রংধনুর রঙ কালো পর্ব ১৭

#রঙধনুর_রঙ_কালো
১৭.

অরিন অন্বয়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ করছে।দরজায় টোকা দিতে পারছে না। আজকে অন্বয়কে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তার পুরো দায় অরিনের। সেজন্য আত্মগ্লানিতে অরিনের চোখমুখ ছোট হয়ে আছে। একটু আগেও তার কোনো হুশ ছিল না। এখন সে কিছুটা স্বাভাবিক। তাই অন্বয়ের খোঁজ নিতে এসেছে৷ না এলেও বিষয়টা অমানবিক দেখাতো। যেহেতু অরিনের জন্যই অন্বয় আহত। সেহেতু অন্বয়ের খেয়াল রাখাও অরিনের কর্তব্য। পার্টিতে ইলহান আর অন্বয়ের সংঘাত খুব জটিলরূপ ধারণ করতে পারেনি। একজন শুধু অন্যজনের নাক-মুখ ফাটিয়েছে। হালকা রক্তপাত হয়েছে। তারপর ইলহানকে তার বন্ধুরা টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে। অরিন আর অন্বয় গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। এখন রাত ১টা বাজে। অরিন রুমে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে গেছিল। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। কিছুক্ষণ আগে তার তার হুশ এসেছে। প্রায় পাঁচ গ্লাস পরিমাণ লেবুর শরবত খেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। পার্টি থেকে তারা ফিরেছিল প্রায় তিনঘণ্টা আগে। অন্বয়ের ঘর থেকে ড্রাইভার বাবা’র কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে অন্বয়ের সেবায় ব্যস্ত। এই অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করা কি ঠিক হবে? অরিনের ভাবনার মাঝখানেই বাবা বেরিয়ে এলো। অরিনকে দেখে অবাক হওয়ার মতো বললো,
” আরে ম্যাডাম, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ভেতরে চলেন। স্যারের অবস্থা এখন ভালোই। নাক থেকে টপটপ করে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। ”
অরিন অপরাধী কণ্ঠে জানতে চাইলো,” শুধু কি নাক থেকেই রক্ত বেরিয়েছে নাকি আরও ক্ষতি হয়েছে?”
” ডানহাতের কবজি ফুলে গেছে। সেইখানে এতোক্ষণ গরম সেঁক দিলাম। এখন অনেকটা ভালো’র দিকে।”
অরিন আঁতকে উঠলো। ইশশ, ডানহাতেই আঘাত লাগতে হলো? আহত ডানহাত নিয়ে অন্বয় সাহেব খাবার কিভাবে খাবেন? অরিন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। অন্বয় বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার নাকের কাছে ব্যন্ডেজ। অরিনের নিজের প্রতি ক্ষোভ লাগছে। সে কেনো অন্বয়কে নিয়ে পার্টিতে গেল? একা গেলেই ভালো হতো। ইলহানের যে মাথাখারাপ সেটা তো অরিন জানেই। তবুও যে কেনো পাগল ক্ষেপাতে অন্বয়কে সাথে নিল? অরিন মাথা নিচু করে অপরাধমিশ্রিত গলায় বললো,” অন্বয়সাহেব?”
অন্বয় চোখ খুলে একটু তাকালো।
” মিসেস অরিন, আপনি উঠেছেন? আসুন।”
অরিন ভেজা গলায় বললো,” আই এম স্যরি অন্বয়সাহেব।”
তারপরই কেঁদে ফেললো। অন্বয় ভ্যাবাচেকা খেলো। অরিনকে হঠাৎ হঠাৎ খুব ইমোশোনাল মনে হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তার থেকে পাষাণতম কেউ নেই। খুবই অদ্ভুত মেয়ে। অন্বয় অরিনকে সহজ করার জন্য বললো,” আহা কাঁদছেন কেনো? কাঁদবেন না প্লিজ। ”
” বিশ্বাস করুন অন্বয়সাহেব, আমি আপনাকে ওইখানে নিয়ে অপমান করতে চাইনি। ইলহান যে এমন জানোয়ারের মতো কাজ করবে সেটা আমি ভাবিওনি।”
” আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। বললে কি আর কিছু ফেরত আসবে?”
” তবুও আমি বলতে চাই। আমি আপনাকে একটা মিথ্যা বলেছি আর আপনার কাছে একটা সত্যি গোপন করেছি।”
” এজন্যই কি কাঁদছেন?”
” কান্না আসছে। আপনাকে দেখেই কান্না আসছে। আমার জন্য বার-বার আপনাকে অপমানিত হতে হয়। আমার উচিৎ আপনার পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া। সেটা করতে পারছি না দেখে আরও বেশি খারাপ লাগছে।”
” এটা আপনাকে করতেও হবে না। আপনার কি মনে হয়? আমি আপনাকে আমার পা ছুঁতে দিবো?”
অরিন মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। অন্বয় বললো,
” বসুন মিসেস অরিন। কি সত্য গোপন করেছেন আর কি মিথ্যা বলেছেন আমি শুনতে চাই।”
