যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -১৪+১৫

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৪

সকাল তখন সাতটা। বর্ষণের কালো মেঘ কেটে গিয়ে বেরিয়েছে আজ ঝকঝকে সূর্যের আলো। ফ্যানের স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ বাড়ল। তৎক্ষনাৎ গতি কমিয়ে ঘুমন্ত ইথানের পাশে বসল মোহ। মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে এখনো নিদ্রাই কিনা! নিশ্চিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশেই মায়ের ঘরে পা রাখল সে। দেখতে পেল মিসেস সুফিয়া জায়নামাজেই তীব্র ঘুমে আচ্ছন্ন। সারারাত মানুষটি কান্নাকাটি করেছে। মাকে আর ডাকল না সে। আস্তে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে গলি দিয়ে হাঁটা ধরল। উদ্দেশ্য বাবার কাছে যাওয়া। তার মন আর টিকছে না। দরকার পড়লে সেখান থেকে স্বচ্ছের বাড়িতে যাবে সে। কথা বলবে স্বচ্ছের বাবার সাথে। তবুও নিজের বাবাকে যেভাবেই হোক ছাড়িয়ে নেবে।

মোহকে পুলিশ স্টেশনে দেখেই একদফা বিরক্তি হলো ইন্সপেক্টর। মোহ সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখমুখ কুচকে ইন্সপেক্টর বললেন,
“তুমি আবার এসেছ? তোমাকে বলেছি না যতক্ষণ উপর থেকে নির্দেশ আসবে ততক্ষণ তোমার বাবাকে ছাড়তে পারব না।”

মোহ শুকনো মুখে বলল,
“আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিছু সময় কথা বলতে চাই।”

ইন্সপেক্টরের তবুও যেন কোনো হেলদোল হলো না। কঠোর ভাবে বারণ করে দিলেন মোহের মুখে উপর।
“তোমার জন্যই তো তোমার বাপ জেলে পঁচে এখন। দরদ দেখিয়ে কী হবে? ওতো দেখা করতে দিতে পারব না আমি।”

“আমি তো উনাকে ছেড়ে দিতে বলিনি। অনেকক্ষণ বাবাকে দেখিনি। শুধু দেখতে চাই। কিছু কথা বলতে চাই। এতটুকু তো করাই যায় তাই না?”

“না যায় না। সবার জন্য করা গেলেও তোমার জন্য এতটুকু করা যাবে না। যাও তো এখান থেকে। বেশি বিরক্ত করলে তোমাকেও তোমার বাবার অবস্থানে ফেলতে সময় লাগবে না। রাগিয়ে দিও না আমাকে।”

ইন্সপেক্টর আর মোহের তর্ক বিতর্ক চলমান অবস্থায় সেখানে এক পুরুষালী কণ্ঠ দাপট দেখিয়ে কিছু কথা ঝেড়ে দিয়ে কিছু কাগজ ইন্সপেক্টরের টেবিলে ছুঁড়ে দিলো।
“আমার দলের ছেলেদের এখনি দেন ইন্সপেক্টর। কাগজ সব রেডি।”

মোটা এবং ভারী কণ্ঠস্বরে পুলিশের জবান বন্ধ হলো। কথার মাঝে এরূপ বাঁধা পড়ায় কপাল ভাঁজ করে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মোহ। সাদা শার্ট পরিহিত এক অগোছালো অগোছালো পুরুষ। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। ছোটো চক্ষুদ্বয় তার ইন্সপেক্টরকে যেন হু/মকি দিচ্ছে। ইন্সপেক্টর নিজেকে ধাতস্থ করে লোকটির উদ্দেশ্যে বলল,
“কাগজপত্র চেক করতে সময় লাগবে। তাছাড়া তোমার ছেলেপেলে যা কাজকর্ম করেছে সেখানে তো ছাড়া পাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার।”

লোকটির ভাবান্তর হলো না। কটমট করে বলে উঠল,
“এসব ভাঁওতাবাজি শৌভিকের সাথে করতে আসবেন না। কারণ কী বলুন তো? হঠাৎ করে আমার বাবার ছেলেপেলেদের মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে এখানে তুলে আনার মানে কী? ওরা যে ড্রা/গ সাপ্লাই করছিল তার প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

দমে গেলেন ইন্সপেক্টর। কিছুটা নির্জীব হয়ে গেলেন। কণ্ঠস্বর হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। তবুও কিছু বলতে চাইলেন তার আগেই লোকটি আবার বলল,
“জানি এটা মন্ত্রী সাহেবের কাজ। আমার বাবা যেন আবারও ভোটে হেরে যায় সেই ব্যবস্থা করতে চাইছেন। কিন্তু ইন্সপেক্টর এখন আমাকে বাহানা না দেখিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে ছেলেদের ছাড়ুন। বাকি কাগজপত্র সব আমার উকিলের সাথে দেখে নিন। আধঘণ্টার মধ্যে কাজটা কমপ্লিট না হলে খবর আছে।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত থামল না শৌভিক। হনহনিয়ে খানিকটা দূরে চলে যেতেই মোহ ফের রাগ এবং ক্রোধন সংমিশ্রণের সুরে বলল,
“আমি আমার বাবার সাথে দেখা করতে চাই। আপনার কাজ আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু উপরমহলের লোকজনদের কথা শুনে ন্যায় অন্যায় ভুলে গিয়ে আপনারা সৎ মানুষটিকে অবধি ছাড়ছেন না। কেন এই সুন্দর একটি চাকরিকে অপমান করছেন? মন্ত্রী সাহেবের কথায় অন্যায় করছেন আপনি।”

