যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -১৭

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি

১৭.
‘ খুব অল্প বয়সে বিয়ে, বিধবা হওয়া, মায়ের পালিয়ে যাওয়া, বাবার মৃত্যু, শেষমেশ শ্বশুরবাড়ি থেকে পালানোর পর মিথ্যে অপবাদ- এতগুলো প্রতিবন্ধকতা যথেষ্ট ছিল আমার থেমে যাওয়ার জন্য। যে রাতে পালালাম, সেদিন মামণি না থাকলে হয়তো আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। শ্রাবণী শিকদার আমার জীবন পরিবর্তনকারী ব্যক্তি। আমার পড়াশোনা থেকে শুরু করে আমাকে সমস্ত বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। শুধু আমাকেই নয়, “শান্তিনীড়” আশ্রমের সমস্ত মেয়ের কাছে ভরসার একমাত্র নাম তিনি। আমি যতবার দুর্বল হয়ে পড়েছি তিনি আমাকে শক্ত করে গড়ে তুলেছেন। আমি কৃতজ্ঞ তার কাছে। আজ থেকে আট মাস আগে মামণি জানতে পারেন তার শরীরে ক্যান্সারের উপস্থিতি। ভেঙে পড়েননি তিনি, কাউকে জানানও নি। আমি তখন এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে বললেন আশ্রমের দায়িত্ব নিতে। আমার সত্যিই ইচ্ছে ছিল আশ্রমের জন্য কিছু করবো কিন্তু তখনো মামণি বলেনি তার ক্যান্সারের কথা। এখন তিনি চিকিৎসাধীন। আমার জীবনের প্রদীপ জ্বলা-নেভার লড়াইয়ে লড়ে যাচ্ছে এণ্ড আই নো শি উইল উইন।’ কথাটুকু শেষ করতেই গলা ভারি হয়ে আসলো সন্ধির। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল অথচ মনে হচ্ছে মাত্র তো কয়েকটা দিন গেল। সামনে বসে থাকা সাংবাদিকের মুখটাও থমথমে। আদতে সে জানত না এত অল্প সময়ে সফলতার শিখরে পৌঁছানো এনজিওর পরিচালক একজন বিধবা তরুণী। নিউজের জন্য ভালো একটা শিরোনাম পেল সে ইতোঃমধ্যে। সাংবাদিকের চাহনী দেখে বিষয়টা বুঝতে বাকি রইল না সন্ধির। কফির মগটা হাতে নিয়ে স্পষ্ট বাক্যে বলল, ‘আমাকে আমার যোগ্যতা দিয়ে বিচার করুন, আমার ব্যক্তিগত জীবনের অবস্থা নিয়ে নয়।’ সাংবাদিক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। অতঃপর কফিতে চুমুক দিয়ে সন্ধির ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজি হওয়াতে তাকে ধন্যবাদ জানালো।

ঘড়িতে আটটা ত্রিশ। সাংবাদিক যাওয়ার কথা সাতটায় অথচ এ প্রশ্ন সে প্রশ্ন করতে করতে আটটা বাজিয়ে ফেলল। আশ্রম থেকে বাড়ি আসতে আসতে আরো মিনিট বিশেক লাগলো। শ্রাবণী শিকদারের ঘরে এখন নার্স রাখা হয়েছে যেন তার কোন অসুবিধে না হয়। সিঁড়ি ভেঙে তার ঘরের দিকেই এগোচ্ছে সন্ধি। দরজার কাছে আসতেই দুজন মানুষের অস্পষ্ট ফিসফিসানি কানে আসলো তার। দরজায় ধাক্কা দিতেই বুঝলো দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। অবাক হলো সন্ধি। এ ঘর কখনো বন্ধ রাখতে দেয় না। চিৎকার করে ডাকতে লাগল সে, ‘মামণি! মামণি! দরজা বন্ধ করেছো কেন তুমি? খোলো দরজা।’ দু’তিনবার ডাকার পর শ্রাবণী দরজা খুলে দিলেন। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র চোখ পড়ল সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে। সাদা শার্ট পড়া এক সুদর্শন পুরুষ। আগের মতো আর ক্লিন শেভড গাল নয় তার, খোচা খোচা চাপদাড়িতে সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়েছে। মুখে একটা পরিণত ভাব এসেছে। চোখজোড়া এখন চশমার আড়ালে আবদ্ধ। সন্ধির ইচ্ছে করলো এক দৌড়ে লোকটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাঁচ বছর! দীর্ঘ পাঁচটা বছর পর মানুষটাকে দেখছে সে। দূরত্বটা কষ্টকর ছিল কিন্তু এখন এই অকস্মাৎ প্রাপ্তিটা তৃপ্তিময়। সন্ধিকে এনে নিজের পাশে বসালেন শ্রাবণী।

