রঙিন প্রজাপতি পর্ব ৮

#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury

পর্ব- ৮
.
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম প্রণবের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না আমার। প্রণব আমার এদিকে এগিয়ে এসে মুখের সামনে আওয়াজ করে একটা তুড়ি বাজালো,
‘হ্যালো?’
আমি চমকে উঠে অপ্রস্তুত জবাব দিলাম,
‘কি-কিসের জানা-জানালার কা-কাঁচ? আমি.. আমি নি-নিশানা টিশানা লাগাতে পা-পারি না বাপু।’

প্রণব বাঁকা হেসে বললো,
‘পারি না বললে তো হবে না। নিশানা লাগাতে বলেছি, লাগাও।’
বলেই আমার দিকে বন্দুকটা এগিয়ে দিলো। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কাঁপা কাঁপা হাতে বন্দুকটা নিলাম। তারপর মোটামুটি তাক করলাম ঐ বোর্ডের দিকে।

চোখ বন্ধ করে আন্দাজেই ট্রিগার চেপে দিলাম। অতঃপর যা চেয়েছিলাম, তাই হলো। নিশানা সঠিক লাগলো না। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসলাম কেন জানি।
প্রণব অবাক হওয়ার মতো ভান ধরে বললো,
‘ওরে, নিশানা লাগলো না! কেমনে সম্ভব!’
সাথে সাথেই আবার ওর বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ওহ, ওহ, বুঝেছি। বুঝেছি। ওরে কে আছিস?’

মাঝপথে থেমে আবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘তোমার নামটা যেন কী?’
আমি বিরক্তি নিয়ে সরু দৃষ্টিতে জবাব দিলাম,
‘দিবা!’
সে আবার বলতে লাগলো,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিবা। ওরে কে আছিস? দিবার জন্য কয়েকটা ইটের টুকরো নিয়ে আয়। এবার ও নিশ্চিত পারবে।’

ওর কথা শোনামাত্রই আমার মাথায় যেন কাল্পনিক নারিকেল পড়ার মতো অনুভব হলো। ইটের টুকরো? এ্যাঁ? আমার বারবার শুধু ঐদিনের ঘটনাটা মনে পড়ছে। তবে কি প্রণবও আমাকে ঐটাও স্মরণ করাতে চাইছে? কিন্ত ও তো জানে না, যে আমিই ঐদিন ঢিল মেরেছিলাম। তবে? এটা কি শুধুই কাকতালীয়? নাকি অন্যকিছু? আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। পুরাই বেকুব বনে গেছি আমি।

এদিকে প্রণবের বন্ধুরা ইতোমধ্যে ইটের টুকরোও জোগাড় করে ফেলেছে। প্রণব একটা ইটের টুকরো হাতে নিয়ে আমার দিকে আসতে আসতে বললো,
‘দিবা, দেখো তো, এখন হবে কিনা। এবার তো নিশানা লাগবেই! কয, এখন তো আর বন্দুক না; খাঁটি ইটের টুকরো আছে।’
আমি বোকার মতো একটু পরপর ঢোক গিলছি। ভেতর ভেতর একটা আসামীর ভাবও বোধ করছি।

আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণব এবার মুখটা কেমন বানিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো,
‘কী হলো দিবা? নাও? এখন তো তোমার ইটের টুকরো এনেই দিলাম। সবাইকে এবার তোমার পাক্কা নিশানাটা দেখিয়ে দাও তো?’
কিছুটা দম নিয়ে প্রণব আবার বলতে থাকলো,
‘হু? নাকি এখন বোর্ডের বদলে আবার জানালার কাঁচও এনে দিতে হবে?’