অরিন বসে চোখের জল মুছলো। কান্নার প্রভাব কণ্ঠ থেকে সরিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলতে শুরু করলো,” আপনি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি এংগেজমেন্টের আয়োজন কোথায় হবে এটা কিভাবে জানলাম তখন আমি বলেছিলাম সিক্সথ সেন্স থেকে অনুমান করেছি। আসলে এই কথাটা মিথ্যে ছিল। আমি কিছু অনুমান করিনি। আসল সত্যি হলো এর আগের দিন রাতে ইলহানের সাথে আমার কথা হয়েছিল।”
এইটুকু বলেই অরিন অন্বয়ের দিকে তাকালো। অন্বয়ের চেহারার ভাব বদলে গেছে। অরিন তড়িঘড়ি করে বললো,” বিশ্বাস করুন, সেটাই আমাদের প্রথম যোগাযোগ। আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম। ইলহান নিজেই আমাকে ম্যাসেজ করেছিল। যাতে আমি ওর এংগেজমেন্ট পার্টি এটেন্ড করি। জানি না ও কেনো হঠাৎ আমাকে ইনভাইট করলো। ও ইনভাইট করেছে বলেই যে আমি গিয়েছি তা কিন্তু না। আমি গিয়েছিলাম আমার কাজে। ইলহানের সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন আমি উত্তর দেইনি কারণ আমি নিজে থেকে ইলহানকে ডিভোর্স দিতে চাই না।”
অন্বয় এবার ভ্রু কুচকালো। অরিনের কথায় যে সে কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট সেটা বোঝা যাচ্ছে। অরিন চোখ নামিয়ে বললো,” আসলে আমি চাইছি ইলহান যেনো নিজে থেকে আমাকে ডিভোর্স দেয়। আর আমি এটাও জানি ও আমাকে সহজে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। কারণ কাবিনের টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। সেই টাকা পরিশোধ করতে গেলে ওর অর্ধেক সম্পত্তি খরচ হয়ে যাবে। তাই ইলহান হয়তো চাইছে যেনো আমিই ওকে ডিভোর্সটা দেই। তাহলে সে কাবিনের টাকা পরিশোধ করার হাত থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু আমি এই বোকামি করবো না। এইটা তো আমার হালাল হক। আর ডিভোর্স তো আমার জন্য হচ্ছে না। সব দোষ ইলহানের। তাহলে আমি কেনো ওর দোষের বোঝা বহন করবো? নির্দোষ হয়েও কেনো আমিই সবদিক থেকে বঞ্চিত হবো? আমি চাই, ইলহান কাবিনের টাকা পরিশোধ করে আমাকে ডিভোর্স দিক। আমি সেই টাকায় নিজের ক্যারিয়ার দাঁড় করাবো। অধিকার কেনো ছাঁড়বো? ইলহানকে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে অনেক বড় চালাকি করছে। ডিভোর্সের কথা মুখেও আনছে না। অন্যদিকে সোফিয়াকেও বিয়ে করে ফেলছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি ও আমাকে ডিভোর্স না দেয় তাহলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিয়ে করার অপরাধে ওর নামে মামলা করবো। কমপক্ষে সাতবছরের জেল তো হবেই। সেই ভয়ে ও নিশ্চয়ই আমাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবে।”
” মিসেস অরিন, আমি আপনাকে যতটুকু বুদ্ধিমতী ভাবতাম আপনি তার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমতী। এই বিষয় তো আমার মাথাতেও আসেনি। একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি চাইলেই ইলহান মাহদীর নামে মামলা করতে পারেন। এই বিষয়ে আমি আপনাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করবো। শুধু সাতবছর কেনো? আপনি চাইলে আমি তাকে যাবজ্জীবনের কারাদন্ড দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারি।”
” এজন্যই তো আপনাকে সাথে নিয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম ইলহানকে এই বিষয়ে জন সম্মুখে থ্রেট করবো। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেল… ইলহান ওইভাবে আপনার উপর আক্রমণ করবে জানলে আমি কখনোই আপনাকে সাথে নিতাম না।”
” উনি কেনো এই কাজ করেছে সেটা কি আপনি জানেন মিসেস অরিন?”
” না তো। কেনো করেছে?”
” আমি আপনার গাঁয়ে ব্যাড টাচ করেছিলাম তাই।”
” কি? কিন্তু আপনি কখন আমার গাঁয়ে ব্যাড টাচ করলেন?”
” কে জানে? আপনার আমার কাছে যেটা নরমাল টাচ ইলহান মাহদীর কাছে হয়তো সেটাই ব্যাড টাচ!”
অরিন চোখমুখ শক্ত করে বললো,” সে তো কাপুরুষ একটা। নিজের ঘৃণ্য চরিত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। অন্যদিকে কেউ আমাকে টাচ করলেও তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিচ্ছে। কি আশ্চর্য!”

