যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -১৬+১৭

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬

ইমারজেন্সি রুমের বাহিরে হাত মুঠো করে স্থির বসে রয়েছে মোহ। তার ওড়নায় লেগে থাকা জবজবে র;ক্ত শুঁকিয়ে গিয়েছে। মাছি ভনভন করছে র;ক্তের কারণে আশেপাশে। ক্ষণে ক্ষণে কিঞ্চিৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠছে মোহের শরীর। স্বচ্ছের র;ক্তপাত ও শরীরের ক্ষ/ত দেখে আতঙ্ক বেড়েছে তার। যতই অসহ্য লাগুক মানুষটিকে তবুও মনে মনে একটিই কামনা করছে সে। সেটা হলো স্বচ্ছের সুস্থতা। আরো দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পরেই ইমারজেন্সি রুমের লাইট যখন বন্ধ হলো নিজের অস্থিরতা চাপিয়ে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেল মোহ। হনহনিয়ে এসে দাঁড়াল ডক্টরের সামনে। সে কিছু না বলতেই ডক্টর বললেন,
“জলদি এখানে নিয়ে এসেছিলেন। সে কারণে মৃ/ত্যু থেকে রেহাই পেয়েছেন। আর একটু ব্লি/ডিং হলে জীবন অনিশ্চিত হয়ে যেত।”

মোহ তীব্র আশঙ্কা নিয়ে শুধায়,
“এখন উনি ঠিক আছেন?”

“হ্যাঁ কপালে সামান্য চো/ট লেগেছে। সেই সাথে হাত আর পায়ে একটু সমস্যা হয়েছে। ঠিক হয়ে যেতে পারে। তবে কপাল থেকে বেশ ব্লি/ডিং হচ্ছিল। ভাগ্যিস র:ক্তের গ্রুপটা রেয়ার নয়। নাহলে কী যে হতো! এখনো অচেতন অবস্থায় আছেন। আশা করা যায় খুব দ্রুতই জ্ঞান ফিরবে।”

“থ্যাংক ইউ ডক্টর।”

মোহ ডক্টরের পাশ কাটিয়ে আস্তে করে রুমে ঢুকে পড়ে। এলোমেলো পায়ে এগোতেই দৃষ্টি বদ্ধ হয় সিঙ্গেল বেডে অবচেতন হয়ে থাকা পুরুষটির দিকে। বাম হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। সরু ঠোঁটের ডান পাশ কেটে গিয়েছে। ডান গালটি ফোলা এবং লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালে পড়েছে মোটা ব্যান্ডেজ যেটা সামনের চুলগুলোকেও ঢেকে নিয়েছে। হাতেও প্লাস্টার করা। সব মিলিয়ে যা-তা অবস্থা! স্বচ্ছের দুই নয়নের পানে তাকায় মোহ। আকাঙ্ক্ষী হয় মানুষটির লোচনের ধূসর বর্ণ দেখার অপেক্ষায়। পাশে থাকা ছোট্ট টুলে ক্লান্তির সাথে বসে পড়ে মোহ। এত চিন্তা, এত ছোটাছুটি তাকে অবসন্ন বানিয়েছে। তার দুটো চোখও বুঁজে আসছে। এমতাবস্থায় ফোনটা বেজে উঠল তার। চমকে উঠে ফোন বের করে একবার স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে জানালার কাছে চলে আসে সে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা মা নামটি দেখে দ্বিধায় পড়ে যায় কলটি রিসিভ করবে কিনা। সে জানে, কল ধরলে প্রথমেই মায়ের প্রশ্ন হবে কোথায় সে, এখনো ফিরছে না কেন? কলটি কেটে গিয়ে যখন আবারও নিজ ছন্দে বেজে ওঠে তখন বাধ্য হয়ে কল ধরে কথা বলতে উদ্যত হয় মোহ। তবে তার আগেই মিসেস সুফিয়া ফোনের ওপাশ থেকে প্রশ্ন করে বসেন,
“কী রে? কোথায় তুই? কতক্ষণ হয়েছে বাহিরে বেরিয়েছিস? এখনো ফিরছিস না কেন?”

