যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০২

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (২)
~মিহি

২.
‘পড়তে যাস নাকি ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে?’ পরপর কয়েকটা থাপ্পড় পড়ল সন্ধির গালে। উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবারো মেঝেতে পড়ল সে। অসহায় দৃষ্টিতে সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ গেল তার হাতে থাকা ভাঁজ করা কাগজটার দিকে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে গালের একাংশ রক্তলাল হয়ে উঠেছে। সায়েরা জামান চিঠিটা সন্ধির মুখে ছুঁড়ে চলে গেলেন। সন্ধি চিঠির ভাঁজ খুলে নিঃশব্দে চিঠিটা পড়ল। চিঠির কথা সে জানতো না, বইটাও তো তূর্ণার কাছে ছিল। মুহূর্তেই তার সমস্ত রাগটুকু গিয়ে পড়লো তূর্ণার উপর। কী ভেবে যেন চিঠিটা বইয়ের ভাঁজে রেখে উঠে চোখ মুছল সে। মা এই যে দুটো থাপ্পড় দিলেন, এতেই শেষ নয় কাহিনী। সন্ধি জানে আসল খেলা শুরু হবে বাবা আসার পর। মা অবশ্যই এ কথাগুলো বাবাকে জানাবেন। সন্ধি একটাবারও বলার সুযোগ পেল না চিঠিটা ওর জন্য ছিল না। সুযোগটা পাবেও না কেননা যদি সন্ধি এ কথা বলে তবে বাবা প্রশ্ন করবেন তার জন্য না হলে, চিঠিটা কার জন্য ছিল। এ প্রশ্নের উত্তরে তূর্ণার নাম নেওয়া চরমতম বোকামি। তূর্ণা মেধাবী ছাত্রী, চারিদিকে তার প্রশংসার জয়গান। বাবা-মা ভাববেন সন্ধি নিজেকে বাঁচাতে তূর্ণার উপর অহেতুক দোষ চাপাচ্ছে। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো সে।

মাহিদের সময় কাটছে ব্যস্ততায়। বড় চাচার দেওয়া গুরু দায়িত্ব সে পালনে সর্বসাধ্য চেষ্টা করছে। সি সেকশনের মেয়েগুলোকে যতটা পাঁজি ভেবেছিল ততটা তারা না, ঠিকমতো পড়াশোনায় মনোযোগ দিলে অবশ্যই ভালো কিছু করতে পারবে। বেশ কয়েকটা নোটস আর শীট বানাতে হবে ওদের জন্য। ল্যাপটপ অন করতেই বাড়ি থেকে ভিডিও কল আসলো মাহিদের ল্যাপটপে। রিসিভ করতেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার বাবা কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। মাহিদ এখানকার অবস্থা জানিয়ে বাড়ির সবার খোঁজ নিল। মাহিদের পরিবারে তার বাবা আর মা। দুজনেই ইট পাথরের ঢাকা শহরে বসবাস করছেন। মাহিদ অনার্স শেষ করে নিজের এলাকায় এসেছিল মূলত হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে। এমন সময় বড় চাচার মুখে শুনলো গ্রামের স্কুলে একজন ইংরেজি শিক্ষক দরকার। শিক্ষকতাটা পেশা হিসেবে নেওয়ার শখ মাহিদের বহু পুরোনো তাই হুট করেই চাচাকে বলে ফেলে কয়েক মাসের জন্য হলেও যেন তাকে শিক্ষকতা করার সুযোগ দেওয়া হয়। চাচাজান সব দিক ভেবে রাজি হন। বাড়ির উপরতলার ঘরটা মাহিদের জন্য খালি করে দিয়েছেন তিনি। আপাতত সেখানে বসেই কাজ করছে মাহিদ। কাজ করতে করতে গান শোনার পুরোনো অভ্যেস মাহিদের। ফোনে একের পর এক গান চলছে। অনেকটা সময় পর ফোনে ‘কাল হো না হো’ গানটা প্লে হতেই সকালবেলার কথা মনে পড়লো। একটা মেয়েকে সে অমনোযোগী হওয়ায় বকেছিল একটু। ছুটির পর অফিস রুমের বাইরে একইসাথে মেয়েটার বিরক্তমাখা রুদ্রমূর্তি খানিকটা চিন্তাতেই ফেলেছিল তাকে। মেয়েরা একবার কারো উপর বিরক্ত হলে নাকি কখনো তার কথার গুরুত্ব দেয় না। এমনটা সত্যি হলে মাহিদ নিজের একটা ছাত্রীর মনোযোগ হারানোর দুঃখে খানিকটা মেকি আফসোস করে আবারো শীটের কাজে লেগে পড়লো।

সাজানো-পরিপাটি এক বাগান। বাগানের মধ্যবর্তী এক বিরাট গাছে ঝুলছে ফুলেল দোলনা। মুহূর্তেই খিলখিল করে উঠলো সন্ধির মনটা। দু হাত বাড়াতে চাইলো দোলনার দিকে। আচমকা সবটা যেন ঝাপসা হয়ে এলো। পেছন থেকে কেউ একজন ক্রমাগত তার হাত ধরে টানছে। বিরক্ত সন্ধি হাতটা ছাড়িয়ে দোলনার দিকে দৌড়াতেই পা ফসকে খাঁদে পড়লো। অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে এখনো হৃদস্পন্দন উঠা-নামা করছে তার। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। পড়তে পড়তে টেবিলেই শুয়ে পড়েছিল সে। উঠে টেবিল ক্লকটার দিকে তাকালো। ঘড়িতে দশটা উনিশ বাজে। বাবা বাড়িতে ফিরেন রাত ন’টায়। সাড়ে ন’টা নাগাদ খেতে ডাকা হয় তাকে। আজ যেহেতু ডাকা হয়নি, সন্ধি ইতোঃমধ্যে বুঝে গেছে কিছু একটা হতে চলেছে। যা ভেবেছিল তাই। খেয়ে উঠে বাবা প্লেট হাতে ঘরে আসলেন।