“হুমম করছি তো কী করবে? কী করতে পারো তাই দেখি।”

পুলিশের একরোখা আচরণের কাছে টিকতে পারল না মোহ। এবার তীব্র শক্ত করে রাখা মনটি আস্তে আস্তে ভেঙে এলো। গলার কান্না আঁটকে গেল। ইন্সপেক্টরের সামনে টিকতে পারল না সে। ওড়না সামলে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হলো বাহিরে। মুখে হাত দিয়ে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়তে হলো সেখানেই। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চিকন ফ্রেমের চশমা পরার মালিকটির তীক্ষ্ণ নজর এড়ালো না। মেয়েটির সঙ্গে ইন্সপেক্টরের বেশ কিছু কথাবার্তা শুনেছে সে। জানার অদম্য আগ্রহ বেড়ে চলেছে মনের মাঝে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে অবশেষে মোহের সন্নিকটে গিয়ে থেমে গেল শৌভিক। কিছুক্ষণ আগে সেই কড়া কণ্ঠস্বর নিভে গিয়ে নম্র সুর বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।
“এক্সকিউজ মি! ক্যান আই হেল্প ইউ?”

অচেনা সেই পুরুষের সাহায্য করার কথা শুনে কান্না আপনাআপনি রোধ হলো মোহের। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। তার এই চাহনিতে অস্বস্তিতে পড়ল শৌভিক। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
“এক্সিডেন্টলি আমি আপনার এবং ইন্সপেক্টরের কিছু কথা শুনে ফেলেছি। আপনার বাবা কি কাস্টারি আছে? এর কারণ কী? তখন বললেন মন্ত্রী সাহেবের কথা! আসলে আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। আপনি বললে সাহায্য করতে পারলে অবশ্যই করব।”

মোহের মনে কেন যেন আশার আলো জাগল না। সে হতাশা নিয়ে প্রতিত্তোর করল,
“আপনি আর কী সাহায্য করবেন?”

“অচেনা বলে অবহেলা করবেন না প্লিজ! আমরা সাহায্য করতে ভালোবাসি। আর যতটুকু আপনাদের কথোপকথন শুনলাম মনে হলো বিষয়টা রাজনীতি অথবা মন্ত্রীর সাথে জড়ানো। খুবই জটিলতা রয়েছে। বাকিটা আপনি একটু বিষয়টা খুলে বললে বুঝতে সুবিধা হতো।”

অনেকটা নিরাশা নিয়েই মোহ শৌভিক নামক ব্যক্তিটির কাছে সব প্রকাশ করল। পুরোটা বেশ মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করল শৌভিক। সবশেষে ওষ্ঠদ্বয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“এদের তো কাজই এটা। যখন যাকে পারছে ধরে নিয়ে আসছে। আর অপরাধীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাহিরে হাসিখুশি অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখি আমি আপনার জন্য কী করতে পারি!”

শৌভিক ফিরে পুলিশ স্টেশনে ঢুকে ফের গটগট করে গিয়ে ইন্সপেক্টরের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসল। আচমকা তার এমন ব্যবহার চমকাল ইন্সপেক্টর। ভাবল, এখনো তো আধঘণ্টা হয়নি! তাহলে কী ব্যাপার? ইন্সপেক্টরের ব্যগ্রতাকে তাচ্ছিল্য করে শৌভিক বলল,
“তা আজকাল কত টাকা সাইড ইনকাম করছেন মন্ত্রীদের থেকে?”

আচানক তার এই প্রশ্নে ঘাম ছুটল ইন্সপেক্টরের। কোনোরকমে বলল,
“আমি তো তোমার ছেলেপেলেদের ছেড়ে দিব। তোমার উকিলের সাথে কথা চলছে।”

শৌভিক সঙ্গে সঙ্গে দায়সারাভাবে বলল,
“সেই সাথে আজহার সাহেবকেও ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলুন তো!”

ইন্সপেক্টরের চোখ তখন কপালে। মোহ ধীর পায়ে আসে সেখানে। তাকে দেখে ইন্সপেক্টরের বুঝতে বাকি থাকে না মোহ সবটাই হয়ত শৌভিককে বলে ফেলেছে। তিনি আমতা আমতা করে বললেন,
“উনাকে তো ছাড়া যাবে না শৌভিক। তুমি নিজের কাজে এসেছ নিজের কাজ শেষ হলে চলে যাও। অন্যের বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাকে আর প্রেশার দিও না।”

“প্রেশারের দেখলেন টা কী? যদি উনাকে না ছেড়েছেন তাহলে কোনদিক থেকে প্রেশার দিতে হয় আমি ভালো করে জানি। আমার বাবা মন্ত্রীর পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে নি বলে এমন না যে আমরা কিছুই করতে পারি না।”

“আরে ভাই! বোঝো না কেন? উপরমহল থেকে নির্দেশ এটা। এই মেয়েটা মন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে যা নয় তাই বলে এসেছে। অভদ্রতা করে এসেছে।”

“তো কাউকে ঠকানোর পর প্রতিবাদ করা যদি অভদ্রতা হয় তবে প্রতিটা ঘরে এমন অভদ্র মেয়ে মানুষ থাকা উচিত।”

ইন্সপেক্টর খুব ভালোভাবে বুঝে নিলেন শৌভিককে বোঝানো সম্ভব নয়। শৌভিক ফের বলল,
“যা করার দ্রুত করে ফেলুন। মেয়েটার কাছে নাকি কাগজপত্র সব আছে। সো আশা করি কোনো সমস্যা হবে না ছাড়াতে। যদি সেটা না হয় তাহলে একটা কল করব তারপর মিডিয়া, আমার বাকি ছেলেপেলে সবাই হাজির হবে। তখন ব/ন্দুক দেখিয়ে সবাইকে থামাতে পারবেন তো?”

বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন ইন্সপেক্টর। শৌভিক বেশ বুঝতে পারল তার কাজ হয়ে গেছে। কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল সে। মোহ কিছু বলার সুযোগও পেল না। ইন্সপেক্টর তৎক্ষনাৎ বলল,
“এই মেয়ে! তোমার উকিলকে ডাকো এখনি। যত্তসব ঝামেলা আমার ঘাড়েই আসে। জানি না মন্ত্রী সাহেব এখন কী করবেন শুনলে।”

মোহের ফ্যাকাশে, শুষ্ক ঠোঁটে অসাময়িক হাসির বাহার ভেসে ওঠে। মনে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। সে দ্রুত হাতে ফোন নিয়ে বাহিরে চলে আসে তার মামাকে কল করতে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে আশেপাশে সেই শৌভিক নামক ব্যক্তিটিকে খুঁজতে থাকলেও তাকে আর পায় না মোহ।

সোফায় একধ্যানে বসে রয়েছেন সরোয়ার সাহেব। চশমার গ্লাসের নিচে উনার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। মিসেস জেবা উনার জন্য চা নিয়ে ঘরে এসে দেখলেন স্বামীকে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতে। চিন্তার বিষয়টা বুঝতে দেরি হলো না মিসেস জেবার। তিনি সরোয়ার সাহেবের কাছে বসলেন।
“স্বচ্ছকে নিয়ে ভাবছ? এত ভেবো না। হাই ব্লাড প্রেশার তোমার। শরীর খারাপ করতে পারে। তাছাড়া ওকে তো চেনো। ও একটু এমনই একটু উগ্র, রাগচটে।”

“স্বচ্ছ কখনো আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি।”

মিসেস জেবার কথার উত্তরে গম্ভীর জবাব দেন সরোয়ার সাহেব। মিসেস জেবা তবুও বোঝানোর চেষ্টা করেন।
“তোমার সঙ্গে এই ব্যবহার করে ও নিজেও ভালো বেই। আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম। একদম মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। কথা বলছে না।”

সরোয়ার সাহেব রাগে কটমট করে বলেন,
“আমাকে এসব বোঝাতে এসো না তুমি। আজ সামান্য একটা মেয়ের জন্য নিজের বাবার সাথে সে এরকম করছে। ভবিষ্যতে কী করবে? ওর এই দুর্ব্যবহার আমি মানতে পারছি না। তাও ওইরকম একটা মেয়ের জন্য!”

“ওকে তো তুমি চেনো। ও কখন কী করে নিজেও জানে না। ওর এমন হঠকারিতায় কষ্ট পেও না। আচ্ছা, তুমিই বা এমন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বলো তো? ওই মেয়েটাকে যা ইচ্ছে করতে দাও না। কিন্তু কেন শুধু শুধু তার বাবাকে ধরিয়ে দিতে গেলে?”

“তো শিক্ষা দেব না? ওই মেয়েটা কাকে কী বলেছে জানে? চেনে আমাকে?”

মিসেস জেবার মুখটা চুপসে গেল। মিনমিন করে বলল,
“ভাগ্যিস ভুল করে ওই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ আর এগোয় নি।”

কথাগুলো কর্ণকুহরে আসা মাত্র বি;স্ফোরিত চোখে দৃষ্টিপাত করেন সরোয়ার সাহেব নিজের স্ত্রীর দিকে। কঠিন সুরে প্রশ্ন করেন,
“মানে?”

মুখ ফসকে কথাগুলো বের করে দিয়ে নিজেই বিপাকে পড়ে গেলেন মিসেস জেবা। নিচু সুরে বলতে লাগলেন,
“আমরা না বুঝে মেয়েটার বাড়িতে গিয়েছিলাম বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। সৌমিত্র মজা করে বলেছিল স্বচ্ছ নাকি পছন্দ করে। সেটা শুনে যামিনী আপা অস্থির হয়ে ওঠেন। আমারও মনে হয়েছিল যে আমার ছেলেটা একজনকে পছন্দ করে তার সঙ্গে বিয়ে হলে ক্ষতি কী! তাই মেয়েটার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। এই আর কী! কিন্তু সৌমিত্র সব ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে স্বচ্ছ মেয়েটাকে ভালো টালো বাসে না।”

সরোয়ার সাহেব চুপ করে রইলেন কিছুটা সময়। গভীর কিছু চিন্তা করে বললেন,
“ভালোবাসে না নাকি বাসে বুঝতে তো পারছি না।”

মিসেস জেবা ভীষণ বিস্মিত হয়ে বললেন,
“কী বলছ?”

“না কিছু না।”

“ইন্সপেক্টরের কাছে কল করেছিলে? যেন মেয়েটার বাবাকে ছেড়ে দেয়?”