মোহ আমতা আমতা করতে আরম্ভ করে। মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে পড়ে কোনো এক বাহানা খুঁজতে। বাহানা খোঁজার কারণ সে এই মুহূর্তে স্বচ্ছকে ছেড়ে যেতে চায় না। সেই মুহূর্তে তার সঙ্গে সাথ দেয় বৃষ্টি। হুট করেই মেঘলা আকাশ থেকে পড়ন্ত ছোটো ছোটো ফোটার বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়। তা দেখে খুশিতে নেচে ওঠে মোহের মন। খুশিতে উৎকণ্ঠা হয়ে ধড়ফড়িয়ে বলে বসে,
“মা, বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো!”

মিসেস সুফিয়া বেশ অবাক হলেন। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“বৃষ্টি এসেছে বিষয়টাতে তোকে এত খুশি মনে হচ্ছে কেন? আর বৃষ্টি জোরে তো সবেমাত্র এলো। একটু আগেও কম ছিল। তুই বেরিয়েছিস কম সময় তো হয়নি। কতক্ষণ আগে বাড়ি ফিরে আসার কথা তোর?”

মোহ এবার মায়ের কথায় ভড়কে গেলেও বিরক্তি হওয়ার ভান ধরল।
“মা! তুমি জানো ঢাকা শহরে কত জ্যাম। তাও এ কথা বলছ। এমনভাবে সন্দেহ করছ যে আমি পালিয়ে এসেছি। টেনশন করবে না আমি সময় মতো বাড়ি পৌঁছে যাব। তুমি জাস্ট ইথানের খেয়াল রেখো একটু। ও খেতে চাইবে না হয়ত। একটু জোর করে খাইয়ে দিও।”

হুড়মুড়িয়ে কোনোরকমে কল কেটে স্বস্তির শ্বাস মন ভরে নেয় মোহ। অতঃপর দৃষ্টি বাহিরে বর্ষিত পানির ফোঁটাতে আঁটকায়। আজকের বর্ষণ তাকে যেন নিজে থেকে এসে বলছে, ‘তুই অসহ্যকর মানুষটাকে ছেড়ে এখনি যেতে পারবি না। তোকে যেতে দেওয়া হবে না। তারই সংলগ্নে থাকতে বাধ্য করব তোকে।’

দীর্ঘ সময় কেটে গেল। স্বচ্ছ নিজের চোখ দুটো খোলার ক্ষমতা পেল। তবে নাড়াতে পারল না শরীরের কোনো অঙ্গ। সারা শরীরের ব্যথায় অবশ হয়ে এসেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে উপরে শব্দ করে চলা একটি পুরোনো ফ্যান নজরে পড়ল। মাথাটা বাম পাশে ঘুরিয়ে দেখল হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। স্যালাইন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ডান দিকে ঘাড় ঘুরাতেই এক নারী মূর্তির দেখা পেল সে। রমনির কোঁকড়া চুলের বেণী দেখে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল সেই সাথে একটি নাম মনে এসে গেল আপনাআপনিই। অথচ স্বচ্ছের এই ঝিম ধরানো নারীটি নির্বিঘ্নে প্রকৃতির বর্ষণ উপভোগে ব্যস্ত। স্বচ্ছ দুর্বল গলায় ডাক দিলো।
“কে?”

আকাঙ্ক্ষিত মানবী পিছু ফিরে তাকাল। যাকে একদমই আশা করেনি স্বচ্ছ। মোহ ভেজা চোখেমুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। স্বচ্ছ হতভম্ব হয়ে শুধাল,
“তুমি এখানে?”

প্রতিবারের মতো মোহের মুখ থেকে বাঁকা উত্তরই বেরিয়ে এলো।
“কেন আমি কি এখানে থাকতে পারি না?”

“সেটা কখন বলেছি? তুমি কখনো সোজা কথা বলতে পারো না?”

“না, পারি না। যে যেমন প্রশ্ন করে তার তেমনই উত্তর হওয়া উচিত।”

প্রতিত্তোর করতে করতে স্বচ্ছের নিকটে এলো মোহ। স্বচ্ছ আবারও মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিলো তাকে। আসলেই এই মেয়েটা তার সামনে? অথচ গত রাতেই কল ধরছিল না! স্বচ্ছ কৌতূহল নিয়ে জানতে চায়,
“তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ?”