তারপর প্রণব আমাকে কেন্দ্র করে চারপাশে হাঁটছে আর এসব বলছে,
‘কী হলো দিবা? আলাদা জানালার কাঁচ এনে দিতে হবে? নাকি একদম আমার বাসার জানালার কাঁচটাই লাগবে তোমার?’
প্রণবের টিপ্পনী আর কথাগুলো শুনে এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে গেলাম, প্রণব ব্যাপারটা জানে। যেভাবেই হউক, সে জানে। কিন্তু কীভাবে, সেটা জানি না।

যাকগে! এখন সেসব ভাবার সময় নেই আমার। এবার যতো তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে সরে পড়াই ভালো। আমি আমতা আমতা করে হেসে জবাব দিলাম,
‘আরে বড় ভাই। এসব ক-কী বলছেন?’
বলেই আবার বোকার মতো হাসলাম। তারপর আবার তাড়া দেখিয়ে বলতে থাকলাম,
‘ইয়ে.. আপনারা খেলুন না বড় ভাই? আমাকে টানার কী দরকার? আ-আমি এসবে নাই, বড় ভাই। আমার ক্লাস আছে ভাই। যাই আমি। হ্যাঁ? যাই, যাই।’

বলেই আমি দ্রুত তাদের এড়িয়ে ক্লাসের দিকে গটগট পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাবা গো, এবারের মতো রক্ষে পেলেই হয়। পেছন পেছন প্রণব ভাই যদিও খুব ডাকছিলো; তবু এটা যে ওরই এক দুষ্টু ফন্দি, ঠিক বুঝে গেলাম আমি। তাই আর ফাঁদে পা দেওয়ার সুযোগ না রেখে চটজলদি ওখান থেকে পালিয়ে এলাম।

______________________________

ক্লাসে বসে আছি ঠিক, কিন্তু স্যারের দিকে মনোযোগ নেই আমার। চিন্তা তো হচ্ছে প্রণবকে নিয়ে। ও কীভাবে জানলো, কাঁচ ভাঙার কথা। ওটার কথা তো আমি আর দিয়া ছাড়া কেউ জানে না। কোনো কাকপক্ষীও না। তবে? আজ হঠাৎ প্রণব.. ইশ! কীভাবে বুঝলো? এই ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতেই ক্লাস শেষ হয়ে গেল।

ক্লাস শেষ করে আমি আর শুভ কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, তখনি দেখি প্রণব ভাইয়ের বন্ধু নিখিলও দৌড়ে উপরে উঠছে। সে হয়তো আমাদের খেয়াল করেনি, কিন্তু আমরা ঠিকই দেখলাম ওকে। ওকে দেখেই আমি শুভকে প্রণবের কথা বললাম,
‘আচ্ছা, প্রণব ভাইয়াকে তোর কেমন মনে হয়?’
শুভ বললো,
‘কেমন মানে?’
আমি ওকে হাত নাড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম,
‘কেমন মানে… কেমন আর কি। মানে মানুষ হিসেবে কেমন? ভালো নাকি খারাপ..’

শুভ প্রশ্নটা শুনেই বলে উঠলো,
‘ওহ আচ্ছা। প্রণব ভাই তো দারুণ একটা মানুষ। এমনিতে র‍্যাগিং ট্যাগিংয়ে জড়িত থাকলেও যেকোনো দরকারেও ভাইকে চট করে পাওয়া যায়। এই যেমন, সেদিনও তো এক ভাইয়া খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেলো না? তখন প্রণবেরাই তো দৌড়াদৌড়ি করে ওকে হসপিটালে নিয়ে গেল।’
আমি অযথাই মুখ বেঁকিয়ে বললাম,
‘হুহ! আমার তো গুন্ডা মনে হয় ওকে।’
শুভ হাসলো আমার কথায়। তারপর বললো,
‘ওরা ভালো গুন্ডা আর কি।’
আমি নাক সিটকে বললাম,
‘ভালো গুন্ডা আবার কী? গুন্ডা আবার ভালো হয় নাকি?’