“না এখনো করিনি।”

মিসেস জেবা বাবা ছেলের মাঝে পড়ে দিশাহারা হলেন যেন।
“সে কী এখনো করো নি? ওদিকে স্বচ্ছ বেরিয়ে গেল কোথায় যেন। আমার তো মনে হচ্ছে পুলিশের কাছেই গেল। ওখানে গিয়ে নতুন ঝামেলা বাঁধাবে। তুমি ওর দিকে তাকিয়ে হলেও মেয়েটার বাবাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

মিসেস জেবার শেষ কথাগুলোতে মিনতি স্পষ্ট। সরোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“হুমম করছি।”
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫

সবে মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে নিজের মনের মাঝে জমিয়ে রাখা সমস্ত জটিলতা ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টায় খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন সরোয়ার সাহেব। তবে তার এই খবরের কাগজের প্রতি মনোযোগ বেশি সময় টিকল না। কল এলো। রিংটোন বাজল। পাশে এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকা কামাল সরোয়ার সাহেবের মনোযোগে যেন বিঘ্ন না ঘটে তাই কল রিসিভ করলেন। কিছু কথা বলার পর গলা খাঁকারি দিয়ে সরোয়ার সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“স্যার ইন্সপেক্টর কল করেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।”

সরোয়ার সাহেব কোনো কথা বলা ব্যতীত হাত এগিয়ে ফোন চাইলেন। কামালের থেকে ফোন নিয়ে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর অসহায়ের ন্যায় বললেন,
“শৌভিক মীরের কথা শুনে তো আগেই মেয়েটার বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলাম স্যার। আপনার কথা শুনে দ্রুত ছেড়ে দিয়েছি। তাও আমার সাথে এমন হলো কেন?”

সরোয়ার সাহেব ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে শুধালেন,
“কী হয়েছে?”

“আপনার ছেলে এসেছিল। আমার উপর যাবতীয় সব রাগ ঝেড়ে দিয়ে গেছে। আমার ইউনিফর্মের কলার ধরে যা নয় তাই বলেছে। আর বলেছে, ‘নেক্সট টাইম কারোর দালালী করলে পরিণাম ভয়ানক হবে আমার। চাকরি কেঁড়ে নিবে, জীবন্ত পুঁ/তে দিবে। আপনারও যদি কথা শুনি তাও পরিণতি ভালো হবে না। কিন্তু স্যার আপনার জন্যই তো এসব কিছু করেছিলাম তাই না। এদিকে আপনার ছেলে হু/মকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার এতগুলো কনস্টেবলের সামনে বেই/জ্জতি করে দিয়ে গেল।”

সরোয়ার সাহেব রাগে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,
“তুমি এটারই যোগ্য আসলে। ইউজলেস!”

“স্যার এটা কিন্তু আমার সাথে ঠিক হচ্ছে না। আমি আপনার কথাতেই কাজটা করেছিলাম।”

“কিন্তু ছেড়ে দিয়েছ কার কথায়? ওই শায়েখ মীরের ছেলের কথায়! ওর কথায় ছাড়তে বলেছি লোকটাকে?”

“আমি কী করব স্যার? আমি নিরুপায় ছিলাম। ও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল রীতিমতো! ভয় তো আমারও আছে। কিন্তু এর জন্য চাকরি নিয়ে টানাহেঁচড়া করবেন না স্যার প্লিজ।”

সরোয়ার সাহেব কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
“স্বচ্ছ আমি ব্যতীত কিছু করতে পারবে না। আমি না বললে তোমার চাকরি কেন যাবে? যাবে না। ওর কথায় ভয় পাওয়ার দরকার নেই। রেগে গেছে তাই এমন করেছে। ওকে আমি সামলে নেব।”

পুলিশ ইন্সপেক্টর আশ্বস্ত হয়ে বললেন,
“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ স্যার।”

কল কেটে দিলো সরোয়ার সাহেব। কামাল ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে স্যার? কোনো সমস্যা?”

“কী আর হবে! একটা বাহিরের মেয়ের জন্য যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে আমার ছেলে। অসহ্য লাগছে এখন আমার। আজ আসুক বাড়িতে।”

“জি স্যার। সে অন্যরকম হলেও আপনার সঙ্গে কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে দেখিনি।”

“তাহলে ভাবো আমার কেমব লাগছে! ওই মেয়েটার জন্য আমার ছেলে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আমি এই বিষয়টা মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু কিছু করতেও পারছি না।”

কামাল আর প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। মিনিট দশেক পরে বাইকের চাবি উপরে ছুঁ/ড়ে ক্যাচ করতে করতে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে দেখা গেল স্বচ্ছকে। সরোয়ার সাহেবকে দেখেও সে না দেখার ভান করে চলেই যাচ্ছিল তবে সরোয়ার সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ভার গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
“দাঁড়াও তুমি। কোথায় গিয়েছিলে?”

“এই খবর এতক্ষণে তোমার দালালী করা লোকজন তোমাকে দেয়নি যে আমি কোথায় গিয়েছিলাম?”
স্বচ্ছের দায়সারা উত্তরে মেজাজ চড়ে গেল সরোয়ার সাহেবের।

“তোমার এত অধঃপতন হলো কবে থেকে? সত্যি করে বলো তো ওই মেয়েটা বা মেয়েটার পরিবার তোমার সঙ্গে কিছু করেছে নাকি? আমি তোমায় চিনতে পারছি না কেন?”

