লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
পর্ব ৪৩
সামিরা আক্তার
রাফসান ভ্রু কুচকে কিছুহ্মণ তাকিয়ে রইলো চৈতালীর দিকে। এর আগে সে যে কয়বার আদ্রর কাছে এসেছে চৈতালী এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করেছে।
এত দিন বিষয় টা পাত্তা না দিলেও আজ কেমন যেন লাগলো রাফসানের।
রাফসান কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা ঢোক গিললো চৈতালী। এতদিন ভেবেছে রাফসান আসলেই সব কিছু খোলসা করবে, রাফসানের ভুল ভাঙাবে। অথচ আজ কিছুই বলতে পারছে না।
উল্টো আদ্রকে কোলে নিতে দেখে রিয়্যাক্ট করে ফেললো।
রাগে দুঃখে চৈতালীর নিজের মাথার চুল ছিড়তে মন চাইলো। কি ভেবেছিলো আর কি হলো।
আড়াল থেকে পুরো বিষয়টা দেখছিলো আরিফ। তবে চৈতালীর কর্মকান্ডে সে হতাশ। এই মেয়ে যে কি চায় বোধহয় নিজেও জানে না।
সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো। তারপর আদ্রকে কোলে নিয়ে বললো – ওকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছি।
চৈতালী বুজলো আরিফ চাইছে সে রাফসানের সাথে কথা বলুক। চৈতালী নিজেও তাই চাইছে। কিন্তু কোন জায়গা থেকে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
চৈতালী কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফসান বললো- ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছি মিসেস চৈতালী। আপনি সাইন করে দিলে আমি চলে যাব। এজন্যই এখানে আসা।
চৈতালীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এখন কি হবে?? সে তো ডিভোর্স চায় না। তার যে রাফসানের সাথে অনেক পথচলা বাকি। আদ্রকে নিয়ে তার আর রাফসানের একটা সুখী সংসার হওয়া বাকি। সে না হয় একটু ভুল করে ফেলেছে তাই বলে রাফসান তাকে ডিভোর্স দেবে?? অদ্ভুত ব্যাপার হলো চৈতালীর গলা দিয়ে সে কোন আওয়াজ বের করতে পারছে না। তাই উপরের কোন কথাই বলা হলো না।
এবার দুঃখে কেঁদে দিলো চৈতালী। রাফসান একটু অবাক হলো। হঠাৎ কাঁদছে কেন??
– কি হলো?? কাঁদছেন কেন?? আপনার স্বামী তো ভাবতে পারে আমি আপনাকে মেরেছি।
রাফসানের কথায় চৈতালীর রাগ হবার বদলে অভিমান হলো। এই লোক তার সাথে মজা করছে?? কিন্তু এখন অভিমান দেখানোর সময় নয়। বহু কষ্টে গলা দিয়ে শব্দ বের করে বললো- ডিভোর্স কেন??