– ‘শুনলাম তুই নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলি।’

– ‘কথা ঘুরিয়ো না বাবা। মা যা বলেছে তার প্রেক্ষিতে কী বলতে চাও সেটা বলো।’

– ‘দেখ, এই বয়সটাই এমন। আশেপাশে যাকে দেখবি, তাকেই ভালো লাগবে। ছেলে একটু সুদর্শন হলেই ভালো লাগবে, পড়াশোনায় ভালো হলে ভালো লাগবে, সেকেন্ড সাতেক তোর চোখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেই ভালো লাগবে। কিন্তু এ ভালো লাগার কোনো ভবিষ্যত আছে কী? তোর দিকে সকলেই হাত বাড়াবে কিন্তু তুই হলি চাঁদ। সবাই তোকে দূর থেকেই দেখে যাবে, তোর কাছে যে পৌঁছাতে চাইবে তাকে কঠোর সাধনা করতে হবে, বুঝলি?’

– ‘মাও তো পারতো এভাবে বোঝাতে।’

– ‘মা মেরেছে, আমি বুঝিয়েছি। পরেরবার আমি মারলে মা বোঝাবে।’

– ‘তুমি মারো না আমায়। তুমি শুধু বুঝাও। মা বোঝে না আমাকে, একটুও না।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও তোর মাকে মনে করিয়ে দিবনি সে স্কুল লাইফে আমার দেওয়া চিঠিগুলো কোন বইয়ের ভাঁজে রেখেছিল।’

বলেই বাবা মুখ টিপে হাসলেন। সন্ধি মুগ্ধ নয়নে তাকালো। বাবার ভুলটা ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না তার, বলতে ইচ্ছে হলো না যে এ চিঠি তার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি। বরং বাবার কথাগুলো মনে করে মনটাতে অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করলো সে। বাবা-মায়ের বিয়েটা ভালোবাসার বিয়ে। তাদের প্রেম কাহিনী জন্মের পর থেকে শতবার শুনেছে সে। বাবা প্রতিবারই তাদের গল্পের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো সন্ধিকে শোনান তবে মা কখনো সন্ধিকে তাদের বিয়ে নিয়ে কিছু বলেন না। বাবার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে খেয়ে শুয়ে পড়লো।

সকালবেলা ক্লাস মিস দেওয়ার পুরো মানসিক প্রস্তুতি নিয়েও শেষমুহূর্তে আর ক্লাস ফাঁকি দিতে ইচ্ছে হয়নি সন্ধির। প্রথমেই ইংরেজি ক্লাস। মাহিদ স্যার ক্লাসে ঢুকবে মিনিট দুয়েক পর। এমন সময় তূর্ণা সি সেকশনের গেট থেকে সন্ধিকে ডাকলো। ভেতরে ঢোকার রূচি হলো না বোধহয়। এ সেকশনের মেয়েরা সি সেকশনে আসে না সচরাচর, তাদের জাত যাবে এই ভেবে হয়তো। তূর্ণাকে ডাকতে দেখে সন্ধি মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো।

– ‘এই সন্ধি! তোকে বাংলা বই দিয়েছিলাম না? ওর মধ্যে না ভুল করে রাফির দেওয়া চিঠিটাও দিয়ে দিয়েছি। একটু ফেরত দিবি প্লিজ? ও জানলে খুব মন খারাপ করবে।’

– ‘এত সময়ে কোনদিন আমি তোকে ছেড়ে স্কুলে আসিনি, আজ আসলাম। একবার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারতি।’

– ‘উফ! এত ঢঙ করোস ক্যান? চিঠিটা দে না ভাই।’

সন্ধি কিছু বললো না। বই থেকে চিঠি বের করে এনে তূর্ণার হাতে দিয়ে বললো, ‘তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।’ তূর্ণা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। সন্ধি পেছনে ঘুরলো। চোখজোড়া জলে ভরে এসেছে। পিছনে ফিরেই মুখোমুখি হলো মাহিদ স্যারের। চোখের অশ্রু মুছে একছুটে ক্লাসে ঢুকলো। মাহিদ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

‘আজকের টপিক হচ্ছে আনসিন প্যাসেজ এবাউট ফ্রেন্ডশিপ। আজকাল সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে বন্ধুত্ব ভেঙে দেয়। এসব মানুষদের বন্ধুত্ব মেকি ব্যতীত কিছু না।’ কথাটা বলে সামনে তাকাতেই সন্ধির চোখে চোখ পড়লো মাহিদের। মাহিদ টপিকটা পড়ানোর ব্যাপারটা বাড়ি থেকেই ঠিক করে এসেছিল কিন্তু সন্ধি ভেবে নিল মাহিদ ইচ্ছে করে তাকে অপমান করার জন্য এভাবে বললো। না চাইতেও চোখে জল এসেছে সন্ধির। ভেজা চোখে আশেপাশে মুখ লুকাতে ব্যস্ত সে। মাহিদ প্রথম প্রথম সেদিকে লক্ষ না করলেও যখন দেখল সন্ধির অমনোযোগী ভঙ্গি, তখনি সন্ধির সামনে গেল। সন্ধিকে বেশ কিছু কড়া কথা বলার জন্য উদ্যত হয়েছিল সে কিন্তু সন্ধি মুখ তুলেই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলল।

চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here