স্বচ্ছ যেন কর্ণপাতও করল না বাবার কথা। জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল সে।

আজহার সাহেবকে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছেন মিসেস সুফিয়া। এত প্রতীক্ষার পর নিজের স্বামীকে দেখে খুশিতে চোখ দিয়ে পানি গড়গড়িয়ে পড়ছে উনার। মোহ ইথানকে কোলে নিয়ে বসে থেকে মা-বাবার সুন্দরতম দৃশ্য উপভোগ করছে। স্ত্রীর এত অশ্রুবর্ষণ দেখে আজহার সাহেব শান্তনা দিয়ে বলে ওঠেন,
“সুফিয়া! দেখো আমি তো চলে এসেছি। এত কাঁদছ কেন? তোমায় কাঁদতে দেখতে আমার ভালো লাগে না। তোমার ওই রাগী চেহারা আমার প্রিয়!”

“তোমার ধারণা আছে? আমার একেকটা মুহূর্ত কীভাবে কেটেছে? আজকেও যদি তোমায় পুলিশ না ছাড়ত তাহলে আমি পাগলই হয়ে যেতাম।”

আজহার সাহেব মৃদু হেসে বলে ওঠেন,
“আরে বাবা ছাড়বে না কেন! আমি কী করেছি যে ওরা আমায় ধরে রাখবে?”

মিসেস সুফিয়া আজহার সাহেবের হাত ধরে মিনমিন করে বলেন,
“না, তুমি জানো না। ওদের কোনো কারণ লাগে না। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া যে তোমায় ফিরে পেয়েছি। ওরা তোমার গায়ে হা/ত তোলেনি তো বলো?”

“না তোলেনি। কিছু হয়নি আমার। তুমি শুধু শান্ত হও।”

এবার সুফিয়া রাগ ঝাড়তে আরম্ভ করলেন নিজের মেয়ের প্রতি।
“শান্ত হবো কী করে! তোমার মেয়ে কি শান্ত হতে দেয় আমায়? নিজে ঝামেলায় পড়বে তো পড়বেই। সবাইকে ঝামেলাই ফেলবে।”

সব সহ্য করতে পারলেও যেন মেয়ের প্রতি রূঢ় আচরণ মানতেই পারেন না আজহার সাহেব। তিনি প্রশ্রয় দিয়ে বলেন,
“আহা, সুফিয়া! ওর কী দোষ? কোথাও কোনো ঝামেলা, অন্যায়, অপরাধ দেখলে মুখ তুলে কথা বলা আমিই ছোটোবেলা থেকে শিখিয়েছি। সেকারণে যদি অ/ন্যায়কারী ভয় পেয়ে এই কাজ করে আমাদের সাথে তাহলে ওর দোষ কোথায় বলো।”

“হ্যাঁ! শুধুমাত্র তোমার আশকারা পেয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।”

মোহ বেশ ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারল তার মা তার উপর কতটা বিরক্ত। বাবার দিকে মলিন পানে তাকাল সে। উনার মুখটাও একরাতের ব্যবধানে কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছে। কতটা সম্মানহানি হয়েছে ভাবা যায়! মোহ অনুতপ্ত হলো।
“ভুলটা আমারই বাবা। আমি বারবার ভুলে যাই আমাদের শ্রেণির মানুষজনকে সবসময় চুপ থাকতে হয়। মুখ বুঁজে সব মেনে নিতে হয়। যদি উচিত কথা ভুলে বলে ফেলি তাহলে চরম শা/স্তির মুখোমুখি হতে হয়। আমি ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করো মা।”

মোহের কথায় নরম হলেন মিসেস সুফিয়া। খানিকটা শান্ত হয়ে মোহের নিকটে গিয়ে পাশে বসে বললেন,
“আজকের পর থেকে এসব কোনোরকম ঝামেলায় জড়াবি না তুই। মনে থাকবে? তোকে এসব নিয়ে ভাবতেই হবে না। ওই মন্ত্রী আর মন্ত্রীর ছেলের কথা বাদ দিবি।”

উত্তর দেওয়ার আগে একবার বাবার দিকে তাকাল মোহ। তার আর আগ্রহ নেই নিজের এসবে জড়িয়ে পরিবারকে কষ্ট দেওয়ার। বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে দিলো,
“আর হবে না এমন। যাই হয়ে যাক নিজেকে নতুন কোনো বিষয়ে জড়াব না।”

মিসেস সুফিয়া সন্তুষ্ট হলেন বেশ। আশ্বস্ত হয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। হঠাৎ জিজ্ঞেসা করলেন,
“আচ্ছা, তোর বাবাকে ছাড়িয়ে নিলি কী করে? মন্ত্রী সাহেব এত দ্রুত অনুমতি দিলো?”

“না, মা। উনি কখনো অনুমতি দিতেন কিনা তারও ঠিক নেই। একজন লোক হেল্প করেছেন।”

“কোন লোক?”

“অদ্ভুত একজন লোক। যেচে সাহায্য করতে পছন্দ করেন। বাবার জন্য একদফা পুলিশের সাথে কথা কা/টাকা/টি করে চলে গেলেন।”

আজহার সাহেব খানিকটা অবাক হলেন। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,
“তুমি চেনো তাকে?”