অনেক মজার কথা শুনতে পেয়েছে এমন ভাবে রাফসান হাঁসতে লাগলো। তারপর হাঁসি থামিয়ে বললো- আমাদের ধর্মে একসাথে দুটো বউ রাখার অনুমতি থাকলেও দুটো স্বামী রাখার অনুমতি নেই।
রাফসানের কথা মানে বুঝতে পেরে চৈতালীর কান অপমানে লাল হয়ে গেলো। তার মাথা থেকে বের হয়ে গেছিলো রাফসান সত্যি টা জানে না। চৈতালীর নিজেকে চরম অসহায় বলে মনে হলো।
পকেটে হাত দিয়ে রাফসান বুঝতে পারলো ডিভোর্স পেপার কটেজে ফেলে আসছে। সে ডান হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। আজ বিকেল চারটার ফ্লাইটে তার ঢাকা ব্যাক করতে হবে। সাইন এখুনি জরুরি।
কোন কিছু না ভেবেই বললো- পেপার কটেজে ফেলে আসছি। আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে। আসুন।
বলেই চৈতালীর উত্তরের অপেক্ষা না করে রাফসান সেখান থেকে চলে গেলো। চৈতালী ও কিছু না বুঝেই রাফসানের পিছু নিলো।
সিলেটের শ্রীমঙ্গল। প্রায় প্রতিদিনই এখানে বৃষ্টি হয়। রাফসানের কটেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। রাফসান দ্রুতপায়ে কটেজে ঢুকতে পারলেও চৈতালী অনেকটাই ভিজে গেলো।
কটেজে ঢুকে এক কোনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চৈতালী। আর মনে মনে প্রার্থনা করলো আজকের এই বৃষ্টিতে পুরো সিলেট ভেসে যাক তবু বৃষ্টি না থামুক।
রাফসান ভিতরে গিয়েছিল পেপার টা আনতে। আসতেই চৈতালী ওরকম জড়সড় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো।
বৃষ্টিতে জামার অনেকটাই ভিজে গেছে। অনেকটা মোহনীয় লাগছে ওকে। রাফসান ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলালো। তারপর একটা তোয়ালে এনে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো ‘মাথাটা মোছ।
অনেকদিন পর রাফসানের মুখে আগের সেই সম্বোধন শুনে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো চৈতালী। রাফসানও তাকিয়ে রইলো।
সামনের মেয়েটা তার চৈতী। একমাত্র তার ছিলো। কিন্তু এখন এই মেয়েটা তার কষ্টের কারণ।
রাফসান ঠিক করছে এই দেশে আর থাকবে না। বাইরের কোন দেশে সেটেল হবে। যে দেশে তার চৈতী অন্য কারো বুকে ঘুমাবে, অন্য কারো বাচ্চার মা পরিচয়ে পরিচিত হবে সেই দেশ তার জন্য বসবাসের অযোগ্য।
রাফসান চৈতালীর দিকে নজর দিলো। চৈতালী এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখে না বলা কত কথা। একজন বলছে না অধিকার নেই ভেবে। আরেক জন বলছে না অস্বস্তিতে।
রাফসান চৈতালীর নাক, চোখ, মুখ সব পরখ করছিল। কোন দিন আর দেখার সুযোগ হবে কি না কে জানে??
আচ্ছা সে যদি এখন চৈতালী কে জাপটে ধরে চুমু খায় তাহলে কি পাপ হবে??
চৈতালী এখনও আইনত তার স্ত্রী। রাফসান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চৈতালীর দিকে চাইলো। কত আদর করেছে সে ওকে আর আজ একটা চুমু দিতে পারবে না??
সে আস্তে আস্তে চৈতালীর দিকে এগুতে লাগলো।
চৈতালী এমনিতেই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাফসান কে এভাবে এগিয়ে যেতে দেখে আরও জড়সড় হয়ে গেলো।
রাফসান চৈতালীর দিকে একটু ঝুকে এলে চৈতালী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আচমকা রাফসানের এরকম ব্যবহার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার।
রাফসান চৈতালীর দুগালে হাত দিয়ে ঠোঁটে ঠোট রাখার আগ মুহূর্তে চৈতালী ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো। সাথে সাথে রাফসানের হুশ ফিরলো। আর সেই সাথে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। চৈতালীর দু গাল চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
– এত খারাপ লাগে আমার ছোয়া?? যে কেঁদে ফেলিস। অথচ আমার ছোয়া পাওয়ার জন্য একসময় কত কি করেছিস। ওই ছেলেটা বুঝি তোকে আরও ভাল করে ছোয়??
খুব বেশি মজা পাস না কি ওই ছেলের কাছে?? যেটা আমি দিতে পারিনি??
তারপর একটু থেমে আবার বললো- সবাই তো তোকে মৃত ভেবেছিলো চৈতী। তুই সত্যি সত্যি মরে গেলি না কেন?? তোকে অন্য কারো বুকে দেখার চেয়ে কবরে দেখা সহজ ছিল আমার জন্য।
রাফসানের কথায় চৈতালী এবার উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। কি জঘন্য কথা বলছে রাফসান?? এত জঘন্য কথা কিভাবে বলছে?? সে তো এতদিন পর রাফসানের ছোয়া পাওয়ার খুশিতে কেঁদে ফেলেছে। আর রাফসান উল্টো বুঝলো??