“না। আমার আত্মা নিয়ে এসেছে। বাইক সামলে চালাতে পারেন না? হঠাৎ এক্সি’ডেন্ট করে বসলেন কেন?”

“সুস্থ লাগতে ভালো লাগছিল না তো তাই এক্সি:ডেন্ট করলাম।”

মোহ কপাল জড়িয়ে বলে ওঠে,
“এটা কেমন কথা?”

“কেমন কথা আবার?”

মোহ দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,
“আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে এদিকে আমি ফেঁসে যাচ্ছি আর আপনার ত্যাড়া কথা আমাকে শুনতে হচ্ছে। আমি ডক্টরকে ডাকতে যাচ্ছি। আপনার একবার চেকআপ করানো দরকার। এমনিতে সরকারি হাসপাতাল। আপনাদের প্রাইভেট হসপিটালের মতো কতটা সেবা দিতে পেরেছে জানি না।”

মোহ বাহিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আগপাছ চিন্তা না করে তৎক্ষনাৎ তার হাতটা চেপে ধরল স্বচ্ছ। স্যালাইনের সুঁচ ফোঁড়ানো হাতে টান পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো মোহের হাত। তবে নিজেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় রেখে বলল,
“এতই যখন রাগ আমার উপর তবে কেন তুমিই আমাকে সাহায্য করলে? এড়িয়ে আসতে পারতে তো আমার র;ক্তাক্ত দেহ।”

মোহ চুপ থাকে এবার। মুখে আসে না একটি শব্দও। আসলেই তো! কেন সে এড়াতে পারল না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে স্বচ্ছ আরো বলতে থাকে,
“তাছাড়া আমি, আমার বাবার দ্বারা কম ক্ষতি তো হয়নি তোমার আর তোমার পরিবারের। অনেক অ/ন্যায় করেছে আমার বাবা। তবুও কেন তার ছেলেকে সাহায্য করতে মরিয়া হয়েছ?”

মোহের মুখের বুলি ফুটল এবার। কাঁপা সুরে বলল,
“কারণ আপনারা যা করেছেন তার শোধ এভাবে তুলতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। আপনি আমাকেও সাহায্য করেছিলেন। আমার ছেলেকে হসপিটাল অবধি নিয়ে গিয়েছেন।”

“সেই সাহায্যের শোধ এভাবে মিটিয়ে দিচ্ছো?”

“হয়ত।”

মোহের এই ছোট্ট, দায়সারা উত্তর হজম হলো না স্বচ্ছের। সে আরো কিছু শুনতে চেয়েছিল। তার প্রবৃত্তি সীমা অতিক্রম করে ফেলে যাচ্ছে। মোহের কথায় কথায় সে স্পষ্ট অনুরাগ খুঁজে পেয়েছে। সেটার কারণও ধরতে পেরেছে স্বচ্ছ। মোহ ফের বের হতে নিলো সেখান থেকে। আগের মতোই তার হাতটা ধরে ফেলল স্বচ্ছ। মোহ এবার রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে চাইল। তবে স্বচ্ছ যেন মন ভোলানো আবদার করে বসল,
“আমার পাশে এসে একটু সময় বসো, প্লিজ।”

আবদারটি ফেলতে পারল না মোহ। আস্তে করে গিয়ে বসল স্বচ্ছের পাশে। অনেকটা ইতস্ততবোধ করে স্বচ্ছ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আই এম সরি।”

চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল মোহ। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চায়,
“হঠাৎ সরি কেন?”

“আমার বাবা তোমার বাবার সাথে যা করেছে তার জন্য। আমি লজ্জিত তোমার কাছে। তুমি হয়ত ভেবেছ আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমি তোমায় বিশ্বাস করেছি। বাবা যা করেছে তার জন্য তোমায় কী করে মুখ দেখাব বুঝতে পারছিলাম না। আমি তোমার বাবাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ততক্ষণে শৌভিক মীর তোমার বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে।”

মোহ নীরব থাকে। উচ্চারিত করে না একটি শব্দও। যার কারণে মনের মাঝের অস্থিরতা ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠে স্বচ্ছের। বেশ উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ? নাকি বিশ্বাস করতে পারছ না?”