“না, বাবা। কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হলো এখনকার মন্ত্রীর পদে বসে থাকা সরোয়ার সাহেবের প্রতিপক্ষ উনার বাবা। বাকি সব জানার আগেই চলে গেলেন সাহায্য করে। আমাকে কথা বলার সুযোগই দিলেন না।”

মিসেস সুফিয়া বড়ো শ্বাস নিয়ে বললেন,
“সৃষ্টিকর্তা তাকে ভালো রাখুক।”

রাত হয়েছে বেশ। তিন ভাইবোন একসঙ্গে হয়েছে। স্বচ্ছের একপাশে সোমিত্র এবং অন্যপাশে বসে রয়েছে ফারাহ। সকলের মুখই চুপসে রাখা। গাম্ভীর্য ধারণ করে কিছু একটা ভেবে চলেছে সবাই।
“যা হয়েছে খুবই খারাপ হয়েছে মোহের বাবার সাথে।”

সৌমিত্রের কথায় ফারাহ তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। একবার চিন্তা করো ওদের পুরো পরিবারের উপর দিয়ে কত বড়ো ঝামেলা বয়ে গিয়েছে। বাবা এটা একদম ঠিক করেনি।”

“ঠিক করেনি সেটা আমিও জানি। কিন্তু এখানে আমি কী করতে পারি বা কী করা উচিত? বাবার কারণে হয়ত ও আর ওর পুরো পরিবার আমাকে খারাপ ভাবছে। এটা আমার কাছে খুবই অসম্মানজনক। আমি নিতে পারছি না।”

স্বচ্ছের এরূপ কথায় সৌমিত্র খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“কিন্তু কাজটা তো বাবা করেছে তুমি এত গিল্টি ফিল করছ কেন?”

“কারণ ও হয়ত ভাবছে সব জানার পরেও আমি কিছু করিনি। আমি হয়ত কোনো সাহায্য করার চেষ্টা করিনি। হয়ত বাবার মতোই আমাকে ভাবছে। কারণ দেখ, দুদিন আগেও আমি বাবার পক্ষে থেকে ওকে অনেক কথা শুনিয়েছি।”

স্বচ্ছের আজগুবি কথায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং গম্ভীর আলাপেও নিঃশব্দে হেসে ফেলল ফারাহ।
“মাই ডিয়ার ব্রাদার! এইতো দুদিন আগে তুমি ওকে সহ্যই করতে পারতে না। এখন ও তোমার সম্পর্কে কী ভাবল না ভাবল সেটা নিয়ে তুমি এত চিন্তিত হচ্ছো কেন? আগে তো কে কী ভাবল সেটা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা ছিল না।”

ফারাহর কথায় কিছুটা বিপাকে পড়ে যায় স্বচ্ছ। নিজের কর্মকাণ্ড ও চিন্তাভাবনার ধরণ দেখে নিজেই বিমূঢ় হয়ে পড়ল স্বচ্ছ। ফারাহ তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছের পরনের টিশার্টের বুকের অংশ খা/মচে মনোযোগ দিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বেশ প্রচণ্ড জ্ঞানবান হবার ভান ধরে বলল,
“আমার নাকে একধরণের তীব্র সুগন্ধ আসছে।”

সৌমিত্র ভ্রু উঁচিয়ে বোনের পাগল প্রলাপে সায় দিয়ে শুধাল,
“সেটা কীসের সুগন্ধ?”

ফারাহ দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“পেয়ার কি খুশবু!”

স্বচ্ছ চকিতে তাকালেও ক্ষেপে গেল মুহূর্তেই। যেন নিজের সকল অনুভূতি লুকিয়ে ফেলার তালে বলল,
“আমি সিরিয়াস আলাপ করার জন্য ডাকছি আর তোরা ফাইজলামি করছিস আমার সাথে? তোদের কী মনে হয়? অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছিস তো দুটোকেই বের করব ঘর থেকে।”

সৌমিত্র ভড়কে দিয়ে ভাইকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় বলল,
“ওকে ভাই রিল্যাক্স। আমরা বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। আমার কাছে সাজেশনও আছে।”

“কী সেটা?”

“তুমি ওর সাথে কথা বলো। সরি বলে দাও। ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নাও। দ্যাটস ইট!”

স্বচ্ছের কপাল কুঁচকে এলো সৌমিত্রের কথায়। একরোখা মনোভাব দিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি কেন সরি বলব? আমি কী করেছি?”

“ভাই, সবসময় কিছু করলে তবেই সরি বলতে হবে তার কোনো মানে নেই। এমনিতে মেয়ে মানুষকে কারণে অকারণে সরি বলতে হয়। যদি ওদের ভুল থাকে তবেও ছেলে জাতিকে সরি বলতে হয় যদি আমাদের ভুল থাকে তাহলে তো কথাই নেই।”

স্বচ্ছ সাথে সাথে বারণ করে দিলো,
“আমি পারব না এসব বলতে।”

ফারাহ তার ছোটো ভাইয়ের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
“ভাই তুমি কি নারী জাতিকে ইনসাল্ট করছ।”

“এটা ইনসাল্ট নয় চরম সত্য। আর ভাই ভুলটা হয়ত তোমার নয়। কিন্তু আমাদের বাবার ভুল তো। বাবা তো কখনোই ক্ষমা চাইতে রাজি হবে না। তার বদলে তার ছেলে হয়ে না হয় তুমিই বলে দিলে!”