– ‘আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তোমার স্যার এসেছিলেন আমার কাছে। পাঁচটা বছর তাকে অপেক্ষা করিয়েছি। তোমার ভালোর জন্য পাঁচ বছর ধৈর্য ধরেছে সে। এখন সময় এসেছে তোমার সিদ্ধান্ত জানার। তুমি কি তোমার স্যারের অর্ধাঙ্গিনী হতে ইচ্ছুক?’

– ‘মামণি, আমি ওনার সাথে একটু কথা বলে নিই?’

– ‘সে আবার বলতে। যাও!’

– ‘তুমি ওষুধ খেয়েছো?’

– ‘খেয়েছি রে মা। যা তুই।’

সন্ধি চোখ দিয়ে ইশারা করতেই মাহিদ সন্ধির পিছু পিছু যেতে লাগল। মাহিদ ভেবেছিল সন্ধি ঘরের দিকে যাচ্ছে কিন্তু সন্ধি তাকে নিয়ে ছাদে এলো। ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে।

– ‘তো স্যার, নেহা ম্যামকে বিয়ে না করে হঠাৎ আমার মতো বিধবা মেয়ের জন্য অপেক্ষা? মানে হয় এসবের?’

– ‘প্রথমত নেহাকে নিয়ে আমার মনে কোনোরকম অনুভূতি ছিল না। সুতরাং ওকে বিয়ে করার প্রশ্নই উঠেনা। দ্বিতীয়ত, তোমার বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছিল তার আমি শুনেছি। আর বিধবা মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না এমন তো কোনো নিয়ম নেই।’

– ‘আছে। সমাজের অলিখিত নিয়মের একটি এটি। বিধবারা পুনরায় বিবাহ করলে এ সমাজের চুলকায়।’

– ‘সমাজের তোয়াক্কা না আমি করি আর না তোমাকে করতে দিব। শুনলাম ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করছো।’

– ‘খোঁজ রেখেছেন তাহলে। হুম করছি।’

– ‘যে মেয়ে ইংরেজিতে পাশ মার্ক তুলতে পারত না, তার এ পরিবর্তনটা বড্ড ভালো লাগছে। শেষমেশ ইংরেজি বিষয়টা পছন্দ হলো তো!’

– ‘একদম ভুল ধারণা আপনার। আমি ইংরেজি সাহিত্য কেন চুজ করেছি জানেন? ঐ মোটা মোটা বইয়ের দাঁত ভাঙা ইংরেজি পড়তে পড়তে আপনাকে গালি দেওয়ার জন্য। যখনি আমার রাগ হয় আমি আপনার কথা ভেবে বলি, আপনার মতো রামছাগলরাই এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে।’

– ‘নিজেকে রামছাগল না বললেও পারতে।’

– ‘আপনাকেও বলেছি।’

– ‘বিয়ে করবে আমায়? দুই রামছাগলের একটা সুইট-কিউট সংসার হবে। ঘরভর্তি সাহিত্যের বই আর মনভর্তি ভালোবাসা। আহা!’

– ‘পটানোর চেষ্টা করছেন?’