সোফিয়া ইলহানের কাঁধে মালিশ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,” কেমন লাগছে এখন?”
ইলহান চোখ বন্ধ রেখে বললো,” ভালো।”
সোফিয়া কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু ইলহানের কানে কিছুই ঢুকছে না। তার দৃশ্যপটে সাদা শাড়ি পরিহিত অরিনের বিচরণ। সে কিছুতেই আজকের স্মৃতি ভুলতে পারছে না। এক মুহুর্তের জন্যেও সাদাপরীর রূপ তার মস্তিষ্ক থেকে যাচ্ছে না। অরিনের চোখ বড় করে তাকানো, তীব্র রাগে ফুঁসে উঠা, হিংসায় জ্বলন্ত নিঃশ্বাস। অরিন কি আসলেই ঈর্ষান্বিত হয়েছিল? অবশ্যই হয়েছিল। নাহলে ওইরকম হাঙ্গামা কেনো করবে? অরিনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে ইলহানের হৃদয় আনন্দে অভিভূত হচ্ছিল। সে শুধু উপভোগ করছিল অরিনের পাগলামী। এই হিংস্র রূপটাই তো দেখতে চেয়েছিল ইলহান। এজন্যই অরিনকে এংগেজমেন্টে আসতে বলেছে। ইলহান চায় অরিন তার বিয়েতেও আসুক। এভাবেই পাগলামি করুক। ইলহানের বিয়েটা ভেসে যাক, ভেঙে যাক। অরিন জনসম্মুখে জোর গলায় বলুক,” তুমি শুধু আমার। অন্যকাউকে বিয়ে করার আগে আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো। বুঝেছো?”
সোফিয়া রোষানল কণ্ঠে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে,” দিস ইজ টু মাচ ইলহান। পার্টিতে তুমি এইসব কি করলে আমার এখনও মাথায় আসছে না। ওই ছেলেটার কি দোষ ছিল বলো তো? তাকে তুমি ওইভাবে কেনো মারলে? তোমার তো উচিৎ ছিল অরিনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া। স্টুপিড একটা মেয়ে যে-কীনা আমাকে চড় মারলো। তোমাকেও চড় মারলো। তোমার চেহারায় থুতু পর্যন্ত দিল। তাও তুমি কিছু বললে না? আমার তো ইচ্ছে করছিল ওকে ওইখানেই গলা টিপে মেরে ফেলতে। ফালতু, বেংলাডেশের বস্তি থেকে উঠে আসা নোংরা,কালো একটা মেয়ে! ব্যাড কালচারড।”
ইলহান আচমকা উঠে সোফিয়ার ডানহাত টেনে পেছনে মুচড়ে ধরলো। সোফিয়া ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। মুখ দিয়ে আর্তনাদের শব্দ তুললো। ইলহান খিটমিট করে বললো,” শী ইজ লভ অফ মাই লাইফ। নট আ স্লাট লাইক ইউ।”

চলবে

-Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here