“করছি বিশ্বাস। আপনার চোখে ছোটাছুটি করা প্রতিটা অনুভূতি লক্ষ্য করছিলাম আমি। চোখ কখনো মিথ্যে বলে না।”

“তাহলে আমাকে বিশ্বাস করলে? আমার সরি এক্সেপ্ট করলে?”

মোহ মৃদু হেসে মাথা দুলায়। স্বচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে হাফ ছেড়ে উপরদিকে তাকিয়ে বলে,
“যাক জীবনে প্রথম কাউকে সরি বলে সফল হতে পেরেছি।”

মোহের হাসি প্রগাঢ় হয়ে এবার। তার মনে হয় মানুষটাকে সে যতটা বিরক্তিকর মনে করেছিল সে ততটাও বিরক্তিকর নয়। বরং তার মাঝে কিছু মুগ্ধতাও রয়েছে।

চলবে…#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

“ভাই! তোমার এ কী অবস্থা?”

সৌমিত্রের বিচলিত কণ্ঠ। স্বচ্ছ দরজার দিকে দৃষ্টিাপাত করতেই সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়াল ভাইয়ের নিকটে। পিছুপিছু এলো ফারাহ। স্বচ্ছ সৌমিত্রের কথার জবাবে বলল,
“দেখতেই তো পাচ্ছিস কী অবস্থা! আবার আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে?”

সৌমিত্র প্রতিত্তোর করবার পূর্বেই সে দেখতে পেল মোহকে। গোলগোল চোখে সৌমিত্র আর ফারাহকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেলল মোহ। সৌমিত্র আর ফারাহ মোহকে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করেছে যে তার অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে এবার। সৌমিত্র ফট করে এবার জানতে চাইল,
“ভাইয়া ইনি এখানে….”

“শুকরিয়া আদায় কর ম্যাডামের। আমাকে বাঁচিয়ে ধন্য করেছেন। নয়ত এইযে অবস্থায় দেখছিস এটাও দেখা যেত না।”

সৌমিত্র তৎক্ষনাৎ ভাইয়ের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে মোহের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম আমার এই জেদি, আপসহীন, একরোখা ভাইকে বাঁচানোর জন্য।”

মোহের চোখ দুটো ছোটো হয়ে এলো এবার। অস্থিরতা কেটে এবার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে। তবে ফারাহ মাঝে বলে উঠল,
“সৌমিত্র ভাই তাহলে আমাদের এখানে থাকার তো মানে হয় না। আমরা অযথা এখানে দৌড়ে দৌড়ে এলাম। ভাইয়া এখানে দিব্যি ফিট আছে। হ্যাঁ শরীরে কিছু স্ক্র্যাচ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় সেটাও খুব জলদি সেরে যাবে। সারিয়ে দেওয়ার লোক তো উপস্থিত রয়েছে।”

স্বচ্ছ এবার খানিকটা ক্ষেপে গেল ভাই-বোনের এমন উদ্ভট কথাবার্তার জন্য। তবে তাকে কিছু মুখ ফুটে বলতে হলো না। মোহ স্পষ্ট বিনয়ের সাথে বলল,
“আপনারা যা ভাবছেন তা একদমই নয়।আমি শুধু আপনাদের ভাইকে সাহায্য চেষ্টা করেছি। যেটা আমার স্বভাব। আপনারা হয়ত উনার বাড়ির লোক। তাই আশা করছি আমার কাজ এখানে শেষ। আমি তাহলে আসি।”

মোহ চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে ধাবিত হয়। ফারাহ চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“হেই স্টপ!”

ফারাহর এমন আচরণে থতমত খেয়ে নিশ্চল হলো মোহ। ফারাহ তার সংলগ্নে এসে একেবারে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোহকে যাচাই করে নিয়ে খপ করে মোহের গালে হাত দিয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে বিচক্ষণ মানুষের ন্যায় বলে ওঠে,
“দেখতে একটা ছোটোখাটো গুরিয়ার মতো। কিন্তু কথাবার্তায় এমন নিমফলের মতো কেন? লিসেন, আমি ফারাহ সাহের যা মুখ দিয়ে বলি সেটা দেরিতে হলেও সত্যি হয়। যেমন গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে। আমি ওটাকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি। ফারাহর কথা বাসি হলেও ফলে। সো ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট মি, ডিয়ার।ওকে?”