স্বচ্ছ এবার কিছুটা হলেও সৌমিত্রের কথা মানতে বাধ্য হলো। কথাগুলো ভুল নয়। সে কিছুটা সময় ভাবতে না ভাবতেই ফারাহ তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আর দেরি নয়। এখনি কল করো।”

দুই ভাইবোনের চাপে আর পেরে উঠল না স্বচ্ছ। মনের সকল দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে ফোনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে খানিকটা অন্যপ্রান্তে গিয়ে মোহের নম্বরে কল করে কানে ধরে তার কণ্ঠস্বর পাওয়ার প্রতীক্ষাই রইল সে।

বাহিরে বাতাসের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছে পরিবেশ। কাঠের জানালা বারংবার শব্দ করে লেগে যাচ্ছে ফের খুলে যাচ্ছে। পর্দা লাগামহীন হয়ে উড়ছে। মোহ তড়িঘড়ি করে জানালা লাগাতে আরম্ভ করল। ফোনের রিংটোন কাজে বিঘ্ন ঘটায় তার। পাশের ওয়ারড্রবে থাকা ফোনটা নিয়ে মুখভঙ্গি পাল্টে গেল তার। হাজারো দ্বিধা ঘিরে ধরল তাকে। চুপসে গেল সুন্দর মুখখানা। স্মরণে এলো মাকে বলা কথাগুলো। সে আর এসব ঝামেলা, মন্ত্রী বা তাদের কারোর জটিলতায় জড়াতে চায় না। ফোনটা তৎক্ষনাৎ সাইলেন্ট করে আগের স্থানে রেখে দিলো মোহ। কলটাও কেটে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে চাইল মোহ। আঁড়চোখে খেয়াল করল আবারও কল এসেছে। মোহ পলকহীন দৃষ্টিতে মলিন মুখে তা দেখছে। মনটা খচখচ করছে ভীষণ। কল রিসিভ করে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একদফা ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে। পরক্ষণেই আচমকা অভিমানের মেঘ এসে হানা দেয় মোহের মনে। মনটা বলে, লোকটি তোকে বিশ্বাস করেনি। তোর কথা যাচাই করেনি। তোর পক্ষে সে ছিলই না। সে নিজের বাবার পক্ষে। সুতরাং, তার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রশ্নই আসেনা।

পাঁচবার কল করার পর থেমে গেল স্বচ্ছ। তার ধূসর আঁখির চাহনিতে সৃষ্টি হলো ক্ষোভ। ফারাহ এবং সৌমিত্রকে ধম/কে বলে উঠল,
“দেখলি দুজন? ম্যাডামকে কত কল করলাম। ম্যাডাম তুলল কল? তোরা অযথা কেন আমাকে দিয়ে এসব কাজ করাস বুঝিনা আমি।”

“ভাই, ও কল ধরেনি এতে আমাদের দোষ কোথায়? আমরা কী করেছি? আমি তো আমার মূল্যবান সময়ের তোয়াক্কা না করে তোমার এমন সিরিয়াস মুহূর্তে তোমার সাথ দিতে এলাম। তাছাড়া আমার মতো একটা ডিজাইনারের হাতে কত কাজ পড়ে থাকে। সব কাজ ফেলে তোমার সাথ দিতে আসার এই মূল্য দিচ্ছো?”

ফারাহর কথায় স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অনেক সাহায্য করেছ আমাকে। এখন বেরিয়ে যাও। একা থাকতে চাই।”

সৌমিত্র আর ফারাহ বিনা বাক্যে ঘর থেকে সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে এসে পেছন ঘুরে তাকাল ফারাহ। স্বচ্ছকে দেখল সে এলোমেলো হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে নিজের ফোনটা দেখছে। সম্ভবত মোহের নম্বরটাই মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ফারাহ বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ভাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”

সৌমিত্র জবাবে বলে,
“ভাই কী চায় সে নিজেও জানে না।”

পরদিন সকালে কিছু ঔষধ এবং সামান্য বাজার করার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলো মোহ। মাথায় কালো ওড়না পেঁচিয়ে ধীর পায়ে মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগল সে। ওড়না ছাড়িয়ে তার কোঁকড়া চুলে বেণী সুন্দর ভাবে দুলছে। মোড়ের চায়ের দোকানগুলো পেরোতেই কানে এলো বড়োদের কিছু অস্বাভাবিক কথাবার্তা। চায়ের দোকানদার শহীদ চাচা বলছেন,
“ওইযে দেখো! কোন বাপের বেটি যায়! আগের দিনই ওর জন্য বাপটারে পুলিশ কেমনে অপ/রাধীর মতো টানতে টানতে লইয়া গেল। আজকেই আবার মাইয়াটা কোন মুখে বাহিরে হইছে বুঝিনা।”

চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা আলমগীর কাকা সাথ দিয়ে বলেন,
“বুঝলাম না। ওর বাবাকে কেন ধরে নিয়ে গেল! এইতো সেদিনই দেখলাম মন্ত্রীর ছেলেটার বাইকে কত সুন্দর করে দুজনে ভিজতে ভিজতে এই অবধি এলো। আবার হঠাৎ করেই মেয়েটার জন্য মেয়েটার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল?”

“আমার তো মনে হয় মাইয়াটা মন্ত্রীর পোলার লগে চক্কর চালাইছিল। ওইডা মন্ত্রী জানতে পাইরা শিক্ষা দেওয়ার জন্যে এই কাজটা করছে।”

সর্বাঙ্গের র;ক্ত যেন আগুনের ফুলকির ন্যায় দপদপ করে জ্বলতে থাকল মোহের। এত বিশ্রী আলাপ শুনে কণ্ঠস্বর আঁটকে গেছে তার। পায়ের শক্তি ফুরিয়েছে। তীব্র ইচ্ছে করছে গলা উঁচিয়ে কয়টা কথা শুনিয়ে দিতে। তবে সে পারবে না। নিজের অশ্রু চোখ টিপের দমন করে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে হনহনিয়ে সামনে চলে এলো মোহ। তবে শান্তি পেল না। যেদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সেদিক দিয়েই একই কথা। পুরো পাড়াতে ছড়িয়ে গেছে বদনাম।