চৈতালী বৃষ্টির মধ্যেই কটেজ থেকে বেরিয়ে গেলো দৌড়ে। চৈতালি যেতেই রাফসান রুমের এক একটা জিনিস ভাঙতে শুরু করলো।
** রাফসানের যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকেলে গড়িয়েছে। তখন ভাঙচুর করতে করতে কখন ঘুমিয়েছে বুঝতে পারে নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো আজকের ফ্লাইট টাও মিস। আবার তখন চৈতালীর কাছ থেকে সাইন টাও নেওয়া হয় নি।
মেজাজ দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলো।
মোবাইল টা হাতে নিতেই মোবাইলের স্কিনে ভেসে উঠলো আদ্রর ছবিটা। তখন তুলেছিল সে ভাবেই আছে।
রাফসান মোবাইল টা হাতে নিয়ে ডেসিংটেবিলের দিকে গেলো। আয়নায় একবার নিজেকে দেখলো আর একবার আদ্রকে। নাহ্ এই তিলটা ছাড়া তেমন মিল নেই। অথচ এই ছেলেটাকে দেখলে তার বুক ধুকপুক করে।
আদ্র মুখের বাবা ডাকেও আজ অদ্ভুত শান্তি পেয়েছে সে।
চৈতালী যখন হারিয়ে যায় তার আগের মাসে চৈতালী পিরিয়ড মিস করেছিল। যদিও চৈতালী বলেছিল সে মেডিসিন নিয়েছে তারপরও রাফসানের আজকের খটকা টা কাটলো না।
কি মনে করে ডিভোর্স পেপার টা বিছানার তলায় চাপা দিয়ে রাখলো। তার মনে কতগুলো প্রশ্ন জমেছে যার উত্তর তাকে আরিফ দিতে পারবে।
** পরদিন সকালে চৈতালী চা বাগানে যাওয়ার সময় আদ্র কে শিউলির কোলে দিয়ে বললো- আজ ওকে ভাইয়ের সাথে পাঠিও না ভাবী। মালিক ভালভাবে নেয় না বিষয় টা।
শিউলি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। চৈতালী কাল রাফসানের ওখান থেকে আসার পর আর কোথাও যায় নি। কাজে ও না। মূলত রাফসানের শেষের কথা গুলো হজম করতে তার কষ্ট হয়েছে।
কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না। কারো কাছে কিছু প্রমাণ ও করতে মন চাইছে না। চৈতালী একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো। তারপর আদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো- মামিকে ডিস্টার্ব করবেন না আব্বা। মামি অসুস্থ।
বিনিময়ে আদ্র চৈতালী কে তার ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললো- মাম্মা তা তা।
চেতালী ছেলেকে একটা চুমু দিয়ে বললো- আমার আব্বার কি বুদ্ধি।
আদ্র তখন থাকলেও বেলা এগারটার দিকে মায়ের জন্য কান্না শুরু করে দিলো। উপায় না পেয়ে শিউলি আদ্রকে নিয়ে চা বাগানের দিকে যেতে শুরু করলো। চা বাগানে ঢোকার মুখে রাফসানের সাথে দেখা হয়ে গেলো শিউলির।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
* পর্ব ৪৪
সামিরা আক্তার
** রাফসান ভ্রু কুচকে শিউলির দিকে চেয়ে রইলো। আদ্রকে কোলে নিয়ে থাকা এই মেয়েটা কে?? বয়স চৈতালীর কাছাকাছি। আগে তো কখনো দেখে নি। আদ্র যেহেতু কোলে কান্নাকাটি করছে না সেহেতু একে ভাল করেই চেনে।
এরই মাঝে আদ্র বাবা বাবা বলে রাফসানের কোলে যাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। রাফসান নিলিপ্ত ভাবে ওকে কোলে নিলো।
শিউলি অবাক হলেও কিছু বললো না। এই লোকটা কে আদ্র বাবা কেন বলছে তার মাথাতেও ঢুকলো না। সে জানে আদ্রর বাবা সিলেটে এসেছিল কিন্ত সে যে রাফসান তা শিউলিকে কে বলবে??। সে বরং আদ্র অচেনা কারো কোলে যাওয়াতে ভয় পেলো।
কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফসান জিজ্ঞেস করলো – আপনি কে?? আদ্রর কি হন??
শিউলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। তার মানে ছেলেধরা টরা নয়। আদ্র কে চেনে। সেহেতু আদ্র চা বাগানে আসে।
– কি হলো কথা বলছেন না কেন??
– আমি ওর মামী….ওর মা মানে চৈতালীর কাছে নিয়ে আসছি ওকে। আসলে কান্না কাটি করছিলো তো।
– ওহ্। বলে আদ্র কে কোলে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো রাফসান। কি মনে করে আবার থেমে গিয়ে আদ্র কে কোলে নিলো। তারপর বললো- আপনাদের ফ্যামিলি তে কে কে আছে??
শিউলি ভ্রু কুচকে ফেললো। বাইরের লোকের কাছে এত কথা বলতে তার ভাল লাগে না। এমনিতেই লোকজন চৈতালী কে নিয়ে মন্দ কথা বলে। এ আবার কি বলবে কে জানে??
বিরক্তিকর স্বরে বললো- আপনি….
রাফসান বোধহয় শিউলির বিরক্তি বুঝতে পারলো তাই কথা শেষ হওয়ার আগেই বললে- আমি এ চা বাগানের মালিক।
শিউলি একটু থতমত খেলো। এখুনি তো কেলো করে ফেলেছিল সে। তার জন্য যদি আরিফ আর চৈতালীর চাকরি চলে যেতো?? বড়লোকেদের বিশ্বাস নেই। দেখা গেলো তার উপর রাগ করে ওদের চাকরি খেয়ে দিলো।
শিউলির মুখভঙ্গি দেখে রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর বললো – ভয় পাবেন না শুধু আমার কয়টা প্রশ্নের উত্তর দিন।
– হ্যাঁ বলুন।
– আদ্রর বয়স কত??
শিউলি একটা ঢোক গিললো। এই লোক কি জিজ্ঞেস করছে তার মাথায় ঢুকছে না। কোন রকমে বললো- এই সামনের মাসের ১৩ তারিখ ২ বছর হবে।
রাফসান একটু চোখ বন্ধ করলো। চৈতালীর পিরিয়ড মিস, ওর হারিয়ে যাওয়া, আর আদ্রর জন্ম ফটাফট হিসাব করে ফেললো।
কাঙ্ক্ষিত হিসাব টা মিলে যেতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। আদ্রকে বুকের সাথে চেপে ধরে পাগলের মত চুমু দিতে লাগলো।
রাফসানের এমন কান্ডে শিউলি চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
আদ্র কে চুমু খাওয়া শেষ করে শিউলির দিকে তাকিয়ে বললো- আপনাদের পরিবারে আদ্র সহ লোক কয়জন??
