত বছর ধরে এই স্কুলে পড়ান। বিশ্বাস করুন কখনোই উনাকে এমন মনে হয়নি। উনাকে স্কুলে রাখাটা কী পছন্দ করছেন না আপনি?”

স্বচ্ছের দৃষ্টির মাঝে ক্ষোভ দেখা গেল খানিকটা। প্রিন্সিপালের কথা শুনে কপাল জড়িয়ে গেল তার। টেবিলে থাবা দিয়ে বলল,
“না। এমনটা কখনোই আমি চাইনি। আমি চাই উনি আগে যেমন মাথা উঁচু করে সবার সামনে চলাফেরা করতেন আজও তাই করুক। যেভাবে সকলের ভালোবাসা পেতেন আজও তাই পাক। কিন্তু আমার এই চাওয়ার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বদনাম। উনি যা নয় সেটাই উনাকে বানানো হয়েছে। উনি অপরাধী নন। পুরোটাই সাজানো ছিল।”

শফিকুল ইসলাম এবার আঁখি দুটো গোলগোল করে তাকিয়ে রইলেন স্বচ্ছের দিকে। মন্ত্রীর ছেলে নিজেই এসে যে আজহার সাহেবের নিরপরাধ হওয়া সম্পর্কে বলবেন সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কোনোমতে নিজের বিস্ময় তিনি কাটিয়ে উঠে প্রশ্ন করেন,
“তাহলে জেলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা…”

“ভুলটা আমার। আমার জন্য উনার সাথে এমনটা হয়েছে। তাই আমি সংশোধন করতে চাই। আমি সবাইকে জানাতে চাই ওই লোকটা কিছু করেননি। উনি পরিস্থিতির স্বীকার। আর আমায় জানাতে আশা করি আপনি সাহায্য করবেন?”

শফিকুল ইসলাম অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠেন,
“জি, জি। অবশ্যই। বলুন কী করতে হবে?”

স্বচ্ছ সোজাসাপ্টা বলে দিলো,
“আমি কিছু সময়ের জন্য সবাইকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত দেখতে চাই। টিচার, স্টুডেন্টস্, স্কুলে অবস্থান করা সকল অভিভাবক সবাইকে ওখানে দেখতে চাই। বিশেষ করে মি. আজহার আহমেদ যদি স্কুলে থাকেন তবে উনাকেও আসতে বলবেন। শুধুমাত্র কিছুটা সময়ের জন্য। আমি জানি স্কুলের কার্যক্রমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি। প্লিজ স্যার!”

“এভাবে বলবেন না। আমি এখনি সবাইকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত থাকতে বলছি। আমাকে কিছু সময় দিন।”

শফিকুল ইসলাম বিদ্যুতের গতিতে নিজের কক্ষ প্রস্থান করলেন। এতক্ষণ নীরব দর্শকের ন্যায় সবটা শুনলেও এখন চুপ থাকতে পারল না সৌমিত্র। প্রচণ্ড ব্যগ্রতা নিয়ে ভাইকে প্রশ্ন করল,
“ভাই, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কেন এখানে এসেছ। মোহের বাবাকে যেন একটু হলেও সাহায্য করতে পারো এটাই উদ্দেশ্য ছিল তোমার। কিন্তু এখন সবাইকে ডেকে তুমি কী করতে চাইছ? আমায় বলবে? আমি এত কৌতূহল নিয়ে থাকতে পারছি না আর।”

“ধৈর্য ধর সৌমিত্র। আপনাআপনি সব জানবি।”

সৌমিত্র স্মিত হাসল। উপহার করে বলল,
“যেই মানুষ নিজে কখনো ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি সেই মানুষ আমাকে ধৈর্য ধরতে বলছে! হাউ স্ট্রেঞ্জ!”

প্রতিত্তোর আর করল না স্বচ্ছ। সে এখন অন্য চিন্তার জগতে প্রবেশ করেছে। তার ভাবনায় এখন শুধুমাত্র একটি বিষয়ই ঘুরছে।

অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলে কৌতূহল, বিস্ময়ের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন। বিশেষ করে শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। স্বচ্ছ স্টেজে বসে আছে চেয়ারে। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না এই অবস্থায়। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন আজহার সাহেব। মুখটা শুঁকিয়ে গিয়েছে উনার। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না স্বচ্ছের এমন সিদ্ধান্তের কারণ। এভাবে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনার পাত্র হতে লজ্জা করছে উনার। স্বচ্ছকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, যা সম্মান ছিল বাকিটুকুও কেঁড়ে নিতে এসেছ? কিন্তু সকলের সামনে এই প্রশ্নটা কিছুতেই করতে পারছেন না তিনি। এবার বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে সৌমিত্রের হাত থেকে মাইক্রোফোন হাতে নিলো স্বচ্ছ। দেরি না করে সালাম দিয়ে একনাগাড়ে বলতে শুরু করল,
“আমি জানি আমার এই আচরণের কারণে আপনাদের কিছুটা হেনস্তা হতে হয়েছে। আপনারা কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি যেই বিষয় নিয়ে কথা বলব সেটাও সকলের জানা খুবই জরুরি। আমি আহিয়ান স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেরের বড়ো ছেলে এবং আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এই স্কুলের একজন সম্মানিত শিক্ষক মি. আজহার স্যার। আমরা সবাই জানি বিগত দিন আগে উনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। না চাইতেও বদনাম হয়ে যান। মাত্র এক রাতের ব্যবধানে উনাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেললেন আপনারা। অথচ এতদিন উনাকে সৎ বলেই জেনে এসেছেন। আপনাদের দোষ দেব না আমি। আসলে মানুষ ভালোটা নয় খারাপটাই মনে রাখতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি নিজে আজকে বলছি, উনি খারাপ নন। উনি বা উনার মেয়ে অথবা উনার পরিবারের কেউই কোনো অন্যায় করেনি যার কারণে উনাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুরোটাই ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। আপনারা আজহার স্যারকে ঠিক যেমনটা চিনেছিলেন উনি ঠিক তেমনটাই সৎ এবং সরল আর আমি এটাও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, উনার মেয়েকে নিয়ে রটানো ঘটনাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ঘটনা সেসব আমায় নিয়ে ঘটেছে তাই আমি নিজে বলছি সব মিথ্যে ছিল। উনার মেয়ের গায়ে সামান্যতম কলঙ্কও নেই। আর না উনার গায়ে রয়েছে।”

পুরো অডিটোরিয়াম নিস্তব্ধ। কেউ কথা বলা বা সমালোচনা করার আর কোনো সাহস পাচ্ছে না। সকলের ভাবমূর্তি পর্যবেক্ষণ করল স্বচ্ছ। অতঃপর কোনোরকমে হাতে স্টিক ধরে উঠে আজহার সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াল সে। আজহার সাহেবের চোখে বিস্ময় স্পষ্ট। সেই উচাটনের মাঝে মুখে আসছে বা একটা শব্দও। সবরকম লজ্জা ত্যাগ করে সকলের সামনে আজহার সাহেবের কাছে মাথা নত করে স্বচ্ছ। জোর গলায় বলে,
“আমি আহিয়ার স্বচ্ছ নিজে ক্ষমা চাইছি আজহার স্যারের কাছে। উনি একেবারেই নির্দোষ ছিলেন। উনি আগের মতোই সম্মানিত এবং সম্মানের যোগ্য।”

একটু থেমে আবারও আজহার সাহেবের উদ্দেশ্যে স্বচ্ছ বলে,
“আমার বাবার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে আপনাকে। হয়ত আমার জন্যও তাই। একারণে আমি সত্যিই আপনার কাছে অনুতপ্ত। আপনি যদি আমায় কোনো শাস্তি দিতে চান তবে নির্দ্বিধায় জানান।”

অনেক সময় পর নিজের কণ্ঠে শক্তি জুগিয়ে মুখ খুললেন আজহার সাহেব।
“দেখো বাবা, আমি জানি না তুমি এসব কেন করছ! তুমি আমার ছেলের মতো। আর তোমায় ক্ষমা না করে আমার কোনো উপায় নেই। আর কোনো রাস্তা তুমি বাকি রাখো নি। তুমি যা করলে তার জন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। আর কিছু চাই না। আমার মতো সাধারণ মানুষ সামান্যতেই সন্তুষ্ট, বাবা। তুমি তো অনেক বেশি করে ফেলেছ। আর কিছু করো না। আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি।”

স্বচ্ছ মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।”

অতঃপর স্বচ্ছ প্রিন্সিপাল শফিকুল ইসলামের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমার কাজ শেষ। আমি আসছি। দুঃখিত এত সময় নেওয়ার জন্য।”

সময় নষ্ট না করে ধীর পায়ে হাতে স্টিক ধরে সিঁড়ি বেয়ে সৌমিত্রের সাহায্যে নিচে নেমে যায় স্বচ্ছ। তার জানা নেই সে কতটুকু করতে পেরেছে মোহের বাবার জন্য। তবে এরচেয়ে বেশিকিছু সে করতে পারবে না। যদি পারত। হয়ত আরো করত মানুষটির জন্য। গাড়ির সামনে এনে সৌমিত্র দাঁড় করায় স্বচ্ছকে। হঠাৎ থেমে যাওয়ায় খানিকটা বিরক্ত হয় স্বচ্ছ। চোখ ছোটো করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর আবার কী সমস্যা?”

সৌমিত্র কিছু না বলে স্বচ্ছকে আচানক জড়িয়ে ধরে। আত্মহারা হয়ে বলে,
“আই এম প্রাউড ওফ ইউ, ভাই!”

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here