মোহ আকাশসম বিস্ময়ের সহিত তাকিয়ে রইল ফারাহর পানে। ফারাহ মেয়েটির সকল কথা একপ্রকার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল তার। চোখ স্বচ্ছের দিকে আবদ্ধ হতেই সে ইশারা করতে থাকল যেন মোহ ফারাহর কথা একেবারেই মনে না নেয়। মোহ দ্রুত জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
“আজ আমার কাজ আছে। অনেকক্ষণ বাহিরে আছি। মা চিন্তা করছে। আমি আসি।”

বিলম্ব না করে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল মোহ। যাওয়ার পথে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“যেমন লোক তার তেমন ভাই-বোন। পা/গল করে দেওয়ার উপক্রম!”

রিসেপশন পেরোতেই মোহ এবার আচানক সামনাসামনি হয়ে যায় সরোয়ার সাহেবের। মোহকে দেখে বেশ অবাকই হন তিনি। সেই সঙ্গে মনের পুরোনো কিছু রোষ জেগে ওঠে। তবে মোহ বিনাবাক্যে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করতেই অসময়ে আজহার সাহেবকে চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পেল মোহ। আশ্চর্য হয়ে বাবার নিকট যেতেই আজহার সাহেব মেয়েকে দেখে মলিন কণ্ঠে বললেন,
“মোহ মা! এসে গিয়েছ?”

“হ্যাঁ বাবা। কিন্তু তুমি এখন বাড়িতে। কিছু হয়েছে? তোমার তো এ সময় স্কুলে থাকার কথা। ক্লাসে পড়ানোর কথা।”

মোহকে আরো চরম বিস্মিত করে দিয়ে আজহার সাহেব মাথা নুইয়ে অপরাধীর মতো বললেন,
“চাকরি থাকলে তবে তো পড়াব তাই না?”

“মানে? কী বলছ তুমি বাবা? চাকরি নেই মানে কী?”

আজহার সাহেবের কাছে তৎক্ষনাৎ বসে পড়ে উনার কাঁধে হাত রেখে বড্ড বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে মোহ। না চাইতেও আজহার সাহেবের মতো একজন পুরুষের চোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। অশ্রু লুকাতে চাইলেন তিনি। ভাঙা গলায় বললেন,
“একজন অপরাধীর কি যোগ্যতা থাকে শিক্ষক হওয়ার?”

মোহের কণ্ঠস্বর এবার আঁটকে এলো। সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি এখনো সেই না অপ/রাধ করে জে/লে যাওয়ার লেশ সবখানে ছড়িয়ে পড়বে। সে প্রায় কান্নারত গলায় বলতে থাকল,
“কে তোমাকে এসব বলেছে বাবা?”

“কে আর বলবে? জানতে কারোরই বাকি নেই। রাতুলের মা যিনি আগে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি তো জেনে ফেলেছেন আমাকে কীভাবে টেনেহিঁচড়ে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। পুরো পাড়ায় ছড়িয়েছে। আজ স্কুলে গিয়ে অফিসরুমে ঢোকামাত্র প্রিন্সিপাল স্যারের ডাক আসে। আমি উনার কাছে গেলে উনি সাফ জানিয়ে দেন, আমার মতো মানুষ যাকে জে/লে রাত কাটাতে হয়েছে তাকে শিক্ষক হিসেবে মানতে চাইছে না কেউই। অসংখ্য অভিভাবক অভিযোগ করেছে একজন অপ/রাধী যেই স্কুলের টিচার সেখানে তারা সন্তানদের পড়াবেন না। বিধায় আমাকে চলে আসতে হয়েছে। আর কখনো মাথা উঁচু করে স্কুলে যাওয়া হবে না।”

মোহের অনুতাপ বাড়তে থাকল একটু একটু করে। ধপ করে বসে পড়ল আজহার সাহেবের পায়ের কাছে। অপ্রস্তুত হয়ে সোজা হয়ে বসলেন আজহার সাহেব। তখনি লেবু পানি নিয়ে উপস্থিত হলেন মিসেস সুফিয়া। মোহ আজহার সাহেবের হাঁটুতে হাত রেখে অস্পষ্ট গলায় বলে উঠল,
“তোমার সম্মান, তোমার গৌরব আমি মিশিয়ে দিলাম বাবা। সব আমার দোষ ছিল। আমি উচিত জবাব দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। আমার বোঝা উচিত ছিল ওদের সাথে আমরা কখনোই পারব না। আমায় ক্ষমা করো বাবা। আমায় ক্ষমা করো।”