– চারজন।
এবার যেন রাফসানের আরেকটা হিসাব মিলে গেলো। নিজেকে মনে হলো পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ ।
শিউলি অবাক হয়ে লহ্ম করলো সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটির মুখ জ্বলজ্বল করছে। গভীর মমতা নিয়ে সে আদ্রকে আদর করছে।
তারপর এক সময় শিউলির দিকে তাকিয়ে বললো- চৈতালী কে বলবেন চোখের সামনে নিজের ছেলে ঘুরে বেড়াবে আর তাকে রাফসান শিকদার চিনবে না এমনটা ভাবা ভুল।
যতই দূরে সরিয়ে রাখুক না কেন রক্তের একটা টান আছে কিন্তু।
যাই হোক, আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ছেলের মা চাইলে সেও ফিরতে পারে।
তারপর আদ্রর গালে একটা চুমু দিয়ে বললো- তাকে বলবেন আমাকে এত সুন্দর একটা উপহার দেওয়ার জন্য তার অতীতের সব ভুল হ্মমা করা হলো।
বলেই আদ্র কে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো সে।
পুরো ঘটনায় শিউলি হতভম্ব হয়ে গেলো। স্তব্ধ হয়ে ওখানেই কতহ্মণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ একটা চিৎকার দিলো। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারলো না সে। শুধু চিৎকারই দিলো।
শিউলির চিৎকারে যতহ্মণে আশেপাশের সবাই ছুটে এলো ততহ্মণে রাফসানের গাড়ি ছুটে চলেছে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্য।
** আরিফ এক নাগারে শিউলির কাছে জানতে চাইছে কি হয়েছে?? শিউলি কিছুহ্মণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো ওদের দিকে। চৈতালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর দিকে তাকিয়ে শিউলি বললো- আদ্র…
এতহ্মণে টনক নড়লো চৈতালী আর আরিফের। তাই তো?? আদ্র কই?? আশে পাশে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেলো।
চৈতালী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করছে। শিউলি কে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো – আমার আদ্র কই ভাবি?? ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো।
শিউলি কোনরকমে বললো- ওর বাবা নিয়ে গেছে।
** ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে চেয়ে আছে রাফসান। গাড়িতে ওঠার পরই খেলতে খেলতে আদ্র ঘুমিয়ে গেছে। এই ছেলেটা তার!! তার নিজের।
অথচ সে কত কি ভেবেছিলো। রাফসান টুকুস করে আর একটা চুমু দিলো।
মনে মনে বললো- এজন্যই কি আপনাকে আমার এত ভাল লাগতো আব্বা??
কাল যখন ভ্রুর তিল টা দেখেছিলো সে তখন থেকেই মনটা অশান্ত ছিলো। হঠাৎই মনে পড়লো হারিয়ে যাওয়ার আগে চৈতালীর পিরিয়ড মিস করার কথা।
তবে সেটা আমলে নেয়নি।
তারপর রাতের দিকে মনে হলো বাবা সেদিন বলেছিল চৈতী তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিল। সারপ্রাইজ টা কি হতে পারে চিন্তা করতেই হঠাৎ মাথায় এলো লাল পাঁড়ের সেই সাদা শাড়িটার কথা।
কথা ছিলো শাড়িটা চৈতী শুধু স্পেশাল ডে তেই পড়বে। আর চৈতী সেদিন ওই শাড়িটাই পড়া ছিল। কি স্পেশাল ডে ছিলো সেদিন??
তারপর বাকি রাত টা সে পিরিয়ড মিস, সারপ্রাইজ, স্পেশাল ডে, লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি এসব চিন্তা করেই কাটিয়েছে। ততহ্মণে তার হিসাব অনেকটাই মিলে এসেছে।
বাকিটা শিউলি মিলিয়ে দিলো। আদ্রর দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললো- প্রথমবারের মত দাদা বাড়ি যাচ্ছেন আব্বা তাও ঘুমিয়ে।
তারপর ড্রাইভার কে বললো সামনে ভাল শপিং মল দেখলে গাড়ি থামাতে। বেবি শপ থেকে আদ্রর জন্য কিছু খাবার কিনতে হবে।
এখনও অনেক টা রাস্তা বাকি।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
* পর্ব ৪৫
সামিরা আক্তার
আরিফ আর চৈতালী হতভম্ব হয়ে গেলো শিউলির কথায়। কি বলছে কি?? বাবা নিয়ে গেছে মানে??
চৈতালী ভয়ার্ত গলায় বললো- এই ভাবী কি বলছো এসব?? তুমি তো আদ্রর বাবাকে চেনোই না। কে নিয়ে গেলো?? বলেই আবার ফুঁফিয়ে উঠলো সে।
এই ছেলেটাই তার সব। যদি খুঁজে না পায়?? কি হবে?