– ‘আগে থেকেই তো পটে আছো। এমনি এমনি তো আর চুমু খাওনি সেদিন।’

– ‘পাঁচ বছর আগের ঘটনা ওটা! আমি তখন বাচ্চা ছিলাম।’

– ‘তখন বাচ্চা ছিলে, এখন বাচ্চার মা হবে। নট আ বিগ ডিল।’

– ‘আপনি যে এই কয়েক বছরে লুচু হয়ে গেছেন তা কি আপনি বোঝেন?’

– ‘তুমি বুঝলেই হলো!’

সন্ধির মনে যেমন আনন্দ হচ্ছে তেমনি একটা অজানা ভয়ও দানা বাঁধছে। মাহিদের পরিবারের লোক কি রাজি হবে?

– ‘আপনার পরিবারের সাথে আগে কথা বলা দরকার।’

– ‘তারা রাজি। আপাতত ছেলে ত্রিশ পোরোনোর আগে একটা মেয়ে ঘরে তুললেই হলো।’

– ‘তো তুলুন যাকে পারেন।’

– ‘তোমায় ছাড়া যে ও ঘর সংসার বানানো সম্ভব না।’

– ‘ঢঙ! যান বিয়ের ব্যবস্থা করুন।’

কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না সন্ধি। দ্রুত পায়ে নেমে এলো। এত সুন্দর আবহাওয়া! আর কিছুক্ষণ থাকতে পারত দুজন। ভাবতে ভাবতে নিচে নামলো মাহিদ। শ্রাবণী শিকদারের সাথে সমস্ত আলাপ শেষ করে বের হয়ে গেল। আপাতত সে নিজের এক ফুপ্পির বাড়িতে আছে। তার বাবা-মাও এখানেই আছে। কারণ একটাই, ছেলের বউসহ বাড়ি ফিরে যাওয়া।

________________________

রাতের খাবার খাওয়ার সময় শ্রাবণী জানালেন তিনি আগামী শুক্রবারে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করেছেন। মাহিদের বাবা-মায়ের সাথে তার আগেই কথা হয়েছে। সন্ধির সম্মতি আছে জানার পরেই তিনি মাহিদকে পাকাপোক্তভাবে কথা দিয়েছেন। সন্ধি কেবল শুনে গেল। এখনও সন্দিহান সে। বিয়ে নামক বন্ধনের প্রতি একটা ভীতি ঢুকে গেছে তার মধ্যে। এ ভয়কে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না সে। ক’মাস আগে মায়ের খোঁজ পেয়েছে সে। নতুন প্রেমিকের সাথে সাজানো সংসার ভেঙেচুড়ে গেছে। পরে সে প্রেমিক তাকে একা ফেলে পালিয়েছে। সন্ধির মা তীব্র অনুতাপে সে রাতেই আত্মহত্যা করেন। খবরটা সন্ধির কানে এসেছে তার আশ্রমের এক ব্যক্তির মাধ্যমে। তিনি কিভাবে খবরটা পেলেন তা আর জানা হয়নি। সম্ভবত তিনি তার মাকে চিনতেন। আত্মীয় স্বজনের খোঁজ সন্ধি দিব্যি রেখেছে। তার খালা এখন একাই থাকেন। রগচটা স্বভাবের কারণে কারো সাথে কথাবার্তা বলেন না। জমানো টাকা দিয়ে জীবন চলছে তার। চাচার খবর ভালো নয়। ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে তাকে। আর মামা-মামির সংসদ বেশ ভালোই চলছে। চাচার সাথে একবার দেখা করেছিল সন্ধি। নিজের কাছে এনে রাখতেও চেয়েছিল কিন্তু লজ্জায় তিনি আসেননি। আশ্রমের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এই ক’মাসে। আশ্রমের প্রত্যেকটা মহিলা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে উপার্জন করছে। এর চেয়ে বেশি সুখকর আর কী হতে পারে? দায়িত্বগুলো কি তবে যথাযথভাবে পূরণ করতে পেরেছে সন্ধি? দায়িত্বের এ শহরে তার প্রেমে পড়া বারণ ছিল এতদিন। এখন কি এই শহরে প্রেমের বাতাস বইবে তবে?

চলবে…

[মাহিদ আর সন্ধির বিয়ের আমন্ত্রণ রইল।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here