যানবাহন দিয়ে ভরা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে আপনমনে বাইক চালাচ্ছে স্বচ্ছ। মাথায় নেই আজ হেলমেট। হাতে নেই গ্লাভস্। মাঝে মাঝে অমনোযোগী স্বচ্ছের বাইকের সাথে দুর্ঘ/টনা হবার মতো অবস্থা ঘটলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে সে। অন্তরের দাপট দমাতে যেন এই একটাই পথ! সেটা হলো লাগামহীনের ন্যায় বাইক চালানো। তবে শেষ রক্ষা হলো না তার। হঠাৎই একটা বড়ো ট্রাক ট্র্যাফিক জ্যামে আঁটকে গেলে সেটা খেয়াল করা হয়না স্বচ্ছের। শেষ অবধি ব্রেক চেপে ধরেও কাজ হয়না তার। বাইক সজোরে দিয়ে সংঘর্ষ হয় ট্রাকের সঙ্গে। মুহূর্তেই বাইক থেকে ছিটকে যায় স্বচ্ছ। উপুড় হয়ে মাঝরাস্তাই পড়ে যেন দেহের সমস্ত অঙ্গ নাড়ানোর শক্তি হারায় সে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে র/ক্ত। নিভু নিভু চোখে খেয়াল করে তার রক্তিম র/ক্তে ভিজে যাচ্ছে পিচঢালা সড়ক। লোকজন একত্রিত হচ্ছে তাকে এই অবস্থায় দেখে।

সামনে লোকজনের জটলা দেখে থেমে যায় অটো। সেই অটোতে বসে থাকা মোহ প্রশ্ন করে,
“কী হলো মামা?”

“সামনে মেলা লোকজন। যাওন যাবে না। মনে হইতাছে এক্সি/ডেন্ট হইছে কোনো।”

মোহ বসেই রইল চুপচাপ। কিন্তু অটো পাশ কাটিয়ে যাওয়া দুটো লোকের কথা কানে এলো তার।
“মন্ত্রীর ছেলে এরা। এদের সাহায্য করাও বিপদ! বলা তো যায় না ওর বাবা আবার নতুন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দেয়।”

মোহের স্থিরতা বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। মনের অস্থিরতাকে প্রাধান্য দিয়ে অটো থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে ভিড়ের মাঝে ঢোকার চেষ্টা চালালো সে। অবশেষে সফল হয়ে রাস্তায় উপুড় হয়ে র;ক্তাক্ত শরীরে পড়ে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য হাহাকার দিয়ে উঠল ভেতরটা। বাকি সব ভাবনা সরিয়ে দিয়ে স্বচ্ছের নিকটে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল,
“উনার এই অবস্থা! এখনি হাসপাতালে নিতে হবে তো। নয়ত বাঁচানো যাবে না।”

এক আগন্তুক লোক মোহের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“একে চেনো তুমি?”

মোহকে উত্তর দিতে হলো না। অন্য একজন বলল,
“চিনে না মানে? এদেরই তো ফুটেজ ভাইরাল হইছিল। এই মেয়েটা এই ছেলেটারে থা;প্পড় দেওয়া নিয়ে কত কাহিনী হলো।”

সেসব কর্ণপাত করল না এই মুহূর্তে মোহ। সকলের পানে চেয়ে বলল,
“উনাকে সাহায্য করা প্রয়োজন।”

“কেউ করবে না। সাহায্য করলে আবার যদি উল্টে ফেঁসে যাই আমরা? যেচে বিপদ কাঁধে নিব নাকি?”

“আরে আশ্চর্য! উনি একজন মানুষ। উনার সাহায্য প্রয়োজন এই মুহূর্তে। এখন নিজেরটা নিয়ে ভাবা জরুরি?”

মোহের কথায় আবার রূঢ় জবাব এলো জনগনের।
“তোমার শখ থাকলে তুমি করো সাহায্য।”

এবার সকলের মন্তব্য শুনে মনের সমস্ত দ্বিধা, অভিমান, রাগ ঝেড়ে ফেলে দিলো মোহ। মাকে বলা কথাটিও যেন মানা হলো না তার। এই অবস্থায় এই মানুষটাকে ফেলে যেতে পারবে না সে। সকলকে অনুরোধ করে কোনোরকমে স্বচ্ছকে অটোতে উঠিয়ে দেওয়া হলো। মোহ নিজ দায়িত্বে আ/হত স্বচ্ছকে নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালে। স্বচ্ছের হাতটা কোনোরকমে চেপে ধরেছে মোহ। তবে সে খেয়াল করে তার ফে/টে দেওয়া কপালের বাম অংশ অটোর রোডের সঙ্গে আ;ঘাত লাগছে। মনের অস্বস্তি কাটিয়ে দ্রুত মোহ স্বচ্ছের মাথায় হাত দিয়ে তার মাথা কাছাকাছি নিয়ে এসে মোহের কাঁধে রাখে। স্বচ্ছের মাথার পেছনপাশে একহাত দিয়ে সযত্নে চেপে রাখে মোহ। পরক্ষণেই স্বচ্ছের র;ক্ত দ্বারা ভিজতে আরম্ভ করে মোহের কালো ওড়না। মোহ খেয়াল করে এই জেদি লোকটির দিকে। সে যতই চেয়েছে এই বিপদজনক লোকটির থেকে দূরে থাকতে ততই কাছে আসতে হয়েছে তাকে। মোহ বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এই মানুষটি যেন আমার বাধ্যবাধকতা!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here