শিউলি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বললো
– ওই তো তোমাদের চা বাগানের মালিক, নাম বললো রাফসান শিকদার।
কথাটা শোনামাত্র চৈতালীর কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। আরিফও প্রচন্ড অবাক হয়েছে কথাটা শুনে। সে বললো- পুরো ঘটনাটা বলো তো শিউলি।
শিউলি একে একে পুরো ঘটনা টা খুলে বললো। এটাও বললো আদ্র লোকটা কে বাবা বলে ডাকছিলো।
কথাটা শুনে আরিফের হাঁসি পেয়ে গেলো সেই গতকাল দেখিয়ে বলেছিল ওইটা তোমার বাবা। ছেলেটা ঠিক মনে রেখেছে। এজন্যই বলে বাচ্চাদের মস্তিষ্ক অনেক শার্প হয়।
তবে রাফসান এত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে সেটা সে ভাবে নি।
চৈতালীর তো কথাই বন্ধ হয়ে গেছে। নিয়ে গেলো ছেলেকে?? এজন্যই আদ্র কে রাফসানের যেতে দিতে চায়নি সে।
– এখন কি করবি??
– জানি না। উদায় ভঙ্গিতে জবাব দিলো চৈতালী। তার কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে জমা হয়েছে অভিমান। রাফাসান যখন সবটা বুঝতেই পারলো তখন তার কাছে কেন এলো না এই অভিমান।
চৈতালীর মনের ভাব বুঝতে পেরে আরিফের ইচ্ছে করলো একটা থাপ্পড় দিতে। এর নাম মেয়ে মানুষ। সব সময় ব্যাঁকা চিন্তা ভাবনা। কিন্তু মুখে বললো- সে তো শুধু ছেলেকে নিয়ে যায় নি। ছেলের মাকেও যাবার নিমন্ত্রণ করে গেছে।
চৈতালী আরিফের মুখের দিকে চাইলো। আরিফ শান্ত গলায় বললো- বিধাতা তোর জীবন গোছাবার আর একটা সুযোগ দিলো চৈতালী। আর মান অভিমান নয়। তাছাড়া আদ্রও ওর বাবার কাছে আছে। তুই বুদ্ধিমতী। কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই।
** রাফসান যখন আদ্রকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো তখন আদ্র জেগে গেছে। জুনায়েদ গার্ডেনে ছিলো। রাফসান কে দূর থেকে দেখলো একটা বাচ্চাকে কিছু বলছে আর বাচ্চাটা খিলখিল করে হাঁসছে।
জুনায়েদ দৌড়ে এলো। কাছে আসতেই বাচ্চাটাকে চেনা চেনা লাগলো। ভালো করে দেখলো এতো চৈতালীর বাচ্চা।
আশে পাশে কোথাও চৈতালী কে দেখলো না।রাফসান কি শুধু বাচ্চা টা কে নিয়ে আসছে না কি?? কিন্ত কেন??
জুনায়েদ একটা ঢোক গিললো। আজ তো বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।
এক দৌড়ে রাফসান কে আটকালো। সামনে বাধা পড়ায় রাফসান একটু বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে জুনায়েদের দিকে তাকালো।
জুনায়েদ সে দৃষ্টি কে পাত্তা না দিয়ে বললো- এটা চৈতালীর বাচ্চা না?? তুই কেন নিয়ে আসলি?? চৈতালী কই?? এই বাচ্চা নিয়ে ভিতরে গেলে কি হবে বুঝতে পারছিস??
রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর বললো- এত প্রশ্নের উত্তর এখানেই নিবি?? চল ভিতরে গিয়ে দেই। এখানে সম্ভব না। আমি ও টার্য়াড আদ্রও টার্য়াড। তাই না আদ্র সোনা???