কথাগুলো বলতে বলতে গাল বেয়ে পানি পড়ে গেল মোহের ফোলা গালে। অপ/মানের যন্ত্র/ণায় ফোঁপাতে থাকল সে। আজহার সাহেব দ্রুত নিজের মেয়েকে কাছে টেনে বসান কাছে। মিসেস সুফিয়াও হন্তদন্ত হয়ে বসেন মেয়ের আরেক পাশে। মোহের মাথা নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে কপাল বুলিয়ে শান্ত সুরে বলতে থাকেন,
“তুই হয়ত সবসময় আমাকে ভুল বুঝেছিস। কারণ আমি তোকে মুখের উপর স্পষ্ট কথা বলার জন্য, কঠিন কথা সহজে বলে ফেলার জন্য অনেক বকেছি, শা/সন করেছি। কিন্তু এসব কেন করেছি এখন বুঝতে পারছিস নিশ্চয়! মুখ তারাই খুলতে পারে যাদের বিপুল অর্থ থাকে। আর যাদের থাকে না তাদের মুখ বন্ধ রাখে বিত্তশালীরা। যদি মুখ বন্ধ না থাকে তারা ভয়া/নক পর্যায়ে নিয়ে চলে যায়। তাই নীরবে সয়ে যাওয়া অত্যাধিক ভালো।”

মোহ এবার সম্মতি জানায় মায়ের কথায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আজহারে সাহেবের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমি আজ এখনি স্কুলে যাব। যা বলার দরকার তাই বলব। আসল সত্যিটা বলব। বাবা কিছু করেনি। সেটা সবার জানা দরকার।”

“তোকে বললাম যে নীরব থাকা ভালো। এখন তুই কিছু বলতে গেলে সবাই আরো উল্টো ভাববে। এমনি অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে। আর না।”

মোহ হার মানতে চাইল না। মায়ের কথার জবাবে ঢক গিলে বলল,
“কিন্তু মা, বাবার চাকরি…”

“কিছু করার নেই। ঘরে যাও। সৃষ্টিকর্তা যা ভেবে রেখেছেন তাই হবে। এসব নিয়ে যত ভাববে ততই চিন্তা হবে। রাগ হবে।”

আজহার সাহেবের কথায় স্তম্ভিত হয় মোহ। যেই মানুষ নিজে তাকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে সেই মানুষ যখন নিজেই নিভে গেল তখন মোহও নিজ থেকে আর শক্তি পেল না যেন। ঢুলঢুল আঁখিতে এলোমেলো পায়ে নিজ ঘরে পা রাখল সে। ইথান তখনও ঘুমে। তার দিকে চেয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে নিজেকে হালকা করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলো মোহ। ডুবে রইল শুধু হতাশায়।

মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। তার লোচন দুটো নিচের দিকে স্থির। মুখটা ভার। পাশেই বসে তাকে এক দৃষ্টিতে দেখছেন সরোয়ার সাহেব। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তাদের দুজনের ভাবভঙ্গি একনাগাড়ে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন মিসেস জেবা। এবার তিনি ছেলেকে বললেন,
“কথা বলছ না স্বচ্ছ? কথা বলো। এটা কেমন আচরণ বাবার সাথে?”

“কী এমন খারাপ আচরণ করলাম উনার সাথে আবার? যদি উনার মনে হয়ে থাকে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি উনার সাথে তবে উনি মোহের বাবার মতো আমাকেও জে;লে দিতে পারেন।”

মিসেস জেবা এবার ছেলের কথা চটে গেলেন। ধমকে বলে উঠলেন,
“স্বচ্ছ!”