শুভ হাসছে শুধু। বললো,
‘হ্যাঁ, হয় তো৷ সিরিয়াসলি হয়। যারা ভালোর জন্য গুন্ডামি করে, তারাই তো ভালো গুন্ডা। হা হা হা।’
বলেই খিলখিল করে হাসলো শুভ। আমি ওর হাসি দেখে পিঠে কয়েকটা থাপ্পড় লাগালাম।
শুভ বলতে লাগলো,
‘কেন বল্ তো? হঠাৎ করে প্রণব ভাইয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলি?’
‘তাতে তোর কী? এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।’
শুভ একটু মজার ছলে বললো,
‘না, প্রণবকে নিয়ে আচমকা খুব বেশিই কৌতুহল মনে হচ্ছে তোর।’

আমি ওর চুলে টান মেরে বললাম,
‘চুপ থাক্। যতসব আবোল তাবোল কথা। শয়তান। তার আগে বল্, তুই একবার প্রণব ভাইকে নাম ধরে ডাকিস, আবার পরে ভাইয়া বলেও ডাকিস। কেন? কেন? বড় ভাইকে সম্মান দিতে জানিস না?’
শুভ মাথা চুলকে হাসলো। তারপর জিহবা বের করে বোকার মতো হেসে বললো,
‘এমনিই কথায় কথায় বলে ফেলি। অতো খাতির নেই তো ওর সাথে। তাই একেক সময় একেক সম্বোধন চলে আসে।’

আমি ওর দিকে আড়চোখে তাকালাম। তারপর বললাম,
‘মানে?’
শুভ কিছু একটা ভেবে বললো,
‘মানে.. ও তো আমার সিনিয়র। তাই সে হিসেবে ভাইয়া সম্বোধনই আসে। আবার হুটহাট মনে হয়, আমার সমবয়সী। তাই সে হিসেবে নাম ধরে ডেকে ফেলি। কিন্তু আমরা তো আর বন্ধু না। জাস্ট ফরমালিটির জন্য ভাইয়া ডাকতেই হয়। এটাই।’
আমি শুভকে মুখ ভেংচিয়ে বললাম,
‘তোর যে কতো আজব তাজব চিন্তা ভাবনা! আর সেই রকমের লজিকও। বাপ রে।’

কথাটা বলেই হালকা হাসলাম আমি। সেই সাথে শুভও হেসে উঠলো। অতঃপর দুজনই হাসতে হাসতে ক্যান্টিনের দিকে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের দিকে এগোলাম।

_______________________

ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পথেই হুট করে প্রণবের সাথে দেখা। ও আমার পথ আটকে দাঁড়াতেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। মনে হলো, প্রণব ভাইয়া এখন আবার আমাকে র‍্যাগ দিবে। প্রতিবারের মতো এবারও কোনো কঠোর শাস্তি দেবে না তো?

আমি এসব ভাবনাতেই মগ্ন আছি। তখনি প্রণব ভাইয়া আমার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে আমার ধ্যান ভাঙালো। আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম,
‘বড় ভাই। সরি, বড় ভাই।’
প্রণব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন শুনি?’
‘ঢং করবেন না। আপনি তো জানেনই।’
‘তবুও বলো দেখি। শুনি।’

আমি অনুতপ্ত কন্ঠে বললাম,
‘ইয়ে মানে.. আপনার বাসার জানালার কাঁচ ভাঙার জন্য।’
সেই সাথেই আবার উত্তেজিত কন্ঠে প্রণবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে?’

প্রণব আমার কথা শোনামাত্রই হেসে দিলো। তারপর একদম আমার চোখের দিকে ওর দৃষ্টি রেখে বললো,
‘সব জানি তো আমি। তারপর.. আরিশাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য তোমায় যে শাস্তি দিয়েছিলাম, ঐদিনও যে তুমি ইচ্ছে করেই ওসব করছিলে, সেটাও জানি।’

কথাগুলো শুনেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। আরে! ব্যাটা বলে কী?
এতকিছু ও কীভাবে জানলো?
এ্যাঁ?
আচ্ছা, গুন্ডা ছেলেরা কি জ্যোতিষ ট্যোতীষও হয় নাকি?

.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here