বিনিময়ে আদ্র তার ভুবন ভুলানো হাসি দিলো। রাফসান টুকুস করে আদ্রর গালে একটা চুমু দিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে বললো- আয় ভিতরে আয়।
জুনায়েদ হতভম্ব হয়ে গেলো। সে দৌড়ে গেলো আসলাম শিকদার আর আরমান শিকদারের বাসার দিকে। কি হয় আজ বাড়িতে কে জানে??
** আরিফ চৈতালীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুহ্মণ বাদে চৈতালী বললো- আমরা কাল যাই ভাইয়া?? আদ্র থাক একদিন ওর বাবার কাছে। আমি এতদিন সামলাতে পারলে সে একদিন সামলাতে পারবে না??
আরিফের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সে এটাই শুনতে চেয়েছিলো চৈতালীর থেকে। এই তিন বছর হতে চললো মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। এবার তার সুখে থাকার পালা।
হেঁসে বললো- তাই তো, সামলাক একটা দিন। রেডিমেট বাপ ডাক শুনতে পেয়ে গেছে। দেখুক তার ছেলেকে আমরা কত কষ্টে মানুষ করেছি।
চৈতালী মৃদু হাঁসলো। যতই বলুক সে আদ্র ছাড়া আজকের দিন রাত তার কিভাবে কাঁটবে কে জানে??
রাফসান যখন আদ্রকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো তখন ডয়িংরুমে আয়শা, রাফিয়া, আসমাত শিকদার সহ সবাই কথা বলছিল। রাফসানের কোলে আদ্রকে দেখে তারা হতভম্ব হয়ে গেলো।
রাফসান ময়ূরী কে ডেকে বললো- বাচ্চাদের জন্য যেভাবে খিচুড়ি রান্না করে সেভাবে রান্না করো। ও খাবে।
বলেই সবার বিষ্মিত দৃষ্টি উপেহ্মা করে আদ্র কে নিয়ে রুমে চলে গেলো। ততহ্মণে বাকি সবাইও এসে পড়েছে।
রাফসান ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আদ্র কে বিছানায় দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর বেবিশপ থেকে কেনা আদ্রর সব কাপড়চোপড়, খেলনা বের করতে করতে বললো- আপনাকে দেখে বাড়ির সবার চোখ গোল গোল হয়ে গেছে আব্বা।
আদ্র একমনে একটা গাড়ি নিয়ে খেলছিলো। বাবার কথায় একটা হাসি দিয়ে আবার গাড়ি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।
রাফসান ছেলের কাছে এসে বসে বললো- চলেন আমরা ফ্রেশ হই, তারপর খাওয়া দাওয়া করি, তারপর আপনি খেলবেন। আপনাকে আজ বাইরের খাবার খাওয়ানো হয়েছে যেটা একদমই ঠিক না।
আদ্র ভদ্র বাচ্চার মত রাফসানের দিকে উঠে এলো। রাফসান হেঁসে ফেললো। বললো – আপনি তো বেশ ভদ্র ছেলে আব্বা। সব কথা শুনেন। চলেন গোসল করে আসি।
আদ্র বাবার কোলে চড়ে বার বার বদ্র ছেয়ে, বদ্র ছেয়ে বলতে লাগলো।
রাফসান পুনরায় হাঁসলো।
-বুঝেছি আপনি প্রচুর ভদ্র ছেলে। আজ থেকে আপনার সব কাজ আমি করবো আব্বা। আপনি পটি করলেও সেটা আমি পরিষ্কার করবো। বুঝেছেন??
গোসল করে রাফসান তোয়ালে পেচিয়ে আদ্রকেও একটা তোয়ালে পেচিয়ে দিলো। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে বললো- দেখেন আমরা বাপ বেটা ম্যাচিং ম্যাচিং।
আদ্র আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে বললো- বাবু, বাবু?
রাফসান আদ্রর নাকে নাক ঘসে বললো- ওটা আপনি।
ছেলেকে রেডি করিয়ে রাফসান নিজে রেডি হয়ে বাইরে বের হলো। ডাইনিংয়ে তখন শিকদার বাড়ির সবাই বসে আছে। এর মধ্যে আয়শা আর রাফিয়া রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আর বাকি সবার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
রাফসান বিশেষ পাত্তা দিলো না। ময়ূরীর কাছে খিচুড়ি চাইতেই ময়ূরী সবার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে খিচুড়ি এনে দিলো।
রাফসান যত্ন করে ছেলেকে খিচুড়ি খাওয়াতে লাগলো। রাফিয়া কিছু বলতে চাইলেও জুনায়েদ থামিয়ে দিলো।
যা বলার রাফসান নিজে থেকেই বলবে।
বাপ বেটার খাওয়া শেষ হলে সোফায় বসতেই জুনায়েদ বললো- তুই ওর মা কে ছাড়া ওকে নিয়ে এলি ও যদি কাঁদে??
– কাঁদছে কি?? জবাব দিলো রাফসান।
জুনায়েদ আদ্রর দিকে চাইলো। তাই তো কাঁদছে না তো?? কিন্তু কাঁদছে না কেন?? জুনায়েদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো রাফসানের দিকে।
বিনিময়ে রাফসান রহস্যময় হাঁসলো।
বাকি সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আসলাম শিকদার আর রেবেকার অসহায় দৃষ্টি। আসমাত শিকদারও রাফসানের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছেন। রাফিয়া রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো- ভাইয়া তুমি কি জানো না বাচ্চা টা কার?? ওর মা কে??
– জানি। রাফসান নিলিপ্ত ভাবে জবাব দিলো।
– জানি তার পর ও নিয়ে এলি?? সব ভুলে গেলি?? আবার আদর করে খাওয়াচ্ছিস?? আয়শা বেগম চিল্লাতে শুরু করলেন।
– আহ্ কি শুরু করলে?? ও একটা বাচ্চা। ধমকে উঠলো আসমাত শিকদার।
– হ্যাঁ বাচ্চা, তবে ওই বেয়াদব মেয়েটার বাচ্চা।
রাফসান আদ্রর সাথে খেলছিলো। যেন ওর কোন কথা কানে যাচ্ছে না। আরমান শিকদার এগিয়ে এসে
বললো- চৈতালীর ছেলেকে তুই কেন নিয়ে এলি রাফসান?? বাড়িতে ঝামেলা শুরু হওয়ার আগে বল।
রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর আরমান শিকদারের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো- কারণ চৈতীর ছেলের বাবা আমি।
রাফসান যত শান্তস্বরে কথাটা বললো ঘরের মধ্যে যেন তত জোরে বিস্ফোরণ ঘটলো। এক মুহূর্তের জন্য সবাই যেন বোবা হয়ে গেলো।
একসময় নীরবতা ভেঙে জুনায়েদ বললো- মানে??
– মানে খুব সিম্পল। চৈতী সেদিন সিলেট গিয়েছিল আমাকে সারপ্রাইজ দিতে। তাই তো বাবা??
আসমাত শিকদার মাথা নাড়লেন। রাফসান বললো- সারপ্রাইজ হলো এটা যে আমার আদ্র আসতে চলেছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে আফরিন কে দেখে ওর মনে হলো আমি ওকে ঠকাচ্ছি। ব্যাস হারিয়ে গেলো।
– কিন্তু ওই ছে ছেলেটা?? রাফিয়া ছলছল দৃষ্টিতে বললো।
– আরিফ??
রাফিয়া মাথা নাড়লো। রাফসান হাঁসলো।তারপর বললো- আরিফের কাছে চৈতী কিভাবে গেলো জানি না। তবে আরিফ কে চৈতী ভাই বলে ডাকে। ইনফ্যাক্ট ওর স্ত্রীর কাছ থেকেই আমি আজ আদ্র কে নিয়ে আসছি।
আয়শা ততহ্মণে কাঁদতে শুরু করছে। জুনায়েদ বললো- কিন্তু তোর কাছে কেন বললো আরিফ ওর স্বামী। আর তুই ই বা কিভাবে বুঝলি আদ্র তোর ছেলে। আমার সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।
(ক্রমশ)