বাকি কথা বলার আগে সরোয়ার সাহেব ইশারায় থামিয়ে দিলেন নিজের স্ত্রীকে। তিনি নিজে বুঝে নিলেন ছেলের সামনে এবার তাকে অনুতপ্ত হবার ভান ধরতে হবে। কেননা, নিজের র:ক্তের ছেলেকে কখনোই নিজের কাছ থেকে হারাতে চান না উনি। তাই তিনি নম্র গলায় বললেন,
“স্বচ্ছ, আমি জানি তোমার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আমিও লজ্জিত। আমিও তখন রেগে গিয়েছিলাম। রাগের মাথায় ভুল একটা কাজ করে ফেলেছি তুমি তা ধরিয়ে দিয়েছ। কিন্তু একটা ভুলের জন্য নিজের বাবাকে এভাবে অবজ্ঞা করো না।”

“বাবা একটা কথা জানো? যেই লোকটাকে তুমি অযথা শায়েস্তা করার জন্য জে;লে পাঠিয়েছিলে সেই লোকটির মেয়ে নিজ দায়িত্বে তোমার ছেলেকে হসপিটাল অবধি নিয়ে এসেছে?”

এবার চুপ রইলেন সরোয়ার সাহেব। স্বচ্ছ আরো বলতে থাকল,
“অন্য যে কেউ কাজটা করতে পারত। কিন্তু ওই মেয়েটাই আমায় সাহায্য করেছে সবটা জেনেও। তাহলে তুমি বুঝতে পারছ তোমার ভুলটা ঠিক কোথায়?”

নিজের মাঝে ক্রোধের আ/গুন পুষতে থাকলেন সরোয়ার সাহেব। তবে মুখে প্রকাশ করলেন। স্বচ্ছের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে হলো উনার কাছে। বললেন,
“বুঝতে পারছি আমি।”

“তাহলে আশা করি তুমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।”

স্বচ্ছের কথায় নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্মতি জানাতে বাধ্য হলেন সরোয়ার সাহেব। তবে নিজের অহংকারের একটুও চূর্ণ হলো না উনার।

রাতেও ঠিকমতো ঘুমটা আসেনি মোহের চোখজোড়ায়। দুটো নেত্রপল্লব জুড়ে ছিল শুধু চিন্তা। শুধু ভেবেছিল কোনোভাবে যদি সবকিছু ঠিক হয়ে যেত! যদি অতিতের মতো সৌন্দর্য ফিরত জীবনে। কিন্তু তার আর হয়ত সম্ভবই নয়। কারণ মানুষের জীবন সবসময় একই রেখায় চলে না। শেষ রাতে ঘুম এসেও তা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কারণ ছিল মোহের প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন।

সকালে কোনোরকমে খাওয়াদাওয়া করে স্বচ্ছের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে মোহ। সে যেতে না চাইলেও যেন কোনো দায়িত্ববোধ থেকে গিয়েছে মানুষটির প্রতি। মনে হয়েছে আজ অন্তত দেখা করা দরকার। কেমন আছে মানুষটি তা জানা দরকার। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে গতকালকের একই বাহানা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো সে। গলি বেরিয়ে মোড়ে দেখতে পেল না কোনো অটো। তাই আস্তে আস্তে সামনে হাঁটা ধরল। কিছুটা সামনে হরেকরকম ফলের দোকান। সেখানে কিছুটা অটোর চলাচল বেশি। দাঁড়িয়ে রইল মোহ একটি অটোর অপেক্ষায়। রৌদ্রতেজে ঘামছে হালকা মুখ। এদিক ওদিক তাকিয়ে অটোর খোঁজ করতেই এক চেহারার মাঝে থমকাল তার লোচন। বড়ো বড়ো তার আঁখি দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তিটির চোখে সানগ্লাস। মোহ ভালো করে চোখ পাকিয়ে দেখল। সে ভুল দেখছে না তো? না ভুল নয়। মানুষটি ফলের দোকান থেকে বিভিন্ন ফল কিনে বিল মিটিয়ে কালো রঙের গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠল। মোহ দৌড়ে যেতে চাইল। কলার চেপে জবাবদিহি চাওয়ার তীব্র বাসনা জাগল। কিন্তু সায় দিলো না দুটো পা। অবশ হয়ে এসেছে শরীর। গাড়িটাকে চলে যেতে দেখল সে। দুহাত মাথায় চলে গেল তার। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলে উঠল,
“এই অমানুষ এই শহরে রয়েছে!”

